হলুদ শালগাছ

হলুদ শালগাছ
রেহান কৌশিক
এক


এ সময়ে এরকম হয়। ভুরু দুটো কাঁপে৷ ক্রমশ মাথা ধরে৷ কিছুক্ষণের জন্য নিজের চারপাশের জগতটা ঘন অন্ধকারে ঢেকে যায়৷ আর ঠিক তারপরেই চোখের সামনে জেগে ওঠে সেই দৃশ্য নিরিবিলি জঙ্গলের ভিতর মাঝারি চেহারার একটা শালগাছ৷ সামান্য ডালপালা৷ গাছটার সমস্ত পাতা হলুদ৷ আশেপাশে ছড়ানো-ছিটোনো কিছু গাছপালা আছে ঠিকই, তবে তা খানিক দূরে দূরে৷ প্রত্যেকবারে ঘটনা আলাদা হলেও জায়গা একই থাকে৷ ঘটনাগুলো ঘটে ঠিক ওই শালগাছের নীচে৷
সুবর্ণকান্তি যেন অন্ধকার থিয়েটার হলে বসে মঞ্চে অভিনীত কোনো নাটকের টুকরো দৃশ্য দেখতে পায়৷ শুনতে পায় সমস্ত সংলাপ, আবহের খুঁটিনাটি শব্দও৷ যেমন আজও দেখতে পাচ্ছে ওই হলুদ শালগাছের নীচে দাঁড়িয়ে রয়েছে অন্তরা৷ মুখোমুখি একটি পুরুষ৷ দোহারা চেহারা৷ মলিন পাজামা-পাঞ্জাবি৷ কান ঝাঁপানো চুল৷ চোখে সস্তার কালো ফ্রেমের চশমা৷
অন্তরার চোখে বিস্ময়৷ বলল, “তুমি!”
লোকটি বলল, “এমনভাবে তাকাচ্ছ যেন এই ক-বছরে আমার চেহারা খুব বদলে গেছে!”
“কিন্তু, তুমি এখানে কেন?” জিগ্যেস করল অন্তরা৷
লোকটা খুকখুক করে একটু হাসল৷ তারপর বলল, “দেখতে৷ দেখতে এলাম তুমি কেমন গুছিয়ে ঘর-সংসার করছ!”
“না, এখানে এসে ভালো করনি, সঞ্জয়৷”
“ঘাবড়ে গেছ? আরে ধুর, ঘাবড়ানোর কিছু নেই৷ আমি তো তোমার কাছে থাকতে আসিনি৷ আর অসময়েও আসিনি যে বরকে সাজিয়ে-গুছিয়ে দুটো মিথ্যে বলতে হবে! জানি, এখন উনি অফিসে বসে চাল-গমের হিসাব করেন৷”
অন্তরার রাগ হল৷ একটু রূঢ়স্বরে বলল, “সে ফুড-ডিপার্টমেন্টে চাকরি করে ঠিকই কিন্তু চাল-গমের হিসাব তাকে রাখতে হয় না৷ যথেষ্ট উঁচু পদে কাজ করে৷ অফিসার৷
“সংরক্ষণের কী লীলা মাইরি! শিডিউল-কাস্ট, শিডিউল-ট্রাইবগুলো দুমদাম চাকরি পেয়ে যাচ্ছে আর জেনারেলদের কপালে লবডঙ্কা!”
আগাগোড়া পড়াশোনায় খারাপ ছিল না সঞ্জয়৷ কিন্তু চাকরির পরীক্ষায় উতরোতে পারেনি৷ তাই সবদিন কাস্ট-বেসড সংরক্ষণের প্রবল বিরোধী৷ অন্তরা বুঝল সঞ্জয়ের ইঙ্গিত তার স্বামীর দিকে৷ যেহেতু সে তপসিলি উপজাতি৷
সঞ্জয়ের কথাগুলো ক্রমশ সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে৷ অন্তরা বলল, “উচ্চবর্ণের মানুষেরা চিরকালই নিম্নবর্ণের মানুষগুলোকে শোষণ করেছে৷ স্বাধীনতার তিয়াত্তর বছরেও এ দেশের ছবিটা এখনো সেভাবে বদলায়নি৷ রাজ্যে রাজ্যে দলিতরা আজও আক্রান্ত৷ তাই তো খবরের কাগজে, টিভিতে প্রায়ই দেখা যায় – কোনো দলিত পরিবারকে উলঙ্গ করে রাস্তায় হাঁটানো হয়েছে, দলিত মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে! সংবিধানে স্বীকৃত হলেও এ দেশের সমাজ আজও প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকারকে মর্যাদা দিতে শেখেনি৷ আসলে বাহুবলি মানসিকতার কিছু লোকজন আজও এই দেশটাকে শুধু তাদেরই জায়গির বলে মনে করে৷ তাই সমাজকে, দেশের সমস্ত মানুষকে একটা সমান প্ল্যাটফর্মে আনার জন্য সংরক্ষণটা জরুরি, সঞ্জয়৷”
অন্তরার জবাবে থমকে গেল সঞ্জয়৷ ভাবতে পারেনি অন্তরা এভাবে পালটা আক্রমণে যাবে৷
অন্তরা হঠাৎ যেন নিজেকেই জিজ্ঞেস করল, সে সঞ্জয়কে এত পাত্তা দিচ্ছে কেন? সঞ্জয়ের সঙ্গে এমন কোনো সম্পর্কে তো সে কোনদিন জড়িয়ে পড়েনি যে তাকে এমন নির্জন দুপুরে এতটা উৎপাত সহ্য করতে হবে!
কলেজবেলায় কয়েকদিন সঞ্জয়ের সঙ্গে একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল ঠিকই কিন্ত তার আয়ুষ্কাল কয়েক মাসের৷ সেটাও সঞ্জয়ের বোন মন্দিরার পীড়াপীড়িতে৷ হিস্ট্রি-অনার্সে মন্দিরা ছিল ক্লাসমেট৷ একদিন মন্দিরাই নিজের দাদার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল৷ সেই সূত্রে বন্ধুত্ব৷ তবে এটা ঠিক, সাময়িক সময়ের জন্য হলেও একটা দুর্বলতা গড়ে উঠেছিল সঞ্জয়ের প্রতি৷ দু-একদিন একান্তে দেখাও হয়েছিল তাদের৷ আর সেটাও মন্দিরা সারাক্ষণ নিজের দাদার কথা বলে বলে কানমাথা ধরিয়ে দেওয়ার কারণে৷ পরে নানাভাবে সঞ্জয় একান্তে দেখা করার অনুরোধ জানাত৷ অন্তরা আমল দিত না৷ আসলে সঞ্জয়ের প্রতি সেভাবে কোনো টানই জন্মায়নি ভিতর থেকে৷ সম্পর্ক বলতে এটুকুই৷
অন্তরা বলল, “বেশ কিছু জরুরি কাজ বাকি আছে৷ তুমি কি আর কিছু বলবে?”
অন্তরা স্পষ্টতই সঞ্জয়কে বিদায় জানাতে চায়৷ নিজের বুকে বামহাতের বুড়ো আঙুল ঘষতে ঘষতে সঞ্জয় হেসে ওঠে৷ তারপর অন্তরার চোখে চোখ রেখে বলল, “ওই যাহ্, যে জন্য আসা সেটাই ভুলে গেছি! দেখেছ কী ভুলো-মন আমার! আসলে হয়েছে কী জানো, আজ পার্সটা কে পকেট থেকে তুলে নিয়েছে! অনেকগুলো টাকা ছিল৷ এসেছিলাম রং-তুলি আর ক্যানভাস কিনতে৷ কী বিপদ, বলতো!”
সঞ্জয় ভালো ছবি আঁকত৷ অন্তরা শুনেছিল চাকরি না পেয়ে ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে একবার নাকি সুইসাইড করার চেষ্টাও করেছিল৷ আঁকা ছেড়ে দিয়েছিল তারও আগে৷ অন্তরা বেশ বুঝতে পারে সঞ্জয় এখন গল্প ফাঁদছে৷ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সঞ্জয়ের চোখের দিকে৷ সঞ্জয়ের কোনো ভাবান্তর নেই৷ সে বলে চলে, “হঠাৎ তোমার কথা মনে পড়ে গেল৷ ভাবলাম, তুমি থাকতে আমার দুশ্চিন্তার কী আছে! তোমার ঠিকানাও জানা ছিল, তাই সোজা চলে এলাম৷”
“তুমি পার্স হারিয়েছ, তা আমি কী করব? হ্যাঁ, যদি বলো বাড়ি ফেরার বাসভাড়াটা দিতে পারি৷”
“থাক, দরকার নেই৷” গম্ভীর হয়ে গেল সঞ্জয়ের মুখ৷ পরক্ষণেই হাসি ফুটে উঠল মুখে৷ চোখ নাচিয়ে বলল, “শুনেছি তোমার উনি মানুষটি নাকি খুব ভালো৷ যাই ওঁর সঙ্গে দেখা করে বিপদের কথাটা বলি৷ হয়তো উনি ফেরাবেন না৷ হাজার হোক, বউয়ের বান্ধবীর দাদা৷”
চমকে ওঠে অন্তরা৷ সঞ্জয়ের মুখের দিকে তাকাতে ঘেন্না হচ্ছে এখন৷ সঞ্জয়ের ঠোঁটে একটা হাড়-জ্বালানো হাসি ঝুলে আছে৷
অন্তরা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “তুমি কি আমাকে ব্ল্যাকমেল করছ?”
“ব্ল্যাকমেল! ছি! একথা তুমি বলতে পারলে! কী নিয়ে ব্ল্যাকমেল করব আমি? আর কেনই বা করব? নিজের নিভে যাওয়া ভালোবাসার সম্পর্ক নিয়ে কেউ ব্ল্যাকমেল করে?” সঞ্জয়ের গলায় স্পষ্ট বিস্ময়৷
অন্তরা বলল, “কলেজদিনের সামান্য ক্রাশকে ভালোবাসা বলে না, সঞ্জয়৷ কয়েকদিনের সাধারণ মোহ৷ তুমি ভুল করছ৷”
“ভালোবাসা ছিল না! তাহলে গোপগড়ের টিলায় উঠে আমাদের আকাশের দিকে দু-হাত তুলে দাঁড়ানোটা মিথ্যে ছিল? মিথ্যে ছিল সেই চুম্বনের নোনতা স্বাদ?” সঞ্জয়ের চোখে আশ্চর্য এক করুণ আলো ফুটে ওঠে৷
অন্তরা চুপ করে যায়৷ মনে পড়ে যায় সেই বিকেলের কথা৷ কলেজ থেকে বেরিয়ে সোজা চলে এসেছিল মেদিনীপুর স্টেশনের কাছে৷ সঞ্জয় দাঁড়িয়ে ছিল৷
অন্তরা জানতও না কেন সঞ্জয় আসতে বলেছিল সেদিন৷ সঞ্জয়ের সাইকেলে উঠে চলে গিয়েছিল গোপগড়ে৷ গোপগড় শহরের পশ্চিমে৷ লোকালয় ছাড়িয়ে অনেকটা৷ চারদিকে ধূ ধূ লালমাটি৷ নির্জন৷ গড়ের কাছে টিলায় পৌঁছুলে দেখা যায় অনেক নীচে পিচের রাস্তা৷ রাস্তার ওপারে কাঁসাই নদী৷ নদীর ওপর রেলব্রিজ৷ ব্রিজের ওপর দিয়ে একটা ট্রেন তখন মেদিনীপুর থেকে হাওড়ার দিকে যাচ্ছিল৷
এতদূর থেকেও ভেসে আসছিল সেই শব্দ৷ পড়ন্ত রোদের লালচে আলোয় কী অপরূপ লাগছিল জায়গাটা৷ সেই সময়ই হঠাৎ সঞ্জয়ের ঠোঁট নেমে আসে তার মসৃণ ফরসা ঘাড়ে৷ সঞ্জয়ের আচমকা চুমুতে শিউরে উঠেছিল সমস্ত শরীর৷ জীবনের প্রথম পুরুষ-স্পর্শে কেমন যেন বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল সে৷ সঞ্জয়ের ঠোঁটে ফিরিয়ে দিয়েছিল নিজের চুম্বন৷
ঘোর কাটলে ফেরার সময় বোকা বোকা মুখে প্রশ্ন করেছিল, “সঞ্জয়, চুমুর স্বাদ কি নোনতা?”
সঞ্জয় মুচকি হেসে উত্তর দিয়েছিল, “হালুয়ার মতো৷”
সঞ্জয় সাইকেলের সিটে৷ অন্তরা সামনে৷ তাই সঞ্জয়ের দুষ্টু হাসিটা দেখতে পায়নি অন্তরা৷ সহজভাবে আবার প্রশ্ন করে, “মানে?”
“হালুয়া যেমন মিষ্টি মেশানো নোনতা, তেমনই৷”
“ধুর, কী বলছ বুঝতে পারছি না!”
সঞ্জয় এবার সিরিয়াস৷ সাইকেল চালাতে চালাতে খানিকটা দার্শনিকতার ভঙ্গিতে বলল, “আরে বোকা, চুমুর স্বাদ চুমুর মতো৷ পৃথিবীর কোনো ভাষার কোনো শব্দ আজও চুমুর স্বাদকে ডেসক্রাইব করতে পারেনি৷”
“আমার কিন্তু নোনতা লেগেছে৷”
‘তোমার ঠোঁটটা অল্প কেটে গেছে৷ রক্তের স্বাদ নোনতাই হয়৷”
পুরোনো দিনের ঘটনাটা চোখের সামনে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠল অন্তরার৷ নিজেকে এই মুহূর্তে কেমন যেন অসহায় লাগছে তার৷ তবু সঞ্জয়ের চোখ থেকে চোখ সরাল না৷ বলল, “ব্ল্যাকমেলই যদি না-হয়, তাহলে তুমি আমার হাজব্যান্ডের সঙ্গে দেখা করতে চাইছ কেন?”
সঞ্জয় মৃদু হাসল৷ তারপর বলল, “খোঁজ নিয়ে জেনেছি উনি বিদ্যাসাগর ওয়েলফেয়ার সোসাইটির গুরুত্বপূর্ণ মেম্বার৷ ওঁর রেফারেন্সে অনেকে আর্থিক সাহায্য পেয়েছে৷ আমিও বিপদের মধ্যে আছি, তাই…।”
স্ত্রী হয়েও অন্তরা এ বিষয়ে কিছুই জানে না৷ কিন্তু সে কথা সঞ্জয়ের কাছে প্রকাশ করা চলে না৷ তাহলে নিজের কাছেই নিজে ছোট হয়ে যাবে৷ সঞ্জয়ের কথায় অন্তরা এখন কিছুটা আশ্বস্ত হল৷ অন্তরা জিগ্যেস করল, “কত টাকা?”
“পার্সে তো অনেক টাকা ছিল৷ বারো হাজার মতো৷”
“পার্স হারানোর গল্পটা মিথ্যে৷ কত টাকা লাগবে, সেটা বলো৷”
“দশ৷ হবে?”
“না৷ অত নেই৷ দেখছি কতটা হেল্প করতে পারি৷”
সঞ্জয় বলল, “রং-তুলি-কাগজের দাম যা বেড়েছে!”
অন্তরা ঘরের ভিতর ঢোকে৷ খানিক পরে ফিরে এসে বলল, “সাড়ে পাঁচ আছে৷”
সঞ্জয় টাকাটা নিয়ে বলল, “আপাতত এতেই কাজ চলে যাবে৷”
অন্তরার স্বর বেশ রূঢ় হল৷ বলল, “আপাতত নয়৷ ভবিষ্যতে আর টাকার প্রত্যাশা করো না৷”
সঞ্জয় স্তব্ধ হয়ে অন্তরার দিকে একবার তাকাল৷ তারপর দরজা দিয়ে বেরোতে যেতেই, অন্তরা পিছন থেকে বলল, “বাই দ্য ওয়ে, আর একটা কথা – তুমি কোনোদিন আমার হাজব্যান্ডের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করো না৷”
সঞ্জয় অন্তরার কথার জবাব না দিয়েই বেরিয়ে যায়৷ সঞ্জয় বেরিয়ে যেতেই অন্তরা হাঁফ ছাড়ে। যেন একটা ঝড়ের হাত থেকে রেহাই পেল৷ মনে-মনে ভাবে, পৃথিবীতে মানুষই বোধহয় একমাত্র প্রাণী যে নিজের চরিত্রে এত শেডস নিয়ে ঘুরে বেড়ায়! গিরগিটির চেয়ে মানুষই বোধহয় দ্রুত রং বদলাতে পারে! আজ সঞ্জয়ের মুখোমুখি না হলে এই সত্যটা বোধহয় উপলব্ধি হত না!
সুবর্ণকান্তি স্পষ্ট দেখতে পেল হলুদ শালগাছের নীচে দৃশ্যটা বদলে গেল৷ সঞ্জয় এখন রাস্তা দিয়ে হাঁটছে, বিদ্যাসাগর ইউনিভার্সিটি থেকে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডের দিকে৷
তারপরেই ঢুকে পড়ল রাস্তার পাশের হোটেলে৷ বসেই মাংস-ভাতের অর্ডার দিল৷

অফিসের ছেলেটার ডাকে সম্বিত ফিরল সুবর্ণকান্তির৷ ছেলেটা বলল, “স্যার, আপনার কি শরীর খারাপ? মাঝে এসে একবার দেখে গেলাম আপনি চুপ করে বসে আছেন!”
চোখের সামনে থেকে হলুদ শালগাছটা মুছে যাওয়ার পরেও বেশকিছু সময় মাথাটা ঝিমঝিম করে৷ সুবর্ণকান্তি জিগ্যেস করল, “অমলবাবু অফিসে আছেন?”
ছেলেটা জবাব দিল, “না, একটু বেরিয়েছেন৷ মিনিট দশের মধ্যেই ফিরবেন৷ আপনি চা খাবেন, স্যার?”
“না৷ অমলবাবু ফিরলে বলিস, আমি বেরিয়ে গেছি৷ আজ আর ফিরব না৷”
“আচ্ছা, স্যার৷” ছেলেটি মাথা নেড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়৷
সুবর্ণকান্তি নীচে এসে বাইকে স্টার্ট দেয়৷ হোটেলটা চেনে৷ বাইকে উঠে মনে মনে হিসাব করে, বাইকে যেতে ম্যাক্সিমাম পাঁচ মিনিট৷ আর একটা লোকের ভাত খেতে মিনিমাম মিনিট পনেরো৷ সুতরাং সঞ্জয়কে হোটেলেই ধরা যাবে৷

দুই


ভবিষ্যত নয়, বর্তমান অথবা সাম্প্রতিক অতীতের কোনো ঘটনাকে দেখতে পাওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা সুবর্ণকান্তি প্রথম উপলব্ধি করে বছর উনিশ আগে৷ সে তখন মেদিনীপুর ডে কলেজের ছাত্র৷ ক্লাসে বসেই দেখতে পায় ওই হলুদ শালগাছ৷ তার ঠিক নীচেই মুখে গামছা বাঁধা কয়েকজন সুবলকাকাকে দাঁড় করিয়ে গুলি করে৷ রক্তাক্ত সুবলকাকা মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যায়৷ কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শরীরটা কেঁপে উঠে স্থির হয়ে যায়৷ লোকগুলো সুবলকাকার মৃতদেহের পাশে একটা পোস্টার রেখে, স্লোগান দিতে দিতে গভীর জঙ্গলে মিলিয়ে যায়৷ সাদা কাগজের পোস্টারে লালকালি দিয়ে লেখা ছিল – পুলিশের চরবৃত্তির জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল৷
দৃশ্যটা দেখেই বুকের রক্ত জল হয়ে গিয়েছিল সুবর্ণকান্তির৷ গ্রামে ফিরে দেখেছিল পুলিশের জিপ৷ গ্রামের বেশ কয়েকজন লোককে পুলিশ আটক করে ভ্যানে তুলছে৷ জঙ্গলমহলে তখন আতঙ্কের পরিবেশ৷ রাতে মাওবাদী, দিনে পুলিশ৷ বনাঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিসহ৷
সুবর্ণকান্তি সোজা পুলিশ জিপের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়৷ অফিসারের চোখে চোখ রেখে বলে, “আমি জানি, সুবলকাকাকে কারা খুন করেছে৷”
পুলিশ অফিসার অবাক৷ জিগ্যেস করে, “কারা?”
সুবর্ণকান্তি স্পষ্টস্বরে জানায়, “বনপার্টির লোকজন৷”
মাওবাদীদের স্থানীয়রা বনপার্টিই বলত৷ পুলিশ অফিসার জিগ্যেস করে, “তুমি কাছাকাছি ছিলে?”
“না৷”
“তাহলে?”
“আমি জানি৷”
পুলিশ সন্দেহ করে সুবর্ণকান্তিকেই৷ তুলে নিয়ে যায় পুলিশ-ক্যাম্পে৷ পরে খোঁজখবর নিয়ে যখন জানতে পারে ঘটনার সময় সুবর্ণকান্তি কলেজের ক্লাসে ছিল, তখন ছাড়া পায়৷
দ্বিতীয়বারের ঘটনাটা আরও মর্মান্তিক৷ সেদিন চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল খড়্গপুর বাসস্ট্যান্ডে৷ তখনই চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে ওঠে৷ সুবর্ণকান্তির চোখের সামনে জেগে উঠেছিল আবার সেই হলুদ শালগাছ৷ দেখতে পায় নিজের মাকে৷ সরু জঙ্গলের পথে মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে মা বাড়ির দিকে ফিরছে৷ হঠাৎই মায়ের মুখোমুখি লেজে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে মস্ত গোখরো৷ কালো ফণা দোলাচ্ছে৷ ফণার পিছনে সাদা নকশা৷ লকলক করছে চেরা জিভ৷
আতঙ্কে ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে মায়ের মুখ৷ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তারপর যেই মাথার ওপর থেকে কাঠের বোঝাটা খসে গিয়ে মাটিতে পড়ল, সাপটা শরীর দুলিয়ে ছোবল দিল মায়ের পায়ে৷ কয়েক মিনিটের মধ্যে সব শেষ৷
ঘোরগ্রস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে দেখেছিল, জঙ্গলের রাস্তায় পড়ে থাকা মৃত মাকে তাদের উঠোনে এনে শুইয়ে রেখেছে গ্রামেরই লোকজন৷
সেদিনই পিতৃহীন সুবর্ণকান্তির জীবনে শেষ টানটাও খসে গিয়েছিল৷ চাকরি পেয়ে গ্রাম ছাড়ে৷ অফিসের কাছে রাঙামাটিতে চারকাঠা জায়গা কিনে বাড়ি করে৷ নিজেকে গুছিয়ে নিতে সময় লেগেছিল৷ তাই বিয়ের কথাও ভাবতে হয়েছিল চল্লিশের কাছে এসে৷


তিন


অন্যদিন কলিংবেল টিপতে হয় না৷ বাইক থামিয়ে বাউন্ডারির গ্রিলের গেট খোলার শব্দেই ঘরের দরজা খুলে যায়৷ একদিনও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি৷ আজ যেন কেমন সব চুপচাপ! সুবর্ণকান্তি কলিংবেল টিপল৷ দরজা খুলেই চমকে উঠল অন্তরা৷ সুবর্ণকান্তির পিছনে দাঁড়িয়ে আছে সঞ্জয়৷
সুবর্ণকান্তি বলল, “হাঁ করে দেখছ কী! চায়ের জল চড়াও৷ আরে আসতে কী চায়, জোর করে ধরে আনলাম৷” তারপর সঞ্জয়ের দিকে ফিরে বলল, “এসো, সঞ্জয়৷”
কিচেনে ঢুকে বিনবিন করে ঘামছে অন্তরা৷ বিয়ের ক-মাস পেরিয়ে গেছে তবু আজও যেন মানুষটা ভীষণ অচেনা৷ কখনো রাগতে দেখেনি৷ পাথরের মতো শান্ত একটা মানুষ৷ বিয়ের আগে নিজেই বলেছিল, “অন্তরা, তোমার সঙ্গে আমার এজ-ডিফারেন্সটা কিন্তু প্রায় চোদ্দো বছর, তোমার আপত্তি নেই তো? তাছাড়া সুবর্ণকান্তি না হয়ে আমার নাম তাম্রকান্তি হওয়া উচিত ছিল৷ দেখছ তো, তামার মতো আমার গায়ের রং৷ গোলাপি মুসুন্ডাফুলের মতো তোমার সঙ্গে কিন্তু আমি ভীষণই বেমানান৷ ভেবে দেখো, এখনো সময় আছে৷”
যে-মানুষ এইভাবে কথা বলে তার দিক থেকে কোনো মেয়ে কি মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারে! অরাজি হওয়ার প্রশ্নই ছিল না৷ তবে দিনেদিনে বুঝেছে, মানুষটা কখনো স্বতঃস্ফূর্ত, কখনো খুব গম্ভীর৷ সবমিলিয়ে তাকে যেন আজও পুরোপুরি আবিষ্কার করতে পারেনি অন্তরা৷
চা হয়ে গেছে৷ ট্রে সাজিয়ে যখন ড্রয়িংরুমে এল, তখন দেখল অফিসের জামাকাপড়েই সোফাতে বসে বকবক করে যাচ্ছে সুবর্ণকান্তি৷ তুলনায় সঞ্জয় বেশ থমথমে, চুপচাপ৷
অন্তরাকে দেখেই সুবর্ণকান্তি বলল, “বসো৷ দেখো তো কী ট্যালেন্টেড ছেলে অথচ জীবনটাকে কীরকম অপব্যয় করে ফেলছে!”
অন্তরা সঞ্জয়ের মুখোমুখি বসে৷ সুবর্ণকান্তি বলে, “চাকরি তো লক্ষকোটি মানুষ করে৷ পৃথিবীতে ক-জন তাদের মনে রাখে? ক-জন তাদের চেনে? কিন্তু পিকাসো, ভ্যানগখ, রেমব্রান্ট, সালভাদর দালিদের এক ডাকে সারা পৃথিবী চেনে৷ আমাদের মকবুল ফিদার কথাই ধরো না, হুসেন সাহেবকে কে না চেনে? সঞ্জয়, জীবন একটা স্বপ্ন৷ বেঁচে থাকায় অনেক চড়াই-উৎরাই আসে ঠিকই, কিন্তু সেগুলোকে অতিক্রম করে নিজের স্বপ্নের দিকে হেঁটে যাওয়ার সাধনাই কিন্তু সত্যিকারের বেঁচে থাকা৷”
সঞ্জয় নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে সুবর্ণকান্তির দিকে৷ তারপর নিচুস্বরে বলল, “আসলে অন্তরার সঙ্গে…”
সঞ্জয়কে কথা শেষ করতে না-দিয়েই সুবর্ণকান্তি বলল, “আমি সব জানি৷ অন্তরা বিয়ের পর আমাকে সবই বলেছে, তোমার ছবি আঁকার কথা৷ তোমাদের বেড়াতে যাওয়ার কথাও৷”
অন্তরা চমকে ওঠে সুবর্ণকান্তির কথায়৷ সুবর্ণকান্তি তাকে পাত্তা না-দিয়েই বলল, “আমি তোমার পাশে থাকতে চাই৷ আমি যা রোজকার করি, তাতে একজন শিল্পীকে অনায়াসেই আমি প্রোমোট করতে পারি৷ তুমি বাড়ি ফিরে আজ থেকে শুধু ছবি আঁকো৷ তোমার সমস্ত কিছুতেই তুমি আমাকে ও অন্তরাকে পাশে পাবে৷ আমরা তোমাকে একজন সত্যিকারের শিল্পী হিসাবে দেখতে চাই৷”
চা শেষ করে উঠে পড়ে সঞ্জয়৷ বাইরে রিকশাতে তুলে দিতে আসে সুবর্ণকান্তি ও অন্তরা৷ রিকশায় বসে সঞ্জয় বলল, “সুবর্ণদা, আপনাকে আমি আজীবন ভুলব না৷ রং-তুলি দিয়ে যে ক্যানভাসে ছবি আঁকে সে হয়তো চিত্রকর, কিন্তু সে-ই প্রকৃত শিল্পী যে একটা সাধারণভাবে বেঁচে থাকা মানুষকে সত্যিকারের জ্যান্ত করে তোলে৷”
সঞ্জয়ের শেষ কথাগুলোয় সুবর্ণকান্তি ও অন্তরার মন আর্দ্র হয়ে উঠল৷ রিকশাটা রাস্তার বাঁকে মিলিয়ে যেতেই বাড়ি ঢুকল ওরা৷ সোফায় চোখ পড়তেই চমকে উঠল সুবর্ণকান্তি৷ দেখল, সোফায় অন্তরার দেওয়া টাকাটা পড়ে আছে৷ স্তম্ভিত অন্তরাও৷
সুবর্ণকান্তির বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল৷ তারপর বলল, “এই হচ্ছে শিল্পীর অভিমান! নাও, টাকাটা তুলে রাখো৷”
টাকাটা হাতে নিয়ে অন্তরা বলল, “আমি তো সঞ্জয়ের কথা তোমাকে কোনোদিন বলিনি!”
“বলেছ৷ আজ দুপুরে৷”
অন্তরা বিস্ময়ে স্বামীর দিকে তাকায়৷ তার হঠাৎ মনেপড়ে গেল হলুদ শালগাছের কথা৷ বিয়ের পর দুটো ঘটনার কথা সুবর্ণকান্তি তাকে বলেছিল বটে, কিন্তু সেভাবে বিশ্বাস করতে মন সায় দেয়নি৷ কিন্তু আজ আর বিশ্বাস না করার কোনো যুক্তিই সে খুঁজে পাচ্ছে না৷ অন্তরা বলল, “তবে কি সেই হলুদ শালগাছ?”
সুবর্ণকান্তি শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল, “হুম, সেই হলুদ শালগাছ৷”

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

20 thoughts on “হলুদ শালগাছ

  1. ক্রমাগত ভাবিয়ে তুলতে পারে এই লেখা। অসাধারণ।

  2. একটা অদ্ভুত মনকেমন এর ভাবনায় পড়ে গেলাম। “হলুদ শালগাছ” রং হারিয়েও ফিরে আসে জীবনের নানা অনুসঙ্গে।

  3. একনিঃশ্বাসে পড়ে গেলাম। ভীষণ সুন্দর। সুবর্ণকান্তি, সঞ্জয় ও অন্তরা তিনটি চরিত্রের বুনোটে গল্প বাঁধা পড়েছে।
    টানটান উত্তেজনা এবং শেষে একটা মেসেজ রয়েছে কাহিনীতে।
    হলুদ শালগাছের প্রতীকিতে গল্প অন্যমাত্রা পেয়েছে।

    1. আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানবেন।

  4. অসাধার। সব জায়গাগুলো আমার চেনা।চরিত্রগুলোও মেদিনীপুর কলেজে দেখেছি।শুধু একজন সুবর্ণকান্তি চাই।

    1. আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই।

  5. জীবনের আশ্চর্য কিছু অনুভব ,তিনটি চরিত্রের নিজস্ব দেখার দৃষ্টিকোন সেভাবেই আলো পড়েছে লেখার মধ্যে যদিও সুবর্ণকান্তি প্রধান চরিত্রর বা কথক । বস্তুত আমাদের প্রত্যেকের ই একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থাকে যে কোনো ঘটনার বিচার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে,সেকারনে এক ই ঘটনা এক একজনের ক্ষেত্রে এক একভাবে প্রতিভাত হয় ।মানবিক সম্পর্কগুলো ও এরকম ই । একটা রূপকের মধ্য দিয়ে রেহান ভাই হয়তো সেটাই দেখিয়েছেন, । অনুপম একটি ছোট গল্প । ভাল লাগলো ।

    1. ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা জানবেন।

  6. Khuub bhalo laglo.jiboner anubhuti…upolobdhi pelam.k’ek ta jayga asadharon laglo.
    Manusher choritro bichitro…
    Manush girgitir thekeo taratari rong bodlaay…
    Jibone choraai utraai achhei, tao sob katoye egiye jaoai jibone sotyiii bneche thaka…
    Ei jayga gulo te nijer jiboner sathe mil pelam.

    1. অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা, কস্তুরী।

  7. এক নিঃশ্বাসে পড়লাম। ভীষণ ভালো লাগলো। মনকে এক অন্য অনুভবে নিয়ে গেল।

  8. হলুদ শাল গাছ কে মাধ্যম করে সুবর্ণ কান্তির বর্তমান বা সাম্প্রতিক অতীত এর সত্য ঘটনা জ্ঞাত হওয়ার বিষয়টি
    গল্পে বেশ আকর্ষণীয় ।
    এই ক্ষমতা বলেই সুবর্ণ কান্তি সঞ্জয় ও
    অন্তরার সম্পর্কের পুঙ্খানুপুঙ্খ কথা এমন কি চুম্বন স্বাদ এর গল্পও জ্ঞাত হওয়ার পর তার চরিত্র একটুও বিচলিত হয় নি । বরং সুবর্ণ কান্তির ইতিবাচক দিক মোহ মুক্ত করলো সঞ্জয়কে ।
    দুটো চরিত্রই বেশ নৈতিকতা বহন করে যা অবশ্যই শিক্ষণীয় ।
    লেখকের পারদর্শিতায় গল্পখানায় বেশ অন্যরকম ভালোলাগা ।

  9. গল্পটির বিন্যাস অসাধারণ। আরো ভাল লাগলো, গল্পটির বিষয়বস্তু খুবই ইতিবাচক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *