চিত্রণ চৌধুরী
নিশুতি রাত। ভারতের একদম উত্তর পূর্ব কোণে, অরুণাচলের থমথমে পাহাড়ি জঙ্গল, হালকা চাঁদের আলোতে আধ-জাগা হয়ে রয়েছে। কুলকুল শব্দ করে নীলবর্ণা দিবাং নদী আপন মনেই বয়ে চলেছে, হিমালয়ের সুগভীর গিরিখাত দিয়ে।
প্রকৃতির ডাকে এই মধ্য রাত্রে, সেনাবাহিনীর অস্থায়ী তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে এল ভারতীয় পদাতিক সেনাবাহিনির এক জওয়ান। তাঁবুর বাইরে তখন চোখ রেখেছে সেনাবাহিনীর অন্য একজন সদস্য প্রকাশ বারভে। তার একজোড়া বিস্ফারিত চোখের সামনেই, সহকর্মীকে চোখের পলকে টেনে নিয়ে জঙ্গলে মিলিয়ে গেল এক পৈশাচিক হিংস্র জীব! হতবুদ্ধি হয়ে পড়া চোখজোড়ায়, এত দ্রুত জন্তুটিকে আবছা আলোর মধ্যে তেমনভাবে শনাক্ত করা গেল না। তবে জন্তুটির আকার, হিংস্রতা এবং ক্ষিপ্রতা এক ঝলকের মধ্যে আন্দাজ করে প্রকাশ ভাবল, কোনও দুঃস্বপ্ন দেখেছে সে বোধ হয়! একদিন পরে, প্রকাশের সহকর্মীর আধখাওয়া মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছিল বেশ কিছু দূরে, পাহাড়ের খাদে। ঘোর ভেঙেছিল প্রকাশের— ব্যাপারটা দুঃস্বপ্ন ছিল না তার মানে! প্রকাশের মনে সেই দিনের প্রত্যক্ষ করা আকস্মিক দুর্ঘটনার, আতঙ্ক এবং অবিশ্বাস, আজও যেন অনেকটা দগদগে ঘায়ের মতোই পীড়াদায়ক।
হিমালয়ের পাদদেশে, চা বাগান ঘেরা ছোট্ট ছিমছাম বিমানবন্দর এই ডিব্রুগড়। ভোরে বিমানবন্দরটিতে অবতরণের পরেই, চৈত্রের শুরুতেও হালকা শীতের আমেজটা যেন আবার নতুন করে ফিরে পেলাম। কলকাতা থেকে তো বসন্তও বিদায় নিয়েছে এর মধ্যেই। এখন কলকাতায় বেশ গরমই বলা চলে। আসলে গত পরশু কর্নেল অর্ণব রায় মহাশয় ফোন করেছিলেন আমাকে। উনি এখন অরুণাচলের রোয়িং অঞ্চলে পোস্টেড। রোয়িং থেকে হিমালয়ের জঙ্গল-পাহাড়ি পথে ঘন্টা ছয়েকের রাস্তা হল হুনলি। মাঝে রয়েছে একটি গিরিপথ— মায়োদিয়া পাস্। এই সময় ওই গিরিপথে বরফ জমে থাকার কথা। এই হুনলির জঙ্গলে বিগত মাস খানেক হলো একটা আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এমনকি দিল্লি অবধি এই খবরে সবাই বেশ নড়েচড়ে বসেছে। খবরের কাগজে ছোট করে লেখা এই খবরটা বেশ কিছুদিন আগে অবশ্য আমারও চোখে পড়েছিল। এই বিগত এক মাসের মধ্যে চারজন সেনা আধিকারিক আর তিনজন অরুণাচল পুলিশের কর্মী মারা গিয়েছেন। স্থানীয় মানুষের ধারণা এটা পিশাচের কাজ।
এই অকৃত্রিম, মুগ্ধ করা প্রকৃতির মধ্যে, হুনলির কাছে দিবাং নদীতে, প্রস্তাবিত জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ শুরু হতে চলেছে। কিছুটা হলেও ধ্বংস হবে প্রকৃতি। এত দিন অবধি বাঁধ না মানা, গভীর গিরিখাতে বয়ে চলা নীল রঙের দিবাং নদীর গতি বাধাপ্রাপ্ত হবে। প্রকৃতিদেবী রুষ্ট হয়েছেন। দূত হিসেবে এক পিশাচকে পাঠিয়েছেন সতর্ক করার জন্য, নাহলে পরিণতি ভয়ংকর হবে— স্থানীয় ইদু-মিসমি উপজাতির মানুষের এইটাই বিশ্বাস। হিমালয়ের এই ইদু-মিসমি সম্প্রদায়ের পাহাড়ি মানুষদের কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট ধর্ম নেই। সবাই প্রকৃতির উপাসক। এদের দেব দেবী, ধর্ম সবটাই অরণ্য আর প্রকৃতিকেন্দ্রিক।
হুনলির এই আতঙ্কের মধ্যে পুলিশ, সেনা আধিকারিক বা আমলাদের অসুবিধে হল— একে এই পিশাচের রহস্য, তার ওপরে আবার স্থানীয় মানুষ এখন মনে করছে— ভবিষ্যতে আরও বড় সর্বনাশের অশনি সংকেত হলো এই পিশাচের আক্রমণ। প্রকৃতি দেবী রুষ্ট হয়ে এই পিশাচরূপী দূতকে এখন মর্ত্যে পাঠিয়েছেন! তাই মানুষজন এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শুরুই করতে দিচ্ছে না। পিশাচ রহস্যের সমাধান করাটাও বেশ মুশকিল হয়ে পড়ছে। এর সামগ্রিক ফলশ্রুতি হল— দিল্লি থেকে আসা চাপ বেড়ে চলেছে অর্ণবদের ওপর।
খবরের কাগজ, বা অর্ণবের সাথে ফোনে দু’-চারবার কথা বলে যেটুকু বুঝেছি— প্রতিটি মৃত্যুর পেছনেই ছিল বন্য জন্তুর আক্রমণ। এটা কোনও সাধারণ ‘লেপার্ড’ অথবা এই অঞ্চলের ‘শ্লথ’ ভালুক গোত্রের প্রাণীর কাজ নয়। দু’-একটি ক্ষেত্রে, জন্তুটির একটি থাবার আঘাতে, আক্রান্তের ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা হয়ে গেছে! এই সময়, শুকনো পাতা বিছানো জঙ্গলে তেমনভাবে জন্তুটির পায়ের ছাপ সংগ্রহ করা যায়নি। তবে আমার মতো সবারই অনুমান, এটা কোনও বড় বাঘের কাজ। হুনলি থেকে ঘন্টা চারেক দুর্গম ধ্বসপ্রবণ রাস্তায় চলতে থাকলে শুরু দিবাং উপত্যকার জঙ্গল। এই উপত্যকাতে ভারতের শেষ শহর ‘আনিনি’। ছোটখাটো দু’-একটি গঞ্জ ছাড়া আর তেমন কিছু নেই, চীন বা তিব্বত অবধি প্রসারিত, এই বিস্তীর্ণ অর্ধেক অনাবিষ্কৃত দুর্ভেদ্য অঞ্চল জুড়ে। দিবাং উপত্যকার জঙ্গল হল ভারতের একমাত্র জঙ্গল যেখানে বাঘ বরফের মধ্যেও শিকার করতে সক্ষম। এত উঁচুতে, এবং হিমাঙ্কের নীচের তাপমাত্রায় ‘বেঙ্গল টাইগার’-এর বসতি ভারতের আর কোথাও নেই।
দিবাং-এর অরণ্য থেকে কোনও বাঘ পথভ্রষ্ট হয়ে এদিকে এসে, হুনলির জঙ্গলে এই আক্রমণ চালায়নি তো? সেটা অবাস্তব কিছু নয়। স্থানীয় শিকারের কারণে এই অরণ্যে এখন জীবজন্তুর সংখ্যা বেশ কম। পেটের দায়ে হয়তো বা বাঘটি এই অঞ্চলে ভুল করে ঢুকে পড়ে মানুষখেকো হয়ে গিয়েছে। সেটা কিছুটা অনুমান করা যায়, এই ধরণের মৃত্যু, আর তার পরে আধ খাওয়া দেহগুলোর বর্ণনা শুনে। কিন্তু নতুন করে লাগানো ক্যামেরা ট্র্যাপেও বাঘের বা এই ধরণের জন্তুর অস্তিত্ব এখনও ধরা পড়েনি। উন্মুক্ত উদার প্রকৃতির মাঝে অসীম এই অরণ্য। সব জায়গায় ক্যামেরা লাগানো সম্ভব নয়। এটাই হয়তো কারণ। অন্তত তাই মনে হয় আমার।
স্বেচ্ছাবসরের আগে এই উত্তর-পূর্ব ভারতে আমি বহুদিন কাজ করেছি। মানসের জঙ্গলে একটা ঘটনা আমাকে ভীষণভাবে নড়িয়ে দিয়েছিল। সেই দুর্ঘটনার পরে আমার জীবন প্রবাহ একদম অন্য খাতে বইতে শুরু করেছিল। এখন কলকাতার এক নামি বেসরকারি সংস্থায় ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’-এর কাজ কর্ম দেখি। অর্ণবের অনুরোধ অবশ্য ফেলতে পারলাম না। অর্ণব নিশ্চয়ই কিছু রহস্যের গন্ধ পেয়েছে, তা নাহলে হঠাৎ এই অর্ক চৌধুরীকে স্মরণ করবে কেন? যদিও কর্মসূত্রে আমাদের আলাপ বহুদিনের। এছাড়া এই অঞ্চলটা অনেকটা আমার হাতের তালুর মতো চেনা ছিল একটা সময়ে। এই উদার প্রকৃতির সাথেও আমার বোধ হয় কোনও আত্মিক যোগ আছে। তাই শত অসুবিধে থাকলেও শেষমেষ রাজি হয়ে গেলাম অর্ণবের ডাকে।
বিমান বন্দরের বাইরেই সেনাবাহিনির তারা চিহ্ন দেওয়া একটা গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল অর্ণব। অর্ণব নিজেই এই গাড়ি চালিয়ে রোয়িং থেকে আমাকে রিসিভ করার জন্য সাতসকালে এসেছে। আজকে রোয়িং-এ ওর ব্যক্তিগত সেনাবাহিনির আবাসনে রাত কাটানোর কথা। পরের দিন সকালে দুজনেই হুনলি চলে যাব। ওখানকার পাহাড়ের মাথায় একটা সার্কিট হাউস আছে। হুনলির ওই সার্কিট হাউসেই সপ্তাহখানেক থেকে, নরখাদকের রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করতে হবে। ব্যাপারটা একটু স্পর্শকাতর, কারণ স্থানীয় আদিবাসীরা এর বিহিত করার চেয়ে এটিকে ঈশ্বরের নির্দেশ বলে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, আজ অবধি কোনও জন্তুর আক্রমণে আদিবাসী বা সাধারণ মানুষের ক্ষতির খবর নেই। কেবলমাত্র পুলিশ বা সেনাবাহিনির মানুষজনের পৈশাচিক মৃত্যু ঘটেছে এই নরখাদক জন্তু বা বাঘের আক্রমণে! তাই স্থানীয় মানুষজন সরাসরি সেনাবাহিনি বা পুলিশের হস্তক্ষেপ চাইছে না এই ব্যাপারে। তাদের বিশ্বাস— এতে লাভের চেয়ে আখেরে ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি।
বছর তিনেক আগেও, ডিব্রুগড় থেকে এই রোয়িং যেতে অনেকটা সময় লেগে যেত। তখনও ব্রহ্মপুত্র নদের ওপরে ভারতের দীর্ঘতম সেতুটি সম্পূর্ণ হয়নি। অরুণাচলে প্রবেশ করতে হলে, ব্রহ্মপুত্র নদের ঘাট থেকে স্টিমারে চেপে অন্য পাড়ে যেতে হত। আর গাড়িও ওই লঞ্চ বা স্টিমারে চাপিয়ে নিয়ে যেতে হত অন্য পাড়ে। তাই অনেকটা সময় লেগে যেত। এখন এই দীর্ঘ সাত কিলোমিটার লম্বা সেতু খুলে গিয়েছে, সমগ্র রাস্তার মানও খুব ভালো। তাই তিন ঘণ্টাতেই রোয়িং পৌঁছে যাওয়া যায়। আমি অবশ্য আজই প্রথম এই সেতু দিয়ে যাব। বিগত তিন বছরের মধ্যে এই অঞ্চলে আমার এর মধ্যে আসা হয়নি।
দু’দিকে সবুজ চা বাগান চিরে চলা রাস্তা শেষে রোয়িং-এর প্রবেশদ্বারে পৌঁছতে কেমন যেন আমার অতীতে ফিরে গেলাম। অবিকল এক রকম আছে ‘ওয়েলকাম টু রোয়িং’ লেখা প্রবেশ তোরণটা। পেছনে সারিবদ্ধ হিমালয় পর্বত মেলা। আজ আকাশ পরিষ্কার থাকায় দৃশ্যমানতা বেশ ভালো। তাই পেছনে দূরের দিকে সবুজ পাহাড় চিরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে বরফাবৃত মায়োদিয়া গিরিপথের তুষার শৃঙ্গগুলোকে।
এই শহরে এককালে ইংরেজ উপনিবেশ ছিল। সেই সময় থেকে ছোট্ট সুন্দর পাহাড়ের পাদদেশের শহরটিতে বহুতল নেই। বেশির ভাগ বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানের ছাদ আজকের দিনেও টিনের চালের। আমাদের উত্তরবঙ্গের শহরগুলি একসময় এইরকমই ছিল। কিন্তু আমরা ধরে রাখতে পারিনি। অরুণাচলের এই শহর কিন্তু সেই ঐতিহ্য এখনও ধরে রেখেছে। দু-একটি ছোট সুন্দর সাজানো কাফে পাশ্চাত্য শিল্পের ছোঁয়ায় ছিমছামভাবে সাজানো। সাজপোশাক, চিন্তাধারা অথবা ইংরেজি ভাষার দক্ষতায় এখানকার স্কুল বা কলেজের ছেলেমেয়েরা বেশ আধুনিক। ভারতের উত্তর-পূর্ব কোণের ছোট শহর হলে কী হবে, হঠাৎ করে এখানে এসে পড়লে কিন্তু আবহাওয়া, পরিচ্ছন্নতা, ছেলে মেয়েদের আদবকায়দা, খাদ্যাভ্যাস— সব মিলিয়ে পাশ্চাত্য শহর বলে ভ্রম হতে পারে। বাজার অঞ্চলের সামান্য অংশ বিগত কয়েক বছরে, বেশ কিছুটা ঘিঞ্জি হয়ে উঠেছে বলে মনে হলো। তবে মনে মনে বেশ আনন্দ পেলাম, বাজারের সামান্য অংশটুকু ছাড়া, প্রায় একই রকম আছে আজকের দিনেও, আমার আগে দেখা এই ছোট ছিমছাম সুন্দর শহরটি।
রাতের দিকে এখানে শীতের বেশ ভালোই কামড় রয়েছে এখনও। আমি আর অর্ণব একটা কাফেতে বসে গল্প করছিলাম সন্ধের দিকটায়। হুনলি-তে তার মানে এখন বেশ ভালো ঠান্ডা হবে। অর্ণব হুনলির সেই ঘাতকের পায়ের ছাপের একটা অস্পষ্ট ছবি দেখাচ্ছিল আমাকে। যদিও ছবি দেখে আয়তন সম্বন্ধে ধারণা করা বেশ কঠিন, তবে দৃশ্যত বাঘের পায়ের ছাপ বলেই মনে হল। কালকে দুপুরের দিকে একটু তাড়াতাড়ি লাঞ্চ সেরে আমরা হুনলির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ব বলে স্থির হল। আমরা একটা সাধারণ গাড়ি নিয়ে যাব, যাতে কোনওরকম সেনা, পুলিশ বা প্রশাসনের ছাপ থাকবে না। আর সন্ধের পরে হুনলির সার্কিট হাউসে পৌঁছালে, স্থানীয় মানুষজনের চোখে পড়ার সম্ভাবনা কম। সবাই পর্যটক বলেই ভাববে। তবে প্রয়োজনীয় অস্ত্র-সস্ত্র বা সরঞ্জাম, আমাদের সঙ্গেই রাখা থাকবে। রোয়িং ছেড়ে একবার বের হলে, মোবাইলের সিগন্যাল থাকবে না। অর্ণবের কাছে একটা স্যাটেলাইট ফোন রয়েছে, প্রয়োজনে সাহায্য চাইলে, সেনাবাহিনি বা আধিকারিকরা সময়মতো উপস্থিত হয়ে যাবে।
পরিকল্পনা মতো একটা ছোট এসইউভি গাড়ি নিয়ে দুপুরের দিকে যাত্রা শুরু করলাম আমরা। বহুদিন পরে আবার পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালাতে শুরু করলাম। অর্ণব নিজেই চালাবে বলছিল, কিন্তু সত্যি বলতে কী, আমার ইচ্ছে করল এই রাস্তায় চালাতে। পাকদণ্ডীর খাড়া পথ বেয়ে কেবল উঠে যেতে হবে টানা ঘণ্টাপাঁচেক। তারপর আমরা পৌঁছব মায়োদিয়া পাস্।
সূর্য প্রায় ঢলে পড়েছে। পাহাড়ি জঙ্গলে ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসতে সময় লাগে না। সন্ধের পরে এই রাস্তায় অন্যান্য গাড়ির দেখা পাওয়া বেশ দুষ্কর। আমরা মায়োদিয়া পাস্-এ পৌঁছে দেখলাম, চাঁদ আর সূর্য আকাশে সহাবস্থান করছে! আগামিকাল আবার পূর্ণিমা। চারপাশের পাহাড় আর রাস্তা বরফে ঢাকা। তার মধ্যেই সেনাবাহিনি রাস্তার বরফ কেটে যাওয়ার পথ করে রেখেছে। বরফের ওপরে ডুবন্ত সূর্যের সোনালি আলোর প্রজ্জলন দেখে মোহিত হয়ে যেতে হয়। গাড়ি থেকে নেমে অল্প কিছু সময়ের জন্য আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে মায়োদিয়া পাস্-এ দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ তীব্র ঠান্ডা হাওয়ার কামড় অনুভব করতে গাড়িতে রাখা মোটা জ্যাকেটটা নিয়ে এসে, একদম মাথা মুড়ে গায়ে চাপালাম। হাত দুটো পকেটে পুরে অর্ণবকে বললাম, ‘একটু কফি খেলে হয় না?’
এখানে একটাই মাত্র চালু ছোট কাঠের লাইন হোটেল আছে। নামটা একটু অন্যরকম। হোটেল সিক্সটি নাইন! এই রাস্তায় হুনলি বা আনিনি যাতায়াত করতে হলে সবাই এখানেই খাওয়া-দাওয়া করে। খাওয়ার জায়গাটিতে সব সময় কাঠের আগুন জ্বলতে থাকে। ঠান্ডা হাত-পা একটু সেঁকে নেওয়া যায় এই আগুনের ওমে। আমরা ম্যাগি আর কফি খেতে খেতে একটু গল্প করতে থাকলাম। ঝুপ করে, নির্জন এই পাহাড় জঙ্গলের বুকে, এর মধ্যে কখন সন্ধে নেমে এল।
অর্ণব এখন গাড়ি চালাচ্ছে। আমাদের পাস্-টা অতিক্রম করে একটু নীচের দিকে নামতে হবে এবারে। আরও ঘন্টা দুয়েক বাদে হুনলি পৌঁছনো যাবে। গাড়ির হেডলাইটের আলোতে, রাস্তার ওপরেই হালকা কুয়াশা বা মেঘ দেখা যাচ্ছে মাঝে মধ্যেই। জঙ্গলের ঘনত্ব কম হলেই আকাশে উঁকি দিচ্ছে পাহাড় ফুঁড়ে উঠে আসা থালার মতো পূর্ণিমার আগের দিনের রক্তবর্ণ চাঁদ!
এই আঁকাবাঁকা জনমানবহীন রহস্যময় পাহাড়ি পথ দিয়ে হুনলির সার্কিট হাউসে ঢুকতে ঢুকতে প্রায় সন্ধে সাতটা বেজে গেল। এই সার্কিট হাউসের অবস্থান ঠিক একটা পাহাড়ের মাথার ওপরে। চারিধারে একেবারে তিনশো ষাট ডিগ্রি আবার এই পাহাড়কে ঘিরে রেখেছে, হিমালয়ের উঁচু উঁচু বরফাবৃত অন্যান্য পাহাড়ের চূড়াগুলি। নীচের দিকে সুগভীর খাদের মধ্যে বিস্তীর্ণ সবুজ উপত্যকা, যা আমাদের এই অবস্থান থেকেই দৃশ্যমান। দু’-একটি মিটি মিটি বাড়ির আলো জোনাকির মতো জ্বলছে নীচের উপত্যকা আর পাহাড়ের গায়ে। রক্তবর্ণ হয়ে ওঠা চাঁদ এখন রুপোলি হয়ে প্রায় মাঝ গগনে বিরাজমান। পাহাড়ের চন্দ্রস্নাত শ্বেতশুভ্র বরফ চূড়া গুলোর গা বেয়ে যেন চুঁইয়ে নীচের দিকের বনানীতে গড়িয়ে পড়ছে তরল বরফ গলা চাঁদের ধারা। অনবদ্য এই মায়াবী পরিবেশ আবার বহুদিন পরে ফিরে পেলাম আমি!
ইদু মিসমি উপজাতির স্থানীয় ছেলে আজু মেলো, এখানকার একমাত্র তত্ত্বাবধায়ক। আজুর বাড়ি একটু নীচের দিকে, সে তালা খুলে ডিমের ঝোল আর ভাতের ব্যাবস্থা শুরু করে তড়িঘড়ি বাড়ির পথে প্রস্থান করল। যাওয়ার সময় ভাঙা হিন্দিতে বলে গেল— ‘অশুভ আত্মা চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এই সময় আপনাদের ঘুরতে আসা ঠিক হয়নি।’ আমরা অন্তত দিন চারেক এখানে থাকব শুনে একটু অবাক হল। রাতে ঘরের টানা বারান্দার বাইরে, রেলিং দেওয়া সুন্দর লনের খাদের ধারে যেতে নিষেধ করে দিল। বিপদ কোনদিক থেকে আসবে তার তো কোনও ঠিক নেই! আমরা অবশ্য এই পিশাচের ভয় পাচ্ছি না মোটেই। তবে নরখাদক বাঘের ভয়েই শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল— এই জনমানবহীন প্রান্তে রাতে সুযোগ বুঝে বাঘে টুঁটি চিপে ধরলে তো কেউ জানতেও পারবেনা! আজু আবার সেই সকালে আসবে!
রাতে চাঁদের আলোতে পিছনের দিকের খাওয়ার ঘরে যেতেও যেন গা ছম ছম করে। আমি আর অর্ণব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ভালো করে ঘরের দরজা আটকে সুখনিদ্রায় মগ্ন হলাম।
সকালে কুয়াশার চাদর সরিয়ে পাহাড়গুলো সবে জেগে উঠছে ধীরে ধীরে। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আমি আর অর্ণব এর পরের পরিকল্পনা নিয়ে একটু আগাম আলোচনাই করছিলাম। সামনের উন্মুক্ত লনের রেলিংয়ের নীচে খাদের দিক থেকে উঠে আসা, পায়ে হাঁটা রাস্তাটায় চোখ পড়ল। মনে হল আজু ছুটতে ছুটতে সার্কিট হাউসের দিকে আসছে। আজু এতটা একটানা দৌড়ে চড়াই পথে উঠে এসে বেশ হাঁপিয়ে গেছে। আমি বলতে যাচ্ছিলাম এত তাড়াহুড়ো করার কী ছিল? আমরা তো নিজেরাই কিচেনের গ্যাস জ্বালিয়ে চা করে নিয়েছি। আজু তার আগেই ভাঙা হিন্দিতে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, কাল রাতেও নাকি এক ভয়ানক ঘটনা ঘটেছে। এবারে গ্রামের লোক। তার নিজের কাকাস্থানীয় আত্মীয়কে কাল সন্ধেয় নাকি পিশাচ পেছনের জঙ্গলে টেনে নিয়ে গিয়ে খেয়েছে! দেহ কোনওরকমে শনাক্ত করা গেছে। আমরা আজুকে একটু অভয় দিয়ে বললাম— ‘আমরা তোমার সঙ্গে আছি। চলো একবার ওখানে যাওয়া যাক। যদি তোমাদের কোনও উপকার করতে পারি, আমাদেরও ভালো লাগবে।’
আজু হয়তো আমাদের কথায় তেমন ভরসা পেল না, কিন্তু আমাদের দুর্ঘটনাস্থলে নিয়ে যেতে তেমন কোনও অমত প্রকাশ কর না। দরজাটা লক করে, প্রয়োজনীয় সামগ্রী সঙ্গে নিয়ে আমরা আজুকে অনুসরণ করে ওদের পাহাড়ের নীচের দিকের বস্তির রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করলাম।
বেশ কিছুটা হেঁটে বস্তির পেছন দিকের জঙ্গলে প্রবেশ করতেই একটা জটলা চোখে পড়ল। উদ্ভ্রান্ত চোখ-মুখ নিয়ে বেশ কিছু স্থানীয় মানুষ নিজেদের মধ্যে কী সব আলোচনা করছে। জটলা ঠেলে আজুর সাথে একটু এগোতেই যে দৃশ্য চোখে পড়ল, তার দিকে বেশি সময় তাকিয়ে থাকা যায় না। আধখাওয়া একটা মুণ্ডুহীন দেহ পড়ে আছে। নীল মাছির দল ভিড় করেছে লাশের পাশে। মুণ্ডুটা নাকি বেশ কিছু দূরে জঙ্গলের মধ্যেই পাওয়া গেছে। আমি আর অর্ণব আশেপাশে নীচের দিকে তাকিয়ে জন্তু জানোয়ারের পায়ের ছাপ কিছু আছে নাকি খুঁজে দেখতে থাকলাম। কিছুটা দূরে, পাতার মধ্যে দিয়ে বের হয়ে থাকা মাটিতে একটা জন্তুর পায়ের ছাপ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। বেশ কয়েকটি পায়ের ছাপ, যার একটি আগের দিন অর্ণব নিজের ফোনে আমাকে দেখিয়েছিল। কিন্তু তখন বুঝিনি। পায়ের ছাপের আয়তন আমাকে শুধু বিস্মিত নয়, বেশ উদ্বিগ্ন করে তুলল। পায়ের ছাপটা অবিকল বাঘের পায়ের ছাপের মতো। কিন্তু এত বড় বাঘের পায়ের ছাপ পৃথিবীতে কেউ দেখেছে বলে মনে হয় না! একটি প্রমাণাকার বাঘের পায়ের ছাপের প্রায় তিনগুণ! দু’-একবার বাঘসুমারির লোকেদের সাথে ঘোরাঘুরি করার সুযোগ পেয়েছিলাম, অসমের মানস অরণ্যে। তাই পূর্বঅভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করতে পারছি এটা অবশ্যই বাঘের পায়ের ছাপ। কিন্তু এত বড়?
আজুকে কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদু স্বরে বললাম— ‘তোমাদের এই গ্রামে কোনও মোড়ল জাতীয় পদের লোক থাকে না? তার সাথে একবার কথা বলা যাবে?’
ওঁদের অনেক অভিজ্ঞতা থাকতে পারে, এই রকম ঘটনা গ্রামে অতীত কালে ঘটেছে নাকি সেই ব্যাপারে আলোকপাত করতে পারবেন…
কথায় কথায় আজু যা বলল তা অনেকটা এইরকম— এই অঞ্চলের সব পাহাড়ি আদিবাসী গ্রামের মতো, এই গ্রামেও একজন গাঁওবুড়ো আছেন। একাই থাকেন, ওনার বাসস্থান এই বস্তি থেকে বেশ কিছুটা দূরে। এটা অবশ্য এই উপজাতিগুলির রেওয়াজ। গ্রামের প্রধানেরা সাধারণত বসতির থেকে একটু দূরে বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে বাড়ি করেই থাকতে অভ্যস্ত।
এই জঙ্গল দিয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার হাঁটলে ওঁর বাড়ি। বিপত্নীক মানুষ। একমাত্র ছেলে কলকাতার কাছে নাকি কোথায় পড়াশুনা করে। ছুটি-ছাটা পেলে তখন আসে এখানে। উনি এমনিতেই কারোর সাথে তেমন দেখা সাক্ষাৎ করেন না, তবে পশুপ্রেমী মানুষ। একসময় এখানকার রীতিরেওয়াজ মতো প্রচুর শিকার করতেন। কিন্তু এখন উনি আহত পশুপাখিদের উদ্ধারের কাজ করেন। এমনকি কিছুদিন আগে আনিনির কাছে দিবাং ব্যাঘ্র প্রকল্পের জঙ্গলের থেকে তিনটে ব্যাঘ্র শাবক উদ্ধার করা হয়েছিল, তখনও উনি এই বৃদ্ধ বয়েসেও দুর্গম অঞ্চলে গিয়েছিলেন উদ্ধারকারী দলের সাথে। তার মধ্যে একটি শাবক বেশ দুর্বল ছিল। উনি এখানে এনে নিজের বাড়িতে রেখে মাস তিনেক চিকিৎসা করেছিলেন। শিকার করাও শিখিয়েছিলেন বাঘের ছানাটিকে। আজুরা সবাই সেই বাঘের ছানাকে চোখের সামনেই বড় হতে দেখেছে। বছর চারেক পরে, বাঘটি পূর্ণবয়স্ক হয়ে যেতে, উনি আবার তাকে ছোট ট্রাকে করে নিয়ে গিয়ে সেই দিবাং-এর জঙ্গলে ছেড়ে এসেছিলেন। তবে গ্রামবাসীরা একদম নাকি নিশ্চিত— সেই বাঘের সাথে এই ঘটনার কোনও মিল নেই। বেশ নিরীহ বাঘ, গ্রামের সবাই তাকে দেখেছে এক সময়। এছাড়া বাঘের গায়ে এত জোর নেই। সর্বোপরি, বাঘেদের শিকার করার কৌশল এইরকম ভয়াবহ নয়। তাছাড়া দিবাং ছেড়ে বাঘ হুনলির জঙ্গলে আসতে যাবেই বা কেন?
শুনে বেশ অবাক লাগল। এভাবে বাড়িতে বাঘ রাখা বেআইনি। যদিও এই সমস্ত প্রত্যন্ত অঞ্চলে দেশের আইনের থাবা তেমন ভাবে আঁচড় কাটতে পারে না। এই সব ব্যাপারে কোনও মিডিয়া এখানে এত কষ্ট করে পৌঁছয় না বা মাথাও ঘামায় না। কিছুটা আদিবাসী নিয়মকানুন চলে এখনও। এই অঞ্চলে প্রশাসনের কেবল একটাই মাথা ব্যাথা— লোকজন কে কিছুটা সন্তুষ্ট রাখতে হবে, যাতে চীন চট করে না আবার তলায় তলায় নিজেদের মাটি পোক্ত করে ফেলে।
অর্ণব বেশ মন দিয়ে শুনছিল আমাদের কথোপকথন। আমি ইশারায় অর্ণবকে বললাম একবার এই গাঁওবুড়োর সাথে দেখা করতে হবে। বেশ আকর্ষণীয় চরিত্র বলে মনে হচ্ছে।
আজু আমাদের সঙ্গে ওই পথে যেতে ভয় পাচ্ছে। অনেকটা জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হবে। এমনিতে এই পথ চলতে কোনও অসুবিধে নেই। পর পর ঘটে যাওয়া ভয়ংকর ঘটনাগুলো এই সাহসি পাহাড়ি মানুষদের মনেও ভয় ধরিয়ে দিয়েছে এখন। আমাদের যে ভয় লাগছে না তা নয়, আমাদের তো পুরো অঞ্চলটাই অচেনা। তবে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, এই রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে চট করে বাঘ আক্রমণ করার কথা নয়। তার ওপরে আগের দিন শিকার করে সে যদি ওই মানুষটিকে খেয়ে থাকে তাহলে এখন আর নিজের ডেরা থেকে চট করে বের হবে না।
আজুকে কোনওরকমে বোঝানো গেল, পিশাচ রাত্রি ছাড়া বের হয় না। আজুর সম্মতি পেয়ে আমরা ওর সাথে বেশ ভয়ে ভয়ে জঙ্গলের পথ ধরে চলতে শুরু করলাম। পায়ে হাঁটা রাস্তার দাগ বরাবর হাঁটলে তেমন অসুবিধের রাস্তা নয়। তবে দুপাশের জঙ্গল বেশ ঘন। যতই নিজেকে অভয় দিই না কেন, এই পথে আবার হেঁটে ফিরতে হবে ভাবলেই ভয়ে বুক দুরু দুরু করছে।
স্থানীয় কোকাম গাছের গুল্ম দিয়ে ঘেরা বাড়িটা দূর থেকেই দৃশ্যমান হল এবারে। টিনের চালের ওপরে লতানো কুমড়োর গাছ। একটু বাড়ির কাছাকাছি আসতেই, লেজ নাড়তে নাড়তে একটি অ্যালসেশিয়ান জাতীয় কুকুর ছুটে এল আমাদের কাছে। শোঁকাশুঁকি করতে থাকল। ভালো করে কুকুরটার দিকে তাকিয়ে মনে হল, একটি প্রমাণাকায় নেকড়ে। কুকুর নয় মোটেই! দূর থেকে চট করে যদিও অ্যালসেশিয়ান বলেই ভুল হয়। অর্ণবকে বললাম— ‘ভালো করে খেয়াল করো, এটা একটা নেকড়ে, কুকুর নয় কিন্তু! তবে এই অঞ্চলে এদের পাওয়া যায় না। দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলমহলে এই ইন্ডিয়ান গ্রে উলফ দেখা যায়, এছাড়া সমগ্র ছোটনাগপুর মালভূমির জঙ্গলেই এদের দেখতে পাওয়া যায়। একমাত্র গাঁওবুড়ো নিজেই বলতে পারবেন এই শ্রেণীর নেকড়ে এখানে এসে পৌঁছল কেমন করে। এই নেকড়ে পোষাও নিষেধ, দেখা পেলে বনদফতরে খবর দেওয়ার কথা। যদিও অরুণাচলের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে বনদফতর কেবল নামেই বর্তমান। সবাই যে যেমন খুশি বন্দুক হাতে শিকার করে চলছে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। তবে ঠিক চোরা শিকার বলা চলে না, কারণ এই দেহাংশ বা চামড়া পাচার হয় না। শিকার মূলত খাওয়ার জন্যই করে থাকে এরা।’
গাঁওবুড়ো আপা মিসো মাটির বারান্দায় একটা বেতের চেয়ারে বসে ছিলেন। নেকড়েটা একদম অনুগত ভৃত্যের মতো তার চেয়ারের পাশে গিয়ে বসে পড়ল। ওঁর ছেলে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে। সেই সুবাদে শান্তিনিকেতনে ওঁর যাতায়াত আছে। বাংলা বুঝতে তো পারেনই, তার সাথে মোটামুটি কাজ চালানোর মতো বলতেও পারেন— দু’-একটি কথাতেই বুঝতে পারলাম।
আমি কৌতূহল চেপে না রেখে প্রাথমিক পরিচয়পর্ব সেরে জিজ্ঞেস করলাম— ‘এই নেকড়েটিকে এই অঞ্চলে কোথায় পেলেন?’
বৃদ্ধ উত্তরে ভাঙা ভাঙা বাংলায় যা বললেন, সে এক লম্বা ইতিহাস। বোলপুর অঞ্চলের বল্লভপুর বা সোনাঝুরিতে দু’-একটি এই শ্রেণীর নেকড়ে এখনও দেখা যায়।
ওঁর ছেলে বোলপুরের আদিবাসীদের হাত থেকে একটি নেকড়ে শাবক উদ্ধার করেছিল বছর সাতেক আগে। তখন সে সদ্য স্কুলের গন্ডি পার হয়ে বোলপুরের একটি কলেজে ক্লাস ইলেভেনে ভর্তি হয়েছিল। এখন সেই ছেলে মাস্টার ডিগ্রি-র ফাইনাল পরীক্ষা দেবে আর মাস দুয়েক পরে। সেই নেকড়ে শাবকটির সঙ্গে ছেলেটির একটু হলেও সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। তাই বোলপুরের স্থানীয় বনদপ্তরে, নিজের মায়া কাটিয়ে, শাবকটিকে জমা করে দিতে পারেনি সেই সময়। ট্রেনে করে লুকিয়ে শাবকটিকে নিয়ে এসে, বাবার কাছে নিশ্চিন্তে রেখে গিয়েছিল সে। সেই থেকেই নেকড়েটি ওঁর কাছেই আছে। খুব ভালো পোষ মেনে গেছে এখন।
আমি বললাম— ‘তার মানে একটা সময় আপনার উদ্ধার করা বাঘের ছানা আর নেকড়ের ছানা এক সাথে বড় হয়েছে এখানে? খুব মজার ব্যাপার তো…’
বৃদ্ধ আর কথা বাড়ালেন না, মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন মাত্র ..
আমি তাও বললাম— ‘নেকড়েটি তো বেশ সুন্দর স্বভাবের একটি ছেলে নেকড়ে, তাই না? আপনার একাকী সময় খুব ভালো কাটে নিশ্চয়ই এর সঙ্গে?’
বৃদ্ধ এবারে সেই কথায় না ঢুকে সরাসরি আমাদের বললেন— ‘আপনাদের তো পর্যটক বলে মনে হচ্ছে না! ভারতীয় প্রশাসনের লোক আপনারা?’
আমি একটু অপ্রস্তুত হলেও বললাম— ‘তা ঠিক নয়, তবে এই পিশাচ রহস্যের একটা সূত্র পেলে সবার মঙ্গল, এই ব্যাপারে কোনও সূত্র পেলে সবার ভালো হবে। এই ব্যাপারে একটু কাজ করতেই এখানে এসেছি।’
বৃদ্ধ এবার মৃদু হাসলেন— ‘বিধাতার অভিশাপ এই পিশাচ। আমিও চিন্তিত। দেখুন কী করতে পারেন…’
‘আপনার পালিত ওই বাঘটি ফিরে আসেনি তো? অনেক সময় দুই বাঘের লড়াই লাগলে, এক অঞ্চল ছেড়ে অন্য অঞ্চলে একটি বাঘ পাড়ি দিয়ে থাকে। আর সেক্ষেত্রে আপনার পালিত বাঘটির পুরোনো ডেরায় ফিরে আসার একটা ঝোঁক থাকতে পারে।’
‘না, সে ফিরে আসলেও নরখাদক হবে না বলেই আমার বিশ্বাস। আর বাঘের গায়েও এত শক্তি থাকে না, আপনি নিশ্চয়ই জানবেন।’
বৃদ্ধের কথায় যুক্তি আছে। মনে মনে ভাবলাম আমি। অপ্রাসঙ্গিক হলেও আমি আবার বোকা বোকা মুখ করে একটা প্রশ্ন করলাম— ‘ওটা বাঘই ছিল? মানে পুরুষ বাঘ…?’
বৃদ্ধ নির্লিপ্ত মুখে বললেন, ‘আপনার এই অনুমানটিও ভুল। সে বাঘিনী ছিল।’
একে এত বড় পায়ের থাবার ছাপ, তাও আবার বাঘিনী! মনে মনেই মাথা নীচু করে বিড় বিড় করলাম আমি। বাঘিনীর থাবার ছাপ, একটু হলেও সমবয়স্ক পুরুষ বাঘের থেকে ছোট হওয়ার কথা!
‘আপনি ভুল দিকে ভাবছেন’, বৃদ্ধ বললেন। ‘পিশাচের কথা আপনি বিশ্বাস করছেন না যখন… ঠিক আছে, যার যা বিশ্বাস…। কিন্তু আজ বিকেলের মধ্যে এই হুনলি ছেড়ে আপনাদের এই অবস্থায় চলে যাওয়াই শ্রেয়। না হলে আপনাদের সঙ্গেও কিছু অঘটন ঘটলে আমার খুব খারাপ লাগবে।’ বেশ চোয়াল শক্ত করে কথাগুলি বললেন আপা মিসো।
‘আপনার ভয় করে না এইরকম অবস্থায় এখানে খোলা বাড়িতে একা থাকতে?’
‘জঙ্গলের একটা নিয়ম আছে। অরণ্যের দেবতারও তাই। আমরা প্রকৃতির উপাসক। তাই পিশাচ আমাকে যদি আক্রমণ করে, তাহলে বুঝতে হবে আমি কোনও দোষ করেছিলাম, আমার এটাই প্রাপ্য ছিল। বহু বছর ধরে এই অরণ্য আমি দেখছি। কোনও জন্তু জানোয়ার আমার এতটুকু ক্ষতি করেনি আজ পর্যন্ত। বাকি আমার ভাগ্য আর কর্মফল।’
‘আপনি দেখেছেন সেই পিশাচ?’
এবার বৃদ্ধ বেশ বিরক্ত হলেন, ‘না দেখিনি তবে আন্দাজ করতে পারি, কীরকম দেখতে হতে পারে। যারা তাকে দেখে, প্রবাদ আছে তারা কেউ বেঁচে থাকে না! আর আমি বেঁচে আছি, আশা করি আমাকে সে দেখা দেবে না।’
গাঁওবুড়োর সাথে কথা বলে ফেরার সময় অর্ণব আর আজুকে বললাম— ‘আরেকবার ওই মৃতদেহর সামনে দু’ মিনিট দাঁড়াব। যদিও তাকানো দায়, তবু একবার ভালো করে দেখতে হবে। যদি পায়ের ছাপ ছাড়া আর অন্য কোনও সূত্র মেলে!’
এখন পুলিশ এসেছে, মৃতদেহ ঘিরে থাকা ভিড়ের পরিমাণ ভোরের থেকে বেশি। আমি তার মধ্যেই এগিয়ে গিয়ে মুণ্ডহীন ধড়টি আর একবার ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলাম। সাধারণ বস্তির ছেলে হলেও পরনে ছিল জলপাই রঙের সেনার পোশাক! আজুকে জিজ্ঞেস করতে বলল রবিবার করে একটা হাট বসে, ওখানে গ্রামের অনেকেই এই পোশাক কেনে। সেটা অবশ্য অস্বাভাবিক নয়। কারণ কলকাতার ফুটপাথ বা নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন, সব জায়গাতেই বেশ ঢেলে বিক্রি হয় এই জলপাই রঙা উর্দির পোশাক। আমি এবার এই জটলা থেকে সরে গিয়ে, জঙ্গলের আনাচে কানাচে একটু খোঁজাখুঁজি করতে থাকলাম, যদি কিছুতে চোখ চলে যায়। আধঘণ্টা পর্যবেক্ষণের পরে, একটা কেটে ফেলা গাছের মোটা গুঁড়ির দিকে চোখ পড়ল। কী যেন একটা ছাই রঙের তুলো জাতীয় বস্তু আটকে আছে না? কাছে গিয়ে হাতে নিতেই মনে হল কোনও জন্তুর লোম। নেকড়ে জাতীয় জন্তু ছাড়া এই রং বা লোমের ধরণ অন্য কোনও জন্তুর তো থাকার কথা নয়। লোমের নীচের দিকে একটা কেমন হালকা সোনালি রঙের আভা আছে। তাহলে কি সত্যি সত্যি পিশাচ? ইংরেজিতে যাকে বলে ওয়্যারউলফ? ওয়্যারউলফ বা পিশাচ সত্যিই ভয়াবহ, কিন্তু সে তো কল্পনার জগতে! মাথাটা কাজ করছিল না। কিছু সূত্র বিচ্ছিন্নভাবে মনের মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। আমি কিছুতেই ঠিক ক্রমপর্যায়ে সাজিয়ে উঠতে পারছি না। কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে বার বার। লোমের দলাটা পকেটে নিয়ে অর্ণবের সাথে হাঁটা লাগলাম আমাদের এখনকার সার্কিট হাউসের বাসস্থানের দিকে।
অসময়ের প্রাতরাশ সেরে ওঠার পরে অর্ণব বেশ কয়েকবার সাধাসাধি করল একটু এদিক-ওদিক ঘুরে আসার জন্য। আমার মনের মধ্যে একসাথে অনেকগুলো জিনিস খচ খচ করছিল বলে বললাম, ‘আজ ছেড়ে দাও। এত ঝামেলার মধ্যে আজু তো রান্নাবান্না করতে পারবে না। তার থেকে দুপুরে আবার ম্যাগি আর ব্যাগে রাখা ক্যাডবেরি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। বিকেলে না হয় একটু হেঁটে আসা যাবে।’
এত বড় অবিকল বাঘের মতো থাবার দাগ কোন জন্তুর হতে পারে? পিশাচ কেবল জলপাই রঙের উর্দিধারীদের বেছে বেছে আক্রমণ করে কেন? আমার সংগ্রহ করা লোম যদি সত্যি আমার অনুমান মতো ঘাতক জন্তুটির হয়, তাহলে এটা কী ধরণের জন্তু? যার লোম ধূসর নেকড়ের মতো, কিন্তু খুঁটিয়ে দেখলে লোমের গোড়ার দিকে সোনালী আভা কেন? কোনও শক্তিশালী মানুষ জন্তুর কৃত্রিম ছাল আর মুখোশ ব্যবহার করে এসব করছে না তো? কিন্তু লোমের নমুনাটা কৃত্রিম বলে মনেও হচ্ছে না। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে চা খেতে খেতে আমার মনে এবার একটা হালকা সোনালি রেখা ধরা দিল। তবে তার সাথে একটা ভীষণ ভয় লাগতেও শুরু করল আসন্ন ভয়ঙ্কর এক বিপদের কথা ভেবে। আজকের রাতটা কোনওরকমে কাটাতে হবে। আমার অনুমান নির্ভুল হলে, আগামিকাল সকালে এই রহস্যের হয়তো যবনিকা পতন হবে। তবে তার আগে আজকের দিনের ফাঁড়া কাটিয়ে উঠে আমাদের পৈতৃক প্রাণ টিকিয়ে রাখতে হবে তো!
আমি অর্ণবের চায়ের কাপের শেষ চুমুকটা দেওয়া অবধি বেশ শান্তভাবে অপেক্ষা করলাম। তারপর অর্ণবকে বললাম— ‘আমার মন বলছে আজকে রাত্তিরে মনে হয় পিশাচ আমাদের এখানে আসবে, সন্ধের পরে, কোনওভাবেই ঘরের বাইরে বের হওয়া চলবে না। লনে বসা তো দূরস্থান, বারান্দাতেও আসা যাবে না দরজা খুলে। কারণ বারান্দায় কোনও গ্রিল নেই। উন্মুক্ত বারান্দার পরেই লনের ঘাসজমি, তার পরেই বিশাল পাহাড়ের নীচের খাদ।’
অর্ণব সেনাবাহিনীর পদস্থ মানুষ। ভয় সে পায়নি, তবে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কিছু সূত্র পেলে নাকি অর্ক?’
আমি বললাম, ‘মনে হচ্ছে অনুমান করতে পেরেছি, তবে আজকের ভয়ংকর পূর্ণিমার রাত্রিটা কাটাতে হবে আগে। তুমি না হয় তোমার বিশ্বস্ত তিন-চারজন পুলিশের আধিকারিককে, কাল সকাল সকাল এখানে চলে আসতে বলো।’
‘তাহলে খাওয়া-দাওয়া কী করে করবে? আজু তো আর সন্ধের পরে আসবে না বলে দিয়েছে। রান্না ঘর বা খাওয়ার ঘরে যেতে গেলে তো সেই বারান্দা দিয়েই যেতে হবে।’
‘সেই ঝুঁকি নেওয়া যাবে না অর্ণব। বন্দুক রেডি করে ঘরের দরজায় খিল মেরে বসে থাকতে হবে। চল এখন তাড়াতাড়ি বরং ভাত, ডাল, আলু— যা রান্নাঘরে মজুত আছে, এইসব দিয়ে একটু খিচুড়ি রান্না করে, হাঁড়ি থালা সব নিয়ে আমরা একটা ঘরেই ঢুকে পড়ি। আমি বরং আমার জিনিসপত্র আজকে তোমার ঘরে নিয়ে রাখছি।’
ঘরগুলো এমনিতেই বেশ বড়। এক-একটা ঘরে তিনটে করে ছোট খাট রয়েছে। সোফাও রয়েছে একটা ঘরে। দু’জন কেন, এক-একটা ঘরে তিন-চারজন সুন্দর ভাবে থাকা যায়। আর রাতের এই ঠান্ডায় দরজা জানলা বন্ধ করে দু’জন মিলে শুয়ে-বসে থাকতে কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।
খিচুড়ি রান্না শেষে, থালা-বাসন ও যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আমরা যখন অর্ণবের ঘরটায় বসলাম, তখন সূর্য সবে পাহাড়ের এক কোণে ঢলে পড়েছে। পূর্ণিমার চাঁদ উঁকি দিয়েছে অন্য এক পাহাড়ের মাথায়। তবে বিকেলের আলো এখনও পুরোপুরি ফুরিয়ে যায়নি। আমাদের বড় বন্দুক দুটো, আমার কথা মতো, ঘরের ভেতরের দেয়ালে হেলান দিয়ে সাজিয়ে রেখে দিয়েছে অর্ণব। শেষবারের মতো বাইরের এই উদার প্রকৃতি, খোলা লম্বা টানা বারান্দা দিয়ে দেখে, আমরা ঘরে প্রবেশ করলাম। সব জানলা দরজা ভালো করে আটকানো আছে কিনা, দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করলাম দুজনে মিলে। তারপর নিশ্চিন্তে বসে আমরা গল্প করতে থাকলাম। অর্ণব আমার সাথে আগে কাজ করেছে বলে জানে, রহস্য নিয়ে এখন খোঁচাখুঁচি জারি রেখে, জোর করে কিছু জানার চেষ্টা না করাই একরকমের ভদ্রতা। রাত ন’টার পরে হুনলিতে বৈদ্যুতিক আলো থাকে না। এটাই এখানকার নিয়ম, তবে সেই জন্য সব ঘরে বেশ কিছু মোমবাতি মজুত আছে। আর আমাদের নিজেদের শক্তিশালী টর্চলাইট তো সঙ্গেই আছে।
অন্ধকার নিঝুম এই পাহাড়ি শীতের সন্ধ্যায় গল্প করতে করতে বেশ খিদে পেয়ে গেল আমাদের। খিচুড়ি খেয়ে আমরা যখন তাস নিয়ে বসেছি, ঘড়ির কাঁটা রাত দশটা ছুঁই-ছুঁই করছে। রাত দশটা মানে পাহাড়ে অনেক রাত। বিদ্যুতের আলো সেই রাত ন’টাতেই নিভে গেছে। ঘরে মোমবাতি জ্বলছে। শোয়ার আগে জানলার পর্দা সরিয়ে একটু বাইরের দিকে চোখ রাখলাম। চাঁদের আলোতে সামনের পাহাড় গুলো বরফ মাথায় নিয়ে বেশ সুন্দর জেগে উঠেছে। হালকা এক চিলতে পর্দাটা ফাঁক করে রেখে, কম্বল টেনে শুয়ে পড়লাম এবারে। মাথার কাছে শোয়ানো রয়েছে আমার রাইফেল, টর্চ আর মোমবাতি জ্বালানোর দেশলাই। পাশের খাটে অর্ণবের মাথার কাছেও এই অতি প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি সযত্নে সাজিয়ে রাখা আছে। অর্ণব শুয়ে শুয়েই এবার বেশ মজার ছলেই বলল— ‘অর্ক তোমার পিশাচের তো দেখা নেই। মনে হয় আমরা যমেরও অরুচি।’
বন্ধ কাঁচের জানলার পর্দার সামান্য ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো আমাদের ঘরের মেঝেতে যেন একটা লক্ষ্মণরেখা টেনে রেখেছে। জানলার পাল্লাগুলো অবশ্য ঘরের দরজার মতো শক্তপোক্ত নয়। নিতান্তই পলকা। তবে কিছুটা নিশ্চিন্ত যে, জানলায় অন্তত লোহার গ্রিলটা রয়েছে।
কখন চোখে ঘুম নেমে এসেছিল খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙল একটা পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হওয়া হাড় হিম করা নেকড়ের চিৎকারে। পূর্ণিমার রাতে নাকি এই ওয়্যারউলফরা জেগে ওঠে। জঙ্গলের মধ্যে কোনও উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে চাঁদের দিকে মুখ করে ঠিক এইরকম পৈশাচিক ভাবে ডেকে ওঠে মাঝরাতে। হাতঘড়িতে দেখলাম রাত বারোটাই বাজে। হয়তো বা বারোটার সময় এইরকম ডাক শোনা কাকতালীয়, অথবা পুরোটাই আমার অবচেতন মনের ভুল। ধীরে সন্তর্পনে বিছানা থেকে নেমে অর্ণবকে ডাকলাম। সামান্য ঠেলা দিতেই জেগে গেল অর্ণব। আবার শুনলাম সেই ডাক, এবার আর পাহাড়ের প্রতিধ্বনি নয়, যেন খুব কাছ থেকে শুনতে পেলাম সেই ভয়াবহ নেকড়ের চিৎকার। সাধারণ নেকড়ের ডাকের থেকে অনেক তীক্ষ্ণ, জোরালো, গম্ভীর আর অবশ্যই হিংস্র।
অর্ণব আর আমি এক হাতে বন্দুক আর অন্য হাতে টর্চ নিয়ে জানলার পর্দার ওই ফাঁক দিয়ে বাইরে চোখ রাখলাম। অর্ণবকে ইশারায় বললাম যে গুলি বা টর্চের আলো কোনওটাই আমি ইঙ্গিত না করলে যেন ব্যবহার না করে। পর্দার ওই ফাঁকটা দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদের আলোতে বাইরে চোখ রেখে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। আমি এটা অনুমান করেছিলাম আগেই। কিন্তু সামনে থেকে পিশাচ দেখা আর অনুমান করা তো এক জিনিস নয়! এই ঠান্ডাতেও আমার পিঠ বেয়ে ঘাম ঝরছে এখন। অর্ণবের চোখ বিস্ফারিত, যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। সামনের লনে একটা ছোট নেকড়ে। গাঁওবুড়োর পোষা নেকড়েটাকে দেখে চিনতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে সাক্ষাৎ শয়তানের রূপ পিশাচ! লাল একজোড়া হিংস্র ভয়ানক চোখের দৃষ্টি। সমগ্র ভয়াবহ অবয়বটা অনেকটা যেন নেকড়ে এবং বাঘের সংমিশ্রণ। গায়ের লোমের রং আর মাথাটা হিংস্র নেকড়ের মতো, তবে বাঘ বা নেকড়ের থেকে আয়তনে অনেক বড়। আর লেজ বা পায়ের আকৃতি বাঘের মতো। একটা পূর্ণবয়স্ক বাঘের থেকে আয়তনে প্রায় আড়াইগুণ বড় তো বটেই! মুখের দুই পাশের তীক্ষ্ণ দাঁতের ফলা এই চাঁদের আলোতে চক-চক করছে। সাধারণত বাঘ বা নেকড়ের দাঁত, বন্ধ মুখের পাশ দিয়ে এই রকম ভয়াবহভাবে বের হয়ে থাকে না। কিন্তু পিশাচটির দাঁত লম্বায় বড়, তাই সেই ঘাতক দাঁতের ফলা বের হয়ে আছে মুখের দুই পাশ দিয়ে!
এই হিংস্র মুখ যে মানুষ সামনে থেকে দেখবে তার আক্রমণের আগেই মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রবল। আমাদের ঘরের ভেতর থেকে দেখেই যেন, নিজেদের হৃৎপিণ্ডগুলো গলার কাছে এসে ঠেকেছে! অর্ণব জানলার কাচের ভেতর থেকে তাক করে, বন্দুকের ট্রিগার-এ হাত দিতে যাচ্ছিল। আমি ইশারায় না করলাম। ছোট পোষা নেকড়েটা ধীরে ধীরে আমাদের ঘরের দরজার সামনে এসে শোঁকাশুঁকি করল। তারপর সেই পিশাচ একটা বড় লাফ দিয়ে আমাদের ঘরের বারান্দায় উঠে এসে বেশ জোরে দরজায় গুঁতো মারল কয়েকবার। আমি ভয়ে চোখ বুজে ফেললাম। অর্ণব দরজার দিকে বন্দুক তাক করে বসে রইল গুঁড়ি মেরে। সামান্য প্রকৃতস্থ হয়ে আমিও একই ভাবে পজিশন নিলাম অর্ণবের পাশে। দু’-তিনবার দরজা ঠেলাঠেলি হওয়ার পরে আবার শান্ত হয়ে গেল চারপাশ। একটা তীব্র বোঁটকা বাঘের গায়ের মতো গন্ধ নাকে আসছে এখন, সঙ্গে পিশাচের গরম নিঃশ্বাসের ফোঁস ফোঁস শব্দ। ঠিক এই গন্ধটা আমার কেমন যেন চেনা চেনা লাগল। গাঁওবুড়োর বাড়িতে হালকা হলেও এই গন্ধটা নাকে এসেছিল! আমার অনুমান তার মানে সঠিক।
মিনিট পাঁচেকের পিন পড়া নিস্তব্ধতার পরে আমি ধীরে উঠে গিয়ে আবার জানলার ফাঁক দিয়ে চোখ রাখলাম। পোষা নেকড়ের সাথে চাঁদের আলোতে বৃহৎ পিশাচটা ছোট বাচ্চার মতো লনে খেলে বেড়াচ্ছে! তারপর এই খেলতে খেলতেই হঠাৎ করে দৌড়ে পাহাড়ের খাদে বিলীন হয়ে গেল দু’জনে। চাঁদের আলোটা এই প্রথমবার কম মনে হল। জন্তু দুটো নিমেষে দৃষ্টির অগোচরে চলে গেল। খাদের নীচ থেকে কেবল শেষবারের মতো ভেসে এল, গায়ের রোম খাড়া করে দেওয়া সেই ভয়াবহ নেকড়ের ডাক। আমরা দুজন ঠায় বসে রইলাম এক ভাবে। ভয়ে যেন নড়াচড়ার শেষ শক্তিটুকুও কেউ যেন নিংড়ে শুষে নিয়েছে শরীর থেকে।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কতক্ষণ এভাবে দু’জনে বসে ছিলাম ঠিক মনে নেই। আশপাশ থেকে ছোট ছোট পাখির ডাক কানে প্রবেশ করার পরে, যেন একটা দুঃস্বপ্ন শেষে সদ্য জেগে উঠলাম বোধ হলো। ভোর হচ্ছে তার মানে। ধড়ে যেন কিছুটা প্রাণ এল। বেশ কিছুটা জল খেয়ে জ্যাকেটটা গায়ে গলিয়ে নিলাম এইবারে। ঠান্ডা বোধটাই ছিল না এতক্ষণ! একটু একটু করে ভোরের সোনালি আভা ফুটে উঠল হুনলির বরফাবৃত পাহাড়চুড়োগুলোতে। আপাতত আর ভয় নেই। অর্ণবকে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে বললাম। গাঁওবুড়োকে গ্রেফতার করতে যেতে হবে। তারপর উনি নিজেই বলবেন পিশাচের রহস্য। আমার যদিও বুঝতে কিছু বাকি নেই।
অর্ণবের আগের দিন সন্ধের নির্দেশ মতো, পনেরোজন সেনার একটা দল, ওদের সেনার ট্রাকে করে এসে পড়বে যে কোনও সময়। ওদের নিয়েই আমরা গাঁওবুড়ো আপা মিসো-র বাড়ি যাব। অর্ণবের মনে অনেক প্রশ্ন, তবুও ভদ্রতার খাতিরে আমি না বলা পর্যন্ত কিছু জোর করে জানার অদম্য আগ্রহটা কোনওরকমে চেপে রেখেছে।
দূর থেকে সেনাবাহিনির গাড়ির শব্দ পেলাম। বারান্দায় বসেই দেখতে পেলাম, আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে নীচের খাদ বেয়ে ওপর দিকে উঠে আসছে আমাদের ভারতীয় সেনাবাহিনির একটা ট্রাক। জুতো গলিয়ে এবার যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম আমরা।
কিছুটা রাস্তা যাওয়ার পরে, বাকি রাস্তা পায়ে হেঁটে যেতে হবে। আমি নির্দেশ দিলাম গাঁওবুড়োর বাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলতে হবে। বেচাল দেখলে বা পিশাচ বের হয়ে এলেই তৎক্ষণাৎ যেন গুলি করা হয়, অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই। নতুন করে আর কারওর প্রাণের বিন্দুমাত্র ঝুঁকিও নেওয়া চলবে না। সবাই হাঁটু মুড়ে বসে, বন্দুকের নিশানা স্থির করে, বাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলা হল। আমি বেশ ধীর গতিতে, রাইফেল সামনের দিকে তাকে করে, ঐ বাড়িটার দিকে খুব সন্তর্পনে পা বাড়ালাম। আমার সামান্য কোনও বিপদ দেখলে, গুলি চালাতে শুরু করবে সেনাবাহিনী। সেই রকমই নির্দেশ দেওয়া আছে। বাড়ির বেড়ার গেটের এতটা কাছে আসার পরেও পোষা নেকড়েটা গায়ের গন্ধ পেয়েও আজ এল না তো? চারিদিক কেমন যেন অতিরিক্ত নিস্তব্ধ এই মুহূর্তে। নাকি এই নিস্তব্ধতা কোনও ঝড়ের পূর্বাভাস? আমি এবার গাছের ডালের বেড়ার গেট খুলে বাড়ির চাতালটায় চোখ রাখলাম। যে দৃশ্য চোখে পড়ল, তার বিন্দুমাত্র অনুমান আমি আগে করতে পারিনি। আপা মিসো নিজেই নিজেকে গুলি করেছে! মাথার খুলি ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে চাতালে। এই কাজ করার আগে সে ওই পিশাচটাকেও গুলি করে মেরে ফেলেছে। অত বড় প্রাণীটার নিথর দেহ পড়ে রয়েছে চাতালের এক কোনে। আর পোষা নেকড়েটা উদ্ভ্রান্তের মতো একবার তার মনিব আর তার স্নেহের পিশাচকে শুকে শুকে দেখে আসছে বার বার। যদি কোনওভাবে জেগে ওঠে একটিবারের জন্য? আমি ইশারায় হাত নেড়ে অর্ণবদের আসতে বললাম এবারে। আর কোনও ভয় নেই। অর্ণবকে দেখে মনে হলো, এখনও আমি কিছুই না বললে আমাকেই মনে হয় গুলি করে দেবে এর পরে। অর্ণবকে আর অপেক্ষা না করিয়ে, এবারে ওর কৌতুহল নিবারণের জন্য বলতে শুরু করলাম:
‘যে ভয়াবহ পিশাচটাকে নিথর অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখছ এখন, এটি আসলে কোনও পিশাচ ছিল না। কেবল পিশাচের মতো দেখতে। তুমি তো জানো— পিশাচ বা ওয়্যারউলফ বলে আসলে কিছু হয় না। আর এই যে পোষা নেকড়েটা দেখছো, সে আসলে হল এই মৃত পিশাচরূপী জন্তুটির পিতা। পিশাচের মা ছিল সেই পালিত বাঘিনী। অর্থাৎ গাঁওবুড়ো একটা অসাধ্য সাধন করেছিলেন। নেকড়ে আর বাঘকে প্রজনন করাতে সক্ষম হয়েছিলেন! যেটা বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আজ অবধি সম্ভব হয়নি পৃথিবীতে। কিন্তু অরুণাচল, আর এই অঞ্চলের ভেষজ ওষুধপত্র সবই রহস্যে ঘেরা। তেমনভাবে উন্মুক্ত নয় বিশ্বের দরবারে। তাই সেই রহস্যময় পদ্ধতি বা আবিষ্কার, একমাত্র আপা মিসো বেঁচে থাকলেই বলতে পারতেন হয়তো।
‘বাঘ আর সিংহের ক্রস-ব্রিড করে লাইগার অথবা টাইগন তৈরি করার কথা তো আমরা সবাই জানি। সেই টাইগন অথবা লাইগার কিন্তু আকারে বাঘ বা সিংহের থেকে অনেকটা বড়। এক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটেছে। এই নতুন প্রাণীটির মুখ নেকড়ের মতো হলেও লেজ বা শরীরের বেশির ভাগ গঠন বাঘের মতো। আমার ধারণা এই পিশাচের বয়স বছর চারেক হবে। আপা মিসো আক্ষরিক অর্থে প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য পরিবেশ বা প্রকৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি। কিন্তু সেটা ঠেকাতে তিনি যে ফন্দি করেছিলেন সেই পথ ঠিক ছিল না। এই পিশাচটিকে তিনি তালিম দিতে শুরু করেন রাতের বেলা করে। দিনের বেলা একে মানুষের থেকে লুকিয়ে রাখতেন কোনও গোপন কক্ষে। প্রাণীটিকে কেবল সবজে রঙের পোশাক চেনানো শেখানো হয়। আর রাতের দিকে পিশাচের খাবার বন্ধ করে, কেবল সবজে পোশাকের লোককে আক্রমণ করে ভক্ষণ করার দিকে জোর করে ঠেলে দেওয়া হয়। একমাত্র সবুজ উর্দিধারী মানব শিকার না জুটলে, তবেই হয়তো ভোরের দিকে আবার মনিবের কাছে এসে খাবার জুটত। আর এই ধরণের সংকর প্রজননের ফলে সৃষ্ট প্রজাতির প্রাণীদের অসুবিধে হল, এদের শরীরের আয়তন এবং সেই অনুপাতে খাদ্যের চাহিদা অনেক বেশি। খাবার না পেলে ভীষণ রকমের হিংস্র হয়ে ওঠে। গাঁওবুড়ো কিন্তু আন্দাজ করে ফেলেছিলেন, আমি পিশাচের ব্যাপারে ঠিক কি অনুমান করছি। কৌতূহলবশত আমি কালকে জিজ্ঞেস করেছিলাম পালিত বাঘটি স্ত্রী না পুরুষ ছিল। ওঁর উদ্দেশ্য ছিল এই ব্যাপারটা পৃথিবীর কাছে গোপন রাখার। ব্যাপারটা রহস্যই রাখতে হলে, আমাদের রাতের মধ্যেই সরিয়ে ফেলতে হবে এই ইহজগৎ থেকে— এটাই ওঁর মনে হয়েছিল। কিন্তু মুশকিল হল আমাদের তো জলপাই সবুজ পোশাক পরে রাতে বসে থাকার কথা নয়! তাই পোষা এই নেকড়েটাকেও পাঠানো হয়েছিল, শুঁকে শুঁকে গতকাল রাতের পিশাচের খাবার চিহ্নিত করার জন্য! ছোট এই নেকড়ে দরজা দেখিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু দু’-তিনবার ঠেলা ঠেলি করে দরজা না খোলায় ভয়ংকর এই পিশাচ রণে ভঙ্গ দেয়। এই সার্কিট হাউসটার সেইভাবে সামগ্রিক ভাবে তেমন দেখভাল না হলেও, সৌভাগ্যবশত ঘরের দরজাগুলো খুব ভালো এবং শক্তপোক্ত জাতের কাঠ দিয়ে বানানো হয়েছিল একসময়। সেটাই এ যাত্রা আমাদের প্রাণে বাঁচিয়ে দেয়। এটা কিন্তু আবার কিছুটা মাংসাশী প্রাণীদের স্বভাবগত বৈশিষ্টও বটে। কোনওদিন তুমি শুনবে না, দরজা ভেঙে ঢুকে বাঘ বা নেকড়ে জলজ্যান্ত মানুষ ধরে খেয়েছে। যাওয়ার আগে বরং সে জোৎস্নার আলোতে তার বাবার সাথে বেশ সুন্দর খেলায় মেতে উঠেছিল, আমাদের ওই সার্কিট হাউসের লনে। তবে ওয়্যারউলফ-এর সিনেমার অস্তিত্ব ধরলে, তারা নির্ঘাত দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়ত— সে শুধু কেবল মানুষের অলীক কল্পনায় সম্ভব, বাস্তবে নয়।
‘এদিকে আপা মিসো বুঝে গিয়েছিলেন আজ রাতের পরে তার খেলা শেষ। তার ওপরে শেষ মৃত্যুটা আপা মিসোকে বেশ দুঃখ দিয়েছিলো। তিনি সবুজ পোশাকের এই পরিণতি আশা করেননি। আজুর আত্মীয়র মৃত্যুটা আত্মঘাতী হয়ে গিয়েছিল। আপা মিসোর লক্ষ্য ছিল প্রশাসনে ভয় ধরিয়ে এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বিরত করা। কিন্তু তার এই পোষ্যকে সে চিনিয়েছিল কেবল প্রশাসনের পোশাক! কেবলমাত্র পোশাকের ভুলে এই পরিণতি তাঁর চিন্তাভাবনার ভিতটাই নড়িয়ে দিয়েছিল। রহস্যটা জানাজানি হলে গ্রামবাসীদের কাছে মুখ লোকানোর আর জায়গা ছিল না তাঁর। তিনি নিজেকে এবং তার প্রিয় পোষ্যকে, ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ধর-পাকড় পরবর্তী যন্ত্রণার মাঝে ফেলতে চাননি এরপরে। প্রথমে চার বছর বয়সের, নিজের সৃষ্টি করা পোষ্যটিকে গুলি করে মেরে, নিজেই নিজেকে গুলি করে শেষ করে ফেললেন! কিন্তু রেখে গেলেন এই নেকড়েটিকে। বেচারা একা হয়ে পড়া বোলপুরের নেকড়েটিকে, এবারে কোনও ভালো জায়গায় রেখে আসতে হবে দায়িত্ব নিয়ে, যেখানে একটু যত্ন-আত্তি পাবে। মনিব এবং সর্বোপরি পুত্রহারা হওয়ার দুঃখ সে হয়তো প্রকাশ করতে পারছে না, কিন্তু মনে মনে নেকড়েটি নিশ্চয়ই এখন নিজেকে বেশ অসহায় ভাবছে।’
এবার ধীরে ধীরে হাঁটা লাগলাম আমি আর অর্ণব। বাকি আনুষ্ঠানিক প্রশাসনিক কাজকর্ম পুলিশ এসে করবে। আমাদের দায়িত্ব নেই তেমন।
‘আজকে আনিনি চলে গেলে হয় না অর্ণব? আমাদের তো প্রায় তিন দিন সময় বেঁচে গেল…’
‘মন্দ বলোনি অর্ক, অসম্ভব সুন্দর আনিনি আর তার আশপাশ, ধ্বসপ্রবণ আট ঘন্টার রাস্তাটাই যা ভয়াবহ, এক কথায় ভয়ংকর সুন্দর,’ বলে একগাল হাসল অর্ণব।
অনেক দূরের আনিনির ঝাপসা পাহাড়গুলোর দিকে তাকালাম একবার। ওই দিকটা অনেক বেশি ঠান্ডা হবে। এর পরে সেই অসীম দিবাং অরণ্য। বাঘিনী কিন্তু জানে না তার সন্তানের মৃত্যুর কথা। না-ই বা জানল, সন্তানের মৃত্যু সবসময় বেদনাদায়ক।
মনটা একটু ভারি হয়ে গেল। আপা মিসো কিন্তু এই অসামান্য প্রকৃতি রক্ষাই করতে চেয়েছিলেন। তাঁর পথ ভুল ছিল। আমার অনুমান অর্ণবও ঠিক এইরকমটাই ভাবছে এখন..
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
Khub bhalo hoyechei..chaliye jao Bondhu..
osadharon lekha..Kakababu ar budhhodeb guhoke mone korai..
টান টান লেখা, কি অসাধারন প্রকৃতির বর্ণনা!!
What a thriller. Although the description of nature “dominates”.