short-story-incompatible

ইনকম্প্যাটিব্‌ল
নলিনাক্ষ ভট্টাচার্য


হরিদ্বার ছাড়িয়ে হৃষিকেশ যাবার পথে রাস্তার পাশে একটা বড় ধাবা দেখে বনানী বলল, “ওখানে এক কাপ চা খেয়ে নিলে মন্দ হয়না।”

দেবল গাড়ির গতি না কমিয়ে, নাক কুঁচকে বলল, “ইট্‌স সো ডার্টি। আর দশ কিলোমিটার ড্রাইভ করেতো আমরা হোটেলে পোঁছে যাব, ওখানেই চা খাব আমরা।”

বনানী একটু ক্ষুন্ন হল কিন্তু গাড়ি থামাবার জন্য দেবলকে কোন চাপ দিলনা। দেবল-তো জানে বনানীর চায়ের নেশা আছে, অফিসে কাজের ফাঁকে প্রতি দু’ঘণ্টায় ওর এক মাগ লিকার চা চাই। চা না পেলে ওর নাকি মাথায় ভাল আইডিয়া আসেনা আর কপিরাইটারের কাজে আইডিয়া না এলে চলবে কি করে? আগে চায়ের পরে অফিসের বাইরে গিয়ে ও একটা বড় গোল্ডফ্লেক সিগারেট ধরাত কিন্তু দেবল সিগারেটের গন্ধ একদম সহ্য করতে পারেনা, তাই বিয়ের পরে বদ অভ্যাসটা ও অনেক কষ্টে ছেড়ে দিয়েছে। প্রথমদিকে ও নিকোটিন প্যাচ নিত, এখন চুয়িংগাম চিবোয়। শুধু অফিসের উইক এন্ড পার্টিতে ওয়াইন বা জিন খেতে খেতে সহকর্মিদের অনুরোধে কখনো সখনো ওদের হাত থেকে সিগারেট নিয়ে একটা দুটো টান দিয়ে নেয় ও।

দেবল চল্লিশ কিমি স্পিডে ওর নতুন কেনা মেরুন রঙের হন্ডা সিটি চালাতে চালাতে আড়চোখে দেখল বনানীর ব্যাজার মুখ, তারপর মুচকি হেসে বলল, “চা এর পরে সিগারেট ধরাবার ধান্দা করছিলে তুমি তাই না?”

“একদম নয়। খোঁজ নিয়ে দেখতে পার, অফিসেও খাইনা আমি।”

দেবল বলল, “তোমাদের অফিসে ঢুকতে ইচ্ছে করেনা আমার। স্পেস কম আর গিজ গিজ করছে সব লোক। তা প্রমোশনের পর তোমাকে একটু বড় কিউবিক্‌ল দেবে বলেছিলে তার কী হল?”

“সময় হলেই পাব বড় কিউবিক্‌ল।”

দেবল স্টিয়ারিং-এ হাত রেখেই একটু শ্রাগ করল, কিছু বললনা।

গত মাসের মাঝামাঝি সিনিয়র কপিরাইটার হিসেবে পদোন্নতি হবার খবরটা বনানী ফোনে দেবলকে জানালে ও “কনগ্র্যাটস, বেবি,” বলেছিল কিন্তু অফিস থেকে ফেরার পথে দিল্লির নামি বাঙালি মিস্টির দোকান ‘অন্নপূর্ণা’ থেকে ক্ষীরকদম্ব নিয়ে ওদের দ্বারকার ফ্ল্যাটে ঢুকে চা করে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে একটা প্লেটে চারটে মিস্টি সাজিয়ে ওর সামনে ধরলে দেবল চামচ দিয়ে ছোট্ট এক টুকরো কেটে নিয়ে মুখে পুরে বলেছিল, “থ্যাংক ইউ, বনি।” দেবল ক্ষীরকদম্ব ভালোবাসে জেনেই ওই মিস্টিটা এনেছিল বনানী কিন্তু অনেক অনুরোধের পরেও ও অঙ্গভঙ্গি করে জানাল ওর গা গুলোচ্ছে, আর খাবেনা। বনানীর কেন জানি মনে হয়েছিল ওর উন্নতিতে দেবল খুব একটা খুশি হয়নি। সাত বছরে তিনটে চাকরি পালটে ইন্ডিয়ান টিভি নিউজ চ্যানেলে গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে যোগ দিয়ে দেবল তিন বছরের মাথায় এখনো কোন লিফট পেলনা সেটাই কি তবে বনানীর প্রমোশনে ওর খুশি না হবার কারণ? সত্যি বলতে কী উইক এন্ডে ঋষিকেশ আসার এই প্ল্যানটা বনানীরই; অফিসের কর্ম ব্যস্ততার বাইরে নিরিবিলিতে গিয়ে দেবলের মনে যে ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স উঁকি মেরেছে সেটাকে দেহমন দিয়ে মিটিয়ে দিতে চায় বনানী।




‘দেবভূমি’ নামের হোটেলটা গঙ্গার পাড়েই। জানলা দিয়ে নীচে তাকালে খরস্রোতা গঙ্গা দেখা যায়। হোটেলের নিজস্ব ঘাট আছে যেখানে সকালে সন্ধ্যায় আরতি হয়, গঙ্গা স্নানেরও সুব্যবস্থা আছে। এসব দেখেইতো বনানী ফোর স্টার দেবভূমিতে কামরা নিয়েছিল। হোটেলে মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে নিয়ে দিল্লি থেকে দুশো ত্রিশ কিমি ড্রাইভ করে আসা পরিশ্রান্ত দেবল বিছানায় গা এলিয়ে দিল। বনানী ওর মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে লাগল কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই ওর চোখ ঘুমে জড়িয়ে এল। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে রুম সার্ভিসে ফোন করে ঘরে চা আনাল বনানী। ব্যালকনিতে বসে গঙ্গার কলধ্বনি শুনতে শুনতে চা খাচ্ছিল ওরা। বনানী বলল, “আজ সন্ধেয় হোটেলের ঘাটেই আরতি দেখব আমরা, কাল বরঞ্চ বড় আরতি দেখতে ত্রিবেণী ঘাটে চলে যাব।”

দেবল গঙ্গার ওপারে ঘন জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে একটা বড় হাই তুলে তুড়ি মেরে বলল, “আমার ধম্মে টম্মে তেমন মন লাগেনা, বনি। আর তা ছাড়া আমাকে একটু ল্যাপটপ খুলে বসতে হবে সন্ধ্যার দিকে, হরিদ্বার পৌঁছবার আগেই হোয়াটসএ্যাপে মেসেজ এসে গিয়েছিল অফিস থেকে।”

“আধ ঘন্টার জন্য আরতি দেখলে তোমার কাজে কোন ক্ষতি হবেনা, দেবু। প্লি-জ চলনা।”

বনানী ওর হাতটা মুঠোর মধ্যে নিয়ে একটু চাপ দিল। মৃদু হেসে দেবল মাথা নাড়ল, বনানী খুশি হয়ে ওর গালে একটা চুমু খেল। একটু পরে স্ট্রলি ব্যাগ থেকে নিজের জন্য একটা লাল পাড় খয়েরি সুতির শাড়ি বের করল বনানী আর দেবলের জন্য বের করল বেগনে রঙের পাঞ্জাবি আর পাজামা। দেবলের ইচ্ছে ছিল কার্গো শর্টস আর বুকের উপর ‘গোয়িং বংকার্স’ লেখা হাতকাটা গেঞ্জি পরে আরতি দেখার কিন্তু বনানীর জোড়াজুড়িতে ও রাজি হয়ে গেল পাজামা-পাঞ্জাবি পরে শ্রদ্ধালু দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে। ঘাটে গিয়ে ওরা দেখল ওদের মত হোটেলে যাঁরা উঠেছেন তাঁরা সব হাজির হয়ে গেছেন। ওর মধ্যে কলকাতা থেকে আসা অল্প বয়সি বঙালি কাপ্‌ল ছিল দুটো যাদের সঙ্গে বনানী আরতি দেখার ফাঁকেই আলাপ জুড়ে দিল। কিন্তু দেবলের চোখে সেই ভ্যাকান্ট লুকটা রয়েই গেল, যাদবপুরের সৌম্য বর্ধন আর বর্ধমানের মহিম সান্যাল ওর সঙ্গে আলাপ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে গঙ্গার ঘাটে তিনজন বিশালবপু পুরুতের গঙ্গারতি দেখতে মনোযোগী হয়ে পড়ল। আরতি শেষ হলে বনানী, সৌম্য আর মহিমের বউ কেতকী আর মৃদুলার সঙ্গে, ঘাটে নেমে নিজ নিজ স্বামী এবং অন্যান্য আত্মীয় পরিজনদের কল্যাণ কামনায় গঙ্গায় প্রদীপ ভাসিয়ে এল। ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠবার সময় মৃদুলা বনানীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “তোমার বর দেখছি খুব গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ, আমার বর চেষ্টা করেও কথা বলাতে পারলনা।” বনানী বলল, “না ভাই, আসলে অফিসের কাজ নিয়ে খুব টেনসনে আছে বেচারা। এইতো এক্ষুণি গিয়ে ল্যাপটপ খুলে বসবে ও।”

“ও মা তাই? কী কান্ড দেখ, তীর্থস্থানে এসেও . . .”

কামরায় ফিরে গিয়ে দেয়ালের কাছে ছোট টেবিলটায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে গেল দেবল। সোফায় বসে ফেমিনার পাতা ওল্টাতে লাগল বনানী। দেবল নিশ্চয়ই ফোটোশপ বা এ্যাডোবে ইনডিজাইন খুলে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। এত কাজ করার পরেও কেন ওর প্রোমোশন হচ্ছেনা, মাইনে বাড়ছেনা বুঝতে পারেনা বনানী। একটু পরে ওয়াশ রুম থেকে ফিরে আসার পথে ও একটা বড় ধাক্কা খেল যখন ওর নজর পড়ল ল্যাপটপের স্ক্রিনের উপর। কী আশচর্য! দেবল ‘ডেভিলস ক্যারেজ’ গেম খেলছে ল্যাপটপে অডিও বন্ধ করে! ও একবার ভাবল চিৎকার করে ওঠে দেবলের এই প্রতারণায়, কিন্তু ও নিজেকে সামলে নিল। দু’দিনের জন্য বেড়াতে এসে ঝগড়া ঝাঁটি করে কি লাভ?

রাত্রে দেবভূমির দোতলায় ‘সীতা কা রসোইতে’ সবার সঙ্গে বুফেতে জয়েন করতে রাজি হলনা দেবল, বলল, “তুমি তোমার নতুন বান্ধবীদের সঙ্গে গিয়ে বুফেতে খেয়ে নাও। আই উইল অর্ডার আ দোসা।” বনানী কোন জোরাজুরি করলনা ওর সঙ্গে, কারণ ওর ভয় হল দেবল এখন যে ডিপ্রেসিং মুডে আছে তাতে ওকে টানাটানি করতে গেলে একটা সিন ক্রিয়েট করে বসবে ও। কাজেই ও সেই যাদবপুরের কেতকী আর বর্ধমানের মৃদুলার সঙ্গে বুফের লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। হাসি ঠাট্টার মধ্যে কেটে গেল ওদের একটি ঘণ্টা। ওরা জানাল কাল ওরা যাবে রাজাজি ন্যাশনাল পার্কে হাতির পিঠে চড়ে জাঙ্গল সাফারি করতে আর সন্ধেয় যাবে ত্রিবেণী ঘাটে বড় আরতি দেখতে। “তোমরাও চল আমাদের সঙ্গে, আমরা ছ’জন বাঙালি মিলে খুব হৈ হৈ করব,” বলল মৃদুলা। বনানী বলল, “দেখি ওকে বলে।”

কিন্তু হোটেলের কামরায় ফিরে রাজাজি পার্কে জাঙ্গল সাফারির কথা তুলতেই দেবল বলল, “আমিতো ঠিক করেছি মহেশ যোগী ওনার আশ্রমে যেখানে বীট্‌লসদের রেখেছিলেন সেখানে যাব। ওটা এখানের হট স্পট খোঁজ নিয়েছি আমি।”

বনানী বলল, “ঠিক আছে বীট্‌লসদের আশ্রমেই যাব আমরা।” দেবলকে খুশি করতে এটুকুতো ও করতেই পারে। সময় থাকলে পরে অল্প সময়ের জন্য রাজাজি ন্যাশনাল পার্কেও ঘুরে আসতে পারবে ওরা। দেবল এবার ব্যাগ থেকে হুইস্কির বোতল বের করে বড় একটা পেগ ঢালল নিজের জন্য আর বনানীর অনুরোধে ওর জন্য একটা ছোট পেগ বানিয়ে দিল। রাত বারোটা নাগাদ যখন ওরা শুতে গেল তখন দু’জনেরই নেশা বেশ জমে গেছে। শেষরাতে ঘুম ভেঙে গেলে বনানী দেবলকে যৌন-মিলনের আহ্বান জানাল ওর বুকের সঙ্গে লেপটে গিয়ে

ওকে চুমু খেয়ে কিন্তু আধো ঘুমের মধ্যে দেবল ওকে না করে দিল, বলল, “ডোন্ট মাইন্ড বনি, আমার এসব ভালো লাগছেনা এখন।”

আর ঠিক সেই মুহূর্তে বনানীর মনে পড়ল সেই শব্দটি যেটি দেবলের বাবা বলেছিলেন যখন দেবল প্রথমবার ওকে ওর মাবাবার সঙ্গে পরিচিত করাতে নিয়ে গিয়েছিল ওদের গ্রেটার কৈলাশের বাড়িতে। ইংরেজি শব্দটা প্রভাত সরকার উচ্চারণ করেছিলেন অস্ফুটে ওঁর স্ত্রী দেবারতির দিকে তাকিয়ে, কিন্তু বনানী শুনতে পেয়েছিল ওই শব্দটা – ‘ইনকম্প্যাটিব্‌ল।’




সরকারি অফিসের ক্লার্ক বিজন বোসের মেয়ে বনানীকে ডায়নামিক প্ল্যাটফর্ম-এর মত একটি নামি ই মার্কেটিং কোম্পানির কপি রাইটার হতে অনেক ঝামেলা পোয়াতে হয়েছে। ইংরেজিতে অনার্স এবং ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এর কোর্স করার পরেও দিল্লি ও গুরুগ্রামের নানা অফিসে এক ডজন লিখিত পরীক্ষা এবং ততোধিক ইন্টারভিউতে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার পর এই কাজটা জুটেছিল বনানীর। সেদিক থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং আর এমবিএ করা বড় ঘরের ছেলে দেবলকে চাকরি পেতে কোনই অসুবিধে হয়নি কারণ ওর বাবা কেন্দ্রীয় সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রালয়ে জয়েন্ট সেক্রেটারি থাকায় শুধুমাত্র কয়েকটা ফোন করে দেবলের চাকরি জুটিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কাজে গাফিলতি বা অমনোযোগী হওয়ায় সাত বছরে তিনটা কোম্পানি পাল্টে দেবল এখন ইন্ডিয়া টিভিতে গ্রাফিক ডিজাইনার হয়েছে ওর বাবার খুঁটির জোরেই। বেঙ্গালুরুতে একটা কনফারেন্সে গিয়ে দেবলের সঙ্গে বনানীর আলাপ হয়েছিল গত বছরের মাঝামাঝি। লম্বা, ফর্সা, সুদর্শন দেবলকে প্রথম দৃষ্টিতেই ভাল লেগে গিয়েছিল বনানীর কিন্তু শ্যামলা, পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি হাইটের মেয়ের সঙ্গে ভাব করতে চাইবে কেন দেবল, ভেবেছিল বনানী। কিন্তু দিল্লি ফিরে এসে বনানীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রেখেছিল দেবল। এক রোববার ওকে নিয়ে লং ড্রাইভে হরিয়ানার সূরজকুন্ড লেকে যাবার পথে দেবল জানিয়েছিল বনানীকে ও ভালবাসে ওর ইনটেলিজেন্স, হার্ড ওয়ার্ক আর ট্রান্সপারেন্ট এ্যাটিটিুউড-এর জন্য। তিন মাসের কোর্টশিপে মল, রেস্তরাঁ, সিনেমা, ছুটির দিনে লোদি গার্ডেনে হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেরোনোর পরে বনানী দেবলকে নিয়ে গিয়েছিল ওদের সরোজিনী নগরের দু’কামরার সরকারি কোয়ার্টারে। সুদর্শন ভাবী জামাতাকে দেখে বিমোহিত হয়েছিলেন বনানীর বাবা বিজনবাবু আর ওর মা সুপ্রীতি আনন্দে চোখের জল মুছে লুচি, আলুর দম আর তিন রকমের মিস্টি খাইয়েছিল দেবলকে। বনানী চেয়েছিল দেবল একদিন ওকে ওর বাবা-মার সঙ্গে পরিচিত করাক কিন্তু দেবল বলল, “হোয়াট ফর, সুইটি? আমরাতো রেজিস্ট্রি বিয়ে করব, নো ফ্যানফেয়ার, হল্লাগুল্লা। আলাদা বাড়ি নেব আমরা ডার্লিং, শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে তোমাকে ঘর করতে হবেনা। ইন ফ্যাক্ট আমার বাবামা সেটা চানওনা।”

রেজিস্ট্রি বিয়ের ঠিক তিনদিন আগে বাবা-মার সঙ্গে দেখা করাতে দেবল বনানীকে নিয়ে হাজির হল গ্রেটার কৈলাশ-এ ওদের চার বেডরুমের ফ্ল্যাটে। পায়ে হাত দিয়ে দেবলের বাবামাকে নমষ্কার করলে প্রভাতবাবু আর দেবারতি দেবী মাথায় হাত দিয়ে বনানীকে আশীর্বাদ করলেন। একটু পরে চাকর এনে হাজির করল বাজার থেকে কিনে আনা বার্গার আর পেস্ট্রি। টুকটাক কথা চলল ওদের মধ্যে, বনানী বুঝতে পারল নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ চেহারার মেয়ে বলেই হয়তো বনানী ওঁদের মনে কোন দাগ কাটতে পারেনি। ঘন্টাখানেক পরে দেবলের বাবা-মাকে আরেকবার নমষ্কার করে সিটিং রুম থেকে বেরিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাবার সময় বনানী পিছন থেকে প্রভাতবাবুর অস্ফুট গলার আওয়াজটা শুনতে পেল – ‘ইনকম্প্যাটিব্‌ল।’ দেবল বেশ জোরে কেশে উঠেছিল শব্দটা চাপা দিতে কিন্তু বনানী শুনতে পেয়েছিল শব্দটা আর ওটা ও ভুলতে পারেনি আজ প্রায় এক বছর দেবলের সঙ্গে ঘর করার পরেও।




বীট্‌লস মন্দির, যাকে স্থানীয় লোকেরা চৌরাশি কুঁয়া বলেই উল্লেখ করে, এখন রাজাজি ন্যাশনাল পার্কেরই অন্তর্ভুক্ত। প্রবেশ মূল্য আড়াইশো টাকা কিন্তু দেখবার মত বিশেষ কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। বীট্‌লসরা এখানে এসেছিলেন তাঁদের খ্যাতির মধ্যগগনে, ১৯৬৮ সালে। ওঁরা এখানে ছিলেন তিন-চার মাস, তারপর মহেশ যোগীর সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি হবার পর রাতারাতি ওরা এই আশ্রম ছেড়ে চলে যান আর মহেশ যোগীও কিছুদিন পরে চলে যান আমেরিকা। আশ্রমিকরাও একে একে এই জায়গা ছেড়ে চলে গেলে প্রায় এক একর জমির উপর বিস্তৃত এই আশ্রম ক্রমে এক ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়। বনানীর জায়গাটা একেবারেই ভাল লাগলনা কিন্তু অসীম আগ্রহ নিয়ে দেবল ঘুরে ঘুরে দেখল মহেশ যোগীর বাংলো, বীট্‌লসদের থাকার ঘর, প্রার্থনা সভাঘর, অতিথি ভবন, স্পিরিচুয়াল মিটিং-এর ঘরগুলি। সঙ্গে যে তরুণ গাইড ছিল সে জায়গাটাকে ‘খান্ডার’ বলেই উল্লেখ করছিল বারবার আর অযত্নে ফেলে রাখা এই ভগ্নস্তূপকে খন্ডাহার ছাড়া কী-ই বা বলা যায়। বীট্‌লসদের ভাঙা ঘরগুলো থেকে কয়েকশো ফিট নীচে গঙ্গাকে দেখতে খুব ভালো লাগে আর সেটাই দেখল বনানী মনোযোগ দিয়ে। প্রায় দেড় ঘণ্টা বীট্‌লসদের ভগ্নস্তূপে কাটিয়ে ওরা যখন বাইরে বেরোল তখন বেলা বারোটা বেজে গেছে। “চলো আমরা এবার কোথাও খেয়ে নি, তারপর রাজাজি ন্যাশনাল পার্কটা দেখেই আসি,” বলল বনানী।

দেবল বলল, “না, আমরা এখন যাব AIIMS ঋষিকেশ দেখতে। আমাদের টিভি ওটার উপর একটা আধঘণ্টার ডকুফিল্ম করতে চায়, আমাকে দেখে আসতে বলেছে।”

এবার সত্যিই বনানীর কান্না পেল। “ঋষিকেশে এসে যদি তোমার এসবই দেখার ছিল তো একাই চলে আসলে পারতে,” বলল ও। “আমার খুব খিদে পেয়েছে, আমি খাব।”

দেবল মুচকি হেসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ওদের কেন্টিন আছে, ওখানে গিয়ে প্রথমেই খেয়ে নেব আমরা।”

কিন্তু হাসপাতালের কেন্টিনে ওরা যখন গিয়ে পৌঁছল তখন ওখানে ব্রেড পকোড়া আর চা ছাড়া কিছু পাওয়া গেলনা। আর কী আশ্চর্য, তেল মশলা খাওয়ার ব্যাপারে যে দেবলের খুব ফিনিকি বলে খ্যাতি বা অখ্যাতি আছে বন্ধু মহলে সে গপাগপ করে দু’খানা ব্রেড পকোরা খেয়ে নিল, সঙ্গে সরবতের মত মিস্টি চা। ওখানেও একজন গাইড জোগাড় করে নিল দেবল আর বনানীকে কান পেতে শুনতে হল ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত, এক হাজার শয্যা বিশিষ্ট এই হাসপাতালটি থাকায় উত্তরাঞ্চলের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এবং পরিষেবায় কত উন্নতি হয়েছে। বনানীর মনে হল ওকে রাজাজি ন্যাশনাল পার্কে না নিয়ে যাবার জন্যই এখানে নিয়ে এসেছে দেবল। বিকেল প্রায় চারটের সময় বাইরে বেরিয়ে দেবল যখন বলল, “রাজাজি ন্যাশনাল পার্কে যাবেতো চল, এখনও সময় আছে”, বনানী একটু গলা উঁচিয়েই বলল, “একদম না, আমি খুব টায়ার্ড ফিল করছি। আমাকে হোটেলে ড্রপ করে তুমি যেখানে খুশি যাও।” দেবল শ্রাগ করে বলল, “ওকে বেবি। লেটস গো ব্যাক টু দ্য হোটেল।”

সেরাতে বনানীকে খুশি করতেই বোধ হয় দেবল ডিনারে বুফের লাইনে জয়েন করলো আর তন্দুরি রুটি, ডাল মাখানি, দইবড়া আর ক্ষীরের বাটি নিয়ে বনানীর সঙ্গে একই টেবিলে গিয়ে বসল। একটু পরে ওদের পাশের টেবিলে এসে বসল সৌম্য বর্ধন আর মহিম স্যান্যাল কেতকী আর মৃদুলাকে নিয়ে। টুক টাক কথা চলল তিন দম্পতির মধ্যে। রাজাজি পার্কে হাতির পিঠে চড়ে জাঙ্গল সাফারি কেমন উপভোগ করেছে ওরা জানালে বনানী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল আর দেবল মহেশ যোগীর পরিত্যক্ত আশ্রমে বীটলসদের ঘরগুলো দেখার বিবরণ দিল এমনভাবে যেন ওটাই ঋষিকেশের মুখ্য দর্শনীয় স্থান। মৃদুলা মহিমকে কনুই-এর গুঁতো মেরে বলল, “কাল কিন্তু আমরা বীট্‌লসদের ঘরগুলো দেখতে যাব, মনে থাকে যেন। ওই পরমার্থ সনাতন মন্দির, স্বর্গাশ্রম, বশিষ্ঠ গুহা ওসব দেখার কোন ইন্টারেস্ট নেই আমার। খালি বার বার চটি খোল আর দেব-দেবীর সামনে মাথা ঠোক . . . না বাবা ওসব অনেক করেছি, বীট্‌লস আশ্রমেই যাব আমরা।” মহিম মিন মিন করে বলল, “ঠিক আছে, তাই হবে।”

নিজেদের কামরায় ফিরে বনানী ওদের স্ট্রলি ব্যাগ গুছিয়ে নিল কেননা খুব ভোরেই ওদের বেরিয়ে পরতে হবে। শোবার আগে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মুখে কোল্ড ক্রিম ঘসতে গিয়ে বনানীর মনে হল দেবলকে কি ও ভুল বুঝেছে? এইতো একটু আগে বুফের লাইনে দাঁড়িয়ে কী সুন্দর ওর প্লেটে ভাল ভাল খাবার তুলে দিল ও, আর ওর সঙ্গে বসে হাসিমুখে গাল-গল্প করল ওই দুই কাপ্‌লের সঙ্গে। সাময়িকভাবে ওর মনে হয়ত একটু হতাশা এসে গিয়েছিল বউ-এর হঠাৎ পদোন্নতিতে আর সেটা হৃষিকেশে এসে ওর নিজের পছন্দসই জায়গাগুলোতে ঘুরে উবে গেছে। যে কারণে বনানী এই ট্রিপটা নিল সেটা সার্থক হয়েছে।

শেষরাতে হঠাৎ যখন দেবল ওকে বুকে টেনে নিল আদর করতে তখন বনানী খুশি হয়ে এক টানে ওর নাইট ড্রেস্টা মাথার উপর দিয়ে খুলে ফেললো দেবলের আদর সোহাগের পাল্টা জবাব দিতে। কিন্তু দেবল এবার যেটা করল তার জন্য একেবারেই তৈরি ছিলনা বনানী। দেবল বনানীর মাথাটা সজোরে ওর পেটের উপর দিয়ে ঠেলে নামিয়ে দুই পায়ের মধ্যে নিয়ে এসে বলল, “নাও সাক মাই ডিক্‌ বেবি।”

বনানীর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, ও এক ঝটকায় মাথাটা সরিয়ে নিয়ে বলল, “ওসব আমি করতে পারবনা দেবু।”

“কেন পারবেনা?” সাপের মত হিস হিস করে উঠল দেবল। “জাস্ট বিকজ ইউ হ্যাভ গট আ লিফট? মাইন্ড ইউ, আই এ্যাম ইওর হাজব্যান্ড, আমি যা চাইব করতে হবে তোমাকে।”

“নেভার! তুমি আমাকে সেক্সুয়ালি এ্যাবিউজ করতে পারনা। আই হ্যাভ মাই রাইটস টু সে নো।”

দেবল ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে, পাজামা টেনে নিয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ল।




একশো কিমি গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিল দেবল। বনানী পিছনের সিটে, সামনে দেবলের পাশে বসার কোন ইচ্ছা ছিলনা ওর। রাতে বিছানায় ওদের মধ্যে যে ঝগড়াটা হয়েছিল তা মিটিয়ে নেবার কোন আগ্রহ ছিলনা ওদের কারও। দেবল কী ভাবছিল জানেনা বনানী কিন্তু ‘ডিভোর্স’ শব্দটা ইতিমধ্যে ওর মাথায় ঘোরাফেরা করতে শুরু করে দিয়েছে। একবছরও পুরো হয়নি ওদের বিয়ের কাজেই কোলিগ আর আত্মীয়-স্বজন, বিশেষত মা-বাবার কাছে জবাবদিহি করতে হবে ওকে। প্যাচ-আপ করার সাজেশন দেবে অনেকেই, কিন্তু বনানী জানে ওদের সম্পর্কে যে ফাটল ধরেছে তা কোনরকম এ্যাডজাস্টমেন্টের ফেভিকল দিয়ে জোড়া লাগবেনা। প্রোমোশন নিয়ে ওদের মধ্যে যদি এই ফাটলটা না ধরত তবে আগামিতে আরও অনেক ব্যাপারে মতানৈক্য ওদের ঠেলে দিত চূড়ান্ত বিচ্ছেদের দিকে। দেবলের কন্ডোম ব্যবহারে আপত্তি থাকায় বনানী কন্ট্রাসেপটিভ পিল নেওয়া শুরু করেছিল সিমলাতে হানিমুনে যাবার দিন থেকেই। অন্তত বাচ্চা পেটে নিয়ে ফ্যামিলি কোর্টে ডিভোর্সের জন্য হাজির হতে হবেনা ওকে।

বনানী ভেবেছিল ব্রেকফাস্টের জন্য হরিদ্বারে গাড়ি থামাবে দেবল, কিন্তু ও শহরে না ঢুকে বাইপাস দিয়ে সোজা বেরিয়ে গেল। ভোর সাতটায় বেরোবার মুখে হোটেলের কামরায় চা করে এক কাপ খেয়েছিল বনানী, কিন্তু এখন বেলা প্রায় দশটা, খিদেতে ওর গা গুলোচ্ছিল। ও ভাবলো হরিদ্বারের ভিড় এড়িয়ে দেবল হয়ত রুরকিতে গাড়ি থামাবে কোন রেস্তরাঁর সামনে, কিন্তু রুরকিতেও গাড়ি থামালনা দেবল। খাবার জন্য গাড়ি থামাতে বললে দেবল কী সারকাস্টিক মন্তব্য করে বসবে কে জানে, তাই বনানী এবার গলা খাঁকারি দিয়ে বেশ জোরেই বলল, “আই নিড আ টয়লেট ব্রেক দেবল। একটা হোটেল বা বড় ধাবার সামনে গাড়ি থামাও।”

দেবল শ্রাগ করল। “ওকে।”

রাস্তার পাশে ছোট, নোংরা একটা ধাবার কাছে গাড়ি থামাল দেবল, কিন্তু ও গাড়ি থেকে নামলনা। বনানী গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেল ধাবাটার দিকে। ধাবার মালিককে জিজ্ঞেস করে জানল পিছনে একটু ঘেরাও জায়গা আছে মেয়েদের টয়লেটের জন্য। ওখানে যাবার কোন দরকার ছিলনা বনানীর কিন্তু নিজের কথার মর্যাদা রাখতেই পিছনটা ঘুরে এল একটু সময় নিয়ে। তারপর চা আর দুটো বিস্কুট চাইল বনানী।

বেশ তৃপ্তি করেই বেশি দুধ আর চা পাতা দিয়ে ফোটানো মিস্টি চা খেল বনানী বিস্কুটের সঙ্গে, তারপর ধাবার মালিককে এক টু অবাক করে দিয়ে গোল্ডফ্লেক সিগারেট চেয়ে নিল ও। দেশলাই জ্বেলে সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বনানী নিজের মনেই বলে উঠল, “ইনকম্প্যাটিব্‌ল!”

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *