short-story-jakhan-bristi-namey

যখন বৃষ্টি নামে
সুমন মহান্তি


ফুরন্ত বিকেলে সূর্যের হলদেটে আলো বারান্দায় উঁকি দিয়েছে।

পুরনো আমলের বাড়ি, শির-তোলা থাম, বিবর্ণ হলদেটে রং, স্যাঁতস্যাঁতে ঘর, বাইরে টানা বারান্দা। এই হল পরিতোষের অফিস। পরিতোষের টেবিলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফাইল, সেগুলো আজকেই সারতে হবে ভেবে সে বিরক্ত হল। আজ সে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাবে ভেবেছিল। ফাইলে ডুব দিয়ে মিনিট চল্লিশ পরে সে যখন মাথা তুলল তখন চারদিকে আলো মরে এসেছে। সে কিছুতেই মনে করতে পারল না কেন আজ তাকে অনন্যা তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছিল।

স্টাফেরা একে একে চলে গিয়েছে। অন্ধকার হয়ে এসেছে চারদিক। শেষবিকেলের রোদ নিভে এলেও রুমটায় বেশ গরম। দেয়ালে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাল পরিতোষ। আষাঢ়ের বারোদিন কেটে গেলেও বর্ষা এখনও মুখ দেখায়নি। আড়মোড়া ভেঙে পরিতোষ চেয়ার ছেড়ে ওঠে। পিওন সনাতনের মুখে মৃদু বিরক্তি, বাবু না গেলে তার ছুটি হবে না, জানালা-দরজা বন্ধ করে বেরোতে হবে। পরিতোষ ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বলল, ‘আমার কাজ হয়ে গেছে।’

টানা বারান্দায় বেরিয়ে কেমন এক ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল পরিতোষ। বাইরে ঝমঝম শব্দে বৃষ্টিনূপুর বেজে চলেছে, বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ শোনা যাচ্ছে, বিদ্যুৎ চমকের আলোয় মোটা মোটা থামগুলো যেন ঘুম থেকে জেগে উঠছে। বাইরে এসে বাইক স্টার্ট করল পরিতোষ। কী আশ্চর্য! কোথাও বৃষ্টির চিহ্নমাত্র নেই। হতভম্ব পরিতোষ গিয়ার বদলাতেও ভুল করল। পুরোটাই তার মনের ভুল?

লোকালয় পেরিয়ে গেল পরিতোষ, হালকা ইউক্যালিপটাসের বনের বুক চিরে মসৃণ পিচরাস্তা, কিছুটা এগোনোর পরে অজানা ভয়ে গুটিয়ে যায় সে। বাইকের হেডলাইট অন্ধকার ভেদ করতে পারছে না, এত অন্ধকার তো কখনও থাকে না এই জায়গাটা। তার গলা শুকিয়ে আসে, ব্যাগের ভেতর থেকে জলের বোতল বের করে। একফোঁটা জল পর্যন্ত নেই। স্তব্ধ অন্ধকারের বৃত্তে বাইক থামিয়ে পরিতোষের মনে হল সে আর এগোতে পারবে না। এই অন্ধকারে বাইক চালিয়ে সে কোথাও যেতে অক্ষম। তার পথ এখানেই শেষ। এমনকী বনের শেষে কোন গ্রাম আছে তার নামটাও মনে করতে পারল না। ঘর থেকে অফিসের পনেরো কিমি যাত্রাপথের প্রতিটা জনপদ, প্রতিটা মোড়ের নাম সে চোখ বুজে বলে দিতে পারত। এই মুহুর্তে কোনও ভৌগোলিক ম্যাপ কাজ করছে না তার মাথায়।

তার স্নায়ুকোষে দুটি শব্দ অনুরণিত হচ্ছে শুধু,

* অ্যাকসিডেন্ট

* ইন্টারনাল হেমারেজ

পরিতোষ কী করবে ভেবে পেল না। মানুষ ভেবে ভেবে একটা জায়গায় তো পৌঁছতে পারে। যাযাবরেরা ভৌগোলিক ম্যাপ বা গুগল ম্যাপ না জেনেও তাঁবু গুটিয়ে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গা অনায়াসে চলে যায়। সে কেন পারবে না? দু’খানা অবাঞ্ছিত শব্দের অনুরণন নার্ভের ওপর খুব চাপ দিচ্ছে। তার মস্তিষ্ক এই দুটি শব্দের ধকল নিতে পারছে না। অনন্যা কেন তাকে তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে বলেছিল তা আবার মনে করার চেষ্টা করল পরিতোষ। এবারেও সে পারল না। তার মাথার মধ্যে হঠাৎই বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। বিদ্যুতের ক্ষণিক আলোয় জেগে উঠল বাপ্পার মুখ। তাদের একমাত্র সন্তান বাপ্পা, সাদা কাপড়ে শরীর ঢাকা, ছেঁড়াকাটার পরে এসেছে ঘরে। নিথর প্রাণহীন বাপ্পার ওপর মূর্ছিত হয়ে পড়ে রয়েছে অনন্যা। এমনও হয়? কতখানি নিষ্ঠুর হলে মাত্র উনিশ বছর বয়সে তাদের ছেড়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে বাপ্পা?

শুধু তারই বিশ্রাম চাওয়ার কোনও অধিকার নেই। অনন্যা এবং সে মিলে কতবার ভেবেছে চিরদিনের মতো বিশ্রাম নেবে। ইঁদুর মারার বিষ, ঘুমের বড়ি, মজবুত দড়ি কতরকম আয়োজন করেছে, তবু কাঙ্ক্ষিত ছুটি কিছুতেই মেলেনি। শেষমেশ জীবনযাপনকে অনিবার্য মেনে নিতে হয়েছে।

সবাই নিষ্ঠুর, ঈশ্বর বলে কেউ থাকলে তিনিও তাই। তাঁর ইচ্ছে মঙ্গলময় আদৌ নয়। সামনে কী নির্মম অন্ধকার! ক্ষিপ্রহাতে বাইক স্টার্ট করে গিয়ার বদলাল পরিতোষ। প্রতিদিন বাইক চালিয়ে মাত্র পঁচিশ মিনিটেই সে ঘরে পৌঁছে যায়। সবদিনই তো পারে। আজ কেন পারবে না?

শহরে পৌঁছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল পরিতোষ। আলো ঝলমল সন্ধের মোহিনী রূপ তাকে আচ্ছন্ন করে দিল। স্ট্রিটলাইটের চোখধাঁধানো নিওন আলো সে যেন সারা শরীরে মেখে নিতে চাইল। সবাই ব্যস্ত, দৌড়চ্ছে, গন্তব্যে যাওয়ার তাড়া তাদের চোখেমুখে। পরিতোষের গলা শুকিয়ে কাঠ। তেষ্টা মেটানোর জন্য সে কোল্ড ড্রিংকস কিনল। রাস্তায় বিরামহীন হর্ন আর গর্জন। হর্ন বাজাতে বাজাতে ছুটছে অটো, বাইক, চারচাকা, মিনিট্রাক, বাস। নির্জন অন্ধকারের গহ্বর থেকে শব্দময় জগতে পৌঁছে গিয়েছে সে, আর কোনও ভয় নেই তার। আরামে ধীরেসুস্থে সে কোল্ড ড্রিংকসের চুমুক দিতে থাকে। লাস্যময়ী তরুণী, বলিষ্ঠ যুবক, হাসিখুশি স্মার্ট লোকজন তার চারপাশে। পরিতোষের নিজেকে একা ও বিচ্ছিন্ন মনে হয়। সে যেন চাপা হাসির আওয়াজ পায়, সবাই বুঝি তাকে ব্যঙ্গ করছে, কাঁপা আঙুল থেকে স্ট্র পড়ে যায় মাটিতে।

সন্ধের মৃদু মিষ্টি বাতাস ছুঁয়ে গেল পরিতোষের কপাল। সে আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়, স্ট্র ছাড়াই নেশাড়ু মানুষের মতো গলায় বাকি ড্রিংকসটা ঢেলে নিল। বাইক স্টার্ট করে ভিড় বাঁচিয়ে সে এগোয়। বেশি জোরে চালালে বিপদ হতে পারে, দুর্ঘটনার ফাঁদ চারদিকে পাতা আছে। পরিতোষ কিছু মনে করতে চায়। ফুটপাতে বাইক থামিয়ে সে বিজ্ঞাপনের আলোকিত হোর্ডিংটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকায়। সে কিছু ভুলে যাচ্ছে। কিছুতেই মনে করতে পারছে না। ফুলে ওঠা স্মৃতির বাবলগাম ফেটে মিলিয়ে যাচ্ছে। বুদবুদ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে শূন্যে মিলিয়ে যেতে চাইছে স্মৃতি।

ছটফট করে পরিতোষ। মাত্র একান্ন বছর বয়সেই সে কি ডিমেনশিয়ার রোগী হয়ে গেল? সময়ের প্রতিটি পদধ্বনি সে শুনতে পাচ্ছে কিন্তু চেতনা কাজ করছে না। সব ভুলে যাচ্ছে সে। চেতনা হারাতে হারাতে সে হয়তো এবার একটি বিন্দু হয়ে যাবে। সংকটের মুহুর্তে মাত্র দুটি শব্দই তার মনে ভাসছে,

১. গড

২. ডেস্টিনি

সামনে একখানা ওষুধের দোকান, গ্লোসাইন বোর্ডে নামটা খুব উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। জীবনদীপ মেডিকেল স্টোর্স। সেদিকে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আরও দু’খানা শব্দ ভেসে উঠল তার মস্তিষ্কে,

* ডক্টর

* মেডিসিন

চারটি শব্দ একটার ওপর একটা সুপার ইম্পোজড হয়ে চলল কিছুক্ষণ। রুমাল বের করে কপালের ঘাম মোছে পরিতোষ। মাথা ঠান্ডা করে ভাবার চেষ্টা করে। অনন্যার মুখ ভাসল মনে। সোনালি রঙ, দিঘল চোখ, কমনীয় ত্বকের অনন্যা কতকাল আগে হারিয়ে গিয়েছে। আগের অনন্যাকে কিছুতেই আর ফিরে পায় না সে। অনন্যার চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েছে, চোখের নিচে কালি, সারাক্ষণ তার চোখে বিষণ্ণতা, মুখের হাসি উধাও। অনন্যা হয়তো এখন ব্যালকনির রেলিং ধরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার জন্য অপেক্ষায় আছে? যুগান্তের প্রতীক্ষা নিয়ে অনন্যা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকে কার জন্য? বাপ্পা তো ফিরবে না।

আবার তার সবকিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে, জট পাকিয়ে যাচ্ছে। স্নায়ুকোষ বিশ্রাম চাইছে কাতরভাবে। কেন অনন্যা তাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছিল তা সে মনে করার অক্ষম চেষ্টা আর করবেই না। এভাবে চললে বাড়ির ঠিকানাও সে ভুলে যেতে পারে। তার চেয়ে বাইক চালিয়ে এগোবে, নিজের বাড়িতে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে। ফার্স্ট গিয়ারে গিয়েই পরিতোষের মনে অবাধ্য প্রশ্ন উঁকি দিল। তাহলে কি ‘ডক্টর-মেডিসিন শপ?’

ধুর, আবার কেন শব্দগুলো উপদ্রব করছে? তার মাথায় কয়েকটি শব্দ মৃদু তরঙ্গ তুলতে থাকে— ‘গড, গড, মাই গড।’

পরিতোষের মনে প্রশান্তি আসে। তার ভীষণ খিদে পেয়েছে। ওই তো রেস্টুরেন্ট সামনেই। সুরুচি রেস্টুরেন্ট। ঠিক তখনই যেন সম্বিত ফিরে পেল পরিতোষ। এখানে তার তো আসার কথা নয়। এটা তার বাড়ি ফেরার রাস্তাই নয়। কীভাবে সে পথ ভুলে স্টেশনের রাস্তায় চলে এল? ভুল পথে না এলে সে অনেকক্ষণ আগেই বাড়ি ফিরে খেতে বসত। বুকপকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করল পরিতোষ। অনন্যার সঙ্গে এখনই কথা বলতে হবে। আবার তার মাথা ঠিকঠাক কাজ করছে। সে আবার সেই পুরনো পরিতোষ, মাঝারি মাপের সরকারি অফিসার্‌, সোহম অ্যাপার্টমেন্টের সি/ ওয়ান ফ্ল্যাট তার ঠিকানা, কাজের চাপ নিতে ভালোবাসে, কাজ করেই সবকিছু ভুলে থাকতে চায়। অফিসে ফাইলে চোখ রেখে সে মোবাইল ফোন সুইচড অফ করে দিয়েছিল।

বনের মধ্যে বিভ্রান্ত অবস্থা কাটিয়ে সে যখন জোরে বাইক চালাতে শুরু করেছিল তখন তার মোবাইলে রিংটোন বেজেছিল। যেন হৃদপিন্ড ফুঁড়ে আর্তনাদ করে উঠেছিল সেই রিংটোন। বেসামাল পরিতোষ মোবাইলে চোখ রেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। স্ক্রিনে আলো নেই, শব্দ নেই, মিসড কল লেখাটিও নেই। এত মনের ভুল হয়েছিল তার? মোবাইল তো বন্ধ ছিল। তাহলে রিংটোন আদৌ বাজেনি? ওই তুমুল ধ্বনিত শব্দ নিছকই কল্পনা? কী সর্বানাশ! এবার কি পরিতোষ রায় মানসিক রোগী হয়ে যাবে? তাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে হবে? অনন্যাকে টানা এক বছর সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে হয়েছিল।

মোবাইলে সে কাঁপাগলায় বলল, ‘অনন্যা, খুব বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম।’

‘সে কী! কি বিপদ?’ অনন্যার গলায় তীব্র উৎকণ্ঠা, ‘তুমি ফোন বন্ধ রেখেছিলে কেন? কতবার ট্রাই করেও পাইনি। চিন্তায় অস্থির হচ্ছিলাম খালি। কি হয়েছিল?’

‘আসলে আমি মাঝেমধ্যে ভুলে যাচ্ছি, রাস্তা গুলিয়ে ফেলছি। সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। বন্ধ মোবাইলে রিংটোন বাজল, বনের মধ্যে অন্ধকার হয়ে এল। তবে চিন্তার কিছু নেই। আমাদের জীবনে চিন্তা করার মতো আর কিছুই নেই। তাই না?’

‘কী যে বলছ বুঝতে পারছি না। হিজিবিজি না ভেবে চলে এসো এখনই।’

‘ফিরতে পারব তো?’ পরিতোষের গলায় দ্বিধা।

‘কী হল তোমার? ওরকম বলছ কেন? শরীর খারাপ লাগছে? কোথায় আছ এখন? যেখানে আছ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। রেডি হয়ে বেরোচ্ছি।’

মাথা ঝাঁকিয়ে পরিতোষ বলে, ‘না, না। আমি এখন ঠিক আছি। যেতে পারব। তুমি বেরিয়ো না।’

‘প্লিজ, তুমি কোন জায়গায় এখন একবার বলো।’

তখনই লাইন কেটে গেল। পরিতোষ অনেকবার চেষ্টা করেও পেল না। তবে নিজের বিভ্রান্ত ভাবটা কেটে যাচ্ছে। তার আর ভয় হচ্ছে না, সে নিশ্চিন্তে ফিরতে পারবে। বাইকে মাত্র সাত-আট মিনিট লাগবে। উল্টোদিকের লজের গেটে ফুলের তোরণ, সানাই বেজে চলেছে, আলোর মালায় সেজে উঠেছে লজটা। ফুলের তোরণে শোলার কারুকাজে লেখা রয়েছে সৌমাল্য-অবন্তিকা’। পরিতোষ সুরুচি রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ল। রুমালি রুটি, পনির বাটার মশলা, চিকেন ভর্তা অর্ডার দিয়ে সোফায় বসল। এসির ঠান্ডায় তার ঘাম শুকিয়ে যাচ্ছে, ফুরফুরে লাগছে নিজেকে।

ঠিক সময়ে তার মনে পড়েছে। আজকের দিনটা সেলিব্রেট করবে না? আজ যে তাদের বিবাহবার্ষিকী। এইজন্যই হয়তো অনন্যা তাকে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে বলেছিল। খাবারের পার্সেল দেখে অনন্যা খুব খুশি হবে, রাগটাগ করবে না। পরিতোষ গুনগুন করে ওঠে ‘You are my heart, you are my soul.’

মিনিট কুড়ি বাদে পরিতোষ রেস্টুরেন্টের দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসে। অনন্যার জন্য একটা ফুলের তোড়া কিনলে ভাল হত। সে অনেক দেরি করে ফেলেছে, খিদেও পাচ্ছে খুব, তাড়াতাড়ি সে অনন্যার কাছে পৌঁছতে চায়।

ডাইনিং টেবিলে খাবারের পার্সেল রেখে পরিতোষ বাথরুমে গেল। শাওয়ারের নীচে দাঁড়াল, স্নান করে তরতাজা হয়ে ফুরফুরে মেজাজে সে সোফায় বসল। অনন্যা তার ফেরার মুহুর্তে আলোকিত হয়ে গিয়েছিল, লাবণ্যে স্নাত ছিল তার দুটি চোখ, ঠোঁটে হাসির সুষমা ছিল। অনন্যা তাকে দেখে নিশ্চিন্ত ও আশ্বস্ত হয়েছিল। অনন্যাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করল তার। কোথায় গেল সে? বিকেল-সন্ধের টালমাটাল মুহুর্তগুলোর কথা মনে পড়তেই বিপন্নস্বরে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল পরিতোষ, ‘অনু, কোথায় তুমি?’

অনন্যা শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে, ‘কিচেনে। কেন ডাকছিলে?’

‘কিচেনে কেন? খাবার তো এনেছি।’

‘প্লেটে সাজিয়ে দিতে হবে না?’

‘ও! এবার তুমি পাশে এসে বোসো।’

পাশেই বসল অনন্যা। খুব পাশে নয়, কিছুটা দূরত্বে বসে উদাস হয়ে থাকল। অনন্যাকে দেখে বিষাদের এক প্রতিমূর্তি মনে হচ্ছে, চোখের আলো নিভে গিয়েছে, মুখে হাসি নেই, তার মন যেন অন্য কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। পরিতোষের অভিমান হল খুব। কত কষ্ট করে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই করে সে ঘরে ফিরে আসতে পেরেছে। তার বিশ্রাম চাই, আনন্দধ্বনি চাই। শ্রান্ত শরীরে একটুখানি আদর, দুটি-একটি হাসিমুখের কথা দরকার ছিল। কীভাবে সে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল তা অনন্যাকে না শোনালে সে শান্তি পাচ্ছে না। অনন্যার ছাইরঙের গম্ভীর মুখ দেখে কিছুই যে তার বলতে ইচ্ছে করছে না এখন। ঘরে ফেরার উদ্বেলিত খুশি রঙ হারিয়ে এত তাড়াতাড়ি চুপসে গেল?

ডাইনিং টেবিলে শুধু তার জন্য খাবার দেখে পরিতোষ অবাক হল। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি খাবে না?’

‘না।’

‘কেন?’

‘এমনিই। খিদে নেই।’

‘তা বললে চলবে? দুজনের খাবার এনেছি। একা আমি খাব বলে তো আনিনি। আজকের দিনটা আমাদের, সেলিব্রেট তেমন করা গেল না। একসঙ্গে বসে খেতে খেতে গল্প করব,’ পরিতোষ বলল।

‘না। বললাম তো খিদে নেই।’

মাথা ঝাঁকিয়ে পরিতোষ ক্ষুব্ধ গলায় বলল, ‘এটা তুমি ঠিক করছ না অনু। খিদে না থাকলেও কিছু অন্তত মুখে দাও। এমন করছ কেন?’

অনন্যা বাষ্পাচ্ছন্ন চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আজকের দিনে আমি কিছু খেতে পারব না। প্রতিবছর এই একটা সন্ধে আমি মুখে কিছু দিই না, নির্জলা উপবাসে কাটাই যে!’

পরিতোষ অস্ফুটস্বরে বিড়বিড় করে, ‘ও গড, গড, ও গড।’

কী করেছে সে? রেস্টুরেন্ট থেকে এনে চব্যচোষ্য খেতে বসে পড়েছে! চেয়ার ছেড়ে সে উঠে দাঁড়াল, ‘আমি একা লোভীর মতো খেতে চাইছিলাম। অসম্ভব, আমি এসব খেতে পারব না।’

অনন্যা তাকে আলগাভাবে জড়িয়ে ধরে শান্তভাবে বলল, ‘তুমি যে সব ভুলে গিয়েছিলে! ওরকম ভেবে কষ্ট পেয়ো না। তাছাড়া তুমি ক্লান্ত, খিদে পেয়েছে তোমার। প্লিজ, খাবার ফেলে উঠবে না ওরকম। খেয়ে নাও।’

বেশি কিছু মুখে দিতে পারল না পরিতোষ। প্রায় অর্ধেক খাবার ফেলে সে উঠে গিয়ে বেসিনে হাতমুখ ধোয়। সবকিছু তার মনে পড়েছে। অস্পষ্ট বা ঝাপসা লাগছে না কিছুই। সে আসলে আজকের তারিখটা ভুলে থাকতে চেয়েছিল। আজকের দিনটা সে ভুলে যেতে চেয়েছিল বলেই অফিসে বেশিক্ষণ ছিল, ফাইলে মুখ গুঁজে, কাজের চাপ নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখার আয়োজন করেছিল। বিবাহবার্ষিকীর উচ্ছ্বাস ফিকে হয়ে গিয়েছে কবে! উৎসব অর্থহীন মনে হয়। আজকের তারিখ শুধু নিঃশব্দে কাঁদার জন্যই আসে। প্রতিবার সে নিজেকে কঠিন, অবিচলিত রেখে অনন্যাকে শান্ত করে, তার চোখের জল মুছিয়ে দেয়। এবার সে নিজেই উদভ্রান্ত হয়ে পড়ল!

বাপ্পার চলে যাওয়াটাই আসল সত্যি, বাকি সমস্ত কিছু মিথ্যে। পোশাকি সেলিব্রেশন, বিশেষ দিন, মনকে চনমনে রাখার চেষ্টা প্রতিবারই নিষ্ফল হয়ে যায়। প্রতিটি কৃত্রিম প্রয়াসের শেষে পড়ে থাকে বিস্তৃত শূন্যগর্ভের আভাস।

বিড়বিড় করে পরিতোষ, ‘ছি! আজকের কান্নারঙের দিনে ম্যারেজ অ্যানিভার্সারির উচ্চকিত শব্দ কেন মনে আসে? কেন তা আর একজনের চলে যাওয়ার তারিখ আড়াল করে দিতে চায়?’

অনন্যা ঘুমিয়ে পড়েছে। পরিতোষের মুখে মাথা রেখে কিছুক্ষণ কেঁদেছিল সে, তাকে শান্ত করেছে, মাথায়-চুলে-পিঠে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতে পেরেছে। কী নিষ্ঠুর সে, একফোঁটা চোখের জল ফেলেনি, একবারও দীর্ঘশ্বাস উঠে আসেনি গলা বেয়ে। পরিতোষ ঘুমোতে পারেনি। স্লিপিং পিল তাকে মাঝেমধ্যেই নিতে হয়। গতকাল শেষ হয়ে গিয়েছিল। অফিস থেকে ফেরার পথে কিনে নেবে ভেবেছিল। শব্দগুলো মাথায় হাতুড়ি পেটালেও কিছুতেই মনে করতে পারেনি সে। আজকের রাতে স্লিপিং পিল ছাড়া কীভাবে ঘুমোবে সে?

ছটফট করতে করতে পরিতোষ জেগে থাকল। মাঝরাতে ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। বিকেল থেকেই অসহ্য গুমোট ছিল, এতক্ষণে বৃষ্টি দেখা দিল। অনন্যার চোখের জলের মতোই সত্যি এই বৃষ্টি। এবার আর মনের ভুল নয়। চারবছর আগে এক নিভন্ত বিকেলে রিংটোন নিয়ে জেগে উঠেছিল মোবাইল। দুর্ঘটনার খবর শুনে সে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়েছিল রাস্তায়।

পরিতোষ সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে, ‘বাপ্পা, হাইরোডে কেন গিয়েছিলি তুই? তুই তো ভালোভাবে চালানো শিখিসনি তখনও! আমার প্রাণ, আমার স্বপ্ন, একটিবার ফিরে আয় তুই। খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় যে তুই আকাশের তারা হয়ে জেগে আছিস দূরে। তারার দেশের রূপকথা শুনিয়ে আমাকে ঘুম পাড়াতে আসবি না তুই?’

ক্রমশ ভিজে আসে পরিতোষ এবং তার বালিশ…।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *