short-story-janmodin

জন্মদিন
স্বপ্না মিত্র




ছোট্ট অপরিকল্পিত মফঃস্বল শহর। বাড়িগুলো ছড়ানো ছেটানো দূরে দূরে। রেলওয়ে স্টেশনটাও খুব ছোট। বল খেলার মাঠের পাশে যে বাজারটা আছে, সেটা ছাড়াও স্টেশনের লাগোয়া স্টেশন-রোডের দু’পাশে রোজ অস্থায়ী বাজার বসে। দূর গ্রাম থেকে নারী-পুরুষেরা ঝাঁকায় করে এনে বিক্রি করে নিজের ক্ষেতের শাক সবজি, গাছের টাটকা ফল।

বাজারটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে একটা রিকশা-স্ট্যান্ড, সবসময়ই অনেকগুলো রিকশা ভিড় করে দাঁড়িয়ে। রিকশা-স্ট্যান্ডের পাশ দিয়ে পরপর কয়েকটা দোকান। ওষুধ, শাড়ি, মিষ্টি, পান-সিগারেট, সাইকেল ইত্যাদি। হালে একটা ছোট্ট জেরক্সের দোকানও খুলেছে। জেরক্সের দোকানে ইন্টারনেট কানেকশন আছে, প্রয়োজনে তারা ইমেইল পাঠিয়ে দেয়, তবে অর্থের বিনিময়ে।

সাইকেলের দোকানটা বেশ বড়, নাম সাইকেল-মার্ট। আসলে ডেলি প্যাসেঞ্জারদের জন্য প্রতিদিন রিকশা করে বাড়ি থেকে স্টেশন যাতায়াত বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। আর রোজ রোজ সকাল-বিকেল এতটা হাঁটাও পরিশ্রমের কাজ। তাই অনেকেই স্টেশন অবধি সাইকেলে আসেন, সাইকেল-মার্টে সাইকেল জমা রেখে ট্রেন ধরে নিজ গন্তব্যে চলে যান। ফেরার পথে সাইকেল-মার্ট থেকে সাইকেল উঠিয়ে বাড়ি ফেরেন। সাইকেল জমা রাখার জন্য দৈনিক বা মাসিক ভাড়া দিতে হয় সাইকেল-মার্টকে। এছাড়াও টায়ারে হাওয়া ভরা, টায়ার চেঞ্জ করা বা ছোটোখাটো রিপেয়ারিংয়ের কাজ হয়ে যায় সাইকেল-মার্টে।

এই সব কাজ করে সুহাস। সে সাইকেলের কাজ দ্রুত শিখে নিয়েছিল নিজের গরজেই। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার পর সুহাসের বাবা দু’দিনের জ্বরে মারা যান। তখন কলেজে ভর্তি হওয়া দূরের কথা, ভাতও জুটত না সুহাস আর তার মায়ের। সেইসময় বাবার এক বন্ধু মণ্ডল-জেঠুর সাইকেল-মার্টের কাজটার খবর দেন। কাজটা জুটে গিয়েছিল সুহাসের, বেঁচেছিল পরিবারটা।

আজ পাঁচ বছর হল সাইকেল-মার্টে কাজ করছে সুহাস। মাস ছয়েক হল সুবু নামে একটা ছেলে এসেছে দোকানে, সুহাসের থেকে কাজ শিখছে। মণ্ডল-জেঠু দূরে কোথাও আর একটা সাইকেলের দোকান খুলবে। সুবুকে তৈরি করছে সেই নতুন দোকানের জন্য।

টায়ারে হাওয়া ভরছিল সুবু। আর দোকানের খাতা দেখছিল সুহাস। ঘোষপাড়ার ছেলেটা হন্তদন্ত হয়ে ঢোকে দোকানে। স্ট্যান্ডে সাইকেল তুলে ছেলেটাকে টোকেন দেয় সুহাস। ঘোষপাড়ার ছেলেটা হনহন করে চলেই যাচ্ছিল, ভাগ্যিস সুহাসের চোখে পড়ে সাইকেলের ক্যারিয়ারে রাখা ছাতাটা! সে উঁচু গলায় ডাকতে যাচ্ছিল ছেলেটাকে, কী ভেবে ডাকে না। নিজেই ছুটে গিয়ে ছাতাটা দিয়ে আসে। সাইকেল-মার্টের শেডের এক কোণে জুতো সারানোর সরঞ্জাম নিয়ে বসে ভোলা।

ছেঁড়া জুতোর সোলে কাঁটা পেরেকটা তাক করে বসাতে বসাতে বলল, ‘তুই কেন শুধুমুধু ছুটলি? ডাকলেই হত, নিজে এসে নিয়ে যেত।’

সুহাস বলল, ‘ওই দ্যাখো ভোলাদা, ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে। ছাতা নিতে ফেরত এলে ছেলেটার ট্রেন মিস হয়ে যেত না?’

ভোলা বলল, ‘তাতে তোর কী?’

ভোলার প্রশ্নের জবাব দেয় না সুহাস। যদিও সে জানে হিসেবমত ভোলাই ঠিক। তবে কবে আর হিসেব কষে চলেছে সুহাস?

অঙ্কে মাথা ছিল সুহাসের। পরীক্ষায় কোনদিন সত্তরের নীচে পায়নি। বাবা বেঁচে থাকলে সেও কলেজে যেত, অফিসে চাকরি করতো। পাশের বাড়ির চম্পাকে সুহাসের খুব পছন্দ। কিন্তু চম্পা পছন্দ করে অশোককে, নন্তুকে। আসলে পছন্দ করার মত কিছুই নেই সুহাসের। সুহাস নিজেই জানে, সে সাধারণ, অতীব সাধারণ। তার লেখাপড়া হয়নি, খেলাধুলায় পিছনের সারির, কথাবার্তায়ও তেমন চৌকস নয়। এদিকে অশোক প্রতিবছর শীতকালে পাড়ার ক্রিকেট টুর্নামেন্টে ক্যাপ্টেন হয়। নন্তু পলিটেকনিক পড়ছে, খুব স্মার্ট।

সুহাসের চিন্তায় ছেদ পড়ে সুবুর চাপা গলার ডাকে, ‘সুহাসদা, মণ্ডল আসছে।’

মণ্ডল-জেঠুর নাম শুনেই সুহাস ঝুঁকে পড়লো দোকানের খাতার দিকে, মেলানো হিসেব আবার হাতের কর গুনে মেলাতে শুরু করলো। আসলে মণ্ডল-জেঠুর কাছে তার ফুলমার্কস চাই-ই, সাইকেল-মার্টের চাকরিটা সে কোনও কারণেই হারাতে চায় না।

সুহাসের কাণ্ড দেখে ভোলা বলে, ‘তোর বাপু নিজের ওপর আস্থা কম। নিজের ওপর ভরসা রাখ সুহাস। তোর যেমন মাসের শেষে মাইনের প্রয়োজন, মণ্ডলের প্রয়োজন একজস বিশ্বাসী মানুষ।’

হিসেব মিলিয়ে মণ্ডল ফিরে গেছে। রাস্তার দিকে তাকিয়ে সুহাস দেখে, ওই যে চম্পা আসছে।

এই বছর চম্পা কলেজে ঢুকেছে। কলেজ যাওয়ার পথে চম্পাও সাইকেল-মার্টে সাইকেল রেখে ট্রেন ধরে কলেজ যায়। চম্পার থেকে সাইকেল নিয়ে টোকেন দেয় সুবু, সুহাস এগোয় না।

চম্পার প্রতি সুহাসের দুর্বলতার খবর রাখে ভোলা। তবে সব দেখে ভোলা বোঝে, আসলে চম্পাকে এড়িয়ে যায় সুহাস। কিন্তু কেন?

ভোলা নিজের মনে চিন্তা করে, চম্পার মুখোমুখি হতে কি সুহাসের অস্বস্তি হয়?




স্টেশনে ট্রেন ঢুকছে দেখে হাতের বই মুড়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো অনিন্দিতা। জানলার পাশের সিট থেকে উঠে এগিয়ে গেল ট্রেনের কামরার দরজার দিকে। আর ট্রেন থামতেই শাড়ি সামলে সে টুপ করে নেমে পড়লো প্ল্যাটফর্মে। সামনেই ওভারব্রিজ। তবে শাড়ি পরে ওভারব্রিজে উঠতে অনিন্দিতার অসুবিধা হয়। এই সেদিন অবধি অধিকাংশ দিনই সে সালোয়ার-কামিজ পরে ইউনিভার্সিটি যেত। বাংলা নিয়ে এম-এ পড়ার সময় কস্মিনকালেও অনিন্দিতা আশাকরেনি, ফাইন্যাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর তিন মাসের মধ্যে সে চাকরি পেয়ে যাবে।

চাকরিটা অ্যাডহক টিচারের, স্কুলটা ছোট্ট শহরতলিতে। তবু চাকরি তো! মাস গেলে কড়কড়ে মাইনে আসছে।

প্ল্যাটফর্মের শেষ অবধি হেঁটে, প্ল্যাটফর্মের ঢাল বেয়ে নেমে, রেললাইনের পাশ দিয়ে একটু এগোলে স্টেশনের প্রাচীরের গায়ে একটা ফোকড় পড়ে। ফোকড় দিয়ে সামান্য মাথা নিচু করে বাইরে এলেই স্টেশন-রোড। রোজকার মত আজও ফোকড় দিয়ে গলে বেরোচ্ছিল অনিন্দিতা, তখনই ম্যাসাকারটা ঘটলো। ফট করে ছিঁড়ে গেল অনিন্দিতার ম্যাচিং স্লিপারের স্ট্র্যাপ!

সাইকেলের দোকানের সামনে একজন মুচিকে বসতে দেখেছে অনিন্দিতা। সে শাড়ি সামলে, ছেঁড়া চটি হেঁচড়ে হেঁচড়ে সাইকেল-মার্টে পৌঁছে দেখে, জুতো সারানোর সরঞ্জাম সাজানো থাকলেও মুচি নিজে নেই।

অনিন্দিতাকে এদিক-ওদিক তাকাতে দেখে দোকানের অল্পবয়সী ছেলেটা বলল, ‘দেরি হবে দিদিমণি, ভোলাদা চা খেতে গেছে।’

দোকানের দ্বিতীয় ছেলেটা, অনিন্দিতার বয়সীই হয়তো, মৃদু গলায় বলল, ‘বসার টুলটা এগিয়ে দে সুবু।’

টিফিনের পর থেকেই আকাশে মেঘ জমছিল।

লাস্ট-পিরিয়ডের মাঝামাঝি তখন, শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। ক্লাস নিতে নিতেও অনিন্দিতার চোখ চলে যাচ্ছিল বাইরে। স্কুলে ঢুকলেই লম্বা বারান্দা। বারান্দার এক পাশ দিয়ে পরপর ক্লাসরুম। বারান্দা থেকে তিন সিঁড়ি নেমে একরত্তি ধূসর মাঠ। ইতিমধ্যেই সেই মাঠ ভরে গেছে জলে।

উফ কী বৃষ্টি শুরু হল, ভালোয় ভালোয় বাড়ি পৌঁছতে পারলে হয়! ছুটির ঘণ্টা বাজতেই অনিন্দিতা ছুটলো স্টেশনে।

স্টেশনে পৌঁছে দেখে হেভি ক্যাচাল, মালগাড়ি ডিরেইলড হওয়ার কারণে আপাতত কর্ডলাইনে ট্রেন বন্ধ। মেঘলা আকাশের দিকে তাকালো সে, কতক্ষণে ট্রেন চলা শুরু হবে রে বাবা? ওদিকে রাতে বাড়িতে যে তার জন্যই পার্টি!

অনিন্দিতা দ্রুত চিন্তা করে। এখান থেকে রিকশা নিয়ে পাঁচ-কিলোমিটার দূরের স্টেশনে পৌঁছে মেনলাইনের ট্রেন ধরে ফিরে গেলে কেমন হয়?

ভাবনাটা মাথায় আসতেই সে আর দেরি করে না, বেরিয়ে পড়ে স্টেশন থেকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, রিকশা স্ট্যান্ডে এসে দেখে একটাও রিকশা নেই।

তখনও টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে।

সে সাইকেল-মার্টের শেডের নীচে ঢুকে দাঁড়ায়।

সাইকেলের টায়ার চেঞ্জ করছিল সুহাস, হাতের কাজ থামিয়ে সে অবাক চোখে তাকায়।

সুবু নিজেই বলে, ‘রিকশা চাই দিদি? কিন্তু ট্রেন বন্ধ, সবাই তো ফিরে গেছে। এখন আর কেউ আসবে না।’

অনিন্দিতার গলা অসহায় শোনায়, ‘সে কী! আমি মেনলাইনের স্টেশনে যাবো। এতটা পথ তো হাঁটতে পারবো না ভাই। আচ্ছা, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখি।’

ধু-ধু কালো আকাশ, নীরব রেললাইন, রিকশার জন্য অপেক্ষারত অনিন্দিতার ছটফটানি দেখে সুহাস বলেই ফেলে, ‘ডাবলরাইডিং পারবেন? তাহলে পৌঁছে দিতে পারি।’

অনিন্দিতা যেন হাতে চাঁদ পায়, সঙ্গে সঙ্গে মাথা হেলায়, ‘হ্যাঁ, পারবো।’

‘তাহলে দু-মিনিট দাঁড়ান। বেরোনোর আগে টায়ারের হাওয়া চেক করে নিই। আর শাড়িটা গুছিয়ে বসবেন কিন্তু। মাডগার্ড থাকলেও কাঁচা রাস্তায় কাদা ছিটবেই।’




সাইকেলে সুহাসের পিছনে উঠে বসে অনিন্দিতা। প্যাডেলে চাপ দেয় সুহাস। সাইকেলের চাকা গড়িয়ে যায় স্টেশন-রোডে। প্রথম দু-চার মিনিট সামলে থাকলেও ব্যালেন্স রাখতে সুহাসের শার্ট খামচে ধরতেই হয় অনিন্দিতাকে। সাইকেল স্টেশন-রোড হয়ে ঢোকে বল-খেলার মাঠের রাস্তায়।

সুহাস বলল, ‘এখনও অনেকটা পথ দিদি। সামনেই বড়দিমনির বাড়ি। আজ নাহয় এখানেই থেকে যেতেন।’

অনিন্দিতা বলল, ‘আসলে আজ আমার জন্মদিন। কয়েকজন নিমন্ত্রিত আসবেন বাড়িতে। নাহলে সত্যিই থেকে যেতাম।’

সুহাস চুপচাপ শুনলো, কোন উত্তর দিল না।

অনিন্দিতাই আবার বলে, ‘তোমার জন্মদিন কবে সুহাস?’

‘সাতাশে শ্রাবণ দিদি।’

অনিন্দিতা হাল্কা চালে জিজ্ঞাসা করে, ‘আর মাত্র পঁচিশ দিন। কী প্ল্যান জন্মদিনে?’

সুহাস মৃদু স্বরে বলে, ‘আমার আবার জন্মদিন! খেয়ালই থাকে না। সোম থেকে শনি শুধু কাজ আর কাজ। রাতে খাওয়ার সময় পায়েসের বাটি দেখে মনে পড়ে আজ আমার জন্মদিন। দিনক্ষণ মনে রেখে মা ঠিক ওটুকু করে দেয়।’

অনিন্দিতা শোনে, আর কিছু বলে না।

রাস্তা এবড়োখেবড়ো। জলো হাওয়ায় শীত শীত করছিল অনিন্দিতার।

তবু তারা বেশ যাচ্ছিল।

তবে পিচের রাস্তা হয়ে, খোয়া ঢালা রাস্তা পেরিয়ে, দীঘির পাশের কাঁচা রাস্তায় ঢুকতেই অনিন্দিতা নড়ে বসে।

চারদিক বড় শুনশান। মেঘলা দিনে বিকেল পাঁচটাতেই কেমন ঝুপসি অন্ধকার নেমে এসেছে চারপাশে। সুহাস ছেলেটা একদমই অচেনা। এরকম একজন অজানা অচেনা মানুষের সঙ্গে রাস্তায় বেরোনো কি ঠিক হয়েছে? ফাঁকা জায়গার সুযোগ নিয়ে এখন ছেলেটা যদি উল্টোপাল্টা কিছু করে? শারীরিক আক্রমণ না করলেও ছিনতাই করতে পারে!

অনিন্দিতার সন্দেহ লাফ দিয়ে আকাশে ওঠে যখন দীঘির ঘাটের পাশে সুহাস সাইকেল থামিয়ে নেমে দাঁড়ায়।

আত্মরক্ষার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হয় অনিন্দিতা, রুক্ষ ভঙ্গীতে বলে, ‘এখানে দাঁড়ালে কেন?’

ততক্ষণে সুহাস মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে। সে বলল, ‘এক মিনিট দিদি। চেনটা পড়ে গেছে।’

সুহাস বলে একমিনিট, কিন্তু অনিন্দিতার মনে হয় যেন এক আলোকবর্ষ।

সে তীক্ষ্ণ চোখে নিরীক্ষণ করতে থাকে সুহাসকে।

মাঝারি উচ্চতা, শ্যামলা গায়ের রঙ, তেল প্যাচপ্যাচে চুলের সুহাস বেগড়বাই করলেই সে দেখে নেবে। তবে সেরকম কিছুই হয় না। অনিন্দিতা নিরাপদে পৌঁছে যায় গন্তব্যে। স্টেশন চত্বরে ঢুকে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে যেন।

পরক্ষনেই সুহাসের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মরে যায়।

উফ, কী ভালো সুহাস নামের এই ছেলেটা। নিজের কাজের ক্ষতি করে, পাঁচ-কিলোমিটার পথ উজিয়ে তাকে স্টেশনে পৌঁছে দিল।

আর সে নিজে? সুহাসের সাইকেলে চড়ে, সুহাসের শার্ট খামচে ব্যালেন্স রাখতে রাখতে সুহাসকেই সন্দেহ করছিল!

অনিন্দিতা লাজুক হাসে, ‘ট্রেনের তো দেরি আছে। একসঙ্গে বসে একটু চা খেলে হত না?’

সুহাস মাথা নাড়ে, ‘না দিদি, সুবু একা আছে, আমি যাই।’

অনিন্দিতা ভ্রুভঙ্গি করে, ‘ঠিক আছে, যাও। তবে দিদি নয়। আমার একটা নাম আছে, অনিন্দিতা।’

কাঁচা রাস্তা দিয়ে ফেরার পথে আবার ঝেঁপে বৃষ্টি এলো।

বৃষ্টির ধারাপাতে ধুয়ে যেতে যেতেও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সুহাস।

যাক, দিদিমণি স্টেশনে ঢোকার পর বৃষ্টি নেমেছে। আর নিরাপদে পৌঁছে গিয়েছে দিদিমণি। নাহলে দীঘির পাশে সাইকেল থামিয়ে চেন লাগানোর সময় ভয়ে তার বুক ঢিপঢিপ করছিল।

দীঘির পাশের তল্লাটটা কালুর। আর কালুর স্বভাব এ অঞ্চলের সবাই জানে। কোন মেয়ের প্রতি কালুর নজর পড়লে তার আর নিস্তার নেই।

দিদিমণি চকচকে শহুরে মেয়ে, গায়ে সোনার গয়না। শরীরের লোভে না হোক, গয়নার লোভে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতো শয়তানটা।

আহা, দিদিমণিটা কী ভদ্র, কী সুন্দর নাম, কেমন মিষ্টি হেসে সুহাসকে চা খেতে ডাকল!




সকাল এগারোটা। স্টেশন-রোডে বাজার জমে উঠেছে। মণ্ডলের রিকশা এসে দাঁড়ালো সাইকেল-মার্টের সামনে।

মণ্ডল রিকশা থেকে নামতেই সুবু বলল, ‘কাল রাত থেকে সুহাসদার মা’র ধুম জ্বর। সুহাসদা খবর পাঠিয়েছে, আজ তার আসতে দেরি হবে।’

সুহাসের জন্য অপেক্ষা না করে মণ্ডল নিজেই খাতা মিলিয়ে চলে গেছে।

সাড়ে এগারোটা নাগাদ উসকোখুসকো চুলে হন্তদন্ত হয়ে সুহাস ঢুকল দোকানে। জিজ্ঞাসা করলো, ‘জেঠু এসেছিল?’

সুবু ঘাড় নাড়ে, ‘হ্যাঁ। খাতা দেখে চলে গেছে।’

সুহাস তাড়াতাড়ি খাতা খুলে বসতে যাচ্ছিল।

পিছন থেকে সুবু ডাকল, ‘এই দ্যাখো সুহাসদা, সেদিনের সেই দিদিমণি এই প্যাকেটটা রেখে গেছে তোমার জন্য।’

প্রথমে সুহাস অবাক হয়, তারপর তার ভুরু কুঁচকে ওঠে। প্যাকেট? দিদিমণি? কেন?

অনিন্দিতার দিয়ে যাওয়া সোনালি রঙের প্যাকেটটা সুবুই খোলে।

প্যাকেট থেকে বেরোয় এক বাক্স চকোলেট আর একটা চিরকুট; তাতে লেখা, ‘সাতাশে শ্রাবণ। শুভ জন্মদিন। অনিন্দিতা।’

চিরকুটটা পড়ে আনন্দে সুহাসের হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে ওঠে। তার যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস হয় না। সে বারবার পড়ে মুক্তোর মত হরফে অনিন্দিতার হাতে লেখা মেসেজটা।

সুহাসের সামনে এখন রাশি রাশি কদমফুল… হঠাৎই সে উচ্চতায় অনেকটা বেড়ে গেছে… পৌঁছে গেছে তারাদের দেশের কাছাকাছি।

সুহাস আবেগে আপ্লুত, কী আশ্চর্য, দিদিমণি মনে রেখেছে কথায় কথায় বলা তার মত সামান্য মানুষের জন্মদিনের তারিখটা!

না না, দিদিমণি নয়, অনিন্দিতা।

মৃদু হাসি ফুটে ওঠে সুহাসের ঠোঁটের কোণে, বিস্ময় ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে অভ্র রেণুর মত ছড়িয়ে যায় তার চোখেমুখে।

রাস্তার দিকে তাকায় সুহাস, দেখে, ওই যে চম্পা আসছে।

আজ আর সুবু নয়, সুহাস নিজেই চম্পার থেকে সাইকেল নিয়ে স্ট্যান্ডে রাখে, টোকেন দেয়।

চলে যাওয়ার আগে চম্পা কি একবার ফিরে তাকালো সুহাসের দিকে?

সুহাসের অবশ্য সেদিকে খেয়াল নেই, ততক্ষণে সে অন্য খরিদ্দার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

ছেঁড়া চটির সোলে পেরেক মারতে মারতে সবটুকু দেখে ভোলা। মনে মনে ভাবে, হল কী রে বাবা, কোন দিকে সুয্যি উঠেছে আজ?

তবে সুহাসের ঝলমলে মুখের দিকে তাকিয়ে ভোলার মুখও খুশিতে ভরে যায়।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *