short-story-je-ghotona-ghotte-pare

যে ঘটনা ঘটতে পারে
অমর মিত্র


বাসে ভীড় তেমন নেই। এমনিতে এ লাইনে মেট্রো চালু হয়ে বাসের সেল কমে গেছে। পেট্রলের দাম বাড়তে বাড়তে আজ কত, কাল কত ছিল, আগামীকাল কত হবে কেউ জানে না। তিন কদম উঠলে এক কদম নামে আবার দুই কদম বাড়ে। কিন্তু বাসের আয় বাড়াতেই হবে। বাজার আগুন। আয় বাড়াতেই সকলে ছুটোছুটি করছে। বাস অটো, অটো বাস করছে। আর তাই বাস ঢিমে তালে চলছে। প্যাসেঞ্জার নেওয়ার জন্য থামলে আর নড়তেই চায় না। স্টপেজে স্টপেজে

প্যাসেঞ্জার জমা হলে, তার লাভ। বেশি লোক নামবে, বেশি লোক উঠবে। খুচরো প্যাসেঞ্জারে আয় বাড়ে। রাস্তা এমনিতে ফাঁকা। অনেক বাস বসে গেছে। রাত ন’টার পর প্যাসেঞ্জার কমে যায়। চালিয়ে লাভ নেই। বাস অতি মন্দগতিতে চলছিল। ঘুম ঘুম চলন। ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে চলা। বাসের এই চলন সহ্য করতে না পেরে একজন চিৎকার করে উঠল, এই কনডাক্টর, আবে এই কন্ডাক্টর?

কন্ডাকটর আমলই দিল না। এ কানে ঢুকল, অন্য কান দিয়ে ফুস হলো। বিড়বিড় করল, শুয়োরের বাচ্চার টাইম নষ্ট হচ্ছে, সোনাগাছি যাবে, আরে হোল নাইট পড়ে আছে।

-এই বাঞ্চোত, বাস চালাবি কি চালাবি না?

-খিস্তি দেবেন না, বাসে অনেক রকম প্যাসেঞ্জার আছে, একজন বলল। সে বিরক্ত হচ্ছিল তার সহযাত্রীর কথায়।

-খিস্তি দেব না, মন্ত্র পড়ব, সেই এসপ্লানেড থেকে বেরোনর পর ঢিক ঢিক করছে, এই ড্রাইভার, ঘুমিয়ে পড়লি না কি?

কন্ডাক্টর এমনি প্যাসেঞ্জার চেনে। রোজই একজন দু’জন বাসে উঠেই নির্দেশ দিতে থাকে কীভাবে

চালাতে হবে। সব বাস ওভারটেক করে চলে যাচ্ছে। অত জোরে চালাসনে, মারবি নাকি? কত সময় স্টপেজে দাঁড়াবি, চালা চালা, এই বেটা, সোনাগাছিতে প্যাসেঞ্জার পাবি।

এইসব শুনতে শুনতে কন্ডাক্টর মেডিকেল কলেজ, ময়াত্তা গান্দি রোড, মোহাজাতি সদন, রাম মন্দির, জুড়াসাঁকো, মসজিদবাড়ি, বিডিন ইস্টিট, শুভাবাজার, শ্যামবাজার, সিঁথি, ডানলপ হাঁকতে লাগল। বাস কিন্তু দাঁড়িয়েই আছে। লোকটা গর্জন করে উঠল, এই ড্রাইভার, আমাদের কি সময়ের দাম নেই?

বাস নড়েই না। একগুঁয়ে বাস ঘাড় হেট করে বার্তা দিচ্ছে, ইচ্ছে হলে চলব। আর একজন মৃদু গলায় বলল, আরে ভাই চালাও।

-কী চালাব, ক’জন প্যাসেঞ্জার বলুন। কন্ডাক্টর তার দিকে চেয়ে কাতর হয়ে বলল, আজ সেল খুব খারাপ, মালিক কী পাবে আর আমরা কী পাব?

-আরে যা যা, তোদের পেট আর ভরে না, রাক্ষুসে খোল। সেই গর্জমান লোকটা বলল। বেশ দশাসই চেহারা, ঘাড়ে গর্দানে এক। সিটের এক তৃতীয়াংশ দখল করে আছে। মাথায় চুল নেই। সব চুলই তার হম্বিতম্বিতে ঝরে গেছে একে একে। এখনই একটি বা দুটি ঝরে গেল। বাকি কয়েকটি যাবে যাবে করছে। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। কথাটা বলে তার প্রতিক্রিয়া না পেয়ে সে ক্ষিপ্ত হয়ে গেল প্রায়, বলল, যা না শালা ভিক্ষে করগে না, কখন উঠেছি, কখন নামব ঠিক নেই।

কন্ডাক্টর টিংটিং করল দড়ি টেনে। মিনিট কয়েক মানে একটা সবুজ সিগনাল ঠেকিয়ে লাল সিগনাল মেরে আবার সবুজ আসাতে টিংটিং। বাস গড়াতে গড়াতে ওপারে গিয়ে সাইড করে দাঁড়ায়। আবার দম ফেলছে। সামনে অনেকটা, জোড়াসাঁকো, রামমন্দির, মসজিদবাড়ি প্রায় বিডন স্ট্রিট পার হয়ে শোভাবাজার পর্যন্ত ফাঁকা রাস্তা। স্টপেজে লোক নেই। লোক জমার সময় দিতে হবে। আগে একটা যাচ্ছে প্যাসেঞ্জার তুলে নিতে নিতে। সে অনেকটা দূর গেলে এই বাস চলতে পারবে নিজের মতো। স্টপেজে প্যাসেঞ্জার জমা হবে। আবার সেই হুমদো লোকটি গর্জন করল, ভিখিরি ভিখিরি, কৌটো নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়, বাড়ি গিয়ে লোক ডেকে আন।

কন্ডাকটর রোগা। মাথার চুল উলুঝুলু। তেল নেই, ধুলো-ময়লায় জট পাকিয়েছে। বিড়ি ধরিয়েছিল। বিড়িটিতে শেষ টান দিয়ে আঙুল আর নখের ডগা দিয়ে বিড়িটি রাস্তায় ফেলে দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, সারাদিন আমাদেরও কত ভিক্ষে দিতে হয়।

-কী বললি, কী বললি তুই? সে প্রায় উঠে আসে আর কী।

-আঁজ্ঞে স্যার সত্যি, দেখলেন না বউবাজার সেন্ট্রাল মেট্রো মোড়ে দিলাম, দুশো নিয়ে ছাড়ল।

-অন্যায় করলে নেবেই। লোকটা বলল, এইটা বাস চালানো হচ্ছে!

-কত অন্যায় করলে কত ফাইন হচ্ছে, আমাদের ইয়ে না মারলে ওদের হয় না, মাসে হাজার বারোশ ওদের পেটে যায়।

-এই বাজে কথা বলবি না, বাসটা চালা।

-বাজে কথা কী বলছি, সত্যি বলছি।

-চালাবি, না দাঁড় করিয়ে রাখবি?

বাস তো দাঁড়িয়ে ভোঁসভোস করছে। ড্রাইভার স্টিয়ারিং ধরে উদাস হয়ে তাকিয়ে আছে সামনে। লোকটার কথার উত্তর দিয়ে লাভ নেই। একএকদিন এমন হয়। রাস্তার প্যাসেঞ্জার সব উধাও হয়। আজ কি ক্রিকেট খেলা আছে কোনো। ইডেন গারডেনে আলো জ্বলছিল, মানে খেলা আছে হয়ত। সন্ধের পর আরম্ভ হয়ে রাতে গিয়ে শেষ হয়। ড্রাইভারের কানে সব বাক্যালাপ প্রবেশ করছিল। তার মনে পড়ছিল এক দীর্ঘ সময়ের কথা। সব বাস বসে ছিল। রাস্তায় বেরোন মানা ছিল। পুলিশ লাঠি হাতে ঘুরছিল। সেই সময় তার খুব ইচ্ছে হতো কামারহাটি বন্ধ ফ্যাক্টরি এরিয়া থেকে বাস বের করে ধর্মতলা পনের মিনিটে চালিয়ে আসবে। রাস্তায় গাড়ি নেই, লোক নেই, রোদ ঝনঝন চতুর্দিক। সে গান গাইতে গাইতে ছুটে যাবে ধর্মতলা। ধর্মতলা থেকে টালিগঞ্জ, নাকতলা, গড়িয়া। সে আর কন্ডাক্টর পিকলু। পিকলু ধর্মতলায় পৌঁছে চিৎকার জুড়েছে, ধরমতলা, গাছতলা, নিমতলা, কেওড়াতলা, বকুলতলা, আমতলা…। নিঝুম রাস্তা দিয়ে পিকলুর কন্ঠস্বর বাতাসে ভাসতে ভাসতে, ঢেউয়ে ঢেউয়ে কতদূর চলে যাচ্ছে। জানালার খোলা কপাট দিয়ে ঘরের ভিতরে। আর বলবেন না স্যার, ফিটনেস বের করতে কত দিতে হয়েছে জানেন, ভিক্ষে না, তোলা বুঝতে পারিনে। কন্ডাক্টর কাউকে বলল, সবাই যে যাকে পারছে টিপে মারতে চাইছে।

বাস গরগর করল। হুমদো লোকটি বলল, সরকার ভাড়া বাড়ায়নি, তোরা বাড়িয়ে দশ টাকা করে দিয়েছিস, আমরা তা দিচ্ছি, এবার আমাদের কথা মতো চালাবি বাস।

কন্ডাক্টর কিছু বলবে বলবে করেও বলল না কিছু। ক’জন প্যাসেঞ্জার উঠল। গুনে দেখল সে।

পাঁচজন। এর ভিতরে একজন উঠল টলটলায়মান। সে উঠেই বলল, ফাঁকা বাস, আচ্ছা ঘুমাই।

-আপনি নেমে যান। কন্ডাক্টর বলে, বাসে ঝামেলা পাকাবেন না।

-ঝামেলা পাকালাম কখন চাঁদু, এই তো উঠলাম। লোকটা জট পাকানো গলায় বলল।

-মাতাল বাসে নেওয়া বারণ।

-আমি মাতাল, আমি গঙ্গার চাতাল, আমি কি হেঁটে যাব, চাঁদু। বলে সে মাথার উপরের রড ধরল। একটু টলে টলে এগোতে লাগল। গান গাইতে লাগল, আজা আজা, ম্যায় হুঁ প্যার তেরা, আহ হা আজা, আহ হা আজা, আহ হা হা, তিসরি মঞ্জিল, শাম্মি কাপুর, আশা পারেখ, দেখেছে কেউ?

হুমদো বলল, নামিয়ে দে কন্ডাক্টর, নামিয়ে দে, বাসে কীত্তন চলবে না।

-আলবৎ চলবে, আব্বে, তোর বাপের বাস। বলতে বলতে সে ধপাস। সিটেই বসল বটে। কিন্তু যার পাশে বসল, সে উঠে গিয়ে অন্য জায়গায় বসল। কন্ডাক্টর বলল, আপনাদের বাস, আপনারা বুঝবেন, বমি করলে ধুয়ে দেবেন।

হুমদো লোকটি বলল, অ্যাই, অ্যাই কন্ডাক্টর, বাসটা চালা, ওকে সোনাগাছির সামনে নামিয়ে দে, ও সেখানকার খদ্দের, আমি জানি।

বাসে দুজন বয়স্ক, একজন বছর বত্রিশ-তেত্রিশ, একজন বছর বাইশ তেইশের মহিলা। তারা শঙ্কিত হয়ে বসে আছে। জানালা দিয়ে সকলেই বাইরে তাকিয়ে।

বাস আচমকা গতি নিয়ে ছুটতে আরম্ভ করল। পেছনে কেউ এসে গেছে। বাসের গতিতে হুমদো প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল। কন্ডাক্টর দরজায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগল জুড়াসাঁকো, রামমন্দির, মসজিদবাড়ি ইস্টিট, গিরিশ পার্ক, শ্যামবাজার, পাইকপাড়া, চিড়িয়ামোড়…।

-আরে আমি নামব নামব নামব। কে একজন চিৎকার করে উঠল।

বাস প্রবল বেগে ছুটে যাচ্ছিল।


দুই


হুমদো লোকটির নাম ধরা যাক বিকাশ। বিকাশ যায় ধর্মতলা থেকে পাইকপাড়া। মেট্রোতে খুব সুবিধে হয় না। নেমে আবার কিছু ধরতে হয়। এই রুটে অনেক বাস। সব বাসেই সে ঝগড়া করে। জোরে চালালে হবে না। আস্তে চালালেও হবে না। তার মনের মতো করে চালাতে হবে। মনের মতো যে কী, তা সে জানে না। বাসের বছর তেইশ-বাইশের তরুণী একটু চঞ্চল হয়েছে। লাল শাড়ি ব্লাউজ, বয়কাট চুল, চোখে চশমা। সে ডাকল কন্ডাক্টরকে, ভাড়া নেবে ভাই?

কন্ডাকটর বলল, বিডন স্ট্রিট?

-না, লাল মন্দির। তরুণী বলল।

-আচ্ছা, শোভাবাজার ছাড়িয়ে, লাল মন্দিরে স্টপেজ নেই, দিদি।

-তাহলে শোভাবাজার, মিত্র কাফে থেকে ফিস ফ্রাই নিয়ে বাড়ি যাব।

হুমদো বিকাশ বলল, এই কন্ডাক্টর, আস্তে চালাতে বল, এত প্যাসেঞ্জার নিয়ে ছেলে খেলা না!

কন্ডাক্টর বলল, দিদি উঠে আসুন, দরজার পাশে বসুন, এক্ষুনি এসে যাবে, শোভাবাজার মিত্র কাফে, ভেটকির ফ্রাই, ডিমের চপ…। বলে হিহি করে হাসতে লাগল। হেবি গন্ধ ছাড়ে, বাস থেকেও পাওয়া যায়।

-খেয়েছ কোনো দিন?

-না, গন্ধ নিয়েছি, দাঁড়ানোর উপায় নেই, একদিন ব্রেক ডাউন করিয়ে দেব বাস, স্টিয়ারিং হাতে পাই।

-তুমি চালাতে পারো?

-পারি, হপ্তায় একদিন, হাফ টিপ, কামারহাটি থেকে পাইকপাড়া, তাও যদি নোটনদা অ্যালাও করে।

লোকটা মানে পাইকপাড়ার বিকাশ আর সহ্য করতে পারল না। বলল, ফিস ফ্রাই। শালা তোদের গরমেন্ট মছলি বিক্রি বন্ধ করে দেবে, মিত্র কাফে উঠে যাবে, সাধু বাবারা বলছে, বলছে সব নিরিমিষ, তখন ফিস ফ্রাই কে খাবে?

-আপনাকে কে মাথা গলাতে বলেছে। তরুণী ক্ষুব্ধ গলায় বলল।

-মাছ খেলে জেল জরিমানা, নিরিমিষে শরীর ভালো থাকে। লোকটা তরুণীর কথা অগ্রাহ্য করল, সেই দিন আসছে, যখন মাছেরা হেসে খেলে বেড়াবে।

-দূর বাবু, এমন সব বলো তুমি। কন্ডাক্টর হেসেছে এবার, সবার কথায় কথা বলা দরকার।

বাস টাল খেতে খেতে চলছিল। একজন বলল, হয় ড্রাইভার না হয় বাসের ইঞ্জিনে হুইস্কি ঢুকেছে।

তার বন্ধু হা হা করে হাসল।

বাসে লোক উঠতে লাগল। এই তো অনেক হয়েছে এবার সাবধানে চালাও ড্রাইভার। ড্রাইভারের

নাম নোটন। কালো স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে। রঙটা গরমে ঝলসে গেছে। সে লুকিং গ্লাস দেখল। পেছনের বাস মনে হয় দাঁড়িয়ে গেছে। তাহলে আর ছুটিয়ে লাভ কী? তখন সেই হুমদো বিকাশ বলল, আরে ড্রাইভার আস্তে চালা।

ড্রাইভারের মাথা গরম হয়ে গেল, বাস থামিয়ে দিল। কন্ডাক্টর বাস থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলতে লাগল। সেই তরুণী নেমে হাঁটতে লাগল। সামনে একটু গেলেই সেই মিত্র কাফে, ফিশ ফ্রাইয়ের গন্ধ। কন্ডাক্টর ঘুরে আবার বাসের দরজায় এল। একজন জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

-জোরে চলছিল, তাই আস্তে চলছে।

এই সময় মাতালের ঘুম ভাঙল। চোখ মুছতে মুছতে সে বলল, বেলঘরিয়ায় চলে এলাম।

কন্ডাক্টর বলল, হ্যাঁ, খড়দা।

মাতাল উঠল। বলল, এদিকে বাংলার দোকান আছে?

-আছে, এগিয়ে যাও। বলল কন্ডাক্টর, ফাস ক্লাস পাবে, আমরা খাই।

মাতাল ধীরে সুস্থে নামল। জায়গাটা অন্ধকার। মাতাল এগোল। বাস চলতে শুরু করল। বাস আচমকা গতি বাড়িয়ে খুব জোরে এগিয়ে গেল শোভাবাজারের দিকে। হুমদো লোকটি, তার নাম একটি দিতে হয়। দিয়েছি তো। সে বিকাশ। বলল, আবার সেই, পাগলা নাকি, এই ড্রাইভার, ক’পাঁইট মেরেছিস?

তখন ড্রাইভারের মনে হচ্ছিল বাস ঘুরিয়ে নিয়ে পেছনে চালিয়ে দেয়। যেদিক থেকে এল সেই দিকে ফিরে যায়। ভেল্কি। ভেল্কি কি হয় না? পুলিশ কেস দিয়েছে ফালতু। সে সিগনাল ভাঙেনি, তবু। এইসব কেসের টাকা তাদের কমিশন থেকে কাটা পড়বে। সে ব্যাক করে ধর্মতলায় নিয়ে গিয়ে লোকটাকে ছেড়ে দেবে। যাহ, শালা, এই তোর পাইকপাড়া। এক একদিন পুলিশ এমনি রাস্তা আটকে দেয়। যেদিকেই যাও, নো এন্ট্রি, বাস ভর্তি প্যাসেঞ্জার নিয়ে চর্কির মতো ঘুরে চলো। এখন তেমনি হয়ে যাক। বাবু ঘাটের পরিবর্তে বেলেঘাটা গিয়ে বাইপাস রাস্তা, তারপর সায়েন্স সিটির উল্টোদিক দিয়ে বাসন্তী হাইওয়ে, একেবারে সুন্দরবন। বাঘের রাজ্যে ছেড়ে দিয়ে আসবে লোকটাকে।

-এই কন্ডাক্টর ডিজেলের দাম তো কমেছে। সেই বিকাশ বলল। তার স্বভাব এই। খিটখিট করতেই অভ্যস্থ। সকলের কথার ভিতরে ফোড়ন কাটতে অভ্যস্থ। বাসে ট্রামে বাজার-ঘাটে, ফুটপাথে, রাস্তায় কারো না কারো সঙ্গে তার লাগবেই। মাছ হোক সবজি হোক, চিকেন হোক, যে কোনো বিক্রেতার সঙ্গে লাগেই। মিটে যায় না। পরদিন আবার শান্ত হয়ে শুরু হয়। সিটের জানালার ধারে বসেছিল সে। তার সামনের সিটে বসা বছর ষাটের প্যান্ট, টিশার্ট পরা এক ব্যক্তি বলল, এত চিৎকার করছেন কেন?

-আপনার অসুবিধে হচ্ছে?

-হচ্ছে বলেই তো বলছি।

-সিট তো ফাঁকা আছে পেছন দিকে, চলে যান।

-আপনি রাস্তার দিকে মুখ বাড়িয়ে হেঁড়ে গলায় চিৎকার করুন, ডিস্টার্ব করবেন না।

-এই কন্ডাক্টর, ডিস্টার্ব করো না, বাস চালাও।

বাস চলছিল। ধীরে ধীরে। বাস ভরে উঠছিল প্যাসেঞ্জারে। তখন বিকাশ বলল, রাক্ষুসে ক্ষিদে মেটে না, বাস বন্ধ করে দিক সরকার, হেঁটে বাড়ি যাব।

-আপনার ক্ষিদে মেটে? সামনের লোকটি বলল, আয় করতেই তো বেরিয়েছেন।

-আপনাকে বলেছি?

-বলেছেন। তিনি, সুগত রায় বললেন।

-আজব লোক তো আপনি, এই কন্ডাক্টর, আমি এঁকে বলছি, গায়ে পড়ে ঝামেলা লাগাচ্ছে, পাইকপাড়ায় নামিয়ে নেব।

কন্ডাক্টর এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বলল, হ্যাঁ, আমিই নামিয়ে দেব, টিকিট।

-পাইকপাড়া চ, টিকিট দেব।

-আচ্ছা, তাই দিও। কন্ডাক্টর বলল, স্যার আপনার হয়ে গেছে?

সুগত উঠে ভাড়া দিয়ে সামনের দিকে দূরে আর একটি সিট খালি হওয়ায় সেখেনে গিয়ে বসল। কন্ডাক্টর আবার তার গেটে ফিরে গেল। বিকাশ বলল, ভালো ভাবে বাস চালা, টিকিট পাবি, পয়সা ফোকটে আসে না, আই পি এল মার গেল তোদের জন্যে।

শোভাবাজারে বাস দাঁড়িয়েছে সিগনালে। বাতাসে ফিস ফ্রাইয়ের গন্ধ। বিকাশ তার ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে গলা ভেজালো। উফ, কী গরম! একটা ঝড়বৃষ্টি হোক রে বাবা, অনেক দিন হয়েছে, আর কত, শালা রাস্তায় এগোনর উপায় নেই। জ্যাম জ্যাম আর জ্যাম। বাস ইচ্ছে করে জ্যামে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সামনের বাসটি মনে হয় খারাপ। এই ড্রাইভার, কোথায় ঢোকালি বাঞ্চোত, আমি কি বাড়ি যাব না, আই পি এল দেখব না, সন্ধেটাই মার গেল।

-নিয়ে যাচ্ছি, নিয়ে যাচ্ছি। বলতে বলতে বাস ইউ টার্ন নিল। ইউ টার্ন নিয়ে বাসের পিছনে বাস, তার পিছনে ট্যাক্সি, দুইয়ের সম্মুখে এবং পিছনে দুই চাকা ঠেকিয়ে সুইগির ডেলিভারি বয়, টানা রিকশা-ইত্যাদি বিকট জ্যাম কাটিয়ে যে পথ ছেড়ে এসেছে, সেই পথে ফিরতে লাগল। হ্যাঁ তাই। বিকাশ স্পষ্ট দেখল। জ্যামে এমন হয়ে থাকে, এই রাস্তা ছেড়ে অন্য রাস্তা ধরবে। পুলিশ নিশ্চয় বাস ঘুরিয়ে দিয়েছে। হয়ত রাস্তা জুড়ে মিটিং চলছে, না হয় অবরোধ। রাত্তিরেও তা হয়ে থাকে। হয়ত দশ ঘন্টা আলো নেই, জল নেই। সুতরাং রাস্তা বন্ধ। ডাউনে ছুটতে লাগল আপের বাস। বিকাশ জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখল, বাস ফেলে আসা পথে ছুটছে। কী সব্বোনাশ। সে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগল, ড্রাইভার, কী হচ্ছে, বাস ধর্মতলার দিকে ছুটছে কেন, এই মাইরি দেরি হয়ে যাব, আই পি এল না, টিভিতে ঘন্টাখানেক তক্কো হবে, আজ পাড়ার জিতেনদা বসবে, শাসক, আমি শাসক দলের, তোর গুয়ো মারা যাবে, লালবাজারে আমার ভগ্নিপতি আছে, এই এই এই।

কন্ডাকটর বেল বাজিয়েই চলেছে। চালাও চালাও চালাও।

-এই কোথায় যাবে এই বাস?

-আরে তুমি বসবে, বাস ঠিক যাচ্ছে। কন্ডাক্টর বলে উঠল, মুখে এবার কাপড় গুঁজে দেব।

-দে না, কত সাহস দেখি, বাস ঠিক যাচ্ছে না, এই যে বিবেকানন্দ রোড চলে এল, স্বামীজির বাড়ি বাঁদিকে গেলে, শিমলে, আবে এই বাস, দক্ষিণে যাচ্ছিস কেন, উত্তরে চ।

-যাচ্ছে তো দাদা। সেই সুগত বলল।

-না যাচ্ছে না, শালা টিভি দেখা হবে না, শাহরুখের নাইট রাইডার্স দেখা হবে না, জিতেনদাকে কী বলব, ফালতু রেগে যাবে, টিভিতে প্রথম চান্স পেয়েছে, এর ভিতরে সব ছক্কা হয়ে যাবে, ইনিংস শেষ, পুলিশ এই পুলিশ, এই যে স্যার। জানালা দিয়ে মুণ্ড বাড়িয়ে বিকাশ কাকে ডাকতে লাগল তা সে-ই জানে না। রোগা, কালো স্যান্ডো গেঞ্জি, কাঁধে গামছা, ঘর্মাক্ত ড্রাইভার হাসছিল। তার হাতে স্টিয়ারিং। সে দরকারে বাসটাকে ব্রিজ থেকেও ফেলে দিতে পারে। চ, ধর্মতলা, নাকতলা, গাছতলা চ, সাউথ কলকাতা চ। বাস স্টপেজে দাঁড়ায়, প্যাসেঞ্জার তোলে, প্যাসেঞ্জার নামায়। বাস চলতে থাকে। বাগবাজার পার হয়ে যায়। টালা ব্রিজে উঠে পড়ে। লোকটা আতঙ্কিত চোখে দেখতে থাকে বাসের ফেলে আসা পথের দিকে ক্রমাগত ছোটা। বউবাজার, ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন্স পার হয়ে সিগনাল না মানা বাস ছুটছে পিছনে। লোকটা ভয়ে ভয়ে বলল, আরে একি হচ্ছে, আমি কোথায় যাচ্ছি?

কে একজন বলল, গঙ্গায়।

ড্রাইভার বাস নিয়ে ব্রিজ থেকে নেমে এল। বিটি রোড ধরে ছুটতে লাগল। সামনে সেই বাস, যে তার প্যাসেঞ্জার তুলে নিচ্ছিল। বিকাশ ভয়ে জানালার কপাট তুলে দিল। বাস ছুটতে ছুটতে ডানলপ পেরিয়ে কামারহাটি দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। কন্ডাক্টর বলল, পাইকপাড়ায়, নেমে যাও।

বিকাশ বলল, পাইকপাড়া এইটা?

-নিজের স্টপেজ চিনতে পার না? কন্ডাক্টর তার কাঁধের ব্যাগ সামলে নিয়ে বলল, ভাড়া তো দাওনি, দাদা।

বিকাশ বলল, চিনতে পারছিনে, কত বদলে গেছে, আমার বাড়ি কোন দিকে?

ড্রাইভার নোটন ঘাম মুছতে মুছতে বাস থেকে নেমে বলল, বদলে দিলাম, ফের বদলে দেব কাকা, লাস্ট ট্রিপ হয়ে গেল, এই যে স্যার, আবার কাল সকালে, কামারহাটি টু কামারকুণ্ডু, নিমতলা, কেওড়াতলা, গাছতলা, বকুলতলা।

কন্ডাক্টর পিকলু বলল, মাইরি কাকা, ভেল্কি দেখালে বটে, রাইট টাইমে এসে গেছি।

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *