নিলুফা আক্তার
শেষ পর্যন্ত ডিমে তা দিয়ে ভবিষ্যত সন্তানের আশ্রয় হয়ে বেঁচে থাকা মা-মুরগীকে নিয়ে গল্পের শুরুও হয় না আবার শেষও না! মহল্লাবাসীর অহেতুক ক্যাচালের সুযোগে, মানুষের ধাওয়া খেয়ে পলাতক অজগরটা আবার একটা পালা মুরগীকে গিলে নির্বিঘ্নে পালিয়ে গেল। গিলে খেলোও সেই মা-মুরগীকেই! বাড়ির মালিকের জন্য সে খুব পয়মন্ত ছিল। তার কনিষ্ঠা কন্যার কান্নায় বাড়িটা মাথায় উঠেছে। ওদের মধ্যে আলাদা এক টান ছিল। কেউ তার কান্না থামাতে পারছে না। বাবার ধমক খেলে চিৎকার করে কান্না, ক্রমশ ঘ্যান ঘ্যান হয়ে এখন মিনমিন হয়ে মিলিয়ে যাবার অপেক্ষায়। মেয়েটার বৃদ্ধা দাদি ঝাপসা চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবে, আহা জীবনটাতো এমনই! কাহাতক মানুষ, কতক্ষণ, কত কিছু সহ্য করতে পারে? এক সময় মৃত্যুর মত করে সবই উবে যায়! এতক্ষণ ঝগড়ারত মহল্লাবাসী মা-মুরগীর খুন হওয়াকে কেন্দ্র করে এক হয়ে ভাবছে, এই অঘটন ঘটলো ক্যামনে? এই চকচকে রোদ সকালে আমাদের এতো চিৎকার-চেঁচামেচিতেও অজগরটা ভয় পেলো না কেন? এই নিয়ে নানা গাল-গল্প এক সময় মেয়েটির মিনমিনে কান্নার রেশ হয়ে শেষে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। মহল্লাবাসী এসে জড়ো হলো সেই জানলার ধারে। যেখানে জানলায় গরাদে মাথা ঠেস দিয়ে বসে থাকা একঘেয়ে বিষণ্ণ মেয়েটা, চোখেমুখে বিভৎস আতঙ্ক নিয়ে বিচিত্র কারুকার্যময় বিশালদেহী অজগরটার মা-মুরগীকে নৃশংসভাবে হত্যা করার কাহিনী বয়ান করতে শুরু করলো সবে…। কাহিনিটা শেষ করলো, আরও একটা বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। বললো, অজগরটা যখন মা-মুরগীকে গিলছিল, তখন আমি ওকে বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে চিৎকার করে তোমাদের সবাইকে ডাকছিলাম। কিন্তু তোমরা সবাই তখন ভয়ানক ঝগড়াঝাটিতে মেতে আছো। আমার চিৎকার কারো কানেই তো পৌঁছায়নি। তারপর মহল্লাবাসীর কাছে প্রশ্ন রাখলো, যদি পৌঁছাতো, তাহলে কী এই অঘটন ঘটতো? সবশেষে, বিষণ্ণ পঙ্গু মেয়েটা হাতমুখ নাড়িয়ে বিজ্ঞের মতন বলে, আমার মনে হয় অজগরটা তোমাদের বিভেদ টের পেয়েই এই খুনটা করার সাহস পেয়েছিল। হঠাৎ ছলছল চোখে বলে, আহা ওই মা-মুরগী কত ডিম দিতো! গতবছর তো কত বাচ্চাও দিলো! উফ্ কী অকৃতজ্ঞ তোমরা মা-মুরগীকে বাঁচাতে পারলে না। পান থেকে চুন খসলেই চুলাচুলি শুরু করে দাও। মুখের মার, হাতের মার কোনটাতেই শান্তি নেই তোমাদের!
জানালার মরচে পরা গরাদে হেলান দিয়ে পাটি পাতা চৌকিতে বসা মেয়েটার কাহিনী গভীর উৎসুক নিয়ে শুনছিল বুড়াবুড়ি, ছোকরা-ছুকরিসহ সবাই। এর হাতে ওর হাত, ওর শরীর তার শরীরে, একজন আরেকজনের পিঠে হেলান দিয়ে কেউ বা গালে হাত দিয়ে পা ছড়িয়ে দাওয়ায় বসে, অদ্ভুত যত মানুষের পটে আঁকা ছবি হয়ে বিষণ্ণ বিরুক্তিকর পঙ্গু মেয়েটার কাছ থেকে অজগরটার মা-মুরগীকে গিলার কাহিনী শুনছে। অজগর আতঙ্কের ঘোর কেটে গেলে, বিষাদী মেয়েটা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে, মানুষগুলো সব কেমন গর্দভের মতো হাঁ হয়ে তার কথা গিলছে। মনে হচ্ছে দাঁতহীন, চলনশক্তিহীন অনেকগুলো অজগর বিচিত্র ভঙ্গি নিয়ে দৃশ্যমান!
শীতের ভরদুপুরে জানলার ফাঁক গলিয়ে ছিটকে আসা রোদের ওম নিয়ে গল্পটা একদিকে যখন মনটাকে যুতিয়ে দিচ্ছিল; অন্যদিকে আবার এক শ্বাসরুদ্ধকর বীভৎস ভীতি বিনয়ীকে একটু একটু করে চূড়ান্ত উত্তেজনায় রোমাঞ্চিত অনুভবের তুঙ্গে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই মায়ের খনখনে চড়া গলার আওয়াজ ভেসে আসলো। যেন ভঙ্গুর কিছু একটা আছড়ে পড়ে খানখান করে ভাঙার বিকট শব্দ বিনয়ীর মাত্র জমে ওঠা উত্তেজনাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিলো।
‘এই বিনয়ী, ওলো বিনয়ী, কী গো বিনয়ী, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এলো অথচ তোর বিছানা ছাড়ার কোনও নামগন্ধ নেই। বিনয়ী ওই বিনয়ী কানে কি তোর হেজারবলা ঢুকেছে, কোনও সাড়া যে দ্যাস না? স্কুল বন্ধ তোর, কই মায়ের সঙ্গে সংসারের কাজে খানিকটা হাত বাটাবি, তা না করে, তুই কী না বই একটা নিয়ে পড়ে আছিস। পরীক্ষার পড়া হলে তবুও বলতাম ঠিক আছে বাবা, মেয়েটা পড়ছে, ভবিষ্যতে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবার পথ খুলছে কিন্তু তুই তো পড়া ছেড়ে গল্পের বই নিয়ে পড়ে আছিস! আজকাল আবার কি ছাইপাশ লেখাও শুরু করেছিস!’
রুদ্রমূর্তি নিয়ে মা বিনয়ীর চৌকির কোণা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘শুন বিনয়ী, এই সংসারে কবি লেখকদের কোন ভাত নেই। গল্প, উপন্যাস বেচে সংসারে এক কেজি চালও আসে না। এসব গাঁজাখুরি দিবাস্বপ্ন ছাড়। বন্ধের পরই-তো পরীক্ষা, এক হলে বইখাতা নিয়ে টেবিলে বস, আর তা না হলে আমারে কাজে সাথ দে।’
বিনয়ী বইটা বালিশের তলায় গুঁজে বিছানা ছাড়ার জন্য এক পা মাটিতে ঝুলায়। মনে মনে বলে, মা যেন হঠাৎ ছেড়ে দেওয়া ভাঙা রেকর্ড। হেঁড়ে গলায় গড়গড় করে বাজতে বাজতে হঠাৎ দুম করে থেমেও যায়! কী যে হয় মানুষটার!
মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি নিত্য ঘটনা। মাঝে মাঝে বিনয়ীর মনে হয়, মা যেন নিজে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। তারা দু’জন উপলক্ষ্য মাত্র। মায়ের ভয়ে বিনয়ী শেষপর্যন্ত ঝুলন্ত পা’দুটো মাটিতে রাখে। মনে মনে বলে, উফ্ এই ভদ্রমহিলার জ্বালায় শীত দুপুরের আারামটা নেয়া গেলো না। ইশ অজগর আর মা-মুরগীর কাহিনীর চূড়ান্ত ক্লাইমেক্সটা মা মাটি করে দিলেন। বিনয়ীর মনে হচ্ছে সে গভীর রাতের কামজ উত্তেজনার স্বপ্নদোষে আক্রান্ত। শিহরণ জাগানিয়া ভীষণ এক কৌতূহল পাথরচাপা দিয়ে বিনয়ী বিছানা ছাড়ে। চোখের আয়েশী ঘুম ছাড়াতে ভূত তাড়ানো ওঝার ঝাড়ন বারির মত কয়েক ফোটা জলের ছিটা চোখে দিয়ে রুম থেকে এক পা বাইরে রাখতেই, আবার মায়ের আগমন। এবার মায়ের মুখটা যেন ঠিক অজগরের মত লাগছে। বিনয়ী চোখ সরিয়ে নেয়। বিড়বিড় করে বলে, না মা, আজ তোমার সঙ্গে কোনও তর্ক আমি করবো না। একদম চুপ থাকবো। তুমি যত পারো চিল্লাও, আমি নির্বিকার থাকবো।
সেই পুরানো খনখনে গলায় মা বলেন, ‘কীরে বিছানাটাও গুছিয়ে নামলি না? কাঁথাটাও ভাঁজ করলি না যে? আমার তো দশটা হাত সব আমি করবো না? সব তো রেডিমেড পাচ্ছিস তোদের আবার কী চিন্তা!’
মায়ের অনবরত খোঁচাখুঁচিতে বিনয়ীর বিনয়, এক নিমেষে উবে যায়। মুখটা ঝামটা মেরে বলে, ‘আরে বাপ, এ্যাতো চিল্লাচ্ছ ক্যানো? সারাদিন খালি ক্যাঁচক্যাঁচ! মাত্র তো ওঠলাম! নিঃশ্বাস ফেলবারও সময় দিবে না, নাকি?’
বিনয়ী মেয়ের বেয়াদবি আচরণে মা যেন খানিকটা দমে গেলেন। অসহিষ্ণু মরিয়া চেহারা নিয়ে বলেন, ‘যা যা তোর কিছু করা লাগবে না। আমিই ভাঁজ করছি কাঁথা।’
বিনয়ী একটানে মায়ের হাত থেকে কাঁথাটা নিয়ে ভাঁজ করতে থাকে। মা নিজের সাথে বকবক করতে করতে বের হয়ে যান।
এবার সে একা একা গজগজ করে আর বলে, আরে বাবা, ধুত্তেরি কী হলো মানুষটার? আজকাল ঘুম থেকে ওঠার পর চোখ বন্ধ করার আগ পর্যন্ত সারা বাড়িটা মাথায় তুলে রাখছেন! কী হয়েছে ওনার? অসহ্য! বিনয়ী আবার কাঁথাটা দলা করে আলমারিতে ছুঁড়ে, দুমদাম পা ফেলে সোজা রান্নাঘরে ঢোকে। মা জননী একচালি ছোট মাছ নিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছেন। ওর বিগড়ানো মনটা নিমিষেই বিষণ্ণ হয়ে, মায়ের প্রতি সব রাগ মাটি হয়ে একরাশ গ্লানি ওকে গ্রাস করে নেয়। ভেতরটা মমতায় কাতর হয়ে ওঠে। তাড়াতাড়ি বঁটিটা হাতে নিয়ে পিঁড়ি হাতে বসতে গেলেই মা ছ্যাৎ করে ওঠেন, ‘ইশ আমার মাছ কাটুনি রে, এই বয়সে কোনওদিন মাছ কুটেছিস? তোকে কি কখনও মাছ কুটতে দিয়েছি? বল দিয়েছি?’
মায়ের এই বিদ্রুপবাণেও বিনয়ীর আর রাগ আসে না।
বরং মাকে মিনতি করে বলে, ‘মা তুমি আমাকে একটা মাছ কুটা দেখিয়ে দাও। প্লিজ মা দাও। দেখবে কেমন ঝটপট আমি সব মাছ কেটে ফেলবো।’
মা হঠাৎ একদম নীরব হয়ে যান। তারপর মেয়ের হাত থেকে বঁটিটা ছাড়িয়ে, মৃদুকণ্ঠে বলেন, ‘যা বাইরে থেকে কাপড়গুলো নিয়ে আয়। ওই দ্যাখ আসমান কেমন কালো হয়ে আসছে। তোর হতভাগা ভাইটার ভারী ভারী জিন্সপ্যান্ট ধুতে গিয়ে আমার কোমরটা টান খেয়েছে, এখনও ব্যথা কমেনি।’
তীব্র অপরাধবোধে মূক বিনয়ী আবারও মায়ের কাছ থেকে বঁটি নিতে চাইলে, এবার মা খেপে ওঠেন। চাপা কান্না কণ্ঠরুদ্ধ করে কপট রাগ দেখিয়ে মেয়েকে বলেন, ‘যা যা জলদি যা, বৃষ্টি এলো বলে…!’
বিনয়ী দ্রুত কাপড়গুলো তুলে চৌকাঠ পার হতে না হতেই রোদ আকাশ ফুঁড়ে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। হতভম্ভ বিনয়ী অবাক হয়ে ভাবে, আচ্ছা এরা এত কিছু টের পায় ক্যামনে?
বিকেলে বাসায় ফিরেই বিনয়ের সঙ্গে মায়ের রাগারাগি শুরু হয়ে যায়। সে বন্ধুদের সঙ্গে কনসার্ট দেখতে যাবে। শহরতলীর শেষপ্রান্তের খোলা মাঠে, আজ নাকি ইলেকশানে জয়ী নেতার চামচারা কনসার্টের আয়োজন করেছে। মা যত বোঝাচ্ছেন, খোকা তোর জিন্স প্যান্টে কাদামাটি লেগে শুকিয়ে ছিল, তাই ধুয়ে ফেলেছি, ছেলে ততই রেগে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে রাগ কমিয়ে ছেলে কথা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘দ্যাখো মা আমি যথেষ্ট বড় হয়ে গেছি। প্লিজ আমাকে না জানিয়ে আমার কাপড়চোপড় ধোবে না। প্লিজ ধরবেও না।’
মা মরিয়া হয়ে বলেন, ‘খোকা তোর প্যান্টটা খুব ময়লা ছিল বাবা…’ ছেলে মায়ের কথা শেষ করতে দেয় না।
চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে বলে, ‘উফ্ মা, তোমার ওই এক ঘাতরামি। তুমি যেটা করো ওটাই ঠিক। তোমার কথাই স্টাবলিশ করতে হবে। প্লিজ মা, আমার জীবন আমার। কী জ্বালা! কেন বুঝতে চাও না, আমি বড় হয়ে গেছি?’ রূঢ় কণ্ঠে বলে, ‘শোন তুমি আমার কাপড়চোপড় আর ধরবে না। গুছাতে গিয়ে সব আরও অগোছালো করে ফেলো। কেন তুমি বোঝো না তোমার কাছে যা আগোছানো সেটা আমার কাছে গোছানো? কেন তুমি সব তোমার মত করে করতে চাও? প্রতিদিন একই জ্বালাতন আমার আর সহ্য হয় না।’
বিষণ্ণ মা নীরবে ছেলের সামনে থেকে সরে যান।
বিনয়ী এতক্ষণ মায়ের সঙ্গে ভাইয়ের চরম বেয়াদবি দেখছিল, কিন্তু ভাইকে ও ভয় পায় তাই চুপ ছিল। সেবার পাড়ার এক ছেলে বিনয়ীকে প্রেমপত্র দিয়েছিলো, ওটা গিয়ে পড়েছিল ভাইয়ের হাতে। বিনয়ী যতই ভাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, ওই ছেলেকে সে চেনেও না, ওটা একতরফা। কিন্তু ভাইয়ের অনড় যুক্তি, ওই ছেলে তোকে চিঠি দেয়ার সাহস পেলো কোথা থেকে? ভাইযের হাতে সেই মারের জ্বালা আর ভয় বিনয়ী এখনও ভুলে যায়নি। বিনয়ী মনে মনে বলে, ভাই তুমি মাকে দোষ দিচ্ছো অথচ তুমিও তো মায়ের মত একগুঁয়ে। ভাইয়ের রুম থেকে বের হবার সময় হঠাৎ চোখে পড়ে, খাটের এক কোণায় যত্ন করে ভাঁজ করে রাখা নতুন একটা জিন্স প্যান্ট। বিনয়ীর মনে পড়ে, গত মাসের খরচের টাকা বাঁচিয়ে মা এই প্যান্টটা ছেলের জন্য কিনেছিল। ছেলের ক্রমাগত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে মা বলতে ভুলে গেছেন। প্রচন্ড বিতৃষ্ণায় ভাইয়ের প্রতি মনটা তেতো হয়ে গেলেও, কিছু না বলে প্যান্টটা ওর হাতে ধরিয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসতে গিয়ে আবার ফিরে যায়। ভাইকে বলে, ‘পারলে মাকে একটি সরি বলিস।’
বিনয় এক থ্যাতানি দিয়ে বোনকে বলে ‘যা ভাগ্, বেশি মুরব্বিগিরি ফলাইস না। ওনার অনেক সমস্যা আছে।’ মুখে ভেঙচি কেটে বলে, ‘ভাঙাচোরা কী এক ঘর! বাপ একটা উড়নচন্ডী! হাঁচা ট্যুরে যায় না অন্য কিছু করে বেড়ায় কে জানে? ভদ্রমহিলার কোনও কিছুর খবর নাই, সারাটা দিন ঘরটাকে রাজপ্রাসাদ বানানোর পেছনে লেগে থাকে। আমরা যেন সাত/আট বছরের খোকাখুকি আমাদেরকেও ফিটফাট রাখতে হবে। আজব! ভদ্রমহিলা বুঝতেই চায় না আমরা আর ছোটটি নেই, সেই যুগও নেই। যত্তসব পাগলামি। ছিটগ্রস্ত এক মানুষ!’
বিনয়ী এক চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘ভাইয়া মুখ সামলে কথা বলো। আমাদের মা উনি!’
বিনয় মারমুখী হয়ে বোনকে বলে, ‘যা ভাগ, ভাগ এখান থেকে’, ভাইয়ের রুদ্রমূর্তি দেখে বিনয়ী দ্রুত সরে আসে। কিছুক্ষণ পরে নতুন জিন্স প্যান্ট পরে বাবু সেজে শিস দিতে দিতে বিনয় বের হয়ে যায়।
বিকেলে হঠাৎ বিনয়ীর স্কুলের বান্ধবীরা এসে হাজির হয়। অন্য সময় বন্ধুদের দেখলে ও খুশিই হয়। আর আজ সবকিছু ছাপিয়ে ওর মনটা রাগে ক্ষোভে বিতৃষ্ণায় খিঁচিয়ে আছে। ভাই তো ঠিকই বলেছে, কে জানে ট্যুরের নাম বিক্রি করে বাপ নামক পুরুষটা আসলে কী করে বেড়ায়? কোথায় কার নাম ভাঙিয়ে খায়? ঘরে ফিরেও সারাদিন মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে। উফ্ খোদা স্ত্রীর আবার স্বামীর প্রতি যা অন্ধ বিশ্বাস! সব দুশ্চিন্তাকে চেপে রেখে, বিনয়ী বন্ধুদের গল্প করতে বসিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে, এক প্যাকেট নুডলস, চানাচুর ছাড়া ঘরে আর কিছুই নাই। মা ঘুমোচ্ছেন। আজ বিনয়ী কিছুতেই চায় না মার ঘুম ভাঙুক। এই সঙের সংসার সংসার করে কতদিন মা একটু শান্তিতে ঘুমান না! মা তুমি ঘুমাও। সন্তর্পণে সে চুলা ধরিয়ে গরম পানি বসায়, ভাবছে একটা ডিম দিয়ে নুডলস বানিয়ে ফেলবে। সঙ্গে চানাচুর আর ট্যাঙের শরবত দেবে। কখন যে মা এসে রান্নাঘরে পা রেখেছেন, বিনয়ী টেরই পায়নি। পেছন থেকে মায়াময় কণ্ঠে মা বলেন, ‘যা বন্ধুদের সঙ্গে গল্প কর। ওরা তোর বাসায় মেহমান এসেছে, আমি নাস্তা দিচ্ছি মা।’ বিনয়ী মৃদু আপত্তি করলেও মা মমতাভরা কণ্ঠে বলেন, ‘যা মা আমি দিচ্ছি। আমি তো রেস্ট নিয়েছি। আছরের আজান পড়েছে, এখনই বিছানা ছাড়তাম রে।’
মা অল্প সময়ের মধ্যে নুডলস, মালপোয়া, ডিমের হালুয়া আর চানাচুর মাখা দিয়ে টেবিল সাজিয়ে ওর বন্ধুদের নাস্তা খাবার জন্য ডাকে। হঠাৎ মায়ের দিকে চোখ পড়তে বিস্মিত বিনয়ীর কাছে মাকে অনেক অচেনা লাগে। কিন্তু একটা বিষয় ও স্পষ্ট বুঝতে পারে, এই সংসার নামক জীবনটা মায়ের কাছে বোঝা হয়ে গেছে। মা এই ভার আর বইতে পারছেন না। একটা কৃত্রিম পর্দার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন। মায়ের জন্য বিনয়ীর মনে প্রচন্ড এক ভয় জেঁকে বসে। আজ আর বন্ধুদের সঙ্গে ওর আড্ডা জমে না। অথচ ওরা প্রায়ই আসে। মা ওদের এভাবেই আপ্যায়ন করেন। এর আগে মাকে নিয়ে কখনোই ওর মনে কোনও ভয়, ভাবনা বাসা বাঁধেনি। মায়েরা তো এমনই হয়, সন্তান জন্ম দেয়, বড় করে, স্বামী-সন্তান, ঘর-সংসার দেখভাল করে। এমনই তো মায়েদের জীবন! আশেপাশের, ওর বন্ধুদের মায়ের জীবনটাও তো প্রায় একইরকম। কদাচিৎ দু/একজনের অন্যরকম জীবন, তাদের নিয়ে পাড়ায় মুখরোচক গল্প। আজ মনে হয় ওই মুখরোচক গল্পের শিকার মায়েরাই ঠিক, এরা বেঠিক। আজ আবার কী হলো বিনয়ীর? ও যেন বন্ধুদের বিদায় করতে পারলেই বাঁচে। মাথাব্যথার অজুহাত দিয়ে শেষপর্যন্ত সে বন্ধুদের বিদায় করার উদ্দেশ্যে গল্পের মাঝে হঠাৎ বলে ওঠে, ‘এই তোরা বাসায় যাবি না? সামনে টেস্ট পরীক্ষা, ম্যাট্রিক যে নকিং এ্যাট দ্য ডোর বন্ধু। ভুলে গেছিস কাল নূরখান স্যারের ক্লাস আছে। ন্যারেশনের এক্টিভ-প্যাসিভ এর নিয়ম ভালো করে দেখে যেতে বলেছেন। জানিস তো, পড়া না পারলে, স্যার ক্লাসরুমের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবেন।’
শেষপর্যন্ত আড্ডা আর জমে না। ওরাও চলে যায়।
বন্ধুদের বিদায় করে এসে দেখে, মা তার ঘর-সংসার সব সামলিয়ে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে গেছেন। বিষণ্ণ বিনয়ীর ভেতরের তোলপাড় থামে না। দূর থেকে সে সজদারত মার দিকে তাকিয়ে অথচ মনটা ভয়ানক অজগর আর মা-মুরগীর গল্পে এসে আবারও আটকে যায়। এবার বিনয়ী দেখে, জায়নামাজে সেই মা-মুরগী হাঁটু ভেঙে নামাজরত। আর ওদের সিমেন্টের পলিশমারা ঘরটায় ছোটবড় অজগর কিলবিল করছে। ভয়ানক আতঙ্ক, ভীষণ ঘৃণায় দৌড়ে সে মায়ের বিছানায় পা তুলে বসে থাকে। মা-মুরগী তখনও সজদায় পড়ে আছে। অজগরগুলো চারপাশ থেকে ফণা তুলে ফোঁস ফোঁস করছে, কিন্তু জায়নামাজের কাছ ঘেঁষতে সাহস করছে না। কাছে গিয়ে বার বার ফণা নামিয়ে ছিটকে দূরে সরে যাচ্ছে। অসহায় ভীতসন্ত্রস্ত মেয়ে তীক্ষ্ণ নজর রাখছে যেন মুরগী- মায়ের নামাজটা শেষে না হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত অজগরগুলো না যায়, তারও যেন নামাজ শেষ না হয়। বিনয়ী ভাবে একটা সময় তো তিনি জায়নামাজ থেকে উঠবেন কিন্তু অজগরগুলো যদি না যায় তখন সে কী করবে? শেষে বিনয়ী বুদ্ধি আঁটে যেভাবেই হোক ওই জায়নামাজ থেকে তাঁকে সরাসরি বিছানায় তুলতে হবে। যেন বিষাক্ত সাপগুলো ছোবল মারতে না পারে!
মা-মুরগীকে পাহারা দিতে দিতে কখন যে বিনয়ীর চোখ লেগে গেছে টেরও পায়নি। সে স্বপ্ন দ্যাখে, এ মহল্লার সবচেয়ে বড় নিমগাছটা যেটা ওদের বাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, তার কী এক কঠিন অসুখ করেছে। অসুস্থ নিমগাছটার গোড়ায় মহল্লার লোকজন বাড়ির যত আবর্জনা এনে স্তুপ করে রাখে। মুরব্বিগণ বলাবলি করছে এই চরম অত্যাচার, অবহেলায় নিমগাছটার রোগে ধরেছে। নিমগাছটা পেছনের বাড়ির এজমালি সম্পত্তি। ওটাকে কাটা না কাটা নিয়ে বাড়িটাতে দ্যান-দরবার লেগেই আছে। ঝগড়া হলে একদল বলে, কী লম্বা রে বাবা! যেন আকাশ ছোঁয়ার শখ! না দাঁতের মাজন বানানোর জন্য ডাল কাটা যায়, না পাতা তোলা যায়, কিছুই করা যায় না। কাজের কাজ একটাই হয়, ঝড় বৃষ্টি তুফান বিজলি বাদল হলে পাহারাদার হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। বৃদ্ধা মায়ের সাত ছেলে। মা ছাড়া সব শালিকের এক রা! গাছটা কেটে ফেলাই ভালো। অভাবের সংসারে ক’টা টাকা আসবে। আর মায়ের একই গোঁ, গাছটা তোর বাপের হাতে লাগানো, আমি মরলে কাটিস। ঝড় এলে একপক্ষের খোদাভক্তি বেড়ে যায়। ওৎ পেতে থাকে নিমগাছটা যেন ঝড়ে ভেঙে পড়ে। গাছটার অসুখের খবরে ওই পক্ষ মনে মনে খুশি, যাক বাবা! আপদ যেন বিদায় হয়। গাছ কাটার দালাল তাদের পেছনে লেগে আছে। গাছটার বিনিময়ে অনেক টাকার লোভ দেখাচ্ছে। বিশ্বম্ভর রায় নামে কোনও এক জমিদার না কে এখনও টিকে আছেন। তার নিমকাঠ চাই খাট বানানোর জন্য। সেই যুগ গেছে, এই কলিকালে জোরজবরদস্তি করতে পারছেন না, তাই পেছনে ফেউ লাগিয়ে রেখেছেন।
বিনয়ী স্বপ্ন দ্যাখে, বৃদ্ধার বাড়ির অজগরগুলো অসুস্থ নিমগাছটাকে পেঁচিয়ে ফণা তুলে ওদের বাড়ির দিকেই অপলক তাকিয়ে আছে। মা-মুরগী গিলে খাওয়া অজগরটা সবার সামনে। ও মাগো! ভয়ে কুঁকড়ে ওঠে বিনয়ী, বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘মা, মাগো জানলাটা বন্ধ করে দাও। সব ছিদ্রও বন্ধ করতে হবে। ওরা সব ওৎ পেতে আছে, ঘরে ঢুকে যাবে মা। মাগো, ও মা কই তুমি?’
‘বিনয়ী ও বিনয়ী কী হয়েছে তোর? তুই এতো কোঁকাচ্ছিস কেন? ভয় পেয়েছিস মা? চোখ মেল মা? এই তো আমি আছি, ভয় পাস না মা।’
ওর মনে হলো, মা যেন কোন দূর থেকে তাকে ডাকছেন! একটা মৃদু ঝাঁকুনিতে ভীত সন্ত্রস্ত বিনয়ী চোখ মেলে দ্যাখে, মা তার অপুষ্ট কর্মী হাতটা দিয়ে পরম মমতায় মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আছেন। বিনয়ী চোখ রগড়ে উঠে বসে, ভয়ার্ত চোখে মেঝেতে তাকিয়ে দ্যাখে মেঝেটা পুরো ফাঁকা। ভয়াতুর কণ্ঠে মাকে বলে, ‘মা এখানে অনেকগুলো অজগর সাপ ছিল। সাপগুলো গেলো কই মা?’ মা হেসে বলেন, ‘কী সব ভয়ের বই পড়িস তাই ওইগুলো স্বপ্নে এসেছে, কোন অজগরটজগর এখানে নেই মা। যা হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বস। আমি তোকে নাস্তা দিচ্ছি।’
বিনয়ী তাড়াহুড়া করে খাট থেকে নামতে গেলেই মা বলেন, ‘দাঁড়া দাঁড়া নিচে পা ঝুলিয়ে কতক্ষণ বস। ঘুম থেকে উঠেই বিছানা ছাড়তে হয় না মা।’
অগত্যা বিনয়ী বাধ্য মেয়ের মতো পা ঝুলিয়ে বসে থাকে।
বাবা ট্যুর থেকে ফিরেছে। খুব ফুরফুরে চনমনে লাগছে বাবাকে। বাবার বয়স যেন দশ বছর কমে গেছে। বিনয়ী তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে। এই প্রথম তার মনে হয়, বাবা যেন তাদের সঙ্গে থেকেও নেই। কোনও পিছুটান নেই বাবার। সব মিলিয়ে বাবার বিষয়টা ওর কাছে জটিল ও রহস্যময় মনে হয়! ওই অজগর-মুরগীর কাহিনিটা পড়ার পর থেকেই ওর মাথায় আজগুবি যত চিন্তা ঘুরছে। ভেতরটা উল্টাপাল্টা হয়ে কী জানি কি একটা হচ্ছে! বাবা এলেই মায়ের অন্যরকম ব্যস্ততা বেড়ে যায়। বুয়া বাড়ি গেছে সেই কবে, ফিরবে কবে কে জানে? বিনয়ীর মনে হয়, এই জাতটা হচ্ছে গোদের উপর বিষফোড়া। বাবা একজোড়া গলাকাটা পাতিহাঁস নিয়ে এসেছে। একটা বড় মাছের মাথাও চটের ব্যাগ থেকে উঁকি দিচ্ছে। বাবা খেতে পছন্দ করেন, আর মা স্বামীর জন্য রান্না করতে ভালোবাসেন। হঠাৎ বিনয়ীর ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ভীষণ অসহায় লাগছে। অথচ মা আজ খুব আহ্লাদে বুঁদ হয়ে আছে। স্বামী ওনার বিশ দিনের ট্যুর শেষে ঘরে ফিরেছেন।
চিরায়ত আয়েশী ভঙ্গিতে বসে আজ বাবা পান চিবুচ্ছেন না বরং সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছেন। বিনয়ী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। বাবাকে তো কখনোই সিগারেট খেতে দেখেনি। বাবা পান চিবাতেন। বাবার চিবানো পানের রসালো একদলা পান খাওয়ার জন্য ওরা পিঠাপিঠি ভাইবোনের মধ্যে কাড়াকাড়ি লেগে যেতো। বাবা ওদের দু’জনকে কোলের দু’পাশে বসিয়ে চিবানো পান দিতেন আর খবর শুনতেন। বিস্মিত বিনয়ী ভাবছে, বাবার হঠাৎ ধুমপান বিলাস কি মায়ের চোখে পড়েনি? অদ্ভুত! বিনয়ীর খুব ইচ্ছে করছে, বাবার হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে ছোটবেলার পান চিবানোর মত করে না বরং বাবার মত আয়েশ করে দুটো টান মারতে। বিনয়ী ওই একই ভঙ্গিতে আড়াল থেকে বাবাকে দেখছে। ওর চোখের সামনেই বাবা যেন আস্তে আস্তে অজগর হয়ে যাচ্ছে। সে চোখ ফিরিয়ে নেয়। না না সে বাবার অজগর হয়ে যাওয়া দেখতে চায় না। কেন জানি তার মনে হয়, বাবা যদি অজগর হয়, সবার আগে মাকে গিলে খাবে। ভয়ে শিউরে ওঠে সে! মায়ের যে স্বামীর প্রতি অগাধ বিশ্বাস, মাকে যদি বাবা গিলে খায় তবে বিনয়ীর কি হবে? খোদা বাবা যেন অজগর না হোন! প্লিজ খোদা বাবাকে অজগর বানিও না।
এবার আসার সময় বাবা কী এক দুর্গন্ধ সাথে করে নিয়ে এলেন। মহল্লার নারীরা আঁচলে মুখ লুকিয়ে ওই গন্ধ নিয়ে নানা গালগল্পে মশগুল। পুরুষরা নাক-কপাল কুঁচকে চরম বিরক্তি নিয়ে বলছে, এই বয়সে ভিমরতি ধরেছে, তা না হলে ওটাকে বয়ে আনার কী দরকার ছিল? সুখে থাকতে ভূতে কিলায় আর কী! মহল্লাবাসী এও বলছে, আহারে, তিনটা মানুষ কীভাবে এই দুর্গন্ধ সহ্য করবে? কেউ কেউ আবার বলাবলি করছে, তারা বাবাকে এক থোকা ফুল হাতে গলিয়ে, হাঁটতে দেখেছেন। ফুলটা তাদের এতই অচেনা যে, আন্দাজ করেও আকৃতির বর্ণনা দিতে পারছেন না! সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, মহল্লাবাসীর ফিসফিসানি চোখাচোখিতে মায়ের কাজের গতি আরও বেড়ে গেছে। কিন্তু মা যেন বোবা হয়ে গেছেন। আসলে মহল্লায় যে বাবাকে নিয়ে এতো কাণ্ড হয়ে যাচ্ছে প্রথমে বিনয়ী কিছুই টের পায়নি। যখন পেল তখন দুর্গন্ধ আগুনের মত ছড়িয়ে গেছে। ওর পরীক্ষার বেশিদিন নাই কিন্তু এখন সব ছাপিয়ে মহল্লাবাসীর কানাকানি অজানা এক ভয় হয়ে বিনয়ীকে জাপটে ধরে!
আসতে না আসতেই বাবা হঠাৎ আবার ট্যুরে গেলেন। এ নিয়ে মায়ের কোন উচ্চবাচ্য নেই, কৌতূহলও নেই। একদিন পুলিশ এসে ভাইয়াকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে গেল। নির্বিকার বাবার ধুমপানের আরাম আরও বেড়ে গেলো। বিনয়ীর অজগর-মুরগী ভীতি দিনের পর দিন বেড়েই চলছে। বাবার মুখ, সেই অজানা ফুলের গোছা, ভাইয়ের মুখ সব, সবই ক্রমশ অজগরের আকৃতি নিচ্ছে! সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, স্বপ্নে বিনয়ী ওই ফুলের নাম পেয়েছে ‘করবী’। বড্ড বিষাক্ত। এবার বাবা ট্যুরে যাবার সময় বিনয়ী শুনতে পেয়েছে, মা নিম্ন-কঠিন স্বরে বাবাকে বলছেন, ‘খবরদার ওই দুর্গন্ধ নিয়ে তুমি আমার ঘরের ত্রি-সীমানায় ঢুকবে না। এ বাড়ি আমার পিতৃ-ভিটা, এ ভিটা আমি অপবিত্র হতে দেবো না। বাবা হ্যাঁ না কিছুই বলেননি। বরং নির্মম এক তাচ্ছিল্য নিয়ে বের হয়ে যান।
বিনয়ীর ঘুম আসে না। ও নিজেও কিছুতেই ঘুমাতে চায় না। চোখ বন্ধ করলেই স্বপ্ন দ্যাখে মা যেন ক্রমশ মুরগী হয়ে যাচ্ছে। আজকাল চোখ খোলা অবস্থায়ও ওই একই দৃশ্য ওকে পাগল করে তুলছে। একদিন ভোর রাতে বিনয়ীর যন্ত্রণার্ত চিৎকারের মায়ের ঘুম ভেঙে যায়। দৌড়ে মেয়ের রুমে এসে দেখেন, মেয়ে হাত-পা ছুঁড়ে কাকে যেন মরিয়া হয়ে তাড়াতে চাচ্ছে, চোখ বন্ধ বিনয়ী চিৎকার করে বলছে ‘যা যা, যা তুই, এখান থেকে যা!’ মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করেন। মেয়ে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে শামুকের মত নিজেকে গুটিয়ে শিশুর মত কাঁদছে। ওর সারা শরীর কেমন ঠাণ্ডা হয়ে আছে। মা কাঁথা দিয়ে মেয়েকে ঢেকে দেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে কোমল কণ্ঠে বলেন, ‘তুই কী স্বপ্ন দেখেছিস? ভয় পেয়েছিস মা? ভয় পাচ্ছিস কেন রে পাগলি, মা তো আছে তোর পাশে।’
বিনয়ী বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে মাকে বলে, ‘মা তুমি কোথাও যেও না, প্লিজ মা তুমি আমার পাশে থেকো।’ মা নীরবে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। ভয়মাখা চোখমুখে বিনয়ী বলে, ‘মা আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমাদের গোটা ঘরটা আস্ত একটা অজগর সাপ হয়ে গেছে। বিশাল হাঁ করে ফণা তুলে আছে, তোমাকে খাওয়ার জন্য।’
মা শব্দ করে হেসে উঠে বলেন, ‘দূর পাগলী কী যা তা বলছিস! গতরাতে নিশ্চয়ই ভয়ের কোনও বই পড়েছিস। কতদিন তোকে বলেছি, ওইসব ছাইপাশ বই পড়তে নাই। তুই আমার কথা শুনিস কই?’
বিনয়ী অবাক হয়ে মায়ের উচ্চস্বরের হাসিতে উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাকে সে কখনোই শব্দ করে হাসতে দেখেনি।
মা মেয়েকে বলেন, ‘নামাজ পড়িস মা। আল্লাহ তোকে বিপদ থেকে মুক্ত রাখবেন। তা নাহলে বাজে চিন্তা তোকে শেষ করে দেবে।’
ক্লান্ত মা মেয়েকে বলেন, ‘ঘুমা মা। রাত এখনও ফুরায়নি।’
অন্যমনস্ক মা, মেয়ের শরীরে হাত বুলাচ্ছেন আর ভাবছেন, আসলেই সে কী করবে? কী করণীয় তার? রাত কী আর ফুরাবে?
বিনয়ীর মনে অহর্নিশি বিদ্ধ সেই ভয়ানক গোপন ভয়ই যে নির্মম সত্য হয়ে যাবে, তা কী কেউ কখনও কল্পনা করেছিল? মা-মেয়ের গভীর ঘুমের সুযোগে বিনয়ীর স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসা সেই অজগর সাপটা করবী ফুলের বিষ মুখে নিয়ে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে পড়ে। মা যখন টের পেলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। নিজেকে বাঁচাতে শেষপর্যন্ত কড়িকাঠে ঝুলে পড়লেন যেন বিষাক্ত অজগর আর করবী-বিষ তার শরীর-মন স্পর্শ করতে না পারে! নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে মা কী তবে মেয়ের কথাও ভুলে গেলেন? মহল্লাবাসী দুঃখ করে আর বলে, আহারে জীবন, শেষে কীনা নিজের হাতে গড়া সংসারের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলে গেলো মানুষটা! আরও একটা বিস্ময় তখনও তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। কড়িকাঠে ঝুলন্ত নারীর প্রায় পাশাপাশি ওই ঘটনাও মহল্লাবাসীর চোখে পড়লো। এজমালি সম্পত্তি সেই নিমগাছটা দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। যে অজস্র পোকামাকড় খাঁজ কেটে কেটে গাছটার দীর্ঘদেহে বাসা বেঁধেছিল, এরা যেন সব বিধ্বংসী বুভুক্ষু হয়ে উঠেছে! কিছুদিন লোকজন ভয়ে নিমগাছের ধারেকাছেও গেলো না। কিন্তু মানুষের স্বভাব কি আর বদলায়! পাড়ার বুজুর্গগণ বলাবলি শুরু করলেন, গাছটা কেটো না পরিবারের বিপদ ডেকে এনো না। কেউ কেউ আবার বলছে কে জানে, কোন একটা দুর্যোগ আসছে মহল্লায়…!
বিনয়ী ভাবছে, কড়িকাঠে ঝুলন্ত মানুষের নীচে বিষাক্ত-অজগর করবী-বিষ মুখে নিয়ে দিব্যি বেঁচে আছে। এত অত্যাচারের পরেও নিমগাছটা পাঁচটা বছর অতিক্রম করেও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। তার দেহের মূলে মহল্লার আবর্জনা জমে জমে গলেগলে মাটিতে মিশে যায়, মানুষের দেহ যেমন মিশে যায় ঠিক তেমনই।
অজগরের বংশও তো বাড়ছেই! নিমগাছটাও তো তবুও বেঁচে আছে! অথচ মা আমার!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
মুগ্ধ হয়ে পড়েছি !
অনবদ্য লেখা !
অভিনন্দন!!🙏❤
পাঠকের মতামত লেখকের পথ চলার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল পাথেয়। ধন্যবাদ প্রিয় পাঠক। ❤️🙏
“অজগরের বংশও তো বাড়ছেই! নিমগাছটাও তো তবুও বেঁচে আছে! অথচ মা আমার!” শেষোক্ত লাইনের মাধ্যমে ছোটগল্পটি হৃদয় ছুঁয়ে গেল৷ বহুদিন পর এইরকম একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের ছোটগল্প পাঠ করলাম। আরো অসংখ্য লেখা এইরকম পাবো এই আশা রাখি!
পাঠক যখন পাঠ করেন, তার উপলব্ধিজাত কথা ব্যক্ত করেন তখন সবচেয়ে বেশি প্রাণিত শাণিত হয় লেখকের মন ও মননের জগত।
ধন্যবাদ প্রিয় পাঠক! 🙏❤️
চমৎকার শব্দ চয়ন। নিমগাছ গুলো রোগা হলেও বেঁচে থাকুক।
এক নিমিষেই ভালোলাগায় পড়লাম।
আরো চাই।
শুভকামনা।
গল্প ছোট কিন্তু ব্যপ্তি বিশাল। অসাধারণ লেখনী। ” মা ” সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে বড় সৃষ্টি। পৃথিবীর কোনো কিছুর সাথে যার তুলনা হয়না। গল্পটা পড়ে,মা’র জন্য কেমন হাহাকার লাগছে।কত কষ্ট না মা কে দিয়েছি।
সৃষ্টিকর্তা র কাছে প্রার্থনা,লেখিকার দীর্ঘ জীবনের।
ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। আরও লেখনী আশা করছি।💜💜💜💜💐
মা যেখানেই থাকুক মায়ের জন্য প্রত্যেক সন্তানের অন্তঃস্থলে কোন না কোন অতৃপ্তির বেদনা আমৃত্যু কাজ করে। কারণ এই বিশ্ব-সংসারে মা-ই এমন এক মানুষ যাকে স্রষ্টা সৃষ্টি করার ক্ষমতা দিয়েছেন। আপনার মত এই আক্ষেপ বিভিন্ন রঙ হয়ে আমাদের সবার ভেতর সক্রিয়। গল্পটা পাঠ ও অনুধাবন করে মতামত দেয়ার জন্য, আপনার প্রার্থনায় আমাকে রাখার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ প্রিয় পাঠক। একমাত্র পাঠক-ই লেখকের সৃষ্টির জীয়নকাঠি। তাই পাঠক আমার কাছে চির নমস্য! ধন্যবাদ প্রিয় পাঠক! ❤️🙏
আন্তরিক ধন্যবাদ প্রিয় পাঠক আমার! ♥️🙏
এক টানে পড়ে ফেলার মত চমৎকার একটি গল্প! পিতা-পুত্রের অকর্মণ্যতায় মা-মেয়ের দুর্বিষহ অসহায়ত্ব, পরিবারের উপেক্ষিত মানুষগুলোর অসহ্য যন্ত্রণা মর্মস্পর্শী করে তুলেছেন সাবলীল সংলাপে পরম মমতায়।
একজন লেখকের লেখায় তখন-ই প্রাণ সঞ্চারিত হয়, যখন পাঠক সেই লেখা নিয়ে কথা বলেন। আমি অনুপ্রাণিত প্রিয় লেখক।
ধন্যবাদ প্রিয় পাঠক! 🙏❤️
Heartfelt congratulations!
I read the short story. It is excellent and heart touching.
Dear apa, you have nicely depicted the scenario of the struggling Bengali mother in the household and society.
It is unfortunate for this Bengali mother that she can’t achieve emancipation from the patriarchal power. The illusion of the phyton is the symbol of fear, patriarchal power and oppression. The description of the neem tree presents the the image of the oppressed. Superb!
Regards
Dr. Laila Ashrafun Joya
SUST
Dear Apa, This is very inspiring for me when a person like you read and comment on my writings! I am overwhelmed!
Regards
Nilufa Aktar
বেশ কয়েকদিন ধরে চেষ্টা করছি,সাদাত হাসান মান্টোর বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ ‘ঠাণ্ডা গোস্ত’ পড়ার। আজকাল না পড়তে পড়তে ক্রমশ সেরিব্রাম সাহিত্য না বুঝার ইঙ্গিত দিচ্ছে ভয়ানকভাবে। হঠাৎ ফেসবুকের হোম পেইজে চোখে পড়ে ‘ঝুলন্ত কড়িকাঠ’ নামে একটা গল্পের। শেয়ার করেছেন আনোয়ার নামে এক ছোটভাই। গল্পের লেখক আমার বিভাগের শিক্ষক। আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করি। অজগরের ভিতর দিয়ে শুরু হওয়া,ঘটনা উপঘটনার এই বিন্যাস একেবারে অকেজো পাঠক বানিয়ে দিল গল্পটা আমাকে। প্রতীকধর্মী এই গল্প বলাইচাঁদের নিমগাছ গল্পের সারকথার মতো চিন্তা জগতে ধাক্কা দিলো। বিনয়ীর চরিত্রের বিন্যাস লেখক আমাকে স্মরণ করতে বাধ্য করলেন, আমি সেই শামসুর রাহমানের অক্টোপাসে আটকা। নারীকে যেন সমাজের অষ্ট পায়ে চতুর্দিকে বেঁধে আছে,নিঃশ্বাসের ব্যাপকতা গিলে নিচ্ছে নিজেই তাঁর। নিজের গণ্ডির সীমানার বাইরে পৃথিবীর চিরায়ত সৌন্দর্য দেখার বিপরীতে শিকড় ছড়িয়েছে মায়ায়। মায়া বড্ড এক অদ্ভুত শক্তি,যা নিজেকে ঠেলে দেয় মৃত্যুর দ্বারে। পাবলো নেরুদায় ভাষায় পড়েছি, “মানুষের আত্মা চির-বিদ্রোহী। ” বিনয়ীর মা কি তেমনি? পৃথিবীর অজস্র আত্মায় সযত্মে মরণকে গিলে ফেলে যন্ত্রণার চাদরে। গল্পে ধীরে ধীরে জীবনের যে গতিপথ অঙ্কন করেছে তা বাঙালির চিরকালীন নারীর মনস্তাত্ত্বিক অস্তিত্বের দ্যোতনা। বিনয়ীর স্বপ্ন, সেই স্বপ্নের অজগর আমাকে আঘাত করেছে বারবার । গল্পের অজগর, অজগরবৃত্তি নয়, রাঘল বোয়ালের করালগ্রাসের বলি এক নারীর চিত্র, লেখক রংতুলির আদলে দেখাতে হয়তো চেয়েছেন। গল্পের বিনয়ীর মাকে কখনো বিলাসী গল্পের বিলাসীর মতো মনে হবে, যার রাতজাগা আত্মসুখ বিসর্জনে মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরে আনা মৃত্যুঞ্জয়ের প্রতিচ্ছবি। নারী সংসার ধর্মের প্রধান প্রতিমা। কিন্তু সংসার ধর্মে প্রতিমাকে পূজা পাওয়ার বদৌলতে পূজারীর দুয়ারে সুখ খোঁজতে হয় ;এ যেন এক বিপরীত কৃত্রিম খেলা। বিনয়ীর মা চরিত্রটি এইগল্পে
এমন এক দেবতা;যাকে পূজারী নামক অজগর বন্দী রাখে করতলে। লেখক রূপকের আড়ালে কি সুন্দর বলে দিলেন,পূজারীর হাতেও দেবতার খুন হয় এই বঙ্গসমাজে।
অনেক শক্তিশালী রূপকতার বয়ান। এই গল্পটা আমি ৮ বার পড়েছি।এর আগে কোনো গল্প আমার ৮ বার পড়া লাগেনি।
উত্তম পুরুষে বলা গল্পটা বেশ জমিয়েছেন, মহাল্লাবাসী উল্লেখে সামগ্রিক লোকের কথা কথার দ্বারা। অজগরের পেটে মুরগি চলে যাওয়ার ঘটনাটা পাঠককে উত্তেজিত করে আর সেই কৌতুহলে এগিয়ে যায় গল্পের অন্তিমের দিকে। শেষটা আরো বেশি দুর্দান্ত হয়েছে, জীবনের বাস্তব সত্যটা যখন পষ্ট হয়ে যায় একজন মায়ের কাছে। বেশ ভালো লাগল। শুভ কামনা।
খানিকটা মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ছিলাম লেখাটা। রূপকের শক্তিশালী কি প্রয়োগ ! এ যেন আমাদের চারপাশের চরম বাস্তবতা। কিশোরী মেয়ের মনস্তত্ত্বকে এত সুন্দর করে তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ ম্যাম। 🖤
শুভ কামনা রইলো। 🖤
পড়তে পড়তে হারিয়ে গেছিলাম ভাবনায়। কিশোরী মেয়ের মাঝে সমাজের এমন নিখুঁত চিত্র। সত্যিই অসাধারণ! একজন শক্তিমান লেখিকা। নিরন্তর শুভকামনা ও ভালোবাসা 🖤
শেষের মাতৃমৃত্যু একটা ধাক্কা দিয়ে যায়৷ আর ফুঁটে উঠেছে চিরায়ত বাঙালি মধ্যবিত্ত সংসারের আতঙ্ক, পারস্পরিক যত্নের মৃদু প্রবহমানতা। ছেলে সন্তানের বয়স যতো বাড়ে সেও হয়ে উঠতে থাকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিভূ। মাকে ঘিরে থাকা সমস্ত ভয় বিনয়ীকে আরো বেশি বাঙালি চিত্রে উদ্ভাসিত করে তুলেছে। চোখের সামনে বড়ো হতে থাকা বড় ভাইয়ের পৌরুষ আর নিজের দোদুল্যমানতায় বিনয়ী আতঙ্কচিত্রের এক অনুপম রূপায়ন। মায়ের মৃত্যু সে আগেই টের পেয়েছে, শেষের মৃত্যুতে তার পরিণতি পাঠককে ট্রাজিক হঠাৎ বেদনার চেয়ে দুঃখ আর ভয়ের আতঙ্ককেই ধারাবাহিক ভাবে বয়ে নিয়ে গেছে।