short-story-joldhakar-sonali-din

জলঢাকার সোনালি দিন
সেলিনা হোসেন


গ্রামের পথেঘাটে হেঁটে সবুজ প্রকৃতির মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করার চিন্তা করে মাসুম। জলঢাকা উপজেলা নামটিও ওর খুব পছন্দের। জল দিয়েতো ঢেকে রাখা যায় না গ্রাম, কিন্তু এমন নামের মাধুর্য ওকে আবিষ্কারের সূত্র ধরিয়ে দেয়। ও প্রাণভরে গ্রামের সবটুকু জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখে। স্কুল বন্ধ থাকলে কোথাও না কোথাও চলে যায়। যে জায়গা দেখা হয়নি সে জায়গা দেখা ওর আনন্দের। হেঁটে যেতে না পারলে কারো সঙ্গে সাইকেলে চড়ে কিংবা গরুর গাড়িতে কিংবা নৌকায়। দূরদূরান্তে যেতে ওর কষ্ট নেই, বরং না যেতে পারলে মন খারাপ হয়।

বিন্যাকুড়ি সরকারি স্কুলে পড়াও ওর স্বপ্নের জমিন। ক্লাশ সেভেনে পড়ে। বাবা আবদুল জব্বার দিনমজুরি করে সংসারের জন্য আয় করে। কয় টাকাই বা আয় হয়। অভাব লেগে থাকে সংসারে। সেজন্য মাঝে মাঝে ওর মা আয়শা খাতুন মানুষের বাড়িতে কাজ করে কিছু টাকা আয় করে। এসব টাকা সংসারের জন্য খরচ না করে দুই ছেলের পড়ালেখার জন্য রেখে দেয়। বলে, যেন টাকার অভাবে পোলা দুইটার স্কুল বন্ধ হয়ে না যায়।

আবদুল জব্বার সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেয়। বলে, হ্যাঁ, ঠিক কাজ কর। ওরা পড়ালেখা শিখে বড় হলে চাকরি করতে পারবে। তখন আমাদের অভাব থাকবে না।

— আমি অভাবের কথা ভাবি না। অভাব মাথায় করে জীবন শেষ করব। কিন্তু আমি চাই ছেলে পড়ালেখা শিখুক। নিজেরা যেন অভাবের বাইরে থাকতে পারে।

— ওহ্, ওহ্, মাগো – মাগো – মামুন আর মাসুদ দুই ভাই হাসতে হাসতে হাততালি দেয়। তারপরে দু’জনে মায়ের পায়ের কাছে বসে পড়ে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। আয়শা খাতুন দু’জনকে টেনে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে। দু’ভাই মাকে আদর করে। কপালে চুমু দেয়। তারপর মামুন লাফিয়ে উঠে বলে, আমি গেলাম জঙ্গলে ঘুরতে। — দূরে যাস না বাবা।

— পা যতক্ষণ টানবে, ততক্ষণ হাঁটব। না পারলে বসে থাকব। মাসুদ বলে, আমি যাব তোমার সঙ্গে?

— না, তুই ছোট্ট ছেলে হাঁটবি কি করে? আমি গেলাম মাগো।

— আয়। আয়শা খাতুন জানে, ছেলেকে নিষেধ করলেও যাবে। মায়ের কথা মানবে না। সেজন্য চুপ করে থাকে। ভাবে, ওতো বনে-জঙ্গলে ঘুরে। কোনো দোষের কিছু করে না। থাক, এসব দেখেটেকে বড় হোক। আয়শা খাতুন মাসুদের হাত ধরে দাঁড়িয়ে মামুনের দৌড়ে যাওয়া দেখে।

একসময় গাছগাছালির ফাঁকে আড়াল হয়ে যায় ও। বিভিন্ন গাছে হাত বুলিয়ে জড়িয়ে ধরে পরে আবার হাঁটতে থাকে। কখনো গাছের নিচে বসে ফড়িং খোঁজে। কখনো গাছের উপরে উঠে পাখির বাসায় ডিম দেখে। ডিম ছাড়া পাখির বাসা দেখলে ওর মন খারাপ হয়ে যায়। প্রায়ই পকেটে চাউল এনে পাখির বাসায় রেখে দেয়। যেন পাখি পেট ভরে চাল খেয়ে বাসাতে থাকে। তবে মাকে লুকিয়ে চাউল আনতে হয়। কারণ অভাবের সংসার। পাখিকে চাল খাওয়ানো মা মানে না। মা ওকে ধমক দিয়ে বলে, এভাবে চাল নষ্ট করবি না। তাহলে একদিন দেখবি ভাত রাঁধতে পারিনি। তখন কি খাবি?

মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে মামুন। মাতো ঠিকই বলেছে। এর কোনো উত্তর ওর কাছে নেই। তারপরও বলে, একটি পাখিও তো না খেতে পেলে মরে যাবে। মা হেসে বলে, পাখির খাবারের অভাব নাই। ওরা উড়তে পারে। সারা গ্রাম খুঁজে খাবার খাবে। আমরা কি জঙ্গলে খাবার খুঁজতে যাব? — না, গো মা, আমরা দোকানে চাল কিনতে যাব। — টাকা পাবি কোথায়?

— ভাঙারির দোকানে কাজ করে টাকা আয় করব।

— বাব্বা, ছেলেটার বুদ্ধি অনেক। লেখাপড়া করে আবার দিন মজুরি করবি?

— করব ক্ষতি কি? কাজকে আমি কাজের মতো দেখি। লেখাপড়া শিখে ভালো চাকরি পাব এটাও আশা করি। দিনমজুরি করে লেখাপড়ার খরচ চালাব এটা ভাবতে আমি লজ্জা পাই না। এটা আমার সাহস।

নিজের স্মৃতিতে মগ্ন থেকে আকস্মিকভাবে দেখে দুটি টিয়াপাখি ওর সামনে দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। চারপাশে পাখির কূজন। গাছের কান্ডে মাথা ঠেকিয়ে পা ছড়িয়ে দেয় মামুন। ভাবে, আজ এক অন্যরকম দিন। সব সৌন্দর্য ওকে ঘেরাও করে রেখেছে। ডানদিকে ছয়টা টুনটুনি লাফাচ্ছে। উড়ে যাচ্ছে অনেকগুলো কাক। কা-কা শব্দ তোলপাড় করছে গাছপালা। আজ স্কুল বন্ধ, সারাদিন বনে থাকা যাবে। হঠাৎ মামুনের মনে হয় এভাবে বসে না থেকে কাজ করা উচিত। কিছু আয় করা মানে, বাবা-মাকে সাহায্য করা। কিছু আয় করা মানে যেসব ছেলেমেয়ে স্কুলে বেতন দিতে পারে না, তাদের সাহায্য করে স্কুলে ধরে রাখা। শিশুদের সঙ্গে সংগঠন করে গান, নাটক করা। গ্রামের মানুষকে বোঝানো যে এইসব করা সংস্কৃতি। সংস্কৃতি চর্চা না করলে মানুষের জীবনে আনন্দ থাকে না। এতকিছু ও শিখেছে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের প্রশিক্ষণ থেকে। শিশুদের পক্ষে কাজ করা একটি বড় প্রেরণা ওর জীবনে। মামুন হাঁটতে হাঁটতে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে থাকে। হাসতে হাসতে বলে, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের প্রশিক্ষণ থেকে আমি তোমাদের কথা জেনেছি গাছ-বন্ধুরা – পাখি বন্ধুরা। ও সবুজ ছায়ায় দৌড়াতে শুরু করে। অল্পক্ষণে পৌঁছে যায় রাস্তায়। বাবার কথা মনে হলে বুকটা কেমন কঁকিয়ে ওঠে। তিন-চার দিন ধরে বাবার জ্বর, গায়ে ব্যথা। বিছানা থেকে উঠতে পারে না। ঘরে টাকা নাই। ওষুধ খাওয়া হচ্ছে না। ধম করে দাঁড়িয়ে পড়ে ও রাস্তার মাঝখানে। ভাবে, ওতো বাড়ির বড় ছেলে। বাবার সেবা করার জন্য মা বাড়ি থেকে বের হতে পারে না। তাহলে ওরইতো বাবার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। টাকা আয় করতে হবে। প্রবলভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, হ্যাঁ, এটা করতেই হবে। বাবাকে সুস্থ করতে হবে।

প্রথমে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল অফিসের সামনে আসে। এখানে যদি কোনো কাজ করা যায় তাহলে করবে। জলঢাকা উপজেলায় প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল শিশুদের নিয়ে নানা ধরনের কাজ করে। বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়। মামুন সব শিশুর সঙ্গে মিলে সব রকম অনুষ্ঠানে যুক্ত থাকে। এজন্য সবাই ওকে ভালোবাসে। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের আলতাফ ওকে জিজ্ঞেস করে, কি রে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

— আমার বাবার অসুখ। তাই কাজ খুঁজতে এসেছি। কাজ না করলে আমাদের ভাত খাওয়া হবে না কাকু।

— এখানেতো কোনো কাজ নাই রে মামুন। তোকে অন্য কোথাও কাজ খুঁজতে হবে। কাজ করলে স্কুলে যাবি কীভাবে?

— যতদিন কাজ করব, ওই কয় দিন স্কুলে যাব না। — কেমন কথা হলো?

— আমার বাবাকে বাঁচাতে হবে তো। স্কুলের হেড স্যারের সঙ্গে কথা বলব, আমাকে যেন নতুন করে ভর্তি করে নেয়। আমি পড়ালেখা ছেড়ে দেব না।

— ঠিক বলেছিস। সাবাস ছেলে। আমার মনে হয় তুই ভাঙারি দোকানে যা। ওরা দিনমজুরি দেবে। তোদের ভাত খাওয়া হবে ওই টাকায়।

— ভাত খাব পরে। বাবাকে আগে ওষুধ খাওয়াব।

— হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস।

— আমার স্কুলের পাশে একটা ভাঙারির দোকান আছে। আমি ওখানে যাই।

— তুই যে অনেক সামাজিক কাজ করিস তা কিন্তু করে যাবি।

— আমি কোনো কাজ ছাড়ব না কাকু। আমার চারপাশের স্কুলের যেসব ছেলেরা টাকার অভাবে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাদের আটজনকে আমি আবার স্কুলে ফিরিয়ে এনেছি। আশে-পাশের সব মানুষজনের কাছ থেকে একটু একটু টাকা জোগাড় করে ওদের স্কুলের বেতন দেই।

— তুইতো বাল্যবিয়ে বন্ধ করার জন্য হৈচৈ করিস রে-

— হ্যাঁ, আমরা সব ছেলেমেয়েরা মিলে করি। খোঁজখবর আমি রাখি। তারপর সবাইকে নিয়ে যাই। অনেক সময় গাঁয়ের লোকেরা আমাদের সঙ্গে রাগারাগি করে। কিন্তু আমাদেরকে ঠেকাতে পারে না। আমরা বাল্যবিয়ে বন্ধ করে থামি। কখনো চড়-থাপ্পড় খেতে হয়। তাতে আমরা কিছু মনে করি না।

— তুই আামদের জলঢাকা গাঁয়ের গর্ব।

— আমি যাই ভাঙারির দোকানে। সালাম কাকু। মামুন দৌঁড়াতে থাকে। অল্প সময়ে পৌঁছে যায় আবদুলের দোকানে। দৌঁড়ানোর কারণে হাঁপাতে থাকে।

আবদুল ওর মাথায় হাত রেখে বলে, হাঁপাচ্ছিস কেন?

— আপনার কাছে দৌঁড়ে এসেছি। আমাকে কাজ দেন। আমি দিনমজুরি করব। আমার বাবার অসুখ। টাকা লাগবে।

— ঠিক আছে কাজ দেব। ওখানে বসে দম নে।

শুরু হয় মামুনের দিনমজুরি। প্রথমবার টাকা পাওয়ার পরই বাবাকে নিয়ে যায় ডাক্তারের কাছে। আবদুল জব্বার ভেবেছিল, ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে শরীর। কিন্তু হয় না। আরও তিন-চার মাস গড়ায়। তারপর আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠে। আয়শা খাতুন ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে, বাবারে তুই লেখাপড়া ছেড়ে বাবাকে ভালো করলি। এখন স্কুলে ভর্তি হয়ে যা। ভয় নাই সংসার চলবে। আমি আয় করব, তোর বাবাও আয় করবে।

— আমিও লেখাপড়া করতে চাই মাগো।

— যা, স্কুলের হেডমাস্টারের সঙ্গে গিয়ে কথা বল।

— আজকেই যাব। আমার কাছে যে টাকা আছে তাই দিয়ে ভর্তি হব। বইখাতা কিনব। আবদুল জব্বার সঙ্গে সঙ্গে সায় দেয়, যা বাবা, এখনই স্কুলে যা। আর দেরি করিস না। এক বছর নষ্ট হয়ে গেল।

— এই নিয়ে আমার কোনো কষ্ট নেই বাবা, আমি গেলাম। ভর্তি হয়ে আসি।

স্কুলে যেতে যেতে দেখতে পায় তিনটি ছেলে রাস্তার ধারে বসে মার্বেল খেলছে। ও কাছে দাঁড়িয়ে ধমকের স্বরে বলে, মতিন, বাবলা, পিন্টু তোরা এখানে বসে খেলছিস কেন? স্কুলে যাসনি কেন? মতিন বলে, আমাদের বাবারা স্কুলের বেতন দিতে পারছে না। সেজন্য আমরা আর স্কুলে যেতে পারব না।

— খবরদার এমন কথা বলবি না। স্কুলে যেতেই হবে। উঠে আয়, আমার সঙ্গে স্কুলে যাবি।

— না, যাব না।

— আজকে তোদের স্কুলের বেতন আমি দিয়ে দেব। — তুমি কেমন করে দেবে মামুন ভাই?

— এত কথা জিজ্ঞেস করবি না। চল। তিনজনে মামুনের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করে। স্কুলে পৌঁছে যায়। তখনও ক্লাশ শুরু হয়নি। মামুন হেডস্যারের রুমে ঢুকে ওদের ভর্তির কথা বললে হেডস্যার অফিসকে ভর্তির নির্দেশ দেন। মামুন খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এভাবে ছেলেটির পথচলা ও নিজের মতো করে গড়ে তুলেছে। হেড মাস্টার ভাবলেন, কেউ ওকে শেখায়নি, কিন্তু নিজের চেতনা আলোকিত করে তোলা ওর এক অসাধারণ দিক। তিনি দেখতে পান যেসব ছেলেরা অভাবের কারণে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে তাদেরকে ও ফিরিয়ে আনে স্কুলে। সবার কাছে সাহায্য চায়। কেউ দুই টাকা দিলেও সেটা খুশি মনে গ্রহণ করে। বলে, এইরকম অনেক দুই টাকা পেলে ওরা আবার স্কুলে ফিরে যেতে পারে। পাশাপাশি মেয়েদের বাল্যবিয়ে হলে ও প্রথমে ছুটে যায় বাবা-মায়ের কাছে। বাবা-মা রাজী না হলে জলঢাকার শিশু সংগঠনের সবাইকে নিয়ে বাড়ির সামনে স্লোগান দিতে শুরু করে, ‘মেয়েদের শিক্ষা আগে, তারপরে বিয়ে’। ওদের হইচইয়ে আশেপাশের মানুষ ছুটে আসে তারপর বিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে অনেক বাল্যবিয়ে ঠেকিয়েছে মামুন। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের প্রশিক্ষণ থেকে শিখেছে বাল্যবিয়ে হলে মেয়েদের কি ধরনের শারীরিক ক্ষতি হয়। মায়েদের কাছে গিয়ে সে কথাও বলে। মায়েদের চোখ বড় হয়ে যায়। ওর মাথায় হাত রেখে বলে, বাবারে তুই আমার মেয়েটাকে বাঁচিয়ে দিলি।

মামুন হাসিমুখে মায়ের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। গ্রামের সব মা ওর কাছে শ্রদ্ধার মানুষ। পায়ে হাত দিয়ে সালাম না করলে ও স্বস্তি পায় না। তাই সবাই ওকে খুব ভালোবাসে। লেখাপড়ার পাশাপাশি সামাজিক কাজ করে ও চরম আনন্দে থাকে। প্রায় পঞ্চাশ-ষাটজন ঝরে পড়া শিশুকে ও আবার স্কুলে ফেরাতে পেরেছে। প্রায় পঁচিশ-তিরিশটি বাল্যবিয়ে ঠেকাতে পেরেছে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে গানের আসর বসায়। গ্রামের লোকেরা খুশি হয়ে গান শুনতে আসে। সবার মুখে এককথা, ছেলেটা আমাদের বেঁচে থাকায় বাতাস দিচ্ছে। ও একদিন বড় মানুষ হবে। আমাদের জলঢাকা গ্রাম ওর নামে ফুটে উঠবে।

এমন চিন্তায় সবাই হাসাহাসি করে। ওর বয়সী ছেলেরা ওকে ঘাড়ে তুলে দোলাতে থাকে। হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে, খুশি লাগছে তোর? — না লাগছে না।

— কেন?

— বাল্যবিয়ে ঠেকাতে গেলে রেজিনার আব্বা যে আমাকে গালাগালি করে বলল, পরে তুই কি ওর বিয়ে ঠিক করে দিবি? বেশি বাড়াবাড়ি করলে তোর মাথা ভেঙে ফেলব।

— এসব কথাতো তুই অনেকবারই শুনেছিস? আবার বলছিস কেন? খবরদার আর কখনো বলবি না। তোর সঙ্গে আমরা আছি না।

আর একজন বলে, আমরাতো জানি তুই এইসব গায়ে মাখিস না। বাল্যবিয়ের চেয়ে মেয়েদের শিক্ষায় তুই অনেক বেশি গুরুত্ব দিস।

— থাক, এসব কথা বাদ দে। আর কিছু বলিস না। আমাকে ছেড়ে দে।

— না ছাড়ব না। তোকে নিয়ে জলঢাকার জঙ্গলে যাব। তোকে গাছে চড়িয়ে দেব। তুই যা করিস তার জন্য আমাদের চেয়ে উপরে থাকবি।

— না, তোদের সঙ্গেই থাকব আমি। মিলেমিশে একসঙ্গে। আমরা সবাই সমান।

— একদম না। তোর মতো এত চিন্তা আমাদের নাই। অভাবী ছেলেদের স্কুলে পাঠাস, মেয়েদের শিক্ষার জন্য বিয়ে বন্ধ করিস, আমরাতো এতো কিছু চিন্তা করি না।

— থাক, চুপ কর।

— আমরা চুপ করলে কি হবে। সবাই তোর কথা বলে, সুনাম করে। তোকে পুরস্কার দেবে এমন চিন্তাও শুনি।

— থাম, থাম, চল খেলি। মামুন জোর করে ওদের হাত ছাড়িয়ে বনের মধ্যে দৌড়াতে শুরু করে। হাডু-ডু-ডু খেলতে থাকে সবাই। একসময় শেষ করে খেলা। যে যার বাড়িতে ফেরে।

বছর গড়ায়। মামুনের স্কুল-পরীক্ষা শেষ হয়। ও কলেজে ভর্তি হয়। কলেজে যায়, মাঝে মাঝে দিনমজুরি করে কলেজের খরচ চালায়। পাশাপাশি ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলে পাঠানো এবং বাল্যবিয়ে বন্ধের জায়গা তৈরি করে ফেলে। কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর জাতিসংঘ থেকে পুরস্কার পাওয়ার খবরটি পৌঁছায় জলঢাকার সবার কাছে। চারদিকে হৈ-চৈ পড়ে যায়। ছেলেরা মামুনকে ঘাড়ে তুলে লাফালাফি করতে শুরু করে। স্লোগানের মতো বলে, জলঢাকা থেকে জাতিসংঘ। জলঢাকা-জাতিসংঘ — জ-জা- আমাদের বর্ণমালা পুরস্কার পেয়েছে। তুই পুরস্কার আনতে গেলে বাংলাদেশের পতাকার সঙ্গে জলঢাকা আর জাতিসংঘ লিখে নিয়ে যাবি। সবাইকে বলবি দেখ আমাদের বাংলা বর্ণমালা। — থাম, থাম, এতকথা বলিস না তোরা।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল থেকে সবাই জানতে পারে জাতিসংঘ শিক্ষা বিষয়ে তরুণদের ‘ইয়ুথ কারেজ অ্যাওয়ার্ড ফর এডুকেশন’ পুরস্কার প্রদান করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেসব তরুণরা শিক্ষা বিষয়ে কাজ করে তাদেরকে এই পুরস্কার দেয়া হয়। এ বছর বিভিন্ন দেশের সাতজন তরুণকে নির্বাচিত করা হয়েছে। জাতিসংঘের ‘ইয়ুথ কারেজ অ্যাওয়ার্ড ফর এডুকেশন’ পুরস্কারের জন্য তাদের মধ্যে একজন মামুন আলী।

যে চিঠিটি এসেছে জলঢাকায় তাতে লেখা আছে, ‘প্রতিটি ছেলেমেয়ের শিক্ষার জন্য তুমি অবদান রেখেছ।

তরুণদের একজন নেতা হিসেবে আমরা তোমাকে মনোনীত করেছি। তোমাকে অভিনন্দন।’

মামুন চিঠিটা বুকে নিয়ে দৌঁড়ায়। ওর পেছনে যুক্ত হয় জলঢাকার অনেক শিশু। আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হয় ওদের উচ্ছ্বাসের হাসি-কলরব। ওরা জলঢাকাকে বদলে দেয়, যেন জলঢাকা বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়ানো এক উপজেলা।

পুরস্কার প্রদানের তারিখ নির্ধারিত হয়। কিন্তু মানুনের নিউইয়র্ক যাওয়া হবে না। ওর পাসপোর্ট নেই। ভিসার ব্যবস্থা করতেও সময় লাগবে। পরে ঠিক হয় যে মানুনের পক্ষে পুরস্কার গ্রহণ করবে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের নিউইয়র্ক প্রতিনিধি। মামুন আনন্দে একা একা ঘুরে বেড়ায় জলঢাকার সবখানে। মাঠের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ঘন ঘাসের কাছে বসে পড়ে বলে, ঘাস তোরা জানিস আমি একটি পুরস্কার পেয়েছি। জানিস কিনা বল। হু-হু বাতাসে তোলপাড় করে ওঠে ঘাসের মাথা। মামুন হাসতে হাসতে বলে, বুঝেছি, তুই জানিস আমার ঘাস-বন্ধু।

ও ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে। মাটিকে বলে, তুমি কি জানো আমি একটি পুরস্কার পেয়েছি। মাটির ওপর চিৎ হয়ে পড়ে থাকে ও। কোথাও কোনো শব্দ নাই। মাথা উঠিয়ে উঠে বসলে টের পায় পুরো পিঠের বিভিন্ন জায়গায় মাটি লেগে আছে। দু’হাতে মাটি ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, বুঝেছি তুমিও জানো আমার মাটি-বন্ধু। যাই নদীতে নামি। তোমাকে মিশিয়ে দেব পানিতে। নদীর ধারে এসে দাঁড়ায়। দুকান ভরে নদীর কলকল শব্দ শোনে। বেশ দূরে তাকালে দেখতে পায় বুলবুল যাচ্ছে। বুলবুল কলেজে একসঙ্গে পড়ে। মামুন আর অপেক্ষা করে না। নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সাঁতার

কেটে অনেক দূরে যায়।

— নদী-বন্ধু তুমি কি জেনেছ আমি পুরস্কার পেয়েছি?

কলকল ধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে নদী। স্রোতের বেগ বেড়ে যায়। মামুন আবেগের স্বরে বলে, ভালোবাসায় আমাকে ভরে দিলে বন্ধু। আমি ধন্য হলাম।



নদী থেকে ওঠার পরে দেখতে পায় বিভিন্ন দিক থেকে ওর কলেজের বন্ধু-বান্ধবীরা আসছে। সবার আগে এসে পৌঁছেছে বুলবুল। ও বলে, তোকে অভিনন্দন জানানোর জন্য আমরা তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম মামুন। শেষে দূর থেকে দেখলাম তুই নদীর দিকে যাচ্ছিস। যারা চারদিক থেকে আসছে তারা, জয় মামুনের জয় – বলে চিৎকার করছে। তুই আমাদের গর্বের বন্ধু হয়েছিস, তোকে অভিনন্দন। হাজার হাজার অভিনন্দন। জয় মামুনের জয় –

ছেলেরা কাছে এসে ওর ভেজা শরীর জড়িয়ে ধরে। মেয়েরা হাত বাড়িয়ে বলে, আমরা হ্যান্ডশেক করব। হাত বাড়িয়ে দে মামুন।

ছেলেরা সরে গেলে মামুন মেয়েদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। ওরা বলে, অভিনন্দন, অভিনন্দন – হাজারো ফুলের শুভেচ্ছা।

— চল ওকে ঘাড়ে তুলে নিয়ে যাই। কলেজের কাছে গিয়ে ছেড়ে দেব। ও আমাদের গৌরব বাড়িয়েছে। বুলবুল বলে, শুধু কি গৌরব বাড়িয়েছে? আমাদের কত অভাবী সংসারের ছেলেমেয়ের পড়ালেখার ব্যবস্থা করেছে। কত মেয়েদের বিয়ে বন্ধ করে স্কুলে ফেরাল। মেয়েরা সবাই একসঙ্গে

চেঁচিয়ে বলে, চল ওকে মিষ্টি খাওয়াই। ওর সঙ্গে আমরাও খাব।

— তাই চল, তাই চল।

— তোদের কাছে টাকা আছেরে বান্ধবীরা?

— কিছু কিছু আছে। সবাই মিলে দিলে হয়ে যাবে।

— হ্যাঁ, আমরা সবাই মিলে দিব। আমাদের পকেটেও টাকা আছে।

— হিপ, হিপ হুররে – চল, চল।

— এই কেউ আমাকে ঘাড়ে উঠাবি না। আমি হেঁটে যাব।

কোনো কোনো ছেলে আগে আগে দৌঁড়াতে থাকে। চিৎকার করে বলে, হিপ, হিপ – হুররে। জয় মামুনের জয়।

ওদের সঙ্গে যুক্ত হয় গ্রামের অনেক ছেলেমেয়ে। পেছনে হাঁটে বড়রাও। গ্রামবাসী এমন একটি মনমাতানো দিনতো আগে দেখেনি। সবাই মিলে বাজারের মিষ্টির দোকানের সামনে আসে। তিনটি মিষ্টির দোকান ঘিরে দাঁড়ায় ওরা। গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জব্বার মিষ্টির দোকানের মালিকদের বলেন, আপনাদের সব মিষ্টি ছেলেমেয়েদের কাছে দিয়ে দেন। ওরা গ্রামবাসীকে একটা করে মিষ্টি খাওয়াবে। মিষ্টির দরদাম হিসাব করে আমাকে বলবেন, আমি সবার কাছ থেকে পাঁচ টাকা করে নিয়ে দাম মিটিয়ে দেবো। আসুন, আমরা সবাই মিলে জলঢাকার সোনালি দিন পালন করি। আমাদের উপজেলা বিশ্বের সামনে পৌঁছে গেছে।

আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই বলে, সোনালি দিনের উৎসব মিষ্টি ছাড়া হবে না। গ্রামবাসী সবাই একটা করে মিষ্টি খাবে এটা ভাবা যায়? আজ সেই দিন আমাদের। এখন রমজানের মাস চলছে। আমরা ইফতারের সময় মিষ্টি খাব। ছেলেমেয়েরা এখন খেয়ে ফেলুক। ওদের আনন্দের শেষ নেই।

যারা রোজা আছেন, তারা সবাই চলেন মসজিদে যাই। সবাই খেয়াল করবেন সবার হাতে যেন একটা করে মিষ্টি থাকে। কেউ যেন বাদ না পড়ে। উৎসবের আনন্দ সবার জন্য সমান থাকবে।

চেয়ারম্যানের কথা শুনতে খুব ভালো লাগে মামুনের। ভিজা প্যান্ট-শার্ট পরে থাকা অবস্থায় দেখে কেউ ওকে শাসন করেনি। সবাই ভালোবাসার কথা বলেছে।

এরমধ্যে সবাই যে যার ঘরে ফিরতে শুরু করে। মামুন বাবা মায়ের জন্য দুটো মিষ্টি নিয়ে ঘরে ফেরে। মায়ের মুখে মিষ্টি নিজেই দেয়, বাবার মুখেও। মাসুদ বাজারের ওখানে ছিল। মিষ্টি খেয়েছে, এখনো ফেরেনি।

উপজেলার সবাই মিলে বলে, আমরা মামুনের জন্য সংবর্ধনার আয়োজন করব। আর কয়দিন পরে আমাদের ঈদের দিন। ঈদগাহ মাঠে নামাজের পরে এই আয়োজন হবে। আল্লাহ যেন ওকে একশ বছরের হায়াত দেন, আমরা এই দোয়া করব।

তারপর ওর কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। ওর গলায় অনেক ফুলের মালা দেয়া হবে। নাচ-গান হবে। আমরা এই বছরে একটি অন্যরকম ঈদ পেলাম। এই ঈদের দিন জলঢাকার গৌরব। এই দিনকে স্মরণ করে আমরা নানারকম অনুষ্ঠান করব। এই পুরষ্কারের কথা স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের বোঝাব। যেন ছেলেমেয়েরা এই জায়গা ধরে আমাদের সমাজকে এগিয়ে দেয়। কলেজের প্রিন্সিপাল মামুনকে কাছে ডেকে বলে, সারা জীবন এমন কাজ করে নিজেকে ভরিয়ে তুলবি বাবা। এমন কাজ থেমে থেকে যাবি না। আমরা সবাই তোর সঙ্গে থাকব।

মামুন স্যারের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। দাঁড়িয়ে থাকা সবাই হাততালি বাজায়। মুখর হয়ে ওঠে গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। মাঠঘাট পথপ্রান্তর বাড়িঘর। উৎসবের আনন্দ সবখানে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *