short-story-jotha-ajotha

যথা অযথা
রুমা মোদক


এক ঝাঁক কাক কা কা করতে করতে বারান্দা লাগোয়া ইলেকট্রিক কিংবা ইন্টারনেটের তার থেকে উড়ে গেলে বাবা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, অথবা বাবা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে এক ঝাঁক কাক পুরো ভোরবেলা জুড়ে বারান্দায় ছড়িয়ে দিতে থাকা তাদের কোলাহল থামিয়ে উড়ে চলে যায়। মোহাম্মদপুর ছয়তলা এপার্টমেন্টের ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে নীরবতা নামে। মোবাইলে মোবাইলে খবরটা তলার পর তলা অতিক্রম করে যায়। ‘নিসর্গ নিরুপমা’ এপার্টমেন্টের মালিক আর বেঁচে নেই। ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে বসবাস করা পরিবারগুলো পারস্পরিক আলোচনায় সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা, তারা কি হাসপাতালে যাবে, নাকি মৃতদেহ এখানে নিয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করবে।

মৃত্যুর সময় বাবার মাথার পাশে থাকা মায়ের দীর্ঘশ্বাস কিংবা স্বস্তির নিঃশ্বাস কিছুই বাইরে থেকে শোনা যায়না, আমরা যারা বাইরে ছিলাম, মৃদু একটা আর্ত চিৎকার শুনলাম কি শুনলাম না, সাদা কাপড়ে পুরো শরীর ঢেকে স্ট্রেচারে করে বাবার মৃতদেহ বাইরে নিয়ে আসা হলো, আর আপাত সব বাস্তবতা আড়াল পড়ে গেলো মায়ের হাহাকার আর্তচিৎকারে। কারো মৃত্যুর পর এই আর্তচিৎকার একটা নিয়ম কিংবা রীতি। না কাঁদলে লোকে কী বলবে। ত্রিশ বছরের সংসার বাবা-মায়ের।

নইলে আর কেউ না জানুক আমি জানি, খুব ভালো জানি, মা হয়তো দীর্ঘদিন পর আজই শান্তিতে ঘুমাবেন। মায়ের চেহারা জুড়ে নিভে যাওয়া উনুনের শীতলতা। সারা দুপুর রান্না করার পর যে উনুন পানি ঢেলে নিভিয়ে দেয়া হয়েছে।

গত পাঁচদিন আই.সি.ইউর বারান্দার এক কোনে বসে থাকা মহিলাটি মৃতদেহের সঙ্গে ‘নিসর্গ নিরুপমা’ পর্যন্ত যায়, তখনও তাকে আলাদা করে গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজনীয়তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে না। কিন্তু সবশেষে এপার্টমেন্টের গ্রাউন্ডে জমায়েত সবার সব কৌতুহল কিংবা লোকনিন্দার তোয়াক্কা না করে মহিলাটি কিছু বলার জন্য এগিয়ে এলে, মা সব আর্তনাদ স্থগিত করে আমাকে নির্দেশ করে, মুকুলকে খবর দে। মহিলা শোনে কি শোনে না, আমি পরিস্থিতির নাটকীয়তা কিংবা জটিলতা এড়াতে মুকুলকে ফোন করি। মুকুলের ফোন বন্ধ। আবার ফোন করি, বারবার। মুকুলের ফোন বন্ধ। এই সময়, যখন তাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তখনই তার ফোন বন্ধ!

বড় হওয়ার পর, ‘বুঝ হওয়া’ যাকে বলে, মা আর বাবার মাঝে কোনো দিন শান্তি দেখিনি আমি কিংবা আমরা, বোনেরা কেউই। বড় আপা দাদীর কাছে শেখা প্রবাদ বলতো, মা আর বাবার ঝগড়ার তীব্র শব্দে ঘরের চালে কাক বসতে পারেনা। টিনের চাল অবশ্য আমাদের নয়, ইন্টেরিয়র ডিজাইনার দিয়ে কাঠের কারুকাজ করানো ছাদ। এই ছাদের নিচে আমরা কেবল দেখেছি সারাক্ষণ বাবার সঙ্গে ক্যাটক্যাট করছেন মা। যে কোনো কিছু নিয়ে তুচ্ছ কিংবা বৃহৎ। বাবাকে দেখা মাত্র ক্ষেন্ত নেই মায়ের। প্রথম প্রথম মাকেই দোষ দিতাম। দিনশেষে সন্ধ্যায় বাবা ঘরে ফেরা মাত্রই মায়ের মেজাজ চড়ে যেতো হঠাৎ কেরোসিন ঢেলে দেয়া আগুনের মতো। যাচ্ছেতাই ব্যবহার করতেন বাবার সঙ্গে। বাবা কখনো চুপ থাকতেন, কখনো পাল্লা দিয়ে চিৎকার করতেন। তারপর দুজনের মিলিত চেঁচামেচিতে আমাদের বাসাটা নরককুণ্ড হয়ে উঠতো। এই চেঁচামেচি গ্লাস বাটি ছুঁড়াছুঁড়িতে থামতো কখনো কখনো। আমরা চার বোন প্রথমে ভয়ে তারপর অভ্যস্ততায় গলাগলি করে বড় হতাম বাসার অন্য কোনো রুমে। ঘুমের দেশে তলিয়ে যাওয়া থেকে চোখ টেনে খুলতে না পেরেও কান খাড়া করে মায়ের শীৎকার শুনতাম, কুত্তার বাচ্চা আমি বলে তোর ঘর করতেছি…আমরা জীবনের নানা গোপন জানতাম, জানাতাম একে অপরকে, আর মনে মনে প্রার্থনা করতাম, প্রায় প্রতিদিন, ইস বাবা যদি আজ বাসায় না ফিরতেন! বাবা যদি এই বাসায় না ফিরতেন, ঘরে নীরবতার মতো স্বস্তি থাকতো।

বাবা মাঝেমধ্যে ফিরতেন, মাঝেমধ্যে ফিরতেন না। আমরা বড় হওয়ার পর ভাবতাম, বাবা ফিরতেন কেন? সামাজিকতা নাকি দায়িত্ব? মায়া নাকি আসলেই প্রেম বলে কিছু একটু কয়েক ফোঁটা স্মৃতি হয়ে উপেক্ষার আঙুলে আঠার মতো লেগেছিলো। নইলে বাবা কোনো দিন না এলে কারো কিচ্ছু করার ছিলো না। মায়ের না, আমাদের চার বোনের না। বড়জোর একজন উকিল আর একটা কাগজ। কিন্তু বাবা ফিরতেন। মায়ের তীব্র ঝাঁঝ আর অসহনীয় যাতনাজাত বাক্যবাণের কাছে ফিরতেন।

আমরা সব জেনে গেলে, মায়ের এই দিনমান ক্যাটক্যাট এর অনিবার্যতার রহস্য আমাদের কাছে উন্মোচিত হয়ে গেলে, আমাদের কাছে বাবার এই না থাকার মতো আবেগহীন লেগে থাকাকে মহত্ত্ব বলেই মনে হতো। কিন্তু মা বলতেন অন্য কথা, সমাজে একটা মান সম্মান আছে না! সিলেটি সৈয়দ বাড়ির মেয়ে তার বউ। পাঁচজন জানে। ব্যাডার মান সম্মান জ্ঞান টনটনে। বাবার উপর রাগ হতো না আমাদের। রাগটা হতো মায়ের উপরেই। সারাদিন অফিস করে ফিরেন বাবা। ফিরতে ফিরতেই কেনো মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করতে হবে প্রতিদিনই নিত্য নতুন অজুহাত তৈরি করে। মা একটু চুপ থাকলেই ঘরের পরিবেশটা ভালো থাকে। বাবা নিজের থেকে কোনো দিন ঝামেলা বাধান না। কিন্তু বাবা ঘরে ফিরেছে আর মা চুপ করে আছেন এমন পরিস্থিতি আমরা কালেভদ্রে দেখেছি বলে মনে পড়েনা।

একটু বড় হতে হতে আমরা টের পেয়েছি, মায়ের ভেতরে কী জলন্ত আগ্নেয়গিরির দাবানল। ইউনিভার্সিটির ছয় আর তারপর আরও তিন। নয় বছর প্রেম করে যে বিয়ে, সংসার, বাবা মায়ের তীব্র আপত্তি অগ্রাহ্য করে, বিয়ের বছর দশ পরে যদি জানা যায় তার আরেকটা সংসার আছে, বাচ্চাকাচ্চা আছে তখন মায়ের মতো নারীর পায়ের তলার মাটি তো মাটি, যেনো পা দুটোই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ততোদিনে ঘরভরা আমরা চার চারজন বোন। মায়ের স্বাবলম্বী হওয়ার শক্তি, সাহস কিংবা মানসিক জোর কোনটাই নেই। মায়ের কোথাও যাওয়ারও জায়গা নেই, আমাদের ভবিষ্যৎ সামনে ঝুলে আছে বাপের ইচ্ছে-অনিচ্ছের দাড়ি পাল্লায়। বাপ যদি কোনো কারণে দায়িত্ব অস্বীকার করে সরে পড়ে তো পথে বসা ছাড়া কোনো গত্যান্তর নেই আমাদের। আমাদের পথে বসা থেকে বাঁচাতেই বোধকরি মায়ের এই রাত জেগে মিহি গলার আর্তনাদ আর বাবার সঙ্গে সময়-অসময় উত্তপ্ত লাভা উগড়ে দেয়া।

দোতলা বাড়ির সিঁড়ির পাশে ঘনিষ্ঠ অন্ধকার। ঘরগুলো পাশাপাশি, সিঁড়িগুলোও একান্নবর্তী ঘরের ভাইবোনের মতো এক বিছানায় আড়াআড়ি শুয়ে থাকা। ঘর গুলো আলাদা হলেও সিঁড়িগুলোতে গলাগলি। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেয়া যায় পাশের সিঁড়ি কিংবা সিঁড়ির মানুষ।

মুকুলের মেসে আজই প্রথম আসা নয়, আগেও এসেছি। যতোটা দরকারে এসেছি, তারচেয়েও বেশি অদরকারে এসেছি। মুকুল শেষের দিকে একদম চাইতো না, আমি ওর মেসে আসি। আসার কথা শুনলেই নানা বাহানায় এড়িয়ে যেতো৷ আজ অবশ্য আসাটা যতোটা প্রয়োজনের ততোটাই বেখাপ্পা। অশালীন বললেও অত্যুক্তি হয়না। জন্মদাতা পিতার মৃতদেহ খাটিয়ায় রেখে বাড়ি থেকে বের হয়ে মুকুলকে খুঁজতে আসা! বেখাপ্পাই বটে।

মুকুলের দরজায় বিরাট এক তালা। হতাশ হই আমি। মুকুল মাকে নিশ্চিত করেছিল, সমস্যাটা সে দেখবে। নিশ্চিত মানে কথার কথা নয়। দায়িত্ব নিয়ে মাকে কথা দিয়েছিল মুকুল। অথচ আজকেই সকাল থেকে মুকুলের মোবাইল বন্ধ।

মুকুলের বন্ধু দুয়েকজনকে ফোন করি। কেউ মুকুলের কোনো খবর জানে না। মুকুলকেই এই মূহূর্তে খুব দরকার, কোথায় গেল মুকুল এই সময়ে!

মুকুলের সঙ্গে মায়ের দেখা হয়েছিলো আমার সঙ্গে মুকুলের পরিচয় হওয়ার বছর খানেক পর। মুকুলই খুব আগ্রহ করে গিয়েছিলো মায়ের সঙ্গে পরিচিত হতে।

আমার কাছে মায়ের গল্প শুনেই মুকুলের আগ্রহ জন্মে। আমি মায়ের গল্পটা বেশ দেরিতেই করেছি। আরও আগে করলে হয়তো পরিচয়টা আরও আগেই হতো। আসলে কী আর গল্প, বাপের আরেকটা সংসার আছে এই নিয়ে সংসারে অশান্তি যার-তার সাথে কি এই নির্মম গল্প চলে? পাশাপাশি চেয়ারে বসে মুকুলের সঙ্গে ততোটাই ঘনিষ্ঠতা আমার হলো, যতোটা হলে ঘরের এই গোপন অথচ নিত্য অশান্তির কথাটা ব্যক্ত করা যায়, ব্যক্ত করার অর্থ হয় নিজের ভারাক্রান্ততা অতিক্রম করা। নিজেকে খানিক হালকা করা। মুকুল আমার ভার নিতে পারে। ওর সান্ত্বনা বাণী, চৈত্রের দুপুরে হঠাৎ আসা বৃষ্টির মতো। পরম মমতায় ঘরের অশান্তি ভুলিয়ে দেয়। আমার ঘরের এই অশান্তির কিচ্ছাতো যেকোনো কারো কাছে যা করা যায়না। মুকুল আমার যেকোনো কেউ এর সীমা অতিক্রম করে বিশেষ কেউ হয়ে উঠলো। আর এই বিশেষ কেউ-এর জোরে আমার মা পর্যন্ত পৌঁছে গেলো।

মুকুল আর মায়ের সাক্ষাৎ পর্বের আলোচ্য বিষয় সচরাচর একটাই হয়। আমার বাপ আর তার কুকীর্তি। মাও যে মুকুলের মধ্যে তাই পায়, আমি যা পেয়েছি। মানুষকে পরম মমত্ব দিয়ে শান্ত রাখার, শান্তি দেয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা রাখে মুকুল। কিন্তু মুকুল মায়ের মধ্যে কী পায় কে জানে! আমার বদমেজাজি খিটখিটে মা। মায়ের অনেক অজানা তথ্য যা আমাদের অজানা, মুকুল তার সব জানে। মা যেনো হঠাৎ আশ্রয় পায় মুকুলের কাছে, জীবনের দেনা-পাওনা, অভিমান-অভিযোগ জীবনের জমানো ট্রাঙ্কের সব ডালা উন্মুক্ত করে দিয়ে মা যেনো হালকা হতেন। প্রয়োজনের গল্প, অপ্রয়োজনের গল্প। বাবাকে ঘৃণা করার প্রকাশ্য গল্প, ভালোবাসার কতো আড়ালের গল্প, কোনো দিন হয়তো প্রয়োজন নেই বলে জানা হতো না আমাদের, যেমন প্রেম করাকালীন মা আর বাবা দু’জন ফার্স্ট ইয়ারেই গোপনে কাজী অফিসে বিয়ে করে ফেলেছিলেন, শুধু তাই নয়, বাবার বন্ধু ফরহাদের মেসে বাসরও হয়েছিল। মেসের সবাই মাকে আর বাবাকে মেস ছেড়ে দিয়ে এখানে ওখানে রাত কাটিয়েছিল। ফুল টুল দিয়ে নাকি বেশ সাজিয়েছিল আকাশী কাঠের চৌকিটার চারপাশ। মেসের সবাই মিলে আটনি পোলাও খেয়ে ছিল পেটপুরে, মায়ের নিজের হাতের সিলেটী ট্র্যাডিশনাল রান্না। মা’য়ের সিলেটী বাপের তীব্র জাত্যাভিমান, সিলেটের বাইরে মেয়ে বিয়ে দেয়ার কথা কল্পনা তো দূরে থাক, প্রসঙ্গ উঠলে খুন খারাপি করারও সম্ভাবনা ছিলো, তাই আগেভাগেই আইনসিদ্ধ করতে হয়েছিল ব্যাপারটা।

বিয়ের পর মা তার সমস্ত গয়না বাবাকে দিয়ে দিয়েছিল ব্যবসা করার জন্য। প্রথম দিকে বাপ সিরামিক্সের কোম্পানিতে ম্যানেজারি করার সময় বিক্রয়কর্মী এক মেয়েকে নিয়ে কক্সবাজার গিয়েছিলো ঘুরতে… ইত্যাদি ছোটখাটো অনেক তথ্যই আমি জেনেছি মুকুলের কাছ থেকে। মা নাকি মুকুলকে বলেছে, বাবার চরিত্র সব সময় খারাপ। বিয়ের আগে তিনি বুঝতে পারেন নি।

বাপের সঙ্গে অশান্তির জেরে মূলত মায়ের সঙ্গে আমাদের স্বাভাবিক বাৎসল্য প্রকাশ কিংবা পারিবারিক মূহূর্ত সৃষ্টি আর ভাগাভাগি হয়েছে খুবই কম। কিংবা একেবারেই হয়নি। বাড়িতে পোষা গরু ছাগলের মতো নিয়মের স্নান খাওয়া আর মানব জন্মের সামাজিক চাপে স্কুল কলেজ যাওয়া। মা কোনো দিন আদর করে মেখে ভাত খাইয়ে দিয়েছেন আমাদের কাউকে, আমাদের মনে পড়েনা। মনে পড়েনা কোনো দিন কপালে চুমু দিয়ে বলেছেন, ঘুমা সোনা, যেমন সিনেমায় দেখি, মায়েরা চুলে বিলি কেটে তেল কেটে বিনুনি করে দেয়। এসব কিচ্ছু ঘটেনি আমাদের ভাগ্যে।

অথচ মুকুল এলে মায়ের চোখেমুখে বাৎসল্য উপচে পড়তে দেখি। মুকুলের পছন্দের আলুভর্তা, ডিম ভুনা রাঁধতে মায়ের কী যে উৎসাহ। মুকুল এলেই আমরা মায়ের মাঝে মাকে দেখতে পেতাম। আরেকটু দেই বাবা, আরেকটু। না খেতে খেতে তো হাড্ডিসার হয়ে গেছিস। একা একা মেস বাড়িতে থাকিস! কী খাস না খাস! আচ্ছা মাছ নয়, মাংস নয় ডিম ভাজি আর আলুভর্তা কারও প্রিয় খাবার হয়…মা সুলভ যেসব কথা মা কে ‘পুরুষতন্ত্রের শহিদ’ করে তোলে, ঘরকে সংসার করে তোলে। তার সবটুকুই আমরা পেতাম কেবল মুকুল বাসায় এলে। আমিতো আমি, আমরা তিন বোনই অপেক্ষা করতাম মুকুলের জন্য। কেবল মুকুল এলেই আমাদের বাসাটা পরিবারের মতো অন্তরঙ্গ বাক-বিতন্ডা, অনুযোগ, আহ্লাদে প্রাণময় হয়ে উঠতো।

আর বাদবাকি সময় আমার মা ‘পুরুষতন্ত্রের শহিদ’ হন বটে, কিন্তু শহিদের মর্যাদা পান না, চানও না। সন্তানদেরও ঠিকমতো সময়, সঙ্গ, যত্ন করলেন না, ব্যস্ত থাকলেন বাপের অবিশ্বাস্য প্রতারণার আক্ষেপে। মুকুলকে কেবলই বলতেন, চৌদ্দ গোষ্ঠীর সঙ্গে কী যুদ্ধ করেই না বিয়েটা করেছেন তিনি। নইলে চাল চুলোহীন ‘আবাদী’র সঙ্গে বিয়ে হয় সৈয়দ বাড়ির মেয়ের! সিলেটের বাইরে যে কাউকে সিলেটীরা বড় তাচ্ছিল্যের সঙ্গে আবাদী বলে। মায়ের বংশের শ খানেক আত্মীয় লন্ডন প্রবাসী। কতোজন তারে বউ করে নিয়ে যেতে চেয়েছে লন্ডন। কতো ত্যাগ করেই বাপকে বিয়ে করা তার। বাপের কতোদিন খাওয়ার টাকা থাকতো না, পরীক্ষার ফি দেয়ার টাকা থাকতো না। মা-ই খরচ দিয়ে চালাতো তাকে। মায়ের বেদনার শেকড় অনেক গভীরে। পুরো যৌবনের জমা-খরচের হিসাব কি এতো সহজে মিটে যাবার! কাকে বলবেন তিনি এসব! কেবল মুকুল এলেই মায়ের এই মা হয়ে উঠাটা দেখার জন্য আমি মুকুলকে প্রায়ই বাসায় নিয়ে আসতাম। আর মুকুল যে কী করে মাকে বশ করে নিলো, কেবল মা নয়, আমি এবং আমরাও বিশ্বাস করলাম মায়ের জীবনের সমস্যা কেবল মুকুলই সমাধান করতে পারে। প্রতিবার মুকুল চলে যাওয়ার পর, মায়ের নিশ্চিন্ত নিঃশ্বাস স্বস্তির শীতল বাতাস ছড়িয়ে দেয় পুরো বাসায়। মা বলে, মুকুলই তার ভরসা। একমাত্র মুকুলই পারবে। মুকুল কথা দিয়েছে, ঐ বেটিরে মোটেই ঘেঁষতে দিবে না তর বাপের কাছে। আমার কিচ্ছুতে হাত দিতে দিবে না বেটিরে। মুকুল বাপের বেটা। সব ব্যবস্থা করতেছে মুকুল…টের পাই মুকুলের আশ্বাসে মা তখন জলপ্রপাতের মতো অশান্ত অস্থিরতা ঝেড়ে বেশ একটু ধীরস্রোতের-শান্ত সরোবর হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। বাবার সঙ্গে মুকুলকে একদিন দেখাও করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন মা, মুকুল চায়নি, বলে ছিল এখন না, সময়মতো। মা জানতেন না, কী সেই সময়, কিন্তু মুকুলের আশ্বাসে অন্ধ বিশ্বাস আর ভরসায় অপেক্ষা করতেন।

মায়ের হিসাবটা শেষের দিকে বেশ সোজা হয়ে উঠেছিল। বাবার বিয়েটাতো আর ফেরানো যাবে না। যা হবার হয়ে গেছে। বউ, বাচ্চা কাচ্চা। কিন্তু মায়ের বিয়ের গয়না বেচার টাকা দিয়ে শুরু করা ব্যবসার এক টাকা হিস্যাও তিনি অপরপক্ষকেও দেবেন না। আমাদের কাছে বাবার চরিত্র নিয়ে সর্বক্ষণ কুকথাই বলতেন মা, অথচ ব্যবসায় ক্রমশ ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকা বাবা নাকি একটা পুত্র সন্তানের মুখ দেখতেই আরেকটা বিয়ে করেছেন বলে মা-ই মুকুলকে নিশ্চিত করেছেন।

আমি এবং আমরা চারবোন মাকে বুঝিয়েছি অনেক। ও পক্ষের ভাই-বোনেরা তো আইনত এসব পায়। কিন্তু মা কেবলই যন্ত্রের মতো আওড়ায়…আমার বিয়ের গয়না বেচা টাকা, আমার গয়না বেচা টাকা। আহা সেই কথা কি কোথাও লেখা আছে? কোনো দলিলপত্রে?

দলিলপত্র নিয়েও ঘরে কুরুক্ষেত্র কম হয়নি। মায়ের দাবি ছিলো, সব সম্পত্তি যেন বাবা আমাদের চারবোনকে লিখে দেন। বাবা দেননি। আবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে স্বাভাবিক মাথায় ভাবলে বাপের যুক্তিও অকাট্য। নিজের বুদ্ধি আর শ্রম না থাকলে নব্বই হাজার টাকার গয়না আজ কোটি কোটি টাকার সম্পদে দাঁড়ায় না। মায়ের নব্বই হাজার টাকার গয়না বাবা অনেক বার ফেরত দিতে চেয়েছে। মা কখনো রাজি হয়নি। আজীবন ঋণী রাখার এই পথটা মা কিছুতেই বন্ধ করতে চায়নি।

কিন্তু এখন মুকুল কই। মুকুলকে এই মূহূর্তে যে খুব দরকার। স্ট্রোক হওয়ার পর বাবা একবারও চোখ খোলেননি। দিন পাঁচেক আই.সি.ইউতে ছিলেন। ভিজিটিং আওয়ারে আমরাই গেছি পালাক্রমে। আমি আর আমরা চার বোন। বাবার দ্বিতীয় পক্ষ, অনাহুতের মতো বসে ছিল বারান্দায়। একবারও ভেতরে যাবার জন্য আমাদের সঙ্গে বাড়াবাড়ি করেনি। মিনমিন করে আবেদন জানিয়েছে দুয়েকবার। আমরা যদিও নিমরাজি ছিলাম, মা এক্কেবারে কঠিন। কিছুতেই এই মহিলাকে বাবার কাছে যেতে দিবেন না তিনি।

ঘটনা ঘটলো অনেক পরে, শেষের ঠিক আগে। হাসপাতালের ছাড়পত্র নিয়ে বাবাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার পর সবই হয়েছে নিয়মমাফিক। গোসল, কাফন, এলাকার মসজিদে জানাজা। অনেক মানুষ আর নানাবিধ সামাজিক আনুষ্ঠানিকতার ভীড়ে একজন অনাহুত নারীর উপস্থিতি আমরা ভুলে গেছি।

কিন্তু মাটি দেয়ার জন্য খাটিয়া নিয়ে বের হওয়ার সময়ই ঘটলো বিপত্তি, মহিলা কেমন বেপরোয়ার মতো সামনে এসে দাঁড়ালো। তার ছেলে না এলে কিছুতেই মাটি দিতে দেবেন না তিনি। দিতে দেবেন না, তার এককথা। দাঁড়িয়ে থাকলেন মৃতদেহ বহনকারী কাফেলা আটকে!

মুকুলকে না পেয়ে হতবিহ্বল আমি, বাসায় গিয়ে কী করে কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেবো ভেবে কূল কিনারা হীন যখন বাড়ি ফিরে এসেছি, তখন দূর থেকে মুকুলকে দেখি। আর্তনাদ করতে থাকা অনাহুত মহিলাটিকে নিয়ে গলির মাথায় মিলিয়ে যাচ্ছে মুকুল…।

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *