বীথি চট্টোপাধ্যায়
কাল রাত থেকে প্রায় কিছুই খেতে পাইনি। বাড়ির পাঁচিলে বসে বসে এখন ঝিমোচ্ছি। এখন আমার কী হবে? ওরা কি আর ফিরে আসবে আমার কাছে? কী করে ফিরবে? বাড়ির ভেতরটা তো সব ভেঙেচুরে দিয়েছে, ওরা তো কেউ আর বেঁচেই নেই। আমি কোনও রকমে ছুটে একটা লাফ দিয়ে পাঁচিলে চলে এসেছিলাম। ভয় পেয়ে চিৎকার করছিলাম। পাড়ার মানুষ, কুকুর, গরু আর আমার মত বেড়ালরা সকলেই কেউ দৌড়চ্ছিল কেউ চিৎকার করছিল। কী ভয়! কী ভয়। এরকমভাবে কেউ কাউকে যে মারতে পারে সেটা নিজে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।
আগুন জ্বালিয়ে মানুষ মানুষকে সেই আগুনের মধ্যে টেনে ফেলে দিচ্ছে। কেন এরকম করছে ওরা। এটাকে নাকি দাঙ্গা বলে। শুধু মানুষই নাকি এই দাঙ্গা করবার ক্ষমতা রাখে। পৃথিবীতে আর কোনও জন্তু জানোয়ার, গাছপালা, পোকামাকড় দাঙ্গা করতে পারে না। মানুষের ভেতরে আবার অনেকগুলো ভাগ। অনেক ধর্ম মানুষের। কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান, কেউ খ্রিষ্টান। একটা ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের থেকে আলাদা। আমাদের তো কোনও ধর্ম নেই; তাই দাঙ্গাও নেই। আমরা তো লিখতে পড়তেই জানিনা। কথা বলতে পারিনা। কী করে আমরা দাঙ্গা করব। ভাগ্যিস আমাদের মধ্যে দাঙ্গা নেই। ওপাড়ার হুলোটা এসে আমাকে পিটিয়ে যায়। আমার কান ছিঁড়ে যায়, হাত পা মুচকে যায়। কিন্তু মানুষ মানুষকে যেভাবে কাল মারল তারকাছে ওইসব মারামারি কিছুই না। সাতদিন ধরে পাড়ায় যা দেখছি তাতে মনে হচ্ছে ওপাড়ার হুলো ভাল, আমাদের পাড়ার ভুলো কুকুর ভাল, তা সে যতই আমায় তাড়া করুক তবুও সে ভাল। দাঙ্গা করা মানুষের থেকে হিংস্র আর কিছু হয় না। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে একেকটা মানুষকে অনেকে মিলে মেরে ফেলছে। নাহলে আধমরা করে আগুনে ফেলে দিচ্ছে। মেয়েদের টুকরো টুকরো করে হাত পা গলা বুক কেটে নিচ্ছে। এরকম এরা করছে কারণ শুধু এদের ধর্ম ওদের সঙ্গে মেলে না বলে! ধর্ম কি এত বড় যার জন্যে যে বেঁচে আছে তাকে টুকরো টুকরো করে কাটা যায়? পোড়ানো যায়? খোঁচানো যায়?
এখন আমার কী হবে ভাবছি। কেঁদে কেঁদে ঘুরছি আবার ঘুমিয়ে পড়ছি। অন্যদিন এইসময় সকালবেলা মা বসে বসে তরিতরকারি, মাছ কুটতো। আমি মায়ের পায়ে পায়ে ঘুরতাম। আমার মাও তো মানুষ ছিল অথচ কত মায়াদয়া ছিল তার। বাড়িতে আমাকে থাকতে দেবার জন্যে কম বকত মাকে বড়োরা! কালো বেড়াল অপয়া, ওর থেকে ক্ষতি হবে, ওকে ছেড়ে দিয়ে এসো। পাড়া-পড়শী, আত্মীয়-স্বজন কতবার মাকে বলেছে। মা আমায় ছেড়ে দেয়নি। খুব মায়া পড়ে গিয়েছিল আমার ওপরে। সত্যি কি আমি অপয়া তাই এই বাড়িটা ওরা এসে জ্বালিয়ে দিল। মায়ের ছোট দু-মাসের ছেলেটাকে আগুনে ছুঁড়ে ফেলল মায়ের সামনেই। কিন্তু আমাদের পাশের বাড়িতে তো কেউ আমার ছায়া দেখলেও ঢিল ছুঁড়ত তাদেরও তো ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মেরে ফেলল। সবাইকে মারল, জ্বালিয়ে দিল। পাড়ার পর পাড়া তো জ্বলছে এখন। সব বাড়িতে তো আমার মত কালো বেড়াল নেই। তাহলে ক্ষতি কি আমার মতো কালো বেড়াল থেকে হয়, নাকি ধর্ম থেকে হয়? লাইন দিয়ে কত লোক হেঁটে হেঁটে কোথায় একটা চলে যাচ্ছে। আমিও ওদের সঙ্গে একটু হাঁটব? ওরা কি এমন কোনও জায়গার খোঁজ পেয়েছে যেখানে খাবার আছে। আমার মা, মায়ের ছোট ছেলেটা আর ফিরবে না, তাই না? জানি ফিরবে না। ওরা মরে গেছে। সামনের বাড়ির বউটা আমার বাচ্চাগুলোকে পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল গতবছর। বাচ্চাগুলোর সবে চোখ ফুটেছে ওরা কাঁদছিল পাগলের মত। বউটা ফিরেও দ্যাখেনি। আমি জলে নামতে গিয়েও ভয় পেয়ে নামতে পারিনি, বাচ্চাগুলে ডুবে গিয়েছিল। ওরাও আর ফিরে আসেনি। তারপর পুকুরের ধারে গেলেই কষ্ট হোত, রোজ কত কেঁদেছি পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে; আমার ছোটছোট বাচ্চারা ফিরে আসেনি। যারা মরে যায় তারা আর ফেরেনা। আমি জানি। কাল যখন চিৎকার করতে করতে কিছু লোক এসে পাড়ার ঘরে ঘরে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছিল, মানুষকে এমনভাবে মারছিল যেন মানুষ নয় খেলনা আর মানুষ কাঁদছিল তখন আমার নিজের বাচ্চাগুলোর মুখ মনে পড়ছিল। ওই সামনের বাড়ির বউটার মতই মুখ চোখ এই আগুন হাতে নিয়ে হল্লা করা লোকগুলোর। চোখমুখে এমন একটা আনন্দ যেন কেমন কষ্ট দিচ্ছি, বেশ করছি। ঠিক ওই সামনের বাড়ির বউটার মত। অথচ দাঙ্গা করা লোকগুলো এসে যখন ওদেরও মারছিল, এমনকি যে বউটা আমার বাচ্চা ফেলে দিয়েছিল তাকেও যখন টেনে হিঁচড়ে তরোয়াল দিয়ে খোঁচাচ্ছিল তখন আমার যেমন ভয় করছিল তেমন কষ্টও হচ্ছিল। আমি ভয়ে কাঁপছিলাম। আমার গায়ে জোর থাকলে আমি সবাইকে বাঁচাতাম। সবার আগে আমার মাকে আর সবাইকে বাঁচানো হয়ে গেলে যে বউটা আমার বাচ্চাদের ফেলে দিয়েছিল তাকেও বাঁচাতাম। কিন্তু আমি তো এইসব দৈত্যদের সামনে দাঁড়াতেই পারব না। যেমন আমার বাচ্চাদের চোখের সামনে মরতে দেখেছি, ঠিক তেমনি মরতে দেখলাম এত মানুষকে। একইরকম অসহায় কান্না, একই রকম পাগলের মতো বাঁচার চেষ্টা। তা সে আমার বাচ্চা হোক বা মানুষের বাচ্চা হোক।
বাড়িটার ঘরগুলো ধোঁয়ায় ধোঁয়া। পাড়ার অনেক বাড়িতে আগুন জ্বলছে এখনও। এখন আরও মানুষ হেঁটে হেঁটে দূরে বড় রাস্তার দিকে যাচ্ছে।
আমিও বড় রাস্তার কাছে একবার গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওদের কথাবার্তায় বুঝলাম ওরা এই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ইন্ডিয়ায় যাচ্ছে ওরা। ইন্ডিয়ার লোকেরা কি খুব ভাল। তারা মাঝরাতে মানুষের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় না। মানুষকে মেরে ফ্যালে না। হয়তো তারা বেড়ালের বাচ্চাদেরও পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়না। নিশ্চয় তাই হবে নাহলে ওরা দলবেঁধে ইন্ডিয়ায় চলে যাচ্ছে কেন! অনেকের সঙ্গে পোষা গরু-ছাগলও রয়েছে। দেশ ছেড়ে কোথাও যাব না এটা এই বাড়ির কর্তা মানে যাকে সবাই ঠাকুর্দা বলত সে বলত আজকাল প্রায়ই। কিন্তু তাহলে এতলোক দেশ ছেড়ে ইন্ডিয়ায় যাচ্ছে কেন? দেশ কাকে বলে? এই পাড়া পাশের পাড়া আরও কটা পাড়া এক হয়ে কি একটা দেশ হয়। ইন্ডিয়া তো আলাদা একটা দেশ, ইন্ডিয়া কি সত্যি খুব ভাল দেশ?
আমার নাম ধরে কেউ ডাকছে। ওই যারা ইন্ডিয়ায় চলে যাচ্ছে তাদের মধ্যে কেউ। বড় রাস্তায় কেউ চিৎকার করছে ‘কালী’ ‘কালী’ করে। গাছের ডাল দিয়ে লাফিয়ে বড় রাস্তার কাছে পৌঁছলাম।
একজন মহিলা বুক চাপড়ে খুব কাঁদছে ‘কালী’ ‘কালী’ করে। আমি তো একে চিনি না, হাতে একটা পু্ঁটলি নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার নাম ধরে কাঁদছে কেন তাহলে? পাশ থেকে একটা বিধবা মেয়ে বলল, “কালী ফিরবা না। অর খোঁস কইরা এহানে পইড়া রইল্যে, কেউ বাঁচবা না। তাড়াতাড়ি সলো। এতক্ষণে হয় কালীকে মাইরা ফ্যালসে, নয় কোথাও বিক্কিরি কইরা দিসে। কোথায় পাইবা তারে? কাঁইদা মাথা কুইটা মইরলেও তোমার মাইয়া আর ফিরবা না।”
তারমানে এরা আমাকে ডাকেনি, কালী এদের মেয়ে। তাকে মনে হয় ধরে নিয়ে গেছে। কালরাতের ভয়ঙ্কর দাঙ্গাটা হবার আগে অব্দি তাদের পাড়াতেও কমবয়েসি মেয়েদের নিয়ে সবাই খুব চিন্তা করছিল। গাঁয়ের মোড়ল বাড়ি বাড়ি এসে বলে যাচ্ছিল বাড়িতে সোমথ্থ মেয়ে থাকলে যেন তাকে পুকুরে না পাঠায়, যেন সেই মেয়ে বাড়ির বাইরে না যায়। দুটো দেশ ভাগ হয়ে যাবার পর এক ধর্মের লোক আরেক ধর্মের মানুষকে যেমন মারছে তেমন তারা ধরে নিয়ে যাচ্ছে কমবয়েসি মেয়েদের। বিশেষ করে যে মেয়েদের বিয়ে হয়নি তাদেরই নাকি বেশি নিয়ে যাচ্ছে। তারপর টানবাজার বলে একটা বাজারে বেচে দিচ্ছে। যে ধর্মের মানুষকে এরা মেরে ফেলছে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খুঁচিয়ে, সেই ধর্মের মেয়েদের আবার নাকি সেখানে এখন এত চড়া দাম যে একটা মেয়ে বেচে লোকে বড়োলোক হয়ে যেতে পারে। আর মেয়েটার বিয়ে না হয়ে থাকলে তার দাম আকাশছোঁয়া। মানুষের এইসব ব্যাপার কী অদ্ভুত লাগে আমার। আমাদের ধর্ম নেই তাই দাঙ্গা নেই। আমাদের মেয়েদের কেনাবেচার ব্যপার নেই, আমাদের তো টাকাপয়সাও নেই। গায়ের জোর আমাদের মধ্যেও কিছুটা চলে। মেয়েদের গায়ে জোর থাকলে, দু-ঘা দেবার হিম্মত থাকলে হুলোরা ভয় পায়। কিন্তু মানুষের মেয়েদের গায়ের জোর বা কেনও জোরই খাটাবার কোনও জায়গা আমি দেখিনি। মানুষের বাড়িতে মেয়ে হলে সকলে মনখারাপ করে। পরপর মেয়ের জন্ম দিলে সেই মাকে লোকে কী গালাগালিই না দেয়। অপয়া, কাকবাঁজা এসব কত কী বলে। এই কাকবাঁজা মানে কী আমি এখনও জানি না। কাক তো বাঁজা হয়না তাহলে পরপর মেয়ের জন্ম দিলে সকলে সেই মাকে এই কাকবাঁজা কথাটা তেড়েফুঁড়ে বলে কেন? মেয়ে হওয়া ভাল নয়। মেয়েরা একটু বড়ো হতে না হতেই মেয়েদের সকলে খুব বকে বাড়িতে। ছেলেদেরও অবশ্য বকে। কিন্তু ছেলেদের বকে পাঠশালা, ইসকুল নিয়ে, পাঠশালায় পড়া না পারলে আর মেয়েদের সঙ্গে এমনিতেই সবসময় খিঁচিয়ে উঠে কথা বলে। যদি মেয়ের আবার রং কালো হয় তাহলে তো উঠতে বসতে তাকে লাথিঝাঁটা মারে মানুষ। কালো রং মানুষ পছন্দ করেনা, আমি বুঝে গেছি। কালো বেড়ালকে বলে অপয়া, কালো মেয়েকে বলে, ‘এই মেয়ে পার করতে ভিটে মাটি চাটি হবে।’ পার করতে মানে বিয়ে দিতে। বেড়ালকে পার করা মানে দূরে ছেড়ে দিয়ে আসা আর মেয়েকে পার করা মানে বিয়ে দেওয়া। রং কালো হলে মানুষের মেয়েদের সহজে বিয়ে হয় না। আমার মায়ের ননদকে নিয়েও আমাদের বাড়ির লোকের খুব চিন্তা ছিল। যতদিন বেঁচেছিল ওরা চিন্তা করত। ওইরকম রক্ষেকালীর মত চেহারা নিয়ে কী করে ওর বিয়ে হবে।
কত কথা মনে পড়ে। এদিকে পেটে খিদে ধকধক করছে। একটু খাবার কোথায় যে পাই! মোড়ের মাথা থেকে বড় রাস্তা ধরে মানুষের যে লাইন চলছিল সেই লাইনের একটু ধার ঘেঁসে আমিও হাঁটছিলাম। এদিকটায় আমি আগেও এসেছি তবে তখন রাস্তাটা ফাঁকা থাকত। এতলোক-কে একসঙ্গে রাস্তায় হাঁটতে এর আগে কখনও দেখিনি।
এত খিদে পেয়েছে মনে হচ্ছে নিজের হাত-পাগুলো চিবিয়ে খাই। পাড়ায় সকাল থেকে এঁটোকাঁটাও কিছু নেই যে খুঁটে খাব। পাখি ধরে মেরে আমি খেতে পারিনা। ছোটবেলা থেকে আমি খুব ভিতু। ছুঁচো, ইঁদুর, তেলাপোকা সামনে দিয়ে চলে গেলেও কিছু ধরিনা।
এই যে এত মানুষ হাঁটছে, এরা তো একটু এগিয়ে কোথাও না কোথাও খাবে। এদের সঙ্গে একটু হেঁটে দেখব যদি কোনও খাবার পাওয়া যায়। আমি দৌড়ে দৌড়ে মানুষের লাইন ধরে এগিয়ে যেতে লাগলাম। একটা বউ আমার মায়ের মত দেখতে অনেকটা, সুন্দর ফর্সা। বউটাকে দেখে আমার মাকে মনে পড়ল। আমি ওর পিছু নিয়ে যত জোর গলায় আছে ডাকতে শুরু করলাম। বউটা চমকে উঠল আমায় দেখে। “দূর হ, কালো বেড়াল রাস্তা কাটতাসে, আর যে কত দুর্ভোগ ভাগ্যে আসে, হায় ভগবান।” পাশ থেকে ষন্ডা মতন একটা লোক তাড়া করে এলো আমি ছুটে ঢুকে গেলাম মানুষের ভিড়ের মধ্যে। একটা বাচ্চা ছেলের হাত ধরে তার মা হাঁটছিল। ছেলেটা নিচে পথ থেকে নুড়ি, বালি পাথর কুড়োচ্ছিল হাঁটতে হাঁটতে নিচু হয়ে, তার মা খেয়াল করছিল না। একসময় আমি ছেলেটার খুব কাছাকাছি এসে পড়তে ছেলেটা টপ করে আমায় তুলে নিল। নিয়ে হাঁটতে লাগল। আমার বেশ ভালই লাগল প্রথমে। ছেলেটার মুখে মাথা ঘসলাম দু-বার। ওর মা তখুনি দেখতে পেল ছেলের হাতে কালো বেড়াল। চিৎকার করে ছেলেকে বলল, “ফেইলা দে। এহনি ছাড় ওরে।” ছেলেটা আমায় রাস্তায় নামিয়ে দিল। ওর মায়ের হাতে ছিল একটা লম্বা লাঠি। সে তাড়া করে এলো আমায় লাঠিটা নিয়ে যাতে আমি রাস্তা কাটতে না পারি। ভয় পেয়ে দিগ্বিদিক ভুলে আমি ছুট লাগালাম। আমাদের স্বভাব ছুটবার সময় কোনও উঁচু জায়গা পেলে লাফিয়ে উঠে পড়া। কুকুর, শিয়ালের হাত থেকে বাঁচতে আমরা এভাবে উঁচুতে উঠে পড়ি। সামনে একটা গরুর গাড়ি ছিল আমি ছুটে সেটায় উঠে পড়লাম। সেখান থেকে লাফ দিয়ে আবার রাস্তায়। রাস্তার একপাশে চারপাঁচজন লোক খেতে বসেছে। এই প্রথম কাউকে খেতে দেখলাম কাল রাতের পর থেকে। পা টিপে টিপে ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম। দুধের গন্ধ পাচ্ছি। দুধ গুড় আর খই খাচ্ছে ওরা। রাস্তার ধারে বসে। কলকাতায় আত্মীয়র বাড়িতে এখন ওদের থাকতে দেবে কিনা সেটা নিয়ে কথা বলছে ওরা। আমি গুটি গুটি গিয়ে কিছুটা দুরে বসে রইলাম। একটা বুড়ি আমায় দেখতে পেল। একটা কী ছুঁড়ল আমার দিকে। ঢিল ভেবে ভয় পিছিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর দেখলাম পাটালির টুকরো। তারমানে খেতে দিচ্ছে আমায়। কিন্তু আমি তো পাটালি খাই না। ওরা খেতে দিচ্ছে বুঝে একটু কাছে গিয়ে ডেকে ডেকে বলতে লাগলাম আমার খিদে পেয়েছে। বুড়িটার পাশে একটা অল্পবয়সি ছেলে বসেছিল সে একটু খই দুধ পাত থেকে তুলে আমার সামনে রাস্তায় রাখল। আমি নিমেষে খেয়ে ফেললাম। তখন ছেলেটা বলল, “আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আসছে। এই বেড়ালটাকে ধরে নিয়ে যাই। নিয়ে গেলে জ্যাঠাদের মায়া হবে। কলকাতায় কলেজে পড়ার সময় থেকে দেখছি জ্যাঠারা বেড়াল তাড়ায় না। এটাকে সঙ্গে নিলে হয়তো আমাদেরও তাড়াবে না। জীবজন্তুর ওপর ওদের খুব মায়া।” বুড়িটা বলল, “এরে এতটা পথ লইয়া যাইবি কেমনে?” ছেলেটা খপ করে আমায় ধরে একটা চটের থলিতে পুরে বলল, এই থলিতে ভরে। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাকে থলিতে ভরে ফেলল। তারপর এঁটো বাসনগুলো সেই থলিতেই ভরে বলল, “নদীতে ধুয়ে নেব।” বুড়িটা বলল, “কালো বেড়াল। আবার অর লগেই শ্যাসম্যাস ওতুল চটবা না তো?” ছেলেটা বলল, “জ্যাঠামশাইরা যদি আমাদের একটু দয়া করে তাহলে তা এর জন্যেই করবে। বড়খোকা রোজ রাস্তা থেকে বেড়াল কুকুর তুলে আনে জানো না? ওদের সঙ্গে আমাদের যা হয়েছে তারপরে ওরা আমাদের আর বাড়িতে রাখবেনা। এই বেড়ালটাকে দেখলে হয়তো মায়া হবে ওদের। সঙ্গে সঙ্গে তাড়িয়ে দেবে না। বড়খোকা বেরোলেই বেড়ালটাকে থলি থেকে বের করব আর যা বলার বলব।”
ওরা আবার সকলে হাঁটতে শুরু করল। ওরা বলছিল আর দেশে ফেরা হবে কিনা। বাড়িতে কত কী পড়ে রইল —- এইসব বলছিল। আমার বুকটা ভয়ে ধকধক করছিল। এবার আমার বুকটা হু হু করে উঠল। আর আমি আমার চেনা পাড়ায় কখনও ফিরবো না! আর দেখতে পাব না আমার বাড়ির উঠোন, শিউলি গাছ, পুকুরপাড়? পুকুরের ধারে গিয়ে দাঁড়ালে প্রথমে কষ্ট হোত বাচ্চাদের কথা মনে পড়ত। তার কিছুদিন পর ওখানে গেলে যেন মনে হোত ওখানে আমার বাচ্চারা যেন কোথাও আছে। আবার তারা ফিরে আসবে আমার কাছে। পাশের পাড়ার সাদা হুলোটা, ডালে দুপুরের ঘুম –এসব আর ফিরে আসবে না কখনও। আমি দূরে কোথাও চলে যাচ্ছি। ইন্ডিয়ার কলকাতায় চলে যাচ্ছি। শুনতে পাচ্ছি কলকাতা খুব বড় শহর। সেখানে ট্রাম চলে, ইলেকট্রিক বলে একটা কী আছে সেখানে তাতে সারা শহরে আলো জ্বলে। সবচেয়ে বড় কথা কলকাতায় নাকি অনেক খাবার।
ওরা বলাবলি করছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আর পারছিনা থলিতে থাকতে। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। ডাকছি যত জোরে পারছি। ওরা হাঁটছে তো হাঁটছেই।
কতদূর ওরা চলে এলো জানি না। এবার তো থলি থেকে বেরোলেও আমি আর ফিরতে পারব না।
ওরা বলছিল, নোয়াখালি পেরিয়ে গেলে আর তত ভয় নেই। তারপর বাস ধরে কলকাতা যেতে পারবে।
আর একটু হাঁটলেই পেরিয়ে যাবে নোয়াখালি। কেন নোয়াখালি পেরোলে ভয় নেই আমি জানি না।
দু-মাস আগে যখন দেশ স্বাধীন হয়েছে তখন থেকেই পাড়া থমথম করত। কলকাতায় নাকি খুব গন্ডগোল তাই আমাদের গ্রামেও অনেক কিছু হতে পারে যখন তখন। আমাদের বাড়ির ঠাকুর্দা বলত, দেশটা ভারতবর্ষ থেকে পাকিস্তান হয়ে গেল। আর কী আমরা এখানে থাকতে পারব? বলত, আমরা রাতারাতি পাকিস্তানের নাগরিক হয়ে গেলাম। আমাদের এখন কী হবে? আমার বয়স হয়েছে, আমি আর ক-দিন বাঁচব? কিন্তু ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনির কী হবে? ঠাকুমা বলতেন, গান্ধী তো বলছে আবার সব ঠিক হইয়া যাবা। ঠাকুর্দা বলতেন, পারবে না,গান্ধীজি একা কী করবে? রুক যাও, রুক যাও করে হাত জোড় করলেই যারা দাঙ্গা করছে তারা থেমে যাবে? জিন্নাহ কিছু ঠিক করতে দেবে না। এক শুধু যদি নেতাজি থাকত তাহলে এই ভারতবর্ষ দু-টুকরো হওয়া আটকে দিতে পারত। কিন্তু নেতাজি তো ফিরে এলো না। আমরাও ধনেপ্রাণে মরলাম।
গান্ধীজি কে? জিন্নাহ কে? নেতাজি কে? আমি কিছুই জানিনা। তবে কোনও জায়গা ভারতবর্ষ থেকে পাকিস্তান হয়ে গেলে কী ভয়ঙ্কর অবস্থা হয় তাতো দেখতে পাচ্ছি নিজের চোখেই।
চোখে কখন ঘুম নেমে এসেছিল। দেখছিলাম আমার বাচ্চারা আবার নতুন করে আমার কাছে ফিরে এসেছে। সেই তিনটে বাচ্চা যারা কাঁদতে কাঁদতে জলে ডুবে গিয়েছিল। সবে ওদের চোখ ফুটেছে। আমাদের বাড়ির উঠোনে ওরা খেলছে। মা উঠোনে বসে কাঁথা সেলাই করছে। আমি মাঝেমাঝে মায়ের কোলের কাছে গিয়ে বসছি। মায়ের ছেলেটা শুয়ে আছে উঠোনে যেখানে রোদ পড়ে, ঠিক সেইখানটায়। একটা ঝুমঝুমি নিয়ে ছেলেটা খেলছে। আমারও ইচ্ছে হচ্ছে খেলি ঝুমঝুমিটা নিয়ে। কিন্তু বাড়ির সকলে বকবে ভেবে বাচ্চাটার কাছ থেকে ঝুমঝুমিটা কেড়ে নিচ্ছি না। ঠাকুর্দা মহাভারত পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছে। শিউলি গাছের তলায় এসে বসে আছে ওপাড়ার সাদা হুলোটা… আমার এত আনন্দ হচ্ছে, বলে বোঝাতে পারব না।
ধপ করে চটের থলিটা কেউ একটা পাটাতনে রাখল। আমি চমকে জেগে উঠলাম। কোথায় মা? কোথায় আমার বাচ্চারা? কোথায় বাড়ির উঠোন? এটা তো একটা চটের থলি। আমি জানিনা আমি কোথায় যাচ্ছি। ঘুম ভেঙে টের পেলাম ভীষণ খিদে। মনে পড়ল আর কখনও আমি বাড়ি ফিরব না। আমার মা বেঁচে নেই, বাচ্চাগুলো আর ফিরবেনা কখনও আমার কাছে। এসব মনে পড়ে এত কষ্ট হল, যে আমার মনে হল যেন পাগল হয়ে কাউকে আঁচড়ে কামড়ে দি। চটের থলির মধ্যে ছটফট করে উঠলাম।
একটা দোকান মনেহচ্ছে এটা। সেখানে এরা বসেছে। আরও অনেক লোক এদিকে ওদিকে। চা-ঘুগনি, মুড়ি খাচ্ছে লোকে। আমাকে কি একটু খেতে দেবে এরা এখন? থলির মুখটা বাধা। থলিতে আরও দুটো থালাও রয়েছে আমার সঙ্গে। নেহাত চটের থলি তাই এখনও দম আটকে মরে যাইনি আমি। ছেলেটা এসে থলিটা খুলে থালা দুটো বের করল। আমাকে একবার দেখল তারপর বলল, “তোমাদের কার কাছে কী গয়না আছে দিয়ে দাও। এখানে বাসন, গয়না সব বিক্কিরি হচ্ছে। ক্যাশ দিচ্ছে গয়না নিয়ে, বাসনকোসন নিয়ে।”
সবে শীত পড়েছে। বিকেলের দিকে ঠান্ডা বেড়ে যায় হঠাৎ। আমি শীতে কাঁপছিলাম। থলি থেকে লাফ মেরে বেরিয়ে পালাব? থলির মুখটা তো এখন খোলা। কিন্তু এখান থেকে পালালে আমি তো চিনে ফিরতে পারব না।
হঠাৎ কেমন একটা হইহই শুরু হোল মনে হচ্ছে। লাফিয়ে বেরোলাম থলি থেকে। ঠিক কাল রাতে যে লোকেরা আমাদের বাড়িতে চড়াও হয়েছিল সেইরকম একদল লোক; হাতে মশাল। তারা তেড়ে আসছে। সকলে পালাল যে যেদিকে পারল। যে ছেলেটা আমায় থলিতে ভরে নিয়ে আসছিল সেও ছুট দিল। ওদের সঙ্গে যে বুড়ি ছিল সে রাস্তায় পড়ে গেল ছুটতে গিয়ে। তার গায়ের ওপর দিয়ে ছুটে গেল লোকজন। ইস্, রক্ত বেরোচ্ছে বুড়ির গা থেকে। চা-ঘুগনির দোকানদার একটা বাক্স বুকে আঁকড়ে দৌড়ল। তার দোকানের চালে আগুন দিয়ে দিয়েছে মশাল হাতে থাকা লোকগুলো। দোকানদার বেশি দূর এগোতে পারল না। তাকে ওরা ধরল। বাক্সটা কেড়ে নিল। তারপর তার মাথায় দমদম করে মারতে লাগল লাঠির বাড়ি। লোকটা মাটিতে পড়ে ছটফট করছে বর দশ-বারোজন মিলে তাকে মারছে। রক্তে আর চিৎকারে ছেয়ে গেল চারদিক।
আমি একটু দূরে বসে থরথর করে কাঁপছি। এই জায়গাটা কোথায় জানিনা। তবে বুঝতে পারছি জায়গা আমাদের পাড়া থেকে অনেক অনেক দূরে। এখান থেকে আমাদের পাড়ার বাড়িতে আর চিনে ফিরতে পারব না আমি।
জায়গাটা কি ইন্ডিয়া? শুনেছি যেখানে গান্ধীজির কথা চলে? নাকি এটা পাকিস্তান যেখানে নাকি জিন্নাহই সব? এখান থেকে কতদূর আমাদের গ্রাম? দুটো দেশ ভাগ হয়ে গেল। এখন আমি এই এতদূূরে বসে বসে কি করব? এপাড়ার বেড়ালরা দেখতে পেলেই তো মারবে আমাকে। আমার গায়ে জোর নেই। পেটে খিদে। আমার কী হবে এখন? আমি তো জানি না আমি ভারতবর্ষে নাকি পাকিস্তানে? কোনটা ভারত আর কোনটা পাকিস্তান কীভাবে বোঝা যায়, তাও আমি জানিনা! এখান থেকে কোনদিকে গেলে কোনদেশ আমি জানিনা। জানতে চাইও না। কোনদিকে গেলে একটু খেতে পাব জানলে সেই দিক ধরে এগোতাম। লোকে বলাবলি করছিল ইন্ডিয়ায় গেলে খাবার দেবে কংগ্রেসের লোকেরা। কোনদিকে ইন্ডিয়া কী করে বুঝব? যেদিকে তাকাই একইরকম আকাশ, একইরকম পথ। একই মাটি। কী করে বুঝব, কোনটা কোন দেশ?
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন