short-story-khancha

খাঁচা
হাবিব আনিসুর রহমান


বুনোমোষের চামড়ার মতো কালো অন্ধকার। আকাশ থেকে হু হু করে শীত নামছে। প্রাচীন নক্ষত্রের দল চেয়ে আছে পৃথিবীর দিকে। নিচে চিৎ হয়ে পড়ে আছে পৌষের বিশাল মাঠ। এপার থেকে ওপারের কিছুই চোখে পড়ে না। মাঠের মাঝখানে শামুকদিয়ার প্রকান্ড বিল ভরা হিমঠান্ডা পানি। চারধারের কাদা যেন কূল বেঁধে রেখেছে সেই পানির। বিলের পাশে ছোট্ট একটা দ্বীপের মতো উঁচু ঢিবি। তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে বহুকালের প্রাচীন একটা বটগাছ। চারপাশে ঝুরি ছড়িয়ে সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন একটা পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে মাঠের মাঝখানে।

অন্ধকার নিশুতি সেই রাতে মাটির ঢিবিটার ওপর আগুন জ্বলে উঠল। আগুনের শিখা ধীরে ধীরে বড় হয়ে অন্ধকারের বুকে নেচে উঠলো। দেখা গেলো আগুনের লালচে কুন্ড সামনে রেখে মুখোমুখি বসে আছে দু’জন মানুষ। ওরা বটের শুকনো ডালপালা আর পাতা তুলে দিচ্ছে আগুনের মুখে। ওগুলো পেটে পড়তেই আগুনের শরীর মোটা হচ্ছে ক্রমশ। ঠান্ডায় জমে যাওয়া হাত পা তাপাচ্ছে লোক দু’টো। একজন বৃদ্ধ অন্যজন যুবক। বুড়োর শরীর হালকা পাতলা, বয়স ষাটের কাছাকাছি। তাকে দেখলে শক্ত সমর্থ কষ্ট সহিষ্ণু মনে হয়। বুড়োর গায়ে একটা নোংরা কালো কোট, বহুকাল আগে ওটা পুরনো কাপড়ের দোকান থেকে কেনা হয়েছিলো। দু’হাতের কনুইয়ের কাছে ছেঁড়া। ওই ছেঁড়া জায়গাটা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে বুড়োর কালো কুচকুচে হাড্ডিসার কনুই দু’টো। তার পরনে নেংটি। নগ্ন হাঁটুদুটো বুক ছাড়িয়ে থুঁতনিতে ঠেকে যাবে মনে হচ্ছে। মাথায় জড়ানো একটা ময়লা গামছা। বুড়োর সামনে বসা যুবকটি বেধড়ক লম্বা ঢ্যাঙা। সেও কালো। ওর গায়ে জড়ানো চাদর। মাথায় মাফলার। হাবাগোবা নিষ্পাপ চেহারা। চারপাশের নৈঃশব্দ ভেঙে দিয়ে বুড়ো বলে উঠল, ‘শীতে হাড় কেঁপে যাচ্ছে রে নবাব, চল, চইল্যা যাই, খাঁচাটা লিয়ে আয়তো দেখি।’

একটু দূরে রাখা খাঁচাটা এনে বুড়োকে দিল যুবক। খাঁচার মুখে বাঁধা জালের ভেতর দিয়ে তাকালো বুড়ো, দেখলো ছোটছোট পাখিগুলো গুটিসুটি মেরে বসে আছে খাঁচার মধ্যে। বুড়ো বললো, ‘কতগুলো হবে রে নবা?’

যুবক উত্তর দিল, ‘তিরিশ-পোঁতিরিশটা তো হবেই।’

‘তাহলে আজ থাইক, তুই জাল গুটিয়ে লিয়ে আয়’ বুড়ো বললো।

যুবক মাঠের মধ্যে পাতা জাল তুলে আনতে গেলো। আজ রাতের মতো পাখি ধরা শেষ। ওরা এখন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে যাবে সুলিকান্দা বাজারে। সেখান থেকে বাস ধরে সোজা নগরবাড়ি ফেরিঘাটে। মাঠের পানির ওপর দিয়ে দ্রুত পা ফেলে জাল নিয়ে ফিরে আসছিল যুবক। ছপাৎ ছপাৎ শব্দ হচ্ছিলো। গাঢ় অন্ধকার আর শীতের নিঃশব্দ রাত একটু একটু করে ভাঙছিলো সেই শব্দ। হঠাৎ যুবক চিৎকার করে বলে উঠলো – ‘পায়ের নিচে কী যেনে ঠেকলো দাদো?’ ভয় পেয়ে দ্রুত সে ডাঙায় উঠে এলো।

‘ভয় পাচ্ছিস ক্যান্, আরে বোকা হাত দিয়ে দ্যাখনা পানির মইধ্যে, বিলের বড় বোইল মাছও হতে পারে’ – জ্বলন্ত আগুনের পাশে বসে নির্বিকার চিত্তে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে বলে উঠলো বুড়ো। আগুনের গায়ে শুকনো পাতা ফেললো বুড়ো, দপ করে বেড়ে গেলো আগুনের শিখা। যুবক দূরে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে কোন কথা নেই, ভীষণ ভয় পেয়েছে সে। বুড়ো বিড়িতে সুখটান দিলো। বিড়ির লাল টকটকে মাথাটা জ্বলে উঠে নিভে গেলো। বিড়ির শেষটুকু ছুড়ে ফেলে দিয়ে বুড়ো নেমে গেলো মাঠের পানিতে। প্রথমে এদিক ওদিক পা চালালো। কিছুই ঠেকলো না পায়ে। হঠাৎ ডান পায়ের আঙুলের মাথায় নরম কিছু মালুম হলো। বুড়ো কোটের ডান হাতটা গুটিয়ে পানির মধ্যে চালালো। চমকে উঠলো শীতে আড়ষ্ট বুড়ো। হিমশীতল মানুষ শুয়ে আছে পানির মধ্যে। বুড়ো জোরে চিৎকার দিলো- ‘নবা রে পানির মইধ্যে মানুষ! টপ কইরে আয়তো দেখি জান আছে কিনা?’ ভীত হিব্বল যুবক জালটা ঢিবির ওপর রেখে দ্রুত নামতে গেলো পানিতে। ওর ব্যস্ত পা লেগে পাখির খাঁচাটা ছিটকে গেলো একপাশে। আচমকা ধাক্কায় বন্দি পাখিগুলো ভয় পেয়ে চিঁ চিঁ শব্দ করে উঠলো একমুহূর্তে। নিমিষেই সে শব্দ মিশে গেলো চারপাশের বিশাল শূন্যতায়।

ওরা দু’জন পানির ভেতর থেকে টেনে তুললো মানুষটাকে। দু’জন দু’পাশে ধরে সোজা আগুনের কুণ্ডলীর পাশে এনে রাখলো। আগুনের শিখায় দেখা গেলো অল্প বয়সের একটা মেয়ের লাশ। হাত পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। তার সাথে বড় বড় আস্ত ইট জড়ানো। বুড়ো ছুরি দিয়ে দ্রুত কেটে দিলো। বাঁধনগুরো শরীরে লেগে থাকা নোংরা খড়কুটো সরালো। মৃত মেয়েটার পরনে শাড়ি ব্লাউজ শায়া কিছুই নেই। একদম উলঙ্গ। শক্ত সটান একটা মরা মাগুর মাছের মতো চিৎ হয়ে পড়ে রইলো লাশটা। মাথায় দীর্ঘ চুল। লম্বাটে হাত পা। মুখের আদল খুব সুন্দর। বুড়ো লক্ষ করলো, যুবক ছোকরা হাঁ করে তাকিয়ে আছে লাশটার বুকের দিকে। বুড়ো দ্রুত লাশটাকে ঢেকে দিলো গামছা দিয়ে। যুবক সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকালো বুড়োর দিকে।

বুড়ো বললো, ‘খোদাই জানে কুন ঘরের মেয়ে, কাঁচা বয়েস, এই বয়েসে মেয়েরা বিহার লাল শাড়ি পইরে শ্বশুর বাড়ি চইলে যায়, আর এই মেয়ে এখন শামুকদিয়ার ঠান্ডা পান্তে পড়ে আছে লাশ হোইয়ে, আহ্ খোদা। এর কপাল খারাপ।’

বুড়োর কথা শেষ হতেই যুবক বলো উঠলো ‘ঠিক আমারগে উজিফার মতো লাগছে না দাদো? দাদো, কুন্ শালায় যে একে মারলো?’

বুড়ো বললো- ‘কে মারলো তাকি হামি জানিরে! কী সুন্দর রূপ দেখ্ নবাব! এইসব গরিব মেয়েদের রূপই হয়েছে কাল। দিন দিন এইসব বেড়ে যাচ্ছে, মরছে শুধু উজিফাদের মতো কাঁচা বয়েসের মেয়েগুলো।’

‘দাদো, যাবার সুমায় থানায় খবরটা দিয়ে যাবো, কি বলো?’

‘খবরদার ওইসব কাজ করিস না, তুই কি কচি খোকা নাকি, জানিস না থানায় গেলে পুলিশ আমারগে বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে।’

‘কেনে বারোটা বাজাবে কেনে?’

‘তুই একবারে গাধা, থানায় গিয়ে খবর দিলে আগে বাঁধবে তোকে, যদি লোক জানাজানি হয়ে যায় তাহলে এই লাশ কাটবে, ওপরে রিপোট দেবে, কিন্তু তুই ছাড়া পাবি না।’

‘তাই বোইলে এখানে রাইখ্যা যাবো এই লাশ, ওর খবর হবে না, মাটি হবে না? শিয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খাবে ওকে, এ কুন কথা! হামি থানায় যাবো।’

‘হামাকে রাগাসনা তো নবাব, বইলেছিতো ওখানে গেলে আগে বাঁধবে তোকে, তখন তোর পাখি বেচা পাছার মইধ্যে ঢুইকে যাবে।’

‘আমি থানায় যাবো।’

‘না যাবি না, হামি তোকে যাইতে দিবো না, শালার আস্ত বুকা!’ বুড়োর ধমকে যুবক চুপ করে গেলো।

বুড়ো আবার বিড়ি ধরালো। যুবকের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো- ‘নে বিড়ি খা।’ যুবক তখনো রেগে আছে, সে বিড়ি নিলো না। ততক্ষণে ওদের সামনের আগুন নিভে গেছে। অন্ধকারে বুড়োর হাতের বিড়ির আগুনটা থেকে থেকে লাল উজ্জ্বল হচ্ছে, দূর থেকে মনে হচ্ছে লাল টকটকে একটা মার্বেল ওপরে নিচে খেলে বেড়াচ্ছে। বটগাছে একটা পাখি ডেকে উঠলো। কু-উ-ব কু-উ-ব। নিশিজাগা পাখির ডাক। বিলের ওপরের অন্ধকার থমথমে সময় কাটতে লাগলো পাখির ডাকে। ওদের পাখি ধরা শেষ। এখন জাল আর পাখির খাঁচা ঘাড়ে করে ওরা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে যাবে লোকালয়ে।

ফিরে যাবার আগে যুবক আর বুড়ো দু’জনে মিলে লাশটাকে টেনে ঢিবির একদম ওপরে রাখলো। তারপর পাখি ধরা জাল আর খাঁচা তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো ওরা। মাঠের ঠান্ডা পানির ওপর দিয়ে হাঁটছে। ছপাৎ ছপাৎ শব্দে ওদের পা পড়ছে পানির ওপর। সে শব্দ একটা ছন্দের সৃষ্টি করছে। হাঁটতে হাঁটতে বুড়ো বললো,

‘এতদিন পাখি ধরছি বিলে এমন লাশ তো হামি কখনো দেখিনি রে, শয়তানে শয়তানে ভরে যাচ্ছে দ্যাশটা।’

‘যাবার সুমায় সুলিকান্দা বাজারের লোকদের খবরটা দিয়ে যাবো।’

‘না বাজারের লোকদের বলার দরকার নাই।’

‘তুমার কথা হামি রাখবো না, বাজারের লোকদের বলবোই।’

বুড়ো থমকে দাঁড়ায়। ‘এক চড়ে তোর মুখ ভেইঙে দিবো হারামজাদা, বাজারের লোককে বললে তোকে ছাড়বে? সাতে কইরে আবার লিয়ে আসবে এই বিলে, তখন তুই পাখি বেচবি কি কইরে, লোক জানাজানি হোলে দেখবি যারা ওকে খুন কইরেছে, তারাই আমাদের ধরিয়ে দেবে পুলিশে, তারপর সামলা পুলিশের ঠ্যালা-মাইরের চোটে তোর পাছার ছাল তুইলে দিবে।’ বুড়ো রাগে ফুঁসতে লাগলো, দ্রুত হেঁটে চললো সে।

‘তাই বইলে হামরা এই সত্যি খবরটা চেপে যাবো, একটা মানুষ কবরের মাটি পাবে না, ওর বাপ-মা কিছুই জানতে পারবে না, এ কুন কথা?’

‘গাঁ গেরামে এমন কতো মেয়ে রোজ রোজ মরছে, তার কি খবর আছে, বেকুব একটা লাশ নিয়ে তুই এত ভাবছিস।’

‘দাদো, যাওয়ার সুমায় না হয় সুলিকান্দা বাজারের একজনকে বইলে যাবো, কি বলো?’

‘তোকে লিয়েতো এই দুনিয়ায় বাঁচা যায় না, মুসিবত হলো দেখছি।’ বুড়ো হতাশার সুরে বললো।

বুড়োর মনোভাব দেখে যুবক ভীষণ আহত হলো। বিষণ্ণ চিত্তে সে আপন মনেই বলে উঠলো, ‘শালার বুড়া তুমি আস্ত একটা শয়তান, তোমার দিলে একটুও মায়াদয়া নাই।’ একটা ব্যথিত মনে সে বুড়োর পেছন পেছন হাঁটতে লাগলো। সারারাত পাখি ধরে বেশ ক্লান্ত ওরা। তার ওপর পাখির খাঁচা আর জাল ওদের কাঁধে।

বুড়ো বললো ‘কী শীতরে বাবা!’ যুবক বুড়োর কথায় সায় দিলো না। সে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো। বুড়ো সেটা খেয়াল করে বলে উঠলো ‘কথা বলছিস না যে।’

যুবক চুপ। বুড়ো সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক করার জন্যে বললো ‘নবাব, আইজ খুব বেশি শীত পড়ছে নারে?’

যুবক নিচুস্বরে জবাব দিলো, ‘হুঁ।’

বিষণ্ণ অনুভূতিহীন সে কণ্ঠস্বর। পায়ের নিচে ঠান্ডা বরফ পানি। বুড়োর হাঁটুতে তীব্র যন্ত্রণা করতে লাগলো। সামনে এখনও অনেক পথ। বুড়ো একটু দাঁড়িয়ে কোটের পকেটে রাখা পলিথিনের ব্যাগ থেকে বিড়ি বের করে ধরালো। যুবকের দিকে একটা এগিয়ে দিয়ে বললো- ‘নে বিড়ি খা।’

যুবক সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না, সামনে এগিয়ে চললো। যুবকের আচরণে বুড়ো বুঝলো লাশ নিয়ে ভীষণ দ্বন্দ্বে পড়েছে বোকা যুবক। বেশ কষ্ট পাচ্ছে ও। বুড়ো মনে মনে বললো, শালার বেকুব কোথাকার, সামান্য এক অচেনা মেয়ের লাশ নিয়ে কিসব উথালপাতাল ভাবছে ছোকরা। দুনিয়ার তুই কি বুঝিস, দুনিয়া বড় কঠিন জায়গা।

অনেক পথ হেঁটে আসার পর ওরা দেখলো পুবদিকের আকাশে লাল আভা ফুটে উঠছে। মাঠের শেষে কালো একটা রেখা। দূর থেকে ভেসে এলো ‘ককরে কক’ শব্দ। মোরগ ডাকছে গ্রামে। একটু এগিয়ে গেলেই দেখা যাবে সবুজ গাছগাছালি আর গ্রামবাসীদের খড়ে ছাওয়া জীর্ণ কুটির। সামনে সুলিকান্দা বাজার। ওখানে গিয়ে বাস না আসা পর্যন্ত দু’একটা বাড়িতে পাখি বেচবে ওরা। তারপর বাস ধরে সোজা চলে যাবে ফেরিঘাটে।

ওরা দু’জন যখন সুলিকান্দা বাজারে পৌঁছুলো ততক্ষণে আলো ফুটেছে। কচি রোদ বের হয়েছে লাল সূর্য থেকে। রাস্তার দু’পাশের বেড়ায় গাছের সবুজ পাতার ওপর ছড়িয়ে পড়েছে সে রোদ। বাজারে ঢুকেই রাস্তার ওপর বসে পড়লো বুড়ো, খ্যাক খ্যাক করে কাশতে শুরু করলো। কাশছে তো কাশছেই। বুড়োর কাশি যেন আর থামতেই চায় না। মনে হলো দম বন্ধ হয়ে এখনই মরে যাবে বুড়ো। যুবক এমনিতেই বুড়োর ওপর রেগে ছিল। এবার সে ফুঁসে উঠলো, ‘কেশে কেশে মরে যাবা, তাও বিড়ির পাছা না চুষলে তুমার সুখ হয় না, উজবুক লোক কুথাকার।’

বুড়ো ততোধিক ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘বেশি ফ্যাচ ফ্যাচ করিসনা তো, তুই খাসনা বিড়ি, জানিস না এসব নেশা, নেশা না করে মানুষ বাঁচতে পারে!’

‘খাও আরও খাও, মরো’ যুবক রেগে বললো।

কথা কাটাকাটি করতে করতে ওরা দু’জন চললো বাজারের পুবদিকের সরু রাস্তা ধরে সিকদার বাড়ির দিকে।

দোতলা পুরনো বাড়ি। চারপাশে প্রাচীর ঘেরা। সদর দরজার লোহার কড়া ধরে খট্ খট্ শব্দ কররো ওরা। খট্ খট্ খট্ খট্। ‘পাখি লিবাগো চাছা?’ বুড়ো চিৎকার করলো। কোন সাড়াশব্দ নেই বাড়িটাতে। এ বাড়ির লোকেরা প্রায়ই পাখি কেনে ওদের কাছ থেকে। ওরা আশা করছে আজকেও পাখি কিনবে সিকদার। অনেক ডাকাডাকির পর সিকদার দরজা খুললো। গায়ে পশমী শাল জড়ানো। মোটাসোটা দেহ। মুখের দু’পাশে ঝুলে পড়েছে লম্বা গোঁফ। ঘুম লেগে আছে চোখে। সিকদার বললো, ‘সাত সকালে চিল্লাচিল্লি কর ক্যা, কী হইছে কী?’

‘চাছা পাখি আইনাছি, পাখি লিবানা?’

‘কই দেখি?’

বুড়ো বেছে বেছে চারটা মোটা কাদাখোঁচা পাখি সিকদারের সামনে ধরলো। বুকের নরম মাংস দেখিয়ে বললো ‘খুব ভাল পাখি চাছা, চরব ভর্তি, খেয়ে মজা পাবাগো চাছা, কয়টা দিবো বলো?’ লোভাতুর দৃষ্টিতে পাখির বুকের নরম মাংসের দিকে তাকালো লাগলো সিকদার, তারপর বললো- ‘আইজ পাখি রাখবো না।’

‘কেনে, কেনে চাছা, লিবানা ক্যান্, সবসময়তো লাও, আইজ লিবানা ক্যান্, দামের জন্যে ভেবো না, খুব সস্তায় দবো- লাও চাছা।’

একটু গা মোড়া দিয়ে সিকদার বললো ‘আমার বউ তার বাপের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে গো, রান্নার লোক নাই।’

‘কেনে কাজের ঝি নাই, সে রেঁধে দেবে।’

‘নাগো তাও নাই, এক মেয়ে ছিল সেও নাই, দু’দিন হলো সেও নিখোঁজ, পাখি নেবো না আজ’। দরজা বন্ধ করে দিলো সিকদার।

সিকদার দরজা বন্ধ করার সাথে সাথে যুবক প্রচন্ড কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে ধরলো বুড়োর মুখের ওপর, সে কিছু বলতে চাচ্ছিল। বুড়োর দৃষ্টি অন্তর্ভেদী। সে জানে যুবক কী বলবে। বুড়ো খাঁচার পাখিগুলোর দিকে একবার তাকাল, তারপর বললো ‘বাসাবাড়িতে ঘুরে আর কাজ নেই, চল্ বাস ধরে চলে যাই ফেরিঘাটে।’ বুড়ো আগে আগে হাঁটতে লাগলো পা চালিয়ে। পেছনে যুবক।

ওরা দু’জন চলে গেলো বাজারের মধ্যে। চা দোকানগুলোর চুলোর ওপর সাদা ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে শূন্যে উড়ে যাচ্ছে। চুলো ধরানোর চেষ্টা চলছে। সমস্ত বাজার জুড়ে তখনও শীতের আড়ষ্ট ভাবটা কাটেনি। বাজারের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে পিচের রাস্তা। দু’পাশে সারি সারি দোকান। আশেপাশে দোকান খোলার শব্দ হচ্ছে। সাইনবোর্ডগুলোর ওপর ধুলো ময়লা পড়ে লেখাগুলো অস্পষ্ট ঝাপসা হয়ে পড়েছে। বড় দোকানগুলোর সামনে সয়াবিনের তেলের কয়েকটা ঢাউস ড্রাম পড়ে আছে। এরই মধ্যে রাস্তার পাশেই বেচাকেনা শুরু হয়ে গেছে। যে সমস্ত কৃষকের টাকার দরকার, তারা এই সাত সকালেই পেঁয়াজ, রসুন, ডাল এগুলো নিয়ে চলে এসেছে বাজারে বিক্রি করার জন্যে। বিশাল অশ্বত্থ গাছটার নিচে চা দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ওরা দু’জন। আশেপাশে রিকশা আর ভ্যানঅলারা ওৎ পেতে বসে আছে যাত্রীর অপেক্ষায়। ওদের অনেকের গায়ে চাদর আর গলায় মাফলার। রিকশার ওপর বসে বসে ওরা ধুমসে বিড়ি ফুঁকে চলেছে। ওদের বিশ্বাস শীতের সকাল বিড়ি টানলে শরীরের উত্তাপ বাড়বে। ওরা সবাই বাসের জন্যে অপেক্ষমান। বাস থেকে যাত্রী নামলেই ওরা ঝাঁপিয়ে পড়বে। যাত্রীদের ওপর। এখান থেকেই বাসগুলো সোজা চলে যাবে নগরবাড়ি ফেরিঘাটে। বুড়ো দোকানীকে বললো- ‘দু’কাপ গরম চা দাও তো বাবা, কাঁপতে কাঁপতে মরে গেলাম।’

যুবক পাখির খাঁচাটা দোকানের সামনে নামাতেই সেখানে একটা ছোটখাটো ভিড় জমে গেল। কৌতূহলী মানুষেরা উপুড় হয়ে দেখতে লাগল পাখিগুলো। দোকানদার চা দিল। গরম ধোঁয়া ওঠা চা হাতে নিয়ে তৃপ্তির সাথে খেতে লাগল ওরা দু’জন। বুড়ো চা খাচ্ছে আর কৌতূহলী মানুষগুলোর দিকে তাকাচ্ছে। ভাবছে- যারা এমন করে পাখি দেখছে ওদের পকেটে পয়সা নেই, ওরা পাখি কিনে খেতে পারে না। পাখি কেনে ফেরিঘাটের গাড়িওয়ালা বড় বড় লোকেরা। শুধু পাখি কেন, নদীতে ধরা বড় বড় পাঙাশ মাছ, দূর থেকে আনা কৃষকদের লাল ঝুঁটিঅলা বড় বড় মোরগ, পুষ্ট কলা, পেয়ারা এসব দেখলে গাড়ির লোকেরাই কিনে নেয়। বুড়ো চা খেয়ে পলিথিনের ব্যাগ থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট বের করে দোকানীকে দিল। তারপর দু’টো বিড়ি বের করে নিজে ধরাল, অন্যটা যুবককে দিল। চা খাওয়ার পর বিড়ির স্বাদটা ওদের কাছে অমৃতের সমান মনে হল। বুড়ো চোখ বুজে টান দিতে লাগলো বিড়িতে। টাকাটা হাতে নিয়ে দোকানী বললো, ‘একটাকার নোট দাও। এত সকালে পাঁচ টাকার ভাঙতি পাবো কনে?’ বুড়ো চোখ বুজে টান দিতে লাগলো বিড়িতে। টাকাটা হাতে নিয়ে দোকানী আশেপাশে তাকাতে লাগলো। দোকানের সামনে পাতলা ছোঁড়া চাদর গায়ে জড়ানো একজন প্রৌঢ় দাঁড়িয়েছিল। লোকটার মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। লোকটা শীতে কাঁপছিল। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে- সে ভীষণ গরিব। চা দোকানের সামনে রাস্তার ধারে দাড়িয়ে লোকটা চলমান মানুষ দেখছিল উদাস দৃষ্টিতে। চা-দোকানী লোকটাকে ডাকল, ‘ও টিয়ার বাপ, এই টাকাটা একটু ভাঙায়ে আনো।’ লোকটা চুপচাপ দাঁড়িয়েই থাকলো উদাস মনে কোন কথা তার কানে পৌঁছুল না। দোকানী এবার জোরে চিৎকার করে ডাকলো- ‘টিয়ার বাপগো, এই ট্যাকাটা একটু ভাঙায়ে আনো।’ দোকানীর দ্বিতীয় ডাকে লোকটা চমকে উঠে হন্তদন্ত হয়ে পিছন ফিরে বললো ‘আমাকে ডাকছিস কালাম?’ ‘হ্যাঁ চাচা, এই ট্যাকাটা একটু ভাঙায়ে আনো’ দোকানী বললো। লোকটা টাকাটা হাতে নিয়ে দ্রুত অন্য দোকানে চলে গেলো। দোকানী আপন মনেই বলে উঠলো ‘মেয়েটা হারায়ে গিয়ে কী যে হলো লোকটার, একদম পাগল হবার দশা।’ পাখিঅলা যুবক কান খাড়া করে শুনলো দোকানীর কথাগুলো। গরিব লোকটার জন্যে সে বুকের গভীরে একটা ব্যথা অনুভব করলো। লোকটা পাঁচ টাকার নোটটা ফিরিয়ে এনে দিলো দোকানীকে- ‘এত সকালে কিডা দিবি ভাঙতি। কেউ দিলো না, ধরো।’

দোকানী টাকাটা হাতে ধরে বললো ‘টিয়ার কুনু খোঁজ পাইলে গো চাচা?’

‘না রে বাবা কুনু খোঁজ নেই, কী করবো বলতো, কুথায় কার কাছে যাবো আমি’ অসহায় কণ্ঠে কথাগুলো বলে উঠলো লোকটা। ততক্ষণে দোকানে আরও খদ্দের এসে দাঁড়িয়েছে। চায়ের কাপগুলোতে খট খট শব্দে চিনি মেশাতে মেশাতে দোকানী বললো ‘সিকদারের বাড়িতে কাজ করতো না?’

‘হ্যাঁ বাবা, ওর বাড়িতেই তো কাজে দিছিলাম মাস খানেক আগে’ লোকটা জানালো। দোকানী বললো ‘সিকদার কী বলতেছে এখন?’

বলতেছে, ‘রোজকার মতো কাজ কইরে ঘরে ফিরে গিয়েছে, এর বেশি সে কিচুই জানে না, কেউ কিছুই জানবে না, এ কেমন কথা বাবা, আমি এখন কনে যাবো, কার কাছে ফরিয়াদ জানাবো ক’তো দেখি?’ অসহায় কান্নাভেজা কণ্ঠে লোকটা কথাগুলো বললো। তখনই একটা বাস এসে দাঁড়ালো সুলিকান্দা বাজারে। দারুণ সাড়া পড়ে গেলো চারপাশে। লোকজন ছোটাছুটি করছে বাসে ওঠার জন্যে। এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা রিকশা আর ভ্যানগুলোর চালকরা দারুণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পাখিঅলা বুড়ো তখন তার পাওনা টাকার জন্যে অস্থির হয়ে পড়ল। দোকানদার বললো ‘এত তাড়া কিসের গো? দেখছো না এখনই আইলো বাস, ইচ্ছামতো প্যাসেঞ্জার গাদাবি বাসের মদ্যি, তারপরেতে ছাড়বি, দেখবা ছাড়ি ছাড়ি করেও ছাড়বি না।’

একটা ছোকরা বাসের গায়ে দমাদম থাবা মেরে চিৎকার করে চলেছে- ‘নগরবাড়ি, ঢাকা-ঢাকা।’ দোকানী পাখিঅলা বুড়োকে টাকা ফিরিয়ে দিতেই ওরা দু’জন জাল আর পাখির খাঁচা নিয়ে তড়িঘড়ি বাসের ছাদের ওপর উঠে গেলো। বাসের ছোকরাটা তখনো চিৎকার করে চলেছে ‘ছাইড়ে গেলো ছাইড়ে নগরবাড়ি নগরবাড়ি জলদি ওঠেন।’ হঠাৎ পাখিঅলা যুবক হুড়মুড় করে নেমে এলো বসের ছাদ থেকে। সে দৌড়ে চলে গেলো চা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রৌঢ় গরিব লোকটার সামনে। যুবক হন্তদন্ত হয়ে তাকে বলে চললো ‘শুনো চাচা, হামরা পাখি মারতে গেছিনু শামুকদিয়ার বিলে, সেখানে বিলের ধারে ঢিবির ওপর একটা জোয়ান মেয়ের লাশ দেইখ্যা আইসাছি, খোঁজ নিয়ে দ্যাখোতে উটা তুমার মেয়ে কিনা?’ উদাস লোকটা হঠাৎ যুবকের কথা শুনে চমকে উঠলো। বুকে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করলো, মনে হলো কেউ যেন আচমকা একটা লোহার হাতুড়ি দিয়ে ওর বুকের ওপর আঘাত করলো। যুবককে কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলো লোকটা। ততক্ষণে বাস ছেড়ে দিয়েছে। ছাদের ওপর থেকে পাখিঅলা বুড়ো ‘নবা নবা’ বলে চিৎকার করছে। যুবক দ্রুত ছুটছে চলন্ত বাসটার দিকে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *