short-story-ko-parar-mariyam

‘ক’ পাড়ার মরিয়ম ও সমাজতন্ত্র
পারভীন সুলতানা


প্রাক ঐতিহাসিক কালের সামিয়ানার মতো টানানো নীল, সাদা, কালো আর ধূসর আকাশটাই কেবল ‘ক’ পাড়ার খাঁটি সমাজতন্ত্রের প্রতীক। একই সাথে রোদ পোহানো, বৃষ্টির ছাট, বজ্রপাত শোনার শব্দে সবার সমান সমান ভাগ, বাকি সব যার যার, তার তার। অভাব, রোগ-শোক, ধার-কর্জ, চাকরি-বাকরি, সঙ্গম, বাচ্চা প্রসব, রোমান্স, প্রেম, বিরহ। আজও তা বহাল আছে, কোন রকম ফের হয়নি। এখানে গনতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র সব তন্ত্রই সুযোগ মাফিক কায়েম হয়, তবে কার্যত সমাজতন্ত্র

অচল। কোন কিছুতে সমান সমান ভাগ নাই। এমন কী পাবলিক টয়লেটেও যার চাপ বেশি, সেও কয়টা টাকা বাড়তি ধরিয়ে নিজেকে হালকা করে নেয়। গনতন্ত্রও মাঝে মধ্যে ধাক্কা খেয়ে কাৎ হয়ে পড়ে। গনতন্ত্রকে কাঁচকলা দেখিয়ে সবার আগে প্রভাবশালীরা সুযোগ সুবিধাগুলো হাতিয়ে নেয়। এরা পাড়ার কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিকে প্রথম আসা কোভিডের টিকা নিতে এসে দীর্ঘ লাইনকে পাত্তা না দিয়ে সরাসরি বুথে ঢুকে টিকা নিয়ে চলে যায়। তবে, এসব বাদে এ পাড়ায় যে উন্নতি হয়নি তা বলা ঠিক না। আজকাল বড় শহরের কিছু আদব-কায়দা ‘ক’ পাড়ায় ঢুকে পড়েছে। কেউ কারো বাসায় হুট করে পাড়া বেড়াতে যায় না। নুনটা, তেলটা, মরিচটা না থাকলে আগে পড়শি দেশের কাছে ধার-কর্জ চলতো। ভব্যতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন কেউ কারও দৈন্য দেখাতে চায় না। বরং ফুটানি প্রদর্শনিতে ফেইস বুক ছয়লাভ করে দেয়..।

-বাসায় দশ পদ রান্না হয়েছে, ইয়াম্মি! ইয়াম্মি! দাও পোস্ট।

– দামী রিসোর্টে অবস্থান করছি.. দে পোস্ট

– নতুন গাড়ি, ঝাড় পোস্ট…।

অসুখ বিসুখে শুভকামনা, আশু রোগ মুক্তি কামনা, সব অবয়ব পুস্তিকায় সেরে ফেলা হয়।

ইতিমধ্যে অনেগুলো বছর পার হয়ে গেছে। পাড়ার মুদি দোকানগুলো আজ ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ‘ক’ পাড়ারও রঙ রূপের খোলতাই হয়েছে। আগের কিশোরেরা এখন যুবক, যুবকেরা পৌঢ়। কিশোরীরা গড়নে, লম্বায়, সুডৌল স্তনে যুবতী হয়ে ওঠেছে। ল্যান্ড ফোন তার আগের মর্যাদা হারিয়ে গুরুত্বহীন; মোবাইল ফোন ছাড়া কারো চলে না! ডাকপিয়ন আসে না বহুকাল। এ একদার ইতিহাস। তবু গূঢ় এক সমাজতন্ত্রের (!) নিপাট রহস্য আজও ছোট আলপিনের মতো গেঁথে আছে। সেটা যদিও শিকেয় তোলা থাকে। আড়ালে, আবডালে, সুযোগে শিকে ছিঁড়ে জুটিয়ে নেয় কেউ কেউ বা ভোগ করার লোভ করে। আপাতত এসব বাত শিকেতেই তোলা থাক।

আটপৌরে সিনামা হলে কেউ আর সিনামা দেখে না। দেখা হয় ‘সিনেমা’। সিনেপ্লেক্সের নরম আসনে পপকর্ন খেতে খেতে অভিজাত (!) দর্শক ‘ডুব’, ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’ দেখে বিভোর চিত্তে। গার্ল ফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড সহ টেনশনহীন প্রেমে যে যার মতো মুভি ইনজয় করে। ‘ইহাদের’ প্রেমে নাক গলানো ভব্যতার বরখেলাপ মনে করা হয়।

তবে এ পাড়ার একটা ভালো দিক, সবাই সবাইকে চেনে। রেহেনাদের বাড়ি, মাহমুদ কটেজ, মুন্সি লজগুলোর নাম নিশানা নতুন স্থাপনায় গাঁথা ইট সিমেন্টেও চাপা পড়েনি। সম্ভবত মফস্বল বলে এ ধারাটা অক্ষত আছে এখনও। পাড়ার সাথে লাগোয়া বাঁশ বাড়ি কলোনির গরীবরা কিন্তু গরীবই রয়ে গেছে। পুরানো ধারায় রাজমিস্ত্রীর ছেলে রাজমিস্ত্রি, রংমিস্ত্রির পুত্র রংমিস্ত্রি, রিকশাওয়ালার পুত রিকশাওয়ালা, কাজের বেটির মেয়ে কাজের ঝি-ই হয়েছে। এ জন্য মইরমের মার দুই ছেলে বাবুল আর খুরশেদ একজন রংমিস্ত্রি অন্য জন টাইলস মিস্ত্রি। আর মরিয়ম মানে মইরম তার মায়ের পুরনো পেশার নতুন ডেজিগনেশনে ‘বুয়া’।

মরিয়মের বয়স বয়স বিশ থেকে পঁচিশের মধ্যে। বিয়ে হয়েছিল। বাদাইম্যা স্বামী, খাওয়া-পরা দেয় না, তার ওপর মারধোর করে বলে বিয়েটা টেকে নাই। বাচ্চা কাচ্চা না থাকায় মায়ের সাথেই থাকে মরিয়ম। চার/পাঁচ বাসায় কাজ করার সুবাদে মরিয়ম ও মরিয়মের মার অবস্থা বরং অনেক গৃহপালিত হাউজ ওয়াইফের চেয়ে ভালো। যদিও দিন শেষে পরিচয় ঐ কামলা বেটিই। মালিকের চেয়ারে, সোফায় বসার অধিকার নাই, ডাইনিং এ বসে খাওয়ার হুকুম নাই; আর বিছানায় শোয়ারতো প্রশ্নই আসে না। এখানে সমাজতন্ত্র, গনতন্ত্র সবতন্ত্র তুমুল ভাবে পরাজিত। এসব নিয়ে অবশ্য মইরম, মইরমের মাঝবয়েসী মা কিংবা অন্য বুয়াদের কোন অভিযোগ নাই; তাপ- পরিতাপ নাই। বরং মাস কাভারি বেতন তুলে এরা সমিতিতে টাকা জমায়, মোটামুটি ভালো কোয়ালিটির ব্রেসিয়ার পরে। মাছটা, মাংসটাও খায়। কেউ কেউ বাচ্চাদের কিন্ডার গার্ডেন স্কুলেও পড়ায়। ওদের হাতেও আছে মোবাইল ফোন।

মরিয়মের বলতে গেলে জন্মের পর এ পাড়ার আলো-হাওয়ায় বড় হয়েছে। প্রাইমারি স্কুল থেকে ফাইভ পাশ করেছে। হাই স্কুলের পড়ার খরচ চালানোর সামর্থ্য না থাকায় বছর পাঁচ পরে দেখা যায়, ঝরে পড়া শিক্ষার্থী বাসাবাড়ির কাজে লেগে গেছে। উত্তর দিকের বাঁশবাড়ি কলোনি ‘ক’ পাড়ার সাথে লাগোয়া। মইরম ওই কলোনির বাসিন্দা হলেও দিনের ৬/৭ ঘন্টা কাটায় ‘ক’ পাড়ায়। এর মধ্যে দুই বার গার্মেন্টস থেকে ফেরত এসেছে। অতিরিক্ত আলোতে দিন রাত কাজ করতে করতে রক্ত শূন্য হয়ে মরার যোগাড় হলে মরিয়ম সেখানে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

গার্মেন্টস ফেরত মরিয়মের বরং ‘ক’ পাড়াতে আদর আর চাহিদা বাড়ে। কাজের বেটিরা দলে দলে

গার্মেন্টস করতে চলে গেলে পাড়ার গৃহিণীরা পড়ে বিপাকে। এরমধ্যে মইরমের মতো কিছু রয়ে যাওয়া গৃহকর্মী পাড়ার গৃহিনীদের এ বিপদ থেকে উদ্ধার করে। পরিচিত পাড়ায় মা, ঝি মোটামুটি সন্তুষ্ট চিত্তে কাজ করে। পাড়ার বেশ কিছু আটপৌরে বাসা এখন ফ্ল্যাট হয়ে গেছে। মাহমুদ কটেজ, মুন্সি লজ, শহীদ কুটির ডেভলপারদের সৌজন্যে বহুতল ভবন এখন। নিচে লিফট, পার্কিং প্লেস। যদিও এ শহরে প্রাইভেট কারের তেমন প্রচলন নাই। এরা লিফটে ফ্লাটে ওঠা নামা করলেও স্বচ্ছন্দেই অটো, টেম্পো, রিকশায় যাতায়াত করে। মোট কথা একটা আধা খেচরা আভিজাত্যে ঝুলাঝুলি করলেও এ নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নাই। জাতীয় নির্বাচন, সংসদীয় নির্বাচন, জেলা, উপজেলা নির্বাচনে গনতন্ত্রকে বাস্তবায়ন করার ভঙ্গিতে এরা সবাই যে যার বাসা থেকে বের হয়ে ভোট দিতে যায়। মরিয়ম বা ওর মায়ের কোন তন্ত্র নিয়ে মাথা ব্যাথা নাা থাকলেও ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটা মইরম, মইরমের মা এবং এ পাড়ার অন্যদের কাছেও পরিচিত শব্দ। যদিও এর সঠিক মর্মার্থ এদের বোধগম্য নয়। ‘ক’ পাড়ার ‘ছায়া নিবিড়’ বাসার মালিক সজিব তরফদার। ছায়া নিবিড় নামের সার্থকতা বাড়ির সমস্ত আঙিনা জুড়ে বিরাজমান। ২০/২২ শতাংশ জমির বিশাল আঙিনা। চারদিকে ফল-মূলের গাছপাছালি, হেলাফেলার বড় উঠান…। এখনও এ বাসার আমটা, সুপারিটা, লিচুটা পাকলে আশপাশের পড়শিদের মাঝে পুরানা আমলের মতো দেয়া-থোয়ার চলন আছে। বাড়ির মালিক সজীব তরফদার তার স্ত্রী সেতারা বেগম প্রতিবেশিদের বিপদে আপদে খোঁজ খবর নেয়। চৈত্র মাসে পানির সমস্যা হলে বাঁশবাড়ি কলোনির মানুষের জন্য বাইরের ডিপ টিউবওয়েল খুলে রাখা হয়। সমাজতন্ত্রের মানে না বুঝলেও মরিয়ম আর ওদের শ্রেনির অনেকে বাসাটাকে সমাজতন্ত্রের বাড়ি বলে ডাকে। যদিও ওদের জিহ্বায় শব্দটা “সমাসতন্ত” হিসেবে উচ্চারিত হয়। সজীব তরফদারকে পাড়ার লোকজন আড়ালে আবডালে মাথা আউলা সজীব ডাকে। বাড়ির এতো বড় চৌহদ্দি! শহরের প্রানকেন্দ্রে এমন জায়গা! ফেলে রেখেছে, হেলাফেলায়! ডেভলপাররা ছোঁক ছোঁক করে। এরমধ্যে বেশ কিছু কনস্ট্রাকশন ফার্মের ফ্ল্যাট তৈরির লোভনীয় প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। সজীব তরফদারের এক কথা, জীবন যাপনের জন্য তাদের আর কিছুর প্রয়োজন নাই। পাড়ার সবাই কম বেশি জানে সজীব তরফদারের বাবা কমিউনিস্ট পার্টি করতো। একবার পৌরসভার চেয়ারম্যান ইলেকশনেও দাঁড়িয়েছিল। যদিও পাশ করতে পারেনি। কমরেড মনি সিং সজীব তরফদারের বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। এ বাড়িতে দু/চাবার এসেছে মনি কাকা। সজীব তরফদার এসব স্মৃতি সযত্নে বাক্স বন্দি করে রাখে। তরফদারের তিন বোন এক ভাইয়ের সবাই শিক্ষিত। সম্পত্তি নিয়ে কখনও কোন গন্ডগোলের কথা শোনা যায় না। মরিয়ম অন্য বাসায় এক ঘন্টা কাজ করলে এ বাসায় কাটায় দু/দেড় ঘন্টা। অন্য বাসার ঝকঝকে টাইলসের মেঝে কম পরিশ্রমে নিমিষে মোছা হয়ে যায়। তরফদার বাড়ির মোজাইকের ফ্লোর ঘষে ঘষে হাত ক্লান্ত হলেও মন ফুরফুরা থাকে। সজিব কাকা ভাইবোনদের মধ্য সবচে বড়। ষাটের কাছাকাছি বয়স। তাঁর স্ত্রী সেতারা বেগম। দুজনেই শহরেরের বেসরকারি কলেজে পড়ায়। মরিয়ম ন্যাংটা কাল থেকে তরফদারকে কাকা আর সেতারাকে কাকি বলে আসছে। ওদের দুই ছেলে মরিয়মের প্রায় সমবয়সী। বড়জন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করেছে। ছোট জন কলেজে পড়ে। ছেলে দুজনও বেশ ভদ্র-সদ্র। কোন বড়লোকি ভাব-সাব নাই। মরিয়ম প্রায়ই এ বাসায় দু দন্ড জিরায়। তরফদার কাকির সাথে গল্প করে। একদিন কাকিকে জিগেশ করেছিলো- কাকি এই সমাসতন্ত বিসয়ডা কী? পাড়ার হগ্গলে কয় আপনেরা সমাসতন্তের লুক, কথাটা বুজবার পারি না! চাচি নিজের চায়ের সাথে মরিয়মের জন্যও চা বানিয়েছে। চায়ের কাপ ওর হাতে দিতে দিতে বলে- বড় বড় মাথাওয়ালারা যেইখানে সমাজতন্ত্র বুঝতে অক্ষম সেই খানে তুমার সমাজতন্ত্র বুঝতে হইবো না মইরম বিবি, তারচেয়ে বইসা চা খাও। সোফায় বসে পেপার পড়ছিলো সজীব তরফদার। হাতের পত্রিকা রেখে মরিয়মের প্রশ্নের উত্তর দিতে আগ্রহ নিয়ে উঠে আসে। গুরুগম্ভীর ভাবে বলে- মন দিয়া শুন মরিয়ম, সমাজতন্ত্র হইলো একটা দেশ চালানোর সব নিয়মের মধ্যে সেরা নিয়ম। সমাজতন্ত্র ব্যাক্তিগত মালিকানার উৎখাত করে, মানুষে মানুষে শোষণ, অর্থনৈতিক সঙ্কট আর বেকারত্বের বিলোপ ঘটায়। সমাজতন্ত্রের মূলনীতি হইলো- প্রত্যেকে কাজ করবে তার সামর্থ্য মাফিক আর প্রত্যেকে গ্রহন করবে তার প্রয়োজন অনুযায়ী…। সুযোগ, সুবিধা সবাই সমান সমান ভোগ করবে। তবেই ধনী গরীবের আকাশ পাতাল পার্থক্য কমে আসবে… সেতারা বেগম আধ খাওয়া চায়ের কাপ টকাস করে টেবিলে রেখে স্বামীকে বলে- এইটা তুমার কলেজের ক্লাস পাইছো? এইসব কঠিন কথা মরিয়মের মাথায় ঢুকবো? তুমি আসলেই পাগল! মরিয়ম এতো কিছু না বুঝলেও এইটা বুঝে যে, সমাজতন্ত্র হইলো গরীব আর ধনীর পার্থক্য কমানো। পাড়ায় এ বাসাতেই মরিয়মদের সোফা কী চেয়ারে বসতে নিষেধ নাই। এ বাসার কেউ ডাইনিং এ বসে চা- নাস্তা খাওয়ায় আপত্তি তুলে না।

কাজ শেষে বাসার ফিরে মরিয়মের তেমন কিছু করার থাকে না। ভাইরা যার যার আলাদা সংসারে। মা-ঝি, দুইজনের কত আর রান্ধা-বাড়া! অবসরে মন ভরে স্টার জলসা দেখে। মরিয়ম সিরিয়ালের কাহিনির স্রোতে ভাসে। পছন্দের চরিত্রের সাথে লীন হয়ে যায়। নাটকের নারীদের মতো মতো চুল কাটে, ভি গলার থ্রিপিস পরে। চাপা রঙ হলেও মরিয়মের গঠন-গাঠন সুন্দর। ঢলো ঢলো চেহারায় একটা সৌন্দর্য টলমল করে।

বাসা বাড়ির কাজ, সিরিয়ালের নায়কদের প্রেমে দিন কাটালেও কোন কোন সময় বুকের মধ্যে তোলপাড় যে ওঠে না তেমন সাদামাটা নয় মরিয়মের জীবন। শরীর জ্বলে-পোড়ে, মুচড়ায়। সমান বয়সীদের স্বামী সুখ দেখে হিংসায় মন টাটায়। কোন কোনদিন পাগলা কুত্তা কামড়ায়। নিজের মায়ের সাথেই সতীনের মতো ঝগড়াঝাটি করে। মাও ছাড় দেয় না- লাঙের ভাত না খাওয়ার দোষ অবলীলায় তার উপর গছিয়ে, বাদাইম্যা বেটার গুণ কীর্তন শুরু করে। মরিয়মের তখন ইচ্ছা করে

ঘরের সিলিং এর সাথে লটকে পড়তে। বোকা সোকা ভালা মাইয়্যা সুইটি ভাবীর বদ জামাইয়ের লগে শুয়ে পরার কথাও ভাবে। ভাবে, বাঁশবাড়ি কলোনির মুদি দোকানদার একচোখ কানা কিপটা ইদ্রিস্যাইর প্রেমে সাড়া দেওয়ার কথাও। কিন্তু সিরিয়াল তার রুচিকে জব্বর শানদার করে তুলেছে। চুলের কাট, জিন্সের প্যান্ট আর কলার তোলা গেঞ্জি পরা নায়কের সাথে এ পাড়ার একখান পোলাও যায় না। বিয়ার প্রস্তাবও আসে সব বুড়া-ধুরা, দুইতিন পোলার বাফ, অসুইখ্যা-বিসুইখ্যা…! এ জগতে কেউ মরিয়মের দুঃখ বোঝে না…।

সকাল থেকে আচানক দিল খুশ মরিয়মের। তার প্রিয় ‘আশা’ সিরিয়ালের নায়ক অভিক, বস্তির সুন্দরী নায়িকা মাধুরির প্রেমে পড়ছে। নায়ক বিরাট বড়লোকের পোলা… আল্লাহ আল্লাহ কইরা প্রেমটা যেন হয়্যা যায়… এই জল্পনা করতে করতে মরিয়ম ‘ছায়া নিবিড়’ বাসার কাজ শেষ করে। সামনে ঈদ, কাকি তাকে সুন্দর একটা থ্রিপিস দিয়েছে। গোলাপি জর্জেট। অনেকটা ‘আশা’ সিরিয়ালের নায়িকার থ্রিপিসের মতো ডিজাইন। খুশিতে বাক-বাকুম হয়ে সে ঢোকে ‘রোজ গার্ডেন’ ফ্ল্যাটে। দরোজা খুলে বিথী আপা। পাড়ার মেয়ে। ফ্ল্যাটটা বিথি আপার আব্বার। মরিয়মের চেয়ে বছর তিনেকের বড়। কোলের মেয়ে ছাড়াও তিন বছরের ছোট এক ছেলে আছে। মরিয়মের খুশি মুখ দেখে বিথি গম্ভীর মুখে জিগেশ করে- আজকে এ-তো দেরি করলি যে? কত কাজ জমে আছে! মরিয়ম হাতের ব্যাগ দেখায়। উপহার পাওয়ার বৃত্তান্ত জানায়। তারপর কোমরে ওড়না জড়িয়ে কাজে নেমে পড়ে। এ সময় দুলাভাই থাকে না। এই এক সুবিধা। বেটার আবার নজর ভালা না। বিথি আপাও যে বোঝে না, তা না। কাজের লোকের সঙ্কট, দুই বাচ্চা নিয়ে সে পড়েছে বিপাকে। মরিয়ম এলে চোখে চোখে রাখে। ঘর ঝাড়ার মাঝখানে হঠাৎ দুলাভাইয়ের উদয়- কী মরিয়ম, এই রকম দেরি করে আসলে চলে সব সময়? আমার বাচ্চারা ছোট, তুমার আপা একলা সামলাইতে পারে না…। যেন কত দরদ! মরিয়ম বোঝে বেটা আসলে মরিয়মকে দেখার বাহানায় উঠে আসছে। ঠাণ্ডা গলায় বলে- দুলাভাই, সমাসতন্ত কাকার বাসাত এট্টু দেরি হয়্যা গেছে, কাকি নিজের হাতে চা বানায়া আনলো তবু দেরি দেইখ্যা চা থুয়াই ছইলা আসছি। ভেতরের রুমে ছেলে ত্রাহি স্বরে কেঁদে ওঠায় বিথি দৌড় লাগায়। বদ বেটা মরিয়মের বুকের দিকে তাকায় সরাসরি- সব সময় খালি এক অজুহাত, সমাজতন্ত্র বাসাত দেরি হয়্যা গেছে! ঐ বাসায় কী মধু আছে নাকি! কথা শেষ করে মরিয়মকে মাথায় ভরে চলে যায় লোকটা। ছেলের জ্বর বলে অফিস কামাই দিয়ে বাচ্চার ডায়পার বদলানো, বউকে কাজে সাহায্য করতে হচ্ছে, তারপর এই যুয়ানকী মাগির চটর-পটর, কথায় কথায় সমাজতন্ত্র কাকা-কাকির নানান কিচ্ছা! যুৎমতো পেলে খানকিটাকে বুঝিয়ে দেয়া যেত সমাজতন্ত্র কারে কয়। নরম বিছানায় তুলে ধনি দরিদ্রের তফাত ভুলিয়ে শালিকে আচ্ছা মতো

সমাজতন্ত্রের মন্ত্র ঢোকানো যেতো! বউ বিছানায় যুতের না হলে কী! আস্তা খান্ডাস। জামাইকে চোখে চোখে রাখবে, চুন থেকে পান খসলে নিচ তলায় বাপের ফ্ল্যাটে ইন্টারকম করে। মইরমকে দেখলে মাথা গরম হয়ে যায়। শালি আল্লাহ জানে কুন গুদামের চাল খায়! জর্জেট ওড়নার নীচে ওর বুকের যৌবন ফাইটা পড়ে। রাস্তায় আসা যাওয়ার সময়, ঘর মোছার ছন্দিত তালে মরিয়মকে দেখলে একটা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটানোর পরিকল্পনা করে বদমাশটা।

রাজিব কাকার বড় ছেলে পাশ করেও বছর দেড়েক বেকার। বাসায় বসে সারাক্ষণ কম্পিউটারে চাকরি খোঁজে। ইন্টারভিউ দিতে ঢাকা যায় ঘন ঘন। শান্ত সুবোধ ছেলের মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠলে কাকি বলে মরিয়মকে চা করে দিতে, মেয়েটা তার চেয়ে ভালো বানায়। ছেলেও পছন্দ করে। মরিয়ম বিরক্ত হয় না, বরং খুশি খুশি মনে চা বানায়। তবে, সিরিয়ালের টাইম শুরুর আগে আগে সে তার বাশবাড়ি কলোনির ঘরে ঢোকে।

‘আশা’ সিরিয়ালে নায়কের সাথে বস্তির মেয়ে মাধুরির প্রেম জমে ওঠেছে। বাসায় ঢুকেই মরিয়ম টিভি অন করে। গেল রাত ঘুমের জন্য সিরিয়ালটা মিস হয়ে গেছে। পুরানোটা দুপর বারোটা আর বিকাল সাড়ে চারটায় আবার দেখায়।

নিরালা বাসায় ঢুকে আজ খুশির খবর শোনে। অমিত নিজের হাতে মরিয়মকে মিষ্টি এনে চাকরির খবর দেয়। কাকি ৭১’ টিভির খবর পাল্টে স্টার জলসা খুলে- নে, তোর প্রিয় সিরিয়াল দেখতে দেখতে মিস্টি খা। আজকে আমার সবচেয়ে আনন্দের দিন। হো হো হাসিতে অমিতও ওদের সাথে যোগ দেয়- আসল কথা, এইটা মায়েরও প্রিয় সিরিয়াল। তোমাদের সিরিয়াল শেষ হইলে মরিয়মের হাতের চা খামু। কাকি হাসতে হাসতে জানায়- আমিও। তারপর বলে- এতো যত্নে বানাই, তবু আমার হাতের চা কেমন টেলটেলা হয়্যা যায়! সিরিয়ালের এক ফাঁকে মরিয়ম অমিতের দিকে তাকায়। নায়কের সাথে অমিত ভাইয়ের চেহারার বহুত মিল। এমন কী গালের টোলেরও। বুকটা কী করে ওঠে যেন ওর। অমিত শিশুর মতো প্রগলভ হয়- জানো মা, আমার পোস্টের জন্য কত মন্ত্রী, এমপির তদবির আর ফোন আছিল কিন্তু অফিসের সিইও খুব নীতিবান। তাঁর এক কথা, আমার কাছে মেধার চেয়ে বড় যোগ্যতা আর কিছু নয়। কে কোন স্ট্যাটাসের… অমিতকে থামিয়ে দেয় চাচি -স্ স্ স্! তারপর খরগোশের মতো কান খাঁড়া করে। স্ক্রিনে চরম নাটকীয় মুহূর্ত চলছে! ওদের প্রেম ধরা পড়েছে…। মরিয়ম আজকে সিরিয়ালে মন দিতে পারছে না; অব্যাখ্যাত ভালোলাগায় মন, শরীর আনচান করছে। নায়িকাকে থাপ্পর দিতে আসা মায়ের হাত দৃঢ়ভাবে চেপে ধরে নায়ক। তারপর একটা রহস্যময় মিউজিক বাজতে বাজতে দর্শককে কৌতূহলে ঝুলিয়ে সিরিয়াল আজকের মতো শেষ হয়ে যায়। মরিয়ম টিভি থেকে চট করে দৃষ্টি ফেরায় অমিতের দিকে। কৌতুকময় হাসি ফুটে ওঠেছে ও মুখে। কাকি গজ গজ করে- হলোই গরীবের মেয়ে, প্রেম কী ধনী গরীব দেইখা হয়! সে জন্য তুই থাপ্পর দিবি! মনটা শান্তি আর সাহসে ভরে ওঠে মরিয়মের।

পরদিন কাকির থেকে উপহার পাওয়া গোলাপি থ্রিপিসটা পরে আসে মরিয়ম। অথচ এটা ঈদের জন্য। ঈদের এখনও ১০/১২ দিন বাকি। আজ পাড়ার যুবক, বৃদ্ধ এমন কী রমনীগণও অপারগ মুগ্ধতায় মরিয়মকে চেয়ে চেয়ে দেখে।

অমিত দরজা খুলে দেয়। বাসায় কাকি নাই। মরিয়ম রোজকার কাজগুলো শুরু করে। কম্পিউটারে কাজ করার ফাঁকে মরিয়মের টুকটাক কথার উত্তর দেয় অমিত। কাকি ফিরতে ফিরতে মরিয়মের কাজ শেষ হলে অমিতকে জিগেশ করে চা করবে কী না। চা না, অমিত কফি খেতে চাইলে মরিয়ম জানায় সে কফি বানাতে পারে না। এর মাঝে কাকি চলে আসে। চেয়ারে বসতে বসতে ছেলেকে বলে- চাকরি পেয়ে তো দায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দিলি। কলেজে আজ তোর জন্য কত জন কত সম্বন্ধ আনার কথা উঠালো! অমিত হাসে- এতো জলাদি দায়িত্ব পালন করতে কে বলছে তুমারে, আমার তাড়া নাই। মাত্র তো চাকরিটা হইলো!

চৈত্র মাস চলছে। পাড়ায় এবার খুব পানির সংকট। এ বাসার ডিপ টিউবওয়েলেও পানি উঠছে না। বাইরের গেট খোলা, লোকজন এসে ফিরে ফিরে যাচ্ছে। কলেজ থেকে ফিরে তরফদার ছেলেকে বলে- মিস্ত্রিকে আসতে বলেছি, দেখুক কিছু করা যায় কী না! এর মধ্যে কাকি মরিয়মের কাছে সিরিয়ালের খবর জানতে চায়- তুই কালকের পর্ব দেখছোস? মরিয়ম জানায় রাইতে দেখছি। সব মিটমাট হয়্যা গেছে। ছেলের পরিবার মাইনা নিছে। বিয়া হইবো। কাকি চেয়ারে জুৎ করে বসে- মনটাই খুশি হয়্যা গেল। অমিত রান্না ঘর থেকে কফি হাতে বেরোয়। নিজেই তৈরি করে নিয়েছে। মাকে বলে- আমিও এরকম একটা করে ফেললেই হতো। আমার বিয়ের দায়িত্ব নিয়ে তোমাদের আর ভাবতে হতো না। কাকি শাড়ির আঁচলে মুখ মোছে-শোকর যে করো নাই। এইসব নাটক সিরিয়ালেই চলে। বাস্তবে কোন বাপ- মা মানবো শুনি! অমিত কফির ফেনায় চুমুক শেষ করে বলে- এই দেড় দুই বছর চাকরি খুঁজতে খুঁজতে খুব শিক্ষা হইছে। জীবন যে নাটক না সেইটা হাড়ে হাড়ে টের পাইছি।

পরদিন মরিয়ম গার্মেন্টসে চাকরির উদ্দেশ্যে ঢাকার বাসে ওঠে। এবং আজও মাথার উপর সামিয়ানার মতো টানানো আকাশটাই কেবল ‘ক’ পাড়ার সমাজতন্ত্রের খাঁটি নিশানা। রোদের তাপ, ঝড় বৃষ্টির ছাট, বজ্রপাতের শব্দে সমান সমান ভাগ। বাকি সব যার যার তার তার। দরিদ্র্য, দুঃখ, অপমান, বিরহ…।

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *