short-story-kono-birol-raat-e

কোনও কোনও বিরল রাতে
সুমন্ত আসলাম


চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সাহির, ফুটপাতে। দু’হাত দু’দিকে, পা দুটো সটান। ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মতো দেখাচ্ছে- স্থির। বেদনায় ছেয়ে আছে দু’চোখ, কেবল ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠছে মাঝে মাঝে; অল্প, তিরতির।

সন্ধ্যার ঠিক পরপরই এসেছে সে, এখানে। বৃন্দাবন যাওয়ার নির্জন রাস্তা, নির্জন ফুটপাত। একটু পর আরও নীরবতায় ছেয়ে যাবে ওপাশের লেকটা, নতুন শহর গড়ে ওঠার বাঁকা ওই ব্রিজ, কয়দিন পর কাটা পড়ার শঙ্কায় লম্বা তালগাছটা। আর সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যে বটগাছটার ডালে লাল রঙের অনেক সুতো ঝুলিয়েছেন, তার নিচে বাঁধানো বেদিতে নকশা কেটেছেন বর্ণিল, চৈত্র্য সংক্রান্তিতে যেখানে ঢোল বাজিয়ে উৎসব হয়, পূজোর সিঁদুর মাখা আছে যার শরীরের এখানে-ওখানে, কেবল সেই গাছটায় কতগুলো পাখি ডেকে উঠছে কিচকিচ করে, একটু পরপরই।

সন্ধ্যা আরও একটু গাঢ় হলেই স্থির হওয়া অন্ধকার ফুঁড়ে একটা সুবাস এসে লাগবে নাকে। সস্তা পাউডারের উৎকট সুবাস। সমস্ত মনোযোগ দিয়ে তার আগে আকাশের তারা গুনবে সে; একা, শুয়ে শুয়ে। সন্ধ্যাতারারা আকাশে প্রথম এসে সম্ভাষণ জানায় সেই সন্ধ্যাতেই, তারপর একে একে অনেক তারা। তার আর তারা গোনা শেষ হয় না; কখনও, আজও।

সমস্ত আকাশের নিচে এ এক অদ্ভুত শুয়ে থাকা-পুরো আকাশটা নিচু হয়ে আছে চারপাশে। ঘিরে রেখেছে সব সবুজ; পাহাড়-নদী-মাঠ। সভ্যতার দাবীদার ওই আকাশ বাওয়া দালান, মোবাইল-টাওয়ার, হাজার চিন্তার মানুষ-সব। বিস্তীর্ণ ফুটে ওঠা শত কোটি সোনালী আলো, তার নিচে, অনেক দূরে, এই মাটি ঘেঁষা অন্ধকার। জোনাকিবিহীন এই শহরে একটা জোনাকি এলে হুমড়ি খাওয়া চোখ, বিবর্ণ হয়ে যাওয়া তার পরপরই- না, একটা জোনাকি কেন! হাজার জোনাকি থাকার কথা তো এখানে, এই কংক্রিট শহরে। প্রজাপতির ডানায় ভেসে যাওয়ার কথা সব মলিনতার, লম্বা লেজের বউ কথা কও পাখি কিংবা হঠাৎ কোকিল-কু-উ-উ। না, এসব কিছু নেই। নেই সেই আকাশও। দূষণ আর ধোঁয়ার আস্তরে উজ্জলতা হারানো চাঁদ, চাঁদের বুড়ির চরকা কাটা নেই আর, থেমে আছে বহুদিন, কতদিন! কেবল ঝিঁঝিপোকারা বেঁচে আছে এখনও, ডেকে যায় নিরন্তর, ফুসরত পেলেই শব্দ বাড়িয়ে দেয় আনন্দে। ‘অতিকায় হস্তি লোপ পাইয়াছে, কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছে’, টিকিয়া আছে ঝিঁঝিপোকা, টিকিয়া আছে মানুষ, টিকিয়া আছে মানুষের অভিনয়।

টিপটিপ আলো একটা জ্বেলে উড়োজাহাজ উড়ে যাচ্ছে দূরে। ভূবন চিলের মতো স্থির তার ডানা। শান্ত তার চলে যাওয়া।

দু’হাত মাথার নিচে নিল সাহির, চোখ বুজে ফেলল আয়েশে। মাথার ভেতর কুট করে উঠল তখনই-একটা অক্ষমতা, একটা অউপশম যোগ্য যন্ত্রণা, একটা নীরব চিৎকার।

‘তারা গোনা হলো?’ ডান পাশের কোণা থেকেই এলো শব্দটা, গাঢ় অন্ধকার সেখানে।

‘না।’ উত্তর দিল সাহির।

‘আজও না!’ মেয়েটার গলায় যতটা না বিষ্ময়, তার চেয়ে বেশী কৌতুক, কিছুটা বিদ্রূপও।

‘গুনে ফেলব একদিন। তারপর একদিন তারা হবো নিজেই, তারা একটা বেয়ে যাবে আকাশে।’ উঠে বসল সাহিব, ‘আজও চুপি চুপি এলেন; শব্দহীন, খুব নীরবে।’

‘নীরব যাদের বাস, আড়ালে যাদের প্রতিদিন, তারা তো এমনই, এমন কি তাদের বেঁচে থাকাটাও।’

পায়ের দিকটা ইশারা করল সাহির, ‘বসুন।’

বসল মেয়েটি। মৃদু হেসে বলল, ‘আমি পৌষি, পুশি নই।’

‘আমি কিন্তু পৌষিই বলি। জিহ্বায় কিছুটা জড়তা, ভারীও মনে হয় একটু, পৌষিকে তাই পুশি শোনায়। অথচ আপনার নাম পৌষিও নয়।’

‘পৌষি, আপনার কাছে পৌষি। কারো কারো কাছে আমি মিতি, কারো কাছে অর্না, কারো কাছে জুঁই। আমাদের জায়গা বদলায়, মানুষ বদলায়, নাম বদলায়, কেবল ভাগ্য বদলায় না।’ আরও একটু কাছ ঘেঁষে বসল পৌষি, ‘একটা মানুষ মারা গেছে, জানেন?’

‘একটা মানুষ!’ হাসতে থাকে সাহির, ‘মাত্র একটা!’

‘একটা স্বামী ছিল মানুষটার, একটা বাড়ি ছিল, একটা গাড়ি ছিল, ব্যাঙ্ক বোঝাই টাকা ছিল, ছিল যত্রতত্র সোনা মোড়ানো গয়নাও।’ গলাটা বিষাদ হয়ে যায় পৌষির, ‘তবু মারা গেল!’

‘মারা যায়নি, মরে গেছে।’ সাহির হাসতেই থাকে, ‘যারা সব পেয়ে যায় জীবনে, তারা মরে যায়-মরে যায় তাদের চোখ, মরে যায় তাদের শরীর, মরে যায় তাদের মন। যদিও জীবন্ত দেখায় তাদের, অথচ ফসিল। পচে যেতে যেতে টিকে থাকে শেষে ওটুকুই।’ পৌষির দিকে তাকাল সাহির। গভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘মরে গেল কেন?’

‘জানি না।’

‘বেঁচে থাকার স্বাদ পেত না সে আর এত আয়োজনেও, সাধ ছিল না আকাশ দেখার, চাঁদের আলোয় চুল ভেজাবার।’ কেমন উদাস হয়ে যায় সাহিরের চোখ দুটো, ‘সবটুকু গিয়ে শেষপর্যন্ত থেমে যায় পথ, সব শখ মিটে গেলে মরে যায় মানুষ।’

‘শেষপর্যন্ত মানুষ মরে যায়-।’ পৌষি দূরাগত গলায় বলে, ‘না?’

‘মরে যায়, মরে যায় একেক কারণে।’ দু’পা গুটিয়ে নেয় সাহির, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছেলেটা আত্মহত্যা করল কয়দিন আগে, মরে গেল নিজে নিজে, সে আসলে প্রতিযোগিতার বাজারে ঢুকে পড়েছিল, নিজের অজান্তেই। টিকতে পারেনি। তাই এই নীরব প্রস্থান। পল্লবীর যে মেয়েটা লাফ দিয়েছিল তাদের ছয়তলার ছাদ থেকে, স্বপ্ন চুরি হয়ে গিয়েছিল তার অনেকখানি, অনেক আগেই। বাড্ডার ওই গৃহকর্তা ঝাঁপ দিয়েছিলেন বাসের চাকায়, তার আসলে হিসাব মিলছিল না কোনও কিছুতেই- কোভিড, চাকরি হারানো, সংসার, ক্ষুধার্ত বাচ্চাদের মুখের খাবার, ক্রমেই বিবর্ণ হয়ে যাওয়া আটপৌরে বউটা।’

‘আচ্ছা, আপনি আবরারকে চিনতেন?’ পৌষি জিজ্ঞেস করল।

‘না।’

‘অথচ আপনারা একসঙ্গে পড়তেন, বুয়েটে।’

‘আমি তো রাফাহ নানজীবা তোরসাকেও চিনি না।’

‘তোরসা কে?’

‘তোরসাকে আপনিও চেনেন না!’ সাহির একটা হাত বাড়িয়ে দিল ডানে, বাতাসে কিছু একটা ধরার ভঙ্গিতে, ‘অথচ বাংলাদেশে মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতা হয়েছিল ২০১৯ সালে, সেখানে মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।’

দু’হাত দিয়ে মাথার চুলগুলো পেছনের দিকে ঠেসে ধরে সাহির, ‘আমরা সম্ভবত ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদকেও চিনি না, শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন তিনি। আমরা নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের উপজেলা কমপ্লেক্সের সেই শিশুটিকেও চিনি না, যার ভাঙা পা রেখে ভালো পায়ে প্লাস্টার করে দিয়েছেন সেখানকার ডাক্তাররা।’

হেসে ওঠে পৌষি।

‘আমি কি পৌষিকেই চিনি? যে পৌষি এরকম একটা রাতে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল আমার, কাছে এসে বলেছিল- কিছু লাগবে আপনার? চুপচাপ মাথা নিচু করে একা একা বসে থাকা আমি চোখ তুলে ছিলাম উপরে, অন্ধকার চারপাশ, ছিটেফোঁটা আলো নেই আশপাশে। তবুও আমি বুঝে যাই সব, জেনে যাই নিমেষে, দেখেও ফেলি নীরবে। পৌষি বেচতে চায় তার শরীর, আমি কিনতে চাই তার গল্প। এই, এই কয়দিনে কতবার দেখা হলো আমাদের। এই, এই কালো রাতের অন্ধকারে, নীরবে, নির্জনতায়! পৌষি তার শরীর বেচতে পারে না আমার কাছে, আমারও তার গল্প কেনা হয় না আর। তবুও আমি জেনে যাই- পৌষি মার্কেস পড়েছে, মুরাকামি পড়েছে, মানিক পড়েছে; জীবনানন্দের অনেকগুলো কবিতা মুখস্থ তার; উইল স্মিথের ‘দা পারসুইট অফ হ্যাপিনেস’ আর ‘সেভেন পাউন্ডস’ দেখে কেঁদেছে আর সবসময়ের জন্য তাকে মুগ্ধ করা মান্টোর গল্পের কথা বলেছে সে অনেকবার। সাদত হাসান মান্টো, তার সেই বিখ্যাত গল্প ‘ঠাণ্ডা গোশত’। ঈশ্বর সিং এক বাড়িতে লুট করতে গিয়ে সাতজনের ছয়জনকে খুন করে, আর একজনকে নিয়ে আসে কাঁধে তুলে- খুবই সুন্দরী ছিল সে। পথের মাঝে একটা গাছের নিচে নামায় তাকে। ডোবার পাশে একটা ঝোপের মাঝে শুইয়ে দেয় তাকে, ঝাঁকুনি দেয়। কিন্তু…।

আর কিছু বলে না ঈশ্বর সিং। তার স্ত্রী কলাবন্ত খুব আগ্রহ নিয়ে বলেন, তারপর?

সে মরে গিয়েছিল, একেবারে মরা লাশ, একদম ঠাণ্ডা গোশত। ঈশ্বর সিং উত্তর দিয়েছিল।’ সাহির হাসতে হাসতে আবার একটা হাত বাড়িয়ে দেয় ডান দিকে, বাতাসে, ‘পৌষি ঠাণ্ডা গোশতের সেই গল্প বলতে বলতে বলেছিল, এই শহরে অনেক ঈশ্বর সিং আছে! তবুও মনে হয়-এই শহরে কোনও পাপী নেই, সাদত হাসান মান্টোও নেই।’

‘আচ্ছা-।’ দূর আকাশের দিকে তাকায় পৌষি, ‘মান্টোর গল্পের ওই মেয়েটা মরে গিয়ে ঠাণ্ডা গোশত হয়ে গিয়েছিল, আর আমরা বেঁচে থেকেই ঠাণ্ডা গোশত হয়ে গিয়েছি। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে আমাদের রক্ত, আমাদের মন, আমাদের ভেতর-বাহির, আমাদের এই নিরুত্তাপ বেঁচে থাকা।’ পৌষি একটু থামে, ‘আমাদের প্রত্যেকেরই একটা গল্প আছে।’ পৌষি বাম হাতটা বাড়িয়ে দেয় সাহিরের পায়ের দিকে, ‘কারও কারও আরও বেশি।’

‘সব গল্প বিষাদের।’

‘প্রতিশোধেরও।’

‘যেখানে প্রতিশোধ, সেখানেই বিষাদ।’

সূক্ষ্ম পর্দার মতো একটা ধোঁয়া ভেসে আছে চারপাশে, কোনও একটা ফুলের গন্ধ ঝুলছে বাতাসে। এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুলগুলো টেনে পেছনের বাঁধল পৌষি, চোখে কৌতুক, ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি, ‘রিকশায় চড়তে ইচ্ছে করছে আজ, খুব, খু-উ-ব।’

‘একা?’

‘না-।’ কিছু একটা বলতে নিয়ে থেমে যায় পৌষি, ‘থাক। আমরা বরং নামতা পড়ি।’ পৌষি হাসে, ‘তিন ঘরের নামতা। তিন ঘরের নামতা জানেন আপনি?’

সাহির কুঁচকে ফেলে নিজের চোখ দুটো।

‘হাট্টিমা টিম টিম? চার লাইনের ওই ছড়াটি?’

চোখ দুটো তীক্ষ্ণ হয়ে যায় সাহিরের।

‘আমার আসলে সেই ছোটবেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে-দু বছর, তিন বছর কিংবা চার বছর; যে বয়সে কোনও স্বপ্ন থাকে না, যন্ত্রণার স্মৃতি বয়ে বেড়াতে হয় না যখন তখন।’ পৌষি একটু ঘুরে বসে, ‘আপনি জানেন-চার বছরের একটি শিশু গড়ে কয়টি প্রশ্ন করে দিনে?’

সাহির পলকহীন তাকিয়ে আছে পৌষির দিকে, কিছু বলে না। ঝুলে পড়া ওড়নাটা পৌষি আরো একটু জড়িয়ে নেয় গায়ে, কিছুটা জড়ো হয়েও বসে দু’পা গুটিয়ে, ‘আমি কি বেশি কথা বলছি?’

‘না।’

‘চার বছরের একটি শিশু দিনে ৪৫০টি প্রশ্ন করে। খুব ইচ্ছে করছে- সেই চার বছর বয়সী সময়টা ফেরত পেতে। প্রশ্ন করি একের পর এক- আমি মেয়ে হয়ে জন্মালাম কেন? পুরুষের চেয়ে মেয়েরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল কেন? কেন আমরাই কেবল পেটে সন্তান ধারন করব? প্রেরিত অনেক পুরুষ পাঠিয়েছেন স্রস্টা এ পৃথিবীতে, একটাও প্রেরিত নারী নেই কেন? বন্দি মানুষের মতো শরীর আবৃত করে মেয়েরা কেন রাস্তায় হাঁটবে, পুরুষ তার চোখ দুটো শালীন করে না কেন?’ পৌষি হাসে, ‘বিরক্ত হচ্ছেন?’

‘না।’

‘প্রশ্নগুলোর জবাব আছে আপনার কাছে?’

‘না।’

‘কী ঝট করে বলে ফেলছেন- না।’ গলাটা কাতর করে ফেলে পৌষি, ‘সত্যি নেই! অথচ দেশের সবচেয়ে মেধাবী বলা হয় আপনাদের!’

‘রিকশায় চড়বেন?’

‘সঙ্গে আপনি থাকবেন?’ প্রশ্ন করল পৌষিও।

মাথা উঁচু-নিচু করল সাহির, বেশ ধীরে, বেশ আয়েশে ।

চোখ দুটো বুজে ফেলল পৌষি। মিহি একটা বাতাস বইছে হঠাৎ। চাঁদটা মেঘে ঢেকে ছিল এতক্ষণ। এক চিলতে উঁকি দিল। সাহির দেখল- পৌষির মুখটা উজ্জল হয়ে উঠেছে, আলো চিকচিক করছে চোখে, এক টুকরো বেদনাও আছে পাশাপাশি।

‘চাঁদটা উঠি উঠি করেও উঠছে না।’ আকাশে তাকাল সাহির।

‘উঠে যাবে, এখনই।’ উঠে দাঁড়ালো পৌষি। আকাশে তাকাল সেও, ‘অদ্ভুত এক ভাগ্য চাঁদের! নিজস্ব কোনও আলো নেই এর, মানুষ তবু ভালোবাসে একে।’

‘মানুষ চাঁদ ভালোবাসে না, তার আলো ভালোবাসে।’

‘আমরা কিছুক্ষণ চাঁদের আলোয় হাঁটব আজ। আমরা আমাদের ছায়া দেখব। ছায়াগুলো অশরীরীর মতো পিছু নেবে আমাদের-লম্বা ছায়া। হাঁটতে হাঁটতে আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করব-ছায়াগুলো আরও লম্বা হয়ে গেছে। আমাদের তখন মনে হবে-মানুষের চেয়ে তার ছায়া বড় হয় মাঝে মাঝে, সুখের চেয়ে যেমন দুঃখের তালিকা।’

লম্বা চকচকে ওড়নাটা দিয়ে মাথা ঢেকেছে পৌষি। উঠে দাঁড়াল সাহির। দূর থেকে কীসের একটা শব্দ ভেসে আসছে এক টানা। বাচ্চার কান্নাও শোনা গেল হঠাৎ। চাঁদটা উজ্জল হয়ে গেছে বেশ। খুব ইচ্ছে করছে- একটা হাত টেনে ধরবে ওর। আন্তরিকতার চরম পরশে বলবে, চলুন, আজ সারারাত রিকশায় ঘুরব দুজন, ভোরের আজান হবে, আমাদের আর ঘোরা শেষ হবে না।

দু’পা এগিয়েও গেল সাহির, থেমে গেল পরক্ষণেই। ব্যাপারটা টের পেল পৌষি, হেসেও ফেলল নীরবে। গলাটা খাদে নামিয়ে বলল, ‘কোনও হাতেই পবিত্র-অপবিত্রের স্বাক্ষর নেই। পচে যাওয়া হাতে যেমন লাল রক্ত বয়, অন্য হাতেও তেমন। আচ্ছা, মানুষের কি কেবল হাত-পা পচে, না পুরো মানুষটাই পচে যায় একসময়? নিজেকে আজ কেন যেন খুব সুখী লাগছে আমার। তেমন কোনও কারণ নেই, হয়তো কেউ একজন হাত ধরতে চেয়েছে-কামনায় নয়, অল্প হলেও ভালোবেসে।’ পৌষি সাহিরের দিকে তাকায়, ‘অথবা ভালোবাসার অভিনয়ে।’

বুক খালি করা শ্বাস ছাড়লো সাহির। জ্যোৎস্নার তীব্রতা বাড়ছে, চারপাশ তবু অন্ধকার। কোথাও জেগে আছে দূর্বাঘাস, শিশিরে ভিজে যাবে ডগা; একটা রাত জাগা পাখি জেগে থাকবে নিশ্চুপ; এখনও বাতাস বয়, এখনও ফুল ফোটায় মাধবী, মানুষ স্বপ্ন দেখে, শিশুরা সুর করে পড়া শেখে- অ তে অজগর, আ তে আম…।

‘আচ্ছা, এমন হলে কেমন হতো- চাঁদের আলো খাওয়া যেত মুড়ির মতো, হাতের মুঠোয় নিয়ে গলায় ঢেলে দেওয়া। অথবা আলোগুলো গ্লাসে ভরে লেবু মিশিয়ে হয়ে গেল শরবত। কিংবা এটাও তো হতে পারত- শরীর চুঁইয়ে পড়া সেই আলোতে ধুয়ে যাচ্ছে গ্লানি, দুঃখ-কষ্ট-বেদনা-সব।’

‘আমাদের আসলে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।’

‘আছে।’

‘আছে!’

‘আপাতত এই শহরের গলিতে, পিচঢালা কনক্রিটে কিংবা মন যেদিকে চায়, চোখ যতদূর তাকায়।’ পৌষি আরো একটু কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায় সাহিরের, ‘আমি কিন্তু বয়সে একটু বড়ই হবো আপনার।’ চোখ তুলে তাকায় সে, ‘হবো না? বয়সে বড় মেয়েরা কখনো প্রেমিকা হয় না, সচরাচর জীবনসঙ্গীও হয় না, গোপন ভালোবাসাবাসি হিসেবেও মানায় না তাদের। বরং বোন হিসেবে মানায়, বড় বোন। চলুন-।’ হাঁটতে থাকে পৌষি, ‘রিকশায় ঘুরতে ঘুরতে আপনাকে আজ এই শহরটা দেখাব, রাতের শহর; যে শহরে রূপের ব্যবসা হয় প্রতি রাতে, কিন্তু সে ব্যবসায় এক টুকরো ভালোবাসা নেই, ঠাঁই হয় না কোনও আকুতির- না মনের, না হৃদয় বৃত্তান্তের!’

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *