short-story-korun-rongin

করুণরঙিন
মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য

story-korunrongin-mriganka-bhattacharya

একটা সর্বভারতীয় ইংরেজি খবরের কাগজের দিল্লি ব্রাঞ্চে আমি সিনিয়র সাব এডিটর। সেন্ট্রালাইজড এসি অফিস। কাচের ওপাশের আকাশ দেখে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা আলাদা করে ঠাহর করা যায় না। ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এটা শরৎকাল। ক’দিন পরই পুজো। এখন থেকেই মন ছটফট করছে কলকাতা ফেরার জন্য। আমার মা নেই। বাবা সিওপিডি পেশেন্ট। মাঝেমধ্যেই নার্সিংহোমে ভর্তি করতে হয়। আগে অন্য একটা কাগজে ছিলাম। ক্যামাক স্ট্রিটে অফিস। বাড়ির ভাত খেয়ে অফিস যেতাম। বেশি স্যালারি আর পার্কসের লোভে এখানে জয়েন করেছি বছরখানেক হল। সুরশ্রী সল্টলেকের একটা বেসরকারি স্কুলে পড়ায়। রিন্টি ওই স্কুলেই ক্লাস এইটে পড়ে। আমার সঙ্গে দিল্লি আসতে গেলে সুরশ্রীকে চাকরিটা ছাড়তে হত। তা সম্ভব নয়। রিন্টিরও পড়াশোনার ক্ষতি হত। বয়স্ক ও অসুস্থ বাবাকে কলকাতায় একা ছেড়ে আসাটাও অসম্ভব ছিল।

বসন্ত বিহারে দু-কামরার একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকি। একজন পরিচারিকা সকালে এসে রান্না করে দিয়ে যায়। অফিস আর বাড়ি – এর বাইরে কোথাও যাওয়া হয় না। ছুটির দিন বেলা অবধি ঘুমোই। যে হাউজিং কমপ্লেক্সে থাকি তার প্রায় কাউকেই চিনি না। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গেও যোগাযোগ নেই। তবে আজকের দিনটা অন্যরকম। কেননা ঠিক এই মুহূর্তে আমার মুখোমুখি বসে আছে আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধু ফারহা চৌধুরি। ঠোঁটে সামান্য হাসি। বলল, তোকে খুঁজে খুঁজে ঠিক চলে এসেছি এখানে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড অনায়াসে চাকরি দিতে পারে আমাকে। কী, পারে না?

ফারহার জলপ্রপাতের মতো চুল ছিল সে সময়। চুলের সেই বিস্তার কমেছে। গমের মতো গায়ের রং তামাটে হয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে। একসময়ের উজ্জ্বল চোখের তারাদুটো নিষ্প্রভ। তখন ছিপছিপে ছিল, এখন সামান্য মুটিয়েছে। পাহাড়ি ঝর্ণার মতো ফারহা এখন যেন হেমন্তের শান্ত নদী। নদীর কথায় মনে হল সময় নিজেই তো এক বহতা নদী। অতীত থেকে বয়ে এসে বর্তমানকে ছুঁয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যতের দিকে। ফারহার সঙ্গে শেষ কবে দেখা হয়েছিল আমার? বছর চব্বিশ হবে। সময়নদী উজিয়ে দেখলাম পুরনো অনেক মুখই আবছা হয়ে গেছে স্মৃতির পর্দায়। অথচ ফারহার সঙ্গে কাটানো প্রতিটা পল অনুপলই রয়ে গেছে আমার মগজের ভেতর। মানুষ যা ভুলতে চায় তা সহজেই ভুলে যায়। যা ভুলতে চায় না অবচেতন মন সেই স্মৃতি যত্ন করে তুলে রাখে নিজস্ব তোরঙ্গে। ফিলাটেলি নিয়ে আগ্রহী মানুষ যতটা প্যাশন নিয়ে ডাকটিকিট জমায় ঠিক তেমনি করে ফারহার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো আমি জমিয়ে রেখেছি আমার নিজস্ব অ্যালবামে। আমি হেসে বললাম, আলবাত পারে।

ইউনিভার্সিটিতে আমাদের স্ট্রিম ছিল ইতিহাস। দুজনই ছাত্র রাজনীতি করতাম। ক্লাস বাংক করে পোস্টার লিখতাম আমরা। ক্যামপেন করতে বেরোতাম দল বেঁধে। আলাপ নিবিড় হল। জানতে পারলাম ফারহার বাড়ি ভগবানগোলায়। ওর আব্বা মেহরুদ্দিন চৌধুরি সিটিং এমএলএ। ওর দাদাজান বদরুদ্দিন চৌধুরিও বিধায়ক ছিলেন। ফারহার প্রপিতামহ ছিলেন জমিদার। এখনও বিঘা কে বিঘা বিঘা দো-ফসলি চাষের জমি আছে ওদের। ধানের মিল আছে। তেলকল আছে। বহরমপুরে হোটেল আছে। আরও কী কী ব্যবসা আছে কে জানে। ওর দুই দাদা সেসব দেখভাল করে। ফার্ন রোডে ওর রিলেটিভের বাড়ি। সেখানে থেকে ফারহা ইউনিভার্সিটি যাতায়াত করত।

এক বাংলা ব্যান্ডকে আনা হয়েছিল সোশালে। তাদের স্টেজ ছেড়ে দেওয়ার আগে অতিথি বরণ, বিশিষ্টদের ভাষণের পর ছাত্রছাত্রীদের নাচ-গান ইত্যাদির জন্য বরাদ্দ ছিল ঘণ্টাখানেক। কালচারাল সেক্রেটারি রোহিণী খবর দিল, ফারহা নাকি দুর্দান্ত গান গায়। নাম করা এক ওস্তাদের কাছে গান শেখে। সাধতে হল না, একবার বলতেই ফারহা রাজি হয়ে গেল। সেদিন ও পরেছিল ধানি রঙের শাড়ি। গলায় ডোকরার গয়না। রবীন্দ্রনাথের যে গানটা ফারহা গাইল সে গানটা আগে শুনিনি – ‘মোর পথিকেরে বুঝি এনেছ এবার করুণরঙিন পথ। এসেছে এসেছে অঙ্গনে, মোর দুয়ারে লেগেছে রথ। সে যে সাগরপারের বাণী মোর পরানে দিয়েছে আনি, তার আঁখির তারায় যেন গান গায় অরণ্য পর্বত।’

কী সুরেলা গলা! কী দীপ্ত উচ্চারণ! সুর তাল লয় একটুও নড়চড় হচ্ছিল না। সকলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল। আমি ভাবছিলাম করুণ আর রঙিন এই দুটো শব্দকে পাশাপাশি কী ভেবে বসালেন রবি ঠাকুর? ফারহা ততক্ষণে এসে পড়েছে গানের সঞ্চারীতে। ‘দুঃখ সুখের এপারে, ওপারে, দোলায় আমার মন – কেন অকারণ অশ্রুসলিলে ভরে যায় দু’নয়ন। … ওগো নিদারুণ পথ, জানি জানি পুন নিয়ে যাবে টানি – তারে চিরদিন মোর যে দিল ভরিয়া যাবে সে স্বপনবৎ।’

রবীন্দ্রনাথের গান যতবার শোনা যায় প্রতিবারই শ্রোতার কাছে ভিন্ন অর্থ বয়ে আনে। এই গানে যেমন সঞ্চারীতে এসে ‘করুণরঙিন পথ’ বিশেষণ পেল ‘নিদারুণ পথ’। কেন তা জানি না। কিন্তু এটুকু জানি যে, সেই সন্ধে আমার সর্বনাশ করে দিল। আমি পা থেকে নখ পর্যন্ত প্রেমে পড়লাম ফারহার। মনে হল আমার জন্মই হয়েছে এই মেয়ের জন্য। কিন্তু ওকে সে কথা বলার মতো বুকের পাটা আমার ছিল না। ফারহা জমিদার বংশের মেয়ে। দুজন বেড়ে উঠেছি সম্পূর্ণ আলাদা পরিমণ্ডলে। আমি বামন, চাঁদ দূর থেকে দেখাই আমার পক্ষে মঙ্গল।

ফারহা ক্লাসের সকলের সঙ্গে সহজভাবে মিশত। ক্যান্টিনে আমরা আড্ডা দিয়েছি বিস্তর। কখনও সদলবলে, কখনও শুধু দুজনে। সাহিত্য, সিনেমা, খেলাধুলো, রাজনীতি, যৌনতা – হেন কোনও বিষয় নেই যা নিয়ে আমরা আলোচনা না করতাম। আমাদের গড়িয়ার বাড়িতেও ফারহা এসেছে কয়েকবার। তবে আমার জন্য ওর কোনও বিশেষ অনুভূতি আছে বলে মনে হয়নি কখনও। ওর কাছে আর পাঁচজন বন্ধুর মতো আমিও ছিলাম এমন একজন বন্ধু যাকে ভরসা করা যায়। ব্যস এটুকুই। তাই ফারহার প্রতি যে আমি দুর্বল হয়ে পড়ছি ক্রমশ, হৃৎপিণ্ডের সেই ধুকপুকুনিটুকু নিজের বুকের ভেতরেই আমি রেখে দিয়েছিলাম সঙ্গোপনে।

আমাদের এক্সকারশানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল দিল্লিতে। উঠেছিলাম একটা ধর্মশালায়। ছেলেরা ডরমিটরিতে, মেয়েরা আলাদা আলাদা ঘরে। চার দিন ধরে দিল্লির যা কিছু দ্রষ্টব্য সব ঘুরে দেখলাম আমরা। আগ্রা গিয়ে তাজমহলও দেখে আসা হল। যেদিন ফিরব তার আগের রাতে ফারহা বলল, কাল ভোরবেলা বুলবুলি খানের গলিতে যাব। তুই কোম্পানি দিবি আমাকে? আমি বললাম, সেখানে কী আছে? ফারহা মৃদু তিরষ্কার করে বলল, ওরে হাঁদাকান্ত, সুলতানা রাজিয়াকে কবর দেওয়া হয়েছিল বুলবুলি খানের গলিতে। দিল্লি এসে সেখানে যাব না একবার? আমি বললাম, বুঝলাম। কিন্তু একটু বেলার দিকে গেলে হয় না? ফারহা বলল, দুপুরে ফেরার ট্রেন। যেতে হলে ভোরেই যেতে হবে।

পরদিন ধর্মশালা থেকে যখন দুজন বেরিয়ে এলাম তখনও সূর্য ওঠেনি। জামা মসজিদের আজান শেষ হয়েছে একটু আগে। নিস্তব্ধতা ভেঙে কানে আসছিল ভিস্তিওয়ালার ভিজে পায়ের ছপছপ শব্দ, পাশ দিয়ে চলে যাওয়া গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ, ভাঙাচোরা বাড়িগুলোর কার্নিশে বসে থাকা পায়রাদের বকমবকম শব্দ, সহিসের ছ্যাকরায় ঘোড়া জোতার শব্দ, কোনও বৃদ্ধের অশক্ত হাতে কয়লা ভাঙার শব্দ। উত্তর কলকাতার সরু গলি দেখেছি কিন্তু এমন ঘিঞ্জি গলি কখনও দেখিনি। পুরনো আমলের বাড়িঘর কোমর বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সরু পথের দু-দিকে। পাশাপাশি হাঁটছিলাম আমরা। ফারহার গা থেকে আমার নাকে ভেসে আসছিল আতরের মিষ্টি গন্ধ। আমি বললাম, এই রাস্তার নামটা এমন অদ্ভুত কেন?

ফারহা বলল, এককালে বুলবুলির লড়াই হত এই গলিতে। আকাশে তারা থাকতে মানুষজন এসে ভিড় করত পরদিন বুলবুলির লড়াই দেখবে বলে। ধুম পড়ে যেত মহল্লায়। এখন এই রিকেট রুগির মতো গলিটাকে দেখে সেটা আন্দাজ করা যায় না। তবে বুলবুলির লড়াই আর না হলেও পায়রা ওড়ে এখনও। আর ওড়ে ঘুড়ি।

আশেপাশেই কোথাও মাছবাজার। মেছো গন্ধ আসছে। ভনভন করছে মাছি। একটা পান-সিগারেটের দোকান থেকে সিগারেট কিনলাম। মাথায় ফেজ পরা একজন দাঁড়ানো সেই দোকানে। আমি সিগারেট ফুঁকছিলাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে। খানিক বাদে রাস্তায় নেমে এল ফারহা। এক নিঃশ্বাসে বলল, ওই ফাঁকা জায়গাটাই রাজিয়ার কবরখানা। আয়, পা চালিয়ে আয়।

শীতের সকাল। প্রকাণ্ড লাল বলের মতো সূর্যটা স্থির হয়ে ছিল পুব আকাশে। উজ্জ্বল টাটকা রোদে আরাম লাগছিল। সমস্ত শরীর দিয়ে সূর্যের আরক শুষে নিচ্ছিলাম আমরা। ফারহা বলল, প্রায় আটশো বছর ধরে যিনি এখানে শুয়ে আছেন যিনি একদিন স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন মানুষকে। মাত্র চার বছর মসনদে বসেছিলেন সুলতানা রাজিয়া। বুকে তির বিঁধে হরিয়ানার কারনালে তিনি চোখ বুজেছিলেন। সেটা ১২৪০ সাল। কে, কীভাবে তাঁকে নিয়ে এসেছিল এই গলিতে তা কেউ জানে না। যেমন জানে না, রাজিয়ার ঠিক পাশের কবরটা তাঁর মাত্র বারো দিনের বিবাহিত জীবনের জীবনসঙ্গী ভাটিন্ডার রাজপাল আলতুনিয়ার কি না!

আমি বললাম, দিল্লির মসনদে বসা প্রথম নারী যদি ইলতুতমিসের মেয়ে হন রাজিয়া, প্রথম আধুনিকাও তো তিনি। ক্রীতদাসের বংশধর সেই নারী মানুষকে আলোকিত করতে চেয়েছিলেন শিক্ষায়, শরীরে, চেতনায়। অথচ তাদেরই ষড়যন্ত্রে প্রাণ দিতে হয়েছিল তাঁকে। এর চাইতে বড় ট্র্যাজেডি আর হয় না।

ফারহা বলল, যার থেকে সিগারেট কিনলি তার নাম আনোয়ার আলি। চার মেয়ের কেউই স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি। দুজন বিয়ের পর তালাক নিয়ে ফিরে এসেছে আব্বার ঘরে। বেপর্দা বাইরে বেরোবার কথা তারা ভাবতেই পারে না। ওই যে ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন ওই দোকানে উনি ডাক্তার সিদ্দিকি। এই গলির মুখে চেম্বার। তিনিও রাজিয়ার নামটুকু ছাড়া বিশেষ কিছু জানেন না। অথচ ইলতুতমিস নিজের ছেলে নয় তাঁর মেয়ের মধ্যে দেখেছিলেন সেই সম্ভাবনা যিনি প্রজাকে দেবেন সুশাসন। সিংহাসনে ইলতুতমিস বসলেও দেশ চালাত চল্লিশজন আমির। ইসলাম নারীকে শাসনের অধিকার দেয়নি এই অজুহাতে ইলতুতমিসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল তারা।

আমি বললাম, ইতিহাসের সেই অধ্যায়ের কথা জানি। ইলতুতমিসের বিবি শাহ তুরকান ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন। পুত্র রুকনুদ্দিনকে বঞ্চিত করে সুলতান শাসন ক্ষমতা তুলে দেবেন কন্যা রাজিয়ার হাতে? তা হয় নাকি! আমিরদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মদ্যপ ও ব্যভিচারী পুত্র রুকনুদ্দিনকে মসনদে বসালেন তিনি। শুরু হল রাজিয়াকে হত্যার ষড়যন্ত্র। রাজিয়াকে মরতেও হয়েছিল তার ফলে।

আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে ফারহা আচমকা বলল, তুই কি পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাস করিস?

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, না, করি না। হঠাৎ এই প্রশ্ন?

ফারহা বলল, আমি বেদান্ত পড়েছি। সেখানে বলছে আমাদের সংস্কার, বিশ্বাস, আদর্শ, কিংবা নীতি আমরা জেনে বা না জেনে ধারণ করি চৈতন্যের মধ্যে। সেগুলো বীজের আকারে রয়ে যায় আমাদের অবচেতনে। তা জমা হয় আমাদের অন্তঃকরণে। মৃত্যুবীজ শরীরে নিয়ে জন্মাই আমরা। কিন্তু এই যে বেঁচে থাকার সময়টা, এর মধ্যেই সুখ দুঃখ, হাসি, কান্না, প্রেম আর অপ্রেম জারিত হচ্ছে আমাদের মধ্যে। তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে প্রত্যাশা, ইচ্ছা, বাসনা, কামনা, অপ্রাপ্তি, হতাশা। এই সব অনুভূতির বেশির ভাগটাই গেঁথে যাচ্ছে আমাদের মনের ভেতর। এই জন্মে আমরা প্রায় কেউই তার সবটা হয়তো অনুভব করতে পারছি না। কিন্তু অবচেতনের গভীরে তা থেকে যাচ্ছে। আত্মা যদি অবিনশ্বর হয়, চির শাশ্বত থাকে, তবে তা বয়ে আসে পরের জন্মে। আমি এমনটাই মনে করি।

আমি বললাম, তোর কথায় আমার গীতার সেই পঙক্তির কথা মনে পড়ে গেল। যেখানে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন, হে অর্জুন, তুমি ও আমি উভয়ে বহুজন্ম অতিক্রম করে এসেছি। কিন্তু তা সত্বেও তোমার সঙ্গে আমার পার্থক্য থেকেই যাবে। আমি পূর্ব পূর্ব জন্মের কথা সমস্তটাই স্মরণ করতে পারি। তুমি পার না।

ফারহা বলল, একজ্যাক্টলি। ইতিহাসের অনেক চরিত্রই আমাকে হন্ট করে। তবে তার মধ্যে আমার সবচাইতে পছন্দের ক্যারেকটার রাজিয়া। আগের কোনও জন্মে হয়তো আমিই ছিলাম সুলতানা রাজিয়া। নইলে তাঁর প্রতি আমার এমন টান থাকবে কেন ! কী হল হাঁদার মতো হাসছিস যে?

আমি হেসে বললাম, ত্রিকালদর্শী বলে আমার খ্যাতি নেই। তোর পাস্ট লাইফের কথা জানি না। তবে এটা মানি যে, রাজিয়া বেঁচে থাকলে আমাদের দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাস অন্যরকম হত।

ফারহা আনমনা গলায় বলল, কারনালের মাঠে মাত্র বারো দিন আগে বিয়ে হওয়া স্বামী আলতুনিয়ার সঙ্গে মিলে রাজিয়া যখন গিয়াসুদ্দিন বলবনের বিরুদ্ধে করছেন, তখনই বুকে তির গেঁথে তাঁর মৃত্যু হয়। আমিরের সৈন্যরা চার টুকরো করে ফেলেছিল রাজিয়ার দেহ। শেষ শ্বাস বেরিয়ে গিয়েছিল আলতুনিয়ারও। কেউ বলে কারনালেই সমাধি দেওয়া হয়েছিল রাজিয়াকে। কেউ বলে খণ্ডিত দেহ নিয়ে আসা হয়েছিল দিল্লির জামা মসজিদের কয়েকশো গজ তফাতে এই গলিতে। শুধু এই কারণে যে, প্রজারা জানুক আধুনিকা ও মুক্তমনা রাজিয়াদের কী পরিণতি হতে পারে।

রাজিয়ার শ্রীহীন কবরটার দিকে ফারহা তাকিয়ে ছিল এক দৃষ্টে। আত্মমগ্ন হয়ে উচ্চারণ করছিল – Weep not for her! Her memory is the shrine / Of pleasant thoughts, soft as the scent of flowers. / Calm as on windless eye the sun’s decline. / Sweet as the song of birds among the bowers. / Rich as rain with its hues of light / Pure as the moonshine of an autumn night. / Weep not for her!

কলকাতা ফিরে এলাম আমরা। তখন বাজারে সদ্য মোবাইল ফোন এসেছে। ফোন করতে তো বটেই কল রিসিভ করতেও গাঁটের কড়ি খসাতে হয়। ফারহা ব্যাগে ঢাউস একটা ফোন নিয়ে ক্লাসে আসত। কদাচিৎ ফোন করতে দেখতাম ওকে। ফোন রিসিভই শুধু করত। সবই বাড়ির লোকজনের ফোন। সেবার ফারহা বাড়ি ফিরে যাবার পর বেশ কিছুদিন হয়ে গেল ওর কোনও খোঁজ নেই। দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। হলটা কী? শরীর খারাপ হল না তো? একদিন দুঃসাহস ভর করল। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে একটা এসটিডি বুথে ঢুকলাম। ফোন করলাম ওর নম্বরে। ফারহা নয়, ফোন ধরলেন অন্য কেউ। ওর মা-ই হবেন খুব সম্ভব। খটখটে গলায় বললেন, আর ইউনিভার্সিটি যাবে না ও।

এসটিডি বুথের বিল মিটিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি আকাশ কালো করে এসেছে। ক্লান্ত পায়ে ফিরে আসছিলাম। বাসে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। হাঁটছিলাম রাস্তা দিয়ে। গলায় কষ্টের দলা। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল। একটু পরে বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেল। আমি ভিজছিলাম হাঁটতে হাঁটতে। আমার চোখের জল মিশে যাচ্ছিল বৃষ্টির জলের সঙ্গে। এখন দু-যুগ আগের সেই কালো বিকেলটার কথা মনে পড়ছিল। চব্বিশ বছর কেটে গেছে। এখন আমার সামনে বসা ফারহার চুলে রুপোলি ঝিলিক। বয়স আর অভিজ্ঞতা ওকে উপহার দিয়েছে অস্তগামী সূর্যের সৌন্দর্য। সূর্য ডুবে যাওয়ার পরও পশ্চিম আকাশ অনেকক্ষণ তার লালিমা ধরে রাখে বুকে। এও তেমন। ফারহা বলল, ছুটির পর একটু সময় দিবি আমাকে? দিল্লি এসে বুলবুলি খানের গলিতে একবার যাব না তা কি হয় নাকি? যাবি তো আমার সঙ্গে?

আমি চোখ বড় বড় করে বললাম, আবার সেই ঘিঞ্জি গলি! গোটা দিল্লিতে আর কোনও জায়গা খুঁজে পেলি না তুই?

অফিস থেকে বেরোলাম। লিফটে আমার পাশে ফারহা। ওর শরীর থেকে ভেসে আসছিল সেই চেনা আতরের গন্ধটা। আমার মনের আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছিল অজস্র রঙিন প্রজাপতি। স্মৃতির অতল থেকে বুজকুরি কেটে ভেসে ওঠা সেই শীতের সকালটার কথা মনে পড়ে গেল। সেই মুহূর্তগুলির ঘ্রাণ আজও আমি বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুরি। সে কথা ফারহা জানে না। জানার কথাও নয়।

জামা মসজিদ থেকে খানিক দূরে গাড়িটা রাখলাম। দু-একজন পথচারীকে জিজ্ঞেস করলাম। কেউই গলিটার নাম শোনেনি। ইতস্তত হাঁটছি। গলিটা কি হারিয়ে গেল? একটা সরু রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালাম হতোদ্যম হয়ে। ফারহা আমার কনুইয়ে খোঁচা দিল। ওর চোখ অনুসরণ করে দেখি বহু পুরনো একটা দোতলা বাড়ি। নিচতলায় ওষুধের দোকান। রং জ্বলা সাইনবোর্ডে ঝুলছে বাইরে। কোন কোন ডাক্তার এখানে চেম্বার করেন তার ফিরিস্তি। ডক্টর সিদ্দিকির নামও দেখি আছে। ফারহা উত্তেজিত গলায় বলল, এই তো সেই গলি!

চব্বিশ বছরে দিল্লি আগাপাশতলা বদলে গেলেও এই গলিটা একই রকম আছে। সরু ঘিঞ্জি গলি দিয়ে যেতে যেতে আটকে গিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে একের পর এক রিক্সা। পাশ কাটিয়ে এগোচ্ছি দুজন। একজন বোরখা পরা মহিলা হেঁটে যাচ্ছিল। ফারহা হিন্দিতে রাজিয়ার কবরটা কোথায় জিজ্ঞেস করল। মহিলা ইশারা করল আঙুল উঁচিয়ে। দু-কদম এগিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। দিল্লির আর পাঁচটা দেখনাই কবর বা স্থাপত্যের সামনে রোজগারের যে পথ খোলা থাকে রাজিয়ার কবরে তা নেই। দেখলে মনে হয় খটখটে শুকনো কুয়োর ওপর সিমেন্টের পাতা বিছানো। একদিকে লোহার গরাদ দেওয়া দরজা। আগের বার এসে এমন দেখিনি। কয়েকটা ছেলে গুলি খেলছিল। তাদের জিজ্ঞেস করে জানলাম জুয়ারিদের উপদ্রব ঠেকাতে এই দরজা লাগানো হয়েছে। বাইরে দুটো ফলকে রাজিয়ার সংক্ষিপ্ত জীবনী। হিন্দি ও ইংরেজিতে। ফারহা জিজ্ঞেস করল, রাজিয়ার নাম শুনেছিস তোরা?

ছেলেগুলো ওর দিকে তাকিয়ে থাকল ফ্যালফ্যালে চোখে। ফারহা আমার উদ্দেশে বলল, আমি রাজিয়ার কথা ভাবি। কী অদ্ভুত একটা জীবন! কত অল্পদিন বেঁচেছেন কিন্তু কত গভীর ছাপ ফেলে গেছেন সকলের মনে। প্রবল জনসমর্থন সঙ্গে নিয়ে রাজিয়া উঠে বসেছিলেন দিল্লির মসনদে, তাঁকে হত্যার সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে। রাজিয়া তাঁর পূর্বসূরিদের মতো ছিলেন না। প্রজা হিসেবে হিন্দু মুসলমান ব্যবধান তিনি মুছে দিয়েছিলেন। গোঁড়া আমির উমরাহদের বুঝিয়েছিলেন সাম্রাজ্য রক্ষায় মুসলমানদের মতোই তরোয়াল ধরতে প্রস্তুত হিন্দুরাও। তাই হিন্দুদের ওপর থেকে জাজিয়া কর তুলে দেওয়া জরুরি। তাঁর আমলে আবশ্যিক করে তোলা হল নারী শিক্ষা। প্রজার মনের কথা জানতে রাজিয়া চলে যেতেন তাদের কাছে। তিনি জানতেন হিন্দু মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে না পারলে দেশ শাসন করা হবে কঠিন কাজ।

আমি বললাম, সেটাই হয়েছিল তাঁর কাল। উলেমারা ক্ষোভে ফেটে পড়ল, চটল আমিররাও। প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ জুনাইদি রাজিয়াকে বললেন, সুলতানা, আপনার পিতার আমলে আপনি পুরুষের সঙ্গে এভাবে মিশতেন না। ওড়নায় ঢাকা থাকত আপনার মুখ। আর এখন আপনি প্রজাদের মাঝখানে বেপর্দা চলে যান।

ফারহা বলল, ঠিক তাই। রাজিয়া বুঝলেন তাঁর প্রগতিশীলতা মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে ধর্মীয় গোঁড়ামির। রাজিয়া জুনাইদিকে বললেন তখন আমি ছিলাম শাসক পিতার কন্যা। এখন শাসিকা। প্রজাদের সঙ্গে দূরত্ব রাখতে পারি না আমি। আমি প্রজাদের রক্ষাকর্ত্রী। আমার প্রজারা মুসলমান বা হিন্দু নয়, তারা সবচাইতে আগে মানুষ। তখন জুনাইদি রাজিয়াকে বললেন ইসলাম নারীকে রক্ষা করতে বলে এসেছে, কারণ নারী হল দুর্বল। রাজিয়া স্মিতমুখে বললেন, নারী মোটেই দুর্বল নয়। সঙ্কীর্ণ মনের পুরুষ পর্দার আড়ালে থাকতে বলে নারীকে। পাপ তাদের চোখে। নারী নয় আসলে সঙ্কীর্ণ মনের পুরুষদেরই পর্দার আড়ালে থাকার প্রয়োজন। ইসলামকে বিকৃত করছেন এই সব পুরষেরা। পয়গম্বর নারীকে অবগুণ্ঠনের আড়ালে থাকতে বলেননি। হতাশা ও কষ্ট থেকে নারীর মুক্তির পথের কথা বলেছেন। পয়গম্বরের স্ত্রী আয়েশার উদাহরণ দিয়ে রাজিয়া বললেন তিনি প্রয়োজনে সৈন্য পরিচালনা করেছেন। তাঁর কন্যা ফাতিমা আরব দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন। নাতনি সাকিনা কারবালার প্রান্তরে খোলা তরোয়াল নিয়ে লড়াই করেছেন। কাজেই ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে যুগযুগান্ত ধরে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে বাধা দিলে ইতিহাস আপনাদেরই ইসলাম বিরোধী বলবে, নারীকে নয়।

আমি আক্ষেপের গলায় বললাম, এমন একজন প্রগতিশীল মননের নারী আটশো বছর আগে জন্মেছিলেন ভেবে আশ্চর্য হতে হয়। হিন্দু মুসলমান সব ধর্মের মানুষেরই সমর্থন ছিল তাঁর পেছনে, তবুও রাজিয়াকে প্রাণ দিতে হয়েছিল আমির আর উলেমাদের ষড়যন্ত্রে। এর চাইতে বড় ট্র্যাজেডি আর হয় না।

একটা পকোড়ার দোকানে এলাম আমরা। অল্পবয়সি দোকানিকে ফারহা জিজ্ঞেস করল, এই গলিতেই তো রাজিয়ার কবর। তাঁর কথা কিছু জানো? পকোড়াওয়ালা আমাদের প্রশ্ন উপেক্ষা করে মন দিয়ে মাখতে থাকল বেসন। আমাদের পাশে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোক। পাশে বোরখা পরা এক ভদ্রমহিলা। বোধ হয় তাঁর স্ত্রী। তিনি ভুরু তুলে বললেন, কে রাজিয়া?

ফারহা তাঁকে সংক্ষেপে বোঝাতে লাগল রাজিয়া অত বছর আগে কীভাবে বদলাতে চেয়েছিলেন মানুষের মন, মুসলিম সমাজের আরোপিত প্রথাগুলো। রাজিয়ার সংক্ষিপ্ত কাহিনি শুনে ভদ্রমহিলা কানে হাত ঠেকিয়ে বললেন, বেশরম! পাগল না হলে কেউ এমন কাজ করে!

আমি পকোড়ার টাকা মিটিয়ে ফারহাকে বললাম, কফি তেষ্টা পেয়েছে। চল, কোনও ফুড জয়েন্টে গিয়ে কফি খাই।

গলির বাইরে বেরিয়ে এসেছি। বড় রাস্তায় একটা কাফেটারিয়া। ফাঁকাই আছে। ভেতরে ঢুকে কফি অর্ডার করলাম। ফারহা বলল, বুলবুলি খানের গলিটার কথা ভাবছি শুধু। রাজিয়ার সঙ্গে এত বছর ঘর করেও গলিটা এক কদমও এগোয়নি। শিক্ষার আলো এখানে এসে পৌঁছয়নি আজও। আটশো বছর আগের প্রথম আধুনিকা, প্রথম প্রগতিশীল নারীর চারপাশ লেপ্টে আছে করুণতম ছবি হয়ে। জামা মসজিদ দেখে যেসব টুরিস্ট লাল কেল্লায় ঢুকে যায়, বুলবুলির গলিতে তারা পা ফেলে না। কূপমণ্ডূক হয়ে আছে এই মহল্লার মানুষজনও। বাহ্যিক সৌন্দর্য শুধু নয় অন্তরের বোধেও ফারাক রয়ে গেছে বিস্তর। আজও মুক্তমনা মানুষের নীতিবোধ টপকে এগিয়ে চলে গোঁড়ামির জেদ। অথচ একেই তো ঘৃণা করতে শিখিয়েছিলেন রাজিয়া। আসলে রাজিয়া কোনও বিশেষ সময়ের নয়, রাজিয়া অনন্তকালের।

কফি দিয়ে গেল। কাপে একটা চুমুক দিয়ে ফারহা বলল, সোশাল মিডিয়ায় তোকে আমি অনেক খুঁজেছি। পাইনি।

আমি বললাম, সোশাল মিডিয়ায় অ্যাকাউন্ট নেই আমার। আমি প্রাইভেট পার্সন। ব্যক্তিগত জীবন পাবলিক করতে রাজি নই। আমার কথা ছাড়। তোর কথা বল। কী করছিস আজকাল?

ফারহা হাসল, লিভারপুলে থাকি। একটা আর্ট গ্যালারির সঙ্গে যুক্ত। সেই সংক্রান্ত কাজেই দুদিনের জন্য দিল্লি আসা। পরশু চেক ইন করেছি হোটেলে। গতকাল দৌড়ঝাঁপ গেছে। তবে ফরচুনেটলি দুদিনের কাজ একদিনেই হয়ে গেল। আজ ফ্রি। সকালে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলাম। একটা পোস্ট এডিটোরিয়ালে চোখ আটকে গেল। লেখকের নাম দেখে গাট ফিলিং হচ্ছিল এটা তুই হতে পারিস। ট্যাক্সি ধরে চলে এলাম তোর অফিসে। তুই দিল্লিতেই থাকিস নিশ্চয়ই? ফ্যামিলি?

আমি বললাম, বসন্ত বিহারে থাকি। বউ আর মেয়ে থাকে কলকাতায়।

কফির কাপে আঙুল বোলাচ্ছে ফারহা। দুই হাতের নখগুলো দেখছে মন দিয়ে। মুখ তুলল। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে দুর্জ্ঞেয় হাসি। জিজ্ঞেস করল, একটা কথা বলি? সেই যে আমি ভগবানগোলা চলে গেলাম দুম করে, ফিরলাম না আর, তুই আমার খোঁজ করেছিস কখনও?

– তোর মোবাইলে ফোন করেছিলাম একদিন। তোর মা জানালেন তোর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আমি গলায় নকল হতাশা ফুটিয়ে বললাম, ভেবেছিলাম নেমন্তন্ন করবি। কবজি ডুবিয়ে তোর বিয়ের ভোজ খাব। সেই সাধ আর পূরণ হল না।

ফারহা বলল, শুধু তোকে নয় কোনও বন্ধুকেই ইনভাইট করতে পারিনি। বিয়েটা হয়েছিল হুট করে। আমার বরের নাম নবাব শেখ। বহরমপুরে বাড়ি। ইঞ্জিনিয়ার। লিভারপুলে অফিস। সত্যি সত্যিই নবাব বংশের রক্ত বইছে ওর শরীরে। বিয়ের পর আমি লিভারপুর এলাম। নবাব সকালে কাজে বেরিয়ে যেত, রাতে ফিরত। আমি সারাদিন ঘরে বসে বোর হতাম। চাইছিলাম কোনও জব করতে। নবাবের সায় ছিল না। ও বলত তোমার কী চাই বলো, আমি এনে দিচ্ছি। মেয়েদের কাজ ঘরে, বাইরে নয়। বাইরের পৃথিবী আনসেফ। হায়না আর হাঙররা বসে আছে দাঁতনখ বের করে।

আমি শুনছি চুপচাপ। কফির কাপে চুমুক দিয়ে ফারহা বলল, একটা নেলপলিশ বা লিপ্সটিক কিনতে হলেও হাত পাততে হত ওর কাছে। ইচ্ছে করত না। আমি চেয়েছিলাম আত্মনির্ভর হতে। বাড়িতে কাগজ আসত। বিজ্ঞাপন দেখে মার্ক করে রাখতাম। নবাবকে না জানিয়ে ওয়াক ইন ইন্টারভিউ দিতে থাকলাম একের পর এক। ছ’বারের বার ভাগ্য ক্লিক করল। চাকরি জুটল একটা প্যাথল্যাবে। রিসেপশনিস্টের কাজ। নবাব অফিস চলে যাবার পর কাজে বেরোতাম, বিকেলের মধ্যেই ফিরে আসতাম বাড়িতে। একদিন সব জেনে ফেলল নবাব। তুমুল অশান্তি হল। কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে আমার গালে সপাটে চড় বসাল ও। কেউ আমার গায়ে কখনও হাত তোলেনি। আঁতে লাগল খুব। সেই রাতে কিছু খেলাম না। অনেক ভাবলাম। আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন এক ল’ইয়ার। দুদিন বাদে তাঁর অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিলাম। ফোন করে সব জানালাম বাড়িতে।

আমি বললাম, তোর বাড়ির লোক কীভাবে রিয়্যাক্ট করল?

ফারহা বলল, আমার দুই দাদা আঁতকে উঠল সব শুনে। বলল ডিভোর্স কেস ফাইল করলে চৌধুরি বংশের সুনাম নষ্ট হবে। আম্মি রেগে গিয়ে বলল এমন কাণ্ড করলে আমার সঙ্গে ওরা কোনও সম্পর্ক রাখবে না। কিন্তু আমি নিজস্ব উপার্জনের স্বাদ একবার পেয়েছি। চাকরি কি আর অত সহজে ছাড়ি! কেস ফাইল করলাম। নবাব অ্যাডভোকেটের চিঠি পেয়ে এত অবাক হল যে বলার নয়। চোয়াল শক্ত করে আমাকে বলল পরদিন সকালেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে। পরদিনই পেয়িংগেস্ট হিসেবে উঠে এলাম মিসেস ব্রাউন নামে আমাদের মহল্লারই এক বৃদ্ধার বাড়িতে। গ্রসারি শপে যাতায়াত করতে করতে আমাদের আলাপ। ওঁর স্বামী মারা গিয়েছিলেন ফকল্যান্ডের যুদ্ধে। ছেলেমেয়ে নেই। কয়েক মাস সেপারেশনের পর মিউচুয়াল ডিভোর্স হয়ে গেল আমার আর নবাবের। বছর ঘুরে গেল। সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে নবাবের অ্যাকাউন্ট ছিল। আলাদা হয়ে যাওয়ার পরও দুর্মর কৌতূহলে ওকে স্টক করতাম। একদিন ওর পোস্ট করা ছবি দেখে জানলাম নবাব ওর এক কলিগকে বিয়ে করেছে। আমার ভেতরটা পুড়ে ছারখার হয়ে গেল।

আমি বললাম, তারপর?

ফারহা বলল, লিভারপুল আর্ট গ্যালারির নামযশ আছে। নানা দেশের টুরিস্ট আসে দেখতে। তার ম্যানেজারিয়াল বোর্ডের কর্তা ড্যানি গর্ডন। ড্যানি যখন মায়ের কোলে তখন ওর বাবা মারা গিয়েছিলেন ফকল্যান্ডের যুদ্ধে। মিসেস ব্রাউনের সঙ্গে ড্যানি দেখা করতে আসতেন মাঝেমধ্যে। আমার সঙ্গে হাই হ্যালো হত। একদিন বললেন একজন রিসেপশনিস্ট চাইছেন তাঁরা। মিসেস ব্রাউন আমার নাম রেকমেন্ড করলেন। ড্যানি বললেন ইন্টারভিউ দিতে। দিলাম। আমাকে পছন্দ হল ওঁদের। প্যাথল্যাবে যা পেতাম তার অনেক বেশি স্যালারি দিয়ে ওঁরা অ্যাপয়েন্ট করলেন আমাকে। অফিস সেক্রেটারির পোস্ট। কয়েক বছর কাটল। মিসেস ব্রাউন মারা গেলেন বয়সজনিত কারণে। ওঁর আত্মীয় বলতে দূরসম্পর্কের এক ভাইঝি। ম্যানচেস্টার সিটির এক হসপিটালের হিস্টোপ্যাথলজিস্ট। সে এল মৃত্যুসংবাদ পেয়ে। আমাকে বলল আমি ইচ্ছে করলে মিসেস ব্রাউনের বাড়িতেই যতদিন খুশি থাকতে পারি। তাঁর আপত্তি নেই।

আমি বললাম, তুই যে কথাটা তখন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলি এবার সেই প্রশ্নটা আমিও তোকে করি? তুইও আমাকে কখনও ফোন করিসনি। আমাদের বাড়ির ল্যান্ডলাইন নম্বর তুই জানতিস না?

ফারহা বলল, না, সত্যিই জানতাম না। নইলে তোকে অন্তত জানাতাম কী ঝড় যাচ্ছিল আমার ওপর দিয়ে। আমাদের বাড়ির নিচতলাটা ছিল বিধায়ক কার্যালয়। আব্বা বাড়িতে থাকলে সেখানে বসতেন রোজ। তিনি আমার দুই দাদাকে বলেছিলেন পালা করে সেখানে বসে মানুষের সমস্যার কথা শুনতে। তার সুরাহা করতে। কেননা এই প্রান্তিক মানুষগুলো তাঁর আপনজন। সে সময় রাজনৈতিক কারণে আব্বা বেশ কিছুদিন টানা ছিলেন কলকাতায়। আমি মাঝেমধ্যে এমএলএ হোস্টেলে গিয়ে দেখা করে আসতাম তাঁর সঙ্গে। সেখানে বসেই আব্বা জানতে পারলেন তাঁর দুই ছেলে কার্যালয়ে তো বসছেই না তারা আব্বার ব্যবসার টাকাও যথেচ্ছ সরাচ্ছে তাদের বিবিদের কুপরামর্শে।

একটু পজ দিয়ে ফারহা বলল, আমার দাদাজান বদরুদ্দিন চৌধুরি ছিলেন নরম মনের মানুষ। প্রজারা এসে কেঁদেকেটে পড়লে তিনি খাজনা মাফ করে দিতেন। এলাকায় দিঘি খনন করিয়েছিলেন, তৈরি করেছিলেন স্কুল। আমার আব্বার দুই বিয়ে। প্রথম পক্ষের বিবির নাম সালমা। সুন্দরবন এলাকায় বাড়ি। পারিবারিক মাছের ভেড়ির ব্যবসা। আমার বড় আম্মির দুই ছেলে মেহরাজ আর মেহতাব। বড় আম্মিকে বিয়ে করার কয়েক বছর পর এক অনুষ্ঠানবাড়িতে গিয়ে সুন্দরী এক তরুণীকে দেখে আব্বার মাথা ঘুরে যায়। শাবানা নামে গরিব ঘরের সেই মেয়েকেই তিনি শাদি করেন। তিনিই আমার আম্মি। আমার যখন চার বছর বয়স মুখে রক্ত তুলে আম্মি মারা যান। আব্বা ছোটবউকে নেকনজরে দেখতেন। বড় আম্মির তা সহ্য হত না। ভগবানগোলায় এক বুড়ি ছিল, শ্মশানে বটগাছতলায় থাকত, তন্ত্রমন্ত্র জানত। সাদা জট পাকানো চুল, ঢিলে হয়ে যাওয়া চামড়া, জ্বলজ্বলে দুটো চোখ। ময়লা একটা সাদা থান পরে থাকত। আমরা বলতাম ডাইনিবুড়ি। কানাঘুষো শুনেছি আম্মিকে মারার জন্য ডাইনিবুড়িকে টাকা খাইয়েছিলেন আমার বড় আম্মি।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, বলিস কী!

ফারহা বলল, বড় আম্মি ভোগী স্বভাবের মহিলা। তিনি আব্বাকে বোঝাতেন আদর্শ ধুয়ে জল খেলে হবে না। জীবনটাকে উপভোগ করার জন্য টাকা রোজগার করতে হবে। আরও টাকা। আমি তখন খুব ছোট, সেরিব্রাল স্ট্রোকে মারা যান বদরুদ্দিন চৌধুরি। বাই ইলেকশন হয়। আব্বাকে প্রার্থী করে দল। বিপুল ভোটে জেতেন আব্বা। তাঁর ক্ষমতা বাড়ে। বাড়ে প্রভাব প্রতিপত্তি। কিন্তু সেই সময় থেকেই মৃত্যুর ছায়া পড়ে চৌধুরি বংশে। কয়েক মাস পর মুখে রক্ত তুলে মারা যান আমার আম্মি। তাঁর মৃত্যুর পর বড় আম্মির প্ররোচনাতে একের পর এক ব্যবসা বাড়িয়ে চলেন আব্বা। ধানের মিল, তেলকল, হোটেল …। ততদিনে বড় হয়ে গেছে আমার দুই দাদা। তারা সামলাতে শুরু করেছে আব্বার ব্যবসা।

নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে ফারহা বলল, আমার আব্বা কোনও সন্ত বা পির নন, ভালমন্দ মেশানো একজন মানুষ। সাদা টাকার পাশাপাশি কালো টাকাও ঢুকেছে তাঁর আলমারিতে। কিন্তু পরে তাঁর অনুতাপ হয়েছে। বাঁকা পথে আসা আয়ের একটা বড় অংশ দান করেছেন বিভিন্ন সামাজিক কাজে। আমি যখন কলেজে পড়ি সেবার হজ করতে মক্কা গিয়েছিলেন আব্বা। ফিরে এসে বাড়ির সবাইকে ডেকে বললেন তিনি এখন থেকে রাজনীতি নিয়েই থাকবেন। লড়াই করবেন সাধারণ মানুষের অধিকারের জন্য। তাঁর ব্যবসা সামলাবে তাঁর দুই ব্যাটা। তবে কোনও অসৎ পন্থা নয়, সততার সঙ্গে ব্যবসা করতে হবে। লভ্যাংশের চল্লিশ শতাংশ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে তারা দুজন। বাকি ষাট শতাংশ ব্যাংকে জমা করতে হবে আব্বা, বড় আম্মি ও আমার নামে।

আমি বললাম, তারপর?

ফারহা বলল, দুই ছেলের কাঁধে ব্যবসার ভার চাপিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন আব্বা। কিন্তু যখন জানতে পারলেন দুই ছেলে তাঁর বিশ্বাস ভেঙেছে তিনি কলকাতা থেকে ফিরে এলেন বাড়িতে। তলব করলেন দুজনকে। হিসেব চাইলেন ব্যবসার। বললেন কোনও গরমিল ধরা পড়লে তাঁর ব্যবসা এবার থেকে সামলাবে তাঁর মেয়ে। মেয়ের ওপর তাঁর অগাধ ভরসা। তাছাড়া তাঁর বয়স হচ্ছে। তিনি হাইকমান্ডের সঙ্গে কথা বলবেন, পরের ইলেকশনে মেয়েকে প্রজেক্ট করবেন এই সিট থেকে। মাথায় বাজ পড়ল সকলের। বড় আম্মি বোঝাতে গেলেন আব্বাকে। কিন্তু ভবী ভুলবার নয়। দুই দাদা তখন মোক্ষম তাস ফেলল। আব্বাকে চুপিচুপি জানাল, তারা জানতে পেরেছে যে, ইউনিভার্সিটির এক বিধর্মী ছেলের সঙ্গে ফারহার প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তার বাড়িতে ফারহার যাতায়াতও আছে। এখনও রেজিস্ট্রি হয়নি, যে কোনওদিন সেই অঘটন ঘটে যেতে পারে। এরপর সেই বেয়াদব মেয়েকে কী করে ভরসা করেন আব্বা! আমার বিরুদ্ধে এত সব ষড়যন্ত্র যে চলছে কলকাতায় বসে আমি তার কিছুই টের পাইনি।

শিউরে উঠলাম আমি। কেন তড়িঘড়ি ফারহা মুর্শিদাবাদ চলে গিয়েছিল এবার ধরতে পারলাম। ফারহা বলল, আব্বা, বড় আম্মি আর আমি থাকলাম বন্ধ ঘরের ভেতর। আমার সম্বন্ধে যেসব কথা তাঁর কানে এসেছে আব্বা সব বললেন। থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলেন, এই কথা কি সত্যি ? আমি চোখ নামিয়ে থাকলাম একটুক্ষণ। মিথ্যে কথা বলতে শিখিনি। কাঁপা গলায় বললাম, আমি একজনকে ভালবাসি। যদিও সে আমাকে ভালবাসে কি না আমি জানি না। জিজ্ঞেস করিনি কখনও।

আমি স্তম্ভিত হয়ে শুনছিলাম। অসহ্য কষ্টে আমার হৃৎপিণ্ড যেন ফেটে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল। ফারহা আমাকে কখনও বলেনি তো কিছু! কেন বলেনি? ফারহা বলল, সারাটা দিন থম মেরে থাকলেন আব্বা। রুদ্ধশ্বাসে আমরা যেন প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সন্ধেবেলা ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হল আব্বার। ভর্তি করা হল নার্সিংহোমে। সে রাতেই মৃত্যু হয় তাঁর। আব্বার মৃত্যুর পর আমি বাড়িতেই থাকতাম চুপচাপ। এক বছরের মাথায় আমার বিয়ে হয় নবাব শেখের সঙ্গে। ততদিনে উপনির্বাচন হয়ে গেছে। আব্বার সিট থেকে দাঁড়িয়ে বড় আম্মি জিতেছেন বিপুল ভোটে। ব্যবসা নিয়ে আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে দুই দাদা।

এত কিছু ঘটনা যে ঘটে গিয়েছিল আমি তার বিন্দুবিসর্গও জানতাম না। আমি মাস্টার্স করার পর চাকরি জুটিয়ে নিয়েছিলাম মিডিয়া হাউজে। তার পর বিয়ে করে সংসারী হয়েছি। এর মধ্যে তিনটে চাকরি ছেড়ে আর ধরে এখন আছি এক সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকের দিল্লি ব্রাঞ্চে। সেখানেই আজ ফারহার সঙ্গে দেখা।

আমি ড্রাইভ করছিলাম। পাশে ফারহা। ওর গায়ের চেনা আতরের গন্ধটা ভেসে আসছিল আমার নাকে। আমি স্টিয়ারিংয়ে একটা মোচড় মারতে মারতে বললাম, তুই আর বিয়ে করিসনি?

ফারহা বলল, মিসেস ব্রাউনের বাড়িতে যখন একা থাকতাম তখন মাঝেমধ্যে ড্যানি গর্ডন দেখা করতে আসতেন। ওঁর স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন লাং ক্যানসারে। কোনও ইস্যু ছিল না ওঁদের। ওঁর সঙ্গে গল্প হত চা কফি খেতে খেতে। আমার অনুরোধে কয়েকবার ডিনার করেও ফিরেছেন। সংযম, সততা, নিষ্ঠা, নীতির প্রতি আনুগত্য – সবরকম গুণ ছিল ড্যানির চরিত্রের মধ্যে। খাঁটি ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায় ড্যানি ছিলেন তাই। আমি ওঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। অফিস সেক্রেটারির চাকরিটা তো ওঁর জন্যই পেয়েছিলাম। কিন্তু তার সুযোগ কখনও নিতে চাননি ভদ্রলোক। ইংরেজদের আবেগ কম থাকে। তাঁর মনে কী চলছিল আমি টের পাইনি। আমাকে অবাক করে দিয়ে ড্যানি প্রোপোজ করলেন একদিন।

ফারহার হোটেল প্যাটেল নগরে। সেদিকে এগোচ্ছি। ওকে নামিয়ে আমি ফিরব বসন্ত বিহারে। ফারহা বলল, সেদিন আমি রাজি হইনি। সামনের দিনগুলোর ছবি তখন আমার কাছে ছিল একেবারেই ঝাপসা। আমি সময় চেয়েছিলাম। ড্যানি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছিলেন। এর পরও আমার ডেরায় এসেছেন, কিন্তু দ্বিতীয়বার একই কথা জিজ্ঞেস করে বিড়ম্বনায় ফেলেননি। আমি অনেক ভেবে সিদ্ধান্তে এসেছিলাম। মনে হয়েছিল একা একটা লম্বা জীবন কাটানোর চাইতে একবার ঝুঁকি নিয়ে দেখা যেতেই পারে। রিস্কটা নিলাম অবশেষে। জুটি বাঁধলাম দুজন। বছর দুয়েক বাদে দুই থেকে তিন হলাম আমরা। আমাদের ছেলে আট বছরে পড়েছে এবার। খুব দুষ্টু। কাল রাতে ফ্লাইট। পরশু লিভারপুল পৌঁছব। ছেলেটাকে দেখার জন্য মনটা বড্ড ছটফট করছে।

আমি সুরশ্রীকে বিয়ে করেছি, রিন্টি এসেছে আমাদের জীবনে, অথচ ফারহা বিয়ে করে সুখী হয়েছে জেনে আমার মন কেন মেঘলা হল জানি না। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললাম, রবীন্দ্রনাথের সেই গানটা শোনাবি? যে গানটা ইউনিভার্সিটির সোশালে গেয়েছিলি?

ফারহা অস্পষ্ট হাসল। বিনা ভূমিকায় ধরল – ‘মোর পথিকেরে বুঝি এনেছ এবার করুণরঙিন পথ। এসেছে এসেছে অঙ্গনে, মোর দুয়ারে লেগেছে রথ। সে যে সাগরপারের বাণী মোর পরানে দিয়েছে আনি, তার আঁখির তারায় যেন গান গায় অরণ্য পর্বত।’

উইন্ডোগ্লাসের ওপাশে ভেসে যাচ্ছে দিল্লির আলো ঝলমলে তীব্র ও আধুনিক জীবন। ফারহার খালি গলার গান শুনতে শুনতে আমি ভাবছিলাম করুণ আর রঙিন এই দুটো শব্দকে পাশাপাশি কী ভেবে বসালেন রবি ঠাকুর ? শোক, বিষাদ আর দুঃখের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে আনন্দ। করুণরঙিন পথ ধরে এসেছে যে-পথিক, সে নতুন ঝলমলে জীবনের বার্তা নিয়ে এসেছে। পথই তার মানে এখানে কর্তা ও কর্ম। জীবনের এই পথই যে বিষাদচেতনাকে দূরে সরিয়ে নবীন উৎসবকে ডেকে আনতে পারে সে কথাই কি বলতে চাওয়া হয়েছে এই গানে?

ফারহা ততক্ষণে এসে পড়েছে সঞ্চারীতে। ‘দুঃখ সুখের এপারে, ওপারে, দোলায় আমার মন – কেন অকারণ অশ্রুসলিলে ভরে যায় দু’নয়ন। … ওগো নিদারুণ পথ, জানি জানি পুন নিয়ে যাবে টানি – তারে চিরদিন মোর যে দিল ভরিয়া যাবে সে স্বপনবৎ।’

রবীন্দ্রনাথের গান প্রতিবারই শ্রোতার কাছে ভিন্ন অর্থ বয়ে নিয়ে আসে। এই গানে সঞ্চারীতে এসে ‘করুণরঙিন পথ’ বিশেষণ পেল ‘নিদারুণ পথ’। কিন্তু কেন? এই পথই একদিন ছিন্ন করে দেবে আত্মশ্লাঘা ভরা দিনগুলোকে, আনবে নতুন উদ্বেগের দোলাচল। সেই পথ নিদারুণ বলেই কি বরণীয়? হয়তো তাই। কেননা জীবন থ্রিলারের চাইতেও উত্তেজনাময় আর আকর্ষণীয়। ফারমা গান শেষ করে বলল, কী ভাবছিস?

আমি বললাম, আগে জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করতাম না। আজকাল ভাবি পূর্বজন্ম পরজন্ম যদি সত্যিই থেকে থাকে, আত্মা যদি সত্যিই অবিনশ্বর হয়, সে যদি শুধুই কাঠামো বদল করে চির শাশ্বত থেকে যায়, তাহলে সেই আত্মার অন্তরে সঞ্চিত সংস্কারও থেকে যায়। কে জানে হয়তো বাহিত হয় পরের জন্মে। ফেলে আসা জীবনের সুপ্ত কিংবা সঞ্চিত সংস্কার বা বিশ্বাস জেগে ওঠে। মিশে যায় চারিত্রিক আচরণে। রাজিয়ার প্রতি তোর এত টান কিসের তা ভাবতে গিয়ে এসবই আমার মনে হল।

আমার ডান হাত স্টিয়ারিংয়ে। আমার বাঁ হাত নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে ফারহা। মনে হচ্ছে এই মুহূর্ত বুঝি সত্য নয়। একটু বাদেই ফুরিয়ে যাবে এই মায়াবী মুহূর্তগুচ্ছ। যাকে ছাড়া এক মুহূর্তও বাঁচতে পারব না বলে মনে হত একদিন সেই নারীকে ছাড়াই দিব্যি বেঁচে আছি। সময়ের ঘূর্ণনে সেই নারী এখন আমার পাশে বসা। ফারহার উষ্ণ করতলের স্পর্শে মোমের মতো গলে যাচ্ছিল আমার ভেতরটা। ভুলে যাওয়া গানের মতো সেই অমোঘ পঙক্তি উচ্চারণ করতে লাগলাম ধীর স্বরে – Weep not for her! Her memory is the shrine / Of pleasant thoughts, soft as the scent of flowers. / Calm as on windless eye the sun’s decline. / Sweet as the song of birds among the bowers. / Rich as rain with its hues of light / Pure as the moonshine of an autumn night. / Weep not for her!



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

7 thoughts on “short-story-korun-rongin

  1. খুব ভাল লাগল গল্পটা। ইতিহাস আর কল্পনার মিশেল মন ছুঁয়ে গেল।

  2. খুব ভালো লাগলো। এই সময়ের অন্যতম এক সেরা লেখকের গল্প পড়ার আনন্দ পেলাম।

  3. করুণরঙিন গল্পটি নিয়ে পাঠ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সহলেখক রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায়। সুখালোচনা নয় এমন গঠনমূলক সমালোচনার জন্যই অপেক্ষা থাকে একজন লেখকের যা প্রাণিত করে তাঁর কলম। রাজেশের পাঠ প্রতিক্রিয়াটি এখানে রাখলাম।

    “প্রিয় লেখক,

    ‘করুণরঙিন’ পড়ে উঠলাম। এক অনাবিল শব্দের মাঠ, ইতিউতি ঘাস আছে, কোথাও আছে ঘাসহীন উঁচুনিচু, সবকিছু মিশিয়ে গড়ে ওঠা এক আদ্যন্ত নিপাট প্রান্তর, যেখানে খেলে যায় হাওয়া, রোদ, মেঘছায়া …

    আপনার সব গল্পের মতই এখানেও নিটোল গল্পের প্রিয় শৈলী রয়েছে। রয়েছে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মোচড়, তারা এতটাই মৃদু যে সযত্ন পাঠ ছাড়া উপেক্ষিত হয়ে যেতেই পারে, আর তাহলে গল্পের চেহারাটি স্পষ্ট হয় না। গল্পের প্রোটাগনিস্ট যখন ভাবছে -“আমি সুরশ্রীকে বিয়ে করেছি, রিন্টি এসেছে আমাদের জীবনে, অথচ ফারহা বিয়ে করে সুখী হয়েছে জেনে আমার মন কেন মেঘলা হল জানিনা।”…

    ওঃ মৃগাঙ্কবাবু! লাভলি! এই যে মানসিকতার আনাচকানাচে আপনার কলমের আলো গিয়ে পড়ছে, আর পাঠকের সামনে আয়না হয়ে প্রতীয়মান হয়ে উঠছে, এই ‘মুখোমুখি বসিবার’ অনুভূতিই তো একটি পাঠ থেকে প্রাপ্তি!

    আর এই মেঘলা হওয়ার উদযাপন করতে চাইল মন। মুখের ভাষায় অনুরোধ ধ্বনিত হল সেই গানটি শুনতে চাওয়ার, যে গান গায়কীর অনুপম কারুকাজে ভালোলাগা ছাড়িয়েও আরও ভেতরের দিকে চলে গিয়েছিল একদিন। যে গান জিজ্ঞাসার জন্ম দিয়েছিল একদিন, যার নিবৃত্তি হয়নি। এই রহস্যমাধুর্যে স্ট্যাচু হয়ে থাকা সময়ের শরীরে প্রাণসঞ্চার করতে ইচ্ছে হল, ইচ্ছে হল যাচাই করে নিতে সুরের প্লাবনে আজও কতটা অথৈ!

    কেন!

    কারণ যে দুটি সত্তা চিরকালীনের আধারে বিক্ষিপ্ত হয়েছে বিপ্রতীপে, তাদেরও যে একত্রিত হওয়ার আসঞ্জনটুকু মিথ্যে ছিলনা, এ যেন দুজনেই পরখ করতে চাইল, নিজের কাছে নিজের জবাবদিহির এই অপাবৃত আঙিনায় যে আলো এসে পড়ল, তা কি কোনও অংশে কম ঐশ্বরিক!

    এতক্ষণ যে কথাগুলো বলা হল, এর সমান্তরালেও গল্পের আরেকটি প্রবাহ রয়েছে – ফারহার সুলতানা রাজিয়া সম্পর্কে কৌতুহল। তথ্যসমৃদ্ধ এই অংশটুকুতে গল্পের ধ্রুপদী বিস্তার যেন মনে পড়িয়ে দেয় সেই বিখ্যাত কলমকে, যাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলি বাংলা সাহিত্যের অমর আখ্যান হয়ে আজও জাগরুক। কিন্তু তাঁর দিশা অনুসৃত না হয়েও, আপনার মৌলিকত্বের সম্ভ্রান্ত প্রতিফলন প্রতীয়মান হল নিজস্বতায়।

    নিছক ইতিহাসের ছাত্রী হিসেবে সুলতানা রাজিয়াকে নিয়ে ফারহার কৌতুহল নয়। এ বোঝার জন্য আপনার শব্দপথ বরাবর পাঠককে এগোতে হয়। নবাবের সঙ্গে ফারহার ডিভোর্স, বাড়ির সঙ্গে বিরোধ, বাবার সামনে দাঁড়িয়ে অন্তরীণকে উন্মুক্ত করে দিতে পারা – এই সবই কি সেই মহীয়সীর প্রতিভূ নয়? ফারহা কি নিজেকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে?

    এই অনন্য সমাপতন গল্পের অন্যতম চরিত্র হয়ে উঠেছে। আর ফারহার স্টেটমেন্টে বেদান্তের ব্যাখ্যা…আপনার স্টাইল সত্যি একান্তভাবে আপনারই!

    David Macbeth Moir-এর কবিতাটির এমন আশ্চর্য প্রয়োগ, জাস্ট চমকে দিল। একবার ফারহার উচ্চারণে এবং আরেকবার কথকের নিজের উচ্চারণে কবিতাটির দ্বিজত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে। আঙ্গিক একই রেখে সম্পদের এই বহুরূপতা …আহা!

    এবার গল্পের কয়েকটি অপছন্দের জায়গা বলি? প্লীজ অন্যভাবে নেবেন না। এ আমার একান্তই ব্যক্তিগত উপলব্ধি :-

    ১। “লখনউ গিয়ে তাজমহলও দেখে আসা হল।” – টাইপো? কিন্তু এডিটিং-এরও অবধারিত ত্রুটি।

    ২। “আমার চোখের জল মিশে যাচ্ছিল বৃষ্টির জলের সঙ্গে।” – বহুব্যবহারে জীর্ণ এ প্রয়োগ আপনি কেন করবেন, প্রিয় লেখক! আপনি তো আপনার ঐশ্বর্যেই সম্পন্ন!

    ৩। “এর চাইতে বড় ট্র্যাজেডি আর হয়না।” – এই পুনরুক্তি গল্পের দুর্বল অংশ। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে রবীন্দ্রনাথের গানটিতে ‘করুণ’ ও ‘রঙিন’ শব্দদুটির একত্র ব্যবহার নিয়ে বিস্ময়েরও পুনরুক্তি ঘটেছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে গানটি প্রত্যেকবার শ্রবণে ধরা দিলেই এই সন্ধিৎসা-ঋদ্ধ হয়ে ওঠা যেন এক শাশ্বত খোঁজেরই নামান্তর, অথচ উল্লিখিত লাইনটির দ্বিরুক্তি সেই এফেক্ট নিয়ে আসছে না।

    আপনার লেখা পড়তে পাওয়ার জন্য কেন মুখিয়ে থাকি জানেন? পাঠশেষ রাজকীয়তার এ আবেশ, এ বড় অভিজাত!

    ভালো থাকবেন।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *