short-story-kusumir-panchali

কুসুমির পাঁচালি
হামিরউদ্দিন মিদ্যা


বট গাছটার বয়স কত, তা বলার মতো এখন আর কোনো মানুষ বেঁচে নেই। শুলুকপুর আর মজলিনগরের মাঝখানে যে বাসস্ট্যান্ড, তার পাশেই কোন যুগ ধরে ডাল-পালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। পাশ দিয়ে বইয়ে গেছে দামোদরের পেট থেকে বেরিয়ে আসা দক্ষিণের ক্যানেলটা। দুর্গাপুর টু বিষ্ণপুর সড়কটা ক্যানেলকে ক্রশ করেছে সামনেই। ফলে পুলটার কাছে বাসগুলো গর্জন করে এসে থামলে, দু-ধারের কয়েকটি গ্রামেরই যাত্রী পেয়ে যায়।

বটতলার পাশে রাস্তার ধার ঘেঁষে কুসুমির চা-পানের দোকান। মাঠের আলপথ ধরে হেঁটে হেঁটে যাত্রীরা বাস ধরতে এলে, বটতলার বাঁধানো বেদীতে বসে অপেক্ষা করে। কেউ হাঁক পাড়ে, কুসুমি একটা চা দিয়ে যা তো। কুসুমি চা দিয়ে আসে। কেউ বলে,কুসুমি একটা বিনা খয়েরের পান সাজ তো। কুসুমি পান সাজে।

খদ্দের না থাকলে একা চুপটি করে হাঁটুতে মুখ নামিয়ে বসে থাকে কুসুমি। মা-বাবা কেউ তো নেই। এই দোকানটাই তার বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল। ক্যানেলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ইংরেজ আমলের নড়বড়ে পুলটার দিকে তাকালে বড় ভয় লাগে। ছ’চাকার গাড়ি গেলে ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্প হয় কুসুমির বুকে। যদি হুশ করে পড়ে যায়! সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়! তা হলে খাবে কী!

সকালের দিকে দোকান খোলার আগেই একবার আলু-ভাতে ফুটিয়ে নেয় কুসুমি। রাত্রে হাতে গড়া দু’-চারটে রুটি। মা তাকে ছোটতে রেখে মারা গেছে। তখন তার সবে ছ’বছর বয়স। মায়ের কথা মনে পড়লে চোখে জল আসে। রোগা-প্যাঁটকা কালো মেয়েটাকে তো তারপর বাবাই মানুষ করেছে।

বাপটা খেটে খেটে ধুঁকতো। কয়লা ভাঙা কাজ। নদীর ধারে হলধর সাহার ইঁটভাটায় কাজ করত। কুসুমি রান্না করে,খেয়ে-দেয়ে বাবার জন্য ভাত নিয়ে যেত। খিদে পেটে বাপটা রাক্ষসের মতো গক গক করে গিলত। বাবার খাওয়া দেখে খুব কষ্ট হত কুসুমির। বেচারি বাপটাকে ভালোমন্দ রেঁধে খাওয়াতে ইচ্ছে করে, কিন্তু পাবে কোথায়!

হলধর চেয়ারে বসে থাকত নদীর দিকে চেয়ে। তাঁর কত লোকজন কাজ করে। তাদের হাজরি, হিসাবপত্র সব খাতায় জমা করতে হয়। ইঁট বইতে কুসুমির মতো মেয়েরাও তাদের বাবা-মায়ের সাথে কাজ করে। একদিন হলধরের সামনে পড়ে গেল কুসুমি। হাতের ইশারায় ডাকল কুসুমিকে।

কুসুমির বুক দুরুদুরু। লোকটার চাউনি তার ভাল লাগে না।

কুসুমি যাবে, নাকি চোঁ করে দৌড় দেবে বুঝতে পারল না। ভয়ে ভয়ে কিছুটা তফাতে গিয়ে দাঁড়াল। —এত দূরে কেন খুকি! আমি কি বাঘ?

কুসুমি তবুও যায় না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

হলধর থুতনিতে হাত রেখে কুসুমিকে দেখে। তারপর বেশ গম্ভীর হয়ে বলে, বাপটা যে খেটে খেটে মরছে, আর তুই এত বড় মেয়ে হয়ে বসে বসে খাচ্ছিস! আমার এখানে কাজের অভাব? কাল থেকেই লেগে যাবি। তোকে হালকা কাজ দেব। জল বওয়াতেও হবে নি,ইঁট বওয়াতেও হবে নি। বলে খ্যাকখ্যাক করে হাসে হলধর।

কুসুমি বলল, কী কাজ?

—এই তো! তোরা আজকালকার ছেলেমেয়ে, একদম ধৈয্য নেই। মুখের ওপর বলিস কী কাজ!

কুসুমি ভাবে, বা রে! তুমি চাঁদু পটিয়ে পাটিয়ে কাজে লাগাবে, তারপর গোরুমোষের মতো খাটিয়ে মারবে! তোমার ধান্দা আমি বুঝি না ভাবছ? কিন্তু সেকথা আর প্রকাশ করে না কুসুমি। বলে, আমি যাচ্ছি। বাবা খিদে পেটে আছে।

এড়িয়ে চলে গেলেও হলধরের নজর কুসুমির থেকে সরে না। বাধ্য হয়ে বাবাকে একদিন জানাল কুসুমি।

কুসুমির বাবা বলল, ধুর খেপি! আমি থাকতে তুর কীসের চিন্তা? বেঁচে থাকতে ওই ঘোড়েল লোকের কাছে তুকে কাজে লাগাব নি।

— আমার যে ভয় করে বাবা। বুড়ো কেমন করে তাকায়!

—তুকে আর খাবার দিতে যেতে হবে না রে মা। আমি এসে খেয়ে যাব’খন।

কুসুমির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বাবা। মাকে ফিরে পায় কুসুমি। কখন যেন চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ে।

হলধর সাহা একদিন কুসুমির বাবাকে দিল কাজ থেকে তাড়িয়ে। কুসুমি আর যায়নি বলে সব সময় পেছনে লেগে থাকত। খিটখিটে মেজাজে চোখ রাঙিয়ে কথা বলত। সেদিন কাজে যেতে কুসুমির বাবার একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। শুধু এটুকুই অপরাধ।

কুসুমির বাবা তখন করবে কী! রোজগার না করলে খাবার জুটবে কোথা থেকে?

পাড়ার অনেকেই তখন কয়লা খাদানে কয়লা কুড়িয়ে আনত। পরিশ্রম থাকলেও রোজগার আছে। কুসুমির বাবাও যাওয়ার জন্য জেদ ধরল। মা-টা বেঁচে থাকতে বাবাকে কোনদিন খাদানে পাঠায়নি। কুসুমি কী করে যেতে দেবে!

বাবাকে বাধা দিয়েছিল কুসুমি, না বাবা, তুমি যেও না। শরীরে বল নাই তুমার। পারবে না বোঝ টানতে।

কুসুমির বাবা শোনে না। সাইকেলটা দোকানে ভালো করে সারিয়ে আনে। সান্ত্বনা দিয়ে বলে, তুই আমার কথা ভাবিস না রে মা। ভাটাতেই কি খাটালি কম হয়? নিজের ইচ্ছা মতো কাজ করব। কেউ চোখ রাঙিয়ে কথা বলবে না।

—কিন্তু বাবা,পুলিশে তাড়া করে যে! বরেনকাকা সাইকেল ছেড়ে দৌড় মেরে ছিল, মনে নাই?

—সবই মনে আছে। ও’রকম একটু আধটু ভয় তো সব কাজেই আছে। গাঁয়ের মানুষগুলো তো ওই করেই খাচ্ছে।

কুসুমির আর কোনো জারিজুরি খাটল না। বাবার সেই এক জেদ। খাদানেই গেল।

মাস ছয়েক তো ভালোই কাটল। সংসারের অবস্থা ফিরল। একদিন কুসুমির বাবা খেতে খেতে কুসুমিকে বলল, মা রে।হাতে কিছু টাকা জমেছে। সারাজীবন তো এই কাজ করার মতো শরীরে জোর থাকবেনি। তাই ভাবছি একটা দোকান-টোকান কিছু করব।

বাবার কথাটা মনে ধরে কুসুমির। বলে, হ বাবা, সেটাই ভালো হবে।

—বটতলার বাসস্টপে একটা দোকান দিব ভাবছি। যাত্রীরা নেমে চা-সিগরেট খাবে। একটু বসে জিরোবে।

—খুব ভালো চলবে বাবা। আমিও তোমায় সাহায্য করতে পারব।

কিছুদিন খাদানে যাওয়া বন্ধ করে কুসুমির বাবা রাত-দিন এক ভাবে খেটে বাঁশ-খুটি দিয়ে মাটির ঘর তুলল। শুধু ছাউনিটুকুই বাকি। অ্যাসবেস্টের ছাউনি করার ইচ্ছা। খড় দিয়ে কে এত বছর বছর ছাওয়াবে! কিন্তু তার জন্য আরও যে টাকা চাই। দেওয়াল তুলতেই সব শেষ!

কুসুমির বাবা বলল, আর কিছুদিন খাদানে গেলেই হয়ে যাবে মা। তুই দেখিস আর আমাদের এত কষ্ট থাকবে না।

—তাই যেন হয় বাবা।

বিকাল হলেই কুসুমির বাবা বাড়ি ফেরে। খাদান থেকে কয়লা কুড়িয়ে বাজারের আড়তে বেচে দিয়ে আসে। সেদিন বিকালে বাড়ি ফিরল না। কুসুমি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। তাদের গ্রামের কত্ত লোক সাইকেল নিয়ে পেরিয়ে গেল, কিন্তু তার বাবা এল না।

সন্ধে ঘনিয়ে আসছে। বাবা এখনও এল না কেন! ভয়ে বুকটা দুরুদুরু করে কুসুমির। গ্রামের যারা খাদানে যায়, তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ও কাকা, আমার বাবাকে দেখেছ?

—না তো! কেন আসেনি?

কুসুমি কেঁদে ফেলে। কুসুমির কান্না দেখে পাড়ার সবাই স্বান্তনা দেয়, কাঁদিস না মা। অপেক্ষা কর, তোর বাবা ঠিক চলে আসবে।

কুসুমির বাবা ফিরল না। দুইদিন বাদ ফিরল বাবার থ্যাঁতলানো পচা শরীরটা। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল কুসুমি। কাঁদল পাড়ার বৌ-ঝিরা। ধ্বস ছেড়ে চাপা পড়েছিল।

সহানুভূতি দেখিয়ে পাড়া-প্রতিবেশীরা দু’-চারদিন করে খাওয়াল কুসুমিকে। কিন্তু বারোমাস কে আর খাওয়াবে! ছেলে নয়, যে বড় হয়ে রোজগার করবে। এই মেয়ের বিয়ে দেওয়াও মুশকিল!

তখন পড়শিরা বলল, এক কাজ করি। কুসুমির বাবা যে দোকানটা তুলছিল, ওটা আমরা করে দিই। কুসুমি তুই পারবি না চালাতে?

কুসুমি মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ, সে পারবে।

সবাই চাঁদা তুলে কুসুমিকে দোকানটা করে দেয়।

পাড়াদিকে কুসুমি আর তেমন যায় না। শেষ বাস রাত ন’টার টিপ পর্যন্ত দোকান খোলা রাখতে হয়। তারপর এতদূরের পথ রোজ রোজ যাওয়া, আবার ভোর ভোর উঠে এসে দোকান খোলা শরীরে কুলায় না। তাই এখানেই থাকা-খাওয়া হয়। দিনদুপুরে লোকজন থাকে বলে তেমন অসুবিধা হয় না। শুধু ভয় হয় রাত্রে।

দোকানঘরের সামনের অংশটা বাঁশের খুটি পিটিয়ে খড়ের ছাউনি দেওয়া। বর্ষা-বাদলে খদ্দেররা একটা মাথা গোঁজার জায়গা পায়। ওই অংশটুকুতেই দোকানের জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখে কুসুমি। রাত্রে ঘরের ভেতর পার করে নেয়। ভেতরে কুসুমির একার সংসার। পলকা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সংসার। সংসার করার সাধ কুসুমিরও জাগে। কিন্তু কোন রাজপুত্তুর তাকে ঘোড়ায় চড়িয়ে নিয়ে যাবে? পণের টাকাই বা কে গুনবে!

পাড়ার স্যান্যাল কাকা একদিন কুসুমির দোকানে এসে অনেকক্ষণ গল্প করে গেল। কুসুমিকে বলল, দেখ কুসুমি, সারাটা জীবন তো এই ভাবে চলতে পারে না। ঘরসংসার হলে তবে একটু নিশ্চিন্তে থাকতে পারবি। আমি তেমন কোনো ছেলে পাই কিনা খোঁজ নিচ্ছি। যদি টাকা-পয়সার দরকার হয়, ভিটেটা তো রয়েছে।

কুসুমি মাথা নামিয়ে লজ্জায় দাঁড়িয়ে থাকে। ঠিকই তো, সেই যদি শ্বশুরবাড়ি চলে যায়, বাপের ভিটেটার আর দরকার কী! কুসুমি বলল, তুমি যা ভাল বুঝো কর কাকা।

স্যান্যাল কাকার মারফতেই দু-তিনজন পাত্রপক্ষ দেখে গিয়েছিল কুসুমিকে। কারও কোনো সাড়া পায়নি। কুসুমি নিজেও বুঝতে শিখেছে, কালো কুচকুচে দেখতে সে, বিয়ের বয়স পেরোতে বসেছে। সব জেনেশুনে কে নেবে? কোন রাজপুত্তুর এসে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে! কোন রাজপুত্তুর এল না কুসুমিকে নিয়ে যেতে, একদিন এল তিনটে অফিসার গোছের লোক। ছোট গাড়িটা বটতলায় দাঁড় করিয়ে নামল। একজন মোটাসোটা, ফরসা। পকেটে নোটবুক, কলম। ঘড়ি পরা হাতে দামী ফোন। লোকটার নির্দেশ মতো সঙ্গের দু’জন ফিতে ফেলল। সকাল থেকেই নড়বড়ে পুলটার মাপজোক চলল। রাস্তার ওপাশ থেকে ফিতেটা কুসুমির দোকান পেরিয়ে অনেকটা চলে এল এ মাথায়।

কুসুমির দোকানে কয়েকজন খদ্দের বসে ছিল। তারাও চা খেতে খেতে দেখল ওদের কান্ড-কারখানা। কিসব যন্ত্রপাতি দিয়ে ক্যামেরার মতো চোখে লাগিয়ে পরীক্ষা করছে।

এদিক ওদিক চাইতে চাইতে অফিসার গোছের লোকটা কুসুমির দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, ইয়ে দোকান কা মালিক কোন হ্যায়?

একজন খদ্দের কুসুমিকে আঙুল বাড়িয়ে দেখাল। লোকটা কুসুমিকে চোখ দিয়ে মাপল। তারপর বলল, ইয়ে দোকান-মোকান সোব জলদি হাটানা পড়েগা।

কুসুমি তেমন হিন্দি জানে না। ভয়ে ভয়ে বলল, কেন? হাটাব কেন?

—তুম পাগলি হ্যায় কিয়া! তুমহারা গার্জেন কো বোলাও।

একজন খদ্দের জানাল, এর কেউ নেই বাবু! বড়ই গরীব!

লোকটা এবার গর্জে উঠল, তো ম্যায় কেয়া করেগা? ও সোব বাত ছোড়। ইধার নয়া ব্যারেজ হোগা। রোড চওড়া হোগা। ইয়ে দোকান হাটানাই পড়েগা।

মাপজোক হলে কয়েকটা সাদা দাগ দিয়ে ওরা গাড়িতে চেপে চলে গেল।

সারারাত কুসুমির চোখে ঘুম এল না। এবার কী করবে সে? কত কষ্ট করে বাবা এই ঘরের দেওয়ালগুলো তুলেছে, এই দোকান চালু করার জন্য নিজের জীবন দিয়ে গেছে। এখন রাস্তা চওড়া হবে বলে দোকান তুলে দিতে হবে?

রাত হলে এক-দুদিন দোকানের আশেপাশে কারা যেন ঘোরাঘুরি করে। কুসুমি টের পায়, কিন্তু ভয়ে বাইরে বেরয় না। পলকা দরজা আগলে বসে থাকে। আজ আর কোনোকিছুই হারানোর ভয় নেই কুসুমির। পলকা দরজাটা ঠেলে বাইরে বেরল। চাঁদের আলো বটের পাতায় পিছল খেয়ে মাটিতে আলপনা আঁকছে।

এখন কত রাত কে জানে! আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল কুসুমি। তারা ঝলমলে রাত। ওই তারাগুলোর মাঝেই কুসুমি দুটি তারাকে খুঁজতে লাগল। ওই তো জ্বলজ্বল করছে। হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে।

সুড়সুড় করে বটগাছটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল কুসুমি। কাছে যেতেই কোথা থেকে মনেপ্রাণে শান্তি এসে বিরাজ করল। বেদিতে পা ঝুলিয়ে বসল সে। বাবার কোলে বসলে এমন শান্তি পাওয়া যেত। নিমেষেই মন থেকে দূর হয়ে গেল সমস্ত দুশ্চিন্তা,দুর্ভাবনা। কুসুমি ভাবল, ধুর! এতবড় আকাশের নীচে তার আবার থাকা-খাওয়ার চিন্তা!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *