short-story-loan

লোন
তন্ময় সরকার


ব্যাঙ্ক-ম্যানেজার সুবোধ ভদ্র এখন হাত কামড়াচ্ছেন। কারণ এই হাতেই তিনি এমন জালিয়াত আর ঠ্যাঁটা লোককে লোন অ্যালোট করেছেন! লম্বা এবং ব্রাইট কেরিয়ারে এত বড় ব্লান্ডার কখনও হয়নি।

বছর-খানেক আগে এক মার্চের দুপুরে স্যুটেড-বুটেড লোকটা ব্যাঙ্কে হাজির হয়েছিল। সুবোধবাবু কোনও জরুরি ফাইলে সই করছিলেন, ঘাড় তুলে তাকালেন, “কী চাই?”

“আপনার কী এমন আছে যা আমাকে দিতে পারেন? আপনার কাছে কিছু চাই না।” “আচ্ছা! তবে?”

“ব্যাঙ্কের কাছে চাই।”

ইন্টারেস্টিং! সুবোধবাবু বসতে বলার আগেই লোকটা ঘ্যাটাং করে চেয়ারে শব্দ করে বসে পড়ল।

“আপনার নাম?”

“বাঁকাচরণ দফাদার।”

“তা, ব্যাঙ্কের কাছে আপনার কী চাই?”

“লোন।”

“লোন নিয়ে কী করবেন?”

“ফুর্তি করব না নিশ্চয়ই।”

অদ্ভুত! সোজা কথা কি বলতে জানে না এই বাঁকাচরণ! শেষমেশ অনেক বাঁকা-কথার গলিঘুঁজি পেরিয়ে জানা গেল, বাঁকাচরণ তার প্রেসের জন্য একটা অফসেট প্রিন্টার-মেশিন কিনবে। প্রিন্টারের দাম চার লাখ। এবং পুরো টাকাটাই সে লোন চায়।

পোড়খাওয়া ব্যাঙ্ককর্মী সুবোধ ভদ্র, এ-রকম বারো ঘাটের কয়েকশো হাঙর-কুমিরকে ট্যাকল করে তবে ম্যানেজার হয়েছেন। বললেন, “পুরো টাকা লোন হবে না। আপনি কিছু দেবেন, ব্যাঙ্ক কিছু দেবে। আপনি কত দিতে পারবেন ভেবে কাল সেকন্ড হাফে আসুন। সঙ্গে আপনার কেওয়াইসি আর আইটি ফাইলটা নিয়ে আসবেন।”

পরদিন বাঁকাচরণ কাগজপত্র নিয়ে উপস্থিত হল। সুবোধবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “কত দিতে পারবেন?”

“আমার পারা না-পারা নিয়ে প্রশ্ন করার আপনি কে, মশাই? দিতে পারি আমি পুরোটাই। কিন্তু দেব না। দেব মাত্র কুড়ি হাজার,” ডাঁটের সঙ্গে বলল বাঁকাচরণ।

“হবে না,” গম্ভীর স্বরে বললেন সুবোধবাবু।

“মহা মুশকিল তো! লোন দেবে ব্যাঙ্ক, শোধ দেব আমি। আপনার এত অসুবিধে কোথায়?” বাঁকাচরণ যৎপরোনাস্তি বিরক্ত।

“দেখুন, যতই ব্যাঙ্ক আপনাকে লোন দিক, লোন অনুমোদন করার দায়িত্ব ব্যাঙ্ক আমাকে দিয়েছে। আর আমি যদি বুঝি যে, আপনি লোন শোধ দিতে পারবেন না, তাহলে আপনাকে এক-টাকাও লোন অ্যালোট করব না,” কয়েক সেকেন্ডের জন্যে কাগজপত্রের উপর চোখ বুলিয়ে নিলেন সুবোধবাবু, “পেপারস বলছে মাসে আপনার প্রায় লাখ খানেক ইনকাম। ঠিকই আছে। আচ্ছা… আপনার প্রেস সম্পর্কে কিছু বলুন, শুনি। কেমন সেট-আপ আপনার? ভবিষ্যতের বিজনেস-প্লান কী ভাবছেন?”

এ-সব জিজ্ঞেস করা দস্তুর। বুঝে নেওয়া যে, বরোয়ার-এর লোন শোধ দেওয়ার মানসিকতা এবং সামর্থ্য আছে কি না।

“আমাকে দেখে কি আপনার ভিখিরি মনে হচ্ছে? থাকি রাজপ্রাসাদে, আর বিজনেস করি মাল্টিন্যাশনালদের মতো। খুব ভাল প্রোস্পেক্ট আমার হাউসের। বুঝলেন!” টানটান উত্তর দিল বাঁকাচরণ।

উত্তর শুনে টানটান উঠে বসলেন ম্যানেজার। বুঝে গিয়েছেন, লোকটার এমন-ধারা কথা বলার ধাঁচ। বললেন, “না, আপনাকে ভিখিরি আমি মোটেই ভাবছি না। কিন্তু অ্যাট লিস্ট পঞ্চাশ হাজার আপনাকে দিতেই হবে। সাড়ে তিন লাখ টাকার লোন আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারব।”

সাড়ে বারো শতাংশো সুদের হারে বিজনেস-লোন পেয়ে গেল বাঁকাচরণ। মাসিক ইন্সটলমেন্ট আট হাজার।

দু’মাস পরে সুবোধবাবু নোটিশ করলেন, এক টাকাও শোধ হয়নি। তিনি একটি চিঠি ইস্যু করলেন বাঁকাচরণের প্রেসের ঠিকানায়।

তার পর আরও তিনমাস। বাঁকাচরণ কোনও মাসে শোধ দিয়েছে এক হাজার, কোনও মাসে পাঁচশো। এ তো মহা মুশকিল! একদিন ম্যানেজার অগত্যা বাঁকাচরণের প্রেসে হাজির হলেন।

শ্যাম মার্কেটে ঢুকে ডানদিকে সরু গলি। তার শেষ সীমানায় একটি লম্বা দোচালা। সেখানে দিনের আলোতেও ঝাপসা অন্ধকার। বাজারের জনৈক পান-বিড়ির দোকানদার জানালেন, এটাই নাকি বাঁকাচরণ দফাদারের প্রেস!

ভিতরে একটা ছন্নছাড়া বিশৃঙ্খলতা। একপাশে কাঠের খোপ-খোপ বাক্সে নানা সাইজের অসংখ্য ধাতব অক্ষর, অন্যপাশে একটা পুরনো ট্রেডিল মেশিন। চারদিকে ছড়িয়ে আছে কাঠের ব্লকে খোদাই করা : ‘অভিজাত বস্ত্র বিপনি’, ‘আমরা বাড়ি গিয়ে পর্দা লাগাই’ বা ‘আমাদের কোনও শাখা নেই’। আছে প্লিয়ারস, রেঞ্জ, কাগজের বাণ্ডিল, রং, ছাপা বিল-বই, বিয়ের কার্ড বা নেমন্তন্নের রাজকীয় মেনুকার্ড। এক কোণে ঋণের অর্থে ক্রয়কৃত সেই অফসেট প্রিন্টার, কালিঝুলি মাখা।

“আপনি না বলেছিলেন, দারুণ সেট-আপ আপনার, বিরাট প্রেস-ইউনিট! ডাহা মিথ্যে! পুরো ভুয়ো আইটি ফাইল দেখিয়ে লোন নিয়েছেন! দেখে তো বোঝাই যাচ্ছে একটাও এমপ্লয়ি নেই আপনার, নিজেই কোনওমতে চালান,” ম্যানেজার ঢুকেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন।

বাঁকাচরণের সর্বাঙ্গে নানা রঙের কালি মাখা, যেন এইমাত্র সে হোলি খেলে উঠেছে। একটা বিড়ি কানের কাছে নিয়ে ভাল করে ডলে ঠোঁটে গুঁজল সে। তার পর বিড়ি ধরিয়ে গাঢ় ধোঁয়া ছাড়ল। চোখ বুজে থাকল দু’সেকেন্ড। শেষে চোখ খুলে অতি অবজ্ঞা সহকারে বলল, “লেখাপড়া কিছু শেখেননি মশাই! একেবারে টুকলি করে পাশ, আর নির্ঘাত ঘুষ দিয়ে চাকরি!”

“কী যা-তা বকছেন! হিসেব করে কথা বলুন,” সুবোধবাবু রাগে ফুঁসছেন।

“ছোটবেলায় পড়েননি ‘নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা’? পড়েছেন কিনা?”

“হ্যাঁ, পড়ব না কেন? বিলক্ষণ পড়েছি।”

“তাই যদি পড়ে থাকেন, তাহলে আমি আপনার কাছে নিজের হাতে তৈরি ব্যবসার নিন্দে করে আসব— এই আশা করলেন কী করে? কমন-সেন্স নেই!”

ম্যানেজার বুঝলেন, এ-সব কথা বলে বাঁকাচরণ মূল বিষয় থেকে নজর ঘোরাতে চাইছে। তাই আসল কথা পাড়লেন, “বাজে কথায় কাজ নেই। আপনার কাছে ব্যাঙ্ক থেকে লাস্ট যে চিঠি এসেছে, সেটা বের করুন।”

বাঁকাচরণ অতি বিরক্ত হল, “আবারও বাচ্চা ছেলের মতো কথা!”

“মানে?”

“আরে সে কোথায় রেখেছি, তা কি আমার খেয়াল আছে!”

“এত জরুরি কাগজ আপনি গুছিয়ে রাখেননি?”

“নির্বোধের মতো প্রশ্ন! আপনার কাছে কাগজটা জরুরি হতে পারে, আমার কাছে জরুরি কি না সেটা আপনি কী করে জানলেন? দাঁড়ান, দেখি কোথায় আছে,” বলে বাঁকাচরণ এক কোনায় ঝাঁট দিয়ে জড়ো করা নোংরার মধ্যে থেকে কালি-ময়লা মাখা একখানা কাগজ তুলে সুবোধবাবুর হাতে দিল। কাগজটার দু’পাশে হিজিবিজি অক্ষরে নানান হিসেব লেখা।

“এ কী করেছেন!” কাগজ দেখে ম্যানেজারের ভিরমি খাওয়ার জোগাড়।

ঠিক সেই সময় একজন এক বান্ডিল লিফলেট নিয়ে প্রেসে ঢুকল। লোকটাকে দেখে মনে হল খুব রেগে আছে।

বাঁকাচরণ হুঙ্কার ছাড়ল, “আবার কী হল তোমার?”

রাগ আর ভয় মিশিয়ে লোকটা বলল, “না… আসলে… প্রিন্ট খুব ভাল হয়েছে, বাঁকাদা। কিন্তু একপাশ যে পুরো উল্টো ছেপে দিয়েছ! এর আগে কালো কালিতে বিয়ের কার্ড ছেপে দিয়েছিলে, শ্রাদ্ধর কার্ডে প্রজাপতি লাগিয়ে দিয়েছিলে, আমি ম্যানেজ করে নিয়েছিলাম। কিন্তু এবার কাস্টোমার আমার ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখিয়ে দেবে। তুমি আমার পয়সা ফেরত দাও তো বাপু। আমি অন্য কোথাও থেকে কাজ করিয়ে নিচ্ছি।”

বাঁকাচরণ ধমকে উঠল, “কোথায় উল্টো ছাপা হয়েছে, দেখি।”

লোকটা একটা লিফলেট এগিয়ে দিল। বাঁকাচরণ উল্টেপাল্টে দেখে বলল, “ঠিকই তো আছে।”

লোকটা লিফলেটটা ছিনিয়ে নিল, “কোথায় ঠিক আছে? এই দ্যাখো, উল্টো পাশে গেলেই লেখার মাথাটা নীচের দিকে!”

“কোন ইশকুলে পড়েছিস, ভাই? পৃষ্ঠা উল্টো করে ধরে বলিস কিনা লেখা উল্টো! আরে বাবা, যে-দিকে লেখার মাথা, সেই দিকটা উপরে ধরেই তো পড়বি, নাকি? নির্বোধ!”

লোকটা ঘাবড়ে গিয়ে লিফলেটটাকে কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ আর এমাথা-ওমাথা ঘুরিয়ে মিনমিন করল, “কিন্তু পৃষ্ঠা উল্টোলেই যে লেখার মাথাটা…”

বাঁকাচরণ এবার আক্ষরিক অর্থেই খেপে গেল, “বেরো আমার প্রেস থেকে, মূর্খ কোথাকার! লেখাপড়া জানিস না, প্রেসের ব্যবসার মিডিল-ম্যান হয়েছিস! ভাগ্!”

লোকটাকে একপ্রকার বের করে দিল বাঁকাচরণ! কাণ্ড দেখে সুবোধবাবুর তো চক্ষু ছানাবড়া! এ তো রীতিমতো ব্লাফমাস্টার! কাকে লোন দিয়েছে সে!

“কী বলবেন তাড়াতাড়ি বলুন। অনেক কাজ। আপনাকে দেওয়ার মতো এত সময় আমার নেই,” মেজাজের আগুন এখনও নেভেনি বাঁকাচরণের।

“দেখুন বাঁকাচরণবাবু, আট হাজার টাকার ইন্সটলমেন্টের জায়গায় মাসে পাঁচশো-হাজার— এ কেমন ব্যাপার! তার চেয়ে আপনি মোটেও টাকা দিতেন না, সেও ছিল ভাল।”

কথাটায় মোটেও পাত্তা দিল না বাঁকাচরণ, এগিয়ে গেল অফসেট মেশিনের দিকে। মুখের নিভন্ত বিড়িটা পাশের টেবিলে রেখে সে মেশিনের মাস্টার সিলিন্ডার ভেজা স্পঞ্জ দিয়ে পরিস্কার করতে শুরু করল।

এই ঔদ্ধত্বের উপেক্ষা সহ্য করতে না-পেরে দাঁতে দাঁত ঘষে সুবোধবাবু বললেন, “আমি আপনার বিরুদ্ধে কোর্টে যাব।”

“যান। পস্তাবেন। কোর্ট আমার পক্ষেই রায় দেবে,” সুবোধবাবুর দিকে না-তাকিয়ে বলল বাঁকাচরণ।

“কেন?”

“আমি তো কিছু-না-কিছু দিচ্ছি। কোর্টে আমাকে কোনওভাবেই ডিফল্টার প্রমাণ করতে পারবেন না।”

ধাক্কা খেলেন সুবোধবাবু। ঠিক কথা। কী সাংঘাতিক চতুর এই লোকটা! কথাটা বলে সে ব্ল্যাঙ্কেটে স্পঞ্জ বুলিয়ে, বড় কালো চাকতি ঘুরিয়ে ম্যাটার সেন্টারিং করতে লাগল। সুইচ চাপতেই শুরু হল প্রিন্ট। ফিডার দিয়ে নীচের একটা বল্টু দু’চক্কর ঘোরাতেই স্পিড বেড়ে গেল, মেশিন ঘচাং-ঘচ্‌ শব্দে আরও দ্রুত প্রিন্ট করতে লাগল। বাঁকাচরণ প্রিন্টেড হরিনামসংকীর্তনের একটা লিফলেট উঁচু করে ধরে পরীক্ষা করল— সব ঠিক আছে কি না। তার পর নিভে যাওয়া বিড়িতে পুনর্বার অগ্নিসংযোগ করে বলল, “আপনি এখন আসুন, ম্যানেজার। আমার বিস্তর কাজ পড়ে আছে।”

সুবোধবাবু গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে এলেন। বুঝলেন, সহজে এই লোন আদায় হবার নয়। এ-দিকে ক্রমাগত উপর-মহলের চাপ আসতে শুরু করেছে। তাঁর ব্রাঞ্চ লোন রিকভারিতে একদম পিছিয়ে। অথচ অতীতে কোটি কোটি টাকার লোন আদায়ের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের জন্যই আজ তাঁর এই পদোন্নতি। মান-সম্মান শুধু ডুববে না, এভাবে চলতে থাকলে তিনি নিজেই একদিন ডুবে যাবেন। উচ্চ কর্তৃপক্ষ হুমকি দিয়েছে, তিন মাসের মধ্যে ডিউ লোন রিকভার না-করতে পারলে সুবোধ ভদ্রের পানিশমেন্ট পোস্টিং হবে।

পানিশমেন্ট পোস্টিং! কোন ভাগাড়ে নিয়ে ফেলবে ভগবানও জানে না। ঘুম উবে গেল। দুর্ভাবনায় অস্থির হয়ে সুবোধবাবু একদিন ফোনে বাঁকাচরণকে ব্যাঙ্কে ডেকে পাঠালেন। ব্যাঙ্কে এসেই সে ব্যস্ততা দেখাতে শুরু করল। সুবোধবাবু রাগত স্বরে বললেন, “আপনি যদি ঠিকমতো ইনস্টলমেন্টের টাকা না-দেন, তাহলে ব্যাঙ্ক কড়া পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে।”

ম্যানেজারের কথায় আমল না-দিয়ে বাঁকাচরণ বলল, “আর কিছু?”

কতখানি রেকলেস! সুবোধবাবু ভয়ঙ্কর রেগে গেলেন। তবু যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত রেখে বললেন, “আর আপনার প্রেসের সামনে একটা বোর্ড লাগাতে হবে। ব্যাঙ্কের কাছে ঋণস্বীকারের কথা তাতে লেখা থাকবে। বোর্ডের ম্যাটার আমি দিয়ে দিচ্ছি আপনাকে। বোর্ড লাগিয়ে একটা ফোটো তুলে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করবেন।”

বাঁকাচরণ অর্ধনিমীলিত চোখে দু’দিকে ঘাড় নাড়ল, “এসব ফালতু কাজ করার মতো অত টাকা আমার নেই, গরজও নেই। আপনার খুব দরকার হলে বোর্ড বানিয়ে পাঠিয়ে দেবেন, আমি লাগিয়ে রাখব,” তার পর হাত জোড় করল, “তাহলে আসি? একটা আর্জেন্ট ডেলিভারি আছে।”

কেটে গিয়েছে আরও মাস তিন-চার। এই ক’মাসে বাঁকাচরণ মাত্র হাজার-দুয়েক শোধ দিয়েছে। আতান্তরে পড়ে গিয়েছেন সুবোধবাবু। পুজোর ছুটির শেষ দিনে একপ্রকার বাধ্য হয়ে আবার তিনি বাঁকাচরণের প্রেসে গেলেন।

ঢুকেই দেখলেন, ব্যাঙ্ক থেকে পাঠানো বোর্ডটাকে কেটে কয়েক খণ্ড ছোট-ছোট প্লাকার্ড বানানো হয়েছে। সেগুলোর উল্টো পাশে সাঁটা নানান স্টিকার— ‘দই ফুচকা’, ‘আলুকাবলি’, ‘পাপড়িচাট’ ইত্যাদি। সুবোধবাবু অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন, “ব্যাঙ্কের বোর্ডটাকে এভাবে নষ্ট করেছেন কেন? সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করা দণ্ডনীয় অপরাধ, আপনি জানেন?”

“কারণ না-জেনে ফলাফল নিয়ে চিৎকার করা মূর্খের পরিচয়,” বাঁকাচরণ বিজ্ঞের মতো বলল, “একটা তিনশো টাকার আর্জেন্ট অর্ডার পেলাম। হাতে সময় অত্যন্ত কম। কোথায় আবার বোর্ড খুঁজতে যাব বলুন! তাই আপতত ওটা দিয়েই কাজ সারছি,” বেহায়ার মতো দাঁত বের করল সে, “তা বলুন ম্যানেজার, আছেন কেমন? হঠাৎ কী মনে করে?”

নির্লজ্জ! মনে মনে গালাগালি দিলেন সুবোধবাবু। মুখে বললেন, “আর আমরা টলারেট করতে পারছি না। আজই আপনার মেশিন সিজ করে আমরা তুলে নিয়ে যাব।”

বললেন বটে, কিন্তু তিনি জানেন এই মেশিন দিয়ে ব্যাঙ্কের টাকা উশুল হবে না। তাছাড়া ব্যাঙ্ক মেশিন চায় না, সুদ সমেত আসল টাকা চায়। তবুও এমন ভাব করলেন যেন এখুনি লোকজন আসবে, আর বাঁকাচরণের অফসেট প্রিন্টার তুলে নিয়ে গিয়ে তাকে আচ্ছা জব্দ করা হবে।

বাঁকাচরণ অচঞ্চল। সে যথারীতি বিড়ি একখানা ধরিয়ে হাতের তালু দু’দিকে নাড়িয়ে বলল, “আমি মোটেই ঘাবড়াচ্ছি না, ম্যানেজার। দশমীর বাজার। কুলি সব চলে গেছে বেশি পয়সার প্রতিমা বিসর্জনে। আর এই মেশিন আপনি একা তুলে নিয়ে যেতে পারবেন না। এ একার কাজ নয়!”

সে-দিনও অপদস্ত আর ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হল সুবোধবাবুকে।

বাঁকাচরণ দফাদার ম্যানেজার সুবোধ ভদ্রর জীবন ও চাকরি— দুইয়েরই দফারফা করে ছেড়ে দিচ্ছে। বসের হুমকি সারাক্ষণ তটস্থ করে রেখেছে তাঁকে। একটা বিহিত না-করলেই নয়। রাতে শোবার পর ঘুমের বয়েস কয়েক মিনিট হতে না-হতেই দুশ্চিন্তার ত্রাসে জেগে ওঠেন সুবোধবাবু।

সেদিন সারা রাত ঘুম হল না। মনস্থির করলেন— কাল সকালেই একটা চরম ব্যবস্থা নেবেনই নেবেন!

সকালের আলো ফোটার আগেই সুবোধবাবু দু’জন বন্দুকধারী সিকিউরিটি নিয়ে গাড়ি চড়ে চড়াও হলেন বাঁকাচরণের প্রেসে। এত সকালে স্বাভাবিকভাবেই প্রেস বন্ধ। কিন্তু বেলা হওয়ার তর সইল না। ফাইল খুঁজে ঠিকানা উদ্ধার করে সুবোধবাবু গাড়ি হাঁকালেন বাঁকাচরণের বাড়ির দিকে।

গ্রামের এবড়োখেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে গাড়ি এসে থামল তেমাথার মোড়ে। ড্রাইভার জানাল, গাড়ি আর এগোবে না। গাড়ি থেকে নেমে অনেক ঝোপঝাড় পেরিয়ে লোকের মুখে শুনেটুনে সুবোধবাবু সিকিউরিটি সমেত উপস্থিত হলেন একটা বিপর্যস্ত মেটে বাড়ির সামনে। এরকম বাড়িতে এখনও মনুষ্য-বসবাস আছে, ধারণা ছিল না।

তাহলে এই হল বাঁকাচরণ দফাদারের রাজপ্রাসাদ! খাসা-ই বটে! ধ্বংসস্তুপের মতো দুটো খুপরি। বাইরে খড়ের ছাউনি দেওয়া বেশ চওড়া বারান্দা। বারান্দায় তক্তপোশের ওপর বসে আছেন তিনজন বৃদ্ধা। তিনজনই খুনখুনে, নিশ্চিত আশির ওপরে বয়স প্রত্যেকের। বাঁকাচরণ হাতে একটা বাটি নিয়ে তাদের সঙ্গে বেশ উত্তেজিত বাক্যালাপ করছে। সিকিউরিটিকে দূরে দাঁড় করিয়ে সুবোধবাবু বাঁকাচরণের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। বাঁকাচরণ বাঁ দিকের বৃদ্ধাকে আদেশ করল, “এই যে সাদাবুড়ি, এটা তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও বলে দিচ্ছি! তার পরে ওষুধ আছে। আর যদি কালকের মতো অবাধ্যতা করেছ, একদম রাস্তায় রেখে আসব আজ বলে দিলাম।

“এই তো গুড গার্ল আমার কালোবুড়ি। সবটুকু খেয়ে নিয়েছ, বাহ্!” মাঝের বৃদ্ধার হাত থেকে একটা এঁটো থালা নিয়ে বাঁকাচরণ ডানদিকে তাকাল, “একি শ্যামলাবুড়ি! তোমার এখনও হয়নি? বুঝেছি, সাদাবুড়ির সঙ্গে মিশে মিশে তোমার স্বভাব খারাপ হচ্ছে। যে জন্যে দু’জনকে কাল আলাদা করলাম, কোনও কাজ হল না দেখছি। তোমার ব্যবস্থা হচ্ছে, দাঁড়াও। কথা যদি না শোনো, একদম ঠ্যাঙ ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেব। শিগ্‌গির খেয়ে নাও বলছি, আমাকে প্রেসে যেতে হবে…” কথা বলতে-বলতে হঠাৎ বাঁকাচরণের মনে হল পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।

“আরে স্যার আপনি!”

আজ যেন এই প্রথম বাঁকাচরণ একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। ম্যানেজারের এই আগমন তার কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত। এখন তার চোখমুখ দেখে কে বলবে যে, এই লোকটা দিনের পর দিন সুবোধবাবুর মতো সুভদ্র মানুষকে অপদস্ত করেছে আর চরকির মতো ঘুরিয়েছে!

সুবোধবাবু নরমভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “এঁরা কারা?”

“এসব বাপে-খ্যাদানো মায়ে-তাড়ানো হাভাতের দল। সবক’টা আমার বাপের বড় দিদি, মানে আমার পিসি। অভাবের জন্যে একটারও বিয়ে দিতে পারেনি ঠাকুরদা। এখন তিনটেরই মাথায় ডিস্টার্ব। আমার ঘাড়ে চেপে ভব-তরী পার হওয়ার ধান্দা ফেঁদেছে! এই রঞ্জি, স্যারকে একটা চেয়ার দে তাড়াতাড়ি,” ব্যস্তসমস্ত হয়ে হাঁক পাড়ল বাঁকাচরণ।

পাশের ঘর থেকে প্লাস্টিকের চেয়ার হাতে বেরিয়ে এল এক তরুণী।

“বসুন স্যর। এ আমার বোন, রঞ্জিতা। এবার এমএ ফাইনাল ইয়ার। সামান্য লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করছি, আর কী! যাতে ওর দশা এই কপালপুড়ীগুলোর মতো না-হয়,” বলে বোনের দিকে তাকাল বাঁকাচরণ, “প্রণাম কর। ইনি ব্যাঙ্কের বড় ম্যানেজার।”

তরুণী সুবোধবাবুকে প্রণাম করতে গেল। সুবোধবাবু দু’পা পিছিয়ে গেলেন, “থাক, থাক! ভাল করে পড়াশুনো করো। ভাল চাকরি পেতে হবে কিন্তু।”

বাঁকাচরণ বলে উঠল, “তবে শোন, এত কষ্ট করে লেখাপড়া শেখাচ্ছি। আর যা-ই হোস, ব্যাঙ্কের ম্যানেজার কিন্তু হবি না। বড্ড বাজে চাকরি। আমার ধারণা সাত-আটটা শুয়োর-জন্মের পর একটা করে ম্যানেজার-জন্ম…”

বাঁকাচরণের কথা শেষ না হতেই অন্য ঘর থেকে লাঠি হাতে কুঁজো হয়ে বেরিয়ে এলেন এক বৃদ্ধ। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কেউ এসেছে নাকি, ব্যাঁকা?”

বাঁকাচরণ বেশ জোরেই উত্তর দিল, “ম্যানেজার।”

“কী বললি? ‘মরে যাও’? হ্যাঁ, আমি মরলে তো তোর শান্তি হয়, মর্কট! অকালকুষ্মাণ্ড জন্ম দিয়েছি! বংশের কুলাঙ্গার! দুধ-কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছি…” এমন নানান সুসম্বোধন করতে-করতে বৃদ্ধ আবার ঘরে ঢুকে গেলেন।

বাঁকাচরণ ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ মুখে বলল, “আমার বাবা। কানেও শোনে না, চোখেও দেখে না। বোন যেদিন জন্মালো সেদিনই জন্ম-ফাঁকি দিয়ে মা চলে গিয়েছিল…” একটু আদ্র হয়ে এল বাঁকাচরণের গলা, “এঁরা আমাকে পনেরো বছর খাইয়েছিল। তার পর রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে খুঁটে খাওয়ার জন্যে। খুব গর্ব করে মাঝেমাঝেই বলে, ছোটবেলায় আমাকে নাকি রোজ সাড়ে তিন টাকার দুধ খাওয়াতো। আমাদের পাড়ার মুরুব্বি অতিনখুড়োকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম— ‘খুড়ো, এই সাড়ে তিন টাকার লোন আমার কত দিনে শোধ হবে? আর তো টানা যাচ্ছে না।’ শুনে অতিনখুড়ো বলল যে, এরা বেঁচে থাকতে নাকি তা শোধ হবার নয়।”

কথাগুলো বলে অনির্দিষ্টের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল বাঁকাচরণ। তারপর ভীষণ কাতর কণ্ঠে বলল, “তা… ম্যানেজার সাহেব, সেই রোজের সাড়ে তিন টাকার লোন এখনও শোধ করে উঠতে পারিনি, আর আপনার সাড়ে তিন লাখ টাকার লোন এত তাড়াতাড়ি শোধ হবে ভেবেছেন?”

ম্যানেজার সুবোধ ভদ্র পলকহীন তাকিয়ে রইলেন বাঁকাচরণের দিকে। ঠিক কতক্ষণ তা তাঁর মনে নেই!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

37 thoughts on “short-story-loan

  1. বাহ্ দারুণ তন্ময় বেশ টানটান উত্তেজনা পুরো গল্পটায় ।বেশ লাগলো।

      1. অপূর্ব সুন্দর লাগলো আপনার লেখা। আজ আপনাকে নুতন ভাবে জানলাম।

  2. এক নিঃশ্বাসে পুরোটা পড়ে ফেললাম তন্ময় টানটান উত্তেজনা ছিল। বেশ ভালো

  3. খুব বলিষ্ঠ লেখা। আশা করি অনেক নামিদামি পত্রের পত্রিকায় আপনার লেখা খুব শীঘ্রই দেখতে পাব।

  4. একটু অন্য ধরণের গল্প পড়লাম । বেশ ভালো লাগলো ।

  5. বেশ মজার আবার একই সাথে করুন। খুব ভালো লাগলো আপনার গল্প। শুভেচ্ছা রইলো।?

  6. পরিস্থিতির ঘূর্ণিপাকে একজন মানুষের জীবনের ওঠাপড়া গুলি খুব সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে আপনার এই লেখাতে। জীবন সংগ্রাম যে কার কেমন তা সত্যই আপাত ভাবে বোঝা যায় না। ভালো লাগলো গল্পটি ।

  7. গল্পটা অসাধারণ, অনবদ্য । খুব খুব ভালো লাগলো।

  8. দারুন গল্প! প্রথম পর্বে ব্যাঁকাচরণের চরিত্র নির্মান অনবদ্য। খুব ভালো লাগল গল্পটা।

Leave a Reply to Sudeep Chakraborty Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *