short-story-madhubala-o-godaichor

মধুবালা ও গদাইচোর
জয়তী রায়

এক গলির গল্প। গলির না আছে জাঁক না জলুষ। মেরেকেটে পঞ্চাশটা পরিবার। দিন আনে দিন খায়। তার উপর গলিখানা কানা। বড়রাস্তার মুখ থেকে শুরু হয়ে, একটু কান্নিক মেরে বুড়ো বটতলার সাইড দিয়ে নিতাইমুদির দোকান পার হয়ে রূপা বিউটি পারলার, তারপর আঁচিপাঁচি ছোট ছোট ঘর পেরিয়ে সো-জা ধাক্কা মারে কবরখানার পাঁচিলে।

এমন গলির আবার গপ্প কিসের! বলে, কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন। ধুর!

শোনো কথা! গল্প আর ফাগুন বাতাস ভেদাভেদ মানে না কি? তাদের কাছে রাজভবন যেমন চালাঘরও তেমন। লোকেদের এই ভারি দোষ। কেবল স্ট্যাটাস খুঁজে বেড়ায়। গলি না হয় কানা, কিন্তু তার বাসিন্দাগুলো? কেউ কম যায় না কারো থেকে।

এই যেমন মুকুজ্জে পরিবার। এককালে টাকা ছিল। কলকাতায় বড়বাড়ি ছিল। ঘচাং করে ব্যবসার ভরাডুবি। দুই ছেলে দুই বৌমা নিয়ে বুড়োকর্তা চলে এসেছেন এখানে। গলিতে তাদের যেন মানায় না। যেমন পুকুরের উপর পানা ভেসে থাকে, তারাও তেমনি এট্টু আলগা। বাড়ির অবস্থা খারাপ না কি ভালো বাইরে থেকে বোঝার কিস্যু উপায় নেই। দিনরাত দরজা জানালা বন্ধ। তব্বে, এক একদিন দুপুরে কমবয়েসী ডবকা ছোটবউ সেজেগুজে গলির বাইরে যায়। আবার ফিরেও আসে চোরের মত। সেদিন রাতে মুকুজ্জে বাড়ির আলো জ্বলে ওঠে। মাংস রান্নার গরম মশলার গন্ধে ভুরভুর করে চাদ্দিক। মাংস বেচে মাংস খাওয়া নিয়ে গল্প লেখা যায় কি না, সে বিচার করা আমাদের কম্ম নয়।


পেছন ফাটছে কেন বস!


গলির গল্প হরেকরকম।

আজকের কথাই যদি ধরো, রহিমচাচা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি আসছেন! সত্তরের উপর বয়স। জব্বর ধাক্কা লেগেছিল বুকে। স্ট্রোক। তো তিনকুলে কেউ নেই তার। না থাকুক গে। টুকুন আছে! আর আছে তার দলবল। সমাজ অবশ্য গালি দিয়ে বলবে হাড়হাভাতে বেকারের দল। গুলতানি মারে আর রকবাজি করে। এর উত্তরে টুকুনের কায়দায় কলার তুলে পা বেঁকিয়ে বলা যায় – তাত্তে তোমার পেছন ফাটছে কেন বস!

রহিমচাচাকে হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে এনে ঘরে দুধ রেখে দেওয়া হল। সেইসঙ্গে ফিনাইল দিয়ে পরিষ্কার করে ঝকঝক তকতক। টুকুন দায়িত্ব নিলে বাপের সুপুত্তুর। কোমরে হাত রেখে বলল, আমি থাকব দাদুর কাছে। বাড়ির লোকের যদি হত, তবে কি ফেলে পালিয়ে যেতাম?

কথাটা শুনে নন্দামাসীর মত দজ্জাল মহিলা পযর্ন্ত আড়ালে চোখ মোছে। মহল্লায় টুকুনদের দলটাকে তেমন কেউ পছন্দ করে না। রোদ্দুর না থাকলেও চোখে কালোচশমা, চকরা বকরা টেরিলিনের জামা আর তেমনি খিটখিট স্বভাব। সবেতেই তেড়ে তেড়ে আসে। তবু, এরাই গলির ভরসা। বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়বে। অসময় পড়লে ছেলেগুলো কী না করে! লোকের বাড়ি রেশন তুলে দিয়ে আসে। ঝড় তুফান হলে টিনের আর টালির চালের কমজোরী ঘরগুলো থরথর। ছেলেগুলো বুক দিয়ে রক্ষা করে সবাইকে। বুড়ি মানদা ঠিকই বলে, ভগমান বাইরে কোথাও নেই। মানুষের মধ্যেই আছেন।


জব প্যায়ার কিয়া তো…


ফাগুনঋতুর এই এক ঝামেলা। দখেন বাতাস চরাচর জুড়ে গান গায়। পলাশ গাছ রঙে রঙে রঙিন। বুকের মধ্যে উথাল পাথাল সমস্ত আবোল তাবোল ছবি। প্রেমের মাস না সর্বনাশের মাস কে জানে! মধুবালা ওরফে পরীর ঠিক এমন মনে হয়েছিল।

গলিতে মধুবালা! অমন হাসলে চলবে না। নিতাইমুদির মেয়ে পরী, দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। রূপা বিউটি পার্লার যেদিন ইয়া বড় মধুবালার ছবি টাঙিয়ে রাখল দেখে সব্বাই অবাক। ওমা! এতদিন খেয়াল হয়নি তো! পরী যে এক্কেবারে মধুবালা! সোনার মত গায়ের রং, পদ্মফুলের মত টুলটুল মুখখানি ঘিরে হাল্কা বাদামী কোঁচকানো চুল, ভাসা ভাসা চোখ। আঠেরো বছরের শরীরে যেন রূপের জোয়ার।

পাড়ার লোকের দায়িত্ব বেড়ে গেল পাহারা দেওয়ার। মেয়ে বড় হচ্ছে, এখানে সেখানে মোটে যাবে না। পরী হল গলির শান। শান মানে ইজ্জত। টুকুনের দল কলার তুলে থাকে। অন্য মহল্লায় আর যাই থাক, মধুবালা নেই। পরীর বাপ নিতাইমুদিকে টুকুন বলে, চিন্তা নেই। পরী একদম সেফ।

পরী ভাবে সুন্দরী হওয়া একটা ঝামেলা। স্বাধীনতা কমে যায়। ওই তো রাস্তা দিয়ে টুনি যাচ্ছে হেঁটে। তা টুনি যাক। কিচ্ছুটি কেউ বলবে না। কিন্তু, পরী হাঁটলেই পাড়ার ছেলেদের মাতব্বরি শুরু হয়ে যায়। যেন, গলির বাইরে লুকিয়ে আছে বাঘ সিংহ! রাগে শরীর জ্বলতে জ্বলতে বিষ্ণুকে দেখে। দেখে, মন হাল্কা হয়।

গলির ছেলে হলেও, বিষ্ণু বরাবর বাইরে যায়। চেহারায় চেকনাই আছে। হাতে ঘড়ি। চুলে বাহারি কাট। পায়ে পরিষ্কার জুতো। গন্ধ মাখা ভুরভুর শরীর। পরীকে ডেকে হেসে হেসে বলবে – এই গলি হল ময়নামতীর দ্বীপ। চারিদিক সাগরঘেরা। বাইরে যাবি, তবে তো দেখবি দুনিয়া কত্ত সুন্দর।

পরী গোঁজ হয়ে বলে, বাইরে যাব না কেন? যাই তো।

কই আর যাস। আগে বালিকা বিদ্যালয়ে পড়তে যেতি, বারো কেলাস পাশ করে সে কম্ম ফিনিস।

কেন? সিনেমা যাই মাঝে মাঝে। আর সবকিছু তো গলির মধ্যেই আছে। বাবার মুদির দোকান, হোমিপ্যথি ওষুদ, জুতো সারাই থেকে চণ্ডীপাঠ … তবে যাব কেন গলির বাইরে?

বিষ্ণু মুগ্ধ চোখে তাকায়।

ওরে তুই শুধু নামে পরী না রে। মাইরি বলছি। তোকে দেখলেই টাটকা কদমফুল মনে হয়। এই গলিতে বসে সে কথা কোনদিন জানতে পারবি?

বিষ্ণুদাদার কথায় জাদু আছে। নিষিদ্ধবস্তুর প্রতি মানুষের চিরকালের টান। বিষ্ণু যেন সুদূরের ডাক। চেনা গলির বাইরে অচেনা দুনিয়ার ডাকহরকরা। পরীর চোখে ঘোর লাগে। সর্বনাশের ঘোর।

চালাক বিষ্ণু। অভিজ্ঞ বিষ্ণু বুঝতে পারে মধুবালার মনের ভিতর জেগে উঠেছে স্বপ্ন। সে ফিসফিস করে বলে, ভয় কী! আমি আছি। আমি নিয়ে যাব নতুন দুনিয়ায়। তোকে ভালবাসি। বিয়ে করব তোকে। ভয় নেই।

তাইতো! ঘোড়ায় চেপে এসেছে রাজকুমার। সুন্দর চোখদুটি তুলে পরী দো – টানায় পড়ে ভাবে, প্রেমে পড়লে আর ভয় থাকে না। সে কি বিষ্ণুর প্রেমে পড়েছে?


সেলফি!


এ এক আজব গলি। সুখ দুখ মান অভিমান প্রেম… সমস্ত নিয়ে আপনমনে আছে। প্রোমোটারের নাক পৌঁছয়নি।

সকলে মিলে এককাট্টা হয়ে সুখেদুখে আছে। কিন্তু বিষ্ণু উল্টো। মাঝে মাঝেই বাড়ি আসে না। ওর নাকি দমবন্ধ লাগে। কাঁচা নর্দমার গন্ধ, লোকের বাসনমাজার শব্দ, মদ খেয়ে ঝগড়া! বিষ্ণু নাক কুঁচকে বলবে, আজ পর্যন্ত একটা সেলফি নিতে পারলাম না গলির মধ্যে।

কথাটা শুনে বাসন মাজার ন্যাতা ফেলে, আঁচল কোমরে জড়িয়ে বুক টান করে দাঁড়ায় নন্দমাসী।

ও বাবা বিষ্ণু। তোর কায়দার ফোন দিয়ে একটা ছবি তুলবি বাপ?

এদিকে লাফ দিয়ে, ওদিকে বালতি টপকিয়ে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বিষ্ণু চেরা চোখে তাকিয়ে উত্তর না দিয়ে চলে যায়। রঙ্গ দেখে নন্দমাসী চটে লাল। সে কাউকে ভয় খায় না। কলের জলে বাসন ডলতে ডলতে ঝনঝন করে চেঁচিয়ে বলবে, ওরে ও বিষ্ণু, এখানেই হেগেমুতে বড় হলি বাপ। এখন গন্ধ লাগে? আমিও শহরে যাই। পাঁচবাড়ি কাজ করি। এক এক ঘরের কেচ্ছার গন্ধে পচামাংস লজ্জা পাবে।

দেওয়ালের গায়ে গাঁথা ছোট্ট মন্দিরে ঘণ্টা নাড়তে নাড়তে বাদল পুরোহিত বলবে, সাহেব আমলের গলি বাপু। এর মজ্জাদা হানি করলে সহ্য হবে না। ঠাকুর কষ্ট পাবে।

প্রণামীর থালায় ঠং করে পাঁচটাকার কয়েন ফেলে বিষ্ণু বলে, বুজরুকি থামাও বাদলজ্যেঠু। অবাক চোখে চায় বাদল। এই ছেলের হাতেখড়ি যখন হল, তার কোলের মধ্যে হিসি করে দিয়েছিল! বাইরের দুনিয়া কালাজাদু জানে না কি! রাম রাম।

মাঝে মাঝে ফিষ্টি হয় গলিতে। টুকুনের দল উদ্যোগ নেয়। মাংস ভাত। নাচ গান। বিষ্ণু একশ টাকা ফেলে দিয়ে হাওয়া। তার নাকি বাইরে পার্টি আছে। টুকুন তেড়ে ওঠে। শালা। পয়সার গরম দেখায়।

ভুতো বলে, ব্যাটা দুনম্বরী। আজকাল পরীর দিকে নজর।

চমকে ওঠে গলি। ঝনঝন করে বাসন পড়ার মত চমক লাগে। এ কেমন কথা! তক্কেতক্কে থাকো ভাই সকল। পাঁচকান হতে দিও না। মেয়েমানুষের বদনাম বাতাসের আগে ওড়ে। নজর রাখতে হবে।

একে ফাগুন মাস। দারুণ সময়। হাজার নজর রাখো, মোটা মোটা পাহারা বসাও… প্রেম সুলুক খুঁজে ঠিক ঢুকে পড়বে। পরী মোটে আঠেরো। উপচে পড়ে যৌবন। এই বয়েস অত নীতি কথা-ফতার ধার ধারে না। ভয় লাগে না। লজ্জা টজ্জা তেমন আসে না। বিষ্ণু এখন স্মার্টফোনে ছবি তোলে পরীর। গালে গাল ঠেকিয়ে সেলফি তোলে। পরী অবাক। নিজের ছবি দেখে মুগ্ধ।

বিষ্ণু আলতো হাতে কোমর ধরে টান মারে। হিরো মার্কা কায়দা। ম্যাক্সি পরা শরীরে নারকেল তেলের গন্ধ। ফস্ করে সেন্টেরশিশি বার করে স্প্রে করে দেয়। মাখো মাখো স্বরে বলে, চল, গলির বাইরে। গোলাপি জামা পরিয়ে ছবি তুলব। তোর বুকের উপর দুলবে সোনার লকেট। ঠোঁট রাঙিয়ে দেব গোলাপী রঙ দিয়ে। ছোট জামার নিচে ফর্সা পায়ে থাকবে গোলাপী জুতো। স্মার্টফোন কিনে দেব। বাথরুমে সেলফি তুলবি।

হায়! হায়! পরী ভেসে যায়। চারিদিকে গোলাপী তরঙ্গ। ঢেউ তুলে তুলে ভেসে যায় অনেক রূপের সেলফি!


নিঝুম রাতে নিখুঁত কাজ


গলির একদিকে যদি থাকে মধুবালা, তো অন্য দিকে গদাইচোর।

ছোট থেকেই গদাই চুরি করে। তোবড়ানো সসপ্যান, ভাঙা মগ, স্টিলের চামচ, পাউডার কৌটো। এইসব হাবিজাবি। লোকে তারিফ করে বলত – কালে কালে বড় চোর হবে।

লোকের আশীর্বাদ সত্য করে গদাই নামী চোর হয়েছে বটে।

বুক ফুলিয়ে বলে – একজন চোর হল শিল্পী। নিঝুম রাতে নিখুঁত কাজ।

কথাটা সত্যি। গদাই এখন বাইশ বছরের তরতাজা যুবক। ধরা পড়েছে দুইবার। থানা জানে। কাজ গদাইয়ের। কিন্ত প্রমাণ? নেই। কোথাও নেই। এই সেদিন গলির বাইরে বড়রাস্তার উপর রূপকথা অ্যাপ্যার্টমেন্টে চুরি হল। স্বামী স্ত্রী ছেলে সব নিজের নিজের ঘরে ঘুমন্ত। ঘরের এত্ত ক্যাশ গায়েব। সোনাদানা গায়েব। থানা হুংকার দিল বটে কিন্তু কোন প্রমাণ পেল না।

গদাই বলবে, যার ঘরে চুরি করি, তারা নিজেরাও সব বড় বড় চোর। কাউকে ঠকাইনি। কোন মেয়ের শরীর নিয়ে ছিনিমিনি খেলিনি। চুরি আমার হবি।

হবি তো কত লোকের কত কিছু নিয়ে হয়। এ নিয়ে বলার কিছু নেই।

টুকুন বলে বিষ্ণুর চাইতে গদাই অনেক ভালো। লোকের বিপদে আপদে পাশে থাকে। নিজের সামান্য ইনকাম দিয়ে যতটুকু পারে খরচ করে। আর গলির ক্ষতির কথা স্বপ্নেও ভাবে না।

তবু, গুরুজনেরা দু-চারটে কথা শোনায়। উপদেশ দেয় চুরি ছেড়ে দেবার জন্য। গদাই উদাস মুখে আকাশ দেখে। তোলা উনুনের কালো ধোঁয়া পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরে বেড়ায়। ঠিক যেন মুকুজ্জে বাড়ির ছোটবউয়ের নীরব কান্নার মত। বুক মুচড়ে ওঠে। আহা গো। কেউ কি জানে? বন্ধ বাড়ির ভিতর ঘরের কথা? কতদিন রান্না হয় না। গদাই চাল ডাল তেল নুন রেখে আসে মাঝে মাঝে। বুড়োর ওষুধ নিয়ে আসে। বড্ড মায়া। চোরের বুকের ভিতর এত মায়া! চুরি ছেড়ে দেবে? আবার ভাবে চুরি ছেড়ে দিলে চলবে কী করে? একটা পেট হলে ভাবনা ছিল না। মহল্লা জুড়ে ভুখা পেট। সবসময় রোজগার ভালো থাকে না। অসুখ বিসুখ হলে টাকা লাগে। টুকুনের বেকার ছেলেদের দলটা নির্ভর করে থাকে গদাইয়ের উপর। পাঁচশ টাকার মাংস এনে দিলে উঠতি ছেলেগুলো আরাম করে খায়! কি করবে গদাই? চুরি ছেড়ে দেবে? নিঝুম রাতে নিখুঁত কাজ বন্ধ করে দেবে? অন্যমনস্ক ভাবনার সামনে দিয়ে মেঘের মত ভেসে যায় পরী। সঙ্গে বিষ্ণু। মেয়েটার মুখে শরৎ-সোনা-রোদ্দুর ঝিলমিল। হাতে একগাদা প্যাকেট। কে কিনে দিল? বিষ্ণু?

গদাই থম মেরে থাকে। পরী তার দিকে ফিরেও তাকায় না। বুকের ভিতর চিনচিন। এই হয়েছে জ্বালা। শালা। চোর না প্রেমিক কে জানে! বুকের ভিতর কখনো মায়া কখনো চিনচিন। যাকগে যাক। নিজের সমস্যা নিয়ে ভাবলে চলবে না। পরীর বিপদ। খুব বিপদ। গদাই জানে, বিষ্ণু মস্ত বড় ঠগ। শহরে যায় বলে খবর রাখে। পরী মনে হচ্ছে বেপরোয়া। বিষ্ণুর ঠগগিরির কথা বললে বিশ্বাস করবে না। উফফ, এখন কী করবে সে? প্রমাণ চাই প্রমাণ। বাঁচাতে হবে মেয়েটাকে। চিড়িক চিড়িক কারেন্ট ঘা মারে বুদ্ধিতে। মুকুজ্জেদের ছোটবউ! হাতের তালুতে ঘুঁষি মেরে লাফিয়ে ওঠে গদাই। ভাগ্যিস মনে পড়ল। দেখেছে বেশ কয়েকবার। শহরের রাস্তায় ছোটবউ আর বিষ্ণু… দুজনেই নিষিদ্ধ কাজের সঙ্গে যুক্ত। একজন বাধ্য হয়ে। একজন ইচ্ছে করে। বিষ্ণুর টার্গেট তবে পরী? ওহহ। গলা শুকিয়ে আসে গদাইয়ের। থোড়াই কেউ তাকে বিশ্বাস করবে? সে চোর। বিষ্ণু ভদ্দরলোক। এখন প্রমাণ চাই। চোরবুদ্ধির কুশলী গভীরতা দিয়ে আবিষ্কার করে রহস্যে ঢুকে যাওয়ার গোপন পথ। দেরি করে না গদাই। চাল ডাল কিনে মুকুজ্জে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়।

 

গোলাপী ফ্রক আর এগরোল


প্রকৃতির সঙ্গে মনের অদ্ভুত সংযোগ আছে। এই যে বাতাসে পলাশের গন্ধ, দিনের আলো কেমন অন্যরকম… যেন টুং করে বেজে ওঠা মেসেজ। নাহ্। টুং করে বেজে ওঠা মেসেজ বা খচ করে তুলে ফেলা ফটো… এমন ফোন পরীর নেই। সে আছে বিষ্ণুর। স্মার্টফোন। বিছানায় গড়াগড়ি খেতে খেতে মন ভালো লাগল পরীর। বিষ্ণুদা ম্যাজিক জানে। এমন পটিয়েছে, বাবা-মা দুজনেই গলে জল। সন্তর্পণে প্যাকেট খুলে গোলাপি সিল্কের ফ্রক উঁকি দিয়ে দেখে। মা গো। ঢাকে কম খোলে বেশি। দাঁত দিয়ে ঠোঁট টিপে আবার দেখে ফ্রক। বিষ্ণুর বন্ধুর ফ্ল্যাটে নিয়ে যাবে বলছে। সেখানে এই জামা পরে অনেক ছবি তুলবে। মানা করলেও শুনতে চায় না। বিষ্ণু বলেছে একবার। মাত্তর একবার। যাকে বিয়ে করবেই তার ছবি তুললে পাপ হয় না। বিষ্ণু যখন বলেছে পাপ হয় না, তখন হয় না। সে যাবে। বন্ধুর ফ্ল্যাটে। গোলাপীড্রেস পরে ছবি তুলবে। এগরোল খাবে। বাড়ি চলে আসবে। ব্যস এই তো! এখন আরাম করে নেলপালিশ লাগায় সে। ফুঁ দিয়ে শুকিয়ে নেয়। জানালার বাইরে সকালের নৈমিত্তিক গলি। অবহেলায় পড়ে আছে। ভাঙাচোরা। বিবর্ণ। পরী ফিসফিস করে বলে – বিষ্ণুর বউ হলে অনেক টাকা হবে আমার। মন্দিরটা বাঁধিয়ে দেওয়া যাবে। কলপাড়ে সিমেন্ট দিয়ে বসার জায়গা করে দিলে বেশ হয়। হাঁটু মুড়ে বাসন মাজতে কষ্ট হয় নন্দমাসীর। এমন ভাবতে ভাবতে সে দেখে গদাইচোর। হনহন করে চলেছে ওই দিকে। মুখ চোখ এমন গম্ভীর যেন কী এক বৈঠক সেরে ফিরল! ধুৎ, চোর না পণ্ডিতমশাই।


মধুবালা-শাহরুখ


হাতের শিরা কেটে ফেলেছিল মুকুজ্জে বাড়ির ছোটবউ। বাঁচানো গেছে। ছলছল চোখে ছোটছেলে বলেছে, আলু বেচে খাবে। তবু বউ বেচবে না।

পরী ভেবেছিল গলায় দড়ি দেবে বা আগুন ধরিয়ে দেবে নিজের গায়ে। হল না ঐ গদাইচোরের জন্য। চোরের না কী আরেকটা ইন্দ্রিয় থাকে। সেই ইন্দ্রিয়ের সিগন্যাল পেয়ে জোর করে পরীকে জড়িয়ে ধরে চিল্লিয়ে উঠেছিল, খবরদার… এমন কিছু করবি না তুই।

তবে আমি কী করব? অমন সব ছবি কখন তুলল? কী মিশিয়ে দিয়েছিল কোকাকোলার সঙ্গে? গদাইদা গো!

কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি ওঠে পরীর।

মুখখানা মলিন করে বলে গদাই, ছোটবউয়ের কত বড় ক্ষতি করছিল বিষ্ণু! ধরা না পড়লে তোরও ওই দশাই হত রে পরী।

শিউরে উঠে নিজেকে আরো বেশি করে গদাইয়ের শরীরে লেপ্টে নেয় পরী। লাজুক হেসে বলে – কী করে এমন কাজ করলে গো? তুমি তো হিরো একেবারে।

গদাই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পরীর শরীর। ফিসফিস করে বলে, তুই শুধু আমার। তোর ক্ষতি কে করবে?

ঘরের বাইরে তখন দু’রকম শব্দ ভেসে আসছে। একটা বিষ্ণুকে পেটানোর। অপরটি গদাইয়ের নামে জয়ধ্বনি।

ডাগর চোখ দু’খানির দিকে তাকিয়ে ঘোর লাগা গলায় গদাই বলে, বিষ্ণুর পকেট থেকে টুক করে তুলে নিলাম মোবাইলটা। ওখানেই তো যত ছবি। কেনাবেচার হিসেব। দুবাইতে কথা হচ্ছিল তোর নামে।

মা গো! বলে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পরী। নিজের বুকের ভিতর ফুটে ওঠা চৈত্র পূর্ণিমার আলো দেখতে দেখতে গদাই বলে, তোর জন্য এইটুকু পারবো না? তুই আমার মধুবালা।

আর তুমি আমার শাহরুখ খান।

মধুবালা-শাহরুখ জুটি হয় কি না হয়, সেসব যুক্তি তর্ক এখন থাক। এখন ভাব-ভালোবাসার সময়। আমাদের বিদায় নেওয়াই ভালো।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

6 thoughts on “short-story-madhubala-o-godaichor

  1. গদাই চোর মন চুরি করে শ্রেষ্ঠ চোর প্রমাণ করলো নিজেকে।

  2. আরে,দুর্দান্ত লিখেছ তো।দারুণ দারুণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *