আশরাফ জুয়েল
এই গতানুগতিক আক্রমনাত্মক শহরের ঈর্ষান্বিত মানুষগুলোর মধ্যে আমি এক অজপাড়া, বুকে একটুকরো গ্রাম নিয়ে ঘুরি, এলোমেলো – আমার বুকের সেই টুকরো আমার ভিটেবাড়ি, বাড়ির পেছনের পুষ্করিণী, পুষ্করিণী ঘিরে অলস ভঙ্গিমায় মৃতপ্রায় জলের আয়নায় লেপ্টে থাকা নারিকেল গাছগুলোর একঘেয়ে ছায়া, সেই ছায়াকে অনস্ত্বিত্বে ঠেলে দিতে শ্বাস নেয়ার জন্য পরাধীন তেলাপিয়াগুলোর উঁকিঝুঁকি, পোয়াতি নারীর স্ফীত স্বপ্নের মতো মাটিলেপা উঠোন পেরিয়ে সামনের শর্ষেক্ষেতে তরুনীহাসির চেয়েও উজ্জ্বল হলুদের ঢেউ-লীন হয়ে থাকি আমি, এই স্বপ্নচোষা শহরের মেকি স্তনের উলম্ফন থেকে নিজেকে আড়ালে রাখার জন্য আমার বুকের টুকরো গ্রামে আমি চাষ করি রাই, তিশি, আর সযত্নে লুকিয়ে রাখি আমার বুকের সেই গ্রামকে, আমি চাই আমার এই গোপনীয়তা আর কেউ না দেখুক, কেউই না। কিন্তু সর্ষেফুল থেকে মধু আহরণে আসে যে সকল মৌমাছি, তারা এই অসাড় শহরে একটুকরো সজীব গ্রামের অস্তিত্বের খবর জানি দিয়েছিলো চিঠিকে।
চিঠি গ্রাম চেনে না, চেনে না বলেই আমার বুকের সেই টুকরো গ্রামে কান লাগিয়ে কী যেন শোনে, কিছু বলতে গেলেই ডান হাতের তর্জনীকে আমার ঠোঁটে ঠেকিয়ে আমার মুখ থেকে বুদবুদের মতো বের হতে চাওয়া শব্দগুলোকে অবশ করে ফেলে, সেই অবশভাব আমার ঠোঁটকে চুমু দিয়ে অবাধ্য বাছুরের মতো দৌড়ে বেড়ায় আমার শরীরের কাতর জমিনে। চোখ বন্ধ করে আমি তখন আমার বসতভিটার উত্তরঘরের জানালার জুঁই গাছটির সাথে নিঃশব্দে কথা বলতে থাকি। আমাদের কথা চলতে থাকে ছোট ছোট সেলাইয়ের মতো, আঘাতে প্রদাহে জর্জরিত হতে থাকি আমরা – বিপরীত প্রান্তে ফুটে উঠতে থাকে সুদৃশ্য সুজনি কাঁথা। আমার আর জুঁইফুলের কথার সুই চলতেই থাকে, শেষ হতে চায় না চিঠির গ্রাম শোনা। এরমধ্যে সরল সন্ধ্যেটা ঢুকে পড়ে ধুলোওড়া বিকেলের ক্লান্ত পেটে, বিকেলটা কুমারী রাতের – মনে হয় এই পৃথিবীতে আমি, চিঠি আর জুঁইফুল ব্যতীত আর কেউ নেই। ঝিঁঝিঁপোকায় মশগুল রাতের ললাটে মাদুলি হয়ে থাকা চাঁদ আর তাতে ললাটিকা হয়ে ঝুলে থাকা চিঠি, তার বুকের শীর্ষবিন্দুতে মিটিমিটি জোনাকির গীত আর জুঁইফুল ঘ্রাণ মাতোয়ারা মিহি বাতাসে। আমি তখনও ঘ্রাণের শরীরে বিবাদ- রাত কাটে, জুঁই থেকে চিঠি, চিঠি থেকে জুঁই। ঠিক জানি না কাকে ভুলে থাকতে কাকে আঁকড়ে ধরছি।
“তোমার গ্রামে চাপকল আছে? আমি সম্পূর্ণ নিরাভরণ হয়ে চাপকলের পানিতে গোসল করতে চাই।” পাতার শরীরে বাতাসের স্পর্শে যেভাবে কথা বলে গাছ, ঠিক সেভাবেই কথাগুলো বলে ওঠে চিঠির বাঁশপাতা ঠোঁট।
বিস্ময়ক্লান্ত হৃদয়ে চিঠির দুবাহু ধরে আমার বুক থেকে তুলে সরল দৃষ্টিতে তার পলিমাখা মুখের দিকে তাকাতে থাকি। আমার দৃষ্টির আয়নায় এসে জমা হয় গুড়িগুড়ি অনুভূতি, বর্ষামথিত আবেগ আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে যায়। আমি চিঠিকে দেখতে পাচ্ছি না, উত্তরঘরের জানালায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা জুঁইফুল গাছটা ক্রমশ আমার স্পর্শগ্রাহ্যের সীমানায় চলে আসলে সদ্য উড়তে শেখা কবুতরের মতো চিঠি আমার হাত থেকে তার বাহুদ্বয়কে উন্মুক্ত করে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিলে স্পষ্ট ঘ্রাণ পাই আমি, চিঠির দেহ ভেসে যাচ্ছে উত্তরঘরের জুঁইফুলের ঘ্রাণে।
নারী কেন নির্বিঘ্নে পুরুষকে এভাবে পড়তে পারে? স্তব্ধ হয়ে যাই, চিঠি যতক্ষণ আমার বুকে মাথা রেখে আমার বুকের গ্রামটুকুকে পড়ার চেষ্টা করছিলো, আমি ঠিক ততটা সময়ই চোখ বন্ধ করে বাড়ির কলপাড়ের শিরিনকে ভাবছিলাম, আমার তের বছর বয়সের ফোড়া, আমার শিরিন – দেখছিলাম সাদা ফ্রকটায় উজাড় শিরিন, চাপ কলের তলে নিজেকে সঁপে দিয়েছে আর আমি প্রবল খরাক্রান্ত চাপকলের হাতলে চাপ দিয়েই যাচ্ছি যতক্ষণ শিরিনের জন্য উপযুক্ত নাব্যতা না আসে। শিরিন আমার দিকে তাকিয়ে অমবস্যার রাতের চেরাগের মত মিটিমিটি হাসে। আমি মুগ্ধতার নেশায় মাতাল, সদ্য হরমোনাসক্ত বর্ষাসিক্ত আমার হতচকিত হৃদয়ের চোখ দিয়ে দেখছি আমার শিরিনকে, আমার শিরিন, স্নানরতা।
শহুরে আভিজাত্যের রঙীন ফানুসে মোড়ানো চিঠি, নাকি চিঠির আড়ালে শিরিন? খুব বিভ্রান্ত হয়ে যাই, মুহুর্তের জন্য। পরক্ষনেই আমার চিন্তার রেশ হঠাৎ মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা সূর্যের মতো ঝিলিক দিতে থাকে আমার হৃদয়ের মৃদুস্বরা নদীপ্রবাহে। এ তো চিঠি, এ কিছুতেই শিরিন হতে পারে না। তবু বারবার আমার হৃদয়ের ঢেউয়ের এক পিঠে চিঠি, অন্য পিঠে শিরিন, শিরিন-চিঠি’র এই দোলাচলে ভাসতে থাকে আমার ভাবনার স্রোত।
চিঠির হাত দুটো তখনও অবাধ্য বাতাসে ভাসতে থাকা ঘুড়ি হয়ে অদৃশ্য নাটাইকে শাসনে ব্যস্ত। আমি জড়িয়ে ধরি চিঠিকে, জড়িয়ে ধরি প্রবল শীতের নগ্ন বাতাস যেভাবে আকড়ে ধরে কুয়াশাগন্ধী সন্ধ্যেকে আর চিঠির বুকের নরম মেঘে ঘষতে থাকি আমার সকল বিভ্রান্তি।
‘যাবে আমাকে নিয়ে?’ চিঠির স্বগোতোক্তি।
‘যাবো’ নিজের মধ্যে ফিরে এসে বলি, ‘যাবে তুমি? হবে আমার উত্তরঘরের জানালার জুঁইফুল গাছ?’ পরক্ষনেই মনে পড়ে, কলপাড় তো কবেই মিশিয়ে গেছে, অথচ আমার মন বলছে, এখনো সেই চাপকল, চাপকলে স্নানরতা, আমার শিরিন! চিঠি তার শরীরের মাখনে নির্বিঘ্নে ঢালতে থাকবে ঈষুদষ্ণ জল, আমি টিউবওয়েলের ত্রস্ত হাতল হয়ে, আমি খুঁজতে থাকবো শিরিনকে।
হয়তো চিঠি যাবে না, হয়ত নয়, আসলেও সে যাবে না, না যাক, কিছু যায় আসে না তাতে- এই যে আমি চিঠির ভেতর আমার নিমপাতা শিরিনকে দেখতে পাচ্ছি! এইতো! আর কিচ্ছু চাই না আমার। কিচ্ছু না।
শিরিনের এখন দুইটি পৃথিবী, এখন কোথায় যে থাকে? যেদিন সে আত্মহত্যা করেছিলো, স্বেচ্ছায় নয়, করতে হয়েছিলো, এ কথা কখনই ভুলতে চাই না আমি, আমিই শিরিনকে উত্তর ঘরের জানালাসংলগ্ন ফাঁকা জায়গাটায় পুঁতে রেখে বাড়ি ছেড়েছিলাম, আর যাইনি, যাওয়া হয়নি। কলপাড় নেই, নেই ঘরের পেছনের পুষ্করিণী। নেই মসৃন মাটিলেপা সেই উঠোন, উঠোনের মাথার উপরের শান্ত চেহারার নিমগাছ। থাকার কথা কি ছিলো? অথবা ছিলো, হয়ত স্মৃতিভ্রমে আক্রান্ত আমি।
কিন্তু চিঠিকে তো কথা দিলাম, তাকে নিয়ে যাবো গ্রামে, আমার মায়ের গন্ধের ভাঁজে নিঃশব্দে শুয়ে থাকা শাড়ীগুলো বের করে পরতে দেবো, পিতলের বাক্সে কবরস্থ দাদীর গয়নাগুলো থেকে খুঁজে খুঁজে বের করব নাকফুল, টিকলী। মায়ের রুপোর বাজুবন্ধনী আর না পরা নূপুর জোড়া পরিয়ে দেবো চিঠির সরীসৃপ পায়ে। পুঁইশাকের পাকা বিচি ঘষে রাঙাবো তার পা, চিঠি তখন কিশোরি, চিঠি তখন শিরিন। কিন্তু চিঠি কি শিরিন? আর শিরিন জুঁইফুল গাছ?
মুনাল তখন ছাত্র, চিঠিও। মুনাল বুয়েটে, চিঠি ভিকারুন্নেসায়, মুনাল থার্ড সেমিস্টারে, চিঠি ইলিভেনে, মুনাল আর্কিটেক্ট চিঠি ঢাকা মেডিকেলে ইন্টার্ণ। কিছুদিন আগেও একটি নামকরা মাল্টিন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ফার্মের চিফ আর্কিটেক্ট, চিঠি এফসিপিএস – পার্ট ওয়ান পাস করে ট্রেইনিং করছে ডিএমসি-তে। চাকরী মুনালের ভালো লাগে না, তাই চাকরী ছেড়ে ব্যবসা করবে ভাবছে, আর পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না চিঠিরও। চিঠি সম্ভবত প্রেম করছিলো, সম্ভবত মুনালও।
কোনকিছু না ভেবেই ফ্রেণ্ড রিকু এক্সেপ্ট করেছিলো মুনাল। একেবারেই কিছু না ভেবে? ঠিক তা নয়, সম্ভবত তেরজন কমন ফ্রেণ্ড এই রিকুয়েস্টটা এক্সেপ্ট করাতে মুনালকে প্রভাবিত করেছিলো। যদিও অন্য কারো দ্বারা প্রভাবিত হবার পাত্র সে নয়, তবু, কী ভেবে? হয়ত মেয়েটির চেহারার কোথাও না কোথাও লেগে ছিলো শিরিন, হয়ত নয়, ছিলো। ছিলো বলেই মেয়েটির আহ্বান স্পর্শ করে আপাতত বন্ধু হয়েছিল। ফেসবুকে কতজনই তো বন্ধু হয়, আবার চলেও যায়, আবার কারো কারো সাথে বায়বীয় অন্তরঙ্গতা চলতে থাকে, সেখান থেকে কোনো কোনো সম্পর্ক সত্যিকারার্থে বন্ধুত্বে গড়ায়, বেশীরভাগই ধসূর হতে হতে মিইয়ে যায়।
‘হাই…’ মুনাল খেয়াল করে না, খেয়াল করে না নতুন বন্ধুটির এই আহবান। ‘হ্যালো’, মুনাল খেয়াল করে না, সত্যি করে না। হাই হ্যালো চলতে চলতে বেশ কিছুদিন কেটে যায়, মুনাল লক্ষ্য করে অথবা করেনা। খেয়াল করা না করার মধ্য দিয়ে তাকে খেয়াল করতে হয়। তার মেসেঞ্জারের ইনবক্স উপচে পড়তে থাকে এসএমএস-এ। মেয়েটির অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন, অনেক অনেক প্রশ্ন – প্রশ্নগুলো ব্যক্তিগত নয়। এই যেমন, ‘এখানে এখন কোন ঋতু’, ‘বৃষ্টি হচ্ছে কী না?’ ‘বছরের কয় মাস এখানে বরফ পড়ে’, ‘এখানকার অটাম কী খুব সুন্দর?’ কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয় কখনও, বেশীরভাগ সময়ই এড়িয়ে যায়, কিন্তু বেশীদিন এড়াতে পারে না। মেয়েটির অনেক অনেক প্রশ্নের বিপরীতে খুব কম কম উত্তর দেয় মুনাল। চিঠি লক্ষ্য করে, খুব নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করে তা না, কিন্তু করে, লক্ষ্য করে মুনাল ক্রমশই ব্যস্ত হয়ে পড়ছে মেসেঞ্জারে। চিঠি কিছু বলে না, অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে কিছু বলতে চায় না সে, আসলে একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষকে সাবধান করার কিছু থাকে না। চিঠি দেখতে চায়, দেখা যাক না, কোথায় যায় ব্যাপারটা। আর যদি কেউ যেতে চায় তাকে আটকে রাখা যায় না, যে থাকার সে চলে গিয়েও আবার ফিরে আসে, সেই ফিরে আসাটা হয় স্থায়ী।
কাজ বাড়েনি, ব্যস্ততা বেড়েছে। কী নিয়ে ব্যস্ততা বাড়ে বুঝত পারে না চিঠি। প্রতিদিনের একই রুটিন, ট্রেনিং, পড়াশোনা, খাওয়া-দাওয়া, ঘুম-কাজ বলতে তো এগুলোই, তবু ব্যস্ত। অবশ্য প্রায় প্রত্যেকের জীবনেই একটা নতুন কাজ যুক্ত হয়েছে, ‘অনলাইন।’ মানুষ সারাদিনে এই কাজটার পেছনেই সবচেয়ে বেশী সময় ব্যয় করছে- প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। মানুষের জীবন পালটে যাচ্ছে, পালটে যাচ্ছে সম্পর্কগুলো, ‘মুনালও কী পাল্টাচ্ছে?’ প্রশ্নটা অল্প জলের পুকুরে ফেলা ছিপের বঁড়শিতে বারবার টোকামারা পুটি মাছের মতো ঘুরে ফিরে আসছে চিঠির মনে।
মেয়েটি ছবি পাঠায়, সমুদ্র, নদী, পাহাড়, পার্কের ছবি। মাঝেমাঝে বাবা-মায়ের ছবি পাঠায়। আলাপে আলাপে জানায় বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান সে, তার মা জাপানীজ বংশোদ্ভূত, বাবা আমেরিকান। এক অদ্ভুত সম্পর্কে জড়িয়ে যায় মুনাল – ছোটবেলায় মহিষের দুধের সাথে কাঁচা হলুদের রস মিশিয়ে খেতে দিতো দাদী, মেয়েটির গায়ের রঙ ঠিক তেমন, এমনই ছিলো শিরিনের গায়ের রঙ। সেই ছোট্ট শিরিন, ছটফটে, অনেক প্রশ্ন করা শিরিন। গভীর এলোমেলো চুলের বাথানে লুকিয়ে থাকা জোছনামুখো শিরিন। মুনাল গুলিয়ে ফেলে, বাঁশ পাতার মতো ধারালো ঠোঁটের চিঠির সাথে শিরিনকে অথবা তিশি গাছের মতো তনুবিশিষ্ট শিরিনের সাথে সিনথিয়া হোয়াইটের।
মুনাল চিঠির বিয়ে আগামী সেপ্টেম্বরে। কেনাকাটা আরম্ভ হয়েছে, চিঠি আর মুনাল দুইজনে মিলেই কেনাকাটা করে, দুইজনে পছন্দ করে শাড়ী-গয়না কেনে, ঘড়ি জুতো কেনে। কেনে আরও আনুষাঙ্গিক, যা যা লাগে বা না লাগে, আসলে কেনার আনন্দটাই মুখ্য, আর একসাথে ঘোরা। চিঠি মুনাল দুইজনেই ঘুরতে খুব পছন্দ করে, পছন্দ করে খেতে। দুইজনের পছন্দ একই রকমের, অপছন্দও। বিয়ের কার্ডের ডিজাইন ঠিক করে ফেলেছে ওরা, কার্ড ছাপানোর কাজ চলছে। জীবনে বিয়ে করাটা জরুরী কিনা মুনাল জানে না, তবে চিঠি তার বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশকীয়। চিঠি তার জীবনের সকল ক্ষতের উপশমকারী। জীবনকে হাতের তালুতে নেয়া আটার দলা থেকে রুটি বানানোর মতো উলটে পালটে দেখেছে মুনাল। ছোট এক টুকরো আটার দলা ক্রমান্বয়ে পরিণত হয় গোল রুটিতে, তারপর আগুনের আঁচে পরিণত হয়, ঠিক তেমনি মুনালের জীবন। হয়ত আগুনে পোড়া এই মুনালকেই ভাল লেগেছিলো, তাই ভালোবেসেছে হয়ত। মাঝেমাঝে চিঠি বুঝতে পারে না ভালোবাসা কী? বুঝতে না পারলেও এটা জানে ভালোবাসা ব্যতীত বাঁচতে পারবে না সে, মুনালকে ছাড়া জীবন চিন্তা করাও অসম্ভব। সিনথিয়া হোয়াইট নামের মেয়েটি তাকেও ফ্রেণ্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছে। মুনালের নতুন বন্ধু, চিঠি কিছু মনে করে না, আবার করে না এটাও পুরোপুরি ঠিক না, ইদানিং কথায় কথায় সিনথিয়ার প্রসঙ্গ টেনে আনে মুনাল। সম্ভবত মেয়েটির সাথে কথা হয় মুনালের, সম্ভবত নয় কথা হয় এটা নিশ্চিত এবং প্রায় প্রতিদিন।
মুনাল নয় শিরিন নিজেই নিজেকে হত্যা করেছিলো সেদিন, অবশ্য মুনাল কিছুতেই দায় এড়াতে পারে না, আবার দায় গ্রহণ করার মতো বয়সও তার তখন হয়নি। মুনাল এসএসসিতে চমৎকার রেজাল্ট করে কলেজে ক্লাস আরম্ভ হবার জন্য অপেক্ষারত, শিরিনও। মুনাল চান্স পেয়েছে নটরডেম কলেজে, শিরিনকে ভর্তি করাবে না ওর বাবা, শিরিনের বিয়ে ঠিক করেছিলো, রাজী না হয়ে কিছু করার ছিলো না শিরিনের। শিরিনের আত্মহত্যার রাতেই বাড়ি ছেড়েছিলো মুনাল, তার নাকি ক্লাস আরম্ভ হবে। বাড়ি ছাড়ার রাতেই মুনাল এক টুকরো গ্রাম বুকে রুয়ে চলে এসেছিলো ঢাকা শহরে। বউ রুপে শিরিনকে দেখতে কেনন লেগেছিলো তা দেখতে চায়নি মুনাল।
চিঠিও জানে মুনালের বুকের গ্রামে শিরিনের উপস্থিতির কথা, মেনে নিয়েছে, সেই পনের বছর বয়সের শিরিন, স্মৃতির ঘুড়ি হয়ে উড়ে বেড়ায় মুনালের বুকে বাস করা গ্রামের আকাশে।
সিনথিয়া হোয়াইট কী মুনালকে ভালোবেসে ফেলেছে? চিঠি বোঝার চেষ্টা করে না, বুঝে যায়, মেয়েদের এই যন্ত্রণাদায়ক ক্ষমতা দিয়েই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা, মুনালও কী!
‘চিঠি, সিনথিয়া বাংলাদেশে আসতে চায়? আরে সে আমাকে না জানিয়েই টিকেটও কেটে ফেলেছে, আমি নিষেধ করেছি, কিন্তু সে আসবেই, কী করি বলতো?’
‘আসুক, ভালো তো, আসুক’ চিঠি জানে মুনাল সিনথিয়াকে আসতে নিষেধ করেনি।
‘তাকে নাকি সারা বাংলাদেশ ঘুরিয়ে দেখাতে হবে! কী আবদার দেখেছো? সময় কোথায় আমার?’
‘আসতে যখন চাচ্ছে, আসুক।’
কথা আর বেশীদূর এগোয় না। চিঠি প্রসঙ্গ পালটায়। প্রসঙ্গ পাল্টাতে চায় মুনালও। কিন্তু দুইজনের মনের মধ্যেই এই কথারই ফিতার ক্যাসেট বেজে চলে।
দিন পেরিয়ে সেপ্টেম্বর আসে, চিঠি-মুনালের বিয়ের দিনও এগিয়ে আসে, সম্পন্ন হয় সকল প্রস্তুতি। ইউএসএ থেকে সিনথিয়া কি আসলেও আসবে? মনে হয় না, আসবে না এটা কনফার্ম, মুনাল বুঝেছে, অবশ্য ফেইক একাউন্টও হতে পারে। এভাবে না কি অনেক মেয়ে বন্ধু সেজে টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়। অবশ্য সিনথিয়া কখনই এমন কিছু চায়নি মুনালের কাছে।
সিনথিয়া এসেছিলো, প্লেন থেকে ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমে ইমিগ্রেশান শেষ করে ফোন করেছিল মুনালকে। মুনাল হতবাক, কী বলবে বুঝতে পারেনি, শুধু বলেছিলো, ‘তুমি থাকো, আমি আসছি, এখনই’, যে মেয়ের চেহারায় শিরিনের ছায়া, সে কখনই ফেইক হতে পারে না।
এয়ারপোর্টে গিয়ে সিনথিয়াকে পায়নি মুনাল। যে ফোন থেকে কল করেছিলো, সে মোবাইলে কল করে জেনেছিলো, এটা আরেকজনের মোবাইল, একটি মেয়ে রিকুয়েস্ট করে একজনের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো।
সিনথিয়ার বাংলাদেশে আসার কথা চিঠিকে জানায়নি মুনাল, জানাতে পারেনি, ইচ্ছা করেনি, মাত্র কয়েকদিন পর বিয়ে, এসবের মধ্যে অহেতুক সিনথিয়াকে ঢোকানোর প্রয়োজন মনে করেনি সে। কিন্তু সিনথিয়া এসেও কেন তার সাথে দেখা করলো না, কেনো ফিরে গেল? কেন? উত্তর মেলেনা মুনালের আর এলেই কী সিনথিয়াকে ঠিক মতো সময় দিতে পারত সে?
গত তিন দিন একবারের জন্যও মুনালকে কল করেনি চিঠি, মুনালও না। সিনথিয়া এসে ফিরে গেল, তার আসার খবর চিঠিকে দিতে না পারা, সবমিলিয়ে সারাটা সময় অপরাধবোধে ভুগেছে মুনাল।
‘হ্যালো?’ চিঠির ফোন।
‘আই এম রিটার্নিং ব্যাক, আই জাস্ট টু সি ইউ ফর আ সিনগেল টাইম, শিরিন ইজ বিউটিফুল, রিয়েলি শি ইজ…’ চিঠির ফোনে সিনথিয়ার কণ্ঠ! মুনাল সময় ঘড়ি থেমে যায়, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে সে, কী বলবে বুঝতে পারেনা।
‘মুনাল আমাদের বিয়েটা হচ্ছে না। মানে আমি তোমাকে বিয়ে করছি না, ভালো থেকো…ও আর শিরিন খুব সুন্দর…কিন্তু ওতো বলল, ও এখন মৃত!’ ফোন কেটে দেয় চিঠি। নিজেকে পরিত্যক্ত রেলস্টেশনের মতো হয় মুনালের।
একটা টেক্সট আসে, ‘আমি তো সেদিনই আত্মহত্যা করেছি, কেন বয়ে বেড়াচ্ছিস তাকে?’
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
কী এক দোলাচল!
ধন্যবাদ