short-story-medusar-birthday

মেডুসার বার্থ-ডে গিফট
সৌরভ মুখোপাধ্যায়


সালটা ২১২১। দু-অর্ধে এইরকম মিল-ওয়ালা সংখ্যা শতাব্দীতে একবার মেলে, কোনও ব্যক্তি শতজীবী না হলে এক জীবনে দু’বার এ-জিনিস দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এটা সেইরকম দুর্লভ বছর।

সেই ২১২১ সালের এক সকালে, মেডুসা তার মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

‘মা, আমার পেটের মধ্যে… কীরকম যেন খালি-খালি লাগছে!’

মা ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছিলেন। মেয়ের কথা শুনে ভ্রূ কোঁচকালেন।

‘কাল রাতে স্টম্যাকফিলার ক্যাপসুলটা খেতে ভুলে গেছিস নিশ্চয়ই।’

মেডুসা জিভ কাটল, ‘ঠিক তো!’ কাল কম্পিউটার-টেবিলে বসেই ঘুম পেয়ে গিয়েছিল খুব, সোজা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছিল। ক্যাপসুলটার কথা মনে ছিল না। দশ বছরের মধ্যে এই প্রথম ভুলে যাওয়া।

মা বললেন, ‘ক্যাপসুলটা খেতে ভুলবি না কক্ষনো। এই-যে পেটে খালি-খালি মনে হচ্ছে, এর মানে তোর খিদে পেয়েছে।’

‘খিদে?’

‘হ্যাঁ। আ ফিলিং অব ভ্যাকুয়াম ইন দ্য বেলি। এর আগে তোর কখনও খিদে পায়নি, তাই জানতে পারিসনি। খিদে যাতে না পায়, সেই জন্যই তো দিনে তিনবার ক্যাপসুলটা খাই আমরা কথা। একবার খেলে আট ঘণ্টা স্টমাক ভর্তি রাখে। যাও, এখনি খেয়ে নাও একটা।’

ক্লাস ফোরের মেডুসা এই প্রথম খিদে ব্যাপারটা জানল। কেমন অদ্ভুত একটা অস্থির অস্থির অনুভূতি… ঠিক ব্যথা-যন্ত্রণার মতো নয়, কিন্তু অন্য রকমের একটা কষ্ট!

স্টম্যাকফিলার। ক্যাপসুলটা হাতে নিয়ে একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল মেডুসা। ফয়েলের গায়ের লেখাগুলোও পড়ল।

এই একটা ক্যাপসুল আট ঘণ্টার জন্য ওই খিদে নামক কষ্টটাকে দূরে সরিয়ে রাখে। একই সঙ্গে শরীরকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি, অর্থাৎ ক্যালরি-ভিটামিন-মিনারেলসের যাবতীয় চাহিদাও পুরোপুরি সাপ্লাই দেয়। এটা অবিশ্যি মেডুসা আগে থেকেই জানে যে, ২০৮০ সালে এক জাপানি সায়েন্টিস্ট এই ক্যাপসুল আবিষ্কার করে নোবেল প্রাইজ পান।

আরও অনেকগুলো ব্যাপার জানার কৌতূহল হচ্ছে মেডুসার। সে আবার গুটিগুটি পায়ে মায়ের কাছে গিয়ে বসল।

‘আচ্ছা, মা…’

মা তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। তিনি জানেন, মেয়ের বয়স দশ হলে কী হবে, কৌতূহল অসীম। ল্যাপটপ বন্ধ করে মা বললেন, ‘কী?’

‘এই যে স্টমাকফিলার ক্যাপসুল, এটা তো আবিষ্কার হয়েছে মাত্র চল্লিশ বছর। তার আগে কী করে খিদে তাড়াত মানুষ?’

‘ওরে বাব্বা! সে এক বিরাট ঝামেলা ছিল, বুঝলি? তখন নানারকম খাবার খেয়ে পেট ভরিয়ে রাখতে হত।’

‘খাবার!’

মেডুসা বেশ অবাক। জন্মে থেকে এ পর্যন্ত শুধুমাত্র ক্যাপসুল খেয়েই সে বড় হয়েছে, অন্য কোনও ধরনের খাদ্যবস্তুর কথা তার ধারণাতেই নেই। ‘কীরকম জিনিস ছিল সেসব?’

‘অনেকরকম। ভেজিটেবলস, মানে ফল-মূল, শাক-সবজি ছিল। ননভেজ, মানে অ্যানিম্যাল প্রোডাক্ট ছিল। জীবজন্তুর মাংস, ডিম, দুধ… এই সব দিয়ে নানা রকম খাবার তৈরি হত।’

‘অ্যানিম্যাল… মানে অন্য প্রাণীগুলোকে খাওয়া হত? মেরে ফেলে তাদের মাংস খেত লোকে?’

‘হ্যাঁ রে, মা। তখনকার দিনে ওইরকমই রীতি ছিল। মাংস পাওয়া যাবে বলে পশু-পাখির ফার্ম তৈরি করা হত। সেখানে তাদের পুষে-টুষে তারপর…’ মা বাক্যটা শেষ করলেন না।

‘হাউ ক্রুয়েল!’ মেডুসা নাক-মুখ কুঁচকে ফেলেছে। ‘তুমিও তোমার ছোটোবেলায় খেয়েছ, তাই না মা?’

‘না, অ্যানিম্যাল প্রোডাক্ট তো সেই কবে, ২০৫০ সাল নাগাদই বন্ধ হয়ে গেছে। সারা পৃথিবীতে ওই সময় জীবজন্তু কমে এসেছিল। কত ধরনের পশু-পাখি তো বিলুপ্তই হয়ে গেল। প্রাণীহত্যার বিরুদ্ধে পশুপ্রেমীরা জোরদার আন্দোলন শুরু করেছিলেন, বিজ্ঞানীরাও অ্যানিম্যাল প্রোটিনের জন্য বিকল্প পথ দেখাচ্ছিলেন। তারপরেই সারা পৃথিবীতে কড়া আইন চালু হয়ে গেল। জীবজন্তু মেরে ফেলে মাংস খাওয়া নিষেধ সেই থেকে। আমাদের ছোটবেলায়, মানে চার-পাঁচ বছর অবধি, আমরা রান্না-করা খাবার খেয়েছি ঠিকই— কিন্তু সেই সমস্তই ভেজিটেরিয়ান ফুড।’

‘তারপর, ক্যাপসুল আবিষ্কার হতে সেসবও বন্ধ হয়ে গেল?’

মা হাসলেন। ‘হবে না তো কী? লাইফ ফাস্ট হচ্ছিল, ঝামেলা এড়াতে চাইছিল মানুষ। রান্নাবান্না করার ঝক্কি কি কম? সাতসকালে বাজারে দৌড়ানো, গলদঘর্ম হয়ে বোঝাই করা, থলি বয়ে আনা। সেসব কোটো রে, বাছো রে। তারপর আগুনের আঁচে আর তেল-মশলার ঝাঁঝে নাকের জলে চোখের জলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রান্না। তারও পরে সাজিয়ে-গুছিয়ে বসা, মেখে-জুখে, চিবিয়ে গিলে খাওয়া। যেমন পরিশ্রম, তেমনই সময়ের অপচয়। শুধু স্টমাকটুকু ভর্তি রাখার জন্য এত কাণ্ড!’

মেডুসা কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘এখন আর সারা পৃথিবীতে কোত্থাও আগের মতো রান্না হয় না?’

‘হয়, তবে সে খুব কম। যারা একদম গরিব মানুষ, ওই অত দামি ক্যাপসুল কেনার পয়সা নেই যাদের— তারা কোনওরকমে সামান্য সবজি-টবজি চাষ করে রেঁধে খায়। অবশ্য এখন সারা পৃথিবীতেই মাটির উর্বরতা প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। সামান্য শাকসবজি, শস্য ফলাতেই তাদের নাজেহাল হতে হয়। জ্বালানিরও খুব আকাল। তবুও কোনওরকমে ওরা পেট ভরায়।’

‘তার মানে, ওদের পেট ভরাতেই প্রচুর টাইম আর লেবার চলে যায়, বলো মা?’ চিন্তিত গলায় বলল মেডুসা।

‘হ্যাঁ, সোনা,’ মা খুব আস্তে আস্তে বললেন, ‘গরিব মানুষদের চিরকালই খুব কষ্ট। একশো বছর আগেও ছিল, এখনও তাই। একটাই তফাৎ— এখন গরিব মানুষের সংখ্যাটা আগের চেয়ে অনেক কমেছে।’

মেডুসার স্বভাবই হচ্ছে যে-কোনও সাবজেক্ট যথাসম্ভব ডিটেলসে খোঁজ নেওয়া। আগেকার দিনের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা খুঁটিয়ে জানবে বলে সে নেট খুলে বসে পড়ল।

ওয়েবসাইট ঘাঁটতে ঘাঁটতে মেয়ের চক্ষু চড়কগাছ। বাপ রে বাপ! শুধুমাত্র স্টমাকটুকু ভর্তি করার জন্য কত রকম এলাহি কারবারই না করেছে ওই যুগের মানুষেরা! প্রচুর মগজ খাটিয়ে, জটিল সব কায়দা-কানুন বানিয়ে, বিপুল অর্থ উড়িয়ে… দিনের অর্ধেকটা সময় শুধু খাবার তৈরি আর সেসব পেটে চালান দেওয়ার কাজে ব্যয় করা! এই বাইশ শতকে দাঁড়িয়ে ভাবাই যায় না।

যত জানছে তত অবাক হচ্ছে মেডুসা।

একদম শুরুর দিকটায়, মানে সভ্যতার গোড়ায় নাকি কাঁচা মাংস খেত মানুষ। একেবারে বাঘ-সিংহের মতো, বন্য মাংসাশী জন্তুই ছিল বলা যায়। তারপর মাংস আগুনে ঝলসানো শুরু হল। আস্তে আস্তে চালু হল তেল-নুন-মশলাপাতির ব্যবহার। ওদিকে হরেকরকম ভেজিটেবলস খাওয়াও বাড়তে লাগল। খাদ্যবস্তুর রেঞ্জ দেখে মেডুসার মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়! হেন কোনও জিনিস নেই যা মানুষ খেত না। সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের ফুড হ্যাবিট মিলিয়ে দেখলে, সেই তালিকাতে সমস্ত স্পিসিস-এর প্রাণী রয়েছে। পোকামাকড় থেকে শুরু করে মাছ, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী, পাখি… কোনওটা বাদ নেই। ইশ! ভাবতেই গা’টা ঘিনঘিন করে ওঠে মেডুসার। স্ক্রিনে সেকালের বিভিন্ন নন-ভেজ ডিশ রান্নার ছবি দেখাচ্ছে— চিকেন, মাটন, প্রন, ফিশ, স্কুইড, লবস্টার… বিচ্ছিরি লাগছে, জ্যান্ত প্রাণীদের মেরে ফেলে, কাঁটা-হাড়-দাঁড়া সমেত কচরমচর করে খাওয়া… ছি, ছি!

ছবিগুলো সরিয়ে দেয় মেডুসা। ভেজ ফুডগুলোর দিকে নজর পড়ল এবার। ও বাবা! এখানেও তো বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সমস্তই হাজির। কোনও গাছের পাতা খেয়েছে মানুষ, তো কোনও গাছের কাণ্ড। কারো আবার শিকড় খুঁড়ে বার করে খেয়েছে। শাক বলে যেগুলো খেত, সেগুলো তো আগাপাশতলা পুরো গাছটাই। ফল তো বটেই, কোনও কোনও গাছের ফুল অবধি রান্না করেছে। ফুল তো একটা ডেকোরেশনের জিনিস, কত সুন্দর— ফুল আবার খায় কেউ! কী যে রুচি ছিল সে যুগের মানুষদের, ভেবে পায় না মেডুসা।

রান্না আর খাওয়া। এই দুটো কাজই আজকের এই ২১২১ সালে অপ্রয়োজনীয় হয়ে এসেছে। দুনিয়ার আশি শতাংশ লোক আজ ক্যাপসুলের ওপরেই নির্ভর করে চালিয়ে যায়। কিন্তু একশো বছর আগের ছবিটা দেখে মেডুসা হতবাক। রান্না, শুধুই রান্না করার জন্য বাড়িতে আলাদা ঘর রাখত সে যুগের মানুষেরা। সেই ঘরটুকুর পিছনে আবার কত যত্ন, কত ব্যয়বহুল সব আয়োজন! খাওয়ার জন্যও আলাদা ঘর! আলাদা ফার্নিশিং, ইউটেনসিলস, ডেকোরেশন, গ্যাজেটস…! কী বোকার মতো অপচয়, ভাবে মেডুসা। একটু অবস্থাপন্ন লোকেরা আবার রান্নার জন্য আলাদা মাইনে করা সার্ভেন্ট রাখত। কী কাণ্ড!

শুধু বাড়িতে বসে খাওয়া নয়, সেকালের মানুষের আবার বিচিত্র শখ ছিল। ওই একই খাবার বাইরের দোকানে খেতে যেত। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ফুড কর্নার— এইসব জায়গায় বসে বসে খাবার খেত, তার বদলে মোটা বিল পে করত হাসিমুখে। সোশ্যাল কোনও অকেশন থাকলে পাঁচ-ছ’শো-হাজার লোককে ইনভাইট করে প্রচুর খাবার ঠেসে খাইয়ে দিত। এটা না করলে নাকি সম্মান থাকত না। হাউ ফানি!

কনক্লুশন হিসেবে যেটা পাওয়া গেল সেটা ভারি মজাদার মনে হল মেডুসার। ওই যুগে খাওয়া-দাওয়া ব্যাপারটা সঙ্গে একটা সামাজিক মান-মর্যাদার ব্যাপারও জড়িয়েছিল দেখা যাচ্ছে। মানে, যে যত বেশি-বেশি করে ওইসব খিটকেল আর জবরদস্ত খাবার খেতে পারত, প্রোভাইড করার ক্ষমতা রাখত— সে তত হাই ক্লাসের মানুষ! আর, কম খাবার জুটত যার— কিংবা নেহাত সাদামাটা— সে হচ্ছে নিচু গ্রেডের লোক। হাসির ব্যাপার নয়? একশো বছর আগেও, ধরা যাক ২০২১ সালেই, বিরিয়ানি-কোরমা-মালাইকারি খেত সমাজের উঁচুতলার সচ্ছল মানুষেরা। আর দীনহীন যারা, তারা খেত আলুসেদ্ধ-ভাত। অনাহার মানেই চূড়ান্ত দারিদ্র্য।

আর আজ? কেমন উলটে গেছে দ্যাখো সিস্টেমটা! রান্না করে খাওয়াটাই আজ প্রিমিটিভ। শুধু গরিব মানুষরা, যারা হচ্ছে হ্যাভ নটস্‌ তারাই খায় কেবল। আর অর্থবানেরা খাওয়া-দাওয়ার হাঙ্গামা ছেড়ে দিব্যি ফুরফুরে অনাহারী। স্রেফ দিনে তিনটে ক্যাপসুল, ব্যস!

মেডুসা যদি কোনওদিন প্রেসিডেন্ট হয়, প্রথমেই গরিব মানুষদের জন্য কম দামে স্টমাকফিলার বরাদ্দ করে দেবে। রান্না আর খাবার ঝক্কি থেকে মুক্তি দেবে বেচারিদের!

এর ঠিক তিন দিনের মাথায় মেডুসার এযাবৎকালের জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনাটা ঘটে গেল।

তাদের হাউসিং কমপ্লেক্স-এর ফাঁকা জমিটাতে বিকেলবেলায় ইলেক্টো-ক্রিকেট খেলছিল তারা সাত-আটজন। আগেকার দিনে কাঠের ব্যাট দিয়ে বল মারা হত, সেই খেলাটা এখন ইলেকট্রনিক কন্ট্রোল সিস্টেমে খেলা হয়। বল আছে, ব্যাটও আছে, কিন্তু হাত দিয়ে জোর লাগাতে হয় না, রিমোটের মাধ্যমেই মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ক্রিকেটের ইতিহাসও ঘেঁটে দেখেছে মেডুসা। এক সময় নাকি শুধু ছেলেরাই খেলত ক্রিকেট, মেয়েরাও এক্সেল করতে শুরু করেছে মাত্রই সওয়া-শ’ বছর হল। কেন যে আগে মেয়েরা খেলত না কে জানে… মেডুসার তো দারুণ লাগে খেলতে!

সেভেন্‌থ ফ্লোরের ডিসুজা খুব বিগ হিট করে। মিড উইকেটের মাথার ওপর দিয়ে বলটা লিফট করতেই সেটা গ্যারাজের ছাদে ড্রপ খেয়ে পিছন দিকটাতে কোথাও গিয়ে পড়েছিল। যেহেতু ওদিকটাতে মেডুসা ছিল একমাত্র ফিল্ডার, তাকেই যেতে হল বলটা খুঁজে আনার জন্য।

গ্যারাজের পিছনে কতকগুলো ছোট-ছোট খুপরি আছে। ওখানে কমপ্লেক্সের কয়েকজন কর্মচারী থাকে। সাফাই কর্মী, লিফটম্যান, ডোরকিপার— এইরকম সব। সচরাচর ওদিকে যাওয়ার দরকার পড়ে না কারো। মেডুসা তো আজই প্রথম পা রাখল।

বলটা গেল কোথায়? গ্যারাজের ছাদটা একবার দেখে নিয়ে ড্রপ খাওয়ার আন্দাজটা করতে চাইল মেডুসা। সামনেই একটা ছোট্ট ঘর। নিচু ছাদ, ছোট ছোট জানলা, ভেতরটা অন্ধকার-মতো। কে থাকে ও ঘরটাতে, জানে না সে। কিন্তু… ওখানেই ঢুকে যায়নি তো বলটা?

অজানা-অচেনা ঘরদোর। উঁকি দেওয়া ঠিক হবে কিনা, এই দ্বিধা নিয়েই মেডুসা মুখটা বাড়াল। টিমটিমে একটা আলো জ্বলছে ঘরে। কেউ একজন পিছন ফিরে বসে কিছু একটা করছে, দরজার বাইরে থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।

মেডুসা একটু গলাখাঁকারি দিল।

‘কে?’

যিনি মুখ ফিরিয়ে তাকালেন মেডুসা তাঁকে আগে দেখেনি কোনওদিন। তবে ঠিক তাঁর মতো দেখতে একজনের ছবি টাঙানো আছে তাদের ড্রইং-রুমের দেওয়ালে। মেডুসার জন্মের আগেই মারা গিয়েছেন যে-ঠাম্মা, অবিকল তাঁর মতোই যেন দেখতে এই বৃদ্ধাকে! শুধু এঁর কাপড়টা একটু ময়লা আর কোঁচকানো, এই যা।

বৃদ্ধা এগিয়ে আসছেন।

‘ও মা, এ যে ছোট্ট পরি গো! এসো না দিদিভাই, ভেতরে এসো। কাদের বাড়ির খুকি তুমি?’ হাসির সঙ্গে সঙ্গে ফোকলা মাড়ি দেখা গেল।

খুব ভালো লাগল মেডুসার। কথাগুলোতেও যেন মোলায়েম আদর মাখানো। সমস্ত ঠাম্মারাই বুঝি এরকমভাবে কাছে টেনে নেন? মেডুসা ঘরের মধ্যে ঢুকল।

‘আমি একটা বল খুঁজছি। আপনি কোনও শব্দ শুনেছেন?’

‘না তো, রানী। এই কম আলোতে আজ কি আর খুঁজে পাবে? আমি আমার ছেলেকে বলব ’খন, কাল সকালে খুঁজে রাখবে। তুমি কাল বেলার দিকে এসে নিয়ে যেও, কেমন?’

‘আপনার ছেলে… কে বলুন তো?’

‘সনাতন গো, দারোয়ানের কাজ করে— চেনো নিশ্চয়ই। তুমি ক’তলায় থাকো সোনাদিদুন?’

‘নাইনথ্‌-এ। ইয়ে…আপনি ওটা কী করছিলেন?’ প্রশ্নটা প্রায় আপনা থেকেই মেডুসার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, কারণ ইতিমধ্যেই তার চোখ চলে গেছে ঘরের কোণটাতে— যেখানে একটু আগে বৃদ্ধা উবু হয়ে বসেছিলেন। দৃশ্যটা যেন তার চেনা-চেনা ঠেকছে, ক’দিন আগেই ওয়েবসাইটে ঠিক এরকম একটা ছবি দেখেছে সে। আগুন জ্বলছে একটা গোল-মতো চোঙায়, কী যেন বলে— হ্যাঁ, উনুন! তার ওপর একটা পাত্র বসানো। একেই তো রান্না করা বলে!

বৃদ্ধা একবার পিছনের দিকে তাকিয়ে নিলেন, তারপর তার দিকে চেয়ে হাসলেন আবার।

‘পায়েস রাঁধছি গো সোনা। আজ তো সনাতনের জন্মদিন, জন্মদিনের পায়েস দিতে হয়। ওহ্‌, তুমি তো জানবে না দিদিভাই, তুমি কক্ষনো কিছু খাও-টাওনি, তাই না? শুদ্ধু ক্যাপসুল! ঠিক বলছি?’

মেডুসার ভুরু কুঁচকে গেছে। এরা রান্না করে, খাবার খায়, তার মানে গরিব মানুষ। হ্যাভ-নটস্‌! কিন্তু এই ঠাম্মার গলায় তো কোনও দুঃখের সুর নেই। খুব যত্ন করে, ভালবেসে এই ডিশটা প্রিপেয়ার করছেন— পায়েস না কী যেন নাম! জন্মদিনে ছেলের জন্য এটাই ওঁর গিফট?

মেডুসার জন্মদিনে বাবা-মা তাকে নানারকম গ্যাজেটস আর গেমস উপহার দেন। ডিসুজার বাবা-মা কিংবা নিমপির বাবা-মাও তাঁদের ছেলেমেয়েদের ওইসবই দিয়ে থাকেন। বাট দিস ইস সার্টেনলি আ ডিফারেন্ট ওয়ান! একটা বড় শ্বাস টেনে নিতে নিতে মেডুসা ভাবল। দারুণ একটা গন্ধ আসছে ওই পাত্রটার ভেতর থেকে! কেন কে জানে হঠাৎ করে মেডুসার মুখের ভেতরটা ভিজে ভিজে লাগতে শুরু করেছে।

বৃদ্ধা মহিলা, যাঁকে মেডুসা ‘ঠাম্মা’ ডাকবে বলে এরই মধ্যে মনস্থির করে ফেলেছে, ওর দিকে তাকিয়ে আছেন একদৃষ্টিতে। হঠাৎ একটু ঝুঁকে এসে প্রায় ফিসফিস করে বললেন, ‘একটুখানি খাবে, দিদুন? খাও না, খেয়ে দ্যাখো, আমি বলছি ভালো লাগবে ঠিক!’

মেডুসা চমকে উঠল। কী বলছেন এই ঠাম্মা! তাদের প্রজন্মের কেউ কোনওদিন কোনও খাবার মুখে নেয়নি। একটু ভয় ভয় করে মেডুসার। অথচ ডিশটার সুগন্ধ তাকে অস্থির করে তুলেছে।

‘ইয়ে, ওটার কম্পোনেন্টস… মানে, কী দিয়ে তৈরি?’ কাঁপা-কাঁপা গলায় জানতে চাইল মেডুসা।

‘সব ভালো-ভালো জিনিস গো দিদুন। অনেক খুঁজেপেতে জোগাড় করা। দুধ, চাল, চিনি, কিশমিশ… দারুণ স্বাদ, মিষ্টি মিষ্টি!’

স্বা-দ! মি-ষ্টি! …কথাগুলো সঙ্গে পরিচয় নেই মেডুসার। কিন্তু তার মনে হল, একটু জানতে হবে ব্যাপারটা। অন্তত, ক্ষতিকর কিছু হতে দেবেন না এই ঠাম্মা, এটুকু নিশ্চিত।

‘একদম একটুখানি কিন্তু, অ্যাঁ?’ তর্জনী আর বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে পরিমাণটা দেখাল মেডুসা।

বৃদ্ধা ফোকলা হাসি হাসতে হাসতে একটা বাটিতে তিন-চার চামচ সাদা অর্ধতরল বস্তুটা তুলে আনছেন। ‘দাঁড়াও, একটু ঠান্ডা হোক, কচি জিভে ছেঁকা না লাগে,’ ছোট্ট একটা পাখা দিয়ে হাওয়া করতে করতে বললেন, ‘কী ব্যবস্থাই হল দিনে দিনে, আহা বাছারা জন্মদিনে একটু পায়েস পর্যন্ত পায় না!’

চামচটা মুখের সামনে এগিয়ে আসার সময় খুব জোরে একবার বুক ঢিপঢিপ করে উঠল মেডুসার। কে জানে কী হবে! মা যদি জানতে পারে…

চোখটা বুজে ফেলে সে চামচটা জিভে রাখল।

এরপরের মুহূর্তের অনুভূতিটা মেডুসা কোনওদিনই ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না। বিস্ময়-আহ্লাদ-তৃপ্তি মেশানো কীরকম একটা শিহরন! আহ্‌! এত আশ্চর্য রকমের ভাল ব্যাপারটা, এত অপূর্ব… এইটুকু মেডুসা হলফ করে বলতে পারে, এই ঘটনার চেয়ে ভাল কিছু তার জীবনে এর আগে ঘটেনি। মুখের মধ্যে তৈরি হতে থাকা অভূতপূর্ব একটা সুখ যেন বিহ্বল করে দিচ্ছিল তাকে। তার চোখ-মুখের অবস্থা দেখে বৃদ্ধা হেসে ফেললেন।

‘কেমন দিদিভাই, মিষ্টি না? কত ভালো বল দেখি!’

মেডুসা কথা বলতে পারছে না। একেই বলে স্বাদ? এরই নাম মিষ্টি… এই অভূতপূর্ব সুখ যা তার জিভ জুড়ে রয়েছে? হায়, এত বছর ধরে শুধুই ক্যাপসুল গিলে এসেছে মেডুসা! প্রকৃতি তার জিভের কোরকগুলোতে এত আনন্দের আয়োজন সাজিয়ে রেখেছে, অথচ সে ব্যবহার করেই দেখেনি!

ভেবে পায় না মেডুসা— কী করে তার আগের প্রজন্মের মানুষেরা শুধুই পাকস্থলী-ভরানোটাকে একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে ধরে নিল, স্বাদের আনন্দটাকে একটুও মূল্য না দিয়ে!

‘আরো একটু খাও, পরী আমার। আহা, জীবনে কিচ্ছুটি খেতে পায়নি বেচারি!’ বৃদ্ধার কণ্ঠে স্নেহ উপচে পড়ছে। মেডুসার চোখে জল চলে এল।

গরিব ডোরকিপার সনাতনকাকুকে হঠাৎই খুব ঈর্ষা করতে ইচ্ছে হচ্ছিল তার। মনে হচ্ছিল, এই পৃথিবীতে যারা সো-কলড বড়লোক, ক্যাপসুল খেয়ে রান্নাবান্নার ‘ঝামেলা’ এড়িয়েছে— প্রকৃত গরিব তারাই। তারা কী হারিয়েছে নিজেরাই জানে না!

তবে, একটা ব্যাপার এর মধ্যেই মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে মেডুসা।

সামনের মাসে তারও জন্মদিন আসছে। বাবা বলেছেন, এবারের বার্থ-ডেতে তাকে একটা রোবো প্রেজেন্ট করবেন। হয়তো আজকালের মধ্যেই ক্যাটালগ নিয়ে এসে তাকে মডেল চুজ করতে বলবেন। মেডুসা কিন্তু সেই ক্যাটালগ উলটেও দেখবে না। রোবো চাই না তার। কোনও খেলনা, কোনও গেমস— কিচ্ছু নেবে না সে।

তার বদলে সে মাকে জড়িয়ে ধরে বলবে, ‘জন্মদিনে পায়েস রেঁধে দিতে হবে। যেভাবেই হোক, যেমন করেই হোক! ‘না’ বললে শুনছি না কিন্তু!’

(পরিমার্জিত পুনঃপ্রকাশ)

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *