short-story-megher-waiting-room

মেঘের ওয়েটিংরুম
রেহান কৌশিক


আশ্চর্যের বিষয়, সান্যালবাবু যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে”সত্যি?”

“সত্যি মানে! কী বলতে চাইছ, তুমি?”

“মানে আপনি যা বলছেন, তা তো সচরাচর…”

“স্পষ্ট করে বললেই তো পার যে আমি মিথ্যে কথা বলছি।”

“কী যে বলেন, মেসোমশাই! প্রশ্নটা সত্যি-মিথ্যের নয়। কথাটা হল, বাস্তবে তো আর এমনটা…”

“দেখা যায় না, তাই তো? পল্লব, তুমি তো এক্ষুনি বাস্তবতার কথা বললে, আচ্ছা বলো তো, বাস্তবতা কাকে বলে?”

“ইয়ে মানে… যা চোখে দেখা যায়। অভিজ্ঞতা দিয়ে যে ঘটনাগুলো সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে…”

“জীবনের কতটা অংশ তুমি চোখে দেখতে পাও? কতটাই-বা অদেখা থাকে? বেঁচে-থাকার সীমানা ঠিক কোথায়? সীমানার এপারে কী আছে? ওপারেই-বা কী আছে?”

“আপনি দর্শনের অধ্যাপক। এসব বিষয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলার যোগ্যতা আমার নেই। তবে, আমি কোনো অলৌকিক ঘটনায় বিশ্বাস করি না। আমরা এজলাসে যখন সওয়াল করি, সবই প্রমাণ-নির্ভর। প্রমাণটাই শেষ কথা।

সেখানে আবেগ, অলৌকিকতার কোনো জায়গা নেই। তাই আপনি যা বলছেন, তা মানতে আমার…”

“অসুবিধে হচ্ছে। তাই তো? আমার কথাগুলো তোমার অলৌকিক বলে মনে হচ্ছে?

হ্যামলেট হোরাশিওকে কী বলেছিল, জানো? বলেছিল— There are more things in heaven and earth, Horatio, than are dreamt of your philosophy.”

“একটি নাটকে শেকসপিয়র তাঁর চরিত্রের মুখ দিয়ে কী বলিয়েছেন, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সেই কথাকে ধ্রুবসত্য বলে আঁকড়ে ধরাটা কি খুব সংগত হবে, মেসোমশাই?”

“শরতের পূর্ণিমায় কোনো গ্রামের পদ্মদিঘি দেখেছ? দেখেছ, সেই দিঘিতে পদ্মকুঁড়িদের জ্যোৎস্নার মশাল হয়ে জ্বলে থাকতে?”

“না।”

“হেমন্তের শালজঙ্গল দেখেছ? দেখেছ, শালের সবুজ পাতায় বানানো পিঁপড়েদের ঘর? সেই ঘরে তাদের বিবাহ উৎসব?”

“না।”

“দুর্গা টুনটুনির খ’সে পড়া পালক কোনোদিন হাতে তুলে দেখেছ? দেখেছ, কালচে-নীল পালকে ঝিকিয়ে ওঠা রোদের নীলাভ দ্যুতি? যে-দ্যুতি হিরের উজ্জ্বলতাকে হেলায় হারিয়ে দেয়?”

“না।”

“শোনো, মানুষ যা চোখে দেখে, তারচেয়ে না-দেখার পরিমাণ চিরকাল বেশি। না-দেখা সেই জগতকে মানুষ যখন তার সীমায়িত দেখার অভিজ্ঞতা দিয়ে যাচাই করতে যায়, তখনই হয় মুশকিল। তার না-দেখা মানেই যে তা নেই, এমন নয়।”

“তার মানে মাসিমার সঙ্গে আপনার নিয়মিত দেখা হয়? কথা হয়?”

“আলবাত।”

“অর্থাৎ, ওই পাকদণ্ডি পথ ধরে নেমে পাইনবনের মাঝ বরাবর হেঁটে গেলে যে নির্জন হ্রদ রয়েছে, সেই হ্রদের পাশে মাসিমা আসেন?”

“হ্রদের পাড়ে একটা বড় পাথর আছে। অনেকটা বেঞ্চের মতো। দেখেছ নিশ্চয়?”

“তা দেখেছি।”

“ওখানে বসি। কখনো হ্রদের জলের ধার দিয়ে হাঁটি। হাঁটতে হাঁটতে গল্প করি।”

“কী কথাবার্তা হয়, সেটা মনেহয় আমার জানতে চাওয়া অনুচিত হবে?”

“সচরাচর বৃদ্ধ দম্পতির যেমন কথাবার্তা হয়, তেমনই। তবে তোমার মাসিমার বেশকিছু আশ্চর্য ক্ষমতা রয়েছে।”

“আশ্চর্য ক্ষমতা! কীরকম?”

“কেন, তুমি জানো না? অনীক কিংবা বউমা তোমাকে কিছু বলেনি?”

“বলেছে। তবে মাসিমার নয়। আপনার। যেমন, রুশো নাকি কলেজে ক্লাস বাঙ্ক করে বন্ধুদের নিয়ে রেঁস্তোরাঁয় আড্ডা দিয়ে বেড়ায়। এ-কথা আপনার জানার কথা নয়, অথচ আপনি জেনে গেছেন। অথচ, রুশোর কলেজের কারও সঙ্গে আপনার জানাশোনা নেই।

পাশের পাড়ার সান্যালবাবু হাসপাতালে ভর্তি। রক্ত লাগবে। রেয়ার গ্রুপ বলে পাওয়া যাচ্ছিল না। আপনি আপনার এক পুরোনো ছাত্রকে পাঠিয়ে সে যাত্রায় সান্যালবাবুকে বাঁচিয়ে দেন। ন, তা আপনি জানতেন না। তার যে এবি নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত জরুরি, সেটাও আপনার জানার কথা ছিল না। এই সমস্ত ঘটনাগুলো আমাদের প্রতিনিয়ত অবাক করছে।”

“নাতির কলেজের ঘটনাই বলো বা সান্যালবাবুর রক্তের কথা, সবই তোমার মাসিমা আমাকে বলেছে। তার কাছ থেকেই আমি জেনেছি।”

“কী বলছেন, আপনি!”

“যা শুনছ, ঠিক তাই। তোমার মাসিমা সবকিছু দেখতে পায়। এবং সে যা দেখে, সেগুলো আমাকে বলে।”

“কিছু মনে করবেন না, মেসোমশাই, আমি উকিল মানুষ, ঠোঁটকাটা বলে দুর্নামও আছে। আপনার এই গল্পগুলো আমাকে মোটেই ইমপ্রেস করছে না।”

“তোমাকে ইমপ্রেস করার কোনো দায় কি আমারও আছে, পল্লব?”




“কী শুরু করলে বলো তো?”

“কেন? আমি আবার কী করলাম?”

“কোনো দরকার ছিল পল্লবদাকে ইনভলবড করার? রোব্বারের সকালটা বাবাকে কী সব যেন জেরা করে কাটিয়ে দিল!”

“আরে, জেরা নয়। জাস্ট এমনিই গল্প করার ছলে বাবার মেন্টাল-স্টেটাসটা বোঝার চেষ্টা করছিল।”

“বাবা তো আর ভাববেন না যে তার ছেলে পল্লবদাকে পাঠিয়েছে। ভাববেন, বউমা-ই বুঝি কায়দা করে দাদাকে পাঠিয়েছে জেরা করার জন্যে। পল্লবদা কীরকম যেন বিচ্ছিরি একটা মুখ নিয়ে চলে গেল।

কথা বলার হলে তুমি নিজে সরাসরি কথা বলতে পারতে। তাছাড়া, এসব নিয়ে কথা বলারই-বা কী আছে?”

“কথা বলার যথেষ্ট কারণ আছে। দেখছ না, দিনদিন বাবার আচরণ কেমন অসংলগ্ন মনে হচ্ছে। রীতিমতো ক্লেইম করছে যে মায়ের সঙ্গে তার নিয়মিত দেখা হয়।”

“মে বি এটা হ্যালুসিনেশন।”

“আমারও তাই ধারণা। আমার মনেহয় রিনাউন্ড কোনো সাইক্রিয়াটিস্টের সঙ্গে কনসাল্ট করা উচিত।”

“তা করো। কিন্তু একটা ব্যাপার আমার কাছে বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে।”

“কীরকম?”

“বাবা কিন্তু জেনুইন প্রেমিক। আ রিয়েল লাভার।”

“হোয়াট! রিয়েল লাভার?”

“নয় তো কী? দেড় বছর হল মা মারা গেছেন, কিন্তু কথা বললে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই মায়ের প্রসঙ্গেই এসে পড়েন। বাবার চিন্তায় চেতনায় মা জড়িয়ে আছেন।”

“আর আমি? আমি তোমাকে ভালোবাসি না?”

“তুমি একটা ঢ্যাঁড়স। ভালোবাসো না, ছাই।”

“বলতে পারলে?”

“আহ্, ছাড়ো ছাড়ো। দুপুরবেলা কী শুরু করলে…”

“রিয়েল লাভার কিনা প্রমাণ করেই ছাড়ব।”

“থাক। অনেক হয়েছে। ছাড়ো। রুশোর ফেরার সময় হয়ে গেছে।”

“প্রেমিক হওয়ার চান্স দিচ্ছ না অথচ অপ্রেমিক বলে অভিমান করতেও ছাড়ছ না, ইটস নট ফেয়ার, মিলি। জোকস অ্যাপার্ট, যেসব ঘটনার সঙ্গে বাবার সরাসরি কোনো যোগ নেই, সেগুলোও কেমন করে জানি না সে জেনে যাচ্ছে! ব্যাপারটা অদ্ভুত না?”

“তবু ভালো, কোনো ঘটনার আগাম পূর্বাভাস দিচ্ছেন না। লোকে বলত, দর্শনের অধ্যাপক হৃদয়নাথ চৌধুরি এখন গ্রেট নস্ট্রাদামুস।”

“হেসো না। ব্যাপারটা যেমন সিরিয়াস, তেমনই মিস্টিরিয়াস।”

“মিস্টিরিয়াস ঠিকই, কিন্তু সিরিয়াস কি?”

“সিরিয়াস নয়?”

“অনীক, বাবাকে নিয়ে তুমি একটু বেশিই ভাবছ। তাছাড়া, আমার তো মনে হয় ব্যাপারটা বেশ মজার। বাবা না জানালে রুশোর ব্যাপারটা কি আমরা জানতে পারতাম?”

“রুশোর বিষয়টা জেনে আমরা ওকে বোঝাতে পেরেছি, এটা ঠিক। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই মজার নয়।”

“কেন?”

“দুনিয়াতে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী, জানো?”

“কী?”

“ক্লাইমেট চেঞ্জ নয়। ইকোনমিক রিসেশন নয়। পোভার্টি নয়। নিউক্লিয়ার ডিপ্লোমেসি নয়। চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে পারসোন্যাল ডাটা সেফ রাখা। ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত রাখা।

তোমার ইচ্ছে-অনিচ্ছে, চাওয়া-না-চাওয়া, স্বপ্ন-অস্বপ্ন, দুঃখ-আনন্দ সব, সমস্ত তথ্য আজ বেরিয়ে যাচ্ছে। এমনকী তোমার বাথরুম, বেডরুমের তথ্যও আজ সুরক্ষিত নয়। অদৃশ্য এক নজরদারির আওতায় তুমি বন্দি। একে কি বাঁচা বলে?

কী হল তোমার এমন মুখ কালো হয়ে উঠল কেন?”

“কই! কালো হয়ে উঠবে কেন? না, তবে বিষয়টা সত্যিই সিরিয়াস।”

“আরে, প্রাইভেসির গুরুত্ব না থাকলে এমনিই কী দুই মার্কিন জুরি স্যামুয়েল ডি ওয়ারেন এবং লুইস ব্রান্ডিস ‘রাইট টু বি লেট অ্যালোন’-র পক্ষে এত সওয়াল করেছিলেন?”




“শ্রাবণী, খুব কষ্ট হয়, তাই না?”

“অত ভেব না তো।”

“ভেব না, ভেব না বলেই তো নিজের এত বড় সর্বনাশ করলে। আমাকে বুঝতেই দাওনি গত কয়েক বছর ধরে কী ভয়ঙ্কর অসুখকে নিজের শরীরে শিকড় ছড়াতে দিয়েছিলে। যখন জানলাম, তখন আর…”

“আমিও কী বুঝতে পেরেছিলাম, ভিতরে ভিতরে মারণ অসুখ কত দ্রুত আমাকে নিঃশব্দে গিলে নিচ্ছিল? জানার পর তুমি তো কম চেষ্টা করোনি, হৃদয়নাথ।”

“সে তো শেষ-মুহূর্তে। তখন আর কিছুই করার ছিল না।”

“যাক গে, ছাড়। কেন পুরোনো কথা তুলে কষ্ট পাচ্ছ, বলো তো? এখন তো দিব্যি আছি। একসঙ্গে থাকতে পারি না ঠিকই, কিন্তু এই তো দেখা হয়, কথা হয়। দেখা করার জন্য অনেকটা পথ উড়ে আসতে হয়, এই যা…”

“কত পথ, শ্রাবণী?”

“তা অনেকটাই। তবে পাখিদের চেয়ে আমাদের ওড়ার গতি অনেক দ্রুত।”

“ডানা কই? ওড়ো কী করে?”

“মেঘেদের কি আলাদা করে ডানা থাকে? পুরো শরীরটাই তো ডানা। আসলে তুমি আমাকে যেভাবে দেখো, সেটা এখানে এসে পৌঁছানোর পর আগের শরীরে ফিরি। এই ট্রান্সফরমেশানটা বেশ কষ্টের। উড়ে আসা এবং শরীর বদল ছাড়া আর কোনো ঝক্কি নেই।”

“বুঝতে পারি তোমার এভাবে আসতে কষ্ট হয়। কিন্তু তোমাকে দেখার জন্য মাঝে মাঝেই মন বড় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তাই মনে মনে ডাক দিই।”

“আনন্দ কি আমার হয় না? হয়। তাই তো আমিও উন্মুখ হয়ে থাকি কখন তুমি ডাক পাঠাবে মনে মনে।”

“এই লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল তোমার মুখ, লজ্জা পেলে এখনো তোমাকে সেই নতুন বউয়ের মতোই দেখায়, শ্রাবণী।”

“কী যে বলো না তুমি! তবে জানি না, তোমার ডাকে আর কতদিন এভাবে উড়ে আসতে পারব।”

“কেন?”

“সবকিছুরই তো একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ আছে, হৃদয়নাথ। মাটির জীবনে যেমন মেয়াদ আছে, আকাশের জীবনেও আছে। এ-মেয়াদ ফুরোলে আবার কোথায় চলে যেতে হবে, তা জানি না।”

“মহাশূন্যের জীবনে যে মেয়াদ আছে, তা বুঝলে কী করে?”

“ওয়েটিংরুম থেকে পুরোনো মুখগুলো যেভাবে একে-একে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, সেভাবেই নতুন মুখেরা এসে হাজির হচ্ছে। নিয়ত এই বদলের খেলা চলছে।”

“ওয়েটিংরুম! অপেক্ষা-ঘর!”

“এতে অবাক হওয়ার কী আছে? তুমি যেখানে আছ, সেটাও কি ওয়েটিংরুম নয়? এই পৃথিবী ওই মহাকাশের সমস্ত জায়গায়ই আসলে ওয়েটিংরুম। কিছু সময়ের জন্য আমরা সকলেই এইসব ওয়েটিংরুমে থাকি, তারপর অপেক্ষা ফুরোলে নতুন পথে উড়াল দিই। কোথাও কারও কোনো স্থায়ী-বসত বলে কিছু নেই।”

“ঠিকই বলেছ। এভাবে তো আগে কখনো ভেবে দেখিনি।”

“জানো, আমার ওয়েটিংরুমটা মেঘ দিয়ে বানানো। মেঘের ওয়েটিংরুম। নীলচে সাদা ও হালকা ধূসর রংয়ের মেঘ দিয়ে তৈরি। নরম। তুলতুলে।”

“শান্ত দুই পাহাড়ের তলদেশে নিরালা এই হ্রদ। হ্রদে টলটলে নীলজল। চারপাশে কত নাম না-জানা অর্কিড। পাইনের মনভালো-করা সবুজ। সবুজ ডালপালার ফাঁক গলে নেমে আসা বিকেলের হলদে রোদ যেন ছড়িয়ে থাকা নুড়িপাথরদের সঙ্গে এক্কাদোক্কা খেলছে।

এমন নির্জন আবহে তোমার কথাগুলো যেন কোনো এক অচিনদেশের রূপকথার গল্প। আর, গল্পগুলো চতুর্দিকে রঙিন প্রজাপতির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে।”

“কলেজে পড়ানোর সময় তোমাকে গদ্য লিখতে দেখেছি। কিন্তু কোনোদিন কবিতার একটা লাইনও লিখেছ বলে তো মনে পড়ছে না।”

“আমার কথাগুলো কি কবিতার মতো শোনাল?”

“তেমনই তো মনে হল।”

“কবিতা বা গদ্য বলে নয়, যে সুন্দরকে ছুঁতে জানে তার কাছে সুন্দর চিরকাল এসে ধরা দেয়।”

“এমন নম্র অহংকার অবশ্য তোমাকে মানায়।”

“ইয়ার্কি করো না। আমাকে কোনোদিন কোনো বিষয়ে অহংকার করতে দেখেছ? এ-আমার আত্মবিশ্বাস, শ্রাবণী।”

“সবাই যদি তোমার মতো করে ভাবত, জগতটাই বদলে যেত, হৃদয়নাথ। লাবণ্যময় কবিতা অথবা গদ্যের দেয়ালে আটকানো সুন্দরের ফ্রেমে মানুষ যদি পারস্পরিক সম্পর্কগুলো সাজিয়ে রাখতে পারত, সেই সম্পর্কের ভিতর কখনো আড়াল তৈরি হত না। অসুন্দর অথবা দূরত্বের জন্ম হত না।”

“কী জানি! জানি না কেন, বারবার মনে হয়, মানুষ নিজেদের সম্পর্কগুলোকে নিজেরাই অহেতুক জটিল করে তুলছে, শ্রাবণী। হয়তো-বা এ এক আশ্চর্য অসুখ।”

“হয়তো তাই।”




“তুমি-ই-ই!”

“আঁতকে উঠলে কেন? আসতে পারি না?”

“এখানে তো কখনো আস না!”

“তা আসি না। কিন্তু আজ এলাম।”

“তোমার কলেজ নেই?”

“থাকবে না কেন? লিভ নিয়েছি।”

“কফি চলবে?”

“না। দুপুরে বরং একসঙ্গে লাঞ্চ করব।”

“লাঞ্চ! অ্যাকচ্যুয়ালি, আমি খুব ব্যস্ত আছি নতুন প্রজেক্টটা নিয়ে।”

“অনীক, তুমি আমাকে অ্যাভোয়েড করছ?”

“কী যে বলো! অ্যাভোয়েড করব কেন?”

“তাহলে! ফোন করছ না। আমি ফোন করলে সেভাবে কথা বলছ না! নিতান্ত দায়সারাভাবে কথা বলে রেখে দিচ্ছ? কী ব্যাপার, বল তো? মিলির সঙ্গে কিছু হয়েছে?”

“আমাদের কথার ভিতর মিলিকে আনছ কেন? মিলি আবার কী বলবে?”

“আফটার অল সে তোমার বউ, কিছু কি বলতে পারে না?”

“এইসব কথা বলার জন্য এলে?”

“না, তা আসিনি।”

“তাহলে? শোনো, আমি একটা ঝামেলায় আছি। সামলে উঠি। পরে সবকিছু বলব।”

“আমাকে দেখে এত অস্থির হয়ে উঠেছ কেন?”

“অস্থির! নাহ্। কই না তো।”

“এমন করছ যেন আমি বলতে এসেছি, অনীক আমি তোমার সন্তানের মা হতে চলেছি, আজই আমায় বিয়ে করো।”

“ডিসগাস্টিং…”

“আমি ডিসগাস্টিং? বাহ্, অনীক বাহ্!”

“স্টপ কাবেরী, স্টপ। ফর গড সেক, তুমি থামো। তোমাকে মিন করিনি। আমার ভয়ানক সমস্যাটার কথা ভাবতেই শব্দ বেরিয়ে গেল। তুমি যদি ব্যাপারটা জানো এক্ষুনি দৌড়ে পালিয়ে যাবে।”

“হোয়াট! কী এমন হয়েছে?”

“বললাম তো, পরে বলব।”

“যা পরে বলা যাবে, তা এখন বলতে অসুবিধে কোথায়?”

“উফ! তুমি এমন বাচ্চাদের মতো জেদ করছ কেন?”

“সব মানুষই মালটিপল লেয়ার নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তুমি জানো না? একজন মানুষ যখন বাথরুমে থাকে তখন তার চোখমুখের ভঙ্গি একরকম। সে যখন বাথরুম থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে বসে, তখন সেই চোখমুখের ভঙ্গি পালটে যায়। আবার ধরো, সেই মানুষটাই যখন গ্যালারিতে বসে খেলা দেখে, তাকে দেখে বুঝতেই পারবে না যে তার ছবি আঁকার স্টুডিয়োতে থাকা মানুষটার থেকে সে কত আলাদা হয়ে গেছে।”

“এত অবান্তর কথা বলছ কেন?”

“অবান্তর কোথায়? তুমি এইমাত্র বাচ্চাদের সঙ্গে তুলনা করলে তাই বললাম। কেন না তুমিই তো বলো, বিছানায় আমি নাকি বাঘিনি।”

“উফ্! আচ্ছা ধরো, কেউ যদি হঠাৎ জানতে পারে সে একটা স্ক্যানারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, আড়াল থেকে একজোড়া চোখ তাকে নগ্ন করে দেখছে, তার সমস্ত গোপনীয়তা অন্যের কাছে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে, তখন সেই মানুষটার কেমন লাগবে?”

“মানে?”

“মানে, আমার প্রাইভেসি বলে কিছু নেই। এই যে তোমার সঙ্গে কথা বলছি, তোমার সঙ্গে আমার ঠিক কীরকম সম্পর্ক— সব, সব আড়ালে থাকা একজনের কাছে ডিসক্লোজ হয়ে যাচ্ছে।”

“ওহ্ মাই গড! হু ইজ দ্য স্ক্যানার?”

“আমার বাবা।”




“তিনবার রিসিভ করলাম না, তার পরেও আবার রিং করছ কেন?” “কেন তখন কি অনীক বাড়িতে ছিল?”

“না।”

“তাহলে কি রুশো কলেজ যায়নি?

“গেছে।”

“তাহলে?”

“কেন, তুমি জান না?”

“আরে আমি জানব কেমন করে? আশ্চর্য!”

“সেদিন বাবার কাছে শুনলে না যে সব কথা তিনি জেনে যাচ্ছেন?”

“ধুর! যত সব ফালতু কথা।”

“ফালতু কথা নয়, পল্লবদা। দূর সম্পর্কের কাজিন বলে তোমাকে সন্দেহের স্কোপ ছিল না। কিন্তু এখন তো বাবা সব জেনে যাবেন। আর, কোনোভাবে যদি আমাদের সম্পর্কের কথা অনীকের কানে ওঠে, কী হবে বুঝতে পারছ?”

“ছাড় তো। ও সব বুজরুকি। উনি হঠাৎ ত্রিকালদর্শী হয়ে উঠলেন নাকি যে সব জেনে যাবেন!”

“উনি যা যা বলেছেন, সব একদম ঠিক বলেছেন। মিলিয়ে দেখেছি। প্লিজ কিছু মনে করো না পল্লবদা, এই রিলেশনটা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত।”

“থাম। বেরিয়ে আসা মানে কী? ওই বুড়োর ভয়ে?”

“তুমি এভাবে কথা বলছ কেন?”

“কাজিন বলে আমাদের সম্পর্কটা কেউ মেনে নিল না…”

“কেন, আমি তোমাকে বলিনি, চলো পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করি? তুমিই তো…”

“তখন কি আমার পায়ের তলায় মাটি ছিল? সদ্য আইন পাশ করে সিনিয়রের চামচাগিরি করছি…”

“অতীত নিয়ে এত খোঁড়াখুড়ির দরকার নেই। এই স্টেবল পজিশনটা…”

“মেয়েরা এত স্বার্থপর কী করে হয়, বলতে পারিস?”

“মোটেই স্বার্থপরের মতো কথা বলছি না।” “এখন তো বলছিস। তুই জানিস না, আমি…”

“সময় থাকতে অনেকবার তোমাকে বিয়ে করতে বলেছিলাম।”

“ভিতর থেকে কখনো বলিসনি। তাছাড়া, তোকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে ভাবতেই পারিনি কখনো।”

“আমি তর্ক করতে চাই না। প্লিজ, পল্লবদা, প্লিজ… আমার সিচ্যুয়েশনটা বোঝার চেষ্টা করো। আমি রাখছি।”




“এত নোংরা মন! এত নীচ!”

“খুনি। ক্রিমিন্যাল।”

“কোনোদিন বুঝতেই পারিনি, ভদ্রসভ্য চেহারার আড়ালে অমন একটা খুনি লুকিয়ে আছে। দেখতাম, বাড়িতে আসত। বউমার দাদা বলে কোনোদিন অন্যকিছু মনে হয়নি।”

“মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও কি আমি বুঝতে পেরেছি, শ্রাবণী? এখন তো সব জলের মতো পরিষ্কার। পল্লবই ভাড়া করা দুটো ছোকরাকে দিয়ে আমাকে খুন করেছে।”

“পাহাড়ি খাদে একজন প্রৌঢ় মানুষকে ফেলে দিতে ওদের একটুও হাত কাঁপল না!”

“কাঁপবে কেন? দুজন দু-লাখ টাকায় সুপারি নিয়েছে যে।”

“অথচ, তোমার মৃত্যুর পর বাড়ি গিয়ে ভালোমানুষের মতো কেমন অভিনয় করল দেখলে?”

“পুলিশও অ্যাক্সিডেন্ট বলে চ্যাপ্টার ক্লোজ করে দিল।”

“মাত্র দুমাস হয়েছে, আবার সবাই কেমন যেন স্বাভাবিক হয়ে গেছে! রুশো কলেজ যাচ্ছে। বউমা দিব্যি পল্লবের সঙ্গে ডেট করছে!”

“তোমার ছেলের কথা কেন বলছ না, শ্রাবণী? সে-ও তো কাবেরীর সঙ্গে…”

“যাক গে, ছাড়ো ওদের কথা। ওদিকে আর ফিরেও দেখব না।”

“সেই ভালো। এই মেঘের ওয়েটিংরুমে আমরা নতুন করে ভালোবাসার কথা বলব, শ্রাবণী। দেখো, দেখো অনন্ত শূন্যের দিগন্ত কেমন মায়াবী আলোয় ভরে আছে!”

“নতুন করে ভালোবাসায় ডুবব বলেই তো আমাদের শরীরগুলো অতিযত্নে ধরে রেখেছি, হৃদয়নাথ। শূন্যের ভিতর ভাঙতে দিইনি।

এই শুনছ, এই নীলচে সাদা, হালকা ধূসর, নরম, তুলতুলে এই মেঘের ওয়েটিংরুমটা চমৎকার না?”

“দারুণ। কিন্তু কতদিন দুজনে একসঙ্গে থাকার এই সুখ সইবে কে জানে! আবার তো চলে যেতে হবে অন্য কোথাও। দুজনের যেকোনো একজন অন্যজনকে ফেলে রেখে চলে যাবে, এটাই তো দস্তুর, তাই না?

এই কী হল, তোমার চোখে জল কেন, শ্রাবণী।”

“তোমার কাছে, একটু মিথ্যে বলেছি, হৃদয়নাথ।”

“মিথ্যে বলছ! তুমি! ধ্যাত্। আমি বিশ্বাস করি না।”

“সত্যি গো। আমি মিথ্যে বলেছি। অর্ধেক মিথ্যে।”

“অর্ধেক মিথ্যে! সে আবার কীরকম?”

“পল্লব তো দাবার ছকের সামান্য বোড়ে। তোমাকে খুনের পরিকল্পনা অন্যজনের।”

“সে কী! কার? কে আমার খুনি?”

“আমি।”

“কী বলছ, তুমি?”

“পল্লবকে মেন্টালি আমিই ফোর্স করেছি তোমাকে হত্যার জন্য। যদিও ও নিজে বুঝতে পারেনি।”

“কেন?”

“তোমাকে ছেড়ে আমার ভালো লাগছিল না, হৃদয়নাথ। খুব একা লাগছিল। তোমাকে ছুঁয়ে থাকব বলে আমিই তোমাকে খুন করেছি।”

“কী হল, তুমি কথা বলছ না কেন? এই, কোথায় গেলে? তুমি কি নিজেকে ভেঙে শূন্যের সঙ্গে মিলিয়ে দিলে, হৃদয়নাথ? এই-ই শুনছ…”



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “short-story-megher-waiting-room

  1. অসাধারণ গল্প লিখেছেন রেহান কৌশিক। লেখক কে আভিননদ জানাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *