জয়দীপ দে
মিনারা বোর্ডিঙের আজ একটা বিশেষ দিন। অথচ সাইদুল দিব্যি ভুলে বসে আছে। ভরদুপুরে কোত্থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে চিৎকার করে, চা!
কিন্তু এ অবেলায় তাকে চা দেবে কে?
বুয়া দুবেলা এসে ভাত-তরকারি রেঁধে যায়, তার সঙ্গে এই কন্ট্রাক্ট, সে কেন চায়ের কেটলি ধরতে যাবে? তাই বুয়া থাকলেও সাইদুলের হুকুম তামিল করতে সে ছুটে আসত না। সাড়া না পেয়ে সাইদুল কিছুক্ষণ নিজের ওপর চোটপাট করে ব্যালকনিতে এসে বসে। পথচলতি মানুষ দেখে। দেখতে দেখতে আকাশ-পাতাল ভাবনায় ডুব দেয়। আহা, এবার যদি বিসিএসটা হয়ে যায়, এই তো গেল বিসিএসে ২১০-এর রায়হানের পুলিশে হয়ে গেলো। ও এখন দিব্যি সারদার ট্রেনিঙে। নীল জিপ, পিপ পিপ, পথ ছাড়ো, হায় ডার্লিং, বটমলেস জিনস… ও আমার সোনাবউ, এক হালি গাবদা-গুবদা বাচ্চা, ড্যাডি, চিকেন রোল…।
এক টুকরো আয়নায় ঝিলিক মারে ছায়ানীড়ের বনলতা। তবে কি সে বনলতাকে বউ হিসেবে ভাবতে শুরু করছে? ছি ছি। নিজেকে নিজে ভর্ৎসনা করে সাইদুল। একি হয়। এই বনলতাকে দিয়ে সে তিন বেলা রাঁধাবে, বাইরে থেকে এসে বলবে চা, রাতে বিছানায় নিয়ে শাড়ি টানবে- ছি!
কি ভাবিস এতো, ইমদাদের স্পর্শে চমকে ওঠে সাইদুল। সাতসকালে এক প্যাকেট চিপস হাতে বেরিয়ে পড়েছিল ইমদাদ। দুপুরের মিল অফ করে গেছে, দূর সম্পর্কের কোন ভাইয়ের বাসায় যাবে বলে। যাওয়ার আগে স্বভাবসিদ্ধ হিসেবটা কষে গেছে। এক প্যাকেট চিপস ১০ টাকা, আসতে-যেতে ৮ টাকা, মোট ১৮ টাকা। আর বোর্ডিঙ মিল ২২ টাকা। নিট ৪ টাকা লাভ। কিন্তু ভরদুপুরে সে ফিরে এলো কেন?
নাই রে, কেউ বাসায় নাই। পুরোটাই লস।
দু’হাতের থাবায় চিপসের প্যাকেটা ফাটিয়ে দেয় ইমদাদ। ফাটার আওয়াজে নিজেই চমকে ওঠে। তারপর হো হো করে হাসে।
নে, চিপস নে, ভালো চিপস, চিকেন চিপস…
সাইদুল আনমনে বলে ওঠে, ড্যাডি চিকেন রোল…
কি কইলি?
না, কিস্সু না।
ব্যাগ কাঁধে আজাদ আর সুরুজ হেসে হেসে উঠে এলো সিঁড়ি ভেঙে।
কি সাইদুল ভাই, মনে আছে। সুরুজের ক্লোজ-আপ মার্কা হাসি।
মনে আছে!
এবার সাইদুলের মনে পড়ল, মিনারা বোর্ডিঙের আজ একটা বিশেষ দিন। অপরাধীর মতো ইমদাদের দিকে তাকায়। চোখাচোখি হতেই মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নাড়ায় ইমদাদ: আরে ধ্যুৎ, রাকিব্যা শালা আস্তা একটা ফাকু।
চল, খাই গিয়া। সাইদুল আশ্বস্ত হয়ে বলে।
আমার তো মিল দেয়া নাই।
তাই বইল্যা না খাইয়া থাকবি। আয়, যা আছে ভাগ-চিৎ কইরা খাই।
না রে, পেট ভইরা চনা-পিয়াজু খাইয়া আইছি। রাইত আট্টার আগে মেশিন ডাক দিব না।
শ্লথ পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে মুন্না।
কি পুলা কি হইয়া গেছে, মনে মনে বলে সাইদুল, এরেই কয় ফ্রাস্টেশন।
ঢুলুঢুলু দুটো চোখ তুলে মুন্না তাকালো তাদের দিকে।
কি মনে আছে?
কি আশ্চর্য, মুন্না ভাই পর্যন্ত ভুলে নাই, কিন্তু ভুইল্যা গেলাম আমি! অনুশোচনায় কাতর হয়ে ওঠে সাইদুল।
আরে রাখেন মুন্না ভাই, ওই ফাকুর লগে দুই বছর কলেজে পড়ছি তো, তারে আমার চেয়ে কেউ বেশি চেনে না। বনলতা তার মতো একটা ফাউলরে সাইড দিব, এইটা আপনে বিশ্বাস করেন? ইমদাদের ভাষ্য।
তোমার দোস্ত তো বিশ্বপ্রেমিক। মাইয়ারা তার লাইগ্যা অস্থির-
আরে মুন্না ভাই, বনলতা কি আর্টস ফ্যাকালটির ওই ফাউল মাইয়া, একটু সুড়সুড়ি দিলেই ‘লা-ভু’ ‘লা-ভু’ কইয়া ফাল পাড়ব।
ওই শালারে ক্যান সাইড দিব, সাইদুল যোগ দেয় কথায়, ওর ভেতরে আছেটা কি? পারসনালিটির প অছে? পীরিত তো দূরে থাক, আগে বনলতা তার লগে কথা কয় নি, দোখো।
সাইদুল লুঙ্গির কোচর সামলাতে সামলাতে উঠে দাঁড়ায়।
খালি পারসনালিটির প কেন আরো অনেক প নাই হালার। না আছে পাছার প, না…
কথা শেষ করতে পারে না ইমদাদ, মুন্না ভাই সামারি টানেন, মজার খেলায় নামছো তোমরা, যারে নিয়ে দুই দল খেলতাছো হেই জানে না, মাগার খেলা চলতাছে!
তোমার কি, সাইদুল মনে মনে বলে, তুমি আছো তো হালায় গাঁজা লইয়া।
মিনারা বোর্ডিঙের প্রতিতলায় মুখোমুখি তিনটি করে ছয়টি রুম, মাঝ বরাবর সরু একটা করিডর, যেটা সামনের দিকে গিয়ে কাটা জিভের মতো ঝুলে পড়েছে রাস্তায়। বাঁয়ের রুমগুলোর উত্তর আর ডানের দক্ষিণে একটা করে জানালা। জানালা থেকে দুহাত পরেই দুদ্দাড় করে উঠছে বিশাল বিশাল সব দালান। কখনো দালানগুলোকে ডিঙিয়ে- কখনোবা পাশ কেটে- কখনোবা ফালি করে জানালায় আলো আসে; আসে ঠাণ্ডা-গরম বাতাস। এ জানলাগুলোই মুমূর্ষু ঘরগুলোকে বাইরের রূপ-রসের প্রলোভন দেখিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে।
তবে বোর্ডারদের কাছে এই জানালার অন্য একটা তাৎপর্য আছে। অন্য এক আকর্ষণ। দিনের একটা বিশেষ সময় একেকটা জানলা একেকজনের জন্য বরাদ্দ থাকে।
• যেহেতু সাইদুল আপাতত বেকার, যেকোনো একসময় তাকে জানলাটা ছেড়ে দিলেই হয়, তাই প্রভাতী অধিবেশন তার;
• ইমদাদের এখনো মাস্টার্স হয়নি, মাঝে মাঝে ভার্সিটি যেতে হয়, তার ওপর আছে পার্টটাইম জব, বিকালটা তাই ইমদাদের;
• জগলু ভাইয়ের ফার্মাসেটিক্যালসের চাকরি, সাতসকালে সুটকেস ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ে, ফেরে রাতে, তাই নিশীথ অধিবেশন তার।
এক অধিবেশনের জন্য জানালা পেলাম, ওমনি যা ইচ্ছা তা করে বেরালাম, সে উপায় নেই এখানে। মিনারার আইন-কানুন খুব কড়া।
• প্রত্যেক বোর্ডারের জন্য একটি দালানের নির্দিষ্ট একটি তলা বরাদ্দ থাকবে।
• একতলার বরাদ্দ নিয়ে অন্যতলার দিকে তাকানো দণ্ডণীয় অপরাধ।
• জানালা ব্যবহারে কোনরূপ অনিয়ম গোচরীভূত হওয়ার ১৫ মিনিটের মধ্যে বোর্ডিং ম্যানেজারকে রিপোর্ট করতে হবে।
• ম্যানেজারের নলেজে আসার তিন ঘন্টার মধ্যে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার হবে।
• এতে সালাম ভাইয়ের নেতৃত্বে ৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি জুরি প্যানেল কাজ করবে। প্যানেলের নিয়োগ প্রত্যাহার বরখাস্তকরণের সর্বময় ক্ষমতা সালাম ভাই সংরক্ষণ করেন।
• বিচারের দণ্ড সর্বনিম্ন এক প্যাকেট ব্যানসন হতে বোর্ডিং থেকে বিতাড়ন।
• তবে ওপেন টাইমে এই বিধিমালা শিথিল থাকবে। বিকেল ৫ টা থেকে সন্ধ্যে ৬ টা পর্যন্ত এর কার্যকাল।
• ওপেন টাইমে নিজ দায়িত্বে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন করতে হবে। কারণ দুর্গে দুর্গে তখন গার্জিয়ানদের সজাগ দৃষ্টি পরিলক্ষিত হয়।
মিনারার বোর্ডারদের সঙ্গে এলাকার মেয়েগুলোর চমৎকার বোঝাপড়া। বিশেষ ব্যক্তিটির চোখের ইশারা কিংবা হাতের মুদ্রা দেখেই তারা বুঝে নেয় পরবর্তী করণীয়। কেউ সঙ্গে সঙ্গে ছাদে গিয়ে দাঁড়ায়, কেউ ভাইয়ার মোবাইলটা কাছে টেনে বসে, কেউ আয়না দিয়ে প্রত্যুত্তর পাঠায়।
শেষমেশ এতো সুখ সইল না বোর্ডারদের কপালে। মহল্লা কমিটির কাপ্তানরা ব্যাপারটা টের পেল।
একদিন বোর্ডিং-এর মালিক সালাম ভাই মিটিঙ ডাকলেন।
এভাবে তো হয় না! দু’হাত তুলে সবাইকে শান্ত করার চেষ্টা করে সালাম।
কেন? আমরা কি করছি, জানলায় গিয়া কি দাঁড়াইতে পারুম না। আমাদের রুমে আমরা যা ইচ্ছা তাই করুম, বুইড়া হারামীগো কী!
এইতো মনজু, তোমারে ডাকাটাই ভুল হইছে, কোন সমস্যার সমাধানের দিকে তো যাবা না, শুধু হৈচৈ করবা।
মনজু চুপ মেরে যায়।
এখানে একটা সমাজ আছে, সমাজরে আমাদের মানতে হয়। গায়ের জোরে কিছু করা যায় না। তোমরা তো জানো না, মহল্লা কমিটি কত দূর আগাইয়া গেছে, তারা দুইদিন পর সাংবাদিক ডাকবো, পুলিশ ডাকবো, তারা কোনমতেই আবাসিক এলাকার মধ্যে বোর্ডিং রাখতে দিবো না। এটা আমার তিন পুরুষের ব্যবসা, তখন বলো কোথায় যাই? সালাম ভাই বললেন।
বোর্ডিং রাখতে দিবো না ক্যান? আমরা ব্যাচলার বইল্যা কি পইচ্যা গেছি। আমরা মানুষ না। ওই তো দুই বিল্ডিং পর টুয়েলভ টাওয়ারে ফি-রাইত মাগিবাজি হয়, শাহ-আলমের দোকানে দেদারে স্পিরিট বেচে, মহল্লা কমিটির পোলারা ঝাপ্টাবাজি করে, মাইয়াগো টিজ করে- কই, তাদের তো এসব নিয়া মাথাব্যাথা নাই। আমরা বাপ-মা-ছাড়া নিরহী পোলাপাইন তো… আমাদের গোয়া মারতে সুবিধা…
হইচইয়ে সেদিনের সভা পণ্ড হয়ে গেলো। কোনো সিদ্ধান্ত হলো না।
পরের দিন সালাম ভাইয়ের মহল্লা কমিটির মিটিঙে যাওয়ার কথা। গেল কিনা কেউ সে খবর নিল না। খবর হলো আরো দুদিন পর।
সন্ধ্যায় যারা বোর্ডিঙে ছিল সবাইকে জরুরী তলব করল সালাম ভাই। সবার মুখ থমথমে। সবাই বুঝতে পারছে, একটা বড়ো নিম্নচাপ ঘণীভূত হচ্ছে। একটু পরেই ঘুর্ণিবায়ু ধেয়ে আসবে।
না, আমি পারলাম না। সালাম ভাই মৌনতা ভাঙলেন।
চাপা গুঞ্জন শুরু হলো।
এখন আর কোন কথা কইয়া কাম হইব না। সালাম ভাই বেশ কনফিডেন্ট মনে হলো। মহল্লা কমিটি কইছে, আগামী মাসে তোমরা বোর্ডিং ছাড়বা। তারা এখানে ফ্যামিলি ভাড়াটিয়া তুইল্যা দিবো। আমার চিন্তা নাই। কথা ফাইনাল। আমার হাতে কিছু নাই।
‘আমারা কই যামু’ ‘দেশে কি আইন কানুন বলতে কিছু নাই’ ‘আগে আমরার এডভান্স টাকা ঝাড়ো’ ‘কুত্তার বাইচ্চাদের বল আমাদের বাসা ঠিক করে দিতে’ বিশাল হট্টগোল তৈরি হলো বোর্ডিঙে।
সন্ধ্যার পর ঘনঘন মিটিং বসতে লাগল। কোনভাবেই বোর্ডাররা বোর্ডিং ছাড়বে না। তবে দুয়েকজন চাকরিজীবী বোর্ডার ঝামেলায় জড়াতে চাইলেন না। তারা এরমধ্যে অন্যখানে বাসা দেখে নিলেন। কিন্তু বেকার ও ছাত্ররা অনড়।
ঐক্যে চিড় ধরল। বোর্ডারদের আগের মতো গলায় জোর নাই।
হঠাৎ একদিন পুলিশ এলো বোর্ডিঙে। বিশাল হৈচৈ। পুলিশ সাথে করে দুই বোতল মদও নিয়ে এসেছে। তাদের বক্তব্য স্পষ্ট, বোর্ডিং যারা ছাড়তে রাজি নয় তারা তাদের অবস্থান প্রকাশ করুক। মাদকের মামলায় কোর্টে চালান করে দেবে।
পুলিশ যাওয়ার পর মন্ত্রাবিষ্টের মতো শান্ত সুবোধ হয়ে গেলো বোর্ডাররা। আর কোন উচ্চবাচ্য নয়।
সাইদুলের সাথে সালাম ভাইয়ের সম্পর্ক ভালো। সেই একদিন সুখ দুঃখের আলাপ করতে করতে সালাম ভাইকে বলল, ভাই, যা দেখতেছি আপনার বোর্ডিং আগামী মাস নাগাদ অর্ধেক খালি হয়ে যাবে।
অর্ধেক ক্যান, পুরাটাই হইব-
আরে শুনেন না আমার কথা। পুরাটাই ধরেন হইল। কিন্তু আপনার পরের মাসের ভাড়াটিয়া কই। আমরা গেলে তো পুরা একমাস বোর্ডিংটা খালি থাকব।
সেটা তো ভাবিনি।
তার চেয়ে একটা বুদ্ধি দেই, আপনি আপাতত চুপ থাকেন। যারা যাওয়ার যাক, যারা থাকবো এক সাইড করে থাকবো। ভাড়াটিয়া পাওয়ার সাথে সাথে পুরো বোর্ডিং খালি হইয়া যাইব। আপনার আমাদের দুই পক্ষেরই লাভ।
ওই মিয়া আমারে কি বেকুব মনে হয়। তোমরা থাকলে কি ভাড়া নিতে কেউ আইব?
কোন অসুবিধা নাই। আমরা ধরেন দিনের বেলায় থাকমুই না বোর্ডিঙে। কেউ আসলে বলবেন বোর্ডিং খালি। জিনিসপত্র কিছু আছে। দুয়েকদিনের মধ্যে ক্লিয়ার হয়ে যাবে।
পরের মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে সালাম ভাইয়ের উৎসাহে ছাই চাপা পড় গেলো। ফ্যামিলি ভাড়াটিয়ারা আসছে। দেখে যাচ্ছে। কিন্তু ফলোআপ করছে না। কেউ কেউ বলে যাচ্ছে, বড়ো ধরনের সংস্কার না করলে এ বাসায় বউ বাচ্চা নিয়ে থাকা সম্ভব নয়।
এখন পাশার দান পাল্টে গেলো। যে সালাম ভাই হম্বিতম্বি করছিলেন বোর্ডিং ছেড়ে দেয়ার জন্য, তিনিই অবশিষ্টদের ফুসলাতে শুরু করলেন থেকে যাওয়ার জন্য। তিনি মহল্লা কমিটিকে সামলাবেন। বিকল্প ব্যবস্থার অনুসন্ধানে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন সালাম ভাই।
একদিন বিকেলে যে যার রুমে ফিরে অবাক। রুমের একমাত্র জানালাটি চিরতরের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। আলো নেই, বাতাস নেই- জগলু ভাই ঠাট্টা করে বলে, ভালোই হলো, কবরের একটা ড্রেস-রিহার্সেল হয়ে যাচ্ছে।
সালাম ভাইয়ের চোখ দুটো ছাইচাপা আগুনে ধিকধিক করে, এছাড়া আমার কিছু করার ছিল না।
মিনারা যেন সব আকর্ষণ হারিয়ে ফেলল। এখন আর কারো ফেরার কোন টাইম-টেবল নাই। যে যার ইচ্ছেমতো যত রাত করতে পারে করে, ফিরে। কিছুদিন পরেই বোঝা গেল মিনারার সব বাসিন্দা এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। রোগটার নাম হতাশা, উপসর্গ অহেতুক উত্তেজনা। এদের ভালো খারাপ যাই বলেন না, গরম কড়াইয়ের মতো ঝ্যাঁৎ করে ওঠে। এরা কেউ হতাশ চাকরি না পেয়ে, কেউ হতাশ চাকরি পেয়ে, কেউ সেশনজটের ঘানিতে আটকে পড়ে।
মানুষ হাল ছাড়ে না, অন্ধকারের মাঝেও দেয়াল হাতড়ায়, আলোর সন্ধান করে। এভাবেই একদিন দেয়াল হাতড়াতে গিয়ে মিনারাবাসী পেয়ে গেলো রান্নাঘরের জানলাটা। সেটা এখনো উন্মুক্ত। তবে এর ঠিক উল্টো দিকে এমপি সাহেবের মার্কেট। জানলা খুললেই এডাজাস্ট ফ্যানের গরম হল্কা। নেই কোন ফ্ল্যাট, নেই জানালা, নেই চপলা নারীর আদরা। কিন্তু এর মাঝেও সম্ভাবনা খুঁজে পেলো ঝন্টু। জানালার একটা কবাটের ওপর সে একটা আয়না ফিট করে দিল। সেই একটুকরো ভাঙা আয়না পুরো বাইশমহল্লাকে কান ধরে হাজির করল বর্ডারদের কাছে। কে আর রুখে প্রাণের ধারা!
এই একটুকরো আয়না যেন আবার মিনারাবাসীর প্রাণশক্তি ফিরিয়ে দিল। সারাদিন যে যার মতো করে মিন্নত দিয়ে এসে বিকেলে জানালার সামনে দাঁড়ায়। আয়নায় দেখা যায় আয়েশা মঞ্জিল, তিন তলায় ইমদাদের ডার্লিং; রাবেয়া ভিলা, নীচতলায় থাকে সায়েমারা; আশালতা, মিস-কল দিলে ছাদে এসে দাঁড়ায় রুমানা। আহা, পৃথিবী কতো সুন্দর! এরই মাঝে একদিন দেখা গেলো অন্য আরেক দৃশ্য। কোলের ওপর জীবনানন্দসমগ্র নিয়ে ছায়নীড়ের দোতলায় কোনো এক গ্রীক দেবী যেন বসে আছেন আপনমনে। কি তার রূপ, কি ধ্যানমগ্ন পবিত্রতা!
বোর্ডারদের সবার চোখ সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায় কপালে। মানুষ এতো পবিত্র, এতো সুন্দর হয় কি করে? তার পর থেকে ইমদাদ আর আয়শা মঞ্জিলের দিকে তাকায় না, আশালতার রুমানা বড়ো পানসে হয়ে গেছে ফজলুর চোখে, সাইদুলও রাত-বিরাতে টুকটুকিকে জাগায় না। মিনারাবাসী রীতিমতো দেবীবন্দনায় মুখর হয়ে ওঠে। জীবনানন্দ চর্চার ধুম পড়ে যায় রুমে রুমে। সব রুমে একটা করে আব্দুল মান্নান সৈয়দ-এর ‘জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা’। বিকেল হলেই দেবীকে দেখার জন্য লাইন পড়ে। প্রতিদিনই দেবীর উদাস দৃষ্টি, এলায়িত চুল, হাতে জীবনানন্দ। মুন্না ভাই গাঁজার নেশায় চুর হয়ে আবৃত্তি করেন-
…তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন…
ইউরেকা। দেবীর নাম পাওয়া গেছে। হ্যাঁ, বনলতা সেন।
এরপর থেকেই দেবীর নাম বনলতা। প্রতিদিন বিকেলে রান্নাঘরে জানালাটা যেন জান্নাতুল ফেরদৌসের তোরণ হয়ে যায়। সবাই কুজ্ঝটিকার রেশমী পর্দা সরিয়ে দেবীদর্শন করে। দেবী ঘড়ি ধরে ঠিক এক ঘন্টার জন্য প্রাসাদের ঝুল-বারান্দায় এসে দাঁড়ান।
এদের কাণ্ড দেখে তো পলিটিক্যাল সায়েন্সের রাকিব হেসে খুন।
একটা মাইয়ার লাইগ্যা এতো জন! এই ছেমরীর আছে কি, ক’?
ওই শালা মুখ সামলাইয়া কথা ক। ইমদাদ মুষ্ঠি বাগিয়ে তেড়ে আসে। বনলতার লগে কোনো মাইয়ার তুলনা হয় না।
ক্যান-ক্যান!
দেহছ না কেমন ইনোসেন্ট, কেমন সেক্রেড!
ধ্যাৎ, ওইগুলা সব ফলস। দেখ গিয়া, কোথায় ছ্যাকা-ট্যাকা খাইছে, মন মিজাজ ভালো না, বিকাল হইলে জীবনানন্দ নিয়া বইস্যা পড়ে।
তুই কি কইতে চাস?
খ্যাইপ্পা যাস ক্যারে। কুল বয় কুল। রাকিব খ্যাক খ্যাক করে হাসে।
তুই কি বনলতারে ফাউল মাইয়া কইতে চাস।
হেইটা তোগো বুঝোনের ব্যাপার, তয় এইটা ডেফিনেটলি কইতে পারি, বনলতারে সাইজে আনা আমার দুই দিনের ব্যাপার।
ওই ব্যাটা বাজি লাগবি।
রাকিব আবার হাসে।
লাগবি নি ক’। দুই দিন না দুই সাপ্তাহ দিলাম। সাহস থাকলে আয়। পাঁচশ টাকা বাজি।
বলেই পকেট থেকে ৫০০ টাকার নোট বের করে দেখালো ইমদাদ।
আজ ২৩ তারিখ। বাজির ডেট। সন্ধ্যায় রাকিব আসবে। এই নিয়ে মিনারা বোর্ডিঙে চাপা উত্তেজনা। শেষবারের মতো সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে বনলতাকে দেখে নিল। সেই শান্ত-সমাহিত ভঙ্গি, হাতে জীবনানন্দ, কপালে উড়ে আসা অলোকচূর্ণ। এই বনলতার পাশে রাকিবকে কল্পনা করে এক পেট হেসে নিল ইমদাদ। তারপর আপনমনেই বলল: ছাগল।
ঠিক ঠিক সন্ধ্যায় হাজির হলো রাকিব। ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা। তার দুষ্টু হাসিতে সবার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। আবার ভেতরে থেকে কে যেন বলে উঠল, ওই শালা ফাকু। ওমনি সবাই আবার সঞ্জীবিত হয়ে উঠল।
তাইলে, ফাইনাল রাউন্ড হয়ে যাক। প্রস্তাবটা সালাম ভাই-ই পেশ করলেন।
রাকিব স্মার্টলি পকেট থেকে তার ফোল্ডিং ফোন সেটটা বের করল। তারপর কয়েকটা বোতাম টিপেই কানের পাশে তুলল।
হ্যালো, কেমন আছো চৈতি।
কথাটা বলেই মোবাইলের লাউড স্পিকার অন করে দিল রাকিব। তার পর হাতটাকে সমকোণে এনে হ্যান্ডসেটটা কম্পাসের মতো ধরল মিনারাবাসীর সামনে।
– ভালো, তা তুমি কেমন আছো সোনা। কাল ফোন করো নাই ক্যানো? কতদিন পর যেন ফোন করলা।
– একটু ব্যস্ত ছিলাম ময়না।
ইমদাদ সাইদুলের কানে ঠোঁট লাগিয়ে বলে, কোন না কোন মাইয়ারে ফোন করছে, দ্যাখ।
উঁহু, ওসব তোমার চাপা। বলো অন্য কোনো মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলা। লাউড স্পিকারে শোনা যাচ্ছে।
না টুনটুনি একদম না। তুমি এখন কোথায়!
কেন, বাসায়।
আজ আকাশ দেখেছো, কি ভরা পূর্ণিমা।
তাই নাকি।
ঘরে বসে থাকলে কি করে দেখবে, ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াও।
সবাই চোখ ফেরালো জানলার দিকে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ছায়ানীড়ের ব্যালকনিতে একটা এ্যানার্জি সেইভিং লাইট চলছে। কেউ নেই সেখানে। হালকা বাতাসে দইয়ের হাঁড়িতে কিছু পাতাবাহার কাঁপে।
একটু পরেই সেই আলোর এসে একটি ফিমেল ফিগার দাঁড়ায়।
মিনারার সবার কপালে হাত।
রাতে না খেয়েই শুয়ে পড়ল সাইদুল। নিজেকে তার আজ এতো ক্লান্ত লাগছে কেন? কোথাকার কোন মেয়ের জন্য তার এতো ব্যাকুলতা কেন? সে আর কিসসু ভাবতে চাইছে না। এখন একটা গভীর ঘুম প্রয়োজন। তারপর কাল থেকে ব্যাংকার্স রিক্রুটমেন্ট পরীক্ষার জন্য উঠে পড়ে লাগবে। কিন্তু ঘুম আসে না। ভেতর থেকে একটা অবুঝ কান্না যেন ফুলে ফুলে ওঠে। সাইদুল ছাদের দিকে তাকায় থাকে। ছাদটা ক্রমেই তার দিকে নুইয়ে পড়ছে। ভয়ে চড়ুই পাখির মতো পা দুটো উপরে তুলে দেয়। এবার শুধু ছাদ নয়, চারদিকের দেয়ালগুলোও ঝুঁকে পড়ে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন