মন্দ মেয়ের গল্প

মন্দ মেয়ের গল্প
পল্লবী সেনগুপ্ত
ব্লাউজের ভাঁজ থেকে চিরকুটটা বের করে ফের তাতে একবার চোখ বোলাল সুমিতা। অভিসার এর আহ্বান। সেইজন্যই বোধ হয় বারবার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে।
ছোটবেলা তেই বাবাকে হারিয়েছিল ও। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর মা ‘ও চলে গেলেন। সুমিতার আশ্রয় জুটলো দিদি জামাইবাবুর বাড়িতে। দিদির ওর প্রতি মমতা থাকলেও জামাইবাবু আর তার পরিবার ওকে ভাল ভাবে মেনে নেয়নি।
তড়িঘড়ি ওকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হল আধবুড়ো সুদের ব্যবসায়ীর নিকুঞ্জের সাথে। বিয়ের পর পরই সুমিতা আবিষ্কার করেছিল তার স্বামী এক বিকৃতমনস্ক মানুষ। প্রতি রাতে জান্তব ভাবে সে ভোগ করে সুমিতাকে, অথচ অবৈধ সম্পর্ক রেখে চলে নিজের বিধবা বৌদির সাথে। সুমিতার ওই বিধবা জা আর শাশুড়িও যার পর নাই অত্যাচার চালাতে শুরু করেছিল ওর প্রতি। প্রথম প্রথম চুপচাপ মুখ বুজে সব মেনেই নিচ্ছিলো ও।
কিন্তু তাতে আরো দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিলো অত্যাচারের মাত্রা।
তাই সুমিতা ঠিক করে নিলো আর নয়। শুরু করলো ও সেইমতো প্রতিবাদ। তাতে যেন আরও ভয়ানক হয়ে উঠতে শুরু করলো ওর বিকৃতমনস্ক স্বামী আর শশুড়বাড়ির মানুষগুলো।
তারপর একদিন তো গায়ে আগুন দিয়ে মেরেই ফেলছিলো ওরা সুমিতাকে।
কোনমতে পালিয়ে বেঁচেছিল ও সেদিন। ফের ঠিকানা হল সেই দিদি জামাইবাবুর বাড়ি।
আবার জীবনে ফিরে এল সেই পুরোনো অপমান, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা। মাঝে মাঝে ওর ইচ্ছা করে সব ছেড়েছুড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে।
ইচ্ছা করে নতুন কোন দিশায় আবার জীবন সাজিয়ে নিতে। কিন্তু কোথায় যাবে, কার সাথেই বা যাবে! এতো বড় পৃথিবীতে ও যে সম্পূর্ণ একা।
কিন্তু তবুও কিভাবে যেন হঠাৎ ওর মরুভূমির মতো জীবনে এক পশলা বৃষ্টি এসে হঠাৎ ওকে ভিজিয়ে দিলো। সুরেশ, মানে ওর দিদির ছেলে বাবলুর প্রাইভেট টিউটর এর চোখে ও আবার এখন দেখতে পাচ্ছে নিজের জন্য বাঁচার এক নতুন ঠিকানা।
সুরেশকে চা জলখাবার পৌঁছে দিতে যেত সুমিতা। তখনই প্রথম লক্ষ্য করেছিল লোকটার চোখে চাপা আগুন। সেই আগুনই এখন দাবানল হয়ে উঠেছে সুমিতার প্রেমে। হঠাৎ করে একদিন বাবলুর চোখ বাঁচিয়ে ওর হাতে চিরকুট গুঁজে দেওয়া থেকেই শুরু হয়েছিল গল্পটা।
কাল সুরেশ ওকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে। নিজের মায়ের সাথে পরিচয় করাবে। তারপর শুভদিন দেখে ওরা শুরু করবে নতুন জীবন।
******

হুহু করে ছুটে চলেছে ট্রেন। সুমিতা জানে না ও কোথায় যাচ্ছে, কার কাছে যাচ্ছে। এই ভরা দুনিয়ায় এখনো যে ও একদম একা।
সুরেশ এর বোধ হয় বিয়ে পাকা হয়ে যাবে আজ।
ওর মায়ের পছন্দ করা মেয়ে। তবে ওর মা যে সুমিতাকে অপছন্দ করেছিল এমন নয়। ওর মা তো সুমিতাকে দেখেনইনি। বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার নাম করে সুরেশ ওকে নিয়ে গিয়েছিলো এক বন্ধুর ফাঁকা ফ্ল্যাটে। বলেছিলো ওর মা ওখানেই আসবেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি আসেননি। সেদিন ওই ফাঁকা ঘরে সুরেশ হয়ে উঠেছিল বেহিসেবি দামাল এক প্রেমিক। আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়েছিলো সুমিতাকে।
এতো আদর সুমিতা কোনোদিন দেখেনি। তাই খুশিতে পাগল হয়ে গেছিলো ও। নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিল সুরেশের কাছে।
কিন্তু সেইদিন ফিরে আসার পর থেকেই সুরেশ যেন কেমন বদলে যেতে শুরু করল। এড়িয়ে চলতে শুরু করল সুমিতাকে। তারপর হুট করে একদিন ছেড়ে দিলো বাবলুকে পড়াতে আসা।
এদিকে মাস দেড়েকের মাথাতেই ঘটলো দুর্ঘটনাটা। একদিন মাথা ঘুরে পড়ে গেল সুমিতা। ডাক্তার এসে বললেন নতুন প্রাণ বাসা বেঁধেছে ওর শরীরে।
দিদি জামাইবাবু সেদিন কি না বলেছিলো ওকে। বাজারের বেশ্যার থেকেও নিচু প্রতিপন্ন করছিলো সেদিন ওকে ওরা। না, সুমিতা সেদিন একটা কথাও বলার সুযোগ পায়নি। সুরেশের নাম ও না।
অবশ্য বলে লাভ হতো না। কেউ বিশ্বাস করতো না ওকে। আসলে সব দোষই তো ওর। ওই তো লোভ করেছিল ভালোবাসা পাওয়ার, সংসার আবার পাবার।
সেদিন রাতে সকলকে লুকিয়ে সুরেশকে ফোন করেছিল সুমিতা।
– আমায় বাঁচাও সুরেশ। এটা যে তোমার সন্তান। দয়া করে বিয়ে কর আমায়। আমি কথা দিচ্ছি সারাজীবন তোমার দাসী হয়ে থাকবো, শুধু বাচ্চাটাকে স্বীকৃতি দাও।
– কি! বিয়ে করবো তোমাকে? তোমার মতো সেকেন্ড হ্যান্ড মেয়েছেলের সাথে বিছানায় ফুর্তি করা যায়, বিয়ে করে ঘরে তোলা যায়না।
ওই বাচ্চাটাকে এবোর্ট করে নাও। হাজার খানেক টাকা দেবার ব্যবস্থা করছি।
আর হ্যাঁ আর আমায় ফোন করার সাহস দেখাবে না। আমার মায়ের দেখা মেয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হচ্ছে। সামনের 2 অগ্রহায়ণে আশীর্বাদ।
না আর কোন কথা সেদিন বলতে পারেনি সুমিতা। অবশ্য সুমিতার মতো মেয়েদের কবেই বা কথা বলতে পারার মতো জায়গা ছিল। আইন আদালত করতে পারার মতো ক্ষমতাও যে ওর মতো সহায় সম্বলহীন নিঃস্ব মেয়েদের নেই।
তাইতো বারবার পার পেয়ে যায় সুরেশেরা, ভুল করে সমাজের কাছে নষ্ট মেয়ে হয় সুমিতারা।
কিন্তু কোনটা ভুল? ভাল থাকতে চাওয়াটা ভুল, একটুকরো সুখ খোঁজাটা ভুল নাকি পিতৃমাতৃহীন গরিব মেয়ে হয়ে বেঁচে থাকাটা ভুল?
দিদির বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। কারণ ভদ্রলোকদের বাড়িতে নষ্ট মেয়েছেলেদের জায়গা হয়না।
সুমিতা চলে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে কোন গন্তব্যহীন ঠিকানায়। এভাবেই হয়তো হারিয়ে যায় সুখের খোঁজে নষ্ট হয়ে যাওয়া হাজার হাজার সুমিতারা প্রতিদিন।
দু চোখের জল মুছে নিল ও। না ও আত্মহত্যা করবে না। হেরে গিয়ে ফুরিয়ে যাবে না।
ও বাঁচবে। কারণ আজ ও আর একা নয়। ওর সাথে ওর সন্তান আছে। আজ আর ও পরিচয়হীন নয়। আজ ওর পরিচয় ও একজন মা। আজ ওর জীবন লক্ষ্যহীন, উদ্দেশ্যহীন নয়।
আজ ওর লক্ষ্য নিজের সন্তানকে একজন যোগ্য মানুষ করে তোলা। অন্ধকারে মিশে যাওয়া তো সহজ, কিন্তু সেটা করবে না সুমিতা। আলোয় ফিরবে ও, নিজের সন্তানকেও হারাতে দেবে না পরিচয়হীনতার গহবরে।
জন্মপরিচয় নয়, কর্মপরিচয় নিয়ে বাঁচতে শেখাবে ও নিজের সন্তানকে আর সেই সন্তানই একদিন ন্যায় খুঁজে আনবে ওর জন্য।
নিকুঞ্জ, সুরেশেদের সেদিন ও বুঝিয়ে দেবে নারী মানেই সে ভোগ্যপণ্য বা দুর্বল নয়, নারী মানে সৃষ্টি, নারী মানে সংগ্রাম, নারী মানেই নতুন দিনের পৃথিবী।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *