নলিনী বেরা
হারু বেহেরা আমাদের গ্রামের একজন সম্পন্ন চাষী। যেমন তার জমিজমা, হাল–লাঙল, তেমনই ঘরের পাল-পার্বণে গ্রামের ছা-ছানা রুণ্ডু উরুণ্ডুদের হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি। আমন্ত্রণ–নিমন্ত্রণ।
‘করম’ নাচের গানেই তো আছে –
আজ রে ছানাপোনারা বিরি খিচৌড়ি।
কাল রে ছানাপোনারা দাঁত গিজৌড়ি।।
গ্রামের অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন গৃহস্থের আঙিনায় ভাদ্রমাসের শুক্ল পক্ষের একাদশীতে জঙ্গল থেকে দুটি করমগাছের ডাল কেটে এনে পোঁতা হয়। যাকে বলে ‘করম গাড়া’।
তারপর তো সারা সন্ধ্যা ও সারারাত্রি ধরে ডালদুটিকে ঘিরে ব্রত, ব্রতকথা, পংক্তি বা ‘পাতা নাচ’ আর গান হয় –
আজ রে করমরাজা ঘরে-দুয়ারে।
কাল রে করমরাজা সবন্নেখার পারে।।
বিরিকলাই, মানে বিউলির ডালের খিচুড়ি হয়। ‘আদা কাসন্দা দিয়া করিয়া খিচরী। কড়িতে কি যোটে মান, বড়িতে খিচুড়ি।’ গন্ধে গন্ধে হোক, আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণে হোক ‘ন্যা-ঙ-টা ভু-টু-ঙ সা-ধে-র কু-টু-ম’রা তো হাজির! তাদের আনন্দ-ফুর্তি দেখেই ওই গান বাঁধা।
গরীব গুর্বো ছা ছানারা আজ না হয় দু’মুঠো ‘বিরি-খিচৌড়ি’ খেতে পেল। কিন্তু কাল? কাল যখন গাছের ডালদুটিকে উপড়ে সুবর্ণরেখা নদীর জলে ‘ফাব্ড়ে’ উৎসবের সমাপ্তি ঘটবে তখন? তখন কে আর তাদের হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি করে খাওয়াবে? খিদের জ্বালায় তাদের তো ‘দাঁত গিজৌড়ি’ – অর্থাৎ, দাঁত কপাটি লেগে যাবার জোগাড় হবে!
যাহোক, হারুচাষির পরব পাইলের শুরু তো জ্যৈষ্ঠের তেরোয় ‘রহিন’ বা ‘ধান মুইঠ্’- মানে, ডাঙা ডুঙোড় ডাহি জমিনে হাল লাঙল করে মুঠো মুঠো ধানের বীজ ছড়ানো থেকেই! তখনও ছা-ছানা রুণ্ডু উরুণ্ডুদের ডেকে একপ্রস্ত খাওন-দাওন। বিরি খিচুড়ি না হোক, নিদেনপক্ষে চিড়া-গুড়, আর নয়তো গুড় মুড়ি। তারপর তো আবার আষাঢ়ে। বর্ষা হলে মাঠ কে মাঠ হারু চাষির ‘হালুয়া’রা হাল লাঙল চালিয়ে জলে বতর হওয়া কৃষিক্ষেত্রকে ‘জাঙড়’ দেয় বা কাদা করে।
এক্ষণে বীজতলা রোপণ করবে মুনিষ মাহিন্দররা। তার আগে লাঙলের ফালে উদ্গত উঁচাঢিলা মাটির ঢেলাকে ‘মহি’ বা মই দিয়ে সমান করতে হবে। আর তখন ডাক পড়বেই পড়বে মই চাপবার জন্যে ‘ন্যা-ঙ-টা ভু-টু-ঙ সা-ধে-র কু-টু-ম’দের। শুধু কী তাই, দৌড়ে দৌড়ে দূরবর্তী স্থান থেকে ‘চিপাকাঠি’ কী হাতে হাতেই ধানচারা বয়ে এনে কাজের সুসার করে দেবে তো তারাই!
পরিবর্তে সন্ধ্যাবেলা আবার একপ্রস্ত শালপাতার ‘খালিপাতা’য় মুড়ি আর ‘চেঁকা দহি’ মিলবে। আষাঢ় যাবে, শরাবণ যাবে। ভাদ্র আসতে না আসতেই ডাহি জমিনের আউশধান পেকে ঝুনো হবে। টিয়া হরিয়াল পাকা ধানের লোভে উড়ে ঘুরে বেড়াবে। তার মধ্যেই একদিন আউশধান কেটে এনে নবান্ন করবে হারু চাষি। সঙ্গে জঙ্গল থেকে ভেঙে আনবে ভেলাগাছের ডাল আর পাতা। সেই আউশধানের চিড়া আর গুড় দিয়ে নবান্ন হবে। ভেলাপাতার দোনায় ভরে চিড়া-গুড়ের নবান্ন খাবে ছা ছানা রুণ্ডু উরুণ্ডুরা।
এমন এমন যে হারুচাষি এ বছর শীত আর কারিকুরি পাখিরা আসতে না আসতেই রোগে ভুগে মারা গেল। আমরা, ‘ন্যা-ঙ-টা ভু-টু-ঙ সা-ধে-র কু-টু-ম’রা ভারি বিমর্ষ হলাম। হারুচাষির জ্ঞাতিগুষ্টিরা যেদিন মিছিল করে খোল-কত্তাল বাজিয়ে ‘তেল খোল’ করতে, অর্থাৎ তিনদিনের দিন রুখা আর অশৌচ শরীরে সুবর্ণরেখা নদীতে তেল মেখে স্নান করতে গেল, সেদিন সদলবলে আমরা, ‘ন্যা-ঙ-টা ভু-টু-ঙ’রাও পিছু পিছু গেলাম। ঘাটক্রিয়াদি, অর্থাৎ ঘাটে ওঠার দিন হারুচাষির পুত্র, পুত্রবধূ ও জ্ঞাতিগুষ্টিদের আবারও সেই মিছিল! মিছিলটা আড়ে বহরে আজ বেশ বড়ই হল।
আমরা তো ‘মুন্ডন’ এর আগে নদীর কাতাধারে লাইন বেঁধে বসে পড়ে রোদ পোহাচ্ছি! হি–হি করে উত্রা হাওয়া চালাচ্ছে। ঈষৎ কড়া রোদটাও আরাম দিচ্ছে।
ওদিকে মাথার চুল ফেলে ন্যাড়া হয়ে হারুচাষির জ্যেষ্ঠপুত্র বাছুর খোঁয়াড় ইডি পোষ্টাপিসের ডাকহরকরা কালীপ্রসন্ন বেহেরা স্নান সেরে শীতে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে কাঁপতে কুশ হাতে বামজানু পেতে বালি দিয়ে প্রেতাত্মা গড়ে তুললে পঞ্চগুঁড়ি দিয়ে তা শোধন করে পুরোহিত অমূল্য মিশ্র বলল “বল, ওঁ এহি প্রেত সৌম্য গম্ভীরেভিঃ পথিভিঃ পূষিনেভিঃ।”
কালীপ্রসন্ন বলল কী বলল না, অমূল্য চেচিয়ে বলে উঠল “কই হে কীর্তনীয়ার দল! এবার নামগান শুরু কর!”
বলা মাত্রই খোলে চাঁটি পড়ল। হরিনাম সংকীর্তন শুরু হল। গলায় কণ্ঠী, ধুতি-গেঞ্জি পরিহিত কীর্তনীয়ার দল একটু তফাতে গোলাকারে দাঁড়িয়ে গলার শিরা ফুলিয়ে পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে গেয়ে উঠল “হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে… ”
পরের দিন একাদশী ক্রিয়া। তারপরেই তো প্রীতিভোজ, ‘আঁশপাল্না’! সেদিনটা হারুচাষি যেন ‘মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই।’ কেননা, রুণ্ডু-উরুণ্ডু চ্যাঙ্না-ম্যাঙ্নারা ফের একপ্রস্ত শালপাতার ‘খালিপাতা’ পেড়ে খেতে পেল। প্রথমটায় বৈতাল পুঁইখাড়ার ঘণ্ট আর ভাত। তারপরই ধোঁয়া ওঠা খাসি মাংস। ছা-ছানা, হারুর পরিবার ও জ্ঞাতিগুষ্টিরা তো খেলই, অধিকন্তু মৃত হারুর জন্যও ‘সেনি’র ভাত, অর্থাৎ আঁশপাল্নার মাংসভাত রেখে এল দখিনসোলের মাঠে, নতুন হাঁড়িতে শালপাতায় মুড়ে।
রাতে হারু এসে খাবে!
ভোর ভোর, চারধারে পাতলা কুয়াশা ছিল। ঝুনঝুনি গাছগুলোর ডগায় সপসপে শিশিরজল। তার ভিতর দিয়ে আমাদের গাঁ মুড়োর ভজহরির ছেলেটা দখিনসোলের মাঠের দিকে এগুচ্ছে, তো এগুচ্ছে।
ভালো করে তখনও সকাল হয়নি। ভজহরি ও তার পরিবার ঘুমোচ্ছে। দড়ি বাঁধা হাফ পেন্টুল, গায়ে চারহাতি ময়লা চাদর, বয়ঃক্রম বড়জোর বছর দশ, হরিহরের ছেলেটা!
এমন হি হি করা ঠান্ডায় মাঠের দিকে ছেলেটার হেঁটে যাবার হেতু অনুমান করা সহজ বৈকি। কিন্তু না, হাফ পেন্টুল ময়লা চাদর আচমকা বাঁক নিল দক্ষিণে।
দেখতে পেয়েছে কিছু একটা। আনকোরা নতুন হাঁড়ির মুখ থেকে কটা কাক উড়ে উঠল ভদভদিয়ে। উড়ল বটে, তবে একেবারে ছেড়ে গেল না জায়গাটা।
ঘুরে ঘুরে মাথার উপর উড়তে লাগল। ততক্ষণে শালপাতার মোড়ক সরিয়ে হাঁড়ির মুখ দেখাচ্ছে ছেলেটা। ঝরঝরে শুকনো ভাত আর খাসি মাংসের তরকারি।
আহ্লাদে স্তম্ভিত হয়ে গেল হাফ পেন্টুল। খানিক হাঁ হয়ে থাকল। তারপর উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল – “এত্ত ভোরে এত্ত ভাতমাংস কে রেখে গেল মাঠের মধ্যি! কে?”
ব্যস্! বাবু হয়ে বসে হাঁড়ির ভিতর ডানহাত ঢুকিয়ে দিল ছেলেটা। উড়তে উড়তে আরো কাছে নেমে এল ক্ষুধাতুর কাকগুলোও। খাড়া খাড়া চুলে ভরতি মাথাটায় খুবলে দেয় আর কি!
ওসব গ্রাহ্য করল না সে। পরম নিশ্চিন্তে ভোজনপর্ব সমাধা করল। মাঠের দিকে যাওয়া আর হল না। ভারি পেট নিয়ে ফিরে আসছে ছেলেটা।
ময়লা চাদর, হাফ পেন্টুল হাত মুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকল। ডান হাতের তর্জনী মুখে পুরে বলল –
“বাপ, মাঠের মধ্যি এ-ত্ত ভোরে এ-ত্ত ভাত মাংস কে রাখল!”
“কেন? তুই কি খেয়েছিস?”
“হুঁ-উম।” ছেলেটার চোখদুটো আহ্লাদে বুজে এল।
“হায় হায়! কী সব্বোনাশ করেছিস, হা-ঘরে, হতচ্ছাড়া বাঁদর! শেষে তুই কিনা মরা মানুষের ভাত খেলি! হারু বেহেরার ‘আঁশপালনা’র ভাতমাংস কাল রাতে মাঠের মধ্যি দে গেছিল – আর তুই অভাগা খে’ ফেললি? বাঁচবি না, আর তোকে বাঁচানো যাবে না রে!”
তাই ত! মরা মানুষের ভাত জ্যান্ত মানুষের পেটে পড়লে মানুষ কী আর বাঁচে! ছেলেটা চেঁচিয়ে কেঁদে উঠে বলল “একটা কিছু ওষুধ এনে তুই আমাকে দে বাপ!”
“সার্থক ওঝার আখড়ায় চ শিগগির! দেরি করলে আর তোকে বাঁচানো যাবে নারে!”
বলেই দু-চোখে জল ভজহরি ছেলেকে কাঁধে ফেলে পড়ি-কি-মরি আখড়ার দিকে দৌড়ুল। আমরাও পিছু পিছু দৌড়ালাম।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন