এক শুক্রবারে আমরা পারিজাতে চলে এলাম। কাজলার জনবসতির কোলাহল ছেড়ে আবাসিক এলাকার নিরিবিলির মধ্যে। পারিজাতে আমাদের বাসার সামনে একটা লেক। তার জল ঘন নীল। ওপারে রাস্তা, রাস্তার পাশ ঘেঁষে রেলওয়ের আবাসন। আবাসনের ওপর দিয়ে গ্রেটার রোডের গাছপালা। তার ওপরে আকাশ। আকাশের ছায়া পড়ে লেকের জলে। নৈঋতে রেলস্টেশনের উঁচু দালান। স্টেশনের স্তম্ভে লাগানো বিশাল ঘড়ি। বিকেলবেলা বারান্দায় দাঁড়ালে প্রথমেই ঘড়িটার দিকে চোখ পড়ে। ঘড়িটাই কেবল দেখা যায়, সময় দেখার কাজে লাগে না। সময়ের কাঁটাগুলো ঝাপসা। কিন্তু ঠিকই সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়। লেকপাড়ে বিকেলবেলা জমে ওঠে। তরুণ-তরুণীরা আসে। লেকপাড়ে হাত ধরে বসে থাকে। খুব ভিড় হয়, তবু নির্জনতা ভাঙে না। কাজলায় নির্জনতা ছিল দুর্লভ। এখানে লেকপাড়ে, মানুষের ভিড়েও নিবিড় মৌনতা সেঁটে থাকে। কিন্তু মৌনতা কি ভালো? এখানে এসে কখনো কাজলার কথা মনে হয়। কাজলার হৈচৈ, চিল-চিৎকার একেবারে অসহ্য হয়ে উঠেছিল। ভিড় ঠেলে ঘরে ফেরার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। মনে হতো কবে যাব এখান থেকে। শুক্রবারের ভোরে বাসা পাল্টানো শুরু হলো। সারাদিন লেগে গেল। বাসা যারা পাল্টে দেয়, তারাই সব গুছিয়ে দিয়ে গেল। পারিজাতে আমরা প্রথম রাত কাটিয়ে দিলাম। নীরবতা ঝিঁঝিঁ পোকার মতো কানে বাজতে থাকল। সকালে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। লেকে নাম না জানা কিছু পাখি এসে নেমেছে। তিনতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম পাখিদের জলকেলি। মনে হলো, পারিজাতে এটা আমাদের স্বাগত-অভ্যর্থনা। মুগ্ধ হয়ে আমরা দুজন এই দৃশ্য দেখলাম। চোখে অবিনশ্বর একটা ছবি হয়ে গেল এই পরিযায়ী পাখিস্নান। কিন্তু মৌনতারও ভার আছে। সারাদিন মনের ওপর চেপে থাকে। কথা বলতে ইচ্ছে করে না। আমরা দুজন দুজনের দিকে তাকাই। কিছু একটা বলব বলে ভাবি। কিন্তু বলা হয় না। আলস্য লাগে। মনে হয়, কথা বললে নীরবতা ভেঙে যাবে। কিছুই ভাঙতে ইচ্ছে করে না। না নীরবতা, না ঘড়ি। সময় নিথর হয়ে চেপে থাকে। ঘড়ির কাঁটা এক মিনিট দু মিনিট করে এগোয়। তখন ভাবি, ভিড়ও খারাপ নয়। ভিড় মানে মানুষ। মানুষ মানে কথা। কথা মানে প্রাণ, সজীবতা। সজীবতা গতির কারক। গতি ছাড়া জীবন অচল। গতি মুহূর্তে সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে রাত নামায়। মনে হয়, এই তো ভোর হলো—এত দ্রুত একটা দিন কেটে যায়! কিন্তু মৌনতা! প্রাণ থেকে প্রাণের নির্যাসটুকু কেড়ে নেয়। নির্যাস মানে উদ্দীপনা। উদ্দীপনা না থাকলে কীসের জীবন! মৌনতা সজীবতা নষ্ট করে। মনও জরাগ্রস্ত হয়। আমরা একটু কলরব চাই। হোক কলরব। দুজনে জোরে জোরে কথা বলি। ভলিয়্যুম বাড়িয়ে টিভি ছেড়ে দিই। গমগম শব্দ হয়। শব্দে ঘরের দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডার কাঁপে। তবু নীরবতার গায়ে আঁচড়টিও যেন লাগে না। হয়তো যে নীরবতা পাথরের মতো চাপ ধরে আছে, তা বাইরে নয় — ভেতরে। দমবন্ধ বাতাসের মতো বুকের মধ্যে আটকে আছে। হয়তো এটাও জীবনের এক পরত। এই পরতে কেবল অভাবিত শূন্যতায় ডুবে যাওয়া আছে। কিন্তু ডুবে যাওয়া মানে ভেসে ওঠার অপেক্ষা। রুমা বলে—জীবন মূলত প্রকৃতির মতো। প্রকৃতিতে যেমন দিন রাত হয়, মেঘ-বৃষ্টি-রোদ হয়, জীবনেও এরকম দিনরাত আছে, মেঘ-বৃষ্টি-রোদ আছে। শীতকাল, শরৎকাল, বর্ষাকাল আছে। আমি রুমার কথা অক্লেশে মেনে নিই। আমরাও তো প্রকৃতিরই অংশ। একটা পাখির মতো। একটা গাছের মতো। মেঘরোদের খেলায় আমরা এখন মেঘে। রোদ এই এলো বলে। জীবনের একেকটা পরত খুলে খুলেই তো পেরিয়ে যেতে হয়। যেতে যেতে দেখতে হয়। কখনো চিল-চিৎকারে, কখনো স্তব্ধ শূন্যতায় ডুবে যেতে যেতে আবার ভেসে উঠতে হয়। জীবনের এই নিয়ম আমরা ধীরে ধীরে শিখি। পারিজাত এ শহরে নতুন আবাসিক এলাকা। শহর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ শহরতলির গ্রামকে খুব যত্ন নিয়ে শহর বানিয়েছে। গ্রামের মধ্যে শহর ঢুকিয়ে গ্রামীণ সবুজ রেখে দিয়েছে। বিকেলে ঘুরতে বেরোই। ছিমছাম রাস্তা দিয়ে হাঁটি। রাস্তাগুলো প্রায় ফাঁকা। কখনো দু-একজনকে দেখা যায়। গোছানো নারী-পুরুষ। কখনো দু-একটা শিশু-কিশোর-কিশোরী। গোছানো রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাছ। গাছ থেকে পাতা ঝরে। পাতার সরসর শব্দ হয়। পাতার সারি বাতাসে ঘুরতে ঘুরতে রাস্তাময় ছড়িয়ে পড়ে। এইসব দেখি। ভালো লাগে। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়। পাতায় ছেয়ে যাওয়া রাস্তার ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা ঘোর লাগে। ঘোর না বিভ্রম! যেন এ রাস্তা নয়—আমাদের বাড়ি। বহুদিন আগে যে বাড়ি ছেড়ে নির্মূল হয়েছি। আমাদের বাড়িটি প্রচুর গাছের ভিড়ে লুকিয়ে থাকে। দূর থেকে বোঝা যায় না—বন না বাড়ি। একসময় আমরা সবাই ওই বাড়িতে থাকতাম। শিশুরা দৌড়াদৌড়ি করত বাড়িময়। আমরা এ ঘর থেকে ও ঘরে যেতাম। আব্বা সবাইকে একসঙ্গে বসিয়ে খেতে বসত। আমরা মাদুর পেতে গোল হয়ে বসতাম। দাদি ছিল আমাদের সংসারের কর্ত্রী। দাদি সবার পাতে ভাত-তরকারি বেড়ে দিত। মা পাশে বসে দেখত আমরা ঠিকমতো খাচ্ছি কি না। খাওয়া শেষে আমরা উঠোনে বসে গল্প করতাম। কখনো কখনো আব্বা এসে ধমক লাগাতো। পড়তে বসতে বলত। আমরা আব্বাকে বেশ ভয় পেতাম। পড়তে বসতাম ঠিকই। ক্লাসের বইয়ের মধ্যে গল্পের বই ঢুকিয়ে। আমাদের পায়ের শব্দে, কথায়, গানে, চিৎকারে বাড়িটা সরগরম থাকতো। এখন বাড়িতে কেউ থাকে না। উঠোনে পাতার দঙ্গল—বুনো ঝোপ জন্মেছে এখানে সেখানে। দেয়ালে, মেঝেতে লোনা ধরা, স্যাঁতসেতে দাগ। হরিপদর ভাড়া বাড়িটার মতো। কিনু গোয়ালার গলির সেই দোতলা বাড়ির একতলা ঘরটার মতো আমাদের বাড়িটা! কালেভদ্রে সে বাড়ির উঠোনে গিয়ে দাঁড়াই। মা বলে না—বাবু এলি? আব্বাকে কোথাও দেখতে পাই না। দরজার তালাগুলোতে মরচে পড়েছে। সহজে খুলতে চায় না। ঘরের ভেতর গুমোট গন্ধ। জানালা খুলে দিলে তবে বাইরের আলো আসে। বাতাস আসে। গুমোট ভাবটা কেটে যায়। পারিজাতের নিরিবিলি রাস্তায় পাতার শব্দে, ছোঁয়ায় আমার ভেতরে জমে থাকা কয়েকটা দূষিত নিঃশ্বাস অনেকদিন পর বেরিয়ে আসে। শূন্যে মিলিয়ে যায়। ছুটির কোনদিন রুমাকে বলি—তোমার রিকশাঅলাকে ডাকো। রুমার রিজার্ভ করা এক রিকশাঅলা আছে। সকালবেলা ওকে কলেজে নিয়ে যায়, ছুটি হলে নিয়ে আসে। শহরের বাইরের কোনো গ্রাম থেকে সে আসে। গায়ে গাঁয়ের গন্ধ লেগে থাকে। সারল্যে মাখা একটি মুখ। চোখ। তাকে যদি বলি, মুকুল ভাই, দেশি মুরগির ডিম পাবো কোথায়? বলে—আমি নিয়া আসপোনে। কুনু সমস্যা নাই। যদি বলি, ঘানির সরিষার তেল এনে দিতে পারবেন? মুকুল ভাই কখনো না করে না। বিরক্ত হয় না। রুমা ফোন দিয়ে ডাকে রিকশাঅলা মুকুলকে। যথাসময়ে মুকুল চলে আসে। রাস্তার পাশে একটা সোনালু গাছ। গাছ ভরে হলুদ ফুল। রোদের মধ্যে ফুলগুলো ঝিলিক দিয়ে ওঠে। রিকশাঅলা মুকুল সোনালু গাছের ছায়ায় একটুখানি দাঁড়ায়। রোদে ঘেমে যাওয়া মুখ গামছা দিয়ে মোছে। আমরা দুজন মুকুলের রিকশায় শহরময় ঘুরি। বৈঠকে গিয়ে কখনো আলুর দম, পরোটা খাই, কখনো কেবল চা। বৈঠক নামের রেস্তরাঁটির আলুর দম, পরোটা কিংবা চা আমাদের খাবার বাসনাকে জাগিয়ে দেয়। কখনো পদ্মার পাড়ে গিয়ে বসি। পাড় ঘেঁষে অসংখ্য খাবারের দোকান। বাহারি সব নাম—রিভার ভিউ, ম্যাকডোনাল্ড, সীমন্তী আরও কী কী। কোনো একটাতে গিয়ে বসি। বসলে কিছু খেতেই হবে। তাই খাই। কখনো ফ্রেন্স ফ্রাই, না হলে কফি। পদ্মা এখানে শুকিয়ে গেছে। একটু দূরেই চর পড়েছে। হেঁটেই চরে যাওয়া যায়। চরে কাশ জন্মেছে এখানে-ওখানে। সবুজ। ফুল এখনো ফোটেনি। কিছুদিন পরে সারা চর ফুলে ফুলে শাদা হয়ে উঠবে। বালির মধ্যে পায়ে হাঁটা পথ। অনেক লোক আসে। হেঁটে অনেকদূর গেলে থৈ থৈ জল। অনেক নৌকা। নৌকার ওপর চেয়ার পাতা। টাকা দিলে নদীতে ঘুরিয়ে আনে। ঘণ্টাপ্রতি বিশ টাকা। চেয়ারে আরামে বসে নদী দেখা যায়। আমরা নৌকায় উঠি না। রুমা নৌকায় উঠতে ভয় পায়। কেন পায়, জানি না। তবে আমরা জলে নামি। নরম করে হাত রাখি জলে। আঁজলা ভরে মুখে মাখি। শীতল। বুকের ভেতরে ক্ষত। জলস্পর্শে আরাম লাগে। মনে হয়, জলের আদর তো বেশ ভালো। কী এক ক্ষত বুকে আছে—পোড়ে। কেন পোড়ে! কী না পাওয়ায় বুকের ভেতর শূন্য হয়ে থাকে! নদীর কাছে এলে এই ক্ষত ও শূন্যতা টের পাওয়া যায়। নদী যেন ডাক্তার, জল এ অসুখের পথ্য। জলচোখে তাকাই, দূরে। ওপারে ইন্ডিয়া। এক সময় আমরা একই দেশ ছিলাম। এখন আলাদা। ইন্ডিয়ার গ্রামগুলো দিগন্তে একটা আঁকা ছবির মতো লেগে থাকে। ওই ছবির সঙ্গে আমাদের গ্রামের ছবির কোনো পার্থক্য নেই। রিকশায় উঠে মুকুল ভাইকে বলি, নদী কেমন লাগে আপনার? মুকুল ভাই প্রথমে বোঝে না। পদ্মার কথা কহসেন? পদ্মা আবার কেমুন লাইগবো! পদ্মার প্যাটে আমার জমি গিসে। সব্বনাশা লদী ভাই! লাক্ষসের মতো। লদীর যদিকা মনে চায়, গিরাম ধরেন দুই হাতও না। রাইতের মধ্যে দেইখপেন জমি নাই, বাড়ি নাই। মুকুল ভাইয়ের কথা আমাকে ভাবায়। নদী কি নারীর মতো! নদীর কাছে জমি যেরকম, নারীর কাছে পুরুষ! মুকুল ভাই বলে, ভাই কী কহব! আমার ফলন্ত মরিচের ক্ষ্যাত—এক রাইতে নদী খায়া ফালালো। লাক্ষস একটা লাক্ষস! মুকুলের ইঞ্জিনচালিত রিকশা ঝটিতি আমাদের লেকের পাড়ে নিয়ে আসে। লিফটের নম্বর টিপে দাঁড়িয়ে থাকি। ওপর থেকে লিফট নামতে থাকে। সাত, ছয়, পাঁচ…। কিন্তু কোথায় দাঁড়িয়ে আছি ভুলে যাই। একটা কথাই কানে বাজতে থাকে । লাক্ষস একটা লাক্ষস! কোনোদিন খুব ফুরফুরে লাগে। সকালে ঘুম ভেঙেই কোনো এক গানের কথা মনে হয। বহু বাসনায় প্রাণপনে চাই বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে। গুনগুনিয়ে গাই। সারাদিন ঘুরেফিরে ওই একটিই গান। ঠাকুর আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে। সমর্পণের একটা স্বস্তি আছে। তখন নিজের ভার আর নিজে বইতে হয় না। আমার বন্ধু শামীম যেরকম ভারমুক্ত হয়ে আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। শামীম গ্রামে থাকে। স্কুলের মাস্টার সে। তার মুখের দিকে ছাত্ররা অবাক হয়ে তাকায়। নিরুদ্বিগ্ন একটা মুখ। চোখে একরাশ প্রত্যয়। ওকে একদিন বলেছিলাম, কী ব্যাপার বল তো! সে একটাই শব্দ বলেছিল—সমর্পণ। আমি তার মতো সমর্পিত হতে পারি না। যখন হাঁটি, তখনও নরম করে পা ফেলি। অস্বস্তি হয়। মাটি যদি কষ্ট পায় আমার সমর্পণের ভারে! কিন্তু সে তো বাইরের ভার—শরীরের। মন থেকে আকাঙ্ক্ষাকে ছিন্ন করতে না পারলে সমর্পণ সম্পূর্ণ হয় না। তবু কোনো কোনোদিন এরকম হয়। হাওয়ায় ভেসে আছি মনে হয়। অস্তিত্বও অনুভব করি না। আমিত্ব শূন্যে লীন হয়ে যায়।কাজলায় রাস্তায় বেরোলেই ভিড়। ভিড়ে অনেক চেনামুখ। চেনামুখ ভয় পাই আমি। রুমাও। ভয়ে সিঁটিয়ে যেতে যেতে আমরা প্রায় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিলাম। ক্যাম্পাস থেকে ফিরতাম কোনোদিকে না তাকিয়ে। উটপাখির মতো। রুমা কলেজ থেকে ফিরতো রিকশার হুড ফেলে। ঘরে ঢুকে বড় একটা নিঃশ্বাস নিতাম। হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। প্রতিদিন প্রত্যেকবার চেনামুখ এড়িয়ে ঘরে ফেরার পর আপনা-আপনি এই অনুভূতি হতো। আমাদের কুশলখবর একবারও কাউকে না বলে ফিরে আসার আনন্দ। এভাবে কতদিন থাকা যায়! ভিড়ের চোখ এড়ানো সহজ নয়। আমি হয়তো না দেখার ভান করি। কিন্তু কয়েসের চা-স্টল থেকে, নাজিম চাচার মুদি দোকানের সামনে থেকে, সেলিম ভাইয়ের পান বিতান থেকে কেউ না কেউ ডেকে ওঠে। চা খেতে বলে, সিগারেট খেতে বলে, পান খেতে বলে। কুশলাদি বিনিময় হয়—কেমন আছেন? কেমন আছ? কেমন আছিস? রুমা কেমন আছে? আপনারা কী করছেন? তোমাদের ব্যাপার কী? তোরা বাচ্চাকাচ্চা নিচ্ছিস না কেন? আমরা আর পারছিলাম না। পরিবারের লোকজন ফোন করে এটাসেটা বলে। শেষে এই প্রশ্নে ফিরে আসে—ডাক্তারের কাছে গেছিলি? কী বলল ডাক্তার? বন্ধুবান্ধব-শুভাকাঙ্ক্ষী ফোন করে। আমাদের খোঁজখবর নেয়। ভালোমন্দ অনেক গল্প হয়। স্মৃতিচারণা করি। স্কুলজীবনের, কলেজজীবনের, ভার্সিটি জীবনের। ফোন রেখে দেওয়ার আগে ঠিক ওই প্রসঙ্গ আসে—দোষ কার বল তো? ভারতে গিয়ে টেস্ট করা। এদেশে তো চিকিৎসা নাই। সব টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট দেয়। একবার চেন্নাই থেকে ঘুরে আয়, দেখবি হবে। আমার এক আত্মীয়া ১৫ বছর হলো বিয়ে করেছে। দেশে কত চেষ্টাতদবির করল। বাচ্চা হচ্ছিল না। চেন্নাই থেকে ফিরেই প্রেগন্যান্ট হয়েছে। কাজলা থেকে আমরা পালাতে চেয়েছিলাম। আসলে চেনামুখের প্রচুর জিজ্ঞাসা থেকে। চিল-চিৎকার, কোলাহল একসময় ঠিক সয়ে যায়। ভিড়ের গন্ধ কখনো উপভোগ্য হতে পারে। কিন্তু কৌতূহলী চোখের দৃষ্টি বড় মর্মভেদী। পছন্দমতো বাড়ি খুঁজে পেতে আমাদের দেরি হয়েছিল। কিন্তু উঠে যেতে দেরি করিনি। এক শুক্রবারে আমরা পারিজাতে চলে এলাম। প্রথম ভোরেই পরিযায়ী পাখিদল আমাদের চমকে দিয়েছিল। শীতের সেই সকালে পাখিদের জলকেলি আমরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলাম। কিন্তু মৌনতা আমাদের ঘিরে ধরেছিল। কাজলায় থাকতে টের পাইনি। বাইরের ভিড় ব্যস্ত করে রেখেছিল। ভেতরে যে শূন্যতা জড়ো হচ্ছিল বুঝিনি। শূন্যতা মানে হাহাকার। পারিজাতের নীরবতায় এসে ভেতরের শূন্যতা বেরিয়ে এলো। হাহাকার বেরিয়ে এলা। মৌনতার ভারে আমরা পিষ্ট হয়ে গেলাম। পিষ্ট হতে হতে, পিষ্ট হতে হতে, পিষ্ট হতে হতে আমাদের মনে হলো—জীবন এমনই। সুযোগ পেলেই পিষ্ট করে। কিন্তু তখনই উঠে দাঁড়াতে হয়। জীবনকে করতলে রেখে পিংপং বলের মতো খেলতে হয়। তখন রুমা রিকশাঅলা মুকুলকে ফোন দিয়ে ডাকে। আমরা রিকশা করে শহরময় ঘুরি। নদীতে যাই। চর দিয়ে হাঁটি। অনেক পাখি ওড়াউড়ি করে। ভুবনচিল আমাদের মাথার ওপরে উড়তে উড়তে খেলা দেখায়। অনেক দূর থেকে কয়েকটা শামুকখোল উড়ে আসে। পাখির মতো উড়তে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমরা জলে নামি। নদীর জল আমাদের আদর করে দেয়। আদরে আপ্লুত হয়ে গাই—আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়। অথচ রিকশাঅলা মুকুল সেই নদীকেই সর্বনাশা বলে। বলে—লদী একটা লাক্ষস ভাই, লাক্ষস! বিমূঢ় দ্বন্দ্ব নিয়ে ফিরে আসি। বারান্দায় দাঁড়াই। লেকপাড়ে তরুণ-তরুণীরা হাত ধরে বসে থাকে। জনান্তিকে চুমু খায়। নৈঋতে তাকালে রেলস্টেশনের স্তম্ভের বড় ঘড়িটা দেখা যায়। ঘড়িতে সময়ের কাঁটা ঝাপসা। সময় যেন স্থির হয়ে আছে। রুমা কোনো একটা কাজে ব্যস্ত হতে চায়। চাকরি আর রান্নাবান্না, সেই একই কাজ। একঘেয়ে। আমিও চাই সে তার পছন্দের কোনো কাজে জড়িয়ে পড়ুক। কিন্তু এ নিয়ে আমরা কোনো পরামর্শ করিনি। ক’দিন আগে ও বলছিল, গিটার শিখতে চায়। আমার ভালোই লাগল ব্যাপারটা। গিটার শেখার ইচ্ছে একসময় আমারও হয়েছিল। অনিমেষ যখন শিখেছিল তখন। তালাইমারিতে কেউ একজন শেখাত। রুমার জন্য গিটার শিক্ষক খোঁজার জন্য অনিমেষকে ফোন দিলাম। অনিমেষের সঙ্গে সেই শিক্ষকের আর যোগাযোগ নাই। বছর কুড়ি আগে কদিনের মধ্যেই অনিমেষ খরবায়ু বয় বেগে শিখে এসে আমাদের শুনিয়েছিল। ওর বাজানো শুনে আমারও ইচ্ছে হয়েছিল, যদি আমিও পারতাম! কিন্তু তখন আব্বা মারা যায়। লাং ক্যান্সারে মারা যাবার সময় আমাদের পরিবারের পথে বসা অবস্থা। আমার জীবন বদলে যায়। বদলাতে বাধ্য হই। আব্বা মারা যাওয়ার আগে আর পরে যেন দুটো জন্ম আমার। বিনোদপুরের মেস থেকে হলে উঠে যাই। নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ছাত্রদের বাড়িতে গিয়ে টিউশনি শুরু করি। টিউশনি বাড়িতে খাই। গিটার শেখার ইচ্ছে হয়েছিল, এই কথাটাই আর মনে থাকে না। এতদিন পরে রুমার ইচ্ছেটা আমাকে পুরনো দিনে নিয়ে যায়। কিন্তু গিটার কোথায় শেখা যায়, কেউ জানে না। এর মধ্যে একদিন দেখি টবসমেত ফুল গাছ নিয়ে ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে বাসার সামনে। রুমা বলে বাগান করব। বাগান করার জায়গা কোথায়! ভাড়া ফ্ল্যাট! কে আমাদের বাগান করতে দেবে! রুমা নাছোড়ান্দা—আমাদের দুটো বারান্দা। দুটো বারান্দাই ফুলে ভরিয়ে দেব। আমি ভাবি, যাক—গিটার মাস্টার খুঁজে পেতে দেরি হলেও আর সমস্যা নেই। সে নবীন গাছে ফুল ফোটানোর কাজে লেগে পড়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই বারান্দায় চলে যায়। কোনো টবের মাটি তৈরি করে। কোনো টবে জৈব সার দেয়। পানি দেয়। গাছগুলো যেন শিশু। আমাদের শিশু নেই। আমাদের কোল খালি। রুমা প্রাণভরে গাছের যত্ন করে। চাকরি থেকে ঘরে ফিরে ঠিকমতো খায়ও না। গাছের কাছে চলে যায়। গাছের সঙ্গে কথা বলে। আমি একটু চিন্তিত হই। দূর থেকে শোনার চেষ্টা করি—আসলে তারা কী কথা বলে! অস্পষ্ট কিছু ধ্বনি কানে আসে। বাণীর চেয়ে সুর বেশি। সেই বাণীতে একটি শিশু থাকে। সেই সুরে একজন মা থাকে। মা তার শিশুকে আদর করে। খাওয়ায়। ঘুম পাড়ায়। আমি আড়ালে থেকে একজন গাছমাতাকে দেখি। এর মধ্যে খবর পাই, গিটার শিক্ষকের খোঁজ পাওয়া গেছে। এবং কী আশ্চর্য সে বউকে নিয়ে আমাদের পারিজাতেই থাকে। ভদ্রলোকের নাম ইয়ান থর্প। আমেরিকান। লোকসংগীত নিয়ে গবেষণা করতে এসে আর ফিরে যাননি। বিকেলবেলা হাঁটতে বেরিয়ে আমরা থর্পের মিউজিক স্কুল দেখে আসি। রুমার যেন তর সয় না। সে এ সপ্তাহেই ভর্তি হতে চায়। ওর আগ্রহ আমাকেও আপ্লুত করে। কিন্তু ততদিনে করোনা ভাইরাস চীন থেকে এদেশে এসে পড়ে। প্যান্ডামিক হয়ে যায়। একশো বছর পরে পৃথিবীর অসুখ হয়। এক সন্ধ্যার খবরে আমরা জানতে পারি, সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা অনির্দিষ্টকালের জন্য কোয়ারেন্টাইনে চলে যাই। গিটার শেখা পিছিয়ে যায়। রুমার তখন অঢেল সময়। সময় নেই অসময় নেই, গাছের মধ্যে হারিয়ে থাকে। একা একা গান গায়। সেলফি তোলে। একদিন তার চিৎকার শুনে চমকে যাই। ভয় লাগে। বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে ওঠে। না, ভয়ের কিছু নেই। বারান্দার কাঠগোলাপে ফুল এসেছে। সেদিন ফেসবুকের মাই ডে’র একটা ছবিতে আমার চোখ আটকে যায়। দেখি কাঠগোলাপটি রুমার বুকের কাছে এমনভাবে লেপ্টে আছে—যেভাবে মা তার শিশুকে চুমু খায়।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
বড় মায়া জড়ানো।
আগুন যদি জীবনঘষে বের হয় তা হলে সে আগুনে কেবল যার চূলা সে জ্বলে না পড়শির গায়েও ছ্যাকা লাগে। আমি পড়শী তাই আগুনের ছ্যাঁকা থেকে আমিও রেহাই পেলাম না। মনে হলো এতো কেবল গল্প নয় জীবনঘষে দাউ দাউ করে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া।
অনুপমদা আমি বরং ‘সংক্রান্তি’র অপেক্ষায় আছি।
বন্ধু ভালোবাসা খুব তোকে।
মায়া কাড়া লেখা! একটানা পড়ে গেলাম
অশেষ প্রীতি আপা।
এভাবে সবকিছু মেনেই জীবন বয়ে চলে জীবনের পথে
ধন্যবাদ ও শুভকামনা
ভালো লাগল। আপনার গদ্য বেশ ভালো, পড়তে ক্লান্তি লাগে না। গল্প বলার শৈলীও সুন্দর।
ধন্যবাদ স্যার। খুব ভালো থাকবেন। সবসময়।
কী দারুণ একটা গল্প পড়লাম!! ভালবাসা ভাই!!!