short-story-neel-ronger-swapno

নীল রঙের স্বপ্ন
অর্পিতা সরকার


‘কী রে বর্ষা মুখটা অমন গম্ভীর করে আছিস কেন? আমি ভাবলাম, তুই ফিরেছিস তোর কাছ থেকে কলকাতার গল্প শুনবো, এসে থেকে তুই মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে আছিস! কিছু হয়েছে নাকি রে?’

বর্ষা ঘাড় নেড়ে বলল, ‘না তেমন কিছু নয়।’

নিশি আরও আগ্রহের সঙ্গে বলল, ‘এই বল না শহুরে ছেলেগুলো বেশ ঝক্কাস দেখতে না? বড় চাকরি করে? আমাদের পাড়ার ছেলেগুলোর মতো হাঘরে অন্তত নয়। সব কটার নুন আনতে পান্তা ফুরায়, ধুর ধুর। এই বর্ষা, তুই কারোর প্রেমে পড়েছিস? বল না তোর প্রেমের গল্প শুনি। জানিস তো আমাদের নূপুরের কী ভালো কপাল রে। শহরে কাজ করতে গেল কোন এক রাখি তৈরির কোম্পানিতে। তারপর তো কোনও পাত্তাই নেই ওর। গ্রামের সবাই বলল, নূপুরকে বোধহয় কোনও বদ লোক বেচে দিয়েছে খারাপ জায়গায়। নূপুরের মা আমাদের সবিতা জেঠিমা তো কেঁদে কেঁদে চোখের জল শুকিয়ে ফেলল গত চার বছরে। নুপুরের দাদাও কলকাতা গিয়ে খুঁজে ফেলল সব। যে রাখির কোম্পানিতে কাজে ঢুকেছিল সেখানে নাকি লোকজন বলেছে ও তো মাত্র পাঁচমাস কাজ করে কাজ ছেড়ে দিয়েছিল। গতমাসে কী হয়েছে জানিস, বর্ষা? তুই শুনলে চমকে যাবি। পুরো হিরোইনের মতো সেজেগুজে একটা দারুণ দেখতে বর, পাঁচমাসের ছেলে কোলে নিয়ে নূপুর হাজির গাড়ি করে। কত গয়না পরেছিল জানিস? একটা বড়লোক বাড়ির ছেলের সঙ্গে বিয়ে করেছে। কোম্পানি যাওয়ার পথেই নাকি ছেলেটার সঙ্গে ওর আলাপ। ভেবে দেখ কী কপাল। ওই তো নূপুরদের বাড়িতে ছাদ ঢালাই হচ্ছে। জামাই করিয়ে দিচ্ছে। কপালটা একবার ভাব। আর নূপুরের থেকে তো তুই কয়েকশো গুণ সুন্দরী। লেখাপড়াও ওর থেকে তো বেশি জানিস। তোর প্রেমে তো কেউ না কেউ পড়বেই।’

এতগুলো কথা একসঙ্গে বলে একটু জোরেই নিঃশ্বাস টানলো নিশি। বর্ষাকে এবারে যেন কেমন একটা অপরিচিত লাগছে নিশির। কথাও যেন একটু কম বলছে। বর্ষা ওদের পাড়ার নামকরা সুন্দরী মেয়ে। যত্ন না করেই গায়ের রংটা মাখনের মতো। কে বলবে যে ওর মা ভরা পেট খেতেও দিতে পারেনি ওকে। লোকে বলে ফল, মাছ, মাংস খেলে গ্ল্যামার বাড়ে। লোকে এসে দেখে যাক বর্ষাকে। শেষ বিকালের সূর্যের আলোও যেন পিছলে যাচ্ছে ওর অন্যমনস্ক কপালে পড়ে। পাড়ার ছেলেরা তো সেই স্কুলবেলা থেকেই বর্ষার সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য নিশিকে ধরতো। নিশি যেন বর্ষার গার্জেন। নিশি আবার খোঁচালো, ‘এই বর্ষা বল না, তুই প্রেমে পড়েছিস? আমার চোখকে ফাঁকি দেবার চেষ্টা করবি না।’

মাত্র উনিশের বর্ষা একমনে তাকিয়ে আছে কেতকী নদীর দিকে। নামেই নদী, সারা গ্রীষ্মকাল জুড়ে শুকিয়ে মাঠ হয়ে থাকে। বৃষ্টি হলে তবেই একটু খাল মতো হয়। তবুও এ পাড়ার সবাই কেতকীর ধারে বলতেই অভ্যস্ত।

বর্ষা স্বপ্নভাঙা গলায় বলল, ‘শহুরে ছেলেরাও অনেকটা কেতকীনদীর মতোই। নামেই রাজকুমার, পকেটে ফুটো কড়ি নেই। কিন্তু স্বপ্ন দেখে আকাশ ছোঁয়া।’

নিশির খুব উৎসাহ কলকাতা শহর সম্পর্কে জানার। মাসির বাড়ি কলকাতায়, তাই দু’বার দেখার সুযোগ হয়েছিল আলো ঝলমলে মায়াবী শহরটাকে। এখন নিজের প্রিয় বন্ধু সেই শহরেই চাকরি করে, তাই জানার সুযোগ বেশি। তাছাড়া সেই পাখি আঁকা টেপফ্রকবেলা থেকে নিশি আর বর্ষার বন্ধুত্ব। তাই কেউ কারোর কাছে কিছুই গোপন করে না।

নিশি বলল, ‘বুঝেছি ছ্যাঁকা খেয়েছিস।’

বর্ষা হেসে বলল, ‘জানিস গরিবের ভোরের স্বপ্নও সত্যি হয় না। আমারটা ভেঙেছে, রাজেশেরটা বাকি আছে। ওরটা যাতে না ভাঙে তার আগেই কাজটা ছেড়ে অন্য কাজে জয়েন করতে হবে।’ নিশি বলল, ‘শোন না, এত ঘোরালো কথা বুঝতেই তো পারছি না।’

বর্ষা আনমনে বলল, ‘আমি যে বাড়িতে আয়ার কাজ করি তার ঠিক পাশেই একটা পার্ক আছে। বিকেল হলেই ওখানে অনেক প্রেমিক-প্রেমিকা প্রেম করতে আসে। আমি শর্টকাটে পার্কের মধ্যে দিয়েই বাজারে যাই। রোজই দেখি জোড়ায় জোড়ায় হাতে হাত দিয়ে পার্কে ঢুকছে। কী সুন্দর তাদের পোশাক-আশাক। আর ঠোঁটে অভিমানী হাসি। ওদের দেখবো বলেই বাজারে যাওয়ার ওই পথটা নিতাম কী না আমিও জানি না। তবে হাঁ করে দেখতে দেখতে যেতাম। শেষ বিকেলের আলোয় পার্কে যেন প্রেমিক-প্রেমিকার মেলা বসে পার্কের বেঞ্চগুলোতে। দূর থেকে ভেসে আসে ওদের হাসির আওয়াজ। তো ওটাই আমার বাজারে যাওয়ার রাস্তা ছিল। একদিন বাজারে ঢোকার আগেই একটা গাড়ির ধাক্কা খেতে খেতে বেঁচে গিয়েছিলাম। দোষটা আমার নয়, গাড়ির মালিকের। তাই মালিক ক্ষমা চেয়ে আমায় গাড়ি করে বাড়ি দিতে আসে। আমার ডান হাতে বেশ ভালোই লেগেছিল। কারণ রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলাম। তো পাশের একটা দোকান থেকে বরফ চেয়ে গাড়ির মালিক আমার হাতে লাগিয়েও দিয়েছিল। সত্যি বলতে অত বড়লোকের ছেলের অমন ব্যবহার দেখা যায় না। মুশকিলটা হলো, আমি যে বাড়িতে কাজ করি তাদের তিনতলা বিশাল বাড়ি দেখে ভেবে নেয় আমি ওই বাড়িরই মেয়ে। প্রায়ই পার্কের রাস্তায় দেখা হচ্ছিল রাজেশের সঙ্গে। রাজেশ যে বেশ ধনী সেটা আমি টের পাচ্ছিলাম ওর পোশাকে, কথাবার্তায়। আমারও স্বপ্ন ছিল বড়লোকের ছেলে বিয়ে করবো। জন্মে থেকে তো ভাঙা চাল ছাড়া গোটা চালের ভাত পাইনি পাতে, এখন তো সংসারটাই চলে আমার পাঠানো টাকায়। বাবা মারা যাবার পরে মাও তো কেমন একটা হয়ে গেছে জানিসই। রাজেশকে কোনওদিন বলিনি আমি আয়ার কাজ করি। সম্পর্কের বয়েস বাড়ছিল। আমরা প্রায়ই দেখা করতাম। রাজেশ আমায় দামি রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিল। বিশাল সিনেমাহলে সিনেমা দেখাতেও নিয়ে গিয়েছিল। অত বড় সিনেমাহল আমি কোনোদিন দেখিনি। তবুও আমি নিজের কোনও দুর্বলতা দেখাতে চাইনি। ওকে বুঝতে দিইনি এসব আমি প্রথমবার দেখছি। পার্কস্ট্রিটে যেদিন খেতে নিয়ে গিয়ে বলেছিল, বল কী খাবে? সেদিন পড়েছিলাম চরম বিপদে। ওসব খাবার খাওয়া দূরে থাক, নাম অবধি শুনিনি। তোর মনে আছে নিরঞ্জনকাকা একবার আমাদের বাজারের রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন খাইয়েছিল, ওটাই বললাম বুক ঠুকে। রাজেশ হেসে বলেছিল, বুঝলাম তুমি চাইনিজ ভক্ত। নিজের মনে হেসেই মরি। আমার খুব বলতে ইচ্ছে করছিল, আমরা শুধু পরিতোষের আলুর চপের ভক্ত। আর মায়ের হাতের চুনো মাছের ঝালের ভক্ত। হালেকালে কারোর বিয়ে লাগলে আমাদের মাংস খাওয়া জোটে। হেসে বলেছিলাম, হ্যাঁ আমি চাইনিজ ভক্ত। রাজেশ জিজ্ঞাসা করেছিল, আমার প্রিয় খাবার কী? প্রিয় রং কী? প্রিয় অ্যাক্টর কে? যা বাবা! আমার আবার প্রিয়? এতটা বয়েস হলো নিজের মা-ই কোনোদিন জানতে চাইল না অভাবের বাইরে আর কিছু প্রিয় কী না আমার। আর রাজেশ জানতে চায় আমার প্রিয় রং কী? দেখ নিশি, বলা তো যায় না, রং জ্বলা, ধূসর রঙের জামা পরেই কেটে গেছে জীবনটা। তাই বললাম, নীল রং খুব প্রিয়।

রাজেশ একটা নীল রঙের চুড়িদার এনে হাজির করেছিল পরের দিন। একটা নতুন চুড়িদার।

যাদের বাড়িতে আয়ার কাজ করতাম, তার মেয়ের বহু দামি দামি পোশাক। পছন্দ নাহলে একবার পরেই আমায় দিয়ে দিতো। সেসব পরে আমি সুন্দর করে সেজেগুজে যেতাম। রাজেশ চুড়িদারটা হাতে দিয়ে বলেছিল, দেখো তো পছন্দ হয় কি না? তুমি অবশ্য অনেক দামি দামি পোশাক পরো। বোঝো কাণ্ড! পরের পরা পোশাক তো দামিই হয়। বিশ্বাস কর, দোকান থেকে কিনে সোজা আমার হাতে দিয়েছিল নীল রঙের চুড়িদারটা। ঠিক যেন রূপকথার রাজকন্যার গল্প। জানিস নতুন পোশাকের একটা অন্যরকম গন্ধ থাকে। বাবা যখন পুজোয় কিনে দিতো, তখন শুঁকতাম নতুনের গন্ধ। তারপর তো মা এনে দিতো শিউলীদির ছোট হওয়া জামা। তাই নতুনের গন্ধ তো ভুলেই গিয়েছিলাম। রাজেশ আমায় নতুনের সুবাস দিয়েছিল। আমিও দিয়েছি ওকে, মাইনের টাকার অল্প জমিয়ে একটা গাড়ির চাবির রিং। আমাদের দিনগুলো স্বপ্নের মত কেটে যাচ্ছিল। চারিদিকে রঙের বাহার। রাতে সস্তার তক্তায় শুয়ে শুয়ে আমি স্বপ্ন দেখতে লাগলাম। একটা হালকা নীল রঙের স্বপ্ন। সেখানে নীল গাড়ি চড়ে একটা ছেলে এসে দাঁড়ায় আর আমি নীল চুড়িদার পরে ওড়না উড়িয়ে সেই গাড়ির দরজা খুলে গিয়ে বসি গাড়ির ভিতরে। যেখানে বাইরের উত্তাপ নেই, ঠান্ডা বাতাস দেয়, মিউজিক সিস্টেমে বাজে ভালবাসার গান।

রাজেশ গাড়ি চালাতে চালাতেই একটা হাত রাখে আমার হাতে। তারপরেই ধড়ফড় করে ভেঙে যায় স্বপ্নটা। তারপর আর ঘুম আসতে চায় না জানিস।’

নিশি বলল, ‘তুই ওকে ভালোবাসিস?’

বর্ষা বলল, ‘হ্যাঁ বাসি, খুব বাসি। কিন্তু লাভ নেই রে। আমি ওই অবস্থাপন্ন রাজেশকে ভালো বেসেছিলাম, মানুষ রাজেশকে নয়। এখন মানুষটাকেও ভালোবাসি, কিন্তু নিরুপায়।’

নিশি বলল, ‘হ্যাঁ রে কলকাতায় বাস করলে বুঝি এত হেঁয়ালি করে কথা বলতে হয়? এ তো সোজা উত্তর হ্যাঁ ভালবাসি অথবা না বাসি না। এর আবার এত ঘোরালো উত্তর হবে এটা তো জানা ছিল না।’

বর্ষা বলল, ‘নিশি তুই বেশ সাদাসিধে, তোর স্বপ্নের রঙও সাদা। দেখবি তোর খুব ভালো বিয়ে হবে। তুই যতটা সহজ করে বললি, আমাদের সম্পর্কের শুরুটা যদি সত্যিই সহজ হতো এমন খুব ভালো হতো। কিন্তু এ সম্পর্কের শুরুতেই একটা বড় গর্ত হয়ে গেছে। এখন সেই গর্ত দিয়ে ঝুরো মাটি ঝুরঝুর করে পড়ে যাচ্ছে। দু’হাতের এর কত ক্ষমতা বলতো যে আটকাবো। জানিস আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে একবার চৌকি বিক্রি করতে যাচ্ছিল। বাবা একটা বড় চৌকি কিনেছিল আমার জন্য। আমি তো সে চৌকি পেয়ে বেজায় খুশি। কিন্তু রাতে ঘুমালেই একটা ঘুণ পোকা এসে কুড়কুড় করে আওয়াজ শুরু করতো। বাবাকে বলতে বাবা চৌকি উল্টে দেখল বেশ বড় গর্ত করে দিয়েছে ঘুণ পোকায়। চৌকিতা বাঁচাতে আলকাতরা লাগানো হলো কাঠে। কিন্তু শব্দ থামলো না। রং করা হলো, ওষুধ দেওয়া হলো তবুও ঝুড়ঝুড় করে কাঠের গুঁড়ো পড়ে থাকতো মেঝেতে। একদিন চৌকিতে শুয়ে শুয়ে রেডিওতে গান শুনছিলাম। হুড়মুড় করে চৌকিটা ভেঙে গেল। বাবা বলেছিল, পায়াটা খেয়ে ভুয়ো করে দিয়েছে যে প্রথম দিন থেকেই। আমাদের সম্পর্কটাও এমন বড় গর্ত নিয়েই শুরু হয়েছে, তাই পা পিছলে সেখানে পড়ে যেতে বাধ্য।’

নিশি বলল, ‘রাজেশকে একটা ফোন কর না শুনবো কী বলে?’

বর্ষা বিষণ্ণ গলায় বলল, ‘প্রায় দিন তিনেক রাজেশের দেখা নেই পার্কে। ফোন করলেও ধরছে না। চিন্তা হচ্ছিল। একটু তাড়াতাড়ি ডিউটি সেরে রাজেশের খোঁজে বেরোলাম। একটা বড় বাড়ির সামনে দেখলাম রাজেশের গাড়িটা দাঁড় করানো আছে। বাড়িতে ভয়ে ভয়েই কলিংবেল বাজালাম। একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা দরজা খুললেন। সম্ভবত রাজেশের মা হবেন।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি রাজেশের মা? ভদ্রমহিলা আমায় বসিয়ে বললেন, না আমি ওর কাকিমা। ও আমাদের গাড়ি চালায়। এখানেই থাকে। ওর মা খুব ভোগে, মায়ের জ্বর বলেই গ্রামে গেছে। ফিরে আসবে। ওনার সঙ্গে গল্প করতে করতেই শুনলাম, রাজেশ বড়লোক হতে চায়, অনেক বড়লোক। ছোট থেকে খুব কষ্টে মানুষ হয়েছে তো তাই। বলে কাকিমা, একটা বড়লোকের মেয়ে দেখো তো বিয়ে করবো। আমি হেসে বলি, বড়লোকের মেয়ে তোকে কেন বিয়ে করবে রে পাগল? তবে ছেলেটা ভালো। রাজেশ বলে, বড়লোকের মেয়ে হলেই হবে, রূপের দরকার নেই।

আমি বলি, শুধু টাকাই কি সব?

রাজেশ বলে, গরিবদের কাছে ওটাই স্বপ্ন, ওটাই ভালোবাসা, ওটাই সম্মান।

কাকিমা জিজ্ঞাসা করলেন, রাজেশ ফিরলে কী বলবো? কী নাম তোমার? তোমায় কি রাজেশ ভালোবাসে? ভারী মিষ্টি দেখতে তো তুমি।

আমি শুধু বললাম, কিছু বলার দরকার নেই।

বুঝলি নিশি, আমি আর রাজেশ দুজনেই বড়লোক হবার জন্য একই পথের পথিক হয়েছিলাম… আমাদের মিলটা এখানেই।’

নিশি বলল, ‘কিন্তু তুই যখন ওকে ভালোবাসিস তখন জানিয়ে দে সত্যিটা।’

বর্ষা হেসে বলল, ‘ধুর পাগলি; নিজের স্বপ্ন ভেঙেছে বলে ওকেও বুঝিয়ে দেব, ও মরীচিকার পিছনে ছুটছিল! গরিবরা মরূদ্যানের দেখা পায় না! বরং ও জানুক একটা বড়লোকের মেয়ে ওর সঙ্গে ব্রেকআপ করেছে ঠিকই, কিন্তু আরেকজন আসতেই পারে। পার্কের কোণে একটা ঝিরিঝিরি পাতার গাছ ছিল। আমরা প্রায়ই তর্ক করতাম ওই গাছটার নাম নিয়ে। রাজেশ বলতো, ওটা ঝাউ, আমি বলতাম, ওটা পাতাবাহার। শেষে কোনও সমাধান না পেয়ে বলতাম, নামে কী আসে যায়? ওটা একটা গাছ, ব্যস। জানিস নিশি, নামে অনেক কিছু আসে যায় রে। অনেক কিছু বদলে যায়। আজ যদি রাজেশ সত্যিই ধনী হত, হয়তো আমার মিথ্যে ধরে ফেলে আমায় ছেড়ে দিতো। অথবা আমি ধনী হতাম তাহলেও রাজেশের সত্যিটা জেনে সরে আসতাম। কিন্তু আমরা একই গোত্রীয়, দুজনেই অভাব দেখি প্রতিমুহূর্তে, দুজনেই অযৌক্তিক স্বপ্ন বুনি চোখের পাতায়।

এই যে কেতকী নদী বললেই সবাই মনে করবে জল থৈথৈ দু’কূল। শুধু বল্লভপাড়ার সবাই জানি কেতকী মানে সরু খাল। তাই যারা নদী ভাবে তাদের ভুল ভাঙিয়ে লাভ আছে? রাজেশের স্বপ্নটা ভেঙে লাভ আছে? তাই তো পালিয়ে এলাম। দিন পাঁচেক পরে অন্য একটা বাড়িতে কাজে জয়েন করবো। আসলে ভালোবাসি বলতে গেলে সত্যি পরিচয়ে যেতে হয়। নাহলে হুড়মুড় করে ভেঙে যায়। জানিস নিশি আমি চাই না রাজেশের সঙ্গে আর কোন পথের বাঁকে আমার দেখা হোক। আমি হারিয়ে গেলাম ঠিকই ওর জীবন থেকে তবুও যেন অল্প স্মৃতি রয়ে যায় রাজেশের মনে। আমি চাই রাজেশের স্বপ্নপূরণ হোক।’

নিশি বলল, ‘রাস্তার দিকে একবার তাকা। ওই দেখ, নীল রঙয়ের গাড়িটা থেকে নামছে একটা ছেলে। রাজেশেরও নীল রঙের গাড়িই বললি না তুই?’

নিশির আঙুল দেখানো দিকে তাকিয়ে চমকে উঠেছে বর্ষা। রাজেশ আসছে ওর গ্রামে। ফোনে না পেয়ে তার মানে দত্তবাড়ি থেকে ওর ঠিকানা জোগাড় করে এসেছে। বুকটা কেঁপে উঠলো, আনন্দে না ভয়ে জানে না বর্ষা।

বর্ষা বলল, ‘চল পালাই।‘

নিশি বলল, ‘তোর সবটা জেনে যখন এসেছে তখন পালাবি কেন? ভালবাসে বলেই তো এসেছে।’

ছেলেটা এগিয়ে আসছে, অবয়বটা একটু করে পরিষ্কার হতে বর্ষা বলল, ‘রাজেশের মতো কিছুটা কিন্তু এটা রাজেশ নয়। ও আরেকটু শ্যামলা, আরেকটু লম্বা। গাড়িটার রং নীল দেখে ভুল করেছিলাম।’

ছেলেটা এগিয়ে এসে একজনকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ব্যানার্জীদের বাড়ি কোনটা? বাড়ি অবধি গাড়ি যাবে না তাই না?’

নিশি চুপ করে বর্ষার হাতটা ধরলো। বেশ বুঝতে পারছে বর্ষার হাতটা কাঁপছে তিরতির করে। ঠিক যেন লুকোচুরিতে ধাপ্পা খেয়ে গেছে ও।

চুপ করে বসে আছে ওরা। সন্ধে নামছে। নারায়ণের মন্দিরে শাঁখের আওয়াজ। এই শব্দটা শুনেই ওরা খেলা ফেলে ছুটে বাড়ি যেতো। শাঁখ বেজে যাওয়ার পরেও বাড়ির বাইরে থাকলে মা মারতো। আজকেও শাঁখের আওয়াজ পেল। বর্ষা বলল, ‘চল বাড়ি যাই। খেলা শেষে বাড়ি ফিরতাম আমরা এই সময়। এখন গল্প শেষে বাড়ি চল।’

নিশি চমকে উঠে বলল, ‘এটা সত্যি নয়? তুই আমায় এতক্ষণ মিথ্যে গল্প বললি? কলকাতার গল্প শুনতে চাইলাম বলে?’

বর্ষা জামার ঘাস ঝেড়ে উঠে বলল, ‘চল, সন্ধে হলো বাড়ি যাই।’

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

2 thoughts on “short-story-neel-ronger-swapno

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *