short-story-niruddesh

নিরুদ্দেশ
আফসানা বেগম


‘একনা দম নিয়া হাঁটিস না ক্যান, বাহে… একনা নামে দে মোক।’

একটু পর পর অনীলের মাথার উপর থেকে একই কথা শোনা যায়। মাথার উপরে বাঁশের ডালার মধ্যে বসে আছে রাধারমন পাল। লিকলিকে বাহুতে ডালার দুইদিকে ধরে আছে অনিল। দুই বাহুতে দুদিকে ঝোলানো দুটো চটের ব্যাগ পিছলে নুয়ে আসে বারবার। সে এক হাত দিয়েই ডালাটা ধরে আর এক হাত দিয়ে দুদিকের ব্যাগদুটোর অবস্থান ঠিক করে নেয়। তবু পা থামে না। পিঁপড়ার মতো পিল পিল করে ক্ষেতের মাঝখানের আলের উপর দিয়ে একের পর এক পা ফেলছে লোকেরা। কারো গায়ে ঝোলানো বোঁচকা, কারো কোমরের কাছে ঝুলছে শিশু, মাথার উপরে বস্তা। মধ্যরাতের চাঁদের আলো আবছায়ার পায়ের অবস্থানটা চিনিয়ে দেয় ঠিকই। পা কখনও সরু আল থেকে ফসকে নিচে পড়ে। ভেজা ভেজা মাটির স্পর্শ লাগে। ধাক্কায় বোঁচকা আর ডালা নড়ে ওঠে। তারপর আবার সংযত হয়ে আলের উপরে নিজেকে দাঁড় করিয়ে নিয়ে হাঁটা। চাঁদটা ঠিক মাথার উপরে ছিল কখন যেন, তারপর ফুস্ করে সামনে চলে এসেছে।

অনীল পাল পিলপিলে পাঁয়ে চলা মানুষের দলের মাঝামাঝি কোথাও হাঁটে। পিছনে কত লোক আছে আর সামনে কত, অনিলের মাথায় আসে না। শুধু জানে পা চালাতে হবে। সামান্য থামলেও পিছনের লোকগুলো আটকে থাকবে। দুইদিকে কাদায় ভরা খেত, নামলেই জোকে ছেঁকে ধরবে। কিন্তু মাথার উপরের ঝুড়ি থেকে খানিক বাদে বাদে ক্ষীণ আওয়াজ আসে, ‘দে না রে নামে একনা। মুই আর আটকি রাখবার পারিম না।’

প্রথম প্রথম অনিল জবাব দিয়েছিল, ‘আরেকনা থাকেন না ক্যান, সামনে নামে দেবো। এলা খাড়াইলে পিছত পড়ি যাইম।’ পরের দিকে আর কথা বলতে ইচ্ছা করেনি। একই কথা আর কতবার বলবে। মধ্যরাত, ভোর হবার লক্ষণ নেই। নিঃশব্দে পা চলে লোকগুলোর। প্রত্যেকে অগাধ বিশ^াসে আগের জনকে অনুসরণ করে। যেখানে পা ফেলে আগের জন, বেলে মাটিতে গেঁথে না-যাওয়া সে দাগ পায়ে পায়ে কল্পনা করে আরেকজন। খানিকটা শীতল শক্ত মাটি পার হয়ে বালুর দিকে যাচ্ছে তারা। পায়ের স্পর্শে ঠাওর করা যায়। ভুরুঙ্গামারির কাছাকাছি একটা গ্রাম থেকে সারা দিন আর তারপর মধ্যরাত পর্যন্ত একটানা হেঁটে কাফেলার মতো দলটা নদীর কাছাকাছি চলে এসেছে হয়ত। নদীটা পার হতে হবে। এ সময়ে পায়ের গোঁড়ালি ধরলার মাঝ বরাবর বড়জোর হাঁটু অবধি ডুববে। নদী পার হয়ে আরো অনেকটা দূরত্ব হলেও, সীমান্ত দেখা যায়। ওই পর্যন্ত কোনোরকম কালকের দিনের মধ্যে যেতে পারলেই হলো।

নদীর ব্যাপারটা আরেকটু নিশ্চিত হতে পারলে মাথার উপর থেকে যে বুড়া নামার জন্য অস্থির হয়েছে তাকে বুঝিয়ে বলা যেত, আরেকনা ধৈয্য ধরেন না ক্যান, বাহে! কিন্তু ভয়ে বা কষ্টে কথা মুখে আসে না অনীলের। একে তো আর্মি আর রাজাকারে জায়গাটা কিলবিল করছে, তার উপরে ভয় সূর্যের। হাঁটতে হাঁটতে সময়ের গুনতি থাকে না, কখন যে হুট করে চরের ওইপারে ওঠা শুরু হয়! আলো খুব খারাপ জিনিস, বিশেষ করে আসছে সকালটার জন্য। আলো শত্রুদের দেখিয়ে দেবে যে, ওই দূরে এক পাল ভয়ে-কাঁপা লোক হেঁটে চলছে, পালিয়ে যাচ্ছে।

কারো হাতে এক ফোঁটা আলো নেই। হারিকেন আছে কারো কাছে, সম্বল ছিল বলে নিয়ে আসা, তাতে কেরোসিনও ভরা কিন্তু সলতে ঠান্ডা। মুখে কথা নেই কারো। তবু প্রত্যেকের দুঃশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা আর ক্ষুধার প্রকোপ কেমন করে যেন শব্দহীন ভাষা খুঁজে পায়। পায়ে পায়ে মাটির উপরের থপ থপ শব্দ যেন গোপন সুরে এক তালে বেজে যায়।

পিছনে অনীলের বউ শেফালি হাঁটে। কোলে এক বছরের আর হাতে ধরা সাড়ে তিন বছরের দুই শিশু। বাচ্চাটা পাশে পাশে হাঁটে, বেশিরভাগ মায়ের শাড়ি টেনে ধরে মাটিতে শুয়ে পড়তে চায়। মায়ের কোলে নতুন জনকে দেখে তার হাঁটার ক্লান্তি প্রতিমুহূর্তে জানান দেয়। সে ওই কোলটা পায় না বলেই কিছু পরে পরে প্রতিবাদে শাড়ির কোথাও খামচে ধরে ঝুলে থাকে। কান্না বাড়লে ধমক খায়, কেবল মায়ের না, সারির অন্যরাও খেঁকিয়ে ওঠে, ‘এইগলা শব্দোতে হামাক ধরে দিমেন এলা!’ বারেবারে ধমকে চুপ হতে হতে তার ঝিমুনি আসে। হাত থেকে শাড়ি খসে গিয়ে মাটিতে পড়ে যায় সে। বাধ্য হয়ে মা তাকে কোলের আরেকদিকে ওঠায় কিংবা ঘাড়ের উপরে চালান করে। স্থানকালপাত্র ভুলে সে শান্তির ঘুম ঘুমিয়ে নেয় তখন। চাঁদ তার ঘামে ভেজা পরিশ্রান্ত মুখটার উপরে অবিরাম আলো ঢালে তখন।

বড়ো মানুষগুলোর মুখে চাঁদের আলোর পরিবর্তে রাতের অন্ধকারের চেয়েও কালো ছায়া থমকে থাকে। কীসের আশায় রান্নাঘরে চুলায় চাপানো ভাত ফেলে, মুকুলে ভরে যাওয়া আম গাছ ফেলে, উঠোনের টানা দড়িতে মেলে রাখা ভেজা শাড়ি-লুঙ্গি ফেলে, গোলাঘরে জমানো সামান্য ধান-চাল ফেলে, সামনের তুচ্ছ্ব সম্পদ হাতে তুলে হুড়মুড় করে হাঁটা দিল, তা এখনো কেউ জানে না। নিশ্চিত মৃত্যুকে ফাঁকি দেবার প্রয়োজন পড়লে হয়ত দিকনিশানা থাকে না।

ভুরুঙ্গামারিতে আর্মি ঢোকার পর থেকে এই নিয়তি হয়েছে তাদের। মুসলমানদের মধ্যে কেউ গেল মুক্তিবাহিনিতে, কেউ নাম লেখাল শান্তিবাহিনিতে কিন্তু না পালিয়ে হিন্দুদের উপায় থাকে না। সাহসী কেউ হয়ত মুক্তিবাহিনিতে যেতে পারে। তেমন অনীল শুনেছে বটে। তবে আগের দিন পাশের পাড়ার মহেন্দ্রর সাথে কথা বলেছিল, মহেন্দ্র নাকি শান্তি কমিটির ছেলেদের সঙ্গে কেমন করে ভিড়ে গেছে। মহেন্দ্রকে দেখিয়ে ওরা তাদের নেতাকে বলে দিয়েছে, এ কিন্তু ভালো হিন্দু, মুক্তি না মোটেই, পাকিস্তান চায়, কোনো অনিষ্ট করবে না। অনীল দেখে কথা সত্য। পরের দিন ওদের পাড়ায় এক সারিতে হিন্দু বাড়িগুলোয় আগুন জ্বলেছে দাউ দাউ করে, অথচ তখন শোনা যায়, মহেন্দ্রদের বাড়ির পাশ দিয়ে আর্মির ট্রাক এলেও সেদিকে তারা ফিরে তাকায়নি। আজকের কাফেলায় তাই মহেন্দ্র নেই, পাড়ার আরো দুই-এক ঘর নেই। তারা মিথ্যে বলে, বাড়ি আগলে, জমি আগলে বেঁচে থাকবে কি থাকবে না, কে বলতে পারে! আবার মন্দিরের প-িত মশাই তো বলে দিয়েছেন, নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও থাকবেন। অনীলের অবশ্য সে বিলাসিতা চলে না, তস্য বুড়ো বাপ আর ছেটো দুটো সন্তান অছে, আছে পরানের শেফালিও, চুপচাপ বসে বসে তাদের মৃত্যু দেখা যায়!

শেফালির কোলের মধ্যে ছোটো বাচ্চাটা ফট করে ঘ্যান ঘ্যান করে ওঠে। অনিল বিরক্ত হয়ে ঘুরে তাকানোর আগেই শেফালি বুক থেকে শাড়ির আঁচল সরিয়ে দেয়। মুখটা ভরে উঠতেই বাচ্চাটা চুপ। তিন-চার মাসের ধারালো দাঁত দিয়ে শেফালির বুকটা কেটে ফেলবে মনে হয়। অবশ্য বাচ্চাটা ইচ্ছে করে ওমন করে না, শেফালি জানে। সেই আগের দিন বিকেলে শেষ খাবার খেয়েছিল আর পথে একবার এক পুকুরে নেমে আজলা ভরে পানি, কী করে দুধ পাবে এখন বাচ্চা? কামড়ের ব্যথা হজম করে শেফালি পা চালায়, যেন রাগও হয়, ভ্যাপসা গরমে এত ঘাম হয় শরীরে, দুধ হতে পারে না?

দুধ না পেয়ে বাচ্চাটা যখনই ডুকরে ওঠে, অনিলের ঘাড়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ে। কিছু পড়ে বৃষ্টির মতো, কিছু গলা চুইয়ে। অনিল ডালার তল দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়, পরিষ্কার আকাশে তারায় ভরা, বৃষ্টির কোনো লক্ষণ নেই। পরমুহূর্তে চমকে উঠে ‘ওরে বুড়া!’ বলে চিৎকার দেয়। মাথা থেকে ডালা নামিয়ে রাখে আলের উপরে। পিলপিলে সারির হাঁটাপথে একটা বাধার সৃষ্টি হয়। তবে কেউ কিছু জানতে চায় না, কারো পা থামে না। অনীলের পরিবারটাকে পাশ কাটিয়ে ভেজা ভেজা জমিতে দুটো পদক্ষেপ রেখে পিছনের লোকগুলো মাথায় আর হাতে বোঁচকা নিয়ে, বাচ্চা নিয়ে নীরবে পেরিয়ে যায়। শুধু অনীল সেদিকে ভ্রƒক্ষেপ করে না। নিজের মনে বাপকে বকতে থাকে, ‘এইটা কী করনেন? মোর গাওত মুতি দিনেন তোমরা?’

বঁাঁশের ডালায় কু-লী পাঁকানো শীর্ণ হাত-পা কাঁপতে থাকা রাধারমন পাল ফ্যাল ফ্যাল করে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে। কালশিটে পড়া মুখের বলিরেখাগুলো জোছনায় দেখতে রূপালি লাগে। আলোছায়ার দোলাচলের মধ্যেও অপরাধী মুখটার মিনতি স্পষ্ট হয়, মিনমিন করে বলে, ‘মুই তোক কোন বেলা নামে দেবার কথা কইছি ক’ তো?’

‘তাই বলি তোমরা অ্যাঙ্কা করমেন?’ বোঁচকা হাতড়ে একটা কাপড় টেনে ঘাড়, গলা মুছতে মুছতে কাঁদো কাঁদো গলায় অনীল বলে। শেফালি ততক্ষণে পা দিয়ে ঘাস খুঁজে গুছিয়ে বসেছে। বাচ্চাদুটো কোলে বেহুশের মতো শুয়ে থাকে। বহুক্ষণ আগেই শেফালির হাতে ঝিঁঝি ধরে গেছে, বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরতে পারে না। বসার দরকার ছিল, তাই শেফালি বলে, ‘বুড়া যা করছে ভালোই করছে। মুইও এইগলাক ধরি আর হাঁটবার পারিম না,’ শেফালি বাচ্চাদুটোর দিকে ইঙ্গিত করে।

‘এহ্, কইলেই হইল্। মইরবার চাইস তুই?’

‘হ, মরিম। ক্যান, অ্যাঙ্কা হাঁটি হাঁটিও মরে মানুষ।’

‘মরলে মরে। তাও শত্রুর গুলিত মরিম না মুই,’ বলতে গিয়ে চোয়ালের হাড় শক্ত হয়ে আসে অনীলের। এক টানে গলার কাছে ভেজা ফতুয়া খুলে ফেলে। গর্তওলা চোয়ালের পাশের পেশীগুলো ফুলে ফুলে ওঠানামা করে। একদিকে রাগ যেন ফেটে বেরোবে, আরেকদিকে বুড়ো আর পঙ্গু বাপের দিকে তাকিয়ে অসহায়ত্বও গ্রাস করে তাকে। রাধারমন পাল একটা হাত তুলে সামান্য উঁচু পাট গাছের খেত ইশারায় দেখায়, বলে, ‘ওই পাকে নিয়া যা না একনা মোক,’ বলার সময়ে তাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়া একের পর এক নির্বাক পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘ওই পাকে আর ক্যান যাইমেন, যা করার করিই তো দিছেন মোর মাথাত।’

লজ্জিত ভঙ্গিতে পোকায় আধাখাওয়া আর তামাক-জর্দার আস্তরে মোড়ানো দাঁতগুলো নাচিয়ে বুড়ো বলে, ‘আটকে রাখছঁ মুই কখন থেকি, নিয়া যাইস না ক্যান একনা?’

ঘাড় মোছা হলে আধাভেজা বাপকে কোলে তুলে নেয় অনীল। বছর চারেক ধরে দিনের পর দিন তোলে, গোসল করায়, সন্ধ্যায় তুলসীতলায় ঘোরায়, পার্বণে আরতীর সামনে বসায়। কিন্তু বাঁশের ডালার উপরে ভেজা চটের বস্তা থেকে তুলতে কেন যেন অনেক ভারি লাগে। মনে হয় হাড়গোড় ভেঙে আসবে কিংবা বাপসহ জমির আলে বাড়ি খেয়ে এমন পড়া পড়বে যে প্যাঁচ খেয়ে কোনটা কার হাত কোনটা কার পা ঠাওর করা যাবে না।

রাধারমন হাতটা বাড়িয়েই থাকে। আরেকটা হাত অবশ, সেদিককার পা-টাও।

বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে কারো চিৎকার শুনে শেফালি রান্না ঘর থেকে ছুটে এসেছিল। টুকটাক জিনিস হাতে তুলে বোঁচকায় রেখে গিঁট বাঁধার সময়ে বলেছিল, ‘উঁয়্যাক নেমেন ক্যাঙ্কা করি?’

অনীল চুপ।

‘উঁয়্যাক কি হামরা অ্যাটে ফ্যালে চলি যামো?’ শেফালির অস্থিরতা চরমে পোঁছে।

অনীল উত্তর দেয়নি। হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ঘরের এক কোণে। শেফালি একাই তিনটা বোঁচকা বেঁধেছে, বাচ্চাদুটোকে উঠোনের মাটি থেকে কোলে তুলেছে। তারপর খেঁকিয়ে উঠেছিল আবারো, ‘আও করেন না ক্যান? তোমার বাপোক কি হামরা ফ্যালে যামো? ভাত হইছে, রান্নাঘরত রাখি গেইলে তিন চাইর দিন বাঁচি থাকপে এলা, কিন্তু তার আগত আর্মি আসি গেইলে যদি ঘরোত আগুনটাগুন…’

শেফালির শেষ বাক্যে যেন অনীলের শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়, ভিতরে ঝনঝন শব্দে ঘোর ভাঙে। সে ছুটে যায় উঠোনে, এক কোণে রাখা মাছ জমা করার চারকোনাচে ডালাটা খাড়া করে রাখা, ওটা হাতে নিয়ে ছুটে ঘরে আসে। চটের বস্তা ভাঁজ করে বিছিয়ে নেয় তার ভিতরে। তারপর ছোঁ মেরে চলাচলের শক্তিবিহীন মানুষটাকে পাঁজাকোলা করে তুলে বসিয়ে দেয় তার মধ্যে। ঘরের এক কোণে নির্বাক বসে ছেলের উদ্দেশে বলা বউয়ের কথাগুলো শুনছিল মানুষটা। অন্যসময়ে ছেলে আর ছেলের বউয়ের কথার মাঝখানে ঢুকে পড়ে খোঁচাখুঁচি করা যার স্বভাব, সে মুখ বন্ধ করে নিজের মৃত্যু পরোয়ানা শোনার অপেক্ষায় ছিল। বাঁশের ডালায় বসে প্রথমে তার কুঁচকে গর্তে ঢোকা চোখে পানি আসে।

তারপর শুরু হয় চলা। ঠিক চলা নয়, দৌড়ানো। গ্রাম ছাড়ার অনেক পরে, যেখানে বাড়িপোড়া আগুনের শিখা আর ধোঁয়ার স্মৃতি আকাশ আর ধরে রাখতে পারেনি, মেঘের ভ্রমণে মিলিয়ে দিয়েছে, সেইখানে গিয়ে তাদের পায়ের গতিতে ধীরতা এসেছে; যেন এখন তারা শত্রুমুক্ত, যেন এখন কোথাও পৌছতে হবে, তবে একসময় পোঁছলেই হলো।

পাঁজাকোলা করে বাপকে তুলে অনীল অন্ধকারে জমির দিকে পা বাড়ায়। কোনোরকমে চলতে থাকে, এবড়োথেবড়ো মাটিতে একদিকে কাত হয় তো আরেক দিক থেকে সামলায়। কষ্টে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, ‘ক্যাঙ্কা করি যে মুই তোমাক নিয়া যাইম! কোটে যাইতেছঁ তাঁও জনো না।’

‘ফ্যালে দিয়া যা তুই আমাক। আনছিস ক্যান? ফ্যালে দিয়া…’

‘থামো তো তোমরা, কী করিম মুই?’

অনীলের কাঁদো কাঁদো গলা শুনে রাধারমন আর উত্তর দেয় না। হয়ত নীরবে তার চোখের দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কে চায় ছেলের মাথার উপরে এরকম বোঝা হয়ে চলতে? কিন্তু জীবনের তৃষ্ণা বড়ো কঠিন, যতক্ষণ জীবন আছে ততক্ষণই জীবনের তৃষ্ণা। এই অপ্রয়োজনীয়, ধুকে ধুকে বাঁচা জীবনটাও হেলায় হারানো যায় না।

রাধারমনকে কয়েক পা দূরে একটা গাছের আড়ালে ছেড়ে দিয়ে এসে অনীল বউয়ের পাশে হাত পা ছেড়ে বসে। মনে হয় আর ওঠার শক্তি হবে না। ধুলোর আস্তরে চোখের পাপড়িগুলো ঢেকে গেছে। হাত দিয়ে মুছে নিয়ে ফেলে আসা গ্রামের দিকে তাকায়। আকাশ ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে আছে, ছাইরঙা মেঘ নাকি ধোঁয়া কে জানে! ওদিককার সব গ্রামে আজ বহু বাড়ি পুড়েছে। এতক্ষণে হয়ত তাদের ঘরগুলোও মাটির সঙ্গে ছাই হয়ে মিশে গেছে।

ধীর পায়ে হেঁটে যেতে যেতে কে যেন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে যায়, ‘ক্যা বাহে, থামি গেইনেন যে?’ সে কথা অনীলের কানে ঢোকে না। শেফালিই বরং একসময় বলে, ‘উয়্যাঁক আনেন তোঁরা, হাঁটো যাই।’ অনিল ক্লান্ত শরীরে ডালা হাতে উঠে দাঁড়ায়, দুর্বল শরীরে শূন্য ডালাটাই ভারি লাগে। ঝোঁপের ওপাশে গিয়ে দেখে তার বাবা সচল হাত দিয়ে ঝোঁপ থেকে খুঁটে খুঁটে কী খাচ্ছে। অনীল অবাক হয়, ‘আন্ধারত কী খাওছেন তোমরা?’

‘অ্যাটে কী জানি পাঁইছো মুই। খিদ্যাতে মরি যাঁওছো।’

আবছা অন্ধকারে ঝোঁপের গাছ থেকে একটা ফল নিয়ে মুখে দেয় অনীল। মুখটা কষে ভরে যায়। ফলটা কাঁচা করমচা মনে হয় একবার, আরেকবার মনে হয় করমচা নয়। খিদে লেগেছে অনীলেরও কিন্তু তাই বলে বাপের মতো মুঠ ভরে কষওলা জংলী ফল খাবে তাও পারে না। বরং রাগ দেখিয়ে বলে, ‘তোমাক ধরি হইছে জ্বালা, এইগ্লা কী খাইতোছেন?’ রাধারমন অপরাধীর মতো চুপ করে থাকে। অনীল রাগের মাথায় তাকে তুলে নিয়ে প্রায় আছাড় দিয়ে ডালায় ফেলে। ‘এহ্’ করে একটা শব্দ শোনা যায়। রাধারমণের হাতের মুঠি থেকে কয়েকটা ফল ছিটকে পড়লেও, ডালায় বসে পড়তেই সে বাকিগুলো গোগ্রাসে গিলতে থাকে। অনীল সেটা অগ্রাহ্য করে ডালা মাথায় তোলে, মুখে বিড়বিড় করে, ‘খালি খাওয়ারে জন্য বাঁচি থাকে বুড়া!

রাধারমন হয়ত ছেলের কথা শুনতে পান না কিংবা পেলেও গায়ে মাখেন না। ডালার উপরে বসে মুখ থেকে বড়োইয়ের বিচির মতো কিছু একের পর এক ছুঁড়তে থাকেন।

আলের কাছে ফিরলে কে যেন চেনা কণ্ঠস্বর বলে, ‘অনীল না, এলাও এইখানত তোমরা? ওদিকে তো সব জ¦ালে দিছে, বসি আছেন ক্যান? হাঁটো।’

শেফালি মরিয়া হয়ে বলে, ‘আমাদের বাড়ি জ¦ালে দিসে?’

‘ওই গ্রামোত কোনো হিন্দুবাড়ি কি আর বাকি আছে? আর মন্দিরটাও. . .’

অনীলের মনে পড়ে গ্রামের কলেজের অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহের কথা। পণ্ডিত মশাই বলতে অজ্ঞান অনীল। ওরকম একটা ভালো মানুষ সে তার জীবনে দ্বিতীয়টি দেখেনি। অনীল চাল কিনতে পারেনি বলে পণ্ডিত মশাইয়ের কু-েশ^রী মন্দিরের বারান্দায় মন খারাপ করে বসে ছিল একদিন। তিনি অনীলের চোখ-মুখ দেখেই ভিতরে গিয়ে পূজার প্রসাদ এনে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘এট্টুক হইলে চলবে না সব্বার?’ অনীল বাজারে যাওয়া-আসার পথে কখনো ক্লান্তিতে, কখনো ¯্রফে তাকে দেখার জন্যই মন্দিরের বারান্দায় কিছুক্ষণ পা ছড়িয়ে বসে থাকত। মনে মনে মানুষটার মায়াময় মুখের ছায়া চোখের সামনে ঝুলতে দেখে অনীল প্রায় ডুকরে ওঠে, ‘কী হইছে মন্দিরটার? জ¦ালে দিছে?’

‘খালি জ¦ালে দিসে? আলছিল ওমাক খুন করবার।’

‘তারপর?’

‘খুন হইবে খবর পায়া পণ্ডিত গোসল করি নতুন জামা-কাপড় পলছে। সাজিগুজি পাকিস্তানী আর্মির হাতে মরার প্রস্ততি নিছে। তারপর গিয়া ঢুকছে মন্দিরত। মূর্তির পায়ের আগত যখন বসি আছিল, তখন আর্মি গিয়া পিছন থেকি গুলি করি মন্দিরত দিছে আগুন লাগেয়া।’

‘ওমরা পালাবার পারেন নাই? কেউ কি ওমাক পালেবার বুদ্ধি দেয় নাইও?’

‘দিসে না? ওমরা কইছে, মাক থুইয়া পালে যাবো না। মাক তো নিজের হাত দিয়া প্রতিষ্ঠা করছেন। আর নিজের দ্যাশও নাকি মার মতো। তাই ওমরা অটেকোনা বসিয়াই আছিলেন। শ্যাষে ঘাড়ে গুলি খায়া পলছেন মাটিত। তারপর আগুনে সব গেইছে ছাই হয়া।’

এটুকু পর্যন্ত বলে লোকটা রাস্তা মাপে। পাশের গ্রামে তাকে কয়েকবার দেখেছে হয়ত অনীল। হতে পারে আক্কাস নাম। মুসলমানের মুখে মায়ের কথা শুনে আপ্লুত হয় অনীল। মায়ের পায়ের কাছে নূতন সিংহের তালগোল পাকানো লাশটা পড়ে আছে আর চারদিকে দাউ দাউ আগুন ঘিরে আসছে এমন একটা কল্পনা তার বুকে হাহাকার তুলে দেয়। কিন্তু প-িত মরতে মরতে এটা কী বললেন, দ্যাশ মার মতো? তাহলে বাপকে মাথার উপরে তুলে নিয়ে অনীল মাকে ফেলে চলে যাচ্ছে! কী করা যায় কী করা যায়… অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ে অনীল। শেফালি পাশ থেকে হঠাৎ খেঁকিয়ে ওঠে, ‘যাইমেন না? সউগ মানুষ গেইল।’

অনীল চমকে ওঠে। মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে যায়, ‘মাওক ছাড়ি কেউ পালায়?’ শেফালিও চমকায়। অনীলের মা মারা গেছে তার শৈশবে, এটুকু তো শেফালি জানেই। তাই বিভ্রান্ত হয়, দুঃচিন্তায় আর পরিশ্রমে মানুষটার মাথাটা গেল নাকি! ততক্ষণে সত্যি সত্যি পিছনের ভিড় পাতলা হয়ে এসেছে। দলটার বেশিরভাগ লোক তাদের ছাড়িয়ে গেছে। বাচ্চাদুটো শেফালির কোলে মড়ার মতো ঘুমাচ্ছে। ছোটোটাকে নিয়ে ডালার মধ্যে বাপের কোলে ছাড়ে অনীল। তারপর ‘ইয়ালি’ বলে ডালাটা মাথায় চালান করে।

আবার হাঁটা শুরু। কিন্তু একটু পরে অনীলের বাবা, রাধারমন আগের চেয়েও বেশি চেঁচামেচি শুরু করে, ‘এ মোক নামে দে নামে দে একনা, প্যাট মোচড়াইতোছে।’

রাধারমন আর দূরে যাওয়ার কথা বলে না। ডালা মাটিতে নামালে নিজেই গড়াতে চায় মাটির দিকে। তারপর চারদিকে ব্যাপক দুর্গন্ধ ছড়ায়। কেউ ভ্রƒক্ষেপ করে না। যে যার মতো হাঁটে, বাচ্চার কান্না থামায় বোঁচকা গড়িয়ে পড়লে আরেকবার শক্তি সঞ্চয় করে তুলে ধরে। বিষণ্ণ আর বিপদগ্রস্থ মানুষের নাকে না গন্ধ লাগে, পায়ে না টনটন করে।

অনীল পিছনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেদিকে ধোঁয়া নেই, আগুনও নেই আর। শুধু ভুরুঙ্গামারির দিকে থেকে স্টেনগানের ধারাবাহিক আওয়াজ আসে। সামান্য বিরতিতে আসে জোরে বোমা পড়ার আওয়াজও। সেদিকে তাকিয়ে অনীলের বুকটা হু হু করে, কবে শেষ কবে এই যুদ্ধ? আবার কবে এই পথ ধরে নিজের উঠোনে, উঠোনের এক কোণের বাঁধানো তুলসীতলাটায় ফিরবে সে? নাকি কোনোদিন ফিরবে না? তুলসী গাছটা কি মরবে ধোঁয়ায় বা পুড়বে আগুনে? প্রতিদিন শেফালির হাতে পানি খাওয়া তরতাজা শরীর তার।

জোর করে পাঁচ বার অনীলকে থামিয়ে নামার পরে অনীলের বাপ, রাধারমন আর নড়ে চড়ে না। কথাও বলে না। বড়ো শিশুটি উপুড় হয়ে তার বুকে কান পাতে। বোঝার শক্তি হয়নি তার। তবু উত্তেজিত হয়ে জানতে চায়, ‘মাও, দাদু কি মলছে?’ সামনে তখন নদী, হাঁটু পানি। নদীর অন্যদিকের পাড় রহস্যে ঘেরা আর প্রায় অদৃশ্য। অস্পষ্ট আলোর কল্পিত ঝিলিক জীবনের নতুন সম্ভাবনা বলে মনে হয়। ওই তো ওদিকে ভারতের সীমানা! ওই তো দেখা যায়। এটুকু হাঁটতে আর কতক্ষণ?

বাবা স্থির হওয়াতে অনীলের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। খানিক পরে নাড়ি ধরে একবার। তারপর বালুর মধ্যে দৌড়ে গিয়ে নদী থেকে আজলা ভরে পানি এনে তার মুখে ঢালে, ছিটায়। লোকটা নড়ে না। পানিও গড়িয়ে পড়ে ঠোঁটের কোণ বেয়ে। ওই শীর্ণ আধামরা শরীরে এত ধকল সয় নাকি! শেষের দিকে বমিও করেছিল বারকয়েক। শেফালি চিৎকার করে কাঁদে আর লালাভরা মুখে দুর্বোধ্য উচ্চারণে বলে, ‘খিদ্যাতে বুড়া জঙ্গল থেকি কী খাইল যে! চুলার উপর ভাত হইছিল, হউকদউক করি দৌড়িবার গিয়া দেওয়া হইল না।’

অনীল ডালাটার দিকে তাকিয়ে থাকে। সামনে বাপের লাশ পড়ে থাকে গোল্লা পাকিয়ে। পেটের মোচড়ে শরীরটা কু-লী পাকিয়েছে। অনীল ডালায় কিছু বালু ভরে বাপের চোখ-মুখ, সারা শরীরের উপরে ছিটায়। পিছন থেকে কেউ কেউ আঁৎকে ওঠে, ‘মলছে মানুষটা!’ অনীল ডালাটা ঝাড়ে। বড়ো সন্তানকে উঠিয়ে মাথায় নেয়। সে হাত-পা ছুঁড়ে চিৎকার করতে থাকে, ‘দাদুক নিমেন না? দাদুক ফেলি যাইমেন তোমরা? দাদুক নিমেন না?’ অনীলের মাথার ডালাটা আগের চেয়ে অনেক হালকা। তবে চিন্তার ভার বেশি… মাকে তো ছাড়ছেই, বাপকেও ছাড়বে? হায়রে যুদ্ধ, হায়রে বাঁচার নেশা! ভিতর থেকে কান্না ফেটে আসে, কেন এতকিছুর পরেও বাঁচতেই হবে?

পিছন থেকে কে যেন ঘাড়ে একবার হাত রেখে যায়, ‘হাঁটো হাঁটো, বাহে!’

গ্রামের অনেক হিন্দু কলেমা শিখেছে। দরুদ শরীফও ঝরঝর করে বলছে। আর্মি ধরলে আগেভাগেই বলা শুরু করে। অনীলের কেন যেন ইচ্ছা করেনি কিংবা মনে হয়েছে সে এসব পারবে না। নাকি বাঁচার ইচ্ছা তখন ততটা চেগে ওঠেনি, নাকি কোথাও বেধেছে? পাশের গ্রামের পরিমল নিজের নতুন নাম রেখেছে রফিক। আর্মি জানতে চাইলে মাথার উপরের সাদা গোল টুপি নাচিয়ে নিজের পরিচয় দিচ্ছে। সাথে লম্বাচওড়া সুরে আলহামদুলিল্লাহ্, মাশাল্লাহ্ বলে যাচ্ছে। ওই গ্রামের তিন চারটা পরিবার কলেমা পড়ে নাকি মুসলিম হয়ে গেছে। এটা অবশ্য অনীলের শোনা কথা। খেত থেকে খুঁচিয়ে আলু তুলতে গিয়ে সেদিন সে কথাটা শুনে চোখ কপালে তুলেছিল, ‘কও কী, খালি বাঁচবার জন্যই ধর্ম বদলাইছে ওমরা?’ যে বলছিল সে অনীলকে অবাক হতে দেখে বলল, ‘এইটায় সমস্যা কী রে, যুদ্ধ শ্যাষ হইলে হইবে আবার হিন্দু। মন্দিরে প্রসাদ চড়াইবে, নাকোত খত দিবে এলা।’ অনীল অবাক হয়েছিল, এত সোজা! অনীলের খেতের পাশের খেতে কাজ করে পবিত্র, একদিন জাংলা থেকে ঝুলন্ত শঁশা ছিড়ে ডালায় রাখতে রাখতে বলল, ‘শুনছেন নাকি, ওমরা নাকি লুঙ্গি খুলি দ্যাখে। হাঁটো, হাসপাতালোত যাই।’ অনীল সে কথার কোনো উত্তর দেয়নি। ব্যথার কল্পনায় তার শরীর কেঁপে উঠেছিল। পবিত্রকে আর জিজ্ঞাসা করার সুযোগ ঘটেনি, তিরিশ বছর বয়সে সে হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারদের কাছে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছিল কি না। ভাবতে গিয়ে এখনো অনীলের তলপেটের নীচে টনটন করে ওঠে।

সপ্তাহ খানেক আগে সরকার নাকি ১০০ আর ৫০০ রূপির সমস্ত নোট বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছে। ওসব নোট পাচার করেই নাকি মুক্তিযুদ্ধের ব্যয় চলছে। এই ব্যয় থামালেই মুক্তিযোদ্ধারা থেমে যাবে বুঝি? অনীল যখন বাড়ির মধ্যে লুকিয়ে জমানো বেশ কিছু ছোটো নোটের ভিড়ে একশ রূপির তিনটা নোটের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল কী করা যায়, গিয়ে সরকারি অফিস থেকে নোট জমা দিয়ে স্লিপ নেবে নাকি। কিন্তু হাটের চালের আড়তের ভুবনচন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করাতে সে বলেছিল, অনীল যেন ওসব করতে না যায়। স্লিপ নিতে গেলেই ও যে হিন্দু তা ধরা পড়ে যাবে। অনীল অবাক হয়েছিল, এ তবে হিন্দু খোঁজার কায়দা? কে জানে! ভুবনচন্দ্র বুঝিয়ে বলেছিল, ‘তুঁই এলাও বুঝবার পারলু না, হিন্দুক ওমরা কয় ভারতীয়। পাক আর্মি হিন্দুক খুঁজি খুঁজি মারবে। যুদ্ধ যে পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যেও লাগি গেইছে, সেইটা খবর রাখিস?’

গতকাল সকালের পরপর যখন গুলির শব্দে বাজার থেকে লুকিয়ে বা নানান কায়দায় অনীল ছুটে পালাচ্ছিল তখন আড়তের বস্তাগুলোর মাঝখান দিয়ে ভুবনচন্দ্রের লাশ দেখা যাচ্ছিল। সাদা গদির উপরে কাঠের ক্যাশ বাকশোটার উপরে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। আড়তের শ্রমিকদের লাশ সামনের বারান্দায় একের উপর আরেকটা পড়ে আছে। চারদিকে চাপ চাপ রক্ত। পাশের দোকানির লাশ পড়ে আছে দাড়িপাল্লার পাশে। কসাইয়ের লাশ পড়ে আছে মাংস কাটার বৃত্তাকার কাঠে। যে যেখানে ছিল সেখানেই স্থির হয়ে আছে। শূন্য বাজারের কোণাকাঞ্চি অনুসরণ করে কখনো দৌঁড়ে কখনো থেমে অনীল বাড়ির পথে শেষবারের মতো এগোচ্ছিল। মনে হয়েছিল যেন একটা কোনো ঝড় এসে চলে গেছে, রেখে গেছে ধ্বংসস্তূপ।

এলোপাথাড়ি দৌড়ে গ্রামের অমলদের বাড়ির পাশ দিয়ে আসার সময়ে আর্তনাদ শুনে দাঁড়িয়েছিল অনীল। অমলের বোনের উলঙ্গ লাশ বুকে জড়িয়ে উঠোনের মাঝখানে বসে আকাশ কাঁপিয়ে ওর বাবা কাঁদছিল। অনীল সামনে যেতেই কৈফিয়ত দেয়ার মতো করে বলে, ‘মুই খালি গুলির শব্দ শুনি ওই পাকে দৌড়ি গেছিনু, আসি দেখি অ্যাঙ্কা করি রাখছে মোর কইলজার টুকরাক।’ অনীল উলটো পায়ে উদভ্রান্তের মতো বাড়ির দিকে দৌঁড়ে গেছে তারপর। চোখে ভেসেছে শেফালির ওরকম একটা পরিণতির দৃশ্য। কিছুতেই না! আজই পালাতে হবে। পাঁচিল ছাড়িয়ে ফিরে যাবার সময়ে কানে এসেছিল অস্পষ্ট, অমলের বাবা হাউমাউ করে কেঁদে বলছিল, ‘মোক কত মাইনষে কইছে ভাগি যাও তোঁরা, অ্যাটেকোনা থেকি ভাগি যাও। মুই শোনো নাই রে কপাল! ও ময়না, মুই শোনো নাই…’

এই সমস্তকিছুর পরে সিদ্ধান্ত নিতে আর অসুবিধা হয়নি অনীলের। মুসলমানের মেয়েরাও আক্রান্ত হবে, তবে হিন্দুর মেয়েরা কিছুতেই ছাড়া পাবে না। ‘শেফালি… শেফালি…’ ডাকতে ডাকতে এসে অনীল যখন উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছিল, শেফালি তখন রান্নাঘর থেকে আঁচল দিয়ে গলা মুছতে মুছতে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। শেফালিকে অক্ষত দেখেও বিশ্বাস করতে কয়েক মুহূর্ত লেগেছিল অনীলের। তবে তারপর আর দেরি করেনি।

নদীতে হাঁটু পানি। মাঝনদীতে কোমর পর্যন্ত ডোবে। ঢল আসা শুরু হয়েছে মনে হয়। আর কিছুদিন দেরি করলে পার হওয়া কঠিন হতো। আর কিছুদিন দেরি করলে হয়তবা আর পার হতেও হতো না। লাশ তো আর দেশ ছাড়ে না, ছাড়ে জীবিত মানুষেরা। জীবিত মানুষ বাঁচার জন্য মা-বাপকে ছাড়ে, সব ছাড়ে।

অনীলের বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মুখ তুলে উপরে তাকায়… ওই যে সীমানা! মানুষের পায়ের মন্থনে নদীর সামান্য উচ্চতার পানিতে ঢেউ খেলে। ঢেউয়ের উপরে খেলে ভোরের আলো। ওই পাড়ের সরু বালুতে সূর্যের প্রথম রশ্মি চিক চিক করে। আসামের সূর্য।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *