নাসরীন জাহান
নর্দমায় পুঁটিমাছ লাফাচ্ছিল। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, আসন্ন শীতের হেমন্ত বৃষ্টিতে ভেসে আসায় তার দম আটকে আসছে।
এমন ভূতবৃষ্টিতে হেমন্ত শিশির ভেজালে গেরুয়া ধানের করোটি শুকিয়ে যায়।
লকডাউন চলছে।
পাপ্পুর চোখ কুয়াশায় ভিজে যেতে থাকা সূর্যের দিক থেকে নোংরা জলে কিছুক্ষণ আটকে থেকে মুহূর্তে হাতটাকে তালগাছ বানিয়ে নোংরা জল থেকে মাছটাকে উঠাতে গিয়ে উল্টি উল্টি অবস্থা হয় তার।
ন্যাপথলিনের গন্ধের মতোই বিষণ্ণ তার পাঁজরের ব্যথা। চাপ খেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
চারপাশটা কেমন যেন কাঁদছে। কপালের কষ্টভাঁজে বিষাদঘোর অবয়বে সে বুক চেপে নর্দমায় চোখ ধাবিত করে।
পুঁটিমাছটার লাশ ভেসে যাচ্ছে। কী এক গহনঘোর মুহূর্তে বিমূর্ত মন তার পাশের গ্রিল ধরা নিজের ঘরটার দিকে যায়। মনে পড়ে ওখানে তার পরাণ পড়ে আছে। ব্যালকনিঘেঁষা বারান্দাটাই এখন তার পৃথিবী।
পাপ্পু আজীবন ছুটন্ত এক রেসের মালিকহীন ঘোড়া। সৃষ্টিশীলতা তার দেহ, মজ্জা অস্তিত্বের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। প্রেম, সংসারের চূড়ান্ত বিমোহী তার জীবনে কারও প্রগাঢ় প্রেম আছাড় খেতে থাকলে তার ভয় হয়। করোটি সাবধান করে, পাপ্পু নখও বাড়াবি না, এরপর কমিটমেন্ট, এরপর সংসার, বাচ্চা… বন্ধন।
শূন্যলোকে ছিটকে পড়ে সে। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় পাথর হতে থাকে।
এই ঋতুবদলের দিনের আবছায়া ঘ্রাণে মাথা থিরথির করে। করোটিতে পাক খেতে থাকে সফেদ আসমান শরীরে পাক খেতে থাকা এক নিঃসঙ্গ শালিক।
একটা পুলিশকে টহল দিতে দেখে তার স্যান্ডেল ঘরমুখী দ্রুত ধাবিত হয়।
চটাং চটাং শব্দে হেঁটে নিজঘরে এলোমেলোতার পর ইজেল ঘেঁষে পা টপকে শরীর গলিয়ে সে বারান্দায় গিয়ে হাঁপ ছাড়ে।
যখন করোনা এ দেশে তার ঠ্যাঙ রাখল, সেইদিন থেকে পাপ্পুকে যেন কেউ টেনেহিঁচড়ে জেলখানায় ঢুকিয়ে দিল।
নানা অঞ্চল শাখাপ্রশাখায় উটের মতো ছোটার সময় মাঝেমধ্যে ঘরটার শিল্পাঙ্গনের এলোমেলোতার গন্ধ তাকে টানত খুব। কিন্তু করোনার সময় তার কয়েদির মুহূর্ত অজগর হয়ে গেল। জান আটকে পড়ত মুহূর্তে মুহূর্তে।
মায়া তার কবজায় কবজায়, কিন্তু সন্তানের মায়া? ভাবলেই কেমন শিউরে ওঠে সে। কিন্তু এই মুহূর্তে সব মায়াজাল তার অস্তিত্বের অঞ্চল থেকে কর্পূরের মতো ছায়া হয়ে গেল।
প্রচণ্ড রাগের অগ্নিদহনে কোনোদিন পিঁপড়ে না মারা মানুষটা জুতোর নীচে আস্ত এক তেলাপোকা পিষে দিল।
কানের মধ্যে ফিসফিসানি— ‘তোমার চুলের গায়ে কেবলই আঁধারের মতো চুল…’ তার ঝুঁটিচুলে নখ বিছিয়ে কোন কালে কে যেন বলেছিল এই কথা?
বমি উগরানো সামলে অনেক সুদূরের ছায়ামগ্নতায় ধেয়ে আসে, রাত্রি।
প্রথমে চোখ, এরপর তার পরিহিত ফতুয়ার রং ধরে ক্রমান্বয়ে খোঁজা। কিছুতেই অবয়ব মূর্ত হয় না। অভিব্যক্তি, কথা বলার ভঙ্গি ধরে যেই মুখটিকে সামনে দাঁড় করাতে চায়, হাজার রং এসে সবকিছু ছায়া করে দেয়।
সহসা বারান্দায় মৃদু কিন্তু অস্থিরময় চিৎকারে তাকে অনর্গল কাছে পাওয়ার তাগিদ আসে।
পাপ্পু রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে, এখন এটাই তার পৃথিবী।
ধীরে ধীরে পা আঙুল সম্মুখে, এবড়োখেবড়ো খড়বাসায় চড়াইটি তার দিকে খিদের ঠোঁট বাড়ায়।
পাশের পাখির বাসায় দোয়েল ছানারাও খিদেয় হাউমাউ করছে।
যখন লকডাউন চলছে, নতুন নতুন আসা দিগন্ত বিনাশ করা রোগের ভয়ে আতঙ্কিত মানুষেরা নিজ ঘরে নিজেরাই অবরুদ্ধ থাকাটাকে বাঁচার আশ্রয় মনে করত। কিন্তু পাপ্পুর মৃত্যুকে থোড়াই না ভয়, যত তার বাজপাখি ডানা চাপে পড়ে নিজের মাংসে গুটাতে হচ্ছিল তত সহসা রাগ ক্রোধহীন মানুষটার ভেতর উস্কে হিস হিস করছিল।
অন্য অনেক সময়, ডকুমেটারি, শর্টফিল্ম বানানোর কাজ, পেইন্টিংয়েও ডুবে থাকত ঘণ্টা, প্রহর। তখন দিনরাত্রি হুঁশ থাকত না।
কিন্ত এখন? ভেসে ভেসে আসে মৃদুতরঙ্গ, মন এলোমেলো পবন আসমানের ঝুরঝুর রাত্রি নক্ষত্রের মতো ঝরে পড়া ঝিমাতে ঝিমাতে হাঁটা খোঁড়া সময়।
তাকে কেউ কেন বলবে ঘরে থাকো?
পেইন্টিংয়ের ব্রাশ খসে যায়, সিনেমার চিনেমাটি মেঝেতে এলিয়ে থাকে। গান অসহ্য, মুভি অসহ্য, অনেক বৃক্ষকেন্দ্রিক এই বাড়ির পাখির সুর, ডাক অসহ্য! অসহ্য!
বড়বোন আসমা প্রতিদিন আসে। তার মুখটা মায়ের আদলের। সে পাপ্পুর কাছে এলেই পাপ্পুর মাথায় জোছনার মতো খসে খসে পড়তে থাকে।
রুমটার আধোধোঁয়া ছায়াচ্ছন্নতায় তাঁর ওষ্ঠ প্রস্ফুটিত হয়, ‘ইস ঘরটা কী নোংরা, আজীবন যদি একাই থাকার ব্রত নিয়েছ ভাই, নিজের ঘরটা নিজে গুছিয়ে রাখতে পারিস না?’
পিঠোপিঠি এই বোন পাশাপাশি বন্ধুময়, ছিলছিলানো ছায়াকুয়াশামগ্নতা ফুঁড়ে পাপ্পুর কণ্ঠ প্রস্ফুটিত, ‘আমাকে এলোমেলো বলতে পারো, কিন্তু আমি নোংরা নই।’
‘তুই খুব অস্থির পাপ্পু, তোর স্থিরতা আর ধ্যান বাড়াতে আমি একটা গোলাপের চারা এনেছি, আমি তন্নেতন্নে অপেক্ষা করব, তুই এটাকে বড় করে ন্যূনতম একটা কুঁড়ি ফোটাতে পারিস কি না।’
পাপ্পুকে মেঘে মেঘে বলে যায়। কী বলে? উষ্মা নিয়ে তার কণ্ঠ উচ্চকিত হয়, ‘আমি এসব পারি না, প্লিজ তুমি নিয়ে যাও, প্লিজ বারান্দায় রেখে চলে যেয়ো না, আমি এসব পারি না। খামোখাই চারাটা মরবে।’
বোন নিজ গুনগুনানিতে চলে গেলে পাপ্পু ডকুমেন্টারিতে যুক্ত করার জন্য একটা কাজে ফের লিপ্ত হয়।
সফেন শয্যায় উবু হয়ে বাল্বের মিঠে রশ্মিতে ঝকঝকে জলের মধ্যে যেভাবে কয়েদিরা থালায় পানি রেখে মুখ দেখে, পাপ্পুও উবু হয়ে সেই জলের দিকে চেয়ে থাকে।
সাদা তো সরল রং, নিশ্চয়ই একদিন আমি ঠিক যে মুখ দেখতে চাইব, পাব।
পাপ্পু আম্মার মুখ হাতড়ে হাতড়ে খোঁজে।
লকডাউনের আগে আগে গোলাপ চারাখানি নিয়ে এসেছিলেন আসমা আপা। মনফতুর ঘরে দাঁড়িয়ে শুয়ে হাঁপ ধরে গেলে বাতাস বারান্দার ওপাশের পাতাঝাঁকড়াচুলেরা হাতছানি দেয়।
দেহে যেন শিশির স্পর্শ লাগে। বারান্দায় গিয়ে রেলিংয়ে পেটভরে বাতাস খেয়ে নিচে চোখ যায়, হায়! শুকনো টবে চারাখানি নেতিয়ে গেছে। আফটার অল আসমা আপা দিয়ে গেছে। বোনের ওপর প্রগাঢ় মায়া মিহি গাছটির ওপর পড়ে, ‘ওল্লে ওল্লে’ করে টবটিকে ঘরে এনে মাটি খুঁড়ে মৃদু মৃদু করে পানি ঢালে, ভেজা হাতে পাতা ভিজিয়ে আদর করে বলে, ‘ওল্লে ওল্লে অতিথি, আপনাকে আমার আপার জন্য বাঁচতেই হবে।’
এর ক’দিন পরই… চড়াই এসেছিল, ভয়ার্ত ছানাটিকে পাপ্পু গোলাপের মতো মমতা মায়ায় চাঙা করে তুলেছিল।
দোয়েলপাখিও কী ভরসায় কী বুঝে এই বারান্দায়ই ছেঁড়া পত্রিকা খড় দিয়ে বাচ্চা পেড়ে গেছে। মাঝে মাঝেই এসে ওদের আদর করতে আসে, খাওয়াতে আসে।
এর মধ্যে আচমকা তার নিঃশব্দ রুমে গাছবাতাসে ভেসে আসা মৃদু কিছু এসে আছড়ে পড়ে আবছায়া শব্দে কাঁদতে থাকে।
তীব্র অনীহায় পাপ্পু কেন যে বারান্দায় যায়! এই চড়াইয়ের এত্তখানি ছোট বাচ্চাটা তার দিকে বিন্দু চোখ তুলে থরথরে কাঁপতে থাকে।
তার চিরকালীন স্বভাবজাত মায়াহাত ওর দিকে যদি না যেত, পাপ্পু কি পরাধীনকে ভালোবাসতে শুরু করতে পারত!
ঘরে ফিরতেই দোয়েল আসার শব্দ হয়। তাকে দেখে দূরে তক্কেতক্কে ছিল।
ওর বন্ধুরা ফোনে বারংবার তাজ্জব হয়। তুই কবে ফালতু মায়ার মধ্যে পড়লি? শালার লকডাউনেই করোনা আটকাতে পারছে? এরমধ্যেই কতজনকে কবজা করেছে, মারা যাচ্ছেও তো কম না।
এসব ব্যাপারে নিস্পৃহ তাকে রাত ঝিমঝিম কুয়াশায় কান পাতে রাত্রি, পাপ্পুকে আমূল জড়িয়ে চুমু খেতে খেতে যখন অগ্নি প্রজ্জ্বলিতপ্রায়, নিজেকে দমন করতে পাপ্পু উত্তম পুরুষে শৈশবে চলে যায়, জন্মের পর থেকে এই অবধি আমি শুধু এই পথ দেখেছি। তখন আমি জানতাম, কোনদিন কোনপথে ঘাসফুল চেয়েছে। সেই একটিই পথ, যে পথ দিয়ে আমি ইশকুলে গেছি। যখনই এক চিলতে ঘাড় তুলেছি, মানুষের কোরাস মুখ। আমার মনে হয়েছে, পৃথিবীর সব মানুষ যমজ। যেভাবে মাছি আলাদা করা যায় না একটা মাছি থেকে আর এক, আর একটা থেকে আর একটা, অনেকটা সেইরকম।
আম্মা আমাকে আমূল জড়িয়ে বলতেন, ‘তুমি শুধু গিজগিজে মাথা দেখেছ, মানুষ দেখোনি।’
আহ! শীৎকারে নিজের মাংসের দিকে অঝোরে পাপ্পুকে টানতে টানতে যখন দেহটা আবোলতাবোল বিচ্ছিরি নগ্নতায় পড়ে থেকে শিরশিরে ধ্বনি পাঠায়, নিজেকে নেভাচ্ছ কেন? দু দিন পর তো আমরা স্বামী-স্ত্রীই হব।
দপ করে প্রদীপ নিভে যায় পুরোপুরি।
আসলে নিরন্তর প্রস্ফুটিত দেহবিন্যাসে সে কাঠিকাঠি অবয়বে বিস্তারিত। শৈশব, কৈশোরে আম্মার দীঘল আয়নার সামনে দেহ পেতে তার কান্না পেত খুব।
কিন্তু যত তার দীর্ঘতা বাড়ে, তত সে মানুষের হাজার হাজার মুখ, হাজার হাজার পাহাড়, হাজার হাজার, তার ক্যামেরা নিরন্তর ছুটতে থাকে মানুষের দেহ থেকে অবারিত প্রান্তে প্রান্তে, আনাচ-কানাচে। কিন্তু ক্রমশ শরীর অবরুদ্ধতায় ভারি হয়ে উঠছে। পাঁজরের ব্যথা আচানক আচানক ঘাই দিয়ে ওঠে। হাসপাতাল এখন করোনার ঘরবাড়ি, মরে না গেলে পাপ্পু যাবে না।
ছায়ারৌদ্রবারান্দার চড়াই পাপ্পুর জন্য কাঁদতে থাকে। মন উচাটন হয়ে ওঠে। পাপ্পু উড়ন্ত যাতনপাতা বুকে চেপে বারান্দায় গিয়ে অরণ্য ধাওয়া বুনোঘ্রাণে আচ্ছন্ন হয় পয়লা, পরে কিশোর হয়ে আসা চড়াইটাকে যত্নে নরম ন্যাকড়ায় স্নান করিয়ে, একটু একটু খাবার তুলে দেয়।
পাপ্পুকে পাগলের মতো পাহাড় টানতে থাকে। কতদিন যেতে পারছে না। আর কদিন পাহাড়ের বুনোঘ্রাণ না পেলে সে মারাই যাবে।
গোলাপচারাটা অনেকদিন কী কারণে যে জেদ ধরে ছিল! যত যতন সার, শুকনো গোবর দিয়ে ডালপালা ভিজিয়ে যেন বা ঝরনা ধ্বনির স্নান করায়, গোলাপচারাটা কিছুতেই বড় হতে চায় না।
মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে পড়ে।
শৈশবে আপা বলেছিল, আম্মা পাপ্পু কী ভীতু, কাঁটার ভয়ে মাছ খায় না। এই ভয়েই দূর থেকে ভয়ে ভয়ে গোলাপের দিকে তাকায়। বড় হলে কোনো মেয়ে ওকে বিয়ে করবে না হা হা!
বড় হলেও কাঁটাভয় যায়নি তার। এখন সে কাঁটা-অকাঁটা কোনো মাছই খায় না।
এরমধ্যে যখন দিন গড়ায়িত ক্রমশ, বাতাসের ভোল পাল্টানো, রোদকে ভেজাচ্ছে কুয়াশারা, ঘুমের স্বপ্নে পাপ্পু আম্মাকে দেখে, সাদাপরি মা, খাইয়ে দিতে থাকে পাপ্পুকে, একসময় মুখদানা পড়ে গেল, হিমাচলে পাখি পাখি, ছায়াছায়া হয়ে মিশে গেল পরী।
আম্মা! জাগরিত চোখ যেন বা বিস্ফারিত শব্দে ঘুম জাগায়।
বিশাল ভাইবোনের পরিবারে সবাই যখন ব্যস্ত, সে ভুলে গেছিল, কেউ খেতে না দিলে খেতে হয়।
ইন্দ্রিয়তে কী তরঙ্গ বয়ে যায়, না বুঝে বারান্দায় যায়, ছোট চারাটির গুচ্ছডালপালার উচ্চতাহীনতার কারণে এতদিন চোখ স্পর্শ করেনি কেন?
আচমকা বুকে উল্লম্ফন শিউরে ওঠে। গোলাপের পাতাভাঁজে একটা কলি ফুটেছে!
হঠাৎ যেন বা নরম শরীরকাঁটা গাছটি পোয়াতি হয়ে কাঁটাগুলো টানটান শক্ত ছায়াচ্ছন্নতার আঁকশি নখর বিস্তারিত করে।
বিয়ের পরের পরে, প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর রাত্রির মধ্যে অনেক মায়া জেগে ওঠে। সে পাপ্পুর সন্ন্যাসবোধকে অগ্রাহ্য না করে তার কাজ, খাওয়া সমস্ত কিছুতে মা মা নজর দিতে থাকে।
পাপ্পু অনেকদিন পর ফেসবুকে স্টেটাস দেয়, প্রেম সন্তান, আমাকে কোনও দিন টানে না। আমি উড়াল চিরবন্ধহীন উড়াল উড়াল… মানুষকে স্বজনদের মধ্যে অনেককে আমি মায়াবাসি খুব। আমার পায়ে কোনো খড়কুটোও দড়ি হয়ে না প্যাঁচায়।
হেমন্ত উলটানো পৌষের দিকে তরঙ্গে তরঙ্গে পাপ্পুকে বিমোহনে বিমুগ্ধতায় জড়িয়ে ফেলে। পাপ্পু গোলাপকে আদর যত করে ততই একটা ছোট্ট গাছে গুচ্ছ গুচ্ছ কলি ফুটে ফুটে সমস্ত পাতা গোলাকৃতির গোলাপ কলিতে আচ্ছন্ন হয়ে যেতে থাকে।
চড়াইটাও জোয়ান হয়েছে অনেক। দোয়েল তার ডাগর হয়ে ওঠা ছানাপোনা নিয়ে এক সন্ধ্যায় কোথায় যেন চলে যায়।
পাপ্পু জানে, এরা পাশ্চাত্যের মতো ছানাপোনা বড় হলে অধিকার ছেড়ে উড়ালে ছেড়ে দেয়। দোয়েলও নিশ্চয়ই তাই করেছে।
পাপ্পু বিগড়ে যাওয়া আকাশ, রাগি তেজপাতাদ্রোহ, মাটিখোর মাতাল, অন্ধ অজগরের ধোঁয়াকু-লী, বৃষ্টিডিম, উপাস্য সৃষ্টির চন্দ্রের প্রথম কলা, দোয়েল নদী পাহাড়, গোলাপ সুন্দরী, পেইন্টিংয়ে নানা ভাবনা পুঞ্জিভূত করে আঁকতে যায়, আচানক রাত্রির কথা মনে পড়ে, বলেছিল, ফিল্মই তোমার মূল জায়গা।
আপোস করে না বলে তার এত খরচের কাজ বাজারে উদ্ভাসিত হয় না।
আসমা আপার নিয়মিত নিজ হাতের রান্নার প্রতি আগ্রহ নিভে যেতে থাকে। উদাসীন নির্বিকার চোখ তার প্রিয় খাবার অপ্রিয়তার প্রতি রংহীন একফোঁটা তাকিয়ে সে ফের সন্ধ্যায় আরও তুমুল আলস্যে বাগানে যায়।
অনেক চেষ্টা করে চড়াইটাকে উড়িয়ে দেওয়ার। কিন্তু এ উড়াল ভুলে গেছে। ভেতরে ভেতরে কেমন কান্না কান্না ফিলিংয়ে ভিজে যেতে থাকে, আমি উড়াল মানুষ, পাখিটাকে জীবনের জন্য উড়াল ভুলিয়ে দিলাম!
আচমকা সন্ধেবেলা গুচ্ছ ঘ্রাণে সে প্রায় লাফিয়ে ওঠে, তার অস্তিত্বের শাখাপ্রশাখায় রক্ততরঙ্গের কল্লোল, সবক’টি গোলাপ যেনবা একসাথে ফুটে এমনভাবে তার দিকে তাকিয়ে অনেক কুহেলিকা ভঙ্গিতে হাসছে, পাপ্পু পুরো টবটা বুকে নিয়ে যেন হাঁ হাঁ করতেই রাত্রির ফোন আসে।
রাত্রি মায়ামুড়িমাখানো পাপ্পুর কথা শুনে বলে, ‘গোলাপছানার বাবা বাবা ফিলিং হচ্ছে?’
আচমকা সে বন্ধঘড়ি হয়ে যায়, গা ঘুলিয়ে ওঠে, গোলাপ গাছের ফুলকে সে কী চোখে দেখে? রাত্রি এখনও যদি তার ফিলিং না বোঝে, আচমকা তার মনে পড়ে গর্ভবতী থাকা অবস্থায় তাকে ফেলে তার হাজব্যান্ডের প্রবাসে গিয়ে পালিয়ে যোগাযোগহীনতার কথা।
এখন সে উঠতে বসতে, দাঁড়াতে, হামাগুড়ি দিতে দিতে তার ছেলে বাবুইয়ের কথা বলে, ‘বাবুই এই, বাবুই হাসি, বাবুই কান্না, বাবুইয়ের প্যান্টুতে হেগে দেওয়া।’
কুয়াশার কুমির কুমির বোধ ছিঁড়ে যায় উদ্ভাসিত হাসির কল্লোল রাত্রির কণ্ঠে, ‘তুমি কি সেই পাপ্পু, অসাধারণ হিউমারের কারণে যার প্রেমে পড়েছিলাম?’
পাপ্পু অপেক্ষা ভুলে যায়।
শিশির শিশিরের সাথে তর্ক করে। দাড়িগুলো এমন লম্বা ধার্মিক দাড়ি হয়ে উঠছে যে আয়নায় সামনে সে টুনি কাঁচি চালায়। মুহূর্ত ঝাঁক ঝাঁক বেঁধে চলে। প্রচ্ছন্ন অপ্রচ্ছন্ন কুয়াশার হিম সোয়েটার খুলে শীত কাঁপনে ভারী লেপের ওমে নিজেকে ছড়িয়ে দেয় সে।
পরদিন সন্ধ্যায় বন্ধু ঝরনা পাপ্পুকে ভিসা সংবাদ জানায়।
‘তোমার মেডিক্যাল ভিসা হয়ে গেছে। আমার শরীরটা ভালো ছিল না গো বন্ধু, তুমি এমব্যাসিতে গিয়ে পরশুই ঢাকায় চলে আসো। তোমার ফ্লাইট পরশু, তোমার শেষ টেস্টের রিপোর্টে যা পাঠিয়েছ, তা দেখে ডাক্তার বলেছেন, ভয়রোগ হলেও ফার্স্ট স্টেজে ধরা পড়েছে। তুমি কালই এসে পড়ো।’
‘ও ঝরনা গো, মায়াবাসি কন্যা গো, সহোদরা সখী গো, কী হয়েছে রে তোর? তোমার? আমার বারান্দায় পাখি, ফুল, আমি ওদের ফেলে কী করে কোথাও যাই?’
আসমা আপা ঠিক ওদের দেখবেন। নিজের জীবনটা তো বাঁচাতে হবে। জলদি জলদি চলে আসো।
ফের ভয়-ভয়-ভয়হীনতা। এর মধ্যে করোনায় অনেক ভুগে রাত্রি মারা যায়।
নিজেকে কেমন অবশ ইঞ্জেকশনে এলোমেলো হাঁটাশোয়া আদিম প্রাণী মনে হয়। সে তো আজীবন অনেক কেয়ারিং, এখন সাপলুডো খেলার চক্করে পড়ল? আগে এমন হলে সবচেয়ে মায়াবী বাক্য, আহা! বলত। ফের খাবার শুকিয়ে যায়, আসমা আপার কণ্ঠে ঝাঁঝ, বলতে বলতে পরেশান হয়ে যাচ্ছি ভাই, আমার বাড়িতে চল, আর ভালো লাগে না! অসহ্য!
গোঁয়ার তার পৃথিবী বিষাদের বিষণ্ণতার ছত্রছায়ায় যতই অবাক অবুঝ থাকুক, এক পশলা ছলনাহীন গোলাপ-চড়াইকে ফেলে কীভাবে যায় ?
মৃদু চক্ষু রিমোটের জং ছোটায়। টিভি স্ক্রিনের শব্দ তাকে চমকে দিয়ে নৈঃশব্দে আচ্ছন্ন ঘরটায় যেন চিৎকার করে ওঠে। আলগোছা চমকে পাপ্পুর রাত্রি দহনে ক্ষণে ক্ষণে এক পশলা করে পোড়ে।
টিভি স্ক্রিনে কোন চ্যানেলে যেন আর এক জগৎ। কতগুলো ঘর তাঁবুর মতো ঠেকছে, আর চারপাশে মরুর ওপর বিকট বিকট পাথর!
পুরোনো পাহাড়ের নাভি ফুঁড়ে যে জল গড়াচ্ছে, তার নীচে যেন বা পাপ্পু বসে আছে। সে কিঞ্চিৎ অবাক হয়, কিন্তু তার ভেতরের রক্তস্রোত তার ভেতর প্রাণসঞ্চার করে না। আগামীকাল ভোরে ঢাকায় যেতে হবে। এরপর কত দিন, কত মাস…!
আস্ত রাত নিশি নিশি জাগরিত বিছানায় পড়ে থাকে। এরমধ্যে লকডাউন ভাঙলে তাকে বিস্ময়ের চূড়ান্তে ঘরে এলায়িত দেখে তাজ্জব বন্ধুরা করোনা থোড়াই ডরাই বলে মদের হুজ্জুত বসিয়ে, কত যে তিরস্কার করল পাপ্পুকে!
যে বন্ধু আয়োজন করেছিল, সেও মারাত্মক করোনার আগ্রাসনে ডুবে। পাপ্পুর অন্তরাত্মা হায় হায় করতে থাকে।
আমি কি মরে যেতে পারি?
গোলাপগুলো যেন হায় হায় হয়ে অদ্ভুত রংধনু প্রচ্ছায়া নিয়ে তার দিকে আলোর রিদম ছড়িয়ে চেয়ে থাকে, বালাই ষাট!
ক্রমশ ভোর নেমে আসতে থাকে শালিক শালিক কাকের কাউয়া কিচিরমিচির পাখি ডানায় ভর করে।
আসমা আপা গতকাল এসে পাপ্পুর সব কাপড়চোপড় গুছিয়ে বলেছিলেন, ‘তোর সাথে তোর পরাণ বন্ধু যাচ্ছে রাজধানী থেকে নিশ্চিত?’
‘এক্কেবারে পাক্কা।’
‘সাবধানে যাবি, আমি অনেক ভোরে এসে যাব।’
তালের শাসরং প্রচ্ছায়া দরজার বাইরে হামাগুড়ি দিচ্ছে। দুম লাফে বিছানা ছেড়ে সে বাথরুমে গিয়ে আয়নায় মুখ পাতে।
ব্রাশের শব্দ, বাথরুমে সুন্দর ঘ্রাণের শব্দ, প্যান্ট শার্ট পরে তৈরি হওয়ার শব্দ, হেমন্তের গান, এমন কোনো শব্দ দিতে পারো যাতে কোনো শব্দ নেই?
দরজায় বেলের শব্দ।
আসমা আপা কথা বলে বলে কীসব গোছাচ্ছেন, ‘নাস্তাটা গরম গরম খেয়ে নে। আমি আবারও বলছি, তোর পাখিগুলাকে পুরো নজরে রাখব। জানিস তো গোলাপ আমার কত পছন্দের!’
কী জানি কেন, তার হৃৎপিণ্ডে কথাবার্তাহীন ভয় ভয় একটা মস্ত পাথর ডিগবাজি খায়।
গ্রিল বারান্দা থেকে ধেয়ে ধেয়ে আসা খেজুর গুড়ের চায়ের মতো কচি রোদে প্রচ্ছায়ায় চোখ যায় তার।
পাখি পাখি রোদ, তার স্যান্ডেল পা দরজা খুলে সে তার শৈশব থেকে দেখা অরণ্যবাগানের দিকে খানিক তাকিয়ে হু হু নস্টালজিক হয়ে বাতাসের ধাঁই ধাঁই শব্দে চুল এলোমেলো ঝুঁটি রাবারব্যান্ডে কষে বাঁধে।
হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে ওঠে। আকাশ সাঁতার না জানা চড়াই পাখিটা কোথায় যেন চলে গেছে।
ছুটে সে আসমা আপার হায় হায় ঠেলে বাইরে অনেক খোঁজ করে।
আত্মার অ্যালব্যাম আউলিঝাউলি বোধে চক্রাকার বোধ করে।
নিজেকে কষে বিন্যস্ত করে সে।
এরপর নিরন্তর যেভাবে বসে সেভাবেই বারান্দা মেঝেতে বসে একেবারে ফতুর চেহারা নিয়ে যেন বা ঝাঁকড়া ফুলগুলোর বহুবর্ণা ফুরানো অবয়ব নিয়ে চুপ হয়ে যাওয়া গোলাপগুচ্ছের ওপর প্রগাঢ় মায়া উপচে নরম হাত বোলাতে থাকে, এই তো কিছুদিন, আমি জলদিই ফিরে আসব।
‘পাপ্পু…’ আউচ করে চমকে ওঠে, চারদিকের ধবধবে কাঁচাকাঁচা রোদ ঝালরে হাত মেলে সে বিমূঢ় বোধ করে— আজকেই পয়লা… সারাদিন সারাক্ষণ নিজের ভেতর গুটিয়ে রাখা গোলাপগাছ তার কাঁটা বিস্তারিত করেছে।
পাপ্পু তার ছিঁড়ে যাওয়া রক্তাভ হাতের দিকে তাকিয়ে সীমাহীন বিমূঢ় বোধ করে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন