সেলিনা হোসেন
অভাবের সংসার ওসমানের। পরের জমিতে দিনমজুরি করে আয় করে। যেটুকু আয় করে তা দিয়ে সংসার চলে না। প্রতিবেলায় থালায় ভাত থাকে না। তিন ছেলেমেয়ের কান্নাকাটিতে ঘরের ভেতর অভাবের ঝড় ওঠে। এভাবে জীবন চলে না। তারপরও নিজেকে নিয়ে কোনো স্বস্তি পায় না। ভেবে দেখে তার কিছু করার নেই। কী করবে? কোথায় যাবে? গ্রামের বাইরে কোথাও গিয়ে কাজ করার সুযোগ নেই। তিন ছেলেমেয়ে আর বউকে নিয়ে কোথায় যাবে? গেলে ওরা থালায় ভাত পাবে কোথা থেকে? এসব ভাবলে বুকের ভেতর হিম হয়ে যায়। ওসমান তখন দ্রুতপায়ে হেঁটে নদীর ধারে যায়। বেঁচে থাকার অভাবের গ্রাস কাটিয়ে দেয় নবগঙ্গা নদীর রাতের কুলকুল ধ্বনি।
বেঁচে থাকার স্বপ্ন খুঁজে পায় নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়ালে। বর্ষায় যখন নবগঙ্গা মেতে ওঠে সেটা ওর প্রবল আনন্দ। ঘরের কাছে নদীর পানি চলে আসে। সেই হাঁটুসমান পানিতে নেমে দাঁড়িয়ে থাকে। নদী এখন পর্যন্ত ওর ঘরবাড়ি ভাঙেনি। কাছাকাছি এসে নিশ্চুপ হয়ে যায় নবগঙ্গা। ও নদীতে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকায়। ফাতেমা পেছন থেকে বলে, “কী গো নদীর জন্য এত টান কেন তোমার?”
ও বউয়ের চোখে চোখ রেখে বলে, “নদী আমার অভাব ভুলিয়ে দেয়।”
“এটা কোনও কথা হলো? নদী যদি তোমার ঘরে মাছ ঢুকিয়ে দিত তাহলে বুঝতাম নদী তোমার অভাব ভরায়। তোমার কেবল ফালতু কথা। অভাবে পোলাপানগুলো কাঁদে এটা ভুলে যাও কেন?”
“ভুলিনা তো। কী করব সেটা ভাবি।”
“ছাতু ভাব। ঘরে তো কিছু আসে না। খালি থালায় পানি গড়ায়।”
“তুমি আমারে বকো কেন? তুমিও নিজে কিছু আয় কর।”
“আশেপাশে সব তো গরিব মানুষ। কার ঘরে গিয়ে কী কাম করব?”
“ঢাকা শহরে যাও। ওখানে গিয়ে মানুষের বাড়িতে কাম কর।”
“পোলাপান কে দেখবে?”
“আমি দেখব।”
“তুমি দেখলে ধানখেতে কাম করবা কখন? ওদের জন্য ভাত রাঁধবে কে?”
“এতকিছু চিন্তা করলে আয় করতে পারবে না।”
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন ছেলেমেয়ে চেঁচিয়ে বলে, “মাকে ছাড়া আমরা ঘরে থাকব না। আপনি ঢাকা শহরে যান আব্বা।”
“না, আমি যাব না। আমি যা পারি এখানে থেকেই করব।”
তিনজন হুড়মুড়িয়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। নদীর পানিতে নামলে পানি ছলছল করে। সবার বড় রতন। ওর বয়স নয় বছর। মেজ রুনা। ওর বয়স সাত। সবার ছোট রজন। ওর বয়স পাঁচ। ওসমান রজনকে কোলে তুলে নিয়ে বলে, “নদীর পানিতে তোরা নামলি কেন?”
“আপনি আর মা তো নেমে দাঁড়িয়ে আছেন।”
“আমরা তো বড় মানুষ। তোরা তো ছোট্ট। পানিতে ডুবে যাবি।”
রুনা পা দিয়ে পানি আলোড়িত করে বলে, “আমরা সাঁতার শিখব আব্বা।”
“তোদেরকে পুকুরে সাঁতার শিখাব। চল, ঘরে চল।”
রতন পানিতে পা নাড়াতে নাড়াতে বলে, “নদী তো আমাদের ঘর হয়ে গেছে। আমাদের ঘরের কাছে আসে। কোনদিন জানি ঘরে ঢুকবে কে জানে?”
“ঢুকবে না। আমি নদী ভালোবাসি।”
ফাতেমা জোরে জোরে বলে, “নদী কি তোমার ভালোবাসা বুঝে? যতসব ফালতু কথা।
পোলাপানরে ফালতু কথা শিখাইও না।”
রতন মায়ের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, “মাগো এমন করে কথা বল ক্যান?”
“চুপ। তুইও বেশি কথা বলবি না। চল, ঘরে চল সবাই।”
রুনা বলে, “আমি আব্বার হাত ধরে ঘরে যাব।”
“আব্বার কোলে তো রজন আছে।”
“ও তো কোলেই থাকবে। আমিও হাত ধরব।”
“আয় আয়।”
ছেলেকে এক হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে আর এক হাত বাড়িয়ে দেয় ওসমান। রুনা বাবার হাত চেপে ধরে। রতন মায়ের হাত ধরে নদীর পানি পেরিয়ে পাড়ে উঠে হাসতে হাসতে বলে, “বাহ্, কি মজা লেগেছে নদীর পানিতে হাঁটতে।”
“পানি বাড়ির কাছে গড়িয়ে এসেছে বলে হাঁটতে পারলি। নদীর ভেতরে গিয়ে তো হাঁটতে পারবি না।”
“হ্যাঁ, তাই তো ডুবে যাব।”
“সে জন্যই বলি নদী, নদী করবি না। কোন দিন ঘর ভেঙে ফেলে কে জানে।”
“আব্বা নদীকে ভালোবাসে। নদী আমাদের ঘর ভাঙবে না।”
“থাক, এমন কথা বলবি না। চল।”
“আজকে থালায় ভাত পাব মা?”
রুনা পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলে।
“হ্যাঁ, আজকে পাবি।”
“ভাতের সঙ্গে আর কী আছে?”
“পুঁটি মাছের তরকারি।”
রতন আর রুনা চেঁচিয়ে ওঠে, “হুররে, হুররে।”
বাবা-মায়ের হাত ছেড়ে দিয়ে দু’জনে দৌড়ে রান্নাঘরে চলে যায়। পিঁড়া টেনে বসে পড়ে মাকে ডাকে, “মা আস, মা আস।” ওসমান রজনকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বলে, “নাও ওকে নাও। ও কী খাবে দেখ।”
“ওকেও ভাত খাওয়াব। ঘরে তো আর কিছু নাই।”
“ঠিক আছে, খাও তোমরা। আমি বাজারের দিকে গিয়ে দেখি কোনও কাজ জোটে কিনা।”
“টাকা পেলে চাল কিনবে।”
“আর কিছু লাগবে না?”
“অনেক কিছুই লাগবে। দেখি তুমি কত টাকা পাও।”
ওসমান আর কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে। নদীর ধারে এসে দাঁড়ায়। নিজের নৌকার উপর উঠে বসে। কোনও যাত্রী পেলে পৌঁছে দিবে কোথাও। কিছু টাকা আয় হবে। কিন্তু চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে নৌকার যাত্রী নাই। সবাই যে যার মতো হেঁটে চলে যাচ্ছে।
একসময় শেখর এসে নৌকার পাশে দাঁড়ায়। শৈশব থেকেই দুজনের বন্ধুত্ব। নিবিড় বন্ধুত্ব। এই বন্ধুত্বে কখনও ছেদ পড়েনি। শেখর বলে, “কী রে একা একা বসে আছিস কেন?”
“নৌকার যাত্রী খুঁজছি? ঘরে চাল নাই।”
“যাত্রী পাসনি তো। উঠে আয়। একসঙ্গে গ্রামের বাজারে যাই। দেখি ওখানে কোনও কাজ পাস কিনা।”
ওসমান নৌকা থেকে নেমে আসে। দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে বাজারের দিকে যায়। একসময় শেখর ওসমানের হাত ধরে বলে, “আমাদের বন্ধুত্ব হিন্দু-মুসলমানের প্রীতির বন্ধন।”
“ঠিক বলেছিস শেখর। তুই খুব সুন্দর করে কথা বলিস।”
“আমার কথা শুনে গ্রামের মানুষেরা আনন্দ পায়। কেউ আমাদের ঘরবাড়ি ভেঙে তাড়ানোর কথা চিন্তা করে না। সবাই বলে, আমরা মিলেমিশে থাকব।”
হাহা করে হাসে ওসমান। হাসতে হাসতে বলে, “ঈদ আমাদের উৎসব। তোদেরও উৎসব। পূজা তোদের উৎসব আমাদেরও উৎসব। আমরা এভাবে চলেছি। আমাদের বেঁচে থাকা সুন্দর হয়েছে।”
শেখর ওসমানের হাত উপরে উঠিয়ে নাড়ায়। নাড়াতে নাড়াতে বলে, “সারা দেশে যদি আমাদের মতো গ্রাম বানাতে পারতাম তাহলে আমাদের বেঁচে থাকায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ হয়ে যেত।”
ওসমান হাত নাড়াতে নাড়াতে বলে, “বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায় শুনেছি যে তিনি বলেছেন যে ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। আমি সবাইকে মানুষ মনে করি। হিন্দু-মুসলমান মনে করি না।”
“হ্যাঁ রে ওসমান, এটা আমিও জানি। আমরা তো ঢাকা থেকে দূরের একটি গ্রামে থাকি। বঙ্গবন্ধুকে বারবার দেখতে পাইনি। যে দু’দিন দেখেছি সেই দেখায় মাথা ভরে আছে। বঙ্গবন্ধুকে মাথায় নিয়ে মৃত্যু হবে। তাঁর মতো মানুষ হয় না রে ওসমান।”
“হ্যাঁ, আমিও তাই বলি। মনে হয় কাছে পেলে মাথা ঠেকিয়ে রাখব তাঁর পায়ে। শুধু হাত দিয়ে ছুঁয়ে প্রণাম করব না।”
দু’জনে বাজারে ঢুকে গেলে বন্ধ হয়ে যায় কথা। ওসমান চারদিকে তাকিয়ে কাজ খোঁজে। কারোর ধানের বস্তা তুলতে হবে কিনা তা দেখতে চায়। নেই সেই রকম অবস্থা।
শাক-সবজী মাথায় নিয়ে যেতে হবে কিনা তাও দেখা যায় না। মনখারাপ হতে থাকে তার। চোখে পানি আসে।
শেখর মৃদুস্বরে বলে, “কী রে চোখ ভিজে যাচ্ছে কেন?”
“ঘরে চাল নাই।”
“দুই কেজি চাল আমি তোকে কিনে দেব। যখন আয় করবি তখন শোধ করে দিস।”
“ভাগ্যিস তোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। নইলে তো খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হত।”
“গাঁয়ের মানুষ তো সবাই আমাদের বন্ধু। আমাদের অভাবের সংসারে কষ্ট আছে, কিন্তু বন্ধুত্বের বেড়াজালে আমরা দুঃখ ভুলি। ভুলি না? বল?”
“সবসময় ভুলি না। কখনও কখনও ভুলি।”
“আমি সবসময় ভুলে যাই রে ওসমান। বন্ধুত্ব আমার কাছে বড় জায়গা। এই আজকে তোর সঙ্গে বাজারে আসতে আমার বুক ভরে যাচ্ছে। তোর ঘরে চাল নাই। এটা ভরে দিতে আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। কারণ তোর ঘরে তো তুই একা থাকিস না। ঘরে বউ-ছেলেমেয়েরা আছে।”
“ঠিক বলেছিস রে বন্ধু শেখর। চালটা আমার বউ-ছেলেমেয়ের জন্য বেশি দরকার। খিদা লাগলে তো ওরা কাঁদতে শুরু করে। ওদের কান্না দেখলে বুক ভেঙে যায়। ভাবি যে কেমন বাপ হলাম যে ওদের খেতে দিতে পারি না।”
“অভাবের সংসারে এইসব ভাবিস না। বঙ্গবন্ধুর কাছে আমরা সবাই দুঃখী মানুষ। বঙ্গবন্ধু চেষ্টা করছেন আমাদের সবার থালায় ভাত রাখতে। নিশ্চয় আমরা একদিন এইসময় পাব।”
“এত তাড়াতাড়ি ভাবিস না। সারা দেশের মানুষের থালায় ভাত দিতে বঙ্গবন্ধুর কিছু সময় লাগবে।”
“তা ঠিক। ঠিক বলেছিস। আমরা বঙ্গবন্ধুর কাজের জন্য অপেক্ষা করব। তাঁর মতো মানুষ আমরা এই দেশে দেখিনি।”
“তিনি আমাদের জাতির পিতা। গরিব মানুষের জন্য তাঁর মায়ার শেষ নাই।”
“হ্যাঁ, আমিও তাই মনে করি। তিনি এখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে দিয়েই আমরা ভাতের থালা ভরাতে পারব। অভাবের সংসারে ছেলেমেয়েদের কান্নাকাটি থাকবে না।”
“চল, তোর চাল কিনে দেই। বাড়ি যা।”
“দুপুরের ভাত খেয়েছে ছেলেমেয়েরা। রাতের জন্য চাল লাগবে। আমি কিছুক্ষণ নদীর ধারে দাঁড়াব।”
“তোর সঙ্গে আমিও কিছুক্ষণ নদীর ধারে থাকব। নদী আমার দুঃখ ভোলায় রে। চল চাল কিনে শেষ করি।”
শেখর ওকে বিভাসের দোকানে নিয়ে যায়। বিভাসকে বলে, “আমাকে দু’কেজি চাল দে। কাল এসে তোকে টাকা দিয়ে যাব বিভাস।”
বিভাস শুকনো মুখে বলে, “আজকে আমার ঘরে ছেলেদের বায়না আছে। ওরা বাড়িতে গেলেই ধরে, বাবা কী এনেছ? সেজন্য আমি একটা না একটা কিছু নিয়ে যাই। আজকে তেমন কিছু বিক্রি হয়নি। সেজন্য খালি হাতে বসে আছি। ছেলেদের জন্য জিলাপি নিয়ে যেতে চেয়েছি। তোমার কাছে টাকা নাই শেখরদা?”
“না রে আমার কাছে টাকা নাই।”
ওসমান ক্লান্ত চেহারায় নিজেকে সবার সামনে তুলে ধরে। বলে, “আমাদের তিনজনের কাছে টাকা নাই। আজ আমাদের সমান দুর্দিন।”
বিভাসও ক্লান্ত স্বরে বলে, “আমাদের বঙ্গবন্ধু এই দুর্দিন সরাবেন। আমরা বঙ্গবন্ধুর দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি আমাদের মতো দুঃখী মানুষের নেতা। তুই এখন ওসমানকে দুই কেজি চাল দিয়ে দে শেখর। আমরা আজকে যাই।”
বিভাস দু’কেজি চাল মেপে ওসমানের হাতে দেয়। বলে, “ঘরে চাল না থাকলে আমার কাছ থেকে ধার নিয়ে যাবে। তোমার ছেলেমেয়েরা যেন দিনরাত না খেয়ে কাটায় না। ওদেরকে অভাব বুঝতে দিও না। ওরা বড় হতে হতে আমাদের সংসার থেকে অভাব তাড়াবেন বঙ্গবন্ধু।”
“হ্যাঁ, আমরা এমন আশাতেই থাকব। বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে ধর্মের উর্ধে মানুষ হিসেবে চিন্তা করেছেন। আমরা এভাবে এগোব। আমাদের অভাবের সংসার কাটিয়ে উঠব।”
“ঠিক বলেছিস ওসমান। তোরা দু’জনে মিলে আমাকে শিখালি। আমি এই শিক্ষা নিয়ে দিন কাটাব। ভগবান যতদিন আমাকে বাঁচিয়ে রাখবেন আমি এই শিক্ষা ভুলব না রে।”
“আমরাও ভুলব না। আমরাও ভুলব না।”
দু’জনে একসঙ্গে কথা বলে। একই কথা দুইবার টেনে টেনে বলে, যেন স্লোগান দিচ্ছে। আশেপাশের সবাই হাসিমুখে তাকিয়ে থাকে। কেউ কেউ ওদের সঙ্গে বলে, “আমরাও ভুলব না।” শেখর আর ওসমান দু’জনে হাততালি দেয়। এভাবে দেশবাসী একসঙ্গে যুক্ত হলে সারা দেশের মানুষ ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে যাবে। মানুষের এক হয়ে যাওয়া বুকের ভেতর ঢুকে থাকবে। মাথার মগজেও আটকে থাকবে। দু’জনে খুশি হয়ে তালি বাজায়। একসময় স্লোগানের মতো বলে, “বঙ্গবন্ধু জয়বাংলা।” একসঙ্গে আশেপাশের সবাই চেঁচিয়ে বলে, “বঙ্গবন্ধু জয়বাংলা।” স্লোগান সবার কণ্ঠে উঠে বলে, চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে। বেশ কিছুক্ষণ সবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকে দু’জনে। ওসমান একসময় স্লোগন তোলে, “বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে অভাবের থালা মুছে যাবে।” সবাই কণ্ঠ মিলায়। খুশি হয়ে হাততালি দেয়। বাজারের লোকজন এসেও জড়ো হয়। দুই জন থেকে দুইশ জনের স্লোগানে বদলে যায় এলাকা।
শেখর চিৎকার করে বলে, “আমরা বঙ্গবন্ধুর দুঃখী মানুষ থাকব না। আমরা বঙ্গবন্ধুর সুখী মানুষ হব।”
শেখর থামলে ওসমানও চেঁচিয়ে বলে, “আমরা যার যার ধর্ম পালন করব, আমাদের হাতে কারোর জন্য ছোরা উঠবে না। আমরা কারোর ঘরে আগুন লাগাব না।”
আশেপাশের সবাই চেঁচিয়ে বলে, “হুররে, আমরা এমন দেশ চাই। বঙ্গবন্ধুকে আমাদের এই অজ পাড়াগাঁয়ে এনে আমরা মাথায় নিয়ে ঘুরব।”
সবাই আবার হা-হা করে হেসে তালি বাজায়। হাততালি থামলে শেখর বলে, “বঙ্গবন্ধুকে বলব আমরা আপনার সোনার গ্রাম বানিয়েছি এই ছোট্ট্ গ্রামে।”
“এটা আমাদের বলতে হবে না। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলবেন।”
ওসমানের কথা ধরে সবাই সমবেত কণ্ঠে বলে, “ঠিক ঠিক।”
ওদের মধ্যে বয়সী আজহার বলে, “চলো সবাই মিলে গ্রামে ঘুরে আসি।”
শেখর বলে, “আপনারা যান। আমরা ওসমানের বাড়িতে চালগুলো দিতে যাই। ওর ঘরে রাতের ভাত রান্নার জন্য বৌদি চালের জন্য কান্নাকাটি করবে।”
“হ্যাঁ, ঠিক। চাল না থাকলে ও কাঁদতে শুরু করে। কাঁদে ছেলেমেয়ের জন্য। নিজের জন্য না।”
“তোর জন্যও কাঁদে না। নিজের কথা বাদ দিলি কেন?”
ওসমান চুপ করে থাকে। অন্যরা হাততালি বাজাতে বাজাতে বাজারের দিকে যেতে শুরু করে। আজাহার বলেছে, “যারা বাজারে আছে ওদেরকেও সঙ্গে নিতে হবে। তাহলে পুরো গ্রাম একসঙ্গে হবে।”
“আমরাও বাদ পড়ব না রে ওসমান। চাল দিয়ে আমরাও যোগ দিব। তাড়াতাড়ি চল।”
“হ্যাঁ, তাইতো। ওরা বাজারে যেতে যেতে আমাদের চাল দিয়ে আসা হবে।”
“চল, চল।”
দুজনে দ্রুতপায়ে হাঁটতে শুরু করে। যেতে যেতে শেখর বলে, “আমরা কাল সকালে নদীর ধারে যাব। এই গ্রামে তুই আর আমি নবগঙ্গাকে বেশি ভালোবাসি।”
“নবগঙ্গার ধারে গেলে আমার অভাবের দুঃখ ঘোচে।” ওসমান দু’হাত বুকের ওপর রেখে মাথা ঝাঁকিয়ে কথা বলে।
শেখর বুক ভার করে বলে, “আমাদের সুখ-দুঃখে নদীর কিছু আসে যায় না। বন্যায় ভাসিয়ে দেয় গ্রাম। ভেঙে দেয় ঘরবাড়ি।”
“থাক এত কথা বলিস না।”
“বলব না কেন? তখন তো রাগে মাথা গরম হয়ে ওঠে।”
“আমার উঠে না। নদীর জন্য আমার ভালোবাসা থেকেই যায়। নদীতে চর জাগলেও আমার কষ্ট লাগে না।”
“ঠিক আছে। আমি কাল সকালে নদীর ধারে আসব। তুইও চলে আসবি।”
“আচ্ছা, যা বাড়িতে যা।”
শেখর দ্রুতপায়ে হেঁটে চলে যায়। ওসমান রান্নাঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ফাতেমার চুলো জ্বলছে না। টুকটাক কাজ করছে। ওসমানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কত টাকা আয় করতে পেরেছ? হাতে কিছু থাকলে একটা কুমড়ো কিনে আন। নইলে ভাত খাবে কি দিয়ে?”
“আমি তো কিছু আয় করতে পারিনি। চাউল এনেছি বাকিতে।”
“তাহলে কুমড়োও বাকিতে আন।”
“দেখি, বাজারে যাই।”
ওসমান নিজের বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় আসে। দেখতে পায় ছেলেমেয়েরা মাঠে ছুটাছুটি করছে। বুঝতে পারে অভাবের সংসারে ওরা আনন্দ খুঁজে পায়। এটুকু ওদের বেঁচে থাকার শক্তি। একই সঙ্গে পেট-ভরা ভাত চাই। ওদের শুধু কুমড়োর তরকারি দিয়ে হবে না। মাঝে মাঝে মাছ-মাংসের জন্য কান্নাকাটি করে। মাছ-মাংস ওদেরকে কমই খাওয়ানো হয়। দ্রুতপায়ে এসে কাছে দাঁড়ায় বিমল। বলে, “কী হয়েছে রে তোর? মনে হচ্ছে গভীর চিন্তায় পড়েছিস?”
“অভাবের সংসারে তো চিন্তা সারাক্ষণই থাকে। এখন একটা কুমড়ো কিনার চিন্তায় পড়েছি। হাতে তো টাকা নাই।”
“কুদ্দুসের বাড়ির মাচায় বেশ কয়েকটা কুমড়ো দেখেছি। চল ওখান থেকে একটা কুমড়ো নিয়ে আসি।”
“ও তো শাক-সবজি বিক্রি করে সংসার চালায়।”
“চল, আমরা আনি। ওকে দামটা পরে দেব। ও দেবে। অন্যদেরকেও এভাবে দেয়।”
“ভালোই তো। বাড়িতে থেকে বিক্রি করার সুযোগ এটা।”
দুজনে গিয়ে কুদ্দুসের সবজি বাগানের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কুদ্দুস বাগানে কাজ করছে। ওদের দেখে এগিয়ে আসে। বলে, “কী সাহায্য করব?”
বিমল বলে, “কুদ্দুস ওসমানের একটি কুমড়ো লাগবে। বাকিতে দিতে হবে।”
“হ্যাঁ, দিব। কোনটা নেবেন, দেখেন ওসমান ভাই।”
ওসমান একটি পছন্দ করে বলে, “এটা দাও। এই কুমড়ো না পেলে আজকে রাতে ভাত খাওয়া হবে না। ছেলেমেয়েরা তো নুন আর কাঁচা মরিচ দিয়ে খেতে পারবে না।”
“তা তো ঠিক। নেন ভাই, নিয়ে যান।” কুদ্দুস কুমড়ো ছিঁড়ে দিলে দু’জনে ফিরে আসে। বিমল বলে, “কুমড়ো একটা জোগাড় হয়েছে এজন্য আমি খুশি। ভাত খাওয়ার সময় ছেলেমেয়েরা কাঁদবে না।”
“তোমাকে ভালোবাসা জানাই বিমল। তুমি সহজভাবে আমার সমস্যা মিটিয়ে দিলে।”
“সবাই সবার জন্য এমনই তো করবে।”
“ঠিক আছে, বাড়িতে যাও। আমি আমার পথে যাই।”
“গেলাম। শুভেচ্ছা।”
দু’জনে দুজনের পথে হাঁটতে শুরু করে। দু’হাতে কুমড়ো ধরে বাড়িতে ঢুকলে ছেলেমেয়েরা দৌড়ে আসে।
“আব্বা, কুমড়ো এনেছেন। রাতের জন্য মা কুমড়া রাঁধবে। আমরা পেট ভরে ভাত খাব।”
ওসমান তিন ছেলেমেয়ের মাথায় হাত রেখে বলে, “পেট ভরে ভাত খেয়ে বড় হও সোনারা।”
রতন সঙ্গে সঙ্গে বলে, “শুধু ভাত খেয়ে বড় হব না। লেখাপড়া শিখে বড় হব।”
“হ্যাঁ, স্কুলে তো ভর্তি করেছি। তোমরা মন দিয়ে পড়ালেখা কর। ভালো রেজাল্ট করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে।”
হাসিতে ভেঙে পড়ে তিনজনে। হাসতে হাসতে রতন বলে, “আমরা বাবার ইচ্ছা পূরণ করব। হিপ হিপ হুররে!”
তিন জনে উঠোনে লাফাতে শুরু করে। ওসমান ছেলেমেয়েদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। ভাবে, এমন অপরূপ দৃশ্য দেখলে বেঁচে থাকা সুন্দর হয়। একসময় ওদের লাফানো শেষ হয়। ওরা এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। রুনা বাবার কাছ থেকে কুমড়ো নিয়ে মায়ের কাছে যায়।
জোরে জোরে বলে, “মাগো রান্না করো। কুমড়ো দিয়ে ভাত খেয়ে রাতে ঘুমাবো।”
ওসমানের মন খুশিতে ভরে যায়। ওদের আনন্দ ওকে মাতিয়ে তোলে। নিজের ভেতরও আনন্দের অনুভব ওসমানকে নবগঙ্গা নদীর ধারে নিয়ে যায়। ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার সময় ভাবে স্বপ্নের ভেতর নদীর ওপর দিয়ে হাঁটাহাটি করবে। নদী ওকে ডুবিয়ে নিজের তলদেশে নিয়ে যাবে না। গভীর রাতে ফাতেমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুমি আমার নবগঙ্গা নদী। আমাকে ভালোবাসায় বাঁচিয়ে রেখেছ।” ফাতেমার কাছ থেকে কোনো সাড়া আসে না। ওসমান নিজেও ঘুমিয়ে পড়ে। সূর্য ওঠার আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নদীর ধারে চলে আসে। কুলকুল শব্দে নবগঙ্গা বয়ে যাচ্ছে। ও নদীতে পা ডুবিয়ে পাড়ে বসে পড়ে। একটু পরে শেখর আসে। ওসমানের পাশে বসে পড়ে। বলে, “দু’জনে একসঙ্গে খাব। এই চিন্তায় রুটি আর ডিম ভাজা নিয়ে এসেছি। আমরা বঙ্গবন্ধুর দুঃখী মানুষ। একসঙ্গে খাব বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে।”
“খাওয়া দিয়ে প্রমাণ করবি যে দুঃখী মানুষের পেটে ভাত থাকে? অভাব নেই কোথাও?”
“তাই তো করব। সেজন্য খাবার এনেছি।” ওসমান ঘুরে বসে শেখরকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
তখন চার-পাঁচ জন লোক কাঁদতে কাঁদতে নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে যায়। দু’জনে উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে? কাঁদছেন কেন?”
“কাল রাতে বঙ্গবন্ধুকে পরিবারসহ মেরে ফেলেছে শয়তানরা।”
“বলেন কি?”
“নুরুজ্জামানের বাড়িতে রেডিও আছে। ও শুনেছে। মেজর ডালিম নামে একজন বারবার রেডিওতে মেরে ফেলার ঘোষনা দিচ্ছে।”
“ওহ হো! এমন ঘটনা ঘটতে পারে?” বাংলাদেশের দু’জনে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। হেঁটে যাওয়া লোকেরা আর দাঁড়ায় না। চলে যায়। শেখর আর ওসমান বসে পড়ে নদীর ধারে।
দু’জনের কারও মুখে কথা নাই। নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। একসময় দু’জনে দেখতে পায় বঙ্গবন্ধুর মুখ ভেসে উঠেছে নদীজুড়ে। বিশাল মুখের ছবি নবগঙ্গা ধারণ করে রেখেছে।
শেখর বলে, “বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন। এভাবে আমাদের বুকের মাঝে। মানবিক চেতনায়।”
“ঠিক বলেছিস। তিনি আমাদের মতো দুঃখী মানুষের ভাতের থালায় বেঁচে থাকবেন।”
“বেঁচে থাকবেন তোর আমার বন্ধুতে। যার যার ধর্ম নিয়ে সবাই মানুষ।”
কথা শেষ হতেই দু’জনে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ওদের চোখের জল নদীর স্রোতের মতো বয়ে যায় দেশজুড়ে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন