নয়া দোস্ত
ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়

পঞ্চা সিটি মারতে মারতে ভ্যান চালাচ্ছে। আহ্লাদের বুড়বুড়ি ‘ভুরুক ভুরুক’ করে উঠছে ওর মন আর শরীর জুড়ে। ছোটবাবুর হারামি চামচাগুলো ব্যাগড়া দেওয়ার জন্যে হাত পেতে ছিল। তাদের শকুন চোখ টপকে শেষ অব্দি জিনিসটা কবজায় আনতে পারবে কিনা, পঞ্চার বেহদ সন্দ ছিল। সব শালা বট ঠাকুরের কৃপা! জয় বাবা শনিঠাকুর, পেন্নাম হই। সামনের শনিবার তোমার থানে সিন্নি দেবই দেব।
ও বেশ বুঝতে পারছে, রাস্তার লোকজন ওকে বেশ নজরুল করছে। করুক গে! ওর ইয়ে ছেঁড়া যাবে৷ এমনকী ফুচকাওলা লখনও আজ ওকে দেখে আলু চটকাতে চটকাতে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আবে পঞ্চুয়া! আজ ইতনা খুশ কিউ বে? উও ক্যা হ্যায় তেরা ভ্যান মে?’
পঞ্চা জবাব না দিয়ে শুধু হাত নেড়েছে। শুডডার সঙ্গে ভ্যাকভ্যাক করতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। এমনিতেই এখন আটটা বেজে গেছে। গিয়ে এরপর মালটা ফিটিন ফাটান করতেও সময় লাগবে।
প্যাডেলে আরও জোরে জোরে চাপ দিল পঞ্চা। বড় রাস্তা পেরিয়ে ভ্যান এসে উঠল খালপাড়ের রাস্তায়। এসে থামল ওদের জবরদখল বস্তির সামনে।
নেমে কোমরের গামছা খুলে ভালো ঝাড়া দিল। বস্তুটা মোটামুটি পরিষ্কারই আছে। তারপর হাঁক পাড়ল, ‘ছুটকি! কই রে তুই?’
ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এল ছুটকি। দেখেই তার চোখ বড় বড়, ‘আইব্বাস! লিয়ে এসছ? আনতে পারলে?’
‘হুঁ হুঁ, পারব না, কী বলিস! তোকে বলিনি, কোম্পানির ছোটবাবু আমায় বহোত ডিপেন করে। আরে, ওনার কত ছুপা কাম ইধার উধার করে দিই। পয়সাও দিতে চেয়েছে, আমি নিই না। তার একটা দাম আছে তো, কী বল!’
পঞ্চার ভ্যানে একটা পুরোনো টিভি। সঙ্গে আরও কিছু হাবিজাবি তার, স্টেবিলাইজার। সবসুদ্ধু ওর ভ্যানে তুলে দিয়েছে ছোটবাবুর খাস বেয়ারা ঘনশ্যাম।
ছুটকি কাছে আসে। টিভিটার গায়ে বারবার হাত বুলিয়ে দেখে। তার ঢলঢলে মুখখানা হাসিতে ঝিকমিক করছে। ‘হ্যাঁ গো, এতে রঙিন ছবি আসবে তো?’
‘না তো কি? ছোটবাবুর চেম্বার ঘরে রোজ চলত, নিজের আঁখে দেখেছি। আজকে নতুন টিভিটা আসার আগেও চলেছে। তাই তো হারামি ম্যানজার বটু মিত্তির ওনাকে আঙ্গলি করছিল, কেন ওকে এত ভালো জিনিসটা একদম ফ্রি দিচ্ছেন, স্যার। টিভি কোম্পানি নিলে দামের উপর দুহাজার ছাড় দিয়ে দিত। কেন বে শালা, মালিক যদি ফ্রি দেয়, তোর কোথায় কামড়াচ্ছে রে? শালা ইয়ে মারানির ব্যাটা৷’
‘না গো, কোম্পানির ছোট মালিক সত্যিই তোমায় ভালোবাসে। এই তো, পাশের ঘরের মনসাদি বলছিল, ওরও খুব রঙিন টিভির শখ। চোরমার্কেটে ওর বর খোঁজ নিতে গেসল। তিন হাজারের নীচে পুরোনো টিভি নেই। বলছে টাকা জমিয়ে কিনবে।’
‘হ্যাঁ, রে।’ পঞ্চা ঠোঁট টিপে বলল, ‘ছোটবাবু সচ পেয়ার করে। যাগ্যে, ছাড়। আজকে নয়া দোস্ত ঘরে এসছে। সেলিবেট করতে হবে তো, কী বল! এই যে, আমি হাফ কেজি চিকেন নিয়ে এসেছি। বেশ গরগরে ঝাল ঝাল করে বানা। হ্যাঁ রে, আজ ভাত বসাসনি তো?’
‘না, এবার বসাব।’
‘না না, একদম না। আমি পাঁইয়ার দোকান থেকে রুটি আর ডিম তড়কা নিয়ে আসছি। তার সঙ্গে তোর হাতের ঝালঝাল চিকেন। জমে ক্ষীর হয়ে যাবে। ভালো কথা, শ্যামলদা ইলেকট্রি লাইন করে গেছে তো?’
‘হ্যাঁ গো। শ্যামলদা কেবলেও টেম্পুরি হুক মেরে দিয়েছে।’
‘ওহ লাভলি। তুই যা, ঝটপট রান্নায় লেগে পড়। আমি বাকি সব করে ফেলছি। ডম ডম ডিগাডিগা মৌসম ভিগা ভিগা…’
২
জমিয়ে খাওয়া হয়েছে। রঙিন টিভি চালু। হিন্দি সিনেমা চলছে। শাহরুখ খান আর করিনা কাপুর। মাঝে মাঝে ছবি একটু ঝিলমিল করছে, কেঁপে যাচ্ছে৷ যাক গে। সাউন্ড তো ঝাক্কাস আসছে। দুজনে গা ঘেঁষে বিছানার তেলচিটে বালিশে আধশোয়া, ছুটকি দুচোখ দিয়ে গিলছে।
‘এট্টু আলো নিব্যে দাও না গো। তা’লে ছবিটা আরো স্পষ্ট দেখাবে।’
‘তোর মুন্ডু! খপরদার ককনো করবি না। চোখ অন্ধ হয়ে যাবে। ছোটবাবু বলেছে।’
‘আহা গো, হিরো হিরোইন কিরম সোন্দর নাচছে গাইছে, আবার জড়াজড়ি করতে করতে গড়িয়ে পড়ছে গো।’
‘এটাই তো অ্যাট্টিং রে, ছুটকি। আয়, আমরাও নেমে নাচি।’
‘কী যে বলো। মাথা খারাপ হয়েছে! আমার নজ্জা করবে না?’
‘কেন রে? লজ্জা করবে কেন? ওরা তো নকলি পেয়ার করছে রে, আমরা তো সত্যি সত্যি বর বউ। তিন মাস তোকে বিয়ে করেছি, এর মধ্যেই পুরোনো হয়ে গেল নাকি? আয়, বিছনা থেকে নেমে আয়। নে, নে, সব কাপড় খুলে ফ্যাল, তারপর অ্যাক্কেরে দুজনে উদোম হয়ে টিভির সামনে — ‘
‘এই এই, আরে, কী করছ? য্ যা, সব খুলে দিলে… উ: উ: এমন আমাকে সারা শরীলে চুমু খাচ্ছ… উফ উফ, খুব নজ্জা করছে।’
‘পাগলি! আমার কাছে তোর আবার লজ্জা কী রে? শুধু তো আমরা, আর কি কেউ দেখছে? তুই হলি গিয়ে আমার সাচ করিনা, আমি তোর সাচ শাহরুখ। এই আমায় দ্যাখ, এইবার এরমভাবে পাছাটা দুলিয়ে … উমম উমম চুমমা চুমমা দে দে, চুমমা… এরম… নাচ নাচ্ ছুটকি নাচ।’
‘উফ… হ্যাঃ… এবার থামো পিলিজ…। আর পারছি না। গতরটা ছেড়ে দিচ্ছে … কাল ভোরে উঠেই ছুটতে হবে। সাত বাড়ির কাজ… ছাড়ো, এবার ছাড়ো… ‘
‘সে সব হবে। এখন এট্টু খুশ… ছুটকি, আমার করিনা। উমম… তুই কি মিষ্টি রে।’
‘ উফ… আহ এই এই… সুড়সুড়ি লাগছে… হ্যাগো, ওরা ওরম সোন্দর জাগায় থাকে?’
‘থাকেই তো। ওদের কোটি কোটি টাকা। বুঝলি।’
‘আমাদের কোনদিন ওরম ঘর হবে গো?’
‘হবে কি রে? হয়েই তো গেছে! ঘরের মধ্যে টিভি, টিভির মধ্যে ঘর৷ সেই ঘরে শুধু তুই আর আমি মনে মনে সব হওয়া যায়।… আয় ছুটকি, বিছানায় চল, তোকে বহোত টেইম নিয়ে আজ সত্যি সত্যিই – উম্-ম্। আয়, আয়’
‘উ– উ আসছি বাব্বা। তোমার যে তর সইছে না।’
‘উম্-ম-ম, সইছে না তো রে, দ্যাখ, ড্যান্সের পোজটা দ্যাখ, ছুট্টুক্কি, ও মাই ডাল্লিং।’
‘আরে, করো কী! এই জালনা দিয়ে যে পাশের ঘর থেকে সব দেখা যায় … আগে গিয়ে আলোটা নেভাও।’
পট করে আলো নিভে যায়। দুটো ছায়াশরীর ধপ করে বিছানায় পড়ে যায় শঙ্খলাগা সাপের মতো।
তারপর কিছু চেনা শব্দ।