short-story-olik-kusum

অলীক কুসুম
ঋতা বসু


শরীরটা ভারি হয়ে এসেছে স্বাগতার। তাও কষ্ট করে একবার একতলায় নেমে শ্বশুরের সঙ্গে দেখা করাটা বন্ধ করেনি। বিপত্নীক শ্বশুরমশায়ের সঙ্গে অকারণে খানিকটা সময় কাটানো তার কাছে কর্তব্যের থেকেও বেশী অন্যরকম একটা কিছু। অথচ শুরুটা এমন ছিল না।

সে একুশ শতকের একজন সাধারণ মেয়ে। দেখতে চলনসই। পড়াশোনা চাকরী সবই মাঝারী, নট আ পেনি মোর নট আ পেনি লেস। প্রিয় বিনোদন ফোন। ভার্চুয়াল ও রিয়েল মিলিয়ে শতাধিক বন্ধু। বিয়ের আগে অসুবিধে ছিল না কারণ মা ও মেয়ের একই নেশা। শুনেছিল শ্বশুর স্বরাজ একটু জ্ঞান দেওয়া টাইপ। স্বাগতার মা উদ্যোগী হয়ে বিয়েটা ঠিক করে দেবার পর লাভম্যারেজ লুক দেবার জন্য তারা কিছুদিন ঘোরাঘুরি করার সময় পেয়েছিল। সেইরকম কোনও একটা দিনে শুভাশীষ তাকে আশ্বস্ত করে বলেছিল, আমার বাবা কখনওই এটা কর ওটা কর বলে জ্ঞান দেয় না। কোনও ডিমান্ডও নেই। ঠাকুরদা ছিলেন নেতাজীর খুব ইন্টিমেট তাই ঠাকুরদা আর নেতাজীর গল্প বলতে পারলে আর কিছু চায় না। সাত বছর বয়সে বাবার সঙ্গে গিয়ে নেতাজীকে প্রণাম করেছে এটা বাবার জীবনে সবথেকে বড় ঘটনা। আমাদের শুনে শুনে মুখস্থ। তুমি নতুন লোক তোমাকে হয়ত একটু বোর করবে। চুপচাপ শুনো খানিকক্ষণ তারপর কাজের ছুতো করে পালিয়ে যেও।

স্বাগতা সেভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করেছিল। তবে সত্যি বলতে গেলে যতটা ভয়ের ভেবেছিল ব্যাপারটা মোটেই তেমন নয়। পায়ের অসুবিধের জন্য স্বরাজ বেশীরভাগ সময়ে ঘরের ভেতরেই বই খাতার মধ্যে মুখ ডুবিয়ে থাকেন। দিনের বেলা জানালা দিয়ে আলো এসে পড়ে টেবিলের ওপর। সেই আলোরই খানিকটা ছড়িয়ে থাকে স্বরাজের এলোমেলো পাকাচুলের ওপর। স্বাগতা অফিসে যাবার আগে আর অফিস থেকে ফিরে একবার বুড়ী ছুঁয়ে যায়। একদিন স্বাগতা জিজ্ঞেস করেছিল ভদ্রতা করে কী লিখছেন?

স্বরাজের চোখে একটু আলো ঝিলিক দিয়ে ওঠে। আশার আলো, একটা কবিতা কাল রাত থেকে চেষ্টা করছি।

স্বাগতার রাগ হল নিজের ওপর, কী দরকার ছিল এই বাড়াবাড়িটা করার? তবু ভদ্রতা করেই বলল, তাই?

লাজুক মুখে স্বরাজ বলে, পড়ি?
স্বাগতার সম্মতির জন্য অপেক্ষা না করেই মুখের সামনে নোটবইটা তুলে পড়তে থাকে,
রাজা জানতো
একদিন সে মরে গেলে
রাষ্ট্রীয় শোক হবে।
পতাকা শুধু খানিকটা
নিচে নেমে
দিন সাতেক
যেমন উড়ছিল তেমনি উড়বে।
পতাকা জানে না শোক!

স্বাগতা উসখুশ করে। ফোনে দেখে গুবরে পোকার মত এ্যাপক্যাব পাক খাচ্ছে। এখনও টিফিন জলের বোতল নেওয়া বাকী। ড্রেসটার সঙ্গে হাই হিল না কোলাপুরী, পরের লাইনগুলো অস্পষ্ট গুনগুন।
তাদের কাঁদতে দেখে
নিজেরই মৃত্যুশোকে
রাজা দোলাচল ।

শেষ করে স্বরাজ আশায় জ্বলজ্বল মুখে স্বাগতার দিকে তাকাতেই সে বলল- খুব ভাল হয়েছে বাবা। কিন্তু এখন আর দাঁড়াবার সময় নেই। পরে শুনব ভাল করে।

কিন্তু সেই সময় আর হয়নি। ছুটির দিনগুলোও কিভাবে যেন পিছলে বেরিয়ে যায়। দিনে দু’বার শ্বশুরের কিছু দরকার কিনা জানার বাইরে স্বাগতারই বা কী করার আছে। তিরাশী বছর বয়সের তুলনায় স্বরাজের মন যথেষ্ট তাজা। পায়ের একটা কষ্ট ছাড়া শরীরও যথেষ্ট ভাল বলতে হবে। শুভাশীষ অনেকবার ডাক্তার দেখানোর কথা বলেছে কিন্তু শুভেন্দুই যাচ্ছি যাব করে গড়িমসি করছিলেন।

কয়েকদিন বাদে সপ্তাহান্তের বিনোদন বাইরে খাওয়া সেরে ফেরার পথে শুভাশীষ স্বাগতাকে বলল, বাবার পায়ের কষ্টটা মনে হয় বেড়েছে।
কিন্তু ডাক্তার দেখাতে চাইছে না তো
চিরকাল এ রকম একগুঁয়ে। এখন কেয়ার করছে না, এরপর তো একেবারে বেডরিড্‌ন্‌ হয়ে যাবে-তখন?
স্বাগতা সমস্যা সমাধানের উৎফুল্ল গলায় বলল- বাদশাকে বলি? ওর তো অর্থপেডিক হিসেবে ভাল নাম হয়েছে এখন।
নিয়ে যাওয়াই তো মুশকিল।
ওকে ডাকব বাড়ীতে।
আসবে?
অবশ্যই আসবে। সেই ছোটবেলার বন্ধু, আসবে না মানে?




সেইদিনই শুভাশীষ আটকে গেল। বাড়ীতে সেটা জানানোর জন্য ফোন করতেই স্বাগতা বলল, খুব বাজে একটা ব্যাপার হয়েছে। না না নার্ভাস হয়ো না… বাবা ভাল আছেন। তুমি বাড়ীতে এস বলছি।

বাদশা কী বলল? সিরিয়াস কিছু?

বললাম তো চিন্তা করার কিছু নেই।

আর কথা না বাড়িয়ে দুম করে ফোন কেটে দেয় স্বাগতা।

শুভাশীষ যখন ফিরল বাড়ী নিস্তব্ধ। না চাইলেও উদ্বেগ চাপা থাকে না।

বারণ করা সত্ত্বেও না খেয়ে বসে আছ? তোমার না খালি পেটে থাকা বারণ এ সময়ে?

কথাটাকে একেবারে বেপাত্তা করে স্বাগতা বলল, জানো বাদশা কি কেলো করেছে?

কী?

দিব্যি আড্ডা হচ্ছিল হঠাৎ বাদশা হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল, তোর শ্বশুর এখনও টাকলুর গল্প চালিয়ে যাচ্ছে?

শুভাশীষ বললো, তাই?

হ্যাঁ দেখো না, বাবা নিশ্চয়ই কথাটা শুনেছেন। আমরা তো দিগ্বিদিক ভুলে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তারপর চা-টা খাওয়া হলে পর বাবার ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি দরজা বন্ধ। কিছুতেই খুললেন না। বললেন ভাল আছি। ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন নেই। আমাকে বিরক্ত কোর না এখন।

কোন কথাবার্তা না বলে রাতের খাওয়া সেরে ঘরে চলে গেলেন। বাবাকে কখনও এত আপসেট দেখিনি। এত খারাপ লাগছে।

কী আর করবে… অত সাবধানে কি সবসময় কথা বলা যায়?

পাজ্‌লের পিসগুলো যেন ঠিকমত বসল না। ঘুমের মধ্যেও স্বাগতাকে অস্বস্তি জড়িয়ে রইল চাপা অম্বলের মত।




অপরাধবোধ থেকেই শুরু হয়েছিল শ্বশুর মশায়ের সঙ্গে খানিকটা সময় কাটানো। উদ্দেশ্য, ড্যামেজ কন্ট্রোল। শারীরিক কারণেও বাইরের ঘোরাঘুরিও কমে এসেছে। অফিসের সময়টা বাদ দিয়ে বাড়ীতে থাকতেই ভাল লাগে। স্বরাজের ঘরে বা মনে কোথাও তো আগল নেই। স্বাগতা সবসময়েই স্বাগত। কখন যে ভাল লাগতে শুরু করল স্বাগতা নিজেও জানে না। বেশী ডিমান্ড নেই। মাঝে মাঝে নিজের লেখা দু চারটে লাজুক কবিতা আর অদেখা দুই মানুষের বন্ধুত্বের গল্প বলা ব্যস্‌।

স্বাগতা স্কুলে পরীক্ষায় যতটুকু লাগে ততটুকুর জন্যই পড়েছে নেতাজীর জীবন। তেইশে জানুয়ারী ছুটি পেত বলে নেতাজীর জন্মদিনটা মনে আছে শুধু। আজ সেই বিস্মৃত বীর্যগাথা তাকে নিয়ে যায় রূপকথার দেশে।

স্বরাজ বলেন, পরশপাথর জান তো… লোহা ছুঁলে সোনা হয়। বাবার জীবনে নেতাজী ছিলেন সেই পরশপাথর। বাবা ছিলেন সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। ভাবতেন স্কুল পেরোলেই যথেষ্ট। তারপর বিয়ে থা যা পরপর ঘটে থাকে জীবনে। নেতাজীর টানেই বাবা কটক থেকে কলকাতায় এসে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। তারপর কারওকে না বলে নেতাজীর সঙ্গী হয়ে উধাও হয়েছিলেন। পাহাড় জঙ্গল তীর্থস্থান প্রচুর ঘুরেছেন সেই সময়ে। নেতাজীর ছোঁয়ায় বদল ঘটছিল আস্তে আস্তে।

স্বাগতা জিজ্ঞেস করে, নেতাজীর অত ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাহলে ঠাকুর্দা কেন ফেমাস হননি?

স্বরাজ হেসে বলেন, বাবার বিখ্যাত হবার কোন ইচ্ছেই ছিল না। সেই ক্ষমতাও ছিল না হয়ত। নেতাজীর ছায়া হয়েই সুখ। সামান্য কাজে লাগতে পারলেই ধন্য হয়ে যেতেন। মুখে ডাকতেন সুভাষ বলে কিন্তু সেই স্কুল থেকেই গুরু মেনেছেন দু’মাসের ছোট বন্ধুকে।




সকালবেলা চা দিতে গিয়ে স্বাগতা শুনল, মেথি ভেজানো জল খাচ্ছ তো নিয়ম করে? ওতে শরীর ঠান্ডা রাখে।
তার থেকেই চলে এল বাবা এবং অবধারিত সুভাষ।

এসব বাবার টোটকা। পাহাড় বনজঙ্গল ঘুরে সুভাষের হল টাইফয়েড। বাবা নাওয়া খাওয়া ভুলে ও বাড়িতে। থেকে থেকে মেথির জল, শরবতি লেবুর রস, বই পড়ে শোনানো। সুভাষের বাড়ীর লোকেরাও বলত সুবোধ থাকলে আমরা নিশ্চিন্ত।
গল্প গড়ায় দুপুর থেকে বিকেল। বিকেল থেকে সন্ধে।

শরীরটা বেশ ভারি হয়ে এসেছে বলে স্বাগতা বেশিটা সময় বাড়ী থেকেই কাজ করে। লাঞ্চ ব্রেকে চলে আসে স্বরাজের ঘরে। তিনিও উৎকর্ণ হয়ে থাকেন এই মুহূর্তটার জন্য। এমন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে যে রবিবারও পড়ে গিয়েছে এই ছাঁচে। পরপর দুটো রবিবার ফরগটন আর্মি, নেতাজী, নেহরু, গান্ধী, এই তিনের পলিটিক্সের কচকচি শুনে মুখ বুজে ভাত মাখল শুভাশীষ। তৃতীয় রবিবার সে বলল, তুমি কি বাবার সঙ্গে বসবে?
তোমার কি আপত্তি আছে?
আপত্তি তোমাদের ওই একঘেয়ে গল্পে। বাবা ছিলই পাগল তার ওপর তুমি সাঁকো নাড়াচ্ছ।

স্বাগতা শুভাশীষের ক্ষোভটা আসল না নকল বোঝার চেষ্টা করল। তারপর হালকাভাবে বলল তোমার তো খুশী হবার কথা।

শুভাশীষ খাবার টেবিল থেকে নিজের প্লেটে একসঙ্গে ডাল ভাত মাছ তরকারী তুলে ঘরে নিয়ে এসে টিভিটা চালিয়ে দিয়ে বলল, নিজের দায়িত্বে শ্বশুর সোহাগী হয়েছো, পরে বলতে পারবে না আমি সাবধান করিনি।
সিঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে নামল স্বাগতা। স্বরাজকে ডেকে বলল, বাবা খেতে এসো।
শুভ রেডি?
ও বেরোবে। তাড়া আছে। আগেই খেয়ে নিয়েছে।
শুভর এ সময়ে আরও বেশী করে বাড়ীতে থাকা উচিত।
স্বরাজ খান খুব ধীরে। হাতে গরাস তুলে কথা বলতে বলতে খেতে ভুলে যান। আজ জিজ্ঞেস করলেন তোমাদের নামের তালিকা প্রস্তুত হয়েছে?
মানে?
আজকাল তো শুনি রাম না জন্মাতেই রামায়ন হয়ে যায়।
দু’একটা ভেবেছি-ঠিক পছন্দ হচ্ছে না।
আমারও কিন্তু জন্মের আগে নাম ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কে দিয়েছিল বল তো? স্বরাজের খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়িতে হীরের ঝিকিমিকি।
স্বাগতার এখন আর ভুল হয় না। শিওর শট আনসার, নেতাজী।
দশে দশ, কসের ফাঁকা জায়গাটা পর্যন্ত হাসিতে ভরে ওঠে।

নেতাজী তখন কংগ্রেসের সভাপতি। সারা ভারত জুড়ে নামডাক। কত লোকের আনাগোনা। এলগিন রোডের বাড়ীতে রোজ মিটিং। হরিপুরা অধিবেশনে বাবা নেতাজীর সঙ্গী ছিলেন। পরের বছর ত্রিপুরীতে। বাবা যথারীতি যাবার জন্য প্রস্তুত। মায়ের শরীর ভাল যাচ্ছিল না। নেতাজী বারণ করলেন। বললেন-স্বরাজ আসছে। তার জন্য জমি প্রস্তুত কর।

মা গল্প করতেন, বাবার মন পড়েছিল ত্রিপুরীতে। সারাক্ষণ অস্থির ভাব। তখন তো তোমাদের মত মুঠোফোন মেসেজ এসব ছিল না। গোলমালের আঁচ পাওয়া গিয়েছিল আগেই। তারপর তো ওখানেই কংগ্রেসদল গান্ধী সুভাষের মধ্যে ভাগ হয়ে গেল। বাবা সে সব দিনের কথা বলতেন এমন করে যেন কালই ঘটেছে।

স্বরাজ গল্প করতে ভুলে যান স্বাগতার অবস্থা। বলেন, কখনও যাওনি তো নেতাজীর বাড়ীতে। সোমবার বাদ দিয়ে শুভকে নিয়ে চলে যাও। দেখবে যে ঘরে মিটিং বসত তার সামনে দিয়ে চলে গিয়েছে চমৎকার টানা বারান্দা। বাবা ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতেন। ঘর সবসময় তখনকার ছোট বড় মাঝারী কর্মী নেতায় ভর্তি। সুভাষ চাইতেন বাবাও আলোচনায় যোগ দিক। কিন্তু বাবা ছুতো করে এড়িয়ে গিয়ে বলতেন, এখানেই বেশ আছি। বিড়ি টিড়ি খাবার সুবিধে।

সুভাষ ছাড়া বাবা আর কারওকে নেতা হবার যোগ্যই মনে করেনি কোনওদিন।

এভাবেই স্বাগতার যাতায়াত অতীত থেকে আরও অতীতে। শুধু রবিবারেই সে নেমে আসে কঠিন কঠোর বর্তমানে। অথচ এমন হবার কথা ছিল না। শুভাশীষও প্রশ্রয়ের হাসি নিয়ে শুনতে পারত বাবার কবিতা। দু’চারটে প্রশ্ন করতে পারত বাপ ঠাকুরদার নেতাজী প্রীতি নিয়ে।

পিঠে বালিশ দিয়ে ভারি পেটটাকে ব্যালেন্স করে স্বাগতা স্বরাজের একটা কবিতা কপি করছিল ফেসবুকে। শুভাশীষ ফোন ঘাঁটা বন্ধ করলে পর সে বলল, এই কবিতাটা শোন। বাবা লিখেছেন। শুভাশীষের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য না করেই সে পড়ে যেতে লাগল-

শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে
একশো পঁচিশ বছর ধরে
দিল্লির দিকে আঙুল তুলে
ঘোড়ার উপর উপবিষ্ট নেতাজী
ভাবলেন এবার তাঁর ডান হাতটাকে
একটু বিরাম দেওয়া দরকার।
ভাবামাত্র ডানপাশের লোকগুলি
তাঁর হাতটি দলাই মলাইয়ে ব্যস্ত হয়ে
পড়ল।
বিস্তর টানামানিতে তিনি ডানদিকে হেলে
যেতেই
তাঁর বাঁদিকের লোকগুলি চিৎকার করে উঠল।
যদিও তাঁর বাঁহাতটা ব্যাথা করছিল না
তবুও বাঁহাতি লোকেরা
তাঁর বাঁহাত মালিশ করতে উদ্যত হল।
এ হেন টাগ অফ ওয়ারে
তাঁর প্রিয় ঘোড়াটি যারপরনাই বিচলিত হয়ে
উঁচু বেদীটার থেকে মারল এক লাফ।
মালা হাতে অপেক্ষমান
ডানহাতি ও বাঁহাতি ফিল্ডাররা
এত বড় ক্যাচ লোফার জন্য
মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না।
খুশি হয়ে নেতাজী তাঁর প্রিয় ঘোড়াটির
গলায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
তাঁর মুখে ফুটে উঠল মৃদু হাসি।
তারপর ডান হাত তুলে
বজ্রকণ্ঠে ডাক দিলেন,
দিল্লী চলোওওওওওও-

বন্ধ ঘরের মধ্যে স্বাগতার গলা গমগম করে অশরীরী বাতাসের মত। শুভাশীষ শেষের ‘ও’ ধ্বনিটা চাপা দিয়ে হিসহিস করে উঠল- অনেক সহ্য করেছি আর না।

স্বাগতা এত অবাক যে প্রশ্ন করতেও ভুলে গেল। শুভাশীষ বলল, তুমি কী জানো ঠাকুরদার মৃত্যু হয়েছিল পাগলাগারদে? নেতাজী যে নেই সেটা বিশ্বাসই করত না। কেউ ভুল ভাঙার চেষ্টা করলে ভায়োলেন্ট হয়ে যেত। নেতাজীর ভূত ঠাকুরদাকে মেরেছে। বাবাকেও মারবে। তার সঙ্গে তুমিও যাবে। পাগল না হলে এরকম কবিতা কেউ লেখে আর কেউ সেটা নিয়ে আদিখ্যেতা করে?

শুভাশীষের চোখে আগুন ধকধক করছিল। ঠোঁট বেঁকে যাচ্ছিল যা বলতে পারছে না তার তীব্রতায়।

যত অসম্ভব উদ্ভুটে গল্পে মেতে আছ সকাল থেকে রাত। এতে তোমারও ক্ষতি বাচ্চারও, শুভাশীষ লম্বা লম্বা শ্বাস নেয়।

স্বাগতা দমবন্ধ করে শরীরের সঙ্গে মনটাকেও বশে আনতে চায়। জঠরের এদিক থেকে ওদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে পূর্ণতার দিকে এগোনো এক প্রাণ। স্বাগতা তাকে শোনাতে চায় স্বপ্নে উদ্বেল এক বীর সেনাপতির গল্প। ডালভাত খাওয়া বাঙালির ঘরে জন্মেছিল এইরকম অবিশ্বাস্য এক মানুষ। একরোখা অথচ মরমী যে মানুষটার জীবনকাহিনী শরীরের অভ্যন্তরে ভ্রূণটার মতই তিল তিল করে বেড়ে উঠে ডালপালা মেলেছে তার মনের মধ্যে সেটা কী শুধুই পাগলামি?

স্বাগতাকে বিছানা ছেড়ে উঠতে দেখে শুভাশীষও উঠে পড়ল, তোমার মতলবটা কী বলতো? তুমি কি ভেবেছ নেতাজীর গল্প শুনে শুনে আর একটা নেতাজীর জন্ম দেবে?

ক্ষতি কী? হিমালয়ের কথা ভাবলে অন্তত উইঢিপি দেখার চান্স আছে।

কালই একটা হেস্তনেস্ত করব। হয় তুমি বাপের বাড়ী যাবে নয়ত বাবাকে যেতে হবে কোথাও একটা।

স্বাগতার শরীরের মধ্যে বিকট একটা আলোড়ন ওঠে। দমক সামলাবার চেষ্টায় তার কপাল কুঁচকে যায়। সে কোমরে হাত দিয়ে পেছনে হেলে যায় সামান্য। শুভাশীষ এগিয়ে আসছিল তাকে ধরার জন্য। সে তাড়াতাড়ি শুভাশীষের নাগালের বাইরে যাবার জন্য পিছু হটতেই সাইড টেবিলে ধাক্কা খেয়ে আছাড় খেল প্রবল জোরে। পতনের অভিঘাতে ভেঙে গেল জলাধার। তীক্ষ্ণ একটা ব্যাথা তার তলপেট থেকে ছড়িয়ে পড়ল শরীরের দূর দূর বিন্দুতে।
প্রথমে হালকা গোলাপী তারপর গাঢ় লাল রঙের তরলের ধারাটা গড়িয়ে গিয়ে তার শৌখিন রাজস্থানী কার্পেটকে ছোঁয়া পর্যন্ত তার জ্ঞান ছিল। একদম অন্ধকার হয়ে যাবার আগে ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবনাগুলো তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। হল না। সে এল না। এ পৃথিবী একবার পায় তারে…

কবিতা ঋণ
নির্ঝর মুখোপাধ্যায়

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

3 thoughts on “short-story-olik-kusum

  1. খুব ভালো লিখেছেন । শেষে জীবনানন্দের কোটেশনটি আমার একটি সাম্প্রতিক গল্পে কিছুদিন আগে ব্যবহার করেছিলাম । তবে বিষয়বস্তু ভিন্ন । আরো লিখুন ।

  2. মর্মস্পর্শী সুন্দর লেখা । খুব ভালো লাগলো ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *