অপেক্ষা

অপেক্ষা
মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য
বেনারসের এক আলোয় মোড়া শপিং মলে এক নামী ব্র্যান্ডের ক্লোদিং আউটলেটে এসেছি। পছন্দসই একটা ট্রাউজার হাতে নিয়ে সার দেওয়া কাঠে ঘেরা পুরুষদের ট্রায়ালরুমের প্রথমটায় ঢুকতে যাচ্ছিলাম। ঠিক মুখটায় ধূসর ইউনিফর্ম পরা কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখে থমকে গেলাম। আরে এ তো বৈজুয়া!

বহু বছর বাদে দেখলাম বৈজুয়াকে। পেটানো চেহারা ছিল। সেই স্বাস্থ্য ভেঙে অর্ধেক হয়ে গেছে। কুঁজো হয়ে গেছে বুড়ো মানুষদের মতো। একমাথা চুল উঠে গিয়ে এখন মাথাজোড়া টাক। আঁচ করলাম এই স্টোরে তার কাজ হল কোন কোন পোশাক নিয়ে সম্ভাব্য ক্রেতা ঢুকছে ও বেরোচ্ছে সেদিকে খেয়াল রাখা। পছন্দ না হওয়া হেলাফেলায় রেখে যাওয়া পোশাকগুলি নিয়ে আবার স্টোর সুপারভাইজারকে দেওয়াও তার ডিউটির মধ্যে পড়ে। বৈজুয়া চিনে ফেলল আমাকে। অবাক গলায় বলল, “ডাক্তারবাবু না? বেনারসে কাজে এসেছেন বুঝি?”

আমি মানসিক রোগের ডাক্তার। রাঁচির হাসপাতালে দীর্ঘদিন পোস্টেড ছিলাম। রিটায়ারমেন্টের পর কলকাতায় চলে এসেছি। নিউ আলিপুরে শ্বশুরবাড়ির কাছাকাছি একটা ফ্ল্যাট নিয়ে সেখানেই বসবাস করি। আমার শিকড় ডুয়ার্সের এক মফস্‌সল শহরে। বৈজুয়াও সেখানকার ছেলে। ছোট জায়গায় সবাই সবার মুখ চেনে, আমিও বৈজুয়াকে সেভাবেই চিনতাম। বৈজুয়ার বাবা ব্রিজবিহারি চৌবের ছিল কুয়োর রিং তৈরির ব্যবসা। পরের দিকে ব্রিজবিহারির থ্রম্বসিস হবার পর বৈজুয়ার দুই দাদা সামলাত পৈতৃক ব্যবসাটা। আমাদের ওই তল্লাটে তিন টার্মের এমপি ছিল রাপ্পা চক্রবর্তী। দোর্দণ্ডপ্রতাপ লোক। বৈজুয়া রাপ্পাদার স্নেহচ্ছায়ায় থেকে ঠিকাদারি করত সরকারি অফিসগুলিতে। এমপি-র ডানহাত বলে তাকে ঘাঁটাত না কেউ। যেমন হয়, রাজনৈতিক ক্ষমতার ভরকেন্দ্রর পরিবর্তন হল, রাপ্পাদা ভোটে হেরে গেল সেবার। ক্ষমতা চলে যাওয়ার শোক বেশিদিন নিতে পারল না লোকটা। প্রেশার, সুগার আগেই ছিল, অতিরিক্ত মদ খেয়ে খেয়ে এবার লিভারটাকে পচাল। এতদিনের বিশ্বস্ত সঙ্গীসাথীরা এক এক করে নাম লেখাচ্ছিল অন্য দলে। তবে বৈজুয়া বেইমানি করেনি, ছায়াসঙ্গী হয়ে রাপ্পাদার সঙ্গে ছিল শেষ দিন অবধি। রাপ্পাদা মারা যাওয়ার পর শহর থেকে রাতারাতি গায়েব হয়ে গেল বৈজুয়া। এতকাল বাদে বেনারসে এসে তার সঙ্গে হঠাৎ দেখা।

মানসিক রোগীদের অধিকার নিয়ে কাজ করে যে সংগঠনগুলি তার মধ্যে একটি হল ‘মুক্তি’। প্রতি বছর ৬ আগস্ট এঁদের তত্ত্বাবধানে দেশজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় পথসভা আর নাটক হয়, আর হয় এরওয়াডি ডে উদযাপন। এবার সেই উপলক্ষে বেনারসে আয়োজিত এক সেমিনারে আমাকে ডেকেছেন এঁরা। আমার মতো আরও কিছু ডাক্তারকে আমন্ত্রণ করে এনে বক্তৃতা দেওয়াবার ব্যবস্থা করেছে ‘মুক্তি’। আসলে এরওয়াডি ঘটনা সভ্যতার ইতিহাসে এক কালো দাগ। এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে সেটা সুনিশ্চিত করা আমাদের কর্তব্য। বেনারসে কেন এসেছি সেটাই খুলে বলছিলাম বৈজুয়াকে।
তামিলনাড়ুর এক শহর হল এরওয়াডি। হজরত মহম্মদের এক বংশধর সুলতান সৈয়দ ইব্রাহিম যে দরগাটি এখানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাতে আছে মদিনার পবিত্র মাটি। মানুষ বিশ্বাস করে – শয়তানের প্রভাবে সৃষ্ট অসুখ, বিশেষত মানসিক অসুখ ভাল হয় এই দরগায় দরখাস্ত করলে। এসব কারণে এরওয়াডিতে মনোরোগীদের ভিড় হয়। দরগায় জায়গা হবে না বলে তাদের থাকার জন্য হোম খোলা হয়েছিল একসময়। চিকিৎসা হত দরগার পবিত্র জল আর তেল মালিশ করে। সারা দিন রোগীদের দরগায় গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হত। রাতেও শিকল দিয়ে আটকে রাখা হত বন্ধ ঘরে। ২০০১ সালের ৬ আগস্ট ভোর রাতে এমন একটি হোমে আগুন লেগে ২৮ জন মনোরোগী পুড়ে মারা যান। সারা দেশে তোলপাড় পড়ে যায়। সেই ভয়ংকর ঘটনার পর থেকে ভারতে বহু জায়গায় ‘এরওয়াডি দিবস’ পালন করা হয় প্রতি বছর। কিন্তু এত কিছুর পরও এরওয়াডিতে রোগীর ভিড় কমে না।

আমার কথা মন দিয়ে শুনছিল বৈজুয়া। চোখের নিচে পুরু কালি। হনু বেরিয়ে আছে। সে যে সুখে নেই সেটা বুঝতে গোয়েন্দা হতে হয় না। বলেই ফেললাম বাধ্য হয়ে, “তোমার চেহারাটা এত খারাপ হল কী করে?” বৈজুয়া ম্লানমুখে হাসল, “সকাল দশটা থেকে রাত দশটা এখানে ডিউটি। একটাই শর্ত, বসা যাবে না।” আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, “বসা যাবে না মানে?” বৈজুয়া বলল, “মেরুদণ্ডে কী যেন হয়েছে। গোল হয়ে ফুলে উঠেছে খানিকটা জায়গা। ব্যাথা করে। রাতে ফিরে ঘুমোতে পারি না এত যন্ত্রণা। ডাক্তার কী কী সব পরীক্ষা করতে দিয়েছে। বলে দিয়েছে দাঁড়ানো বন্ধ করতে হবে। কিন্তু সে তো সম্ভব নয়।”
আমার সপ্রশ্ন চাউনি দেখে বৈজুয়া যা বলল তার মর্মার্থ হল, রাপ্পাদার এক ধনী বন্ধু এই স্টোরের মালিক। প্রাক্তন সাংসদ চোখ বোজার আগে ছায়াসঙ্গী বৈজুয়ার জন্য মস্ত একটা উপকার করে গিয়েছিল। রাপ্পাদার সুপারিশেই এই চাকরিটা পেয়েছে বৈজুয়া। কিন্তু এই স্টোর এখন লোক ছাঁটছে সম্প্রতি। সাতদিন, দিনে বারো ঘণ্টা ডিউটি। বৈজুয়ার এখন তাই একটাই অপেক্ষা। লাঞ্চ ব্রেকের। লাঞ্চের জন্য তিরিশ মিনিট আর টি ব্রেকের জন্য পনের মিনিট বরাদ্দ এই স্টোরে। সারাদিন অপেক্ষা করে থাকে সেই মহার্ঘ সময়টুকুর জন্য। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একটুক্ষণ পর পর ঘড়ি দেখা বৈজুয়ার মুদ্রাদোষ হয়ে গেছে।
আমি বললাম, “বারো ঘণ্টার মধ্যে এগারো ঘণ্টা পনের মিনিট দাঁড়িয়ে থাকা যায়? অন্য কোথাও যাচ্ছ না কেন?” বৈজুয়া সিসিটিভির দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকাল। ত্রস্ত স্বরে বলল, “সব ছাঁটাই হচ্ছে জানেন তো। দেশের সর্বত্র এক হাল। আমার এক বন্ধু রায়পুরে এক কনস্ট্রাকশনে কাজ করত। নোটবন্দির পর তার আর কাজ নেই। সে বেচারি গ্রামে ফিরে এসেছে। নিজের এক টুকরো জমিতে চাষবাস করে। আমার সবকিছুই তো আপনি জানেন। আমি ডুয়ার্সে গেলে আমাকে খুন হতে হবে। তাই নিজের বাড়িতেও ফেরার উপায় নেই। এই চাকরিটা চলে গেলে না খেয়ে মরব। সেই ভয়ে মেরুদণ্ডের ব্যাথার কথা কাউকে বলিনি।”
আমি বললাম “বিয়ে করেছ? বৈজুয়া মাথা নেড়ে বলল, নিজেরই চলে না বউকে খাওয়াব কী।” আমি দু’এক মুহূর্ত চুপ থেকে বললাম, “মধুবনিকে মনে পড়ে?” বৈজুয়া আমাকে দেখল একটুক্ষণ। বলল, “ও রাঁচিতে আপনার ট্রিটমেন্টে আছে তাই না?” আমি বললাম, “ছিল এক সময়। এখন আমি রিটায়ার করেছি। কলকাতায় থাকি। তবে আমি তোমাকে বলছি, মধুবনি একদম ভাল হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরে যেতে তার কোনও অসুবিধে নেই। শুধু দু’চারটে ওষুধ খেয়ে যেতে হবে আজীবন। না না তেমন দামি নয়, সস্তার মেডিসিন।”
বৈজুয়া ঘরঘরে গলায় বলল, “এক সময় মৌজমস্তি করে টাকা উড়িয়েছি। এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি টাকার মর্ম কী। ওকে বিয়ে করে এখানে নিয়ে এলে আমি পথে বসব। এই মলের ওপরতলায় চারশো স্কোয়ার ফিট একটা ঘরে আমরা বত্রিশজন থাকি। সকলে এখানেই কাজ করে। টপ ফ্লোর তো, খুব গরম ঘরটায়। সারা ঘরে ফ্যান আছে তিনটে। সারাদিন পরিশ্রম করার পর সকলেই রাতে ফ্যানের নিচে শুতে চায়। তা নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকে। মধুবনিকে এনে তুললে আমি খাব কী ওকেই বা খাওয়াব কী। থাকতেই বা দেব কোথায়?”

বৈজুয়ার ভাষাহীন চোখ দেখতে দেখতে মধুবনির প্রাণোচ্ছল দুটো চোখের কথা মনে পড়ছিল। রাঁচির কেন্দ্রীয় মনশ্চিকিৎসা সংস্থান ছিল আমার কর্মস্থল। সেখানে একদিন এসে ভর্তি হয়েছিল মধুবনি। আমাদের মফস্‌সল শহরে মধুবনি নামে একটা স্বচ্ছতোয়া নদী আছে। সেই নদীর নামে তার নাম। ছিপছিপে চেহারা, পলিমাটির মতো গায়ের রং, বড় বড় চোখ। ছুটিছাটায় বাড়িতে গেলে বৈজুয়ার মোটরসাইকেলের পিলিয়নে তাকে দেখেছি দু’-চারবার। পরে মধুবনির সঙ্গে আলাপ হবার পরে জেনেছি বৈজুয়া দীর্ঘ অধ্যবসায়ের পর ছিপ ফেলে গেঁথেছে পানপাতার মতো মুখের এই মিষ্টি মেয়েটিকে।

মধুবনির বাবা মোহনলাল রাম জুটমিল অফিসের সাবস্টাফ। বাবার আর্থিক অবস্থার জন্য মধুবনি উচ্চমাধ্যমিকের পর পড়াশোনাটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। তার আরও দুটো বোন আছে। সে সকলের ছোট। বৈজুয়া টেনেটুনে মাধ্যমিক পাশ। সে রাপ্পা চক্রবর্তীর চ্যালা, তার মধ্যে গুণ্ডামি করে, নেশাভাঙের দোষও আছে। এমন পাত্রকে জামাই হিসেবে মোহনলালের পছন্দ নয়। তাছাড়া আগের দুই মেয়ের বিয়ে না দিয়ে ছোট মেয়েকে পাত্রস্থ করবে না সে।

আমার মা নেই। ছুটিছাটা পেলে বিপত্নীক বাবার সঙ্গে ক’টা দিন কাটাতে ডুয়ার্সে ফিরি। সেবার বাড়ি এসে সেলুনে গিয়েছিলাম চুল কাটাতে। সেখানে মোহনলালের সঙ্গে দেখা। তার মুখেই শুনলাম রাপ্পাদার মৃত্যুর পর বৈজুয়া গা ঢাকা দিয়েছে। না পালিয়ে তার উপায় ছিল না। খুন হতে হত প্রতিপক্ষ দলের ছেলেদের হাতে। এদিকে বৈজুয়া লা-পাতা হবার পর মধুবনি ভয়ানক মুষড়ে পড়েছে। নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। আচার আচরণ অস্বাভাবিক। স্থানীয় ডাক্তার মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করেছে।

সন্ধের দিকে মেয়েকে আমার কাছে নিয়ে এল মোহনলাল আর তার স্ত্রী। ছোটবেলা থেকেই তার আচার আচরণে একটু অস্বাভাবিকতা ছিল। এই হাসছে খেলছে পরক্ষণেই মুখ শুকনো করে বসে থাকছে। মনখারাপ বলে স্কুলে না গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়েই হয়তো কাটিয়ে দিল দুটো দিন। তার পর আবার সব স্বাভাবিক। বাড়ির লোক কখনও এসবে গা করেনি। চিকিৎসাও করায়নি। কেসস্টাডি শুনে আর পেশেন্টকে দেখে তেমন জটিল কিছু নয়, বাইপোলার ডিসঅর্ডার বলেই মনে হল। মেয়ের ‘বিয়ের আশা নেই’, গজগজ করছিল মোহনলালের স্ত্রী। আমি অভয় দিয়ে বললাম নিয়মিত চিকিৎসা করালে আর দু’-চারটে ওষুধ নিয়মিত খেলেই মধুবনি ভাল থাকবে। মোহনলাল বলল, “তা সম্ভব নয়। পাগলের চিকিৎসা করালে সবাই মেয়েকে পাগল বলবে। মনখারাপ করে চলে গিয়েছিল ওরা।”

ঝাড়ফুঁক করিয়ে লাভ হয়নি। বাধ্য হয়ে একদিন মেয়েকে রাঁচির হাসপাতালে এনে ভর্তি করাল মোহনলাল। আমাদের চিকিৎসায় অল্পদিনের মধ্যেই তার অসুখ সেরে গেল। মোহনলালের ছোটভাই এসে নিয়ে গেল তার ভাইঝিকে। কিন্তু মাসকয়েক বাদে কাকার হাত ধরে আবার ফেরত এল মধুবনি। জানতে পারলাম তাকে এর মধ্যে কোনও ওষুধ খাওয়ানো হয়নি। ডাক্তারও দেখানো হয়নি। ডাক্তার দেখালে কিংবা ওষুধ খাওয়ালে মানুষজন জেনে যাবে সব। আমি হাঁ করে খেটো ধুতি পরা লোকটাকে দেখছিলাম। মানুষের যুক্তি কোন পথ দিয়ে হাঁটে বোঝা মুশকিল। মেয়েটাকে চিকিৎসা করে সুস্থ রাখলে লোকে পাগল বলবে, আর তাকে অসুস্থ হতে দিয়ে, তার ‘পাগলামি’ দুনিয়াকে প্রত্যক্ষ করিয়ে পাগলাগারদে ভর্তি করলে লোকে কিছু বলবে না?

হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী মধুবনির বাড়ির লোক তিন মাসের হাসপাতাল খরচা দিয়ে তাকে ভর্তি করেছিল। সময়ের আগে রোগী সেরে গেলে বা তিন মাস পেরিয়ে গেলে বাড়িতে চিঠি পাঠাতে হয় হাসপাতাল থেকে। সেই চিঠি লেখার দায়িত্ব আমার। মধুবনিকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ফাইলের এটাই তো তোমার বাড়ির ঠিকানা?” মধুবনি ঘাড় কাত করে বলল, “হ্যাঁ।” বললাম, “আমি চিঠি লিখছি তোমার ছুটির জন্য। তবে খবরদার, এবার কিন্তু বাড়ি গিয়ে ওষুধ বন্ধ করবে না।” মধুবনি বিষণ্ণ গলায় বলল, “বাড়ি গেলে তো! আগের বার বাড়ি থেকে বেরোবার সময় বাবা বলে দিয়েছে, অনেক হয়েছে। আর ফেরত নিয়ে যাবে না।” দু’চার সেকেন্ড পজ দিয়ে বলল, “বৈজুয়ার কোনও খবর জানেন? আমি যে এখানে আছি সেটা ও জানে?”
বৈজুয়ার খোঁজ আমি সত্যিই জানি না। মধুবনির কথা শুনে বুকটা ধড়াস করে উঠল। মানসিক হাসপাতালের বহু পরিবার-পরিত্যক্ত মানুষ পড়ে আছে। এই মেয়েটাও কি সেভাবে আজীবন পড়ে থাকবে? আমি বললাম, “নেগেটিভ ভাবনা একদম ভাববে না। এসব কথা বাবা-মা রাগ করেই বলে। দেখো, ঠিক নিয়ে যাবে ওরা এসে।” মধুবনি শক্ত গলায় বলল, “ওরা কেউ আসবে না আমাকে নিতে। বাজি রাখবেন?” আমি বললাম, “বেশ, রাখলাম। তুমি হারলে আমাকে পেট ভরে মিষ্টি খাওয়াতে হবে।” মধুবনি বলল, “আমি জিতলে?” আমি বললাম, “তার সম্ভাবনা নেই। তোমার বাবা আর মা এই এল বলে।”

মুখে যাই বলুক মধুবনি যে আশাহত হয়নি সেটা বুঝলাম ক’দিন পরেই। ওয়ার্ডে ঢোকামাত্র হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এল, “বাবা উত্তর দিয়েছে?” আমি বললাম, “একটু সবুর করো, সবে তো চিঠি গেল এখান থেকে।” একাধিকবার ভর্তি হয়েছে যে রোগীরা তারা নিয়মকানুন জানে। দিন গোনে ডাক্তারের থেকেও বেশি। একদিন মধুবনি বলল, “দেখুন তো ডাক্তারবাবু, আবার চিঠি পাঠানোর সময় হয়েছে না?” ফাইল খুলে দেখি, হ্যাঁ ঠিকই হিসেব করেছে সে।

দ্বিতীয় চিঠি গেল। এই সব ফরমাল চিঠির বয়ান কম্পিউটারে সেভ করা থাকে। শুধু রোগীর নাম আর ঠিকানাটুকু লিখে পূরণ করতে হয়। আর লাগে ডাক্তারের সই। প্রথম চিঠির সময় বয়ান নরম থাকে। দ্বিতীয় চিঠির সময় একটু কড়া। এক সপ্তাহ পর থেকে আবার শুরু হল মধুবনির প্রশ্ন, “জবাব এসেছে ডাক্তারবাবু?” আমি ঘাড় নেড়ে বলি, না। বেচারীর মুখচোখের ঔজ্জ্বল্য কমতে থাকে। প্রশ্নের ধাঁচও বদলায়। ইতস্তত করে মধুবনি বলে, “বৈজুয়ার কোনও খোঁজ নেই, তাই না?” কথাটার উত্তর না শুনেই মধুবনি চলে যায় মুখ ফিরিয়ে।

তৃতীয় চিঠি পাঠালাম এবার। বয়ান আরও খানিকটা উঁচু তারে বাঁধা। ব্যাপারটা কী? পেশেন্টের উন্নতির খবর পাঠানো সত্ত্বেও আসছেন না কেন আপনারা? কারণ জানতে চাইছে হাসপাতাল। এদিকে মধুবনির স্বভাবের পরিবর্তন হয়েছে। সে আর আগের মতো উদগ্রীব হয়ে ছুটে আসে না। শান্ত পায়ে আসে আমার কাছে। যেন জানে কী বলব আমি। তবুও প্রশ্নটা অস্ফুটে করেই ফেলে। আমি নরম করে জানাই যে এখনও ওর বাড়ি থেকে কোনও চিঠি আসেনি। একটু থমকে থেকে রুটিনমাফিক বৈজুয়ার কথা জিজ্ঞেস করে। আমি মাথা নাড়ি। শুকনো মুখে বেচারী ফিরে যায়।

দিন কাটে। মাস যায়। বছর ঘুরতে চলে। নিয়ম হল ছাপানো তিনটে চিঠির উত্তর না এলে ডাক্তার নিজে হাতে লেখা চিঠি লিখতে পারে রোগীর বাড়ির লোককে। আমার চিঠির ততটা ওজন হবে না, এবার যাই বড় ডাক্তারের কাছে। ডক্টর সাক্সেনা ভাল মনের মানুষ। আমার মুখে সব শুনে হিন্দিতে চোখা চোখা দুটো গালি দিয়ে বলেন, “ব্যাটাদের বড্ড বাড় বেড়েছে। দিন তো আমাকে, আমিই লিখছি এবার।” উনি নিজেই হাতে লেখেন চিঠি। পড়েন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। চিঠির বয়ান পছন্দ হয় না। কাটাকুটি করেন। পাতাটা ফেলে দিয়ে আবার চিঠি লেখেন নতুন করে। আমাকে চিঠিটা দিয়ে বলেন, “এনভেলপে ভরে পাঠিয়ে দিন। বাপ বাপ বলে এবার ছুটে আসবে বাড়ির লোক।” আমি মধুবনিকে বলি, “এবার দ্যাখো কী কাণ্ড হয়।”

দু’সপ্তাহ বাদের কথা। ওয়ার্ডে বসে কাজ করছিলাম, আর্দালি রামভজন ছুটতে ছুটতে এসে বলল, “বড়াসাহাব বুলা রাহা হ্যায় আপকো, তুরন্ত যাইয়ে। ভুরুতে ভাঁজ পড়ল আমার। কী ব্যাপার! হাসপাতালের সবচাইতে বড় সাহেব মানে তো ডক্টর চতুর্বেদী। রাশভারী মানুষ। মানুষখেকো বাঘের থেকেও বেশী ভয় পাই আমরা সকলে।” সাধারণত কোন বিরাট মাপের ভুল না করলে তো উনি ডাকেন না। তাঁর আবার কী দরকার পড়ল আমাকে! করিডোর দিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে হাঁটতে হাঁটতে ডক্টর সাক্সেনার সঙ্গে দেখা। উনিও হন্তদন্ত হয়ে ছুটছেন। মুখ ফিরিয়ে বললেন, “কী ব্যাপার তোমারও ডাক পড়েছে নাকি?”

ভয়ে ভয়ে ডিরেক্টরের চেম্বারে ঢুকি আমরা। ডক্টর চতুর্বেদী চশমার ফাঁক দিয়ে দেখলেন আমাদের দুজনকে। তাঁর হাতে একটা কাগজ। মুখ তুলে ইংরেজিতে কেটে কেটে জানতে চান, “মধুবনি আপনার পেশেন্ট?” বললাম, “হ্যাঁ স্যার।” ডক্টর চতুর্বেদী বললেন, “কেমন আছে সে?” আমার পাশ থেকে ডক্টর সাক্সেনা বললেন, “ভাল আছে স্যার। ডিসচার্জের জন্য অপেক্ষা করছে। অনেকগুলো চিঠি গেছে এখান থেকে। বাড়ির লোক টার্ন আপ করছিল না। শেষে আমি নিজেই…।”
ডক্টর সাক্সেনাকে থামিয়ে দিয়ে ডিরেক্টর ধমকে ওঠেন, “এনাফ ইজ এনাফ। আর চিঠি পাঠাতে হবে না।” কথাটা শেষ করে তাঁর হাতের কাগজটা এগিয়ে দেন আমাদের দিকে। উঁকি মারি। কোনও সরকারি চিঠি মনে হচ্ছে। অশোকস্তম্ভ এমবস করা রয়েছে লেটারহেডে। নিঃশব্দে সেই কাগজটায় একবার চোখ বুলিয়ে ডক্টর সাক্সেনা আমার দিকে বাড়িয়ে দেন।

চিঠি পড়ে আমার চক্ষুস্থির। আমাদের মফস্‌সল শহরের নতুন সাংসদ চিঠি লিখেছেন। তাঁর এলাকার অমুক শহরের তমুক পাড়ার বাসিন্দা মোহনলাল রাম একজন নিম্নবিত্ত মানুষ। তাঁর তিন মেয়ের মধ্যে ছোট মেয়ে মধুবনি বদ্ধ উন্মাদ। তাকে রাঁচির হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠালেও তার অসুখ সারেনি। ফিরিয়ে আনার পর আবার পাঠাতে হয়েছে সেখানে। অথচ হাসপাতাল থেকে দুই ডাক্তার মোহনলালকে বার বার মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে লিখছে যে, মেয়ে ভাল হয়ে গেছে, তাকে বাড়ি নিয়ে যান। চিঠির বয়ান দিন দিন কঠিন হতে হতে এখন হ্যারাসমেন্টের পর্যায়ে চলে গেছে।
প্রমাদ গুনলাম। ঢোক গিলে বাকি চিঠিটা পড়লাম কাঁপা হাতে। চিঠির শেষ প্যারায় বলা আছে – এতদ্বারা এই পত্রের নিম্নসাক্ষরকারী এমপি কেন্দ্রীয় মনশ্চিকিৎসা সংস্থানের ডিরেক্টরকে কড়া নির্দেশ দিচ্ছেন, যাতে মধুবনির সজ্জন বাবাকে আর হ্যারাস করা না হয়। তিনি স্বল্পবেতনের চাকরি করেন। মধুবনি ছাড়াও তাঁর দুটি মেয়ে আছে। তাদের বিয়ে দিতে হবে দুঃস্থ মানুষটিকে। মোহনলাল রামের পক্ষে একটি উন্মাদ মেয়েকে বাড়িতে বসিয়ে খাওয়ানো সম্ভব নয়। সাংসদ এই বলে তাঁর বক্তব্য শেষ করেছেনযে, আবার যদি এই হাসপাতাল থেকে কোনও চিঠি মোহনলালের কাছে যায় তবে তিনি তাঁর ক্ষমতাবলে এই হাসপাতালের ডিরেক্টর সমেত দুই ডাক্তারের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন। সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের কাছে নালিশ করে আমাদের তিনজনকে সাসপেন্ড করবেন।

চিঠি পড়া শেষ করে মুখ তুললাম। দেখি ডিরেক্টর সাহেব আমাকে দেখছেন থমথমে মুখে। বললেন, “ক’টা চিঠি গেছে এখান থেকে?” মিনমিন করে বললাম, “তিনটে। প্রথম দুটো চিঠিতে আমি সই করেছি। শেষটা করেছেন ডক্টর সাক্সেনা।” ডক্টর সাক্সেনা তড়িঘড়ি বললেন, “আমি নিয়ম মেনেই সই করেছি স্যার।” ডিরেক্টর বললেন, “আমি বলছি না আপনারা বেআইনি কিছু করেছেন। তবে ফারদার কমিউনিকেশনের আর প্রয়োজন নেই। আমার নির্দেশ, আর একটাও চিঠি এই হাসপাতাল থেকে যাবে না। ইজ ইট ক্লিয়ার?”
ডক্টর সাক্সেনা ঢক করে ঘাড় নাড়েন, “রাইট স্যার।” আমার জন্য অপেক্ষা না করে তিনি সুইং ডোর খুলে বেরিয়ে যান। আমি তাঁকে অনুসরণ করতে যাচ্ছিলাম। দরজা অবধি গিয়েও আবার ফিরে এলাম ওঁর টেবিলের সামনে। মৃদু স্বরে বললাম, “স্যার, একটা অল্পবয়সি মেয়ে, হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছে, বাইপোলার ডিজঅর্ডার হয়েছে। রোজ দশ-পনের টাকার ওষুধ খেলেই ভাল থাকবে। নিডি ফ্যামিলির মেয়ে। প্রয়োজনে চাকরি করে বাবাকে সাহায্য করতে পারবে। শুধু বাড়ির লোককে চিকিৎসাটা চালিয়ে যেতে হবে …।”
আমাকে হাত তুলে নামিয়ে ডিরেক্টর বললেন, “বাড়ির লোককে বোঝাবার আগে এমপি-কে সেটা বোঝাতে হবে। কে বোঝাবে আপনি? নাকি আমাকেই সাজেস্ট করছেন সে দায়িত্ব নিতে?” শ্লথ পায়ে আমি ফিরে আসছিলাম। দরজার কাছাকাছি আসতেই তাঁর গলা পেলাম। বললেন, “রোগীকে এসব কিছু বলার দরকার নেই। ঠিক আছে? এবার আসুন।”

আমার ট্র্যান্সফার অর্ডার বেরোল। এই ঘটনার জেরেই মধুবনির ওয়ার্ডে আমার কাজ করার মেয়াদ শেষ হল এবার। যখন চার্জ হ্যান্ডওভার দিচ্ছি মধুবনি ঘরে এল। স্থির গলায় বলল, “আপনি চলে যাচ্ছেন?” মুখ ফিরিয়ে বলি, “যেতে তো হবেই।” মধুবনি বলল, “আমার বাড়িতে কে চিঠি লিখবে এবার?” আমার জায়গায় যিনি এসেছেন সেই ডক্টর মঙ্গেশকরের কথা বলতে যাচ্ছিলাম। মুখ দিয়ে কথা সরল না।
মধুবনি বলল, “আপনি কিছু বলেন না কেন আজকাল? বাড়ি থেকে কেউ আমাকে নিতে আসবে না তাই না? আচ্ছা ডাক্তারবাবু আপনার তো ডাক খোঁজ আছে। একটা কথা খুলে বলুন তো আমাকে, বৈজুয়ার কোনও খবর পেলেন? আমি চুপ করে থাকি।” মাথা নাড়ি দু’দিকে। মধুবনি বলে, “আমার কথা ফলল কি না? খুব তো আপনি বাজি রেখেছিলেন…।” গলাটা শেষদিকে কেঁপে গেল। মুখ ফিরিয়ে দৌড়ে চলে গেল মধুবনি।

ডক্টর মঙ্গেশকর সবই জেনে গেছেন ইতিমধ্যে। চাপা গলায় বললেন, “আই ওন্ট টেক এনি চান্সেস। মধুবনির ফাইলে ‘সুইসাইড রিস্ক’ কথাটা আজই লিখে দিতে হবে। এমন কেস আমি আগেও ডিল করেছি। কোনও কারণে এর পর পেশেন্ট গলায় দড়ি দিলে দেখবেন কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। যাদের এতদিন হেলদোল ছিল না তারাই কোর্টে নিয়ে গিয়ে আমাদের দাঁড় করাবে। কোর্ট আমাদের সব শুদ্ধু একেবারে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। মানুষের সাইকোলজি বোঝা ভার। বাড়ির যে আত্মীয় পরিজনকে আমরা নিজেরা ছেঁড়া জামার মতো ছুঁড়ে ফেলে দিই অন্যের হাতে তার সামান্য অনাদরও আমরা সহ্য করি না।”

‘জোর করে ভর্তি করা কি রোগীর পক্ষে মঙ্গলজনক?’ এটাই ছিল আজ দুপুরবেলা এরওয়াডি দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সভার আলোচনার বিষয়বস্তু। বক্তারা নানা কথা বলছিলেন। সেই সব কথা শুনতে শুনতে মধুবনির মুখটা বার বার মনে পড়ছিল। সেদিনের পর ডক্টর চতুর্বেদী আমাকে অন্য সেকশনে বদলি করেছিলেন। কিন্তু যতদিন রাঁচির হাসপাতালে চাকরি করেছি ততদিন ফিমেল সেকশনের পাশ দিয়ে কোয়ার্টারে ফেরার সময় হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিতাম। না তাকালেও বুঝতে পারতাম, জাল লাগানো গেটের ওপারে অনেক আশা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে মধুবনি। যদি আমি দাঁড়িয়ে পড়ি, ওর ওয়ার্ডের দিকে হেঁটে যাই, যদি স্মিতমুখে বলি, তৈরি হও তোমার বাবা এসেছে তোমাকে নিতে।

শপিং মল থেকে সদ্য কেনা ট্রাউজারের প্যাকেট হাতে ঝুলিয়ে সটান চলে এসেছি দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে। ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ধীর পায়ে হাঁটছি। ঘাটে এলাম অন্যমনস্ক পা ফেলে। সামনে সারি দিয়ে খালি নৌকো বাঁধা আছে। একটা চবুতরার ওপর বসে পড়লাম। একটু দূরে হরিশ্চন্দ্র ঘাটে শ্মশানের আগুন জ্বলছে। এক গুচ্ছ প্রদীপ ভেসে আসছে গঙ্গার জলে। শ্রাবণ মাস। অল্প অল্প হাওয়া দিচ্ছে। প্রদীপগুলো দেখি জড়ো হয়ে গোলমতো একটা ফর্মেশন তৈরি করেছে। আলোর বৃত্তটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল নশ্বর জীবনের কথা। আমরাও তো ওই অনির্বাণ প্রদীপগুলোর মতোই পুড়ছি। জীবনদহনে দহিত হচ্ছি আর অপেক্ষা করছি একদিন না একদিন নির্বাণ আসবে বলে। অ্যাসাইলামের ভেতরে চাতকপাখির মতো বসে আছে মধুবনি, মুক্তির আশায়। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত বৈজুয়া অপেক্ষায় আছে একটু বসবে বলে। এই অপেক্ষার বুঝি শেষ নেই।

একটা শ্বাস ফেলে উঠে পড়লাম। ফিরে আসছি এবার। হলুদ রঙের বাদাম সরবতে দোকানটা ছাড়ালাম। পাশেই দেওয়ালের মধ্যে আর একটা দোকান। কাচের বাক্স, ভেতরে মিষ্টি আছে। পিতা, প্রপিতামহের ছবিও আছে মালা দেওয়া। তার পাশে স্টেশনারি দোকান। বসে আছেন এক বয়স্কা বাঙালি বিধবা মহিলা। এ সবের পাশ দিয়ে আর একটা অন্ধকার গলি। গলির মুখে হলদে আলো জ্বলছে। দেওয়ালে গেস্ট হাউজের বিজ্ঞাপন। তারযন্ত্রের দোকানে এক মেমসাহেব টুংটুং করছে। মদনপুরার রাস্তা আর গঙ্গার ঘাটগুলোর মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে দোকান, মন্দির। পুরনো বাড়ি ঠাসা সরু গলিটা গমগম করছে এখনও। এক সাহেব বাঁশি বাজাচ্ছে আপনমনে। দুটো ছাগল তার পায়ের কাছে বসে শুনছে। বিশ্বনাথ গলিতে ঢোকার মুখে একটা মিষ্টির দোকানের সামনে ষাঁড় বসে আছে রাজকীয় ভঙ্গিতে। ওই দিকে বাঙালিটোলা। ওর ভেতর শুনেছি সস্তায় থাকার আস্তানা আছে অনেক। থমকে দাঁড়ালাম। বৈজুয়া কি এসব দিকে কোথাও মধুবনিকে নিয়ে থাকতে পারত না?

আমি রাঁচি ছাড়লেও মধুবনি আমাকে ছাড়েনি। তার চোখের দৃষ্টি আমার মনের মধ্যে গেঁথে আছে আজও। এখনও ঘুম ভেঙে যায় মাঝরাতে। অন্ধকার দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকি। এপাশ ওপাশ করি। মনে হয় যেন এক স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকার ঘরে বন্দি হয়ে আছি। দম বন্ধ হয়ে আসে। কেমন অসহায় লাগে। সুযোগের অপেক্ষায় থাকি। ক্ষণিকের জন্য এই অন্ধকূপ থেকে পালাতে চেষ্টা করি। ফিরে আসি আবার। আমি জানি, অপেক্ষা জড়ো করে করে পাহাড় বানিয়ে ফেললেও কোনও লাভ নেই। এ আমার নিজস্ব এরওয়াডি। এই অ্যাসাইলাম থেকে আমার ছুটি হবে না কখনও।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

27 thoughts on “অপেক্ষা

  1. ধন্যবাদ। আমার আপ্লুতি জানবেন।

  2. ভীষণ ভালো লেগেছে এই গল্পটি । আরো ভালো ভালো গল্প পড়ার অপেক্ষায় রইলাম ।

  3. খুব ভাল লাগল গল্পটা। অনেক অনেক অভিনন্দন

  4. মধুবনি আর বৈজুয়া দুজনের অন্তহীন অপেক্ষা গল্পের নামকরণের স্বার্থকতা এনেছে। “এরওয়াডি” র concept টা ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়ে গেল। অ্যাসাইলাম এ সত্যি হয়ত অনেক মানুষ এভাবে ফেরার অপেক্ষায় থাকে। মানসিক রোগের যতটুকু বিশেষণ করা হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে গল্পকার psychological disorder এবং তার therapy নিয়ে রীতিমত পড়াশুনো করেছেন। ভীষণ ভাল লাগল। অন্যরকম একটা গল্প। শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ মৃগাঙ্ক দা।

    1. গল্পটি ভাল লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। অনেক ধন্যবাদ।

  5. খুব সুন্দর, খুব ভালোলাগার মতো একটা গল্প । অনেক অনেক অভিনন্দন মৃগাঙ্ক দা।

    1. অজস্র ধন্যবাদ, মৌমিতা।

  6. অনন্ত অপেক্ষা। প্রেমের আকুতি। অসহায়তা। রোগের জটিলতা। বিচিত্র মানবজীবন। অসাধারণ লেখা। কতো বড়ো জীবনকে এঁকে ফেললেন!

    1. তোমার ভাল লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম, সেমন্তী।

  7. মৃগাঙ্ক বাবু আপনার গল্পের বিষয়বস্তু খুবই ভালো এবং এ সম্বন্ধে আপনার পড়াশোনা এবং আপনার রিসার্চ সত্যিই এক কথায় অনস্বীকার্য । কিন্তু একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি সেটা হল, এত বেশি পারিপার্শ্বিক বিষয়বস্তু আপনি তুলে ধরেছেন সেটাতে গল্পের যে সত্যিকারের ছন্দ সেটা মাঝে মাঝেই ব্যাহত হয়ে যাচ্ছে । এবং গল্পের যে আসল রস সেটা মনের ছবিতে আঁকতে বিশেষ অসুবিধা হচ্ছে । আমি আপনার লেখার একজন নিয়মিত পাঠক এবং আপনার লেখা আমার খুবই প্রীয় । কিন্তু এই কথাটা না বলে পারলাম না । তাই ক্ষমা প্রার্থী ।

    1. দ্বিধাহীন স্পষ্ট মতামত জানাবার জন্য ধন্যবাদ।

  8. সত্যি , এমন একটা বিষয় বস্তু আপনি বেছেছেন যে বিষয়বস্তুর উপর লেখা খুব কমই পাওয়া যায় ।

    তাই, দারুন বললেও কম বলা হবে । আমরা আরো ভালো ভালো লেখা আপনার কাছ থেকে আশা করি, ভবিষ্যতে এরকম আরো লেখা পড়তে চাই আপনার কলম থেকে ।

  9. খুব সুন্দর গল্প । আজকের politically biased society তে আমাদের সবার ই তো LRD অবস্থা ! তাই বৈজুয়া দের ভুল শোধরানোও হয়না, আর মধুবনী দের অপেক্ষাও শেষ হয়না । তাই ডাক্তার বাবুর মতো মানুষরা থাকলেও বড্ড অসহায় । অপারগতা বড্ড পীড়াদায়ক !

  10. অপেক্ষা, গল্প টা পড়ে আমার খুব ভালো লাগলো। যদিও আপনার সব গল্পই আমার ভালো লাগে। এই সাবজেক্টটা নিয়ে আরও লিখুন। মানুষ বড় অসহায় তাই না।

    1. আমার আপ্লুতি জানবেন। ধন্যবাদ অফুরান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *