short-story-pagla-saheber-kuthi

পাগলা সাহেবের কুঠি
মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য


বাংলা ছাড়িয়ে ওড়িশায় ঢুকে পড়েছি। এক্সপ্রেস ট্রেন, অথচ ছুটছে ছ্যাকরা গাড়ির গতিতে। ফ্লাইটের টিকিটের দাম এখন আকাশছোঁয়া। ট্রেনের টিকিটও অমিল। বাধ্য হয়ে নন-এসি কামরায় উঠতে হয়েছে। শ্রাবণ মাস। অসহ্য না হলেও দমচাপা একটা গরম আছে। তবে থেকে থেকে হাওয়া দিচ্ছে বলে তেমন অসুবিধে হচ্ছে না। কিছুদিন আগে বন্যা হয়েছিল এদিকে। ট্রেন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল ক’দিন। সম্প্রতি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। নতুন করে শুরু হয়েছে ট্রেন চলাচল। স্বাভাবিক রুট নয় ঘুরপথ দিয়ে যেতে হচ্ছে ধীরগতিতে। দুলুনিতে চোখটা লেগে এসেছিল। ট্রেনটা দাঁড়িয়ে গেল তখনই। এর আগেও এমন হয়েছে। একটুক্ষণ পর ছেড়েও দিয়েছে। এবার বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেল ট্রেন ছাড়ার নাম নেই। জানলা দিয়ে বাইরে তাকালাম। একেবারে ধানখেতের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়েছে ট্রেনটা।

বারমুডা পরা ষণ্ডাগণ্ডা চেহারার এক হকার সেদ্ধ ডিমের বালতি নিয়ে ‘আন্ডা আন্ডা’ বলে হাঁক দিতে দিতে চলে গেল প্যাসেজ দিয়ে। একজন এল কফি নিয়ে। একটু কফি খাওয়া দরকার। তাহলে ঘুম ঘুম ভাবটা যাবে। নিলাম এক কাপ। কিন্তু চুমুক দিতে গিয়ে মুখ কুঁচকে ফেললাম। কফিটা বিস্বাদ। পাউডার দুধটায় গন্ডগোল আছে। জানলা দিয়ে কাপ সমেত কফি ফেলে দিলাম। নেমে পড়লাম ট্রেন থেকে।

আকাশ মেঘলা। হাওয়া দিচ্ছে মৃদু মৃদু। ট্রেনে যেটুকু গরম লাগছিল বাইরের খোলা হাওয়ায় আর তেমন লাগছে না। আমার মতো আরও অনেকেই নেমেছে। সামনে জবজবে ধানখেত। মাঝখান দিয়ে রাস্তার মতো কিছু একটা গেছে। একটু দূরে বাঁশঝাড়। বর্ষায় ভিজে ঘন সবুজ হয়ে আছে। তার পিছনে একটা নির্জন জঙ্গুলে জায়গা। শ্যাওলা ধরা হাড়জিরজিরে একটা পোড়ো বাড়ির আভাস পাওয়া যাচ্ছে গাছগাছালির ওপাশে। সেই হকার আমার পাশে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলছিল বিজাতীয় ভাষায়। ফোনটা পকেটে গুঁজে ভাঙা হিন্দিতে বলল, নতুন করে জল উঠেছে সামনে। ঘণ্টা দেড়েকের আগে লাইন ক্লিয়ার হবে না। যান না, পাগলা সাহেবের কুঠিটা দেখে আসুন গিয়ে।

– পাগলা সাহেবের কুঠি? হানাবাড়ি গোছের ইটের স্তূপ থেকে চোখ সরালাম। লোকটার দিকে মুখ ফিরিয়ে গলায় বিস্ময় মেশালাম, কে পাগলা সাহেব? কোন জায়গা এটা?

– ঢেংকানাল। দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবটুকুই শুধু দিয়ে সেদ্ধ ডিমের বালতি নিয়ে লোকটা উঠে পড়ল ট্রেনে। আমি ঠায় দাঁড়ানো। ঢেংকানাল আর পাগলা সাহেব – শব্দগুলো জট পাকাচ্ছিল মাথার মধ্যে। ওড়িশার দু-চারটে জায়গায় কাজের সূত্রে গেলেও ঢেংকানালে পা রাখিনি কখনও। এই ট্রেনের রুটও এটা নয়। বন্যার কারণে ঘুরপথে চলছে। কী অদ্ভুত ব্যাপার, ঠিক এখানে এসেই দাঁড়িয়ে পড়তে হল ট্রেনটাকে! এর নামই কি নিয়তি! মনে মনে পৌঁছে যাচ্ছিলাম সেই বৃষ্টিভেজা সন্ধেটার কাছে। এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম বউ-মেয়েকে ড্রপ করতে। ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। পাশে ছিল লালকাকা। শক্ত মনের যে মানুষটাকে জন্ম থেকে দেখে আসছি সেই লালকাকা ভীষণই আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিল সেদিন। কাঁদছিল শব্দ না করে।

বাবার শ্রাদ্ধের কাজ মিটে গিয়েছিল। নিয়মভঙ্গের পরদিন ওরা দুজন চেন্নাই ফিরে গেল। ব্যাংক-ট্যাংকের কাজ সেরে আমি দু’দিন বাদে ফিরব। এয়ারপোর্ট থেকে সরাইডাঙা ফিরছিলাম। বৃষ্টি হচ্ছিল অল্প অল্প। আমি ড্রাইভ করছিলাম। পাশের সিটে লালকাকা। গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনের দিকে দূরমনষ্ক চোখ, ঘনঘন নাক টানছিল, কথা বলছিল ভাঙা গলায়। সরাইডাঙা রাজবাড়ির মুখে কালি লেপে দিয়েছিলেন যিনি সেই স্কট ওয়ালকটের শেষজীবন কেটেছিল ঢেংকানালে। ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াতেন রাস্তায় রাস্তায়। ওড়িশার মাটিতেই আমার প্রপিতামহ কীর্তিনারায়ণের লোকের হাতে খুন হতে হয়েছিল তাঁকে। সেই সাহেবের বদরক্ত বইছে লালকাকার শরীরে। লালকাকা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেছিল, এতে আমার কী দোষ বলো! নিজের জন্মের ওপর কি কারও হাত থাকে? সামনের ভাঙাচোরা ইটের স্তূপটার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, এই পাগলা সাহেব কোনও ভাবে স্কট ওয়ালকট নয়তো?

আমার চেহারা গড় বাঙালির মতো। দেখে কেউ বলবে না আমার শরীরে রাজরক্ত বইছে। কিন্তু সত্যি সত্যিই একটা সময় আমাদের পূর্বপুরুষরা সরাইডাঙা নামে ছোট্ট এক ভূখণ্ডের রাজা ছিলেন। গোলাভরা ধান, দিঘিভরা মাছ, ঘোড়াশালে ঘোড়া, হাতিশালে হাতি, কুলদেবতার আটচালা মন্দির সবই ছিল। আর ছিল রাজবাড়ি। সাতমহলা না হলেও খুব ছোট নয়। তারপর ব্রিটিশরা এল দেশে। আমাদের রাজপাট উৎসন্নে গেল। রাজবাড়িটা জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়ছিল। হেরিটেজ প্রপার্টি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল আগেই। আইনি জটিলতা কাটিয়ে সম্প্রতি সরকারি নোটিস এসেছে। রাজবাড়ির বাসিন্দাদের সরে যেতে বলা হয়েছে অন্যখানে। খবরের কাগজে ছবি সমেত বড় করে বেরিয়েছিল খবরটা। বাবা যত্ন করে রেখে দিয়েছিল পেপারকাটিং। রাজবাড়ির এই গৌরবপ্রাপ্তিতে বাবা খুশি হয়েছিল। পাশাপাশি জন্মভিটে ছেড়ে ফ্ল্যাটের খাঁচায় বাকি জীবন কাটাতে সায় দিচ্ছিল না অবুঝ মন। শেষ হাসি হাসল নিয়তি। প্রস্টেট গ্ল্যান্ডে ক্যানসার ধরা পড়েছিল আগেই। অনেকেই দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে এই রোগ নিয়ে। বাবা পারল না। বাস্তুভিটে থেকেই শ্মশানযাত্রা করল বাবার শবদেহ।

আমি তখন চেন্নাইতে। মৃতদেহ বরফ দিয়ে রাখা, ফুলের ব্যবস্থা করা, মরচুয়ারি ভ্যান জোগাড় করা, পুরোহিত ধরে আনা, তাঁর লিস্ট মিলিয়ে দশকর্ম ভাণ্ডার থেকে শ্মশানের জিনিসপত্র আনা – সব একা হাতে করেছিল লালকাকা। আমি পরদিন ভোরবেলা চলে এসেছিলাম ফ্লাইটে। ইলেকট্রিক চুল্লিতে যখন বাবার দেহ পুড়ছে তখন একটা কাগজে শ্মশানযাত্রীদের নাম লিখছিল লালকাকা। জনা দশেক লোক হবে সাকুল্যে। অথচ একটা সময় এই রাজবাড়িতে কত লোক যে থাকত তার ইয়ত্তা নেই। আত্মীয়স্বজনের আনাগোনা লেগেই থাকত। আশেপাশের গ্রাম থেকে আসা বহু মেধাবী কিন্তু দুঃস্থ ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করত রাজবাড়িতে থেকে। দূরদূরান্ত থেকে আসত প্রজারা। দু-বেলা ভিয়েন চাপত রসুইঘরে। কিন্তু সুখের সময় স্থায়ী হল না বেশিদিন। ব্রিটিশদের সঙ্গে আমাদের অগ্রজরা পেরে উঠল না। আমাদের প্রভাব প্রতিপত্তি কমল। ম্লান হল রাজবাড়ির জৌলুস। শরিকেরা যে যার মতো ছিটকে গেল অন্য ঠিকানায়। আমিও চাকরি নিয়ে চলে এলাম চেন্নাইতে। রাজবাড়ির সদস্য সংখ্যা কমতে কমতে নেমে এল তিনজনে। বাবা, লালকাকা আর মেনকাপিসি।

আমার মা নেই। ছোটবেলাতেই মাকে হারিয়েছি আমি। তবে শান্তশিষ্ট মায়ের চেহারাটা আবছা আবছা মনে আছে। সাদা খোলের সবুজ-পাড় শাড়ি, হাতায় ফুলতোলা সাদাসিধে একটা ব্লাউজ। মায়ের মুখের গড়ন ছিল ডিমের মতো। চুল ছিল খুব। সেই কালো চুলগুলো অযত্ন আর অবহেলায় বাঁধা থাকত প্রকাণ্ড একটা খোঁপায়।

বাবা ছিল অডিটর। একটা নাম করা বিজনেস ফার্মের সঙ্গে যুক্ত। কিছুদিন পর পর অডিট করতে যেত উত্তরবঙ্গের কোনও না কোনও চা বাগানে। বাবা ছিল রীতিমতো সুপুরুষ। ছ-ফিট লম্বা দেহের গড়ন। চৌকো মুখ, বড় বড় চোখ। হাত দুটো অস্বাভাবিক লম্বা, প্রায় হাঁটুর কাছাকাছি নেমে এসেছে। অরণ্যের মাঝখানে দাঁড়ানো কোনও ঋজু গাছের কথা মনে পড়ত বাবাকে দেখে। বাবা শুনেছি প্রাণচঞ্চল মানুষ ছিল, মায়ের মৃত্যুর পর শুকনো খোলসে ঢুকিয়ে নেয় নিজেকে। বাবা শুনেছি দ্বিতীয়বার দ্বার পরিগ্রহ করেনি আমার মুখ চেয়ে। পাহাড়ের এক বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল আমাকে। অডিট করতে বাইরে যেত না আর, ফিরিয়ে দিত সব ক্লায়েন্টদের। বেশিরভাগ সময় শুয়েবসেই থাকত। আমি বাড়ি এলে আমার পড়াশোনা কেমন চলছে জানতে চাইত। ব্যাস, এর বাইরে কথা হত না খুব একটা। লালকাকা ব্যস্ত থাকত রাজনীতি নিয়ে। ছুটিছাটায় বাড়িতে এলে আমার কথা বলার লোক কেউ ছিল না। যা গল্প হত মেনকাপিসির সঙ্গেই হত।

মেনকাপিসি আমাদের জ্ঞাতি। অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল। বউ বাঁজা এই অজুহাতে তার বর দ্বিতীয় বিয়ে করে। স্বামী পরিত্যক্তা আঠারো বছরের কিশোরীটি র ঠাঁই হয় রাজবাড়িতে। সেই থেকে রাজবাড়িতেই আছে। গোল মুখ, পুরু ঠোঁট, গায়ের রং কালো বললে ঠিক বোঝানো যায় না, কুচকুচে কালো লংকা পাকলে যেমন হয় তেমনই এক দ্যুতি মেনকাপিসির মসৃণ চামড়ার তলা থেকে ঠিকরে বেরোয়। মুখে দোক্তা ঠুসে রাখে সর্বক্ষণ, দাঁত মাজে নস্যি দিয়ে। এই বাড়ির ঘর গেরস্থালির কাজ একা হাতে সামলে আসছে বরাবর। আশি ছুঁই ছুঁই বয়সেও ভোরবেলা স্নান সেরে বাগান থেকে ফুল তুলে কুলদেবতার মন্দিরে গিয়ে নিষ্ঠাভরে পুজো দেয় রোজ। আমাকে ভালবাসে পেটের ছেলের মতো। ছোটবেলায় মেনকাপিসির কোল ঘেঁষে শুয়ে কত যে রাজারানি, রাক্ষস খোক্কস আর দত্যিদানোর গল্প শুনেছি তার ইয়ত্তা নেই।

মেনকাপিসি শুচিবায়ুগ্রস্ত মানুষ। এঁটোকাঁটা মানে খুব। আমরা সকলে ডাইনিং হলে গিয়ে খাবার খাই। লালকাকার সেসবের বালাই নেই। বিছানায় পা মুড়ে বসে আয়েশ করে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে জলখাবার খাওয়ার অভ্যেস লালকাকার। মেনকাপিসির বারণ করলেও গা করে না কখনও। একদিন লালকাকার অসতর্ক আঙুলের ফাঁক গলে ঝোলমাখা এক টুকরো আলু পড়ে গিয়েছিল বিছানায়। বেডকভারে লেগে গিয়েছিল হলদে ছোপ। মেনকাপিসি হুলুস্থূল লাগিয়ে দিয়েছিল। লালকাকা সে সময় ঘরে ছিল না। মেনকাপিসি কপাল চাপড়ে বলছিল, এমন নিঘিন্যে লোক জন্মে দেখিনি! হবে না-ই বা কেন, ম্লেচ্ছ রক্ত যার শরীরে বইছে তার কাছ থেকে এর বেশি আর কী আশা করা যায়!

তখন সম্ভবত ক্লাস ফাইভে পড়ি। ম্লেচ্ছ রক্তের ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারিনি। তবে লালকাকার বাবা হরিদাদুর কেচ্ছার গল্পটা মেনকাপিসির সৌজন্যে সেই বয়সেই জানা ছিল। হরিদাদু ছিলেন এই বাড়ির বাজার সরকার। তখন একশোর ওপর পাত পড়ত রাজবাড়িতে। রোজ সকালে কয়েকজন ভৃত্য নিয়ে বাজার যেতেন হরিদাদু। তখন আট থেকে দশ পদ রান্না হত প্রতিদিন, কেজি বিশেক শুধু মাছই আসত এই বাড়িতে। হরিদাদু মুখচোরা গোছের মানুষ। কারও চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেন না। একবার সেই লাজুক মানুষটিই দুঃসাহসিক এক কাণ্ড ঘটিয়ে হৈ চৈ ফেলে দেন। সেবার শীতে কলকাতার ইম্পেরিয়াল সার্কাস এসেছিল শহরে। ভিড় উপচে পড়ত প্রতিটি শোয়ে। হরিদাদু ফিটফাট হয়ে সার্কাস দেখতে যেতেন রোজ। পুনম সিং নামে এক পাঞ্জাবি তরুণী সার্কাসে ঘোড়ার খেলা দেখাত। তলে তলে কী চলছিল কে জানে, এক রাতে হরিদাদু সেই মেয়েটিকে তাঁবু থেকে ইলোপ করে বসেন।

স্থানীয় ছিন্নমস্তার মন্দিরে নিয়ে গিয়ে পুনমের কপালে সিঁদুর ছুঁইয়ে তাকে হরিদাদু নিয়ে আসেন রাজবাড়িতে। কীর্তিনারায়ণ স্তম্ভিত হয়ে যান। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বলেন হরিদাদুকে। সদ্যপরিণীতা স্ত্রীর হাত ধরে এক কাপড়ে রাজবাড়ি ছেড়ে চলে যান হরিদাদু। সেই রাত স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে কাটিয়ে এই শহরেই বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে ওঠে নবদম্পতি। যৎসামান্য পুঁজি ছিল। রাস্তার ওপর খাতাকলমের দোকান দেন হরিদাদু। সেই ব্যবসা জমেনি। বছর গড়াতে না গড়াতেই এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেয় পুনম। পাঞ্জাবি মা আদর করে শিশুটির নাম রাখে ‘লাল’।

সন্তান জন্মাবার পর অপুষ্টিতে ভেঙে পড়ছিল পুনমের শরীর। যক্ষা ধরে। তখন যক্ষার চিকিৎসা বলতে বিশেষ কিছু ছিল না। ধুঁকে ধুঁকে মারা যায় পুনম। স্ত্রীবিয়োগের পর হরিদাদু ভেঙে পড়েছিলেন। কিডনির সমস্যা ধরা পড়ল। ব্লাডপ্রেশার অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল। নাকমুখ দিয়ে রক্ত বেরোত মাঝেমধ্যেই। ডাক্তার দেখানোর ইচ্ছে বা সামর্থ্য কোনওটাই হরিদাদুর ছিল না। মুখে রক্ত তুলে ঘুমের মধ্যেই মারা যান একদিন। সেরিব্রাল থ্রম্বসিস। তখন লোকে বলত সন্ন্যাস রোগ। খবর আসে হেমনলিনীর কানে। তিনি অবোধ শিশুটির জন্য কান্নাকাটি করতে থাকেন। সরাইডাঙার সিংহাসনে তখন কন্দর্পনারায়ণ। মায়ের অনুরোধ ফেলতে পারেননি তিনি। হেমনলিনীর জোরাজুরিতে দু-বছরের শিশুটি রাজবাড়িতে আশ্রয় পায়। সেই থেকে লালকাকা এই বাড়িরই একজন সদস্য।

লালকাকার গায়ের রং রোদে পোড়া। তবে এককালে ফর্সা ছিল আঁচ করা যায়। চুল ছিল ঘন, এখন সব চুল উঠে কপালটা প্রকাণ্ড মাঠ হয়ে গেছে। নাকটা খাটো, চাপা থুতনিতে কাটা দাগের মতো ভাঁজ। মোটা ভুরু, খসখসে চামড়া। ম্যাট্রিকের পর আইএ অবধি পড়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছিল। ঢুকে পড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে। আমাদের একটা পুরনো অস্টিন গাড়ি ছিল। বয়স্ক ড্রাইভার মারা যাবার পর লালকাকাই চালাত সেটা। গাড়িটায় আমরা চাপতাম কম, জনকল্যাণের কাজেই বেশি ব্যবহার হত। এক বর্ষার রাতে লালকাকা দূরের এক গ্রাম থেকে ডেলিভারি কেসের পেশেন্ট আনছিল গাড়িটাতে চাপিয়ে। সামনে চলে আসা রাস্তার একটা কুকুরকে বাঁচাতে গিয়ে ডিভাইডারে ধাক্কা মারে গাড়ি। বাকিদের তেমন চোট না লাগলেও লালকাকার স্পাইনাল কর্ড জখম হয়। প্রাণে বাঁচলেও ড্রাইভিং ছেড়ে দিতে হয় জন্মের মতো। মেনকাপিসি চুপিচুপি আমাকে বলেছিল, সেই দুর্ঘটনার অভিঘাতেই লালকাকা পৌরুষ হারিয়ে ফেলেছিল, বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত সে কারণে।

রাজবাড়িটায় ঘুরে বেড়াতাম অলস দুপুরে। এ ঘর ও ঘর হয়ে একসময় এসে পড়তাম হলঘরটায়। মস্ত এক ঝাড়লণ্ঠন ঝুলত সেই ঘরে। তবে আমাদের সুসময়ের স্মৃতিচিহ্ন সেই ঝাড়লণ্ঠন নয় দেওয়ালে ঝোলানো একটা ছবি আমাকে টানত চুম্বকের মতো। ছবিটার সামনে এলে আমার পা দুটো সেঁটে যেত চকমেলানো মেঝের সঙ্গে। এক রাজকীয় ভোজসভার দৃশ্য। ছবিতে মোট সাতাশটি চরিত্রের মধ্যে চারজনকে শুধু চিনতাম। সিংহাসনে বসা প্রৌঢ কীর্তিনারায়ণ, আমার প্রপিতামহ। পাশে রাজমহিষী হেমনলিনী। অনতিদূরে তাঁদের যুবক পুত্র কন্দর্পনারায়ণ। ডানদিকের কোণে কীর্তিনারায়ণের কন্যা হেমকুসুম। এছাড়া মন্ত্রী সান্ত্রী অমাত্য সভাসদরা রয়েছেন ভোজসভায়। আছেন তাঁদের স্ত্রীরাও। এছাড়াও কয়েকজন মেম আর সাদা চামড়ার সাহেব আছেন ছবিতে। কারও হাতে পানীয়র গ্লাস। কারও হাতে আঙুর। এক সাহেবের হাতে ভর রেখে এক মেম চোখ বুজে এলিয়ে আছেন। সকলের অলক্ষ্যে এক শ্বেতাঙ্গ যুবকের ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছেন এক মেম। তাঁর গোলাপি গাউন লুটিয়ে পড়েছে মেঝেতে।

ছবিটার নাম ‘দ্য রয়্যাল পার্টি’। ছবির নিচে স্কট ওয়ালকট নামে একজনের সই। কালো ফ্রেমে বাঁধানো ছ’ফুট বাই তিন ফুট মাপের পেন্টিংটার বাঁ দিকের কোণে কালো স্যুট পরা এক সাহেব লম্বা পাইপে তামাকের মৌতাতে বুঁদ। নরম হলদে আলোয় স্নান করছে নারী ও পুরুষেরা। উৎসবের মেজাজ সংক্রামিত হয়েছে সকলের মধ্যে। এই উৎসবমুখর পরিবেশ থেকে খানিক তফাতে, একেবারে ডান দিকের কোণে নীল শাড়ি পরা হেমকুসুম নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে। কোঁকড়া চুল কাঁধ অবধি নেমে এসেছে। চোখ দুটো বড় বড়। বাঁশির মতো নাক। পাতলা ঠোঁট। কোমল বিষণ্ণ মুখ। ভোজসভায় উপস্থিত থেকেও সে যেন আলাদা করে নিয়েছে নিজেকে। একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই ছবিটা আমাকে টানতে শুরু করত নিজের ভেতর। কানে ভেসে আসত হাসির হররা, বাজনার শব্দ, নিঃশব্দ সংলাপ।

আমি তখন বারো ক্লাস। পুজোর ছুটিতে এসেছি বাড়িতে। আশ্বিন মাস। আকাশে শিমুল তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ। বাবা গেছে সেলুনে চুলদাড়ি কাটাতে। লালকাকা ঘুম থেকে উঠেই খাওয়া দাওয়া না করেই বেরিয়ে গেছে পার্টির রক্তদান কর্মসূচিতে। লালকাকার ঘরে বিছানার এক কোণে মশারি গুটিয়ে রাখা। মশারি ভাঁজ করতে গিয়ে মেনকাপিসি আবিষ্কার করেছে তাতে একটা ছ্যাঁদা। রাতে লালকাকা বিছানায় শুয়ে সিগারেট খেয়েছে। অসাবধানে সিগারেটের আগুন লেগে গেছে সুতির মশারিতে। নাইলনের মশারি হলে আর দেখতে হত না! আগুন লেগে যেত বাড়িতে। সেদিনও ম্লেচ্ছ রক্তের প্রসঙ্গ তুলে গজগজ করছিল মেনকাপিসি। আমি থাকতে না পেরে বলে ফেলেছিলাম, হরিদাদু তো পাঞ্জাবি মহিলাকে বিয়ে করেছিল, কোনও বিদেশি মহিলাকে তো নয়। তা হলে ম্লেচ্ছ রক্ত বলছ কেন?

মেনকাপিসি থমকাল খানিক। কী যেন ভাবল। ছুরির দাগের মতো দু-তিনটে দাগ পড়ল কপালে। এদিক ওদিক দেখে নিল একবার। চাপা গলায় বলল, তুমি এখন বড় হয়েছ। তোমার সব কিছু জানা উচিত। সঅব। দ্যাখো, রাজবাড়ি থাকলে কেচ্ছার কাহিনিও থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। এই বাড়িরও তেমন কিছু গল্প আছে যা এই বাড়ির সীমানার বাইরে যায়নি কখনও। একবার এক লজ্জার ঘটনা ঘটেছিল এই রাজবাড়িতে। এক ফিরিঙ্গি সাহেব কীর্তিনারায়ণের মেয়ে হেমকুসুমকে ঘোড়ার পিঠে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। চিরুনি তল্লাশি করে খুঁজেও সেই দুশ্চরিত্র সাহেবকে পাওয়া যায়নি।

হেমকুসুম, মানে কন্দর্পনারায়ণের বোন, আমার ঠামি! ছবির ওই নীল শাড়ি পরা ভীরু ভীরু চোখের তরুণী। অসহায় রাগে আমার গা জ্বলে গেল। আমি চোয়াল শক্ত করে বললাম, কেন? অসভ্য লম্পট লোকটাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি কেন?

মেনকাপিসি বলল, সরাইডাঙায় থাকলে তো দুদিনেই খুঁজে পেত। কিন্তু সেই ফিরিঙ্গি সাহেব হেমকুসুমকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল উড়িষ্যায়। তখন তো আর মোবাইল ফোন ছিল না, ফলে খোঁজ পেতে পেতে লেগে গিয়েছিল পাক্কা দু-বছর। তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। হেমকুসুম মারা গেছে এক বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে। কীর্তিনারায়ণের পাইক বরকন্দজরা অবশ্য রেয়াত করেনি, সাহেবকে তার পাপের শাস্তি দিয়ে ছ’মাসের বাচ্চাটাকে নিয়ে এসেছিল রাজবাড়িতে। বাচ্চাটার পরিনাম হয়তো তার বাবার মতোই হত কিন্তু হেমনলিনী দুধের শিশুটাকে আঁকড়ে ধরেন বুকে। একমাত্র মেয়ের নাড়িছেঁড়া ধন, হেমকুসুমের স্মৃতিচিহ্ন, সেই আবেগ থেকে নিষ্পাপ বাচ্চাটা আশ্রয় পায় রাজবাড়িতে। তার নাম রাখা হয় হরিনারায়ণ।

– সরাইডাঙা রাজবংশ নিয়ে লেখা দু-একটা বই পড়েছি। সেখানে এই ঘটনার উল্লেখ আছে বলে তো মনে হয় না।

মেনকাপিসি বলেছিল, কীর্তিনারায়ণের বিশ্বস্ত কয়েকজন লোক আর রাজবাড়ির কিছু সদস্য ছাড়া কেউ এসব জানে না। একজন রাজা নিজের যুদ্ধ জেতার কথা, গৌরবের কথা, কৃতিত্বের কথা মাইনে করা লোকেদের দিয়ে লেখান। হেরোদের ইতিহাস কখনও লেখা হয় না। তাছাড়া পারিবারিক কলঙ্কের কথা কি কেউ ঢাকঢোল পিটিয়ে জানায়?

আমি ফিসফিসিয়ে বলেছিলাম, লালকাকা এই কথাটা জানে?

মেনকাপিসি বলেছিল, এখন এত বড় বাড়িতে জনমনিষ্যি নেই, কিন্তু আগে তো এমন ছিল না। আমি ষাট বাষট্টি বছর আগে এসে দেখেছি লোকজনে গিজগিজ করত এই বাড়ি। বাড়ির ভেতরমহলের লোকেরা সবই জানত। আমি নিজে এই ঘটনাটা শুনেছি অনেক পরে, তোমার মায়ের মুখে। সে সময় এত লোকজন ছিল এই বাড়িতে, কারওর মুখ ফসকে কখনও কিছু বেরিয়ে গিয়ে থাকলে তোমার লালকাকার কানে তা যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।

বাবা আর আমার মধ্যে সেই সখ্য ছিল না যাতে এই বিষয়ে বাবাকে কিছু জিজ্ঞেস করি। লালকাকাকে জিজ্ঞেস করার তো প্রশ্নই নেই। ততদিনে স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে ভিনরাজ্যের এক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছি। সেমেস্টার শেষ করে ক’দিনের জন্য বাড়ি এসেছি, এক দুপুরে ঘুরঘুর করছিলাম হলঘরে। সেই পেন্টিংটার সামনে এসে দাঁড়ালাম অভ্যাসবশত। ছবির বাঁ দিকের কোণে কালো স্যুট পরা সাহেবকে এর আগে অজস্রবার দেখেছি। পাথুরে মুখ। শক্তপোক্ত গড়ন। ঠোঁটে চেপে রাখা পাইপ। এতদিন মনে হত সাহেব আধবোজা চোখে তামাকের মৌতাত নিচ্ছেন। কিন্তু তিনি যে হেমকুসুমের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছেন সেটা সেদিনই প্রথম খেয়াল করলাম। খানিক এগিয়ে এসে ছবির কাচে নাক ঠেকিয়ে দাঁড়ালাম। সাহেব যে তার দিকেই তাকানো সেটা কি বুঝতে পারছে হেমকুসুম?

স্থানীয় শিল্পীদের দিয়ে এই রাজবংশের নারী-পুরুষদের পোর্ট্রেট আঁকানোর চল ছিল সে সময়। হলঘরে টাঙানো আছে ছবিগুলো। সবই গতানুগতিক ছাঁদের ছবি। শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠন বা মুখচোখের গড়ন নিখুঁত নয়। ছবিগুলোও নিষ্প্রাণ। কী যেন নেই। ওয়ালটের আঁকা পেন্টিংটা তেমন নয়। আমি ছবির অআকখ বুঝি না। কিন্তু আমার মতো গোদা দর্শকের চোখেও ‘দ্য রয়্যাল পার্টি’ নামের পেন্টিংটা অনেক বেশি জীবন্ত মনে হত।

স্থানিক ইতিহাস নিয়ে যে বইগুলো আমাদের বাড়িতে আছে তার সবই পড়ে ফেললাম নতুন করে। স্কট ওয়ালকট সম্পর্কে কোনও তথ্য নেই সেখানে। ইন্টারনেট ঘাঁটলাম। সেখানেও কিছু পেলাম না। হেমকুসুম সম্বন্ধেও বিশদে কিছু জানা গেল না। কীর্তিনারায়ণের মেয়ে হেমকুসুম বাপের বাড়িতেই মারা গিয়েছিলেন দুদিনের অজানা জ্বরে, এটুকুই উল্লেখ আছে সেসব বইতে। আর কিছু নয়। অথচ সেদিন এয়ারপোর্ট থেকে ফেরার সময় লালকাকার মুখ থেকে যা শুনলাম তা আপাদমস্তক নাড়িয়ে দিল আমাকে। মেনকাপিসি বহুদিন আগে যা বলেছিল আর সেদিন লালকাকা যা শোনাল, তাতে মনে হল দুজনের বলা গল্পদুটো আসলে জিগ-শ পাজলের দুটো আলাদা খণ্ড। যা জোড়া লাগাতে পারলে খুঁজে পাওয়া যাবে আসল স্কট ওয়ালকটকে।

এয়ারপোর্ট থেকে সেদিন বাড়ি ফিরছিলাম। বৃষ্টি পড়ছিল গুঁড়িগুঁড়ি। আমি ড্রাইভ করছিলাম। পাশে বসা লালকাকার মুখটা বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল সেদিন। রাজবাড়ি আর ক’দিন পরই ভাঙা পড়বে। পুরনো খোলনলচে বদলে তৈরি হবে রয়্যাল প্যালেস। টুরিস্টরা টিকিট কেটে ঝাঁক বেঁধে আসবে রাজবাড়ি দেখতে। রাস্তায় সার দিয়ে বসবে স্ট্রিট ফুডের দোকান। এই শান্ত নির্জন পরিবেশটাই বদলে যাবে। মেনকাপিসির কথা হয়েছে এক রিটায়ার্ড জাজের সঙ্গে। বিশাল একটা বাড়িতে একা থাকেন ডিভোর্সি ভদ্রমহিলা। মেনকাপিসি সেখানে থাকবে। কিন্তু লালকাকা? তার তো তিনকূলে কেউ নেই। এই বয়সে কোথায় যাবে মানুষটা? লালকাকাকে বলেছিলাম, আমাদের বাড়িটা ভাঙা পড়বে, তোমার কি মনখারাপ করছে?

– করবে না? রাজবাড়ির ইটকাঠপাথরের গায়ে লেপ্টে আছে কত স্মৃতি ভেবে দেখেছ? বিল্ডিং ভাঙা পড়লে সেই স্মৃতিগুলোও তো ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে …। রাজবাড়িতে দুষ্প্রাপ্য জিনিসের অভাব নেই। কষ্টিপাথরের বিষ্ণুমূর্তি, স্টাফ করা বাঘের মাথা, ডোকরার গয়না, পানপাত্র, বাহারি মুখোশ, রকমারি অস্ত্রশস্ত্র, কত সব পেন্টিং …। আচ্ছা, হলঘরের সবচাইতে বড় পেন্টিংটার কী হবে? ওটা কি ওরা নিয়ে যাবে?

– নেবে নিশ্চয়ই। আবার ফিরিয়েও দেবে। দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

– দুশ্চিন্তা হবে না? ক্ষুন্ন গলায় কথাটা বলতে বলতেই কাশ উঠল। কাশির দমক থামলে লালকাকা বলল, এককালে তামাকের নেশা ছিল খুব। তার কুফল ভোগ করছি এখন। শরীরের সেই জোর আর নেই। দু-পা হাঁটতে গেলেই হাঁফ ধরে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় কাশতে কাশতে। কখনও কখনও কফের সঙ্গে চাপ চাপ রক্ত ওঠে। যেদিন রক্ত ওঠে সেদিন গায়ে জোর পাই না। বিছানায় পড়ে থাকি মরা মানুষের মতো। আমার বাবা মারা গিয়েছিল মুখে রক্ত তুলে। আমারও তেমনটাই হবে। কী জানো, জন্মের মতো মৃত্যুরও প্রস্তুতি দরকার। তাহলে জরুরি কাজগুলো গুছিয়ে নেওয়া যায়। আমার সময় ঘনিয়ে আসছে। যাওয়ার আগে তোমাকে কয়েকটা কথা না বললেই নয়।

যে কোনও সঙ্কটে বরাবর অবিচল থাকতে দেখেছি লালকাকাকে। সেই শক্ত ধাতুর মানুষটাকে এমন আবেগতাড়িত হতে দেখে অবাক হচ্ছিলাম। জরা আর বার্ধক্য মানুষকে বড় অসহায় করে দেয়। লালকাকা বলল, সরাইডাঙা রাজবংশের ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে আছে স্কট ওয়ালকটের নাম। কিন্তু সেই ইতিহাস গৌরবের নয়, কলঙ্কের। রাজবাড়ির বাইরের লোক সেসব কথা জানে না। তোমার বাবা জানত। মেনকাদিও নিশ্চয়ই জানে। তোমাকে কখনও বলেছে কিছু?

– ওসব প্রসঙ্গ এখন থাক না।

– আমার শরীরের যা অবস্থা তুমি সরাইডাঙা ছেড়ে চলে গেলে তোমার সঙ্গে আর আমার দেখা হবে কি না জানি না। তোমার বাবার বারণ ছিল বলে এতদিন বলিনি, কিন্তু আমার মনে হয় এবার তোমার সবকিছু জানা দরকার। তুমি কি লরেন্স অ্যাটকিনসনের নাম শুনেছ?

– না তো। কে তিনি?

– একজন নামী ইংরেজ চিত্রশিল্পী। গুগলে তাঁর নাম দিয়ে সার্চ করলে তাঁর সম্বন্ধে জানতে পারবে। লন্ডনের এক আর্ট গ্যালারিতে তাঁর ছবির প্রদর্শনী চলছিল। সেখানে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় স্কট ওয়ালকট নামে এক তরুণ আঁকিয়ের। অ্যাটকিনসন তাঁর স্টুডিওতে ডাকেন ছেলেটিকে। কফি খেতে খেতে দুজনের আড্ডা হয় অনেকক্ষণ। অ্যাটকিনসন রং আর রেখা দিয়ে ম্যাজিক ঘটাতে পারতেন। তাঁর ছবি বিক্রি হত চড়া দামে। কিন্তু ওয়ালকটের সম্ভবত সে প্রতিভা ছিল না। তিনি ছবি আঁকতেন সহজ সরল ঢঙে। তাঁর আঁকা ছবি অবিকল ফোটোগ্রাফির মতো। গাছপালা হোক বা মানুষজন, ওয়ালকটের তুলিতে তা ফুটে উঠত আসলের অবিকল নকল হিসেবে।

আমি বললাম, আমি ছবির অআকখ জানি না। কিন্তু আমার মনে হয় এই ধরনের ছবি শিল্পবোদ্ধাদের প্রশংসা আদায় করতে পারে না। কেননা ফোটোগ্রাফি আর চিত্রশিল্প তো এক নয়। বাস্তবের নিখুঁত প্রতিকৃতি আঁকলে তার মধ্যে কোনও রহস্য থাকে না। ফলে তা একবার দেখার পর দ্বিতীয়বার দেখার কোনও আকর্ষণ থাকে না।

– ঠিক তাই। ওয়ালকটের ছবি বিক্রি হত না তেমন। কিন্তু তিনি গরিবের বাড়ির ছেলে। ছবি আঁকা শেখার স্কুলে যাননি কখনও। ছবি আঁকার হাত তাঁর জন্মগত। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে স্বপ্ন দেখতেন একদিন দেশজোড়া নাম হবে। সেই স্বপ্নের সাম্পান বাস্তবের শক্ত ডাঙায় আছড়ে পড়ে। যখন সাফল্য এল না, ওয়ালকট হতাশায় ছেড়ে দিলেন ছবি আঁকা। ইজেল রং তুলি ছুঁড়ে ফেলে দিলেন ডাস্টবিনে। পুড়িয়ে দিলেন ক্যানভাস। মদ ধরলেন। ঘুরে বেড়াতেন রাস্তায় রাস্তায়। রাত কাটাতেন কবরখানাতেও। ওয়ালকটের মা মারা গিয়েছিলেন ছেলের জন্ম দিয়েই। বাবা ট্যাক্সি ড্রাইভার। ওয়ালকটের অ্যাজমা ছিল ছোটবেলায়। পরেও কষ্ট পেতেন হাঁপানিতে। এদিকে গোঁফের রেখা গজাতে না গজাতেই বিয়ে করে বসেছিলেন পানশালার এক নর্তকীকে। এক পুত্রসন্তান জন্মায় তাঁদের। নাম রাখেন হ্যারি। কলেরায় ভুগে হ্যারি মারা যায়। ওয়ালকটের তখন অভাব নিত্যসঙ্গী। ডাক্তার দেখানো তো দূরের কথা ওষুধপত্র কেনারই টাকা নেই। তুমুল ঝগড়া হয়, রেগেমেগে বউ ছেড়ে চলে যায় তাঁকে। ওয়ালকট কবরখানায় ছেলের সমাধি আঁকড়ে পড়ে থাকতেন দিনরাত। অ্যাটকিনসনের কাছে খবর আসে। তাঁর জানাচেনা ছিল উঁচু মহলে। একরকম জোর করে ওয়ালকটকে ভারতগামী জাহাজে তুলে দেন তিনি। ডুয়ার্সের এক চা বাগানে চাকরি নিয়ে আসেন ওয়ালকট। শুরু করেন নতুন জীবন।

আমি রীতিমতো অবাক হয়ে বললাম, তুমি এত কিছু জানলে কোত্থেকে?

– ওয়ালকটের ডায়েরি পড়ে। তাঁর লেখার অভ্যেস ছিল। খাপছাড়া ধরনের লেখা। রেগুলার এন্ট্রি নেই। এই যেমন ধরো টানা লেখা আছে পর পর কয়েকদিন, আবার বহু মাসে কিছু লেখাই হয়নি। সেই ডায়েরি কন্দর্পনারায়ণের কাছে আসে প্রথমে। তাঁর হাত মারফত যায় তোমার বাবার কাছে। দাদা চোখ বোজার আগে ওটা দিয়ে গেছে আমাকে। আমি তোমাকে আজকেই সেই ডায়েরি পড়তে দেব।

– কী লেখা আছে সেই ডায়েরিতে?

– তখন সাহেবদের খুশি রাখার জন্য পার্টি দিতে হত স্থানীয় রাজাদের। সাহেব আর মেমসাহেবদের জন্য থাকত সুরাপানের ব্যবস্থা। রাজবংশের মহিলারাও উপস্থিত থাকতেন সেখানে। এমন এক রাজকীয় ভোজসভায় সরাইডাঙা রাজবাড়িতে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন ওয়ালকট। সেখানে তাঁর চোখ টেনে নেন অষ্টাদশী হেমকুসুম। বহু বছর বাদে ওয়ালকট তুলে নেন রংতুলি। দু-মাস ধরে প্রায় ঘরবন্দি থেকে একটা ছবি আঁকেন তিনি। নাম দেন দ্য রয়্যাল পার্টি। ওয়ালকট নিজেকেও এঁকেছেন এই ছবিতে। বাঁ দিকের কোণে কালো স্যুট পরা এক সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন, ঠোঁটে সরু লম্বা পাইপ, উনিই স্কট ওয়ালকট।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, বলো কী!

লালকাকা বিষণ্ণ হাসল, গোপন ভালবাসার ক্ষেত্রে মানুষের বাইরের মন চায় তার প্রেমের কথা লুকিয়ে রাখতে, কিন্তু তার ভেতরের মন চায় তার প্রেমের কথা সকলে জানুক। ওয়ালকট নিজেকে এই ছবিতে এঁকেছিলেন হয়তো সে কারণে। ছবিটার বিশেষত্ব হল প্রথম দেখায় ওয়ালকটকে মনে হয় তিনি তামাকের আমেজ নিচ্ছেন। খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় তিনি আধবোজা কিন্তু অপলক চোখে তাকিয়ে আছেন হেমকুসুমের দিকে। মানে, তিনি যে হেমকুসুমের প্রেমে মজেছেন তার সূক্ষ্ম ইঙ্গিত দেওয়া রইল ছবিতে। একদিন ওয়ালকট গিয়ে সেই ছবিটা উপহার দিয়ে আসেন কীর্তিনারায়ণকে। সেই ছবি টাঙানো হয় রাজবাড়ির হলঘরে। কয়েক মাস বাদে ওয়ালকট ফের রাজবাড়ি যান। হেমকুসুমকে বিয়ে করার প্রস্তাব রাখেন কীর্তিনারায়ণের কাছে।

– কীর্তিনারায়ণ রাজি হয়েছিলেন?

– একজন হিন্দু রাজা স্বেচ্ছায় একজন শ্বেতাঙ্গকে কন্যাদান করতে পারেন কখনও! কীর্তিনারায়ণ অসম্মত হন। প্রত্যাখ্যাত হয়ে ওয়ালকট মুষড়ে পড়েন। তিনি ইংরেজ বন্ধুদের কাছে গিয়ে তাঁর অভিপ্রায় জানান। কিন্তু ওয়ালকটকে সাহায্য করা মানে কীর্তিনারায়ণের কোপে পড়া। কীর্তিনারায়ণ দুর্বল রাজা ছিলেন না। বড়লাট অবধি তাঁর হাত ছিল। সকলেই ওয়ালকটকে বুঝিয়ে বলেন হেমকুসুমকে ভুলে যেতে। কিন্তু ওয়ালকট দমবার পাত্র নন। হেমকুসুম বিকেলের দিকে ঘোড়ার পিঠে চেপে বেড়াতে যেতেন। একজন সহচরী থাকতেন তাঁর সঙ্গে। হেমকুসুমের যাতায়াতের পথে ওয়ালকট লুকিয়ে থাকতেন বাঁশঝোপের আড়ালে। একদিন সুযোগ জুটে যায়। সেদিন হেমকুসুম সঙ্গিনীর থেকে খানিকটা পিছিয়ে পড়েছিলেন। তক্কে তক্কে ছিলেন ওয়ালকট। হেমকুসুমের ঘোড়ায় তাঁকে জোর করে বসিয়ে পালিয়ে যান তিনি। খবর আসে কীর্তিনারায়ণের কানে। পাঁচকান হলে রাজবংশের সম্মানহানি হবে, তাই রাজবাড়ির পেয়াদা লেঠেলরা বেরিয়ে পড়ে গোপনে। সরাইডাঙা জুড়ে চলতে থাকে খানাতল্লাশি। হেমকুসুমকে নিজের জিপে চাপিয়ে ওয়ালকট বেরিয়ে পড়েন রাতের অন্ধকারে। দুদিন বাদে পৌঁছন ঢেংকানালে। স্থানীয় আদিবাসীদের দিয়ে ডোকরার গয়না তৈরি করাত এক সাহেব কোম্পানি। সেই কোম্পানির একজনের সঙ্গে এক জাহাজে ভারতে এসেছিলেন ওয়ালকট। আলাপ ছিল তখন থেকেই। সেই দেশোয়ালি বন্ধুর সৌজন্যে ম্যানেজারির চাকরিতে ঢুকে পড়েন ওয়ালকট। থাকার ব্যবস্থা হয় একটা কুঠিতে।

– কীর্তিনারায়ণের পাইকরা তাঁকে খুঁজে পায়নি?

– পেয়েছিল। কিন্তু তাতে লেগে গিয়েছিল প্রায় দু-বছর। তার মাস ছয়েক আগে ঢেংকানালের এক প্রসূতি সদনে বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান হেমকুসুম। ইংল্যান্ডের স্যাঁতসেঁতে এক কবরখানায় শুয়ে থাকা তাঁর ছেলের স্মৃতিতে ওয়ালকট নবজাতকের নাম দেন হ্যারি। হেমকুসুম মারা যাওয়ার পর ওয়ালকট ভেঙে পড়েন। অ্যাজমার বাড়াবাড়ি শুরু হয়, ফুসফুসের জটিল রোগ ধরা পড়ে। তখন তাঁর শ্বাস টানতে কষ্ট, পা ফেলতে কষ্ট, একটুতেই হাঁফ ধরে যায়।

– এসব কথা তুমি জানলে কী করে?

– ডায়েরিটা পড়ে। সেখানে ওয়ালকট লিখেছেন হেমকুসুমের সঙ্গে তাঁর ভালবাসা একতরফা ছিল না। একসঙ্গে থাকতে থাকতে হেমকুসুমও ভালবেসে ফেলেছিলেন তাঁর জীবনের প্রথম পুরুষকে। চেয়েছিলেন বিবাহিত জীবনে সুখী হতে। তাঁদের সন্তান দুজনের ভালবাসার ফসল। কিন্তু হেমকুসুম বাঁচলেন না। তাঁর মৃত্যু ওয়ালকটকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল। চাকরি ছেড়ে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াতেন রাস্তায় রাস্তায়। স্নান করতেন না, চুলদাড়ি কাটতেন না, ওজন কমে অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। ছেঁড়া পোশাক পরা ওয়ালকটকে দেখে স্থানীয় ছেলেপুলে বলত পাগলা সাহেব। কীর্তিনারায়ণের পাইকরা যখন আসে তাদের প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ওয়ালকটের ছিল না। তারা ওয়ালকটকে খুন করে, আগুন লাগিয়ে দেয় কুঠিতে। তবে ডায়েরিটা নষ্ট করেনি, বাচ্চাটার সঙ্গে সঙ্গে সেটাও নিয়ে আসে সরাইডাঙায়, কীর্তিনারায়ণের কাছে।

– তার পর?

– কীর্তিনারায়ণের মনে ক্ষীণ আশা ছিল একদিন না একদিন হেমকুসুম ফিরে আসবে। কিন্তু মেয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি বুকে হাত দিয়ে বসে পড়েন মাটিতে। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই মারা যান। এবার সিংহাসনে বসেন কন্দর্পনারায়ণ। ওয়ালকটের আঁকা ছবিটা ফেলে দেওয়া হয়েছিল আস্তাকুড়ে। মায়ের অনুরোধে কন্দর্পনারায়ণ ছবিটা ফের হলঘরের দেওয়ালে টাঙান। অকালমৃতা হেমকুসুমের আর কোনও ছবি রাজবাড়িতে ছিল না বলে। ওয়ালকটের ডায়েরিটা কন্দর্পনারায়ণ পড়েছিলেন কি না বলা মুশকিল, তবে পুড়িয়ে দেননি। রেখে দেন নিজের ঘরের দেরাজে। হেমনলিনীর জোরাজুরিতে বাচ্চাটাকে স্থান দেন রাজবাড়িতে। হ্যারি থেকে নাম বদলে রাখা হয় হরিনারায়ণ। রাজবাড়ির কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রাখা হয় সেই অভিশপ্ত ইতিহাস। লালকাকা এক নাগাড়ে কথা বলতে বলতে থামল। জামার হাতা দিয়ে মুছে নিল চোখের জল।

গাছগাছালির ওপাশে ভাঙাচোরা ইটের স্তূপটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ ধরে। কুঠিটা আমাকে টানছে এক অমোঘ আকর্ষণে। ভূতে ধরা মানুষের মতো সামনের দিকে এগিয়ে এলাম খানিকটা। জায়গাটা ছায়াঢাকা। বাঁশবনটা আরও অন্ধকার। চাপ চাপ সবুজ থরথর করে কাঁপছে চারপাশে। হাঁসের ডাক কানে এল। আশেপাশে বসতি আছে নাকি কে জানে। একটা বাঁকের মুখে পায়ের শব্দ পেলাম মনে হল। আসছে কেউ। লুঙ্গি পরা। খালি গা। সরে দাঁড়ালাম একটু। আমার দিকে ভ্রূক্ষেপ অবধি না করে লোকটা চলে গেল আমার পাশ কাটিয়ে।

জঙ্গল নয় ঝোপঝাড় বেড়ে গেছে অযত্নে। ভাঙা ইটের দেওয়াল দেখতে পাওয়া গেল। দেওয়ালে শ্যাওলা জমে আছে। আর একটু এগোতেই দেখি দেওয়ালে বেশ বড় একটা গর্ত। একটা মানুষ অবধি গলে যেতে পারে সে ফোঁকর দিয়ে। উঁকি দিলাম। পোড়ো একটা বাড়ি। পলেস্তারা খসে পড়েছে। এটা পিছনের দিক। ঢুকে পড়লাম গর্তটা দিয়ে। ছপছপে জলের ওপর দিয়ে হেঁটে বাড়িটার সামনের দিকে পৌঁছলাম। উঠোনে ছ-জোড়া থাম। একটার মাথায় রয়েছে শ্যাওলা ধরা এক পরি। চাতাল থেকে সিঁড়ি ধরে উঠলাম প্রাণহীন বাড়িটার হাট করে খোলা সদর দরজার দিকে। সোঁদা গন্ধ নাকে এল। চোখ চলে গেল সামনের দিকে। চলটা ওঠা মেঝের মধ্যে পড়ে রয়েছে লাল রঙের একটা চিরুনি।

ওদিকে একটা ঘোরানো সিঁড়ি। সিঁড়িটা আমাকে টানতে লাগল। পা টিপে টিপে এগোলাম সামনের দিকে। সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দিয়েই দেখলাম ধুলোর মধ্যে আমার পায়ের ছাপ পড়ছে। বহুদিন কেউ ওঠেনি এই সিঁড়ি দিয়ে। ল্যান্ডিংয়ের পরের অংশটা ভাঙা। খানিকটা ঝুলছে। ঝুঁকি নিয়ে উঠে এলাম দোতলার বারান্দায়। এখান থেকে অনেকটা দূর অবধি দেখা যায়। আকাশে বিদ্যুতের ঝলক দেখতে পেলাম। কিন্তু কোনও শব্দ কানে এল না। হাওয়ার গতি বেড়ে গেছে। ওদিকের সবুজ জঙ্গল প্রবলভাবে মাথা ঝাঁকাতে লাগল সেই খ্যাপাটে হাওয়ায়। কাদের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম।

পেছনদিকটায় একটা দিঘি আছে। সেই জলাশয়ের কিছুটা চোখে আসছে। ওদিক থেকে কাদের নড়াচড়া, কথাবার্তা টের পাচ্ছি। মেয়েলি গলা, হাসাহাসির শব্দ ভেসে আসছে এদিকে। দু-পা পিছিয়ে গেলাম। গ্রামের মেয়েরা হয়তো স্নান করতে নেমেছে দিঘিতে। আমার এখানে থাকা উচিত নয়। এবার ফেরা দরকার। ভাবতে ভাবতেই শব্দটা কাছে এগিয়ে এল। শাড়ি পরা কয়েকজন মেয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে হেঁটে আসছে এদিকে। মেয়েলি ঠাট্টা ইয়ার্কি চলছে বোধ হয়। এদের শাড়ি পরার ধরনটা অন্যরকম। ভয়ে ঘাম দিতে লাগল। এরা যদি আমাকে দেখে ফেলে তাহলে একটা যাচ্ছেতাই কাণ্ড হবে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে নেমে এলাম নিচে।

ভেতরের দেওয়ালগুলোর দশা সুবিধের নয়। যেখানে সেখানে খসে পড়েছে কড়ি-বরগা। জানলা দরজার কাঠ নেই। কোনও আসবাবপত্র নেই। দেওয়ালে যে দু-চার জায়গায় চুন সুরকি আছে সেখানেও সময় তার জলছাপ এঁকে দিয়ে গেছে। এটা লিভিং রুম। আগে ফার্নিচার-টার ছিল নিশ্চয়ই। এখন হু হু শূন্যতা। জানলা দরজার কাঠের মতো সেগুলোও চুরি হয়ে গেছে। দেওয়ালে উঁচিয়ে মরচে ধরা পেরেক। অন্যদিকের দেওয়ালে ঝুলছে কাচহীন একটা ছবির ফ্রেম। কালো ফ্রেমে বাঁধানো একটা পেন্টিং। একসময়ের উজ্জ্বল রং সময়ের আস্তর পড়ে এখন মলিন। আমার রক্ত চলাচল বেড়ে গেল। ছবিতে সাদা গাউন পরা এক তরুণী দাঁড়ানো। মেয়েটির কোঁকড়া চুল কাঁধ অবধি নেমে এসেছে। মেমসাহেবের মতো পোশাক হলেও মেয়েটির মুখের ডৌল বাঙালিদের মতো। এত চেনা লাগছে কেন মেয়েটিকে ? আকাশে মেঘ ডেকে উঠল আচমকা। কেঁপে উঠল আমার বুকের ভেতরটা। ছবির নিচে চোখ গেল। এ তো স্কট ওয়ালকটের সিগনেচার ! আর ঠিক তখনই চারদিক আলোয় আলো হয়ে গেল। প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল একটা। একেবারে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের সামনেটায়।

যখন চোখ খুললাম তখন আমি ট্রেনে বসা। আমার মুখের দিকে উদগ্রীব হয়ে তাকানো সহযাত্রীরা। একজন জলের বোতল এগিয়ে দিল। ঢকঢক করে খানিক জল খেলাম। সকলে বলল আমি নাকি বসে থেকে থেকেই অচেতন হয়ে গিয়েছিলাম। বিভ্রান্ত হয়ে ভাবছিলাম, কী হল এটা? এতক্ষণ যা ঘটতে দেখলাম তার পুরোটাই কি আমার ভ্রম? হ্যালুসিনেশন?

ট্রেন চলতে শুরু করেছে দুলকি চালে। বিকেলটা বড্ড মনখারাপ করা আজ। সেই ষণ্ডাগণ্ডা চেহারার হকার এসেছিল সেদ্ধ ডিমের বালতি নিয়ে। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম পাগলা সাহেবের কুঠির কথা। সে আধভাঙা হিন্দিতে বলেছিল, সে এই লাইনের ট্রেনে হকারি করে। ঢেংকানালেই তার বাড়ি। বাড়ি থেকে স্টেশন যাতায়াতের পথে পাগলা সাহেবের কুঠি পড়ে। রোজই সে দেখে আসছে ভুতুড়ে কুঠিটাকে। দাদু-দিদিমার কাছে সে শুনেছে তার জন্মেরও বহু বছর আগে একদল সৈন্য এসেছিল বাইরে থেকে। পাগলা সাহেবকে শিকারি কুকুরের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছিল লাল উর্দিধারী লোকগুলো। ঢেংকানালে এসে পেয়ে যায় যাকে খুঁজছিল। সাহেবকে গলা কেটে খুন করে পুঁতে দেয়। কুঠিতে ঢুকে দেরাজ আর আলমারি ভেঙে টাকাপয়সা লুঠ করে কুঠিতে আগুন লাগিয়ে দেয় তারা। জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছিল পাগলা সাহেবের কুঠি।

ঠেস দিয়ে বসে ট্রেনের দুলুনির সঙ্গে দুলতে দুলতে সেদিনটার কথা ভাবছিলাম। সেদিন লালকাকার বলা কথাগুলো আমার বুকের ভেতর ঝড় তুলছিল। সেই ঝড় আর উন্মাদনার আঁচ স্তিমিত হয়ে এসেছিল। এখন নতুন করে অদ্ভুত উত্তেজনার মতো আমার রক্তকণাগুলোর ওপর ভেঙে ভেঙে পড়ছিল সেই ঝড়। হঠাৎ শীত লাগার মতো গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। আমার সমগ্র সত্তার মধ্যে দিয়ে কী একটা প্রতিক্রিয়া ঘটে যাচ্ছিল। হেমকুসুম ওয়ালকটের সঙ্গে বছর দেড়েক কাটিয়েছিলেন ঢেংকানালে। কেমন ছিল তাঁদের যৌথ সম্পর্ক?

লালকাকা সেদিন বাড়ি ফিরে আমাকে পড়িয়েছিল রেক্সিনে মোড়া ছেঁড়াখোঁড়া ডায়েরিটা। টানা লেখা আছে কখনও। কখনও বেশ কিছুদিন কোনও লেখা নেই। কোথাও প্রেমাস্পদের উদ্দেশে চার পঙতির প্রেমের পদ্য লিখেছেন ওয়ালকট, কোথাও লিখেছেন বিরহের কথা। বেশ কিছু স্কেচও আছে ডায়েরিতে। ওয়ালকট নিজেকে আঁকেননি কোথাও। তাঁর প্রিয়ারই শুধু স্কেচ এঁকে গেছেন একের পর এক। নানা বিভঙ্গের ছবি। প্রতিটি ছবিতেই ভোরের আলোর মতো হেমকুসুমের মুখে লেগে আছে স্মিত প্রশ্রয়। ওয়ালকট আসলের হুবহু নকল আঁকতেন। তাঁদের দাম্পত্য যে ধীরে ধীরে জমাট বাঁধছিল সেটা আঁচ করা যায়।

ট্রেন লাইনের পাশ দিয়ে চলে গেছে সমান্তরাল নির্জন নিঝুম সড়ক। সার দেওয়া কতগুলো ট্রাক হেডলাইট জ্বালিয়ে যাচ্ছে। ট্রাকগুলোকে দেখতে দেখতে নিজের মনের অতলে ডুবুরি নামাচ্ছিলাম। আমার অবচেতনের ওপর কি গভীর প্রভাব ফেলেছিল ওয়ালকটের ডায়েরিটা? সে কারণেই কি খানিক আগের এই বিভ্রম! স্থির করে নিলাম, খুব শিগগিরি একবার সরাইডাঙা যেতে হবে। লালকাকা বেঁচে থাকতে থাকতেই। বলতে হবে আমার নিয়তি কীভাবে আজ সন্ধ্যায় পাগলা সাহেবের কুঠিতে আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। পুড়ে ঝামা হয়ে যাওয়া সেই কুঠিতে এখন কিছুই অবশিষ্ট নেই আর। ধুলোয় ধূসর একটা প্রাচীনকালের ফ্রেমভাঙা ছবি আছে শুধু। যার নিচে স্কট ওয়ালকটের সই। সেই ছবিতে হেমকুসুম সুখী, পরিতৃপ্ত মুখের এক নারী। কাজেই হরিদাদু যে পৃথিবীতে এসেছিল দুই প্রেমিক প্রেমিকার ভালবাসার স্মৃতিচিহ্ন নিজের ক্রোমোজমে বহন করে তা অনুমান করতে বিশেষ অসুবিধে হয় না।

মিথ্যে? তা হোক। সাদা কালি দিয়ে মিথ্যের ছবি আঁকলে পৃথিবীতে কার কী ক্ষতিবৃদ্ধি হবে? বরং মৃত্যুপথযাত্রী একজন ভালমানুষকে স্বস্তি দেবার জন্য এটুকু তো করাই যায়।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

4 thoughts on “short-story-pagla-saheber-kuthi

  1. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ওপর ভিত্তি করে লেখা টান টান উত্তেজনার এমন একটি ছোট গল্প যার পরতে পরতে রাজবাড়ীর গোপন রহস্যের উন্মোচন যা বিরতিহীন ভাবে গল্পটি পড়তে পাঠককে বাধ্য করে। তার সাথে মন কেমন করে ওঠা সমাপ্তির রেশ থেকে যায় বহুক্ষণ। এক কথায় অসাধারণ !!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *