short-story-parijan

পরিযাণ
শেখর মুখোপাধ্যায়


চারদিকে কলমির বেড়া। শাক নয়। ঢোল কলমি। গুল্মজাতীয় গাছ। প্রায় একমানুষ লম্বা। বড় বড় সবুজ পাতা। বেগুনি রঙের লম্বাটে ফুল। গাছের কিছুই মানুষে তো বটেই, গরু-ছাগলেও খায় না। সরু কাণ্ডগুলি ফাঁপা। দরকারে গরু, ছাগল, মানুষ, সবাইকেই এই দিয়ে ঠেঙানোও চলে। কলমির নমনীয় ডাল প্রথমটা চাবুকের মতো কাজ করে। তারপর পেটাতে পেটাতে ভেঙে যায়।

বেড়া দিয়ে ঘেরা চার কাঠার এককোণে কিছুটা জায়গায় ধীবর পরিবারের বসতবাড়ি। পাশাপাশি দুটি ঘর। একটি ইট-সিমেন্টে পাকা। অন্যটি মাটির, গাড়া গেঁথে তোলা দেওয়াল খরুটি করা। দুটিরই চাল টিনের। পাকা ঘরটি শোয়া-বসায় ব্যবহৃত হয়। মাটিরটি ভাঁড়ার ঘর, চাল-ডাল-নুন-তেলের পাশাপাশি রাখা থাকে বিচিত্র আকৃতির বিভিন্ন বাসনকোসন। কাঁচা-পাকা দুই ঘর মিলিয়ে গড়া বাড়িটির সম্মুখভাগে গোবর মারুলি দেওয়া মেটে দাওয়ায় একদিকে মাটির আখা, অন্যদিকে একটি চারপাই। ধীরেন বাড়ি থাকলে সন্ধেয় চারপাইতে এলিয়ে জিরোয়। দাওয়ার নীচে নিকোনো একচিলতে উঠোন, বড়ি এবং আচার রোদে দিতে কাজে লাগে। উঠোনের দুই প্রান্তে দুটি বাঁশ পুঁতে দড়ি টাঙানো আছে, ধোয়া জামাকাপড় মেলে শুকোনোর জন্য। চার কাঠা জমির বাকিটুকুতে সবজির বাগান। বাগানের একপাশে একটা ঝাঁকড়া সজনে আর একটা পেঁপে গাছও আছে। বংশপরম্পরায় ধীবরদের মাছধরা ছিল পেশা। নদী নালা শুকিয়ে যাচ্ছে। তাতে ইতিউতি চর জাগছে। স্তব্ধ স্রোতস্বিনীর বুক মানুষের বাসস্থান এবং চাষের জমি হয়ে উঠছে। জমিতে ছড়ানো কীটনাশক মিশছে আশপাশের খালবিলে। মাছ মরছে। ধীবরদের জীবিকানির্বাহের মতো মাছ নদী এবং অন্যান্য স্বাভাবিক জলাশয়গুলিতে আজ আর নেই। ধানীজমিতে মাটি কেটে জল ঢুকিয়ে ভেড়ি বানিয়ে মাছচাষের ব্যবসা জমে উঠেছে আজকাল। এসবে জমির সঙ্গেই পুঁজি লাগে। বাহুবলও। এবং, শাসকদলের প্রতি প্রামাণ্য আনুগত্য। ফলে, এলাকার প্রভাবশালীদের ধরাকরাও করতে লাগে। ধীবরদের পুঁজি নেই। বাহুবল বলতে নিজের হাতটি। সে-হাত ভেঙে দেওয়া আদপেই কঠিন নয়। শাসক চিনলেও, তার নিকটবর্তী হওয়ার ক্ষমতা কারই বা আছে এই জাতপাতে শতধাবিভক্ত দেশের অণুজাতের! ধরাকরার এলেমও নেই ভীতু গ্রামীণ ভোটব্যাংকের বেশিরভাগেরই। নিজের সামান্য জমি থাকলে তাতে চাষবাস, অন্যের জমিতে দিন খাটা, হরেক ধান্দা মিলিয়েজুলিয়ে দিনপাত হয়। একান্তই না হলে, অনেকেই কাজের খোঁজে যায় দেশান্তরে।

সন্ধে নামছে। সুভদ্রা আখায় আগুন দিয়ে সতের হাঁড়িতে ভাত বসায়। আজকাল ছেলেমেয়েরা সতের বাসনকোসনকে বলে অ্যালুমিনি। ধীরেন-সুভদ্রার দুটি মেয়ে, একটি ছেলে। বড় মেয়ে বাসন্তীর বিয়ে দিয়েছে তিন বছর আগে। বাসন্তীর বয়স তখন পনেরো বছর। আজ হলে কাজটা মুশকিল হত। ইদানীং গরমেন্টের লোক খুব হুঁশিয়ার। না কি, নাবালিকার বিয়ে দিতে দেবে না। হুঁঃ! মুখ ভ্যাটকায় সুভদ্রা। পনেরো বছর বয়সে নাবালিকা! তেরো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল সুভদ্রার। ষোলতে কোলে বাসন্তী এল। আঠেরোয় পা দিয়েছে বাসন্তী। বলতে নাই, ডাগরডোগর চেহারা। তবু, বিয়ের তিন বছর পরও, মেয়ের কোল খালি। কোথাও কোনও দোষ হল কি! আজকালকার ছেলেমেয়েরা জানেও বাপু অনেক। ফেম্লি পেলান না কীসব! যত আসুটনো ইড্ডিংফিড্ডিং! ছেলেপিলে হবে তো! মন ভারী হয়ে ওঠে সুভদ্রার। চোখ বুজে তখনই বিড়বিড়িয়ে প্রার্থনা জানায়, “দ’য় মা ষষ্ঠী! বিটির আমের মতুন বেটা হোক, সীত্যের মতুন বিটি!” আন্তরিক উদ্বেগ ও প্রার্থনার নিষ্ঠায় নিটোল চেতনায় একই গর্ভে রাম ও সীতার জন্মগ্রহণ অসম্ভব শোনায় না।

বাসন্তী ক্লাস ফোর অবধি পড়েছিল। আরও পড়ার ইচ্ছে ছিল। ইচ্ছেপূরণ হয়নি। তখন ঘরে মেলা কাজ। গরিবের গেরস্থালির ঝঞ্ঝাট তো আছেই, তাতে আবার ছোট দুটো ভাই-বোন। স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে বাড়িতে মাকে সংসার সামলাতে সাহায্য করার প্রয়োজনটা ছিল বেশি জরুরি। তারপর তো বিয়েই হয়ে গেল। মেয়েটা সাজতেগুজতে ভালবাসে। মেলাখেলায় যেতে খুব আনন্দ। বরও পেয়েছে তেমনই উড়নদদ্দ্যা হুঁশমুদল। সাধন ছেল্যা খারাব লয়। কিন্তু, বউয়ের তালে তাল! হয়তো, বউ বিদ্বান বলে। বাসন্তী কেলাস ফোর পাস। সাট্টিফিট আছে। সাধন কেলাস টু। কিছুই নাই। পাশ না ফেল কেউ জানে না। সি যা হোক তা হোক, বউকে লাই দেয়া ভাল লয়। উঁহু! মাথা নাড়ে সুভদ্রা। তাই বলে ধীরেনের মতো হিসেবি হওয়াও ভাল নয়। একটা বাড়তি পয়সাও সুভদ্রার হাতে দেয় না। অবশ্য, হিসেবি বলেই হয়তো মেয়ের বিয়ে দিতে পেরেছে, বাড়ি অর্ধেক পাকা করেছে, মেজ মেয়ে আর ছোট ছেলেটাকে ইস্কুলে পড়াতে পারছে। নাহ্‌, সুভদ্রা মাথা দোলায়, সি মানিষটোও খারাব লয়খো। দোষের মধ্যে অবরেসবরে পচুই টানা স্বভাব। মদ খেঞে যিদিন লিশা মাথাকে চড়ি যেল, সিদিন আর দ্যাখে কে! সুভদ্রার যত দোষ তখন ধীরেনের নজরে পড়ে। প্রথমে কিল-ঘুষি-লাথি। তারপর বেড়ার কলমি ভেঙে প্রহার। সে অবশ্য রোজকার ব্যাপার নয়। ধীরেন বাড়ি থাকে কতদিন! দূর দেশে চাকরি করে। বছরে বড়জোর দু’বার আসে। এক-এক বারে দশ থেকে পনেরো দিনের বেশি থাকতে পায় না। ওই দশ-পনেরো দিনে ধরো যেঞে চার থেকে পাঁচ দিন পচুই গেলে। তারপর ধরো যেঞে দুই থেকে তিন দিন মাথাকে লিশা চড়ি যায়। তাহলে দাঁড়াল, বছরে খুব বেশি হলে, হপ্তা খানেক সুভদ্রাকে ধীরেনের মার খেতে হয়। কমই বলতে হবে! গেরামে আরও ঘরগেরস্থালি আছে তো। কোন বউ ক’দিন বরের পিটুনি খায় সে আর কাউকে বলতে হবে না, সারা গ্রাম জানে। ইসব অ্যাদের অক্তে! বাপদাদারাও দিনান্তে মদের কলসি নিয়ে বসত। তুলনায় ধীরেনকে খুবই সংযত বলতে হয়। আর, জামাইটা তো নিপাট ভদ্রলোক। সাধন মদ ছোঁয় না। বাসন্তী সত্যি ভাগ্যবতী। শুধু একটা ছেলে বিয়োলেই আর চিন্তা থাকে না। দ’য় মা ষষ্ঠী!

সুভদ্রা হাতা দিয়ে ভাতটা কতদূর হয়েছে দেখে নিল। এরপর সবজি বসাবে। বেশি কিছু না। একটু কুমড়ো, সজনে পাতা আর লাল শাক একটু। রান্না হবে রসুন ফোড়ন দিয়ে। রসুন বাদে বাকিগুলো বাড়ির বাগানের। সবজি আরও কিছু ফলেছে ছোট বাগানে। কয়েকটা ঢেঁড়স আর বেগুন। চালের লাগোয়া মাচায় লাউ আর গুটি দুই কুমড়োর জালি। বেশিটাই জমিয়ে রাখছে সুভদ্রা। চালটা নিয়েই একটু চিন্তা। ভাঁড়ারে কমই আছে। ধীরেন আবার বাড়ি ফিরে খুব ভাত ভাত করে। বিদেশে না কি পাকেপ্রকারে আটাটাই বেশি খাওয়া হয়। তাই, বাড়ি এসে ভাত ছাড়া কথা নেই। সুভদ্রা আঁচলে চোখ মোছে। ক’টা দিনই-বা বউয়ের রাঁধা ভাত খেতে পায়! মেরেকেটে বিশ দিন কি এক মাস বছরে। তবে … কপালে ভাঁজ পড়ে সুভদ্রার … এবার ব্যাপার অন্যরকম। শেষে কী হবে বাবা ধরম্‌ই জানে!

ধীরেন চাকরি খুঁজতে গুরুগ্রাম গেল সে প্রায় দশ বছর আগে। এলাকায় কাজ জুটছিল না। অনেক ধান্দাই করেছিল। চাষের মরসুমে অন্যের জমিতে দিনখাটা তো বটেই, সে-কাজ না পেলে বাপ-পিতামহের পেশা স্মরণ করে জাল কাঁধে বেরিয়ে পড়ত। লোকে ডাকলে মাইন্দ্যারি বাগালিও করেছে। কোনওটাতেই পরিবারের সকলের মুখে নিয়মিত দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জোগাড় হল না। ধীরেন সামান্য লেখাপড়া শিখেছিল। বোধহয় মেয়ে বাসন্তীর মতোই কেলাস ফোর পাশ। শেষে, রামপুরহাট শহরে এক ছুতোর মিস্ত্রির কাছে জোগাড়ের কাজ ধরল। রামপুরহাট, ছোট করে রামপুর, স্থানীয় জিভে আমপুর। বছর তিন সেখানে কাজ করে কাঠের কাজ ভালই শিখেছিল। সংসারে তবু টানাটানি, নিত্য অকুলান। কারখানায় মাসে ক’টাই-বা আসবাবের বরাত আসে! মিস্ত্রির অভাব নেই শহরে। কিন্তু, কাজ নেই সবার জন্য। কারখানার যে মালিক সে-ই হেডমিস্ত্রি। তারই রোজগারের ঠিক নেই, ধীরেনকে সে কত মজুরি দেবে! গ্রামে পচুইয়ের আড্ডায় একদিন বন্ধু জগন্নাথ প্রস্তাব দিল, “গুরগাঁও যাবি? ভাল রোজগার হবে।”

জগন্নাথ নিজে গুরুগ্রামে কাজ করে। এক হোটেলে। বলে, ম্যানেজার। বেশভূষায় ফাঁটুস। হাতে টাকা আছে। স্মার্টফোন। কথাবার্তার ধরণই আলাদা। খুব হিন্দি কপচায়। বিপুল আত্মবিশ্বাস। গ্রামের বাড়ি অনেকটাই পাকা করে ফেলেছে। ধীরেন প্রস্তাবটা বিবেচনা করবে বলে বউয়ের সঙ্গে আলোচনা করেছিল। সুভদ্রা তো অকূল পাথারে! গুরগাঁও! “সি কী অটাল অথান্তর জাগা! কুট্‌ক্যে? মুদের ঘুটিঙ্যা থিক্যা কদ্দূর!”

ধীরেনের মনেও ভয় কম নয়। তবু, সাহস দেখিয়ে বলেছিল, “সি দূর আছে, ই পচ্ছিমবঙে লয়খো। জগা হরিয়ানা বুলছে। কম-সি-কম হাজার মাইল তো হব্যেই।”

সুভদ্রা গালে হাত দিয়ে বলেছিল, “থাল্যে, মুনে লাগে অ্যানেক দূর! তাও কদ্দূর বটে?”

“তা ধর”, ধীরেন বুঝিয়েছিল, “ঘুটিঙ্যা থিক্যা আমপুর হল যেঞে পাঁচ মাইল। থাল্যে ধর, ইঠিং থিক্যা দুশোটো আমপুর যথদূর হয় সেই তথটো।”

“সি তো অ্যানেকটো!” বিস্ময়ে সুভদ্রার হাঁ-মুখ বুজতেই চায়নি।

“সি তো অ্যানেকটো!” ধীরেন ভেঙিয়েছিল, “ঘরকে বসি রাহালে মাগি তু খেত্যে দিবি, না তুর বাপ দেবে! সি তো অ্যানেকটো! মুরা মাগি, মরদ, তিনটো বেটা-বিটি। বুল্যে, পাঁচঝুনার খ’ জুটে না। মাগি বুল্যে, সি তো অ্যানেকটো!”

কথা বাড়ায়নি সুভদ্রা। ধীরেনও নিজের ভয়ের কথা বউয়ের কাছে ব্যক্ত করেনি। সব বুকে চেপে রেখে রওনা হয়েছিল জগন্নাথের সঙ্গে। সেদিন কেঁদে ভাসিয়েছিল সুভদ্রা। সামনে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। ঘরে তার সঙ্গে রইল তিনটি সন্তান। ধীরেনের বয়স তখন আঠাশ, সুভদ্রার চব্বিশ। বাসন্তী আট বছরের বালিকা। চঞ্চলা পাঁচ আর ছোট ছেলে দীপকের বয়স তিন। সেই যে গেল, মাসের পর মাস আর কোনও খবর নেই ধীরেনের। জগন্নাথের বাড়ির লোকজন শুধু বলে সবাই না কি ভালই আছে। বয়সে বড়রা বলে, “অদের উট্‌ক্যে অ্যামনপারাই হয়। আইসবে, সুমায় হলিই এসি যাবে দেখিস-সে। আজরপাঁজর করিস নাখো বহু, সবুর কর।”

তারপর সত্যিই ধীরেন ফিরল একদিন। যাওয়ার ছ’মাস পরে। দেখে তো সুভদ্রা মূর্ছা যায়। বাবুর পিরান-পেন্টুলের কী চিকনাই! এখানে সর্বদা পরত লুঙ্গি। এ একেবারে ফিল্মের হিরোর মতো পোশাক। তবে, বাড়ি ফিরেই ধীরেন স্নান সেরে পরল সেই লুঙ্গি। আরামের নিঃশ্বাস ফেলে, তিন সন্তানের হাতেই পয়সা দিয়ে বলল, “যা, পরানের দুকানকে যা কিনবি, কেন-গা। যা ভাগ।”

তিন ছেলেমেয়ে কলরব করে বাড়ি থেকে বেরতেই, ঝটিতি বউকে টেনে ঢুকল ঘরে। দরজা বন্ধ করে সুভদ্রাকে ফেলল মাটির মেঝেয় পাতা কাঁথায়। ঘটনা পরম্পরার দ্রুততায় সুভদ্রা তখন হতবাক। তার চোখ আরও কপালে উঠে গেল যখন দেখল ধীরেন ব্যাগ থেকে স্বচ্ছ রবারের টুপি বের করে নিজের পুরুষাঙ্গে পরল। চোখ পাকিয়ে বলল, “মাগি, আখুন থিক্যা ফেম্লি পেলান। আর আন্ডাগণ্ডা লয়খো, বুইলি?”

বাঙনিষ্পত্তি হয় না সুভদ্রার। সুযোগও ঘটে না। ধীরেন সময় নষ্ট না করে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। তাণ্ডবে বোধ হয় ছ’মাসের অনাদায় সুদে-আসলে তুলে নেবে। সুভদ্রাও সাড়া দিতে থাকে। কর্ষণ ও বর্ষণের অভাব তার শরীরও অনুভব করেছে খরার দীর্ঘ ছ’টা মাসে।

দিন পনেরো পরে ধীরেন গুরুগ্রাম ফিরে যায়। আবার আসে ছ’মাস পরে। ততদিনে সে গুরুগ্রামেই ভ্যাসেকটমি করিয়ে নিয়েছে। বাড়ি ফিরে করালে লোক জানাজানি হত। হয়তো হাসাহাসিও কিছু। সুভদ্রাকে শুধু জানাল। “বুইলি, উই রবাটে সি মজাটোই নাই! তাই …”

দশটা বছর কেটে গিয়েছে তারপর। মাটির বাড়ি অর্ধেক পাকা হয়েছে। চালের টিন বদলেছে। নতুন বাসনকোসন, ঘরগেরস্থালির সরঞ্জাম এসেছে। বাসন্তীর বিয়ে দেওয়া হয়েছে। চঞ্চলা আর দীপক হাইস্কুলে পড়ছে। গ্রামে মান বেড়েছে ধীবর পরিবারের। অনেকেই বড়লোক ভাবে। কষ্টের দিনে সুভদ্রার কাছে এক-দু’টো টাকা কিংবা, চাল-ডালের জন্য হাত পাতে পড়শি বউয়েরা। ধীরেন হিসেব করেই পয়সা দেয় বউয়ের হাতে। তবে সে হিসেবী হলে, সুভদ্রা আরও একটু বেশি হিসেবী। ধীরেনের হিসাব করে দিয়ে যাওয়া টাকা থেকেও সে কিছু বাঁচায়। ফলে, সুভদ্রার নিজেরও এখন কিছু সঞ্চয় আছে। ধীরেন অবশ্য জানে না।

বছর কয়েক আগে মোবাইল ফোন কিনেছে ধীরেন। বোতাম টেপা সস্তা চাইনিজ মাল। পরের বছরই একটা বউকে দিয়ে গেছে। ব্যবহারের কায়দাকানুনও শেখাতে চেয়েছিল, সুভদ্রা শিখে উঠতে পারেনি। তখন ধীরেন বাসন্তীকে শিখিয়ে বলেছিল, “বেটা, মাকে ফোন করিঞ দিবি, ধরিঞ দিবি, হোক?” বউকে বলেছে, “আমু তো ফোন করবই, এবেটি মুন কল্ল্যে তু-ও ফোন করিস, হোক? কথা বেশি বুলিস না তা বলে। প’হা কাটে। বুইলি? তবে, দু-চার খান কথা বুলিস, হোক?”

ধীরেন যখন ফোন করে, বেশি কথা বলে না। কেবল বলে, “ক্যামুন আছিস? বেটাবিটিগোলা ক্যামুন আছে?” আরও দু-চার কাজের কথা বলেই বলে, “হইলছ্যে হইলছ্যে, লে ফোন কাট, কাট!” সুভদ্রা ফোন কাটতে না কাটতে ধীরেনই কেটে দেয়।

বাসন্তীর বিয়ের পর চঞ্চলা আর দীপকের সাহায্যে ফোনাফুনি হয় ধীরেন-সুভদ্রার। গতবছর বাড়ি এসে ধীরেন অবাক হয়ে দেখেছিল, তার মেজ মেয়ে আর ছোট ছেলে মোবাইলের ব্যাপার তার চেয়েও ঢের ভাল বোঝে। গতবছর দ্বিতীয়বার যখন এল, সঙ্গে এনেছিল চঞ্চলার জন্য একটি স্মার্টফোন, সেকেন্ড হ্যান্ড। সুভদ্রা বিরক্ত হয়ে বলেছিল, “ঘরকে একটো তো রইচে। আবার ক্যানে? এদানী প’হা খোব সস্তা মুনে লাগে! যথ পেঙা!”

ধীরেন আলতো ধমক দিয়েছিল, “চোপ মাগি! ঘর থিক্যা আথ দূরে পড়ি রইচি কীসের লেগ্যে? তু শালি দেখিছিস কী! দীপকের লেগ্যেও একটো আমুন হ্যান্সেট লিঞ আইসব্য দেখিস-সে।”

“মরণ! গিদ্যার!” গজগজ করতে করতে বাগানে শাক তুলতে গিয়েছিল সুভদ্রা। ধীরেন ফিকফিকিয়ে হাসতে হাসতে স্বগতোক্তি করেছিল, “মাগিকে খেপিঞ জোর মজা! রাগে চালভাজার মতুন কটকটিঞে ফুটতে লাগে!”

তিন বছর আগে বাসন্তীর বিয়ে দেওয়া হল চালশ্যা গ্রামের সাধন গোঁড়ের সঙ্গে। বাসন্তী পনেরো বছরের কিশোরী, সাধন আঠেরো বছরের কিশোর। ঘরদোর দেখেই সম্বন্ধ করা হয়েছিল। গোঁড়রাও ধীবরদের মতোই জেলে কৈবর্ত। তাদেরও প্রাচীন পেশা মাছধরা। সাধনের বাপের কিছু জমিজমাও ছিল। সেই দেখেই বিয়ে দিয়েছিল ধীরেন। কিন্তু, হিসাবটা ঠিক দূরদর্শী দাঁড়ায়নি। সাধনের দুটি পিঠোপিঠি বোন। তাদের বিয়ে দিতে গিয়ে ধীরেনের বেয়াইমশায় পড়লেন অথৈ জলে। এককালে জেলে কৈবর্তদের মধ্যে বরপণের চল ছিল না। বরং, কন্যাপণের প্রথা ছিল। কিন্তু, বহুদিনই হল দ্বিতীয়টি ঘুচে গিয়ে প্রথমটি প্রবল পরাক্রমে চালু হয়েছে। সাধন নিজেও বরপণ নিয়েছিল। এখন মেয়েদের বিয়ে দিতে গিয়ে, পাত্রপক্ষের দাবী মেটাতে জমি প্রায় সবটাই বিক্রি করতে হল সাধনের বাপকে। জমি যাওয়াতে সাধনকে তার বাপের সঙ্গেই হতে হল দিনমজুর। তাদের অবস্থা দাঁড়াল গুরুগ্রাম যাওয়ার আগের ধীরেনের মতোই।

গত বছর ধীরেন গুরুগ্রাম থেকে ছুটিতে এলে, সাধন তাকে ধরে পড়ল, “আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলো। এখানে কাজ জোটে না। নিজে খেতে পাই না। বাপ, মা, বউকেও খেতে দিতে পারি না।” বাসন্তীও ধরল সুভদ্রাকে। সুভদ্রা মেয়ে-জামাইয়ের হয়ে ধরল ধীরেনকে। ধীরেন অবশেষে সাধনের সঙ্গে নির্জন মাঠের ধারে বৈঠকে বসল। বিড়ি ধরিয়ে বলল, “জামাই, তুরা যেমুনটো ভাবিস, গুরগাঁওয়ে জেবন ধর যেঞে তেমুনটো আসান লয়খো। ইঠিঞে খানিক-আধেক বাবুগিরি ফলাই বটে, লুকে বুলে বিদ্যাশে কাম করে, প’হা কামায়, ইসব শুনতে ভাল, কিন্তু সিটোর লেগ্যে উঠিঞে কী লতিজ্যে মানতে হয়, কী খিচিবিচি লিঞে বাস করি, মালিকের গাল খাই, তবু রা-টি কাড়ি না, সব মেনে থুয়ে আঁতগুমুরি কাম করি, তুরা বুইবি নাখো।”

সাধন বলল, “বুইব না ক্যান! তুমো যদি পার, আম্মো পারব।” বোঝাল যে, লাঞ্ছনা যেমনই হোক মেনে নেবে, যাবতীয় ঝঞ্ঝাটের সঙ্গে মানিয়ে নেবে, মালিকের গালি খাবে, প্রতিবাদ করবে না, সে-ও বুকের মধ্যে সব যন্ত্রণা চেপে কাজ করবে।

ধীরেন অবশেষে বলল, “জিদ করছিস, আচ্ছা, চল থাল্যে। কিন্তু, উট্‌ক্যার ব্যাপার ইট্‌ক্যে কখুনও বুলতে পাবি না। বাসন্তীকেও বুলবি না। কেহুকে বুলবি না খো।”

“বুলব না।”

“মাকালীর কির‍্যা?”

“মাকালীর কির‍্যা।”

সাধন ধীরেনের শর্তে রাজি হল। শ্বশুর আর জামাই একসঙ্গে গেল গুরুগ্রাম।

সাধন জায়গাটা দেখে থ। অসংখ্য বহুতল বাড়ি। নির্মীয়মানও বহু। বড় বড় কোম্পানির অফিস, কারখানা। তার আশপাশেই গোঁজা অসংখ্য বস্তি। এমনই একটি বস্তিতে এক ঝুপড়িতে বাস ধীরেনের। আরও কয়েক জন থাকে সেই ঝুপড়িতে। স্থানীয়রা বলে ঝুগ্‌গি। ধীরেনের ঝুগ্‌গির সকলেই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। অবশ্য, জীবিকা সকলের এক নয়। বস্তির পরিবেশ নোংরা। হাওয়াতেও দুর্গন্ধ। প্রথমটা সাধনের গা গুলিয়ে উঠত। দশ বছর আগে একই অনুভূতি ধীরেনেরও হয়েছিল। সেদিন সঙ্গে ছিল বন্ধু জগন্নাথ। আর, আজ সাধনের সঙ্গে আছে তার শ্বশুর। প্রাথমিক সহায়তা এবং সহানুভূতি হয়তো সে একটু বেশি পাবে। ধীরেনের জামাই বলে ঝুগ্‌গির সকলেই সাধনকে জামাই ডাকে। গুরুগ্রামের বস্তিজীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে নিতে সেখানকার আরও এক উপদ্রবের সঙ্গে পরিচিত হল সে। মাঝেমধ্যেই বস্তিতে পুলিস হানা দেয়। ঝুগ্‌গি থেকে টেনে বের করে বাসিন্দাদের। কখনওসখনও উদোম ঠেঙায়। পরিচয়পত্র দেখতে চায়। বেশি করে খাপ্পা ওরা বাঙালিদের উপর। বাঙালি বুঝলেই তদন্ত আরও কড়া হয়। বাঙালি মানেই এদের কাছে বাংলাদেশী। যেন পশ্চিমবঙ্গ নামে এদেশের কোনও রাজ্যের নাম পুলিসগুলো বাপের জন্মে শোনেনি। তাই বস্তির বাঙালিদের কাগজপত্র বেশি রাখতে হয়, ঘুষের হারও তাদের ক্ষেত্রে একটু চড়া ধার্য হয়। অনেক চেষ্টা করে বোঝাতে হয় যে, তারা অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশী নয়।

ধীরেন এখানেও আসবাব কারখানায় জোগাড়ে হিসাবেই কাজ শুরু করেছিল। গত দশ বছরে পদোন্নতি হতে হতে সে হয়ে দাঁড়িয়েছে কারখানার একজন নির্ভরযোগ্য দক্ষ মিস্ত্রি। কপাল ভাল থাকলে, আরও কয়েক বছর পরে হয়তো একেবারে হেডমিস্ত্রি না হলেও, তার দু-এক ধাপ নীচের গুরুত্বপূর্ণ কর্মচারী হতে পারবে। কাজের লোকের প্রয়োজন এখানে আছে। কিন্তু, সাধন কাঠের কাজ জানে না। এখানে কারখানায় আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারটাও বেশি। সে সব শিখতে সময় লাগবে। আপাতত জোগাড়ের কাজ পেলেও পেতে পারে। ধীরেন দিন কয়েক হেডমিস্ত্রিকে জপাল। হেডমিস্ত্রি সুপারিশ করলেন মালিকের কাছে। সাধন কাজ পেল। তবে, শর্তানুযায়ী, তার সাপ্তাহিক রোজগারের পাঁচ শতাংশ হেডমিস্ত্রিকে দিতে হবে। কতদিন সে বলা মুশকিল। ধীরেনকে এই কমিশন দিতে হয়েছিল বছর দুই। সাধন দেখল, হেডমিস্ত্রিকে দিয়েও হাতে যা থাকে তার অর্ধেকও সে জন্মভূমিতে রোজগার করতে পারত না। গুরগাঁওয়ের জীবনে দ্রুত মানিয়ে নিল সাধন।

এখানেও ধীরেন মাঝেমধ্যে মদ্যপান করে। দেশি ঠার্‌রা। আসরে যোগ দেয় জগন্নাথ। সাধন অবাক হয়ে দেখে। একদিন সে জিজ্ঞেস করল, “জগাখুড়্যোও ঠার্‌রা খায়?”

“ক্যানে, খাবে না ক্যানে?” জড়ানো গলায় কৈফিয়ত দাবী করে ধীরেন, “তু খাস না বুলে কি জগাও খাবে না!”

“না, তা লয়”, সাধন বোঝায়, “ঠার্‌রা বুলে বুলছি। জগাখুড়্যো তো হুটেলের ম্যানিজার।”

“বটে! কুন হুটেলের ম্যানিজার?”

“সি আমু কী জেনি! গেরামে তো লুকে বুলত, উ হুটেলের ম্যানিজার।”

“বুলত! তা হব্যে”, অট্টহাস্য করে ধীরেন। হাসি থামতে বলে, “শালোর বেটা শালো জগা যদি হুটেলের ম্যানিজার হয় আম্মো থাল্যে হাইকোটের জজ!” আবার অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে সে।

সাধন জানতে পারে জগন্নাথ হোটেলের বেল বয়। “তবে, মাইনে যা বটে, তাবাদে উপরিও খারাব লয় খো”, ধীরেন আঙুলে টাকা বাজানোর ইঙ্গিত করে, “টিপ! কামায় ভালুই।”

কিছুদিন আগে ধীরেন সুভদ্রাকে জানিয়েছে মোবাইল কিনেছে সাধন। পয়সা জমাচ্ছে, বউয়ের জন্যও একটা কিনবে। “আবার মুবাইল!” সুভদ্রা বিরক্ত হয়েছিল, “জামাইকে বলো-গা প’হা ক’টা জুগিঞ রাইখত্যে। সোমসারেও তো সুসার চাই। মুবাইল কিনে প’হাগোলা লষ্ট!”

“না না, বহু শুন”, ফোনে ধীরেন বউকে সচরাচর মাগি সম্বোধন করে না, “জামাইয়ের কামখ্যান ধর যেঞে খারাব লয়। বহুর হাতকে মুবাইল না থাইকল্যে লিজের হাতের মুবাইল কুন কামের, বল ধিনি! ক’দিনই-বা অদের বিহা হইলছ্যে। জামাই পড়ি আছে ইঠিঞে, বিটি উঠিঞে। দিনমানে মাগি-মরদে দু’খ্যান কথাও যদি না হয়, আথ কষ্ট কীসের লেগ্যে! জুয়ান বেটা-বিটি, সখ-আহ্লাদ তো থাকে।”



সুভদ্রা আর তর্ক করেনি সে-দিন। বরং, একটু অপরাধী ঠাউরেছিল নিজেকে। তার বয়স হল চৌত্রিশ। ওদিকে, বাসন্তী মাত্র আঠেরো বছরের তরুণী। স্বামীর সঙ্গে কথা বলার তাগিদ এবং হক দুটোই সম্ভবত তার বেশি। ধীরেন নিয়ম করে প্রতিদিন সুভদ্রাকে ফোন করে। কোনও কারণে একদিন ফোন বাদ গেলে সুভদ্রার মন আনচান করে। বাসন্তীর কেন করবে না!

আজ ক’টা দিন মন একেবারে মানছে না। পরশু শেষবার ফোন করেছিল ধীরেন। সে তখন আরও অনেকের সঙ্গে পৌঁছেছে কানপুর। সঙ্গেই আছে সাধন। আরও দেড় দিন আগে তারা দল বেঁধে রওনা হয়েছিল গুরুগ্রাম থেকে। কখনও হেঁটে, কখনও চড়া ভাড়ায় লরিতে চড়ে কানপুর অবধি পৌঁছেছে। তাও পুলিসের ভয়ে খুব লুকিয়ে। ফোন কাটার আগে ধীরেন বলেছিল মোবাইলের ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে আসছে। সাধনের মোবাইলের ব্যাটারি আগেই ফুরিয়ে গিয়েছে। কমবয়সি ছেলে, ফোনে কথা বলার সময় হিসাব করতে জানে না। সুতরাং, তারা বাড়ি পৌঁছনোর আগে আর যোগাযোগ করতে পারবে না। সুভদ্রা যেন চিন্তা না করে।

যেন চিন্তা না করে! সুভদ্রার চিন্তা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। গ্রামে অনেক খবর ওড়ে। ছেলে-মেয়ে দুটো কোথা কোথা থেকে নানা খবর আনে। ধীরেন আর সাধনের মতো বহু মানুষ না কি গুরুগ্রাম, মুম্বই, আহ্‌মদাবাদ, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, দেশের আরও সব জায়গা থেকে নিজের নিজের বাড়ির পথে রওনা হয়েছে। তাদের জন্য ট্রেন নেই, বাস নেই, এতটা পথ অতিক্রম করার কোনও বন্দোবস্ত, কোনও সহায় নেই। সুভদ্রা ভাবে আর তার বুক ধড়াস ধড়াস করে। যত ঠাকুরের নাম তার জানা আছে, চোখের জল ফেলতে ফেলতে সকলের কাছে স্বামী আর জামাইয়ের মঙ্গলকামনায় আবেদন-নিবেদন করে। আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে ছেলে-মেয়েদের জন্য রান্না করে। ভাত আগেই হয়ে গেছে। পাঁচমিশালি সবজিটাও হব হব। চঞ্চলা কড়াইয়ে খুন্তি নাড়ছিল। বলল, “মা, হঞে যেলছে মুনে লাগে, দ্যাখো-সে।”

সুভদ্রা দেখে না। বলে, “লামিঞ লে। হাত ধুঞে বস-গা। দীপু, তু-ও আয়।”

ভাই, বোন পাশাপাশি আসনপিঁড়ি হয়ে বসে। দুজনের পাতে ভাত বাড়ে সুভদ্রা। ভাত সকলেরই একটু কম পড়বে। সুভদ্রা হাঁড়িতে চাল কম নিয়েছিল। জমিয়ে রাখছে কবে ধীরেন বাড়ি ফিরে ভাত চাইবে। মানিষটো ভাতের ভুক্যো। সুভদ্রা বোঝে চঞ্চলা আর দীপকের পেট ভরল না। সে হাঁড়িতে আধ হাতা মাত্র ভাত রেখে বাকিটা প্রথমে ঢালে ছেলের পাতে, তারপর ঢালতে যায় মেয়ের পাতে। চঞ্চলা মায়ের হাত চেপে ধরে। করুণ চোখে তাকায়, “খিদ্যা নাই। প্যাট ভরি যেলছে।”

সুভদ্রার চোখ ফেটে জল আসতে চায়। সামলে নিয়ে তর্জন করে মেয়েকে, “ইহ্‌, খিদ্যা নাই! প্যাট ভরি যেলছে! গিদ্যার কথ! খা বুলছি। ভাত ক’টা খেঞে লে!”

চঞ্চলা মিনতি করে, “মা!”

সুভদ্রা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে, “আচ্ছা, আচ্ছা, খোব হইলছে!”

চঞ্চলা আর দীপক উঠে পড়ে। নিজের জন্য ভাত বেড়ে চুপ করে বসে থাকে সুভদ্রা। খেতে মন ওঠে না। গ্রাস বানিয়ে মুখে তুলতে যায়, তখনই বুক দলা পাকিয়ে গলায় উঠে আসতে চায়, মুখ বিকৃত হয়ে ওঠে, চোখ ভেসে যায় জলে। মাখা ভাতটা বাটিতে তুলে জল ঢেলে দেয় সুভদ্রা।

ধীরেনরা কানপুর শহরের বাইরে লুকিয়ে ছিল। খবর আছে, এই দুঃসময়ে লোকজন এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে যাচ্ছে দেখলেই পুলিস ধরছে। ধরে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে রাখছে অস্থায়ী জেলখানা ধরনের জায়গায়। আরও কী কী সব করছে। পুলিসের চোখে ধুলো দিতে ধীরেনরাও লুকোচুরি খেলতে খেলতে যতটা পারে এগোচ্ছে। তাদের দলে বাঙালি, বিহারি, ভোজপুরী, মৈথিলী নানা জাতের মানুষ। বিকেল চারটে নাগাদ তারা হাইওয়ে ধরে হাঁটতে শুরু করে। দূরে লোকজন দেখলে হাইওয়ে থেকে সরে লুকিয়ে-চুরিয়ে এগোয়। একসময় পেয়ে যায় রেললাইন। কানপুর স্টেশন তখন অনেকটা পিছনে। ধীরেনরা হাঁটতে থাকে রেলের লাইন বরাবর। সন্ধের অন্ধকারও নামতে শুরু করেছে। কোথাও থামে না ঘরমুখো পথিকেরা। কেবল সামনে স্টেশন দেখলে, থমকে, থেমে, সতর্ক হয়ে নির্জন কোনও পথে স্টেশন অতিক্রম করে আবার রেললাইন ধরে তারা। রাস্তাঘাট বেশিরভাগই নির্জন এখন। শহরের মানুষ ভয়ে ভাবনায় ঘরে বন্দি করেছে নিজেদের। বাইরে বেরনোর আগে পাঁচ কথা ভাবে। এসব ভাবে না, ভাবতে পারে না তারা, যারা ঘরমুখো, এখনও ঘর থেকে দূরে।

রাত দুটো নাগাদ চোখে পড়ে সামনে এক স্টেশন। স্টেশনে দাঁড়িয়ে মালগাড়ি। কানে আসে ইঞ্জিনের ধক্‌ধক্‌ আওয়াজ। থমকে এ-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। ধীরেন হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে বলে, “গাড়িটা কোথায় যাবে খোঁজ নিলে হয়।” দলের সকলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ নয়। কারও কারও গন্তব্য উত্তরপ্রদেশেই। তারা বাড়ির কাছে এসে পড়েছে। স্টেশনে ঢুকে সকলের নজরে পড়তে চায় না। বাকিদের বাড়ি কারও বিহার, কারও ঝাড়খণ্ড, কারও পশ্চিমবঙ্গ। তারাও সকলে সাহস পায় না। ধীরেন সাধনের দিকে তাকিয়ে বলে, “আয়, জামাই। একবারটো দেখি লিই।”

সাধন ভীরু স্বরে বলে, “উদিকে যাবা? শ্যাষে বেপদ হবে না? যদি জেহেলে চালান দেয়!”

“ওরে শালো!” ধীরেন চাপাস্বরে বোঝায়, “ঘর আখুনও অ্যানেকটো দূর। না হোক, দশ ঘণ্টা টানা হাঁটা হইলছ্যে। আর কথ পারবি! দিনের আলো ফুটি যেলে তখুন লুকাবি কুথাকে?”

সাধন অগত্যা সায় দেয়, “চলো থাল্যে। কিন্তু, শালো বুলছ ক্যানে? আমু তুমার জামাই!”

“আর শালো জামাই!” ধীরেন চলতে শুরু করে। চলতে চলতেই বিড়বিড় করে, “বুল্যে, ঠ্যালায় পইল্লে রেতের বেলা বহু পজ্জুন্ত ভাতারকে বাপ ডাকে! জামাই!”

সাধন এবং আরও ছ’জন অনুসরণ করে ধীরেনকে। বাকিরা বিকল্প পথের অনুসন্ধানে অন্যদিকে যায়। স্টেশনের নাম অম্বুজনগর। কানপুরের মতো বড় স্টেশন নয়। লোকজন নেই বললেই চলে। একে রাত দুটো। তাছাড়া, যাত্রীবাহী ট্রেন সবই তো বন্ধ। লোকে স্টেশনে আসবে কী মরতে! কয়েকজন মালবাহককে শুধু দেখা যায় ইতিউতি। ধীরেন বাকিদের আড়ালে অপেক্ষা করতে বলে একাই এগিয়ে যায়। উর্দিধারী মালবাহকদের একজনকে জিজ্ঞেস করে, “এ গাড়ি কাঁহা যায়গা?”

“কিঁউ? ইস্‌সে তুমহারা ওয়াস্তা?” হাতের খৈনি টেপা বন্ধ করে সন্দিগ্ধ চোখে চায় মাতব্বর মালবাহক।

ধীরেন শুকনো হাসে। প্রশ্নের জবাব দেয় না।

“কাঁহা সে আ রহে হো?”

“গুরগাঁও।”

“বঙ্গালি? ঘর লৌটনা হ্যায়?” মালবাহক খৈনি টেপায় মন দেয়।

“হাঁ।” ধীরেন ঘাড় নাড়ে।

“হো সকতা হ্যায়”, মালবাহক বলে, “কিতনে আদমি হো?”

“আট।”

“আঠ আদমি?” হাতের খৈনি ঝেড়ে মুখে পুরে হাঁক দেয় মালবাহক, “এ বুধিয়া, এ বজরঙ্গি, জরা ইধর আ তো!”

ধীরেন পালানোর প্রস্তুতি নেয়। চারদিকে তাকিয়ে বলে, “আবার উস লোগকো বুলানে কো ক্যা জরুরত?”

মালবাহক বলে, “ডরো মাৎ। বোলা না হো জায়েগা! রামলালকে জবান কী কীমৎ হ্যায়। ভাগনা মাৎ। ঠহ্‌রো।”

বুধিয়া আর বজরঙ্গি অকুস্থলে হাজির হয়। বিষয়টা তাদের বোঝায় রামলাল। সব শুনে বুধিয়া এবং বজরঙ্গিও খৈনি ডলতে শুরু করে। স্পষ্টতই, সমস্যা গুরুতর। কিছুক্ষণ গভীর আলোচনা চলে তিন মালবাহকের। অবশেষে রামলাল বলে, “ইন্তজাম হো জায়েগা। হো ক্যা! সমঝো হো গয়া। আঠ আদমি বোলা না? আঠ আদমি কে লিয়ে ডেঢ়-ডেঢ়সো কে হিসাব সে হোতা হ্যায় বারাসো রুপয়ে। হজার রুপয়ে দে দেনা।”

ধীরেন বলে, “কিন্তু, ইন্তিজাম কী হোগা?”

রামলাল হাসে, “দেখ রহে হো গাড়ি? চালিশ ডিব্বে লগে হুয়ে হ্যাঁয়। সির্‌ফ চার ডিব্বে হি ভরে হ্যাঁয়। খালি হ্যাঁয় সারে কে সারে ছত্তিস ডিব্বে। তুমকো পিছেওয়ালে কিসি ডিব্বে মেঁ বিঠা দেঁঙ্গে। সমঝে? ইয়ে গাড়ি পহ্‌লে রুকেগি সাসারাম ইস্টেশন। ওঁহা তুম উতর জানা। ওঁহা সে হর ডিব্বা ভর কর গাড়ি জায়েগি দুসরি দিশা মে, তুমহারে ঠিকানে সে দূর। ঠিক হ্যায়? তো, লাও রুপয়ে।”

“সাসারাম!” ধীরেন চিন্তিত মুখে বলে, “ও তো বিহার হ্যায়। গাড়ি বঙ্গাল নেহি যায়গা?”

“নহি।”

“সাসারাম সে তো বঙ্গাল দূর হ্যায়।”

“সাসারাম তক ভি তুমকো লে জায়েগা কওন সসুরা?”

কঠিন প্রশ্ন। ধীরেনের শ্বশুর এখনও বেঁচে আছে ঠিকই, কিন্তু এই অম্বুজনগরে জামাইয়ের সহায় হওয়ার উপায় তার নেই। ধীরেন ভেবেচিন্তে বলে, “এক কাম করো, আট আদমি কা পচাশ-পচাশ করকে চারশো রুপিয়া লো।”

“নহি। হজার”, রামলাল সঙ্গীদের দিকে চায়, “সালা বঙ্গালি! সামনে মওত খড়ি, তব ভি সওদা করেগা!” সওদাগর বলে বাঙালিদের আজও কি প্রাতঃস্মরণীয় মনে করে ভারতবাসী! ধীরেন লড়ে যায়, “একশো করকে আটশো লো।”

“নহি!” গর্জে ওঠে রামলাল, “হজার রুপয়ে। বাত খতম। দেনা হ্যায় তো দো, নহি তো রাস্তা নাপো।”

“একটু মানে, থোড়া কম করো।”

“বহত হুয়া”, রামলাল ফচ করে থুতু ফেলে, “জো বোল দিয়া সো বোল দিয়া।”

“আচ্ছা, ঠিক হ্যায়।” ধীরেন দূরে আড়ালে দাঁড়ানো সঙ্গীদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। তারা সভয় সতর্ক পদক্ষেপে নিকটস্থ হলে, ধীরেন তাদের ব্যাপার বুঝিয়ে বলে। শেষপর্যন্ত সকলেই রাজি হয়। হিসাবে মাথাপিছু ভাড়া পড়ে একশো পঁচিশ টাকা করে। টাকা জোগাড় করতে গিয়ে প্রয়োজনীয় ভাঙতি পাঁচ, দশ, বিশের নোটে কিছু ঘাটতি দেখা যায়। সেই বাবদে সামান্য বিবাদও বাধে। রামলাল মাথা নাড়ে। সঙ্গীদের দিকে চেয়ে মন্তব্য করে, “বঙ্গালি!”

ধীরেন রামলালকে টাকা দিয়ে বলে, “বেশ, কুন ডিব্বামে উঠনা হোগা?”

“আও।” রামলাল, বুধিয়া এবং বজরঙ্গি ধীরেনদের সকলকে মালগাড়ির পিছনের দিকের একটি খালি ওয়াগনে উঠতে বলে। সবাই ওঠে। ধীরেন থমকে বলে, “লেকিন পুলিস যদি হামকো পকড় লিয়া? হামকো গাড়ি সে উতার দিয়া, তো?”

“অ্যায়সা কুছ নহি হোগা। কোই কুছ নহি করেগা”, আশ্বাস দেয় রামলাল, “তুম ক্যা সোচ রহে হো? ইয়ে রুপয়া হম লে রহে হ্যায়! গাড়িকা ডেরাইবার, গার্ড সাহাব, জিআরপি সবকা হিস্‌সা ইস রুপৈয়েমে হ্যায়। সোচো মাৎ। সাসারাম তক বেফিকর পঁহুচ জাওগে।”

গাড়ি চলতে শুরু করে। চলার গতি বাড়ে। মালগাড়ি যাত্রীবাহী এক্সপ্রেসের গতি পায়। পেতে অসুবিধেও নেই। যাত্রীবাহী গাড়ি আজ তো একটিও নেই ভারতীয় রেলের বিস্তৃত কক্ষপথে। দুরন্ত মালগাড়ির দুলুনিতে ক্লান্ত মানুষগুলির সকলেরই চোখ লেগে আসে। একসময় গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যায় তারা। জানতে পায় না, সেদিনই প্রায় সেই সময়েই, অন্য এক রুটে অন্য এক মালগাড়িতে কাটা পড়ে মারা গেছে তাদেরই মতো ঘরমুখো কিছু মানুষ। যেভাবে এই গাড়ির মানুষগুলো ওয়াগনের ভিতরে ঘুমোচ্ছে, অন্য সেই ক্লান্ত তারা রেলের লাইন স্তব্ধ শান্ত অব্যবহৃত দেখে লাইনের উপর তেমনই অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমের মধ্যেই রেল চলে গিয়েছিল তাদের পিষে দিয়ে।



সাধনের ঘুম যখন ভাঙল বাইরে গনগনে রোদ। সে অস্থির হয়ে ডাকাডাকি করে ধীরেনের ঘুম ভাঙাল। “ই কুন জাগা এল্যাম বলো ধিনি?”

“আমু কী দিশায় বুলব্য, শালো! আমু ই জাগা চিনি!”

“তাও, বেলা ক’টা হব্যে?”

ধীরেন ওয়াগনের দরজার বাইরে মুখ বাড়িয়ে চারপাশ দেখে বলে, “ন’টা-দশটা মুনে লাগে।”

“সাসারাম আর কদ্দূর হব্যে?”

“শালো!” চটে উঠতে গিয়েও হেসে ফেলে ধীরেন। সাধনের মুখটা এখনও কৈশোরের সারল্যে ভরা। হবে না কেন! বয়স মাত্র একুশ বছর। বোঝাই যাচ্ছে সে বাসন্তীর কথা ভাবছে। এই সংকটটা অনেককিছুই নতুন করে চিনিয়ে দিল ধীরেনকে। নাহ্‌, এবার কোনওমতে বাড়ি পৌঁছতে পারলে আর বিদেশে আসা নয়। বরাবরই গুরুগ্রামে বিদেশির মতোই থাকত ধীরেনরা। কিন্তু, এই একটা ঘটনা বড় নিষ্ঠুরভাবে স্পষ্ট করে দিল দেশ আর বিদেশের ফারাক।

ধীরেন ভেবেচিন্তে বলল, “মুনে লাগে, আরও পাঁচ-ছ ঘণ্টা-বা।”

ধীরেনের হিসাব মিলল না। বেলা একটার মধ্যে সাসারাম পৌঁছে গেল মালগাড়ি। স্টেশনে ঢোকার অনেকটা আগে থেকে গাড়ির গতি কমতে শুরু করেছিল। রেলের জমির বেড়ার বাইরে রাস্তার ধারে বন্ধ দোকানপাটের সাইনবোর্ডে হিন্দিতে লেখা সাসারাম। গাড়ির গতি যখন প্রায় গরুগাড়ির গতির সমান, ধীরেনরা টপাটপ নেমে পড়ল ওয়াগন থেকে।

তবে, এখানে ধরপাকড়ের কড়াকড়ি নেই। এলাকায় কিছুক্ষণ ঘোরাফেরার পর জানা গেল ধীরেনদেরই মতো আরও কিছু গৃহাভিমুখী মানুষ জড়ো হয়েছে শহরের বাসস্ট্যান্ডে। খবর শুনে ধীরেনরা সেদিকেই দৌড়ল। বাসস্ট্যান্ডে জটলারত মানুষের ঢল। বাসও অনেক দাঁড়িয়ে সারিসারি। সব ক’টিরই দরজা-জানলা বন্ধ। ড্রাইভার, কন্ডাকটর কেউ নেই। বাসস্ট্যান্ডে জমায়েত মানুষজনের লক্ষ্য কয়েকটি লরি। লরিগুলি ভিনরাজ্য থেকে মালপত্র নিয়ে এসেছিল সাসারাম। নিজের নিজের রাজ্যে ফিরবে তারা। যাত্রীদের জায়গা দিতে পারে। কিন্তু, প্রতিটি লরিই যাত্রীপিছু ভাড়া চাইছে অসম্ভব বেশি। অম্বুজনগরের রামলালদের মতোই সোজাসাপটা তাদের বক্তব্য – এই ভাড়ায় যেতে হলে চলো, নইলে রাস্তা নাপো। ধীরেনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল একটি লরি, রেজিস্ট্রেশন নম্বর ঝাড়খণ্ডের। যাত্রীদের তারা ঝাড়খণ্ড-পশ্চিমবঙ্গ সীমান্ত অবধি পৌঁছে দেবে। মাথাপিছু ভাড়া দশ হাজার। শুরু হল দরাদরি। শেষপর্যন্ত ভাড়া নামল মাথাপিছু সাত হাজার টাকা। তার কমে ড্রাইভার-খালাসি রাজি নয়। অনেকেই রাজি হয়ে গেল। পকেটের শেষ কড়িটি পর্যন্ত বের করে তুলে দিতে উদ্যত হল ড্রাইভারের হাতে। ধীরেন পকেট থেকে টাকা বের করতে করতে সাধনের দিকে তাকিয়ে বলল, “জামাই, আর উপ্যায় নাই।”

সাধন চাপা স্বরে বলল, “কিন্তু, সাত-সাত চোদ্দ হাজার! আথগোলা টাকা! হব্যে?”

“হব্যে”, ধীরেন সঙ্গের টাকা গুণে পকেটের মোবাইল ফোন বের করল, বলল, “তুর কাছকে যা রইচে দে, মুবাইলটোও দে।”

সাধন বিনাবাক্যে সঙ্গের টাকা এবং মোবাইল ফোন ধীরেনের হাতে তুলে দেয়। ধীরেন সবটা গুছিয়ে ড্রাইভার আর খালাসির সামনে রাখল। নগদে চোদ্দ হাজার হচ্ছে না। দুটি মোবাইল ফোনের দরুণ কিছু দর কষাকষির পর ড্রাইভার আর খালাসি রাজি হল। গরু-ছাগলের মতো গাদাগাদি করে ভর্তি হল ট্রাক। তাতেও অনেকে জায়গা পেল না টাকা দিতে পারেনি বলে। ধীরেন বলে উঠল, “জানলি জামাই, ভওমান আছে। তুর শাউড়ি দোব্‌লা ভওমানের কাছকে মাথা কুটে। ভওমান মানে, শিব, দুগ্‌গা, ধরম্‌ঠাকুর, দাতাবাবা, কেহু বাদ নাই খো। জানবি, অর পুইণ্যেই আইজ জানটো বাঁইচ্‌ল। জয় বাবা ধরম্‌রাজ!”

ট্রাকের যাত্রীরা বেশিরভাগই ছিল বিহারের পূর্বপ্রান্ত এবং ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা। তারা পথে বিভিন্ন জায়গায় নেমে গেল। গাড়ি বরাকর নদের পশ্চিম পারে ধীরেন আর সাধনকে নামিয়ে ফিরে গেল। প্রায় মাঝরাত তখন। আকাশে আধখানা চাঁদ। তার আলোয় আশপাশ সামান্য দৃশ্যমান। ধীরেন জানে, ক’দিন পরেই পূর্ণিমা। কিন্তু, জানে না এই পূর্ণিমা নিয়ে খুব হইচই চলছে কাগজে, টিভিতে। আগামী পূর্ণিমার সেই আগুয়ান চাঁদের নাম দেওয়া হয়েছে সুপার পিংক মুন। ধীরেন দূরে সেতুর দিকে চায়। সেতুর মুখটায় রাস্তার দু’পাশে দুটো বাতি জ্বলছে। গাড়ি চলাচল চোখে পড়ে না। কিন্তু, দুটো গাড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বাতিদুটোর নীচে। আশপাশে লোকজন কেউ নেই। গাড়ির মধ্যে থাকতে পারে। ধীরেন আন্দাজ করে, পুলিসের গাড়ি। সে বলে, “ইদিক দিঞে হবে না, জামাই। শালোর বেটা শালো পুলিস ধরি লিঞ যেঞে ঢুকিঞ দিবে ফাটকে। চল, ভিনো দিকে যাই।”

“কুন দিকে?”

“এলের বিরিজ।”

“সিখানে পুলিস থাইকব্যে না?”

“আথটো আস্তা এলি। এলের লাইনে, বিরিজে পুলিস দেখ্যাছিস?”

“দেখি নাই।”

ভাঙা চাঁদের আলোয় পথ খুঁজে দুজনে পৌঁছয় রেলব্রিজের পশ্চিম কিনারায়। ধীরেন আগুপাছু দেখে। কোথাও কিছু নাই। ধীরেন আগে আগে যায়, পিছনে সাধন। গ্রীষ্মের শুরুতে নদীর চওড়া বুকের বেশিটাই চড়ার দখলে, বিশেষ করে নদীর মাঝ বরাবর। কেবল দুই প্রান্তে দুটি ধারা বয়ে চলেছে। দুজনে সন্তর্পণে হাঁটে। কাস্তের মতো চাঁদের আলোয় এই ব্রিজে চলা আর শত্রুর হাতের কাস্তেয় গলা গলিয়ে হাঁটা একই ব্যাপার। দুজনেরই চলার গতি রীতিমতো মন্দ।

দেখতে দেখতে মাঝনদী পেরিয়ে যায় দুজনে। সামনে ব্রিজের শেষে নদীর পার তবু এখনও অনেকটা দূর। হঠাৎ লোহার সেতু কেঁপে ওঠে। দু’বার ভোঁ ভোঁ আওয়াজ হয়। মুহূর্ত কয়েক পরে ব্রিজে গমগম আওয়াজ ওঠে। পিছন থেকে এসে পড়ে একঝলক আলো। ধীরেন ঘুরে দেখে পশ্চিমে সেতুর শুরুতে আগুয়ান রেলের ইঞ্জিন। ঘুরে তাকায় সাধনও। মুহূর্ত খানেক ঘোরের মধ্যে কেটে যায়। দুজনে স্তম্ভিত চেয়ে থাকে ধীর গতিতে ধেয়ে আসা গাড়ির দিকে। ধীরেনের ঘোর কাটে। সামনে চায়। ব্রিজের পূর্বপ্রান্তে ডাঙা এখনও যতটা দূর অতটা ছুটে অতিক্রম করা সম্ভব নয়, বিশেষ করে এই পথে। তার আগেই গাড়ি এসে পড়বে। ধীরেন ব্রিজের নীচে তাকায়। জল দেখা যাচ্ছে। তারা নদীর পূর্বপ্রান্তের জলধারার উপরে দাঁড়িয়ে আছে। “জামাই!” ধীরেন সাধনের হাত ধরে টেনে আনে ব্রিজের কিনারায়। নীচে জল দেখিয়ে বলে, “কুদ্‌।”

সাধন ভয়ার্ত চোখে একবার নীচে জল দেখে, ফের শ্বশুরের দিকে চায়, “কুদব!”

ধীরেন জামাইয়ের ঘাড়ে চাপড় মারে, “কুদ্‌ বে শালো! কুদিঞ পড়!”

সাধন তবু বিবশ দাঁড়িয়ে থাকে। ধীরেন তাকে পিছন থেকে ধাক্কা দেয়। সাধন ব্রিজ থেকে পড়তে থাকে। খসে পড়ে হাতের ব্যাগ। চোখের পলকে নিজেও লাফিয়ে পড়ে ধীরেন। পড়তে পড়তে টের পায় মাথার উপরে ঝমঝমিয়ে চলেছে লোহার গাড়ি। সাধন জলে পড়েই ডুবে যায়। মুহূর্ত পরে তার পিছনে ডোবে ধীরেন। কয়েক মুহূর্ত পরে ভেসে ওঠে সাধনের মাথা। পাশে জাগে ধীরেনের মাথা। ধীরেন মুখ হাঁ করে শ্বাস নিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, “শালো! জেলের বেটার আবার জলের ডর!”

দুজনে সাঁতরে পৌঁছয় পাড়ের লাগোয়া চড়ায়। বালিতে হাঁটতে হাঁটতে পাড়ে ওঠে। আরও অনেকটা হেঁটে একসময় পৌঁছয় বড় রাস্তায়। সাধন বলে, “আর পেরি না! পাঁজর হালছ্যে।”

ভিতরে ভিতরে কাঁপছিল ধীরেনও। তারও বোধ হচ্ছিল আর পারছে না। সামনে একটা বন্ধ দোকানঘর দেখে বলে, “চল বেটা, আট্টুকখানি। উই ঠিঞে যেঞে বসব।”

বন্ধ দোকানঘরের সামনে পৌঁছে শুয়ে পড়ে সাধন। তার গায়ের জামাটি খুলে দোকানের সামনে মাটিতে মেলে দেয় ধীরেন। নিজেরটিও মেলে। সাধনকে বলে প্যান্ট খুলতে, নিজেও খোলে। প্যান্টদুটিও মেলা হয়। দুজনেরই অন্তর্বাস গায়েই শুকোয়। সঙ্গের ব্যাগ বরাকরে ভেসে গেছে। বদলানোর মতো পোশাক তো দূরের কথা, গামছাটিও নেই। ক্লান্ত চোখে ঘুম নামে। ভোরের দিকে ঘুম ভাঙে ধীরেনের। সাধনকে ডেকে তোলে, “চল বেটা, আর দেরি লয়।”

জামা-প্যান্ট তখনও ভাল শুকোয়নি। তবু ওই পরেই দুজনে ধুঁকতে ধুঁকতে ঘণ্টা পাঁচ হেঁটে পৌঁছয় আসানসোল। পথশ্রান্ত সাধন বসে পড়ে একটা বাজারের মুখে রাস্তার ধারে। পথচলতি যাকেই পায়, তারই কাছে গিয়ে খাবার আর জল ভিক্ষা করে ধীরেন। অনেকেরই মুখে মুখোশ। প্রায় সকলেই এড়িয়ে যায়। দু-চার জন দূরে দাঁড়িয়ে নানান প্রশ্ন করে। নিজের রাজ্যে এসে পড়েছে। এখন পুলিস, মিলিটারি, মন্ত্রী, সান্ত্রি, যে ধরে ধরুক, যেখানে পাঠাবে পাঠাক। ধীরেন কিছুই লুকোয় না। সব খুলে বলে। একজন দয়া করে এক বোতল জল ধরিয়ে দেয় তার হাতে। আধ বোতল নিজে খেয়ে বাকিটা সাধনকে দেয় ধীরেন। ইতিমধ্যে পুলিসের গাড়ি আসে। তাদেরও সমস্ত প্রশ্নের জবাব দেয় দুজনে। পুলিস দয়াপরবশ হয়ে খাবারের ব্যবস্থা করে। কিছুক্ষণ পরে অন্য একটা গাড়ি আসে পুলিসের ব্যবস্থাপনায়। গাড়িতে তাদের মতো আরও অনেক মানুষ। দুজনের হাতে দুটি মুখোশ ধরিয়ে তাতে উঠতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ওরা গাড়িতে ওঠে। গাড়ি রওনা হয়। বিকেল পাঁচটা নাগাদ পৌঁছয় রামপুরহাট হাসপাতাল। সেখানে তাদের লালারস সংগৃহীত হয়। রামপুরহাট পুলিসের গাড়ি ধীরেন আর সাধনকে সন্ধেয় পৌঁছে দেয় ঘুটিঙ্যা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। স্কুল বন্ধ। সেটি আপাতত কোয়ারেন্টিন সেন্টার। জেলা প্রশাসনের নির্দেশে প্রধানশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ধীরেনদের কিছু অত্যাবশ্যক সামগ্রী দেওয়া হয়। আপাতত চোদ্দ দিন থাকতে হবে এই স্কুলেই। গ্রামে ঢোকার মুখে রাস্তায় এবং স্কুলের বাইরে দূরে পাহারায় পালা করে আছে গ্রামের মানুষ। বাড়ির মানুষদের আপাতত ধীরেনদের কাছে ঘেঁষতে দেওয়া যাবে না।

মানুষটা গ্রামে পৌঁছে গিয়েছে, তবু চোখের দেখাটুকুও হবে না। কাঁদতে কাঁদতে রান্না করে সুভদ্রা। তার জমানো চাল এবার কাজে লাগতে শুরু করল। নিজে একাহারী থেকে, ছেলেমেয়েদের আধপেটা খাইয়ে, যাবতীয় ভাত-তরকারি ডাবোর আর খোরায় ভরে পাঠায়, সঙ্গে দুটি বগি থালা। নিয়ে যায় চঞ্চলা আর দীপক। পাহারাদাররা তাদের হাত থেকে সে-জিনিস নিয়ে নামিয়ে আসে স্কুলের বারান্দার নীচে। ধীরেন খাবার তুলে ভিতরে যায়। সে গোগ্রাসে খায়। তেমন খেতে পারল না সাধন। রাতে জ্বর এল তার। সকালে শুরু হল কাশি। খবর শুনে আবার পুলিস এল অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে। সাধনকে নিয়ে গেল হাসপাতাল। ক’দিন পরে জানা গেল, তাদের লালারসের পরীক্ষার রিপোর্ট এসেছে। রিপোর্ট মোতাবেক, সাধনের শরীরে জীবাণুর অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। ধীরেনের শরীর জীবাণুমুক্ত। এদিকে স্কুলে ধীরেন, ওদিকে ঘরে সুভদ্রা, আকুল হয়ে যাকে সামনে পেল তার কাছেই জানতে চাইল, “হাঁ গো, জামাই বাঁইচব্যে তো?”

ধীরেন চোদ্দ দিন পরে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরল। আরও ক’দিন পরে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে নিজের গ্রামে ফিরল সাধন। আরও হপ্তা দুই পরে দুপুরে কাঁদতে কাঁদতে বাপের বাড়ি এল বাসন্তী। কী বৃত্তান্ত? না, শ্বশুরবাড়ি থেকে তাকে খেদিয়ে দিয়েছে।

“কে খেদালে?” ধীরেন রক্তচক্ষু দর্শিয়ে জানতে চায়, “শালোর বেটা শালো সাধন?”

“না, উ লয়”, বাসন্তী জবাব দেয়, “অর বাপ।”

“ক্যানে? খেদুড়ে দিলে ক্যানে? কী কর‍্যাছিলি?”

“কিছুই করি নাই খো”, বাসন্তী কান্নায় ভেঙে পড়ে বলে, “অরা বরপণের বাকি টাকা চাহাছে।”

বরপণের বাকি টাকা!



“এক নয়া প’হাও বাকি নাই!” গর্জে ওঠে ধীরেন।

“অরা বুইলছ্যে।”

“আংসাং বুইলছ্যে”, ধীরেন জিজ্ঞেস করে, “যখুন শউর তুকে খেদুড়ে দিলে, সাধন কিছু বুল্ল্যে না?”

“না”, বাসন্তী আবার ডুকরে কেঁদে ওঠে, “সি কিছুই বুল্ল্যে না খো। ডাড়িং ডাড়িং দেইখল্যে খালি।”

“শালোর বেটা শালোর খোব রস হইলছ্যে!” ধীরেন টিনের চালে গোঁজা রামদা হাতে নেয়, “আইজ শালোর বাপ-বেটাকে কেট্যি ফেলাব্য।”

সুভদ্রা ছুটে এসে তাকে ধরে। বাসন্তী বাপের পায়ে পড়ে। দুজনে কাঁদে, মিনতি করে, “শুনো, কথা শুনো। খুনখারাবি লয় গো, খুনখারাবি লয়।”

বাসন্তী কাঁদতে কাঁদতে বলে, “অদের দোষ নাই খো। ঘরকে খুরাক নাই। অর উপরেই ভরসা ছেল। সি তো এক নয়াও আনত্যে পারে নাই।”

ধীরেন হাত থেকে দা ফেলে দেয়। অবসন্ন মনে ফিরে এসে বসে দাওয়ায়। সে নিজেও এক পয়সা আনতে পারেনি। সবই গিয়েছে ঘরে ফেরার পাথেয় বাবদে। সামান্য যা কিছু অবশিষ্ট ছিল, ভেসে গিয়েছে বরাকরের জলে। তবু যে দু’মুঠো ভাত খেতে পাচ্ছে সে ওই সুভদ্রার গুণে। সংসার খরচ থেকে বাঁচিয়ে রাখা তার সঞ্চয়ের গুণে। কিছুক্ষণ পরে ধীরেন বউয়ের দিকে চায়, “শুন বাসন্তীর মা, কথ ট্যাকা রইচে তুর কাছকে?”

“ক্যানে?” সুভদ্রার মুখে শঙ্কার ছায়া।

“দরকার রইচে। বল।”

সুভদ্রা ইতস্তত করে বলে, “তা, পাঁচশো-হাজার হবে।”

“মাগি! পাঁচশো না হাজার?” গর্জন করে ধীরেন।

কেঁপে ওঠে সুভদ্রা। “তা হাজারই হব্যে-বা।”

“পাঁচশো ধরিঞ দে বাসন্তীর হাতে। উ যেঞে অর শউরকে দেক।”

“না।” ভয়ে বুক কাঁপলেও, শরীর শক্ত করে আপত্তি জানায় সুভদ্রা।

“ক্যানে? শাড়ির খুঁটে ট্যাকা জমাইলছিস বুল্যে তুরও রস বেড়াছ্যে, না কি?” ধীরেন দাওয়া থেকে ওঠে, “ট্যাকাটো ক্যার? তুর লয় রে মাগি, ট্যাকা আমার।”

বাসন্তী বাপের সামনে দাঁড়ায়। “মা হক কথা বুল্যাছে। অদিকে ট্যাকা দুব না। আমু অই ঘরকে ফিরত যাব না।”

“শউরঘরকে যাবি না, ভাতারের কাছকে ফিরবি না!” যত রেগে ওঠে, তত অবাকও হয় ধীরেন।

“না”, বাসন্তী বাপের চোখে চোখ রেখে বলে, “ভাতার আবার কী! যি ভাত দেয় না, সি ভাতার কীসের!”

“কী বুইল্‌লি ছুঁড়ি!” ধীরেন বেড়া থেকে মট করে একটা কলমির ডাল ভাঙে। পেটাতে শুরু করে বাসন্তীকে। সুভদ্রা দৌড়ে আসে। তাকেও পেটায় ধীরেন। মুখে গালিগালাজের বন্যা। পেটাতে পেটাতে একটা করে কলমির ডাল ভাঙে, বেড়া থেকে আর একটা তুলে আনে ধীরেন। উঠোনে আছাড়িপিছাড়ি যায় মা আর মেয়ে। চঞ্চলা আর দীপক ভয়ে কাঁটা হয়ে বেড়ার বাইরে লুকিয়ে সব দেখে। শেষে ধীরেন ক্লান্ত হয়ে নিজেও বসে পড়ে উঠোনে। কিছুক্ষণ পরে হাত বাড়িয়ে সুভদ্রার আঁচল টানে। আঁচলের গিঁট খোলে। ভিতরে পায় দশ টাকার একটা দোমড়ানো নোট আর এক-দু’টাকার ক’টা কয়েন। সেগুলো হাতে নিয়ে বেরিয়ে যায়।

সুভদ্রা চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, “মদ গিলতে যেল। আইজ কী হয় দ্যাখ!”

বাসন্তী ভয়ার্ত চোখে মায়ের দিকে চায়। এবার সুভদ্রা গালি দিতে শুরু করে তাকে। শ্বশুরবাড়ি ফিরে যেতে বোঝায়। বাসন্তী কাঁদে আর মিনতি করে। এও এক লড়াই। মা-মেয়ের লড়াই কখনও থামে, আবার শুরু হয়, চলতে থাকে। ক্লান্ত হয়ে পড়ে সুভদ্রা। বিকেলও গড়িয়ে যাচ্ছে। সে উঠোন থেকে বারান্দায় উঠে আখায় আগুন দেয়। রান্না চড়াতে হবে। অন্তত, ধীরেনের জন্য রেঁধে রাখতে হবে কিছু। এক গলা মদ গিলে সন্ধেয় বাড়ি ফিরে মুখের সামনে ভাতের থালাটি না পেলে অনর্থ করবে। বাসন্তী মাকে সাহায্য করতে যায়। প্রথমটা মুখঝামটা দেয় সুভদ্রা। শেষে বলে, “যা পেরিস কর-গা।” নিজে গিয়ে বসে দূরে। উদাস চেয়ে থাকে কলমির বেড়ার দিকে। বাসন্তীর রান্না সারা হতে চঞ্চলা আর দীপককে ডাকে সুভদ্রা। বাসন্তীকে বলে, “অদের খেত্যে দে। তু-ও খেঞে লে। তুদের বাপ ঘরকে এসি যেলে আর খেত্যে পাবি না।”

“তুমি খাবা না?”

“মুখপুড়ি! তুর বাপের অ্যাগে আমু কুনোদিন খাই যে আইজ খাব!”

চঞ্চলা আর দীপক নীরবে খায়। বাসন্তীও। প্রায় নিঃশব্দে শুরু হয়ে হাপুস-হুপুস শব্দে খালি হয় তার থালা। সুভদ্রা বুঝতে পারে বহুদিন মেয়ের পেটভরে খাওয়া জোটেনি। চোখ থেকে জল গড়ায় তার।

সন্ধে পার করে টলতে টলতে ফেরে ধীরেন। মুখে কথাটি নেই। তার নৈঃশব্দ্যে ধীবরবাড়ি আরও থমথমে হয়ে ওঠে। সুভদ্রা কাঁসার বগি থালায় স্বামীর জন্যে ভাত বাড়ে। ধীরেন সেদিকে আসে না। দাওয়ার অপর প্রান্তে বসে। হঠাৎ ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজে চমকে চায় সুভদ্রা। বিহ্বল বোধ করে। এমন আগে কখনও দেখেনি। ধীরেনের কান্নার বেগ বাড়তে থাকে। শেষে আওয়াজ করে হাউহাউ করে কাঁদে। সুভদ্রা ছুটে গিয়ে স্বামীর পিঠে হাত রাখে। ধীরেন দু’হাতে জড়িয়ে ধরে সুভদ্রার হাঁটু। কান্নার সঙ্গে ভলকে ভলকে বমি করে। বমিতে ময়লা হয় সুভদ্রার শাড়ি। সে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকে। ধীরেন একসময় ধপ করে পড়ে যায় উঠোনে। বেহুঁশ ঘুমিয়ে পড়ে। ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ধীবরদের তিন সন্তান। মা ও তিন সন্তান মিলে ধীরেনকে উঠোন থেকে তুলে দাওয়ার চারপাইতে শোয়ায়। সুভদ্রা পুকুরে যায়। স্নান করে, ময়লা কাপড় কাচে। ফিরে এসে অবশিষ্ট ভাত-তরকারিতে জল ঢেলে দেয়।

পরদিন কাজ খুঁজতে বেরয় ধীরেন। সুভদ্রা ডাবোরে ভাত-তরকারি গুছিয়ে গামছায় বেঁধে সঙ্গে দেয়। ধীরেন সারা গ্রাম ঘোরে। পাশের গ্রামগুলিতেও যায়। কোথাও কাজ পায় না। তবু এভাবে কাজ খুঁজতে যায় দিনের পর দিন। কাজ জোটে না। গ্রামের লোকেরাও যেন ভাল চোখে দেখে না তাকে। যেন সে উড়ে এসে জুড়ে বসে এই দুঃসময়ে তাদের সীমিত রোজগারে ভাগ বসাতে চাইছে। পঞ্চায়েতের মাতব্বরেরা বলে, “ডাঁড়া, রোস ধিনি, তু তো অ্যানেক রোজগার কর‍্যাছিস বিদ্যাশে। জমানো-জুটানো টাকা লিচ্চয় রইচে। তুর থিক্যা গরিব কম নাই ইট্‌ক্যা। অ্যাগে সি মানিষগোলা কাজ পাক। বুইলি? আর, তুর তো জব কার্ডও নাই, রইচে?”

ধীরেন মাথা নাড়ে। বিদেশে কাজ করে, এখানে জব কার্ড করায়নি। এও বলতে পারে না যে, জমানো টাকা তার নেই। সে টাকা জমায়নি। গত দশ বছরে রোজগার করা টাকায় কাঁচা বাড়ি অর্ধেক পাকা করেছে। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। মেজমেয়ে আর ছোটছেলের স্কুলে পড়ার খরচ জুগিয়েছে। সামান্য বড়মানুষিতেও খরচ হয়েছে কিছু। নিজের, বউয়ের এবং মেজমেয়ের মোবাইল ফোন কিনেছে। এসব কথা বলা যায় না।

দেখতে দেখতে সুভদ্রার সঞ্চয় তলানিতে ঠেকল। বিক্রি হতে শুরু করল ঘরের জিনিসপত্র। সতের বাসন কেউ কিনবে না। অন্যান্য যাবতীয় বাসনপত্র বিক্রি হতে থাকল। ধীরেন শখ করে একটি টেবিল ফ্যান কিনেছিল একসময়। সেটিও বিক্রি হল। সুভদ্রা একদিন নিজের এবং চঞ্চলার মোবাইল ফোন ধীরেনের হাতে দিয়ে বলল, “এগোলাও বেচি দ্যাও।”

ধীরেন রাজি হল না। সে শুনেছিল চঞ্চলা আর দীপকদের স্কুলের শিক্ষকেরা অনলাইন পড়ানো শুরু করবেন। চঞ্চলার স্মার্টফোনটি সেক্ষেত্রে কাজে লাগবে। সুভদ্রা কপাল ঠুকে বলল, “আর ল্যাখাপড়া! খ’ জুটে না। মুবাইল রেখ্যে হব্যেটো কী, রিচাজ করব্যে কে?”

ধীরেন জবাব দিল না। ফোন বিক্রিও করল না। সুভদ্রার সাধারণ ফোনটিও না। ইদানীং তাকে দেখে মনে হয় গভীরভাবে কিছু চিন্তা করছে। সুভদ্রা বাড়ির অন্যান্য জিনিসপত্র বেচে কোনওমতে সংসার চালাতে থাকে। কিছুই না থাকলে সেদিন উঠোনের বাগানে শাকপাতা যেটুকু পায় তা-ই রাঁধে। পুকুরপাড়ে, জঙ্গলেও কন্দমূল আর শাকপাতা খুঁজতে যায়। তেমনকিছু পায় না। গ্রামের সকলেরই একই দশা। এলাকায় কাজকাম নাই, এক ওই পঞ্চায়েতের কাজ ছাড়া। অর্ধাহারে অনাহারে ধীবরদের দিন কাটে। দিনের পর দিন। মাসের পর মাস।

একদিন সাধন এল। ধীরেন তাকে দেখে প্রথমে খেপে উঠল। সুভদ্রা তার দিকে চেয়ে কিছু ইঙ্গিত করতে নিজেকে সামলে নিল। বলল, “আয় জামাই। বহুকে লিথ্যে আইলছিস?”

সাধন জবাব দেওয়ার আগেই বাসন্তী বলে উঠল, “আমু অর ঘরকে যাব না।”

ধীরেন চটে উঠে দাবড়ায়, “ক্যানে! বর লিথ্যে আইলছে, তু যাবি না ক্যানে? কুন পেঙায়?”

“অর বাপ মুকে মেরাছ্যে, খেদুড়ে দিঞ্যাছে। যাব ক্যানে?” বাসন্তী ফুঁসে উঠে জবাব দেয়, “তাবাদে, উ বেমার মানিষ। অর ছুঁয়াচে আমুও বেমার হব না কি!”

ধীরেন বোঝায় এই রোগ এভাবে হয় না। বলে, “বেমার যখুন ছেল তখুন ছেল। আখুন উ সেরি যেলছ্যে। তুর কিছু হবে নাখো।”

সাধন বলে, “আমু অখে লিথ্যে আসি নাই।”

ধীরেন আবার রাগতে থাকে। “লিথ্যে আসিস নাই! তো, আইলছিস কীসের লেগ্যে? গাঁড়দাবাতে?”

“একখান কথা ছেল।”

“কী কথা?”

“চলো ক্যানে, মুরা আবার উঠিঞে যাই।”

ধীরেন সাধনের দিকে একদৃষ্টে চায়। “কুন ঠিঞে?”

“গুরগাঁও”, সাধন বলে, “শুনতে পাও না? লুকে ফিরত যেচে। ইঠিঞে মুদের লেগ্যে কেহু কিছু রাখে নাই। বাপ বাসন্তীকে খেদুড়ে দিলে। কিছু বলি নাই”, বাসন্তীর দিকে আঙুল তুলে বলে, “উ জানে, ক্যানে বলি নাই। ইঠিঞে দুটি খেতি পায়। মুদের ঘরকে পড়ি থাইকল্যে পেথ না।”

ধীরেন মাথা নামায়। ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ আর মধ্যমায় কপাল টিপতে টিপতে বলে, “যা, তু ঘরকে যা।”

সাধন বলে, “কুনও খবর হলে, খবরটো দিয়ো য্যান।”

ধীরেন নীরবে মাথা নাড়ে।

সাধন পায়ে পায়ে বাসন্তীর দিকে এগোয়। ম্লান কণ্ঠে বলে, “শুন বাসন্তী …”

বাসন্তী বেড়া থেকে মট করে কলমির ডাল ভাঙে। ডাল ঝাঁকিয়ে বলে, “বারাও ধিনি! জেনি রাখ, তুমো মুর কেহু লয় বটে। লয়! কখুনও ভুল না হয়।”

সুভদ্রা অবাক হয়ে দেখে। সত্যিই সাধনকে মারবে না কি বাসন্তী! প্রশ্নের জবাব মেলে না। সাধন মাথা নিচু করে বেরিয়ে যায়।

আরও কয়েক সপ্তাহ যায়। একদিন ধীরেন সুভদ্রাকে জিজ্ঞেস করে, “ট্যাকাপ’হা খানিক-আধেক রইচে না কি তুর খুঁটে?”

“ক্যানে?”

“থাইকল্যে দশটো ট্যাকা দে। আর, তুর মুবাইলটো। রিচাজ করব।”

“ফেরি! ক্যানে? রিচাজ করি ফুন করবা ক্যাখে?”

“সি রইচে একঝুনা। ট্যাকা আছে তো দে।”

সুভদ্রা কিছুক্ষণ চিন্তা করে কিছু কয়েন বের করে তার লুকনো জায়গা থেকে। তার থেকে গুনেগেঁথে দশ টাকা ধরে দেয় ধীরেনের হাতে।

ধীরেন বউয়ের ফোনে দশ টাকার ব্যালেন্স ভরে। গুরুগ্রামের আসবাব কারখানার মালিককে ফোন করে। মালিক ফোন ধরতে নিজের পরিচয় দেয়। মালিক তার গলা শুনে চিনতেও পারে, তাকে খুশি শোনায়। ধীরেন জিজ্ঞেস করে গুরুগ্রামে কাজকাম চালু হয়েছে কি না। ফিরে গেলে কাজ পাবে কি না। মালিক সোৎসাহ জবাব দেয় যে, আগের মতো রমরমে ব্যবসা চালু না হলেও, টুকটাক বরাত আসছে। কাজের লোক কম বলে সেটাও বেশ চাপের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মালিক জানায়, ধীরেন ফিরে এলে সে খুশি হবে। চাই কি, পদের নিরিখে ধীরেনের তরক্কিও হতে পারে। ধীরেন সাধনের কথা বলে। মালিক বলে, “উসকো ভি লে আ। দিল্লি কে আসপাস কোই ভি নজদিকি জগা পহুঁচ জা। উসকে বাদ মেরী জিম্মেদারি। বে-ফিক্‌র আ জা।”

ধীরেন সাধনের বাড়ি যায়। তাকে খবর জানায়।

“কব্‌কে?” জানতে চায় সাধন।

“আসছে বুইধব্যার। হাতকে কিছু রইচে? আস্তায় আহাখচ্চা?”

সাধনের মুখ ম্লান দেখায়। “মাহাজুনের কাছকে যাব। যদি কিছু দেয়।”

“দেখ। বুইধব্যার কিন্তু।”

বাড়ি ফিরে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ধীরেন। বউকে জিজ্ঞেস করে, “তুর ভাঁড়ারে আর কিছু রইচে? আথটো আস্তা। আহাখচ্চার ব্যাপার। পেরিস তো সাধনের লেগ্যেও কিছু দিস।”

সুভদ্রা সঞ্চয়ের অবশেষ গুনতে বসে। গোনা শেষ হতে সময় লাগে না। সুভদ্রা তবু বসেই থাকে। একসময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। টাকা ক’টা এগিয়ে ধরে ধীরেনের দিকে। ধীরেন বউয়ের মুখের দিকে চায়। হাসে। বলে, “যা, রেখি দে-গা যিখানে ছেল সিখানকে।”

সুভদ্রা অবাক হয়ে স্বামীর দিকে চায়। ধীরেন বলে, “অ্যাথে আহাখচ্চার কিছুই হবে না। কিন্তু, ইঠিঞে তুদের ক’টা দিন চলি যাবে।”

“থাল্যে?”

“মাহাজুনের কাছকে যাই। সি যদি …”

ধীরেন গ্রামের মাতব্বরের কাছে যায়। পেশায় মহাজনি তো করেই লোকটা, স্বনামে-বেনামে জোতদারিও, তাছাড়া সে শাসকদলের নেতা, পঞ্চায়েতে প্রভাবশালী সদস্য। অনেক ভজনার পর মোড়ল রাজি হয়। “তা যা। ই কপালের লিখা। য্যার যিখানকে ভাত জুটে”, মোড়ল মাথা নাড়ায়, “কথায় বুল্যে, দানায় দানায় লিখা থাকে খাদকের নাম। ভওমান লিখ্যাপড়া করি রাহাছে। তু-আমু তার কী বিগাড়তে পেরি বল! সবই ভওমান!” মোড়ল টাকা দিতে রাজি হয়। চড়া সুদে। মাতব্বরের কাছে আইনি কাগজপত্র রাখা থাকে। “ক্যার কখুন কাজে লেগি যায়”, মাতব্বর বোঝায়, “মানিষের সেবা করব্যার লেগ্যেই তো ধর যেঞে মুর সবকিছু। টাকা লাইগব্যে, লে। কিন্তু, মুনে করে ভোটের টাইমে এসে ভোটটো দিঞে যাস বাপু।” অতঃপর স্ট্যাম্প পেপারে সই করে দেয় ধীরেন। সাক্ষীদের সইসাবুদ পরে করিয়ে নেবে মাহাজুন। ধীরেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হলেও, পড়তে পারে। বোঝে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ধার শোধ করতে না পারলে তার বাড়ি এবং চার কাঠা জমির দখল নেবে মাতব্বর, যে কি না একাধারে মোড়ল ও মাহাজুন।

একইভাবে কিছু টাকা জোগাড় করে সাধন। বাসন্তী জেদ ধরে সে-ও বাপের সঙ্গে গুরুগ্রাম যাবে। ব্যাখ্যা দেয়, “ইঠিঞে মুর কী রইচে! ঘর নাই, বর নাই, কাম নাই, খুরাক নাই। আমুও যাব গুরুগেরাম। সি তো এক গেরামই বটে!” কোনও কথাই শুনতে চায় না। মা-বাপের সঙ্গে তর্ক করে কোমর বেঁধে।

মেয়ে মানবে না দেখে শেষে ধীরেন বলে, “তু উঠিঞে যেঞে কী হাথিঘুড়াটো মারবি বটে? ঘর আর বর ধর যেঞে বাদই দিল্যাম, কাম আর খুরাক পাবি কুন ঠিঞে?”

“ক্যানে!” বাসন্তী বাপের চোখে চোখ রেখে বলে, “লুকের ঘর-ঘরকে কাম করব। বাসনমাজুনি, কাপড়ধোয়ানি, ঘরপুঁছুনির দরকার নাই অদের? অই গুরুগেরামের বাবুগোলার?”

“তা”, ধীরেন চিন্তার ভারে ঝুঁকতে ঝুঁকতে হাল ছেড়ে দিয়ে হাসে, “তা রইচে। চল থাল্যে।”

ইতিমধ্যে, ধীরেন আর সাধন তাদের কর্মক্ষেত্রে ফিরছে জেনে এলাকায় তাদের পরিচিত আরও কিছু মানুষ একই ঝুঁকি নিতে মনস্থ করে। তারা সবাই গুরুগ্রাম যাবে না। তবু কিছুটা রাস্তা একসাথে যাওয়া হবে। এই সময়ে এমন অভিযানে আগাগোড়া একলা-দোকলা পথে নামতে সাহস নেই কারও।

নির্দিষ্ট দিনে যাত্রা শুরু হয়। কীভাবে গোটা রাস্তাটা পার করে গুরুগ্রাম পৌঁছবে এখনও নিশ্চিত নয় ধীরেন। কিন্তু, গ্রামে বসে থেকেও লাভ নেই। সে স্থির করে প্রথমে যে করেই হোক বর্ধমান, দরকার হলে কলকাতা পৌঁছতে হবে। খবর আছে, কয়েক জায়গার ট্রেন এক-আধটা করে আবার চালু হয়েছে। দিল্লি, আগ্রা, আলিগড়, মীরাট, ফরিদাবাদ, নয়ডা, কাছাকাছি কোথাও একটা যেতে পারলেও, গুরুগ্রাম পৌঁছনোর ব্যবস্থা হতে পারে।

গ্রামের আলপথ ধরে হাঁটে তিন জন। গ্রাম ছাড়িয়ে শানবাঁধানো রাস্তায় পৌঁছতে বাকিরা যোগ দেয় তাদের সঙ্গে। সকলে হাঁটতে থাকে। শোনা গিয়েছে রামপুরহাট থেকে সরকারি বাস চালু হয়েছে। আপাতত সকলের লক্ষ্য রামপুরহাট। আগে আগে চলে ধীরেন। তার সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে বাকিরা। কেবল সাধন আর বাসন্তী সামান্য পিছিয়ে পড়ে। তাতেও স্বাস্থ্যবতী বাসন্তী হাঁটে তুলনায় জোর কদমে। বেমার সাধন তার পিছনে। পথে পড়ে চিলা। স্থানীয়রা বলে চিল্যা। বাইরের লোকে বলে নদী। স্থানীয়রা বলে কাঁদর। ধীরেন সদলবল হেঁটে হাঁটুজল চিলা পার হয়। ওদিকের পাড়ে উঠে চোখের আড়ালে চলে যায়। চিলার এপার এখন শান্ত, নির্জন। সাধন দৌড়ে বাসন্তীর পাশে এসে দাঁড়ায়। চিলার পাড়ে কলমির ঝোপ। বাসন্তী চোখের পলকে একটি ডাল ভেঙে বাগিয়ে ধরে।

“শুন, বাসন্তী!” ককিয়ে ওঠে সাধন। বাসন্তী কলমির ছড়ি চাবুকের মতো চালায়। অব্যর্থ লক্ষ্যে চাবুক পুরুষের মুখে নারীর বক্তব্য আঁকে। সাধনের ঠোঁট ফেটে রক্ত গড়ায়। গালে কলমি ফুলের মতোই বেগুনি ছোপ ধরে। বাসন্তীর হাত থেকে কলমির ডাল খসে পড়ে। সাধন এগিয়ে তাকে বুকে বাঁধে। বাসন্তী তার ঠোঁটে হাত বুলায়। সাধন চোখ বন্ধ করে। মাত্র কয়েকটি মুহূর্ত। বাসন্তী সাধনের বুকে ধাক্কা দেয়। সাধন দু’পা পিছিয়ে যায়। বাসন্তী ফিরে যায় কলমির ঝাড়ের কাছে। আর একটা ডালই বা ভাঙে! কিন্তু, বাসন্তী ডাল ভাঙে না। বেগুনি রঙের লম্বাটে কলমি ফুল তুলে খোঁপায় গাঁথে। একবার আড়চোখে চায় পিছনে। তারপর গুনগুনিয়ে সুর তোলে। পরনের শাড়ি হাঁটুর উপরে তুলে চিলা পেরয়। পিছন পিছন সাধনও নদী পেরয় প্যান্ট গুটিয়ে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *