short-story-porajoy

পরাজয়
অনন্যা দাশ


অলকানন্দাকে নিউ ইয়র্কের ইনসোমনিয়া নাইটক্লাবে দেখে আমি প্রথমে চিনতেই পারিনি। অবশ্য চিনতে পারার কথাও নয়। সেই কোন পনেরো বছর আগে ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তখনকার তন্বী মেজাজি সুন্দরীর সঙ্গে আজকের এই ক্লান্ত চড়া মেক-আপ করা মহিলার মিল খুব কম! পনেরো বছর আগে ওর মা বাবা ওর সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন বলে আমাকে কলকাতা থেকে নিয়ে এসেছিলেন এই মার্কিন মুলুকে। মেয়েকে জিগ্যেস না করেই করেছিলেন কাজটা, ফলে মেয়ে যখন আমাকে বিয়ে করবে না বলে বেঁকে বসেছিল তখন ভয়ানক অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলেন ওঁরা। হ্যাঁ, অলকানন্দার আমাকে পছন্দ হয়নি মোটেই। আমার সামনেই সে মা বাবাকে বলেছিল, “তোমাদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? কোথা থেকে এই গেঁয়ো ভূতকে ধরে নিয়ে এসেছ! একে বিয়ে করব আমি? একে আনার আগে আমাকে একবার জিগ্যেস পর্যন্ত করলে না তোমরা?”

ওর বাবা বেশ রেগে গিয়ে বলেছিলেন, “অমলেন্দু যথেষ্ট পড়াশোনা করেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছে! ওকে গেঁয়ো ভূত মোটেই বলে যায় না! ভারতে ওর কাছে চাকরিরও কয়েকটা অফার আছে। তোমার মিলি মাসির ওখানে ওর সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে আমি ওকে এখানে আসার প্রস্তাব দিয়ে রাজি করিয়ে এনেছি।”

সেই শুনে নাক সিঁটকেছিল অলকানন্দা, “অমলেন্দু! কি বিশ্রী নাম! শুধু ওই নামটার জন্যেই ওকে রিজেক্ট করা যায়! ওকে ফিরে যেতে বলো, এ বিয়ে আমি কিছুতেই করব না!” বলে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সে।

ওর বাবা মা আক্ষেপ করেছিলেন, “আমাদের এদেশে থেকে যাওয়াটাই ভুল হয়েছিল। মেয়েটা দিন কে দিন অসভ্য হয়ে উঠেছে। শিষ্ট আচার ব্যবহার যেন জানেই না! এত আত্মকেন্দ্রিক যে কি বলব! আমাদের কোন কথা শোনে না। কাদের সঙ্গে মেলামেশা করছে তাও আমরা জানি না। আমরা ভেবেছিলাম হাই স্কুলের পর অন্তত কলেজে যাবে। কিন্তু কলেজে ভর্তি হয়েও ক্লাস না করে নাম কাটিয়ে দিল। সেই জন্যেই আমরা ভেবেছিলাম বিয়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু সেটাও তো করবে না বলছে।”

সেদিন অনেক রাত অবধি আমার সঙ্গে কথা বললেন ওর মা-বাবা। বললেন, “তুমি ফিরে যেতে চাইলে যেতে পারো। টিকিটের দাম আমরা দিয়ে দেবো।“

আমি কিন্তু ফিরে যেতে চাইনি। কী মুখ নিয়ে ফিরে যাব? এত শখ করে এদেশে এসে খালি হাতে ফিরে গেলে নিজেকে যে পরাজিত মনে হবে। তাছাড়া আমার মা-বাবা অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন। একা একাই তো থাকতাম তাই পিছুটানও ছিল না তেমন। সেই কারণেই তো অত সহজে অলকানন্দার বাবা-মার প্রস্তাবে রাজি হতে পেরেছিলাম।

আমি বলেছিলাম, “না, ফিরে যেতে চাই না। আশা করছি এখানে একটা কিছু জোগাড় করে নিতে পারব। ততদিন যদি আপনাদের এখানে থাকতে পারি তাহলে খুব সুবিধা হবে। চাকরি পেলেই আমি থাকার জায়গা খুঁজে নেব।“

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, কোন অসুবিধাই নেই। তুমি যতদিন খুশি এখানে থাকতে পারো।“

সেই সূত্রেই ওদের বাড়িতেই ছিলাম আমি কিছুদিন। প্রায় মাস তিনেক মতন, চাকরি পাওয়া আর অন্য বাড়ি ভাড়া নেওয়া পর্যন্ত। এমনিতে কোন রকম অসুবিধা হয়নি। মাসিমা মেসোমশাই খুব যত্নেই রেখেছিলেন। তবে সেই সময় আমাকে সর্বতোভাবে এড়িয়ে চলেছিল অলকানন্দা। আমারও ওর সঙ্গে কথা বলার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না। বাড়িটা বেশ বড়োই তাই দেখা না করতে চাইলে এড়িয়ে যাওয়া কঠিন ছিল না। অলকানন্দার প্রত্যাখ্যান আমাকে খুব লজ্জিত করেছিল। ভারতে আমি মোটামুটি ভালো পাত্র আর ওর আমাকে ওই ভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করাটা আমিও ভালো মনে নিতে পারিনি, ভীষণ অপমানিত হয়েছিলাম। মাথায় একটা আগুন জ্বলেছিল, বুকের মধ্যে একটা অসহ্য যন্ত্রণা। আমি আমার গেস্ট রুমের জানালা দিয়ে দেখতে পেতাম অলকানন্দা কোন ছেলের গাড়িতে বা কোন ছেলের মোটরসাইকেলে করে সেজেগুজে ডেটে যাচ্ছে। ভয়ানক হীনমন্যতায় ভুগতাম তখন আমি। ডিপ্রেশানও হয়েছিল মনে হয় কিছুটা, যদিও সেটা আমি কাটিয়ে উঠেছিলাম।

এক বাড়িতে থেকেও আমরা পরস্পরকে যথাসাধ্য এড়িয়ে চলছিলাম বটে কিন্তু একদিন সেলোটেপ খুঁজতে গিয়ে না পেয়ে ওকে জিগ্যেস করতে হয়েছিল কারণ সেদিন ওর বাবা মা বাড়িতে ছিলেন না, কোন এক পার্টিতে গিয়েছিলেন।

“অলকানন্দা, সেলোটেপ কোথায় থাকে বলতে পারো? একটু দরকার ছিল।”

“অলকানন্দা? হু ইস অলকানন্দা? আমি অ্যালি! আমার মা-বাবা যদি আমার একটা বিশ্রী সেকেলে নাম দিয়ে বসে থাকেন তাহলে কি সেটা আমার দোষ? আমাকে অ্যালি বলে সম্বোধন করবে সব সময়! আর সেলোটেপ আবার কি? খায় না মাথায় দেয়?”

“ইয়ে মানে আঠা দেওয়া টেপ…”

“ও স্কচটেপ ওই ড্রয়ারে আছে নিয়ে নাও। এত দিন হয়ে গেল তাও গেঁয়ো ভূতই থেকে গেলে দেখছি!”

আবার অপমানের জ্বালায় জ্বলেছিলাম আমি। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করেছিলাম।

ব্যাস ওই টুকুই! চাকরি পেয়ে সেই যে বেরিয়ে যাই ওদের বাড়ি থেকে তারপর আর কোন খোঁজ খবর রাখিনি। মাসিমা-মেসোমশাইকে হয়তো ফোন করলে ভালো হত। মনেও হয়েছে অনেকবার, ওঁদের নম্বরটাও টিপেছি কিন্তু শেষমেশ ফোনটা আর করা হয়ে ওঠেনি – দ্বিধায়, কুন্ঠায়। পরে লতায়পাতায় শুনেছিলাম যে অলকানন্দা নাকি পালিয়ে গিয়ে মা বাবার অমতে নিজের এক বয়ফ্রেন্ডকে বিয়ে করেছিল।

তারপর ইনসোমনিয়ায় দেখা এত বছর বাদে! স্বল্প পোশাকে ককটেল ওয়েট্রেসের কাজ করছে অলকানন্দা (ও বলা সত্ত্বেও আমি ওকে অ্যালি হিসেবে মেনে নিতে পারিনি কোনদিন, ও আমার চিন্তায় বরাবর অলকানন্দাই থেকে গিয়েছে!)। সব চাইতে আশ্চর্যের ব্যাপার আমি ওকে চিনতে পারিনি কিন্তু ও আমাকে ঠিক চিনেছে! আমি সচরাচর নাইটক্লাবে আসি না। আজ উৎপল আর শ্রেয়ার অ্যানিভার্সারি। ওরাই আমাদের কয়েকজনকে জোর করে নিয়ে এসেছে। বাকিরা সবাই নাচানাচি করছে। আমি টেবিলে একাই বসেছিলাম। মিউজিকটা যেন বড্ড জোরে মনে হচ্ছিল। কী করে বাহানা বানিয়ে পালিয়ে যাওয়া যায় সেটাই ভাবছিলাম এমন সময় শুনলাম ওর ডাক।

“অমলেন্দু না?”

আলো আঁধারির মধ্যে আমি কিছুক্ষণ হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর বললাম “অলকানন্দা! সরি, অ্যালি!”

“হ্যাঁ, চিনতে পেরেছো তাহলে। ভালো আছো?”

“চলে যাচ্ছে একরকম। তুমি কেমন আছো? মাসিমা-মেসোমশাই কেমন আছেন?”

“দুজনেই মারা গেছেন ভগ্ন হৃদয় নিয়ে। আমি বড্ড দুঃখ দিয়েছিলাম যে ওদের। যাক সে সব কথা থাক। তোমার কথা বলো। কাজে খুব উন্নতি করেছো শুনেছি।”

আমি আবার চমক খেলাম, আমি কি করছি না করছি সেটার খোঁজখবর রাখছে কেন রে বাবা মেয়েটা?

আমি কিছু বলছি না দেখে সে আবার বলল, “আমি খুব ভুল করেছিলাম তোমাকে বিয়ে না করে কিন্তু সেটা বোঝার বুদ্ধি আমার তখন ছিল না! অ্যান্ডিকে বিয়ে করেছিলাম পালিয়ে, সে ছিল একটা রাক্ষস! সেটাও তখন বুঝতে পারিনি। মা-বাবা কত করে বারণ করেছিলেন, কিন্তু আমি তাঁদের কোন কথা শুনিনি। অ্যান্ডি আমাকে মদ আর ড্রাগের নেশা ধরিয়েছিল। কোন রকমে সেই রোগ থেকে নিজেকে মুক্ত করেছি রিহ্যাবে গিয়ে গিয়ে। অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম যেন। যখন জ্ঞ্যান হল তখন বুঝলাম সে আমার শরীর থেকে রক্ত শুষে নিয়ে ছিবড়েটা ফেলে দিয়েছে! বাড়ি, গাড়ি কিছুই আর নেই। মা বাবাও নেই আর আমি পেটের দায়ে নাইটক্লাবে ওয়েট্রেসগিরি করছি! এটা মনে হয় আমারই পাপের শাস্তি, অনেক মানুষকে অনেক কষ্ট দিয়েছি আমি, তোমাকেও! পারলে আমাকে ক্ষমা কোরো! যাক যেতে হবে এবার, ম্যানেজার ইশারা করছে। আমার কথা বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে! তবে দেখা হয়ে ভালো লাগল। এই কথাগুলো বেশ কিছুদিন ধরে তোমাকে বলতে চাইছিলাম। মনটা এখন অনেকটা হাল্কা লাগছে। ভালো থেকো!” বলে অর্ডার নিতে অন্য টেবিলে চলে গেল অলকানন্দা। আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম সেই দিকে।

ওর এই রকমটা হোক আমি উঠতে বসতে বার বার কামনা করেছি পনেরো বছর ধরে। অতগুলো বছর এই দেশে থেকে, সব কিছু পেয়েও প্রত্যাখ্যানের একটা সুতীক্ষ্ণ কাঁটা ক্রমাগত খচখচ করেছে বুকের মাঝে! কিন্তু এখন ওকে এই ভাবে দেখে কোন রকম সুখ হল না আমার মনে। ভেবেছিলাম অলকানন্দার জীবন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলে আমি মনে শান্তি পাব কিন্তু সেই রকম কিছুই হল না। ক্ষমা চেয়ে নিয়ে হেরে গিয়েও যেন জিতে গেল অলকানন্দা!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *