পরপর দুটো সিগারেটের ধোঁয়া বুঝি নিতে পারল না সে। কাশি হল খানিকটা। বুকের মধ্যে এতক্ষণ যে যন্ত্রণা হচ্ছিল তার ওপর প্রলেপ পড়লো বুঝি! আশ্চর্য! কাশির সঙ্গে চোখের কোল বেয়ে জলও বেরিয়ে এসেছে। শার্টের হাতায় মুছে নিল তপন।
সামনের আকাশে আজ মেঘের বিস্তার। গুমোট ভাব। বৃষ্টির সম্ভাবনা!
ওদিকে গোছগাছ চলছে নিঃশব্দে। গার্গী কিছুই নিয়ে যাবে না হয়ত। যেটুকু নেবে হয়ত তার নিজস্ব অর্জন। বইপত্র সামান্য জামাকাপড় আর টুকটাক গয়না। আর কিছু সময়ের মধ্যে চলে যাবে সে। যাবার কারণ বলেনি। কোনোদিন কোনো ক্ষোভ বা অভিযোগ সে করেনি মুখ ফুটে। আচমকাই পরশু সকালে বলেছিল – আমি চলে যাব সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
— তার মানে??
— এই বিয়ে বা সম্পর্ক যাই বলো আমি আর থাকতে পারছি না। লিগ্যালিই হোক। তোমার সময়মত ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিয়ো। ঠিকানা জানিয়ে দেব।
এই শেষ সংলাপ। অতর্কিত এই আক্রমণে সে এতটাই হতচকিত হয়েছিল যে কিছু বলার মত খুঁজে পায়নি। হয়ত সম্মানেও বেঁধেছিল!
বৃষ্টি নেমেছে। হাল্কা। বারান্দায় বসেই দেখতে পেল অফিস আর স্কুলের যাত্রীরা ভীষণ ব্যস্ততায় চলেছে বৃষ্টি মাথায় করে।
আজ দিনটা ঘরেই কোনোমতে কাটিয়ে দিয়ে কাল কোথাও বেরিয়ে পড়বে স্থির করে নিয়েছে সে। অফিসে ছুটির দরখাস্তও করে দিয়েছে। ঘুরে বেড়াবে এদিকওদিক! বিয়ের পরে আটবছর পরে একবার মাত্র দুজনে মিলে বেড়াতে গিয়েছিল, পুরীতে। তারপর থেকে কেন জানি আর কোথাও বেরোনো হয়নি।গার্গী ও কোনোদিন মুখ ফুটে বলেনি। কেন যে যাওয়া হয়নি সেই ভাবনাই কেমন যেন আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে তাকে এখন।
দরজায় টোকা পড়ল তখনই, আমি বেরোচ্ছি। দরজা আটকে দাও।
পা কাঁপছে তার। শরীরে কোনো জোর নেই যেন! কোনোক্রমে শরীরটা টেনে তুলে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়িয়েছে! ছোট্ট একটা ব্যাগ হাতে গার্গী পাথরের মূর্তির মত ; তার দিকে না তাকিয়ে বলল, যাচ্ছি।
বেরিয়েও গেল দ্বিধাহীন পায়ে।
কোন্নগড়ের এই বাড়ি থেকে স্টেশন পায়ে হাঁটলে মিনিট দশেক। বৃষ্টির গতি বেড়েছে বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। হেঁটেই ওইটুকু পথ পেরিয়ে গেল গার্গী। সন্ধ্যে নেমেছে যেন এই সকালেই! বারোটার ট্রেনে আসবে অভিনয়। তারপর আজই কলকাতা থেকে রাতের ট্রেনে চণ্ডীগড়। ঘড়ি দেখল, সোয়া এগারোটা!
স্টেশনে পরিচিত মুখ অনেক। অনেকেই কৌতূহলী। বিশেষত এই সময়ে একলা সে স্টেশনে দেখে কয়েকজন ইতস্তত এসে জিজ্ঞেস ও করে গেল, কোথাও যাচ্ছেন? দাদা কই?
সবাইকেই একই উত্তর দিয়েছে সে দায়সারা গোছে, একটু দরকারে যাচ্ছি…।
বুকের মধ্যে অস্থির রকমের উত্তেজনা টের পাচ্ছে সে। অজানা ভয় আর আনন্দ মিলেমিশে অদ্ভুত এক অনুভূতি! ফাঁকা ও হয়ে গেল একসময় স্টেশন চত্তর। অফিস, স্কুলের যাত্রীরা বেরিয়ে গেছে। তাছাড়া ঝড় বৃষ্টিতে এমনিই লোক কম আজ।একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো সে।ঘড়ির দিকে চোখ চলে যাচ্ছে শুধু বারবার।
ফাঁকা ঘর! এক লহমায় কেমন শূণ্য হয়ে গেছে! গার্গীর উপস্থিতি চোখে পড়ার মত থাকে। সারাদিন কিছু না কিছু কাজে ব্যস্ত থাকে। আজ বড় শান্ত পরিবেশ! ঘরের মধ্যে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ালো তপন খানিকক্ষণ। তারপর সিগারেট ধরালো একটা। মনেমনে প্রশ্ন গুলো আসাযাওয়া করছে – কেন? কেন চলে যাওয়ার এই সিদ্ধান্ত নিল? কবে কোথায় ছন্দপতন হল বোঝেনি তো সে! কোথায় যাচ্ছে? বড় আত্মসম্মানে লেগেছিল বলেই জিজ্ঞেস করেনি সে।
ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁতেই বুকের ভেতর থেকে হৃদপিন্ডটা লাফিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো যেন গার্গীর। যেন দমবন্ধ হয়ে যাবে। বাতাস ক্রমশ সাইক্লোনের রূপ নিচ্ছে এদিকে।
নির্দিষ্ট সময়ের কিছু পরে ট্রেনটি এলো। অল্প কয়েকজন নেমে পড়েছে দ্রুত গতিতে। উদভ্রান্তের মত খুঁজছে মানুষটাকে গার্গী। নেই! কোথাও নেই তো অভিনয়! ট্রেনটি বেরিয়ে গেল। মোবাইলে ফোন করল সে। সুইচড অফ!
পরবর্তী ট্রেনের আগমনসূচি ঘোষণা করে যাচ্ছে ঘোষক। একটি একটি করে ট্রেন এলো। চলেও গেলো। শরীরের সমস্ত স্নায়ু ক্রিয়াবিক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে যেন তার।মস্তিষ্ক কাজ করছে না। একটি ভাঙাচোরা আসবাবের মত পড়ে রইলো সে স্টেশনের বেঞ্চিতে। কোথায় যাবে এই মুহূর্তে, কার কাছে ভাবতে গিয়েও মস্তিষ্কের ভেতর অন্ধকারটিই আরো গভীর হল।
ঘুমিয়েই পড়েছিল তপন চেয়ারে বসে বসেই। সিগারেট কখন নিভে গেছে খেয়াল ও নেই! আচমকাই যখন ঘুম ভাঙলো প্রথমে কিছুই বোধ হল না তারপরেই অদ্ভুত এক হাহাকার বোধ আচমকাই ছড়িয়ে পড়ল! কী যেন নেই! কী যেন হারিয়ে গেছে! একটি কী দুটি নিমেষ মাত্র! উঠে পড়ল সে চেয়ার ছেড়ে। জানলা দিয়ে বৃষ্টি এসে ঘর জলে থৈথৈ! ঘন অন্ধকার বাইরের পৃথিবী। এ কী দুর্যোগ! কুকুর বেড়াল পথে বেরোয় না এই দুর্যোগে আর গার্গী… !
কতদূর চলে,গেল সে! কতদূর?
তবু কে যেন কুহকের মত ডাকছে তাকে। স্টেশন চত্তরটি শূন্য জেনেই বেরিয়ে পড়ল কী এক আশ্চর্য আহ্বানে!
গার্গী!! বসে আছে ভাঙাচোরা বেঞ্চির এককোণে কুণ্ডলী পাকিয়ে! গার্গীই তো! এক বিস্তীর্ণ শূন্যতার মধ্যে একটিমাত্র জীবন্ত প্রাণী! তপনের মনে হল, এ ভ্রম! এ হতে পারেনা। এ তার উইশফুল থিঙ্কিং! হাঁটু কাঁপছে তার প্রচণ্ড উত্তেজনায়। দু’ পা এগোতেই দৃষ্টি স্থির হয়ে গেছে তার। গার্গীই তো! যায়নি তবে? তাকে ছেড়ে, সংসার ছেড়ে কোথায় যাবে সে? এই দশবছরের সম্পর্কের মায়া ছেড়ে কোথায় যাবে সে? অভিমান করে বেরিয়ে এসেছিল হয়ত তার শূন্যতা উপলব্ধি করার জন্য। এতই সহজ গ্রন্থিহীন হওয়া! অভিমানী মেয়ে বসে আছে তারই অপেক্ষায়। নিজেকে ধমক দিল তপন, এত কষ্ট দিলি মেয়েটাকে? আরেকটু আগে আসতে পারলি না?
— চলো। বাড়িতে।
কুঁকড়ে গেছে গার্গী। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তখনো।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে এখানে ক্লিক করুন