short-story-profile

প্রোফাইল
জয়তী রায়



— ফেল!

শব্দটা চাবুকের মত আছড়ে পড়ল মুখের উপর — ফেল করে গেলি রে জিৎ। যা যা বাড়ি যা। আর কোনো লাভ নেই।

কথাটা বলে জোরে হেসে ওঠে ভিকি।

আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে ফেলু ছাড়া আর কিচ্ছু মনে হয় না জিৎ মুখার্জির। স্কুল — কলেজে প্রথমসারি হয়েও জীবনের পরীক্ষায় ফেল করা হয়ে উঠেছে অমোঘ নিয়তি। এখন উনিশ — এই বয়সে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বন্ধুরা আর সে দেখভাল করছে পরিবারের। মা চলে গেল, রেখে গেল পুচকি বোন টুকটুকি। আচ্ছা, তেরোবছরের তফাতে একটা বোন হলোই বা কেন? এমন একটা নিষিদ্ধ প্রশ্ন করবে কাকে? নিয়তিকে ছাড়া? সেই থেকে জীবনটাই বদলে গিয়ে লটরপটর ফেলু মার্কা হয়ে হয়ে বইতে লাগল, সারাক্ষণ তোম্বা মুখে হিসেব কষতে হলে হাসি আর কোথায় থাকবে? রাকা অবশ্য এই সব দুঃখ টুঃখ পাত্তা না দিয়ে বলে — দেখ জিৎ, তোকে চিনি সেই ক্লাস ফাইভ থেকে। দুজনে একই কলেজে পড়ছি এখন। কাকিমার চলে যাওয়াটা শকিং কিন্তু, তুই সবসময় প্যাঁচার মত মুখ করে থাকিস এটাও ঠিক না। আমি থাকি? আমারও মা নেই।

উত্তরে গোঁজ হয়ে জিৎ বলেছিল — তোর দশটা কাজের লোক, চারটে গাড়ি, হাই ফাই বাবা — তুই যা চাস করতে পারিস।

রাকা অবাক হয়ে বলেছিল — টাকা দিয়ে সব হয়?

— কেন হবে না? সেই সতেরো বছর বয়েস থেকে সিনেমা নিয়ে ভাবছি, পড়াশুনো করছি, কেউ দিল আমায় সুযোগ?

— তুই এখুনি ভাবছিস এমন?

— রাকা, এটাই বয়েস রে। করতে হলে এখনই করতে হবে।

রাকা সেদিন গুছিয়ে বসে বলেছিল — বল, তুই কী চাস?

— না রে। হাসবে সবাই।

— কে সবাই? রাকা সেন কথা শুনছে সেখানে হাসবে কার ক্ষমতা আছে? তুই বলে দেখ।

জিৎ বলেছিল। বলেছিল, ও একটা স্ক্রিপ্ট লিখেছে, সিনেমা করতে চায়। এর মধ্যে টুকটাক যা কাজ করেছে, তাতে অভিজ্ঞতা বেড়েছে। সেইটুকু পুঁজি নিয়ে নামতে চায় নতুন দুনিয়ার মাঠে।

রাকা বলল — নেমে পড়। আটকাচ্ছে কে?

— টাকা।

জিৎ বলে — এইসব কাজে খরচ করার মত টাকা নেই আমার।

রাকা সেদিন অভয় দিয়েছিল — একটা কাজ কর। ড্যাড ফাইন্যান্স করবে। তুই স্ক্রিপ্ট নিয়ে আয়। দেখি, মালটা কেমন।

পছন্দ হলে, বিন্দাস থাক।

মুখের ভাষা উল্টোপাল্টা কিন্তু মনটা খাঁটি সোনা। বুকের ভিতর লাখ তুবড়ি ফোটানোর শব্দ শুনতে শুনতে বাড়ি পৌঁছে কোনমতে রাতটুকু কাটিয়ে আজ এলো রাকার বাড়ি। ভিড় করে আছে গ্যাংয়ের সব কটা চাঁদমুখ, মধ্যমণি রাকা আদেশ দিলে মোবাইল খুলে স্ক্রিপ্ট পড়া শুরু করতেই রাকা এমন চেঁচিয়ে উঠল যে জিৎ বুঝে গেল — আবার ফেল। হল না সিনেমা। কোনোমতে সে বলতে পারল — হলো কী?

রাকা ঠোঁট টিপে, চুল ঝটকে বলল — নামটা বল আবার?

— চয়ন নামের ছেলেটি।

— এটা নাম?

— চয়ন নামের ছেলেটি প্রেমে পড়েছে রানি নামের মেয়েটির — তারপর অপেক্ষা —

জিৎ শেষ করতে পারে না, আগেই চেঁচিয়ে ওঠে রাকা

—- উফ্! আবার সেই প্যান প্যান? আজকাল হয় এমন প্রেম? জিৎ, পরিষ্কার বলছি ওইসব টিপিক্যাল প্রেম দেখালে আমি নেই। বাবার টাকাও নেই!

উত্তেজিত রাকা সিগারেট ফুঁকছে জোরে জোরে। জিৎ অসহায় মুখ করে তাকায় গ্রুপের দিকে। রাকা আর ওর টাকা — দুটো কম্বো না থাকলে সিনেমা তো দূর মাঠে তেরপল টাঙিয়ে নাটক করার ক্ষমতা রাখে না জিৎ।

বেগুনি রঙের চুল সামলে সিমলি সাপোর্ট করে রাকাকে — নামটা বোগাস। ঝক্কাস নাম চাই।

গাধা! ইল্লি ন্যাকু। বেগুনি চুল, ছেঁড়া হট প্যান্ট আর রাকার গাড়ি চেপে ঘুর ঘুর করা ছাড়া কি করতে তুই পারিস সিমলি? মাথায় গোবর, এসেছে সিনেমা নিয়ে জ্ঞান দিতে।

মনে মনে গর্জন করে মুখের মিষ্টি হাসি বজায় রেখে জিৎ বোঝায় — রাকা, ট্রেন্ডের বিপরীতে যেতে হবে। খুল্লাম খুল্লা সেক্স, লিভ টুগেদার — ঝড় বইছে সোসাইটির চারিদিকে। তার মধ্যে কাশ ফুটছে, পুজো আসছে, ধুনোর গন্ধ, ঢাকের আওয়াজ — বনেদী বাড়ির সাবেকি পুজোয় গমগম করছে চারিদিক — এমন একটা অন্যরকম পরিবেশে, চয়ন আর রানির প্রথম দেখা।

— আমাদের ম্যানেজারের নাম চয়ন।

গম্ভীর সুরে বলে ওঠে ভিকি। রাকার আরেকটা চামচা। ওই যে বলে না? লোভে পাপ পাপে মৃত্যু। মধ্যবিত্ত সাধারণ ঘরের ছেলে হয়ে দরকার কি ছিল চাঁদে হাত দেওয়ার? চাঁদ নয় — বলা যায়, আগুনে হাত দেওয়ার নিট ফল হেরো হয়ে ঘরে ফিরে যাওয়া।

জিৎ মোটামুটি বোঝে সিনেমা ব্যাপারটা। বিখ্যাত পরিচালকদের কাছে ঘেঁষে থাকে। হাতে কলমে দুটো একটা ডকুমেন্টরি বাজারে ছেড়েছে। একেবারে আনাড়ি মোটেই নয়। ফাইন্যান্স যখন সলিড — লেগে পড়া যেতেই পারত।

চয়ন নামের ছেলেটি — মিঠে গল্প। রাকা জ্বলে উঠল নাম শুনেই। প্রেম ব্যাপারটা না কি ন্যাকা। ফালতু। মধ্যবিত্ত সেন্টুদের বাড়িতে থাকে ওইসব — গদগদ ভ্যাবলাকান্ত ছেলের দল।

জিৎ বোঝে, — প্রতিটি শব্দ বিষের মত তাকেই বিঁধছে। মন খারাপ হয়ে যায়। না হয় সে মামুলি মধ্যবিত্ত। না হয় তার চেহারাটাও সাধাসিধে। কোনোরকম। দামি পার্লারের ফেসিয়াল নেই। চুলের বাহার নেই। সেকেন্ডইয়ারে উঠে ড্রিংক করলেও সিগারেট খায় না। মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করতে ঠিক পেরে ওঠে না, তাই বলে তার কী কোনো গুণ নেই?

রাকা বলবে — না নেই! দুনিয়া তোকে ল্যাং মারবে আর তুই? চুপ করে সরে আসবি। কেন? উল্টে থাপ্পড় কেন মারবি না?

জিৎ অবাক — কখন মারল ল্যাং?

মুখ ভঙ্গি করে চুল ঝাঁকিয়ে রাকা বলবে — অদ্ভুত! ভুলে গেলি? সেবার পিকনিকে যাওয়ার পর? পাগলি মিমি তোকে নিয়ে মজাক করছিল, তুই বুঝিস নি?

— ও ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সবাই একসঙ্গে হলে ওরকম পিছনে লাগেই। ওতো সিরিয়াস হওয়ার মত কিছু না।

— সিরিয়াস হওয়ার মত কিছু না?

রাকা আকাশ থেকে পড়ল — এই জন্য দেখতে পারিনা তোদের মত ছেলেদের। আত্মসম্মান বলে কিছু নেই? আমার বাবা হলে দেখিয়ে দিত মিমিকে।

উফ্। এই হয়েছে জ্বালা। রাজন সেন নামক ধনী নাক উঁচু গোল্লা মোটা ফর্সা শরীরের লোকটা … যিনি কিসের বিজনেস করেন জানা নেই। জেনে কাজও নেই। অদ্ভুত ব্যাপার হল, সেই ছোট্ট থেকে আজ পর্যন্ত যতবার রাকার বাড়ি গেছে, ভদ্রলোককে দেখেছে, সামনের বিশাল ড্রয়িংরুমে বসে ফোনে কথা বলছে আর বিশাল বপু কাঁপিয়ে হাসছে। জিৎ ঘরে ঢুকলে ফোন নামিয়ে তিনি আদেশ করবেন — এ্যাই। কোই হ্যায়? ইসকো খিলাও পিলাও।

যেমন বাবা তেমনি মেয়ে। সেদিন কিছুই তেমন করে নি মিমি। জিৎ সুইমিং জানে না শুনে বলেছিল — তুই গড়িয়ায় থাকিস। পুকুরে সাঁতার কাটিস নি?

জিৎ বোকার মত উত্তর দিয়েছিল — পুকুর কোথায়? গড়িয়া তো শহরের মধ্যে।

— কোন্ শহর?

— ওই যে গড়িয়ার ওই দিকে।

ব্যাস! মিমি বেদম হাসতে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে গোটা দলটা হাসে। এতে হাসার হল কী? বালিগঞ্জ ছাড়া কলকাতা হয় না? সে বেকুবের মত দাঁড়িয়ে ছিল। রাকা কোথেকে ছুটে এসে মিমির গালে এক বসিয়ে দিয়ে চেঁচায় — হাউ ডেয়ার ইউ? একদম লাগবি না ওর পিছনে। নও ও ও।

ব্যাস! এরপর থেকে মিমি বিষ নজর দিয়ে দেখে। ভিকি রেগে থাকে। সহ্য করতে পারে না। স্কুল মাষ্টারের ছেলে কেন পড়বে শহরের নামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে? রেজাল্ট কেন ভালো করবে? কেন একই সঙ্গে একই কলেজে অনার্স পড়তে আসবে? সবচেয়ে রাগের কারণ অন্য। রাকা কেন এত প্রশ্রয় দেবে?

জিৎ ধনী না হলেও গরীব মোটেই নয় তাদের পরিবার। স্কুল মাষ্টারের বেতন খারাপ নয়। বাবা – ঠাকুমা, ছোটবোন টুকটুকি — নিজেদের বাড়ি। অভাব তো একেবারেই নেই। তার চেহারাটা সাধারণ। লম্বা, রোগা। ভাসা ভাসা বড় দুটো চোখ, এলোঝেলো চুল – উনিশ বছরের সারল্য ছড়িয়ে আছে হাসিতে। ভিকির মত ড্যাশিং নয়। ভিকির পেটানো চেহারা। জিম করে আরো কি কি সব করে। বাদামি চোখের মণি নিয়ে ভিকি এক্কেবারে ঋত্বিক রোশন। কই? তাকে কেউ কিছু বলে? রাকার মুড ভালো থাকলে বলবে — ওদের কথা বাদ দে। তোর চিন্তা নেই। আমি আছি।

এইসব সময়ে মুচড়ে ওঠে বুকের ভিতর। রাকা যদি আর একটু নরম সুরে কথা বলত! আর একটু বুঝত কি চায় জিৎ? এই তো সিনেমা নিয়ে এমন করছে, যেন একটা ভিখারির সঙ্গে কথা বলছে! নাহ্। সিনেমার প্রজেক্টে থাকবে না। যা খুশি করুক। টাকা নেই বলে কি আত্মসম্মান নেই? চুলোয় যাক রাকা আর তার সিনেমা।




সেদিন বৃষ্টি। জিৎ ভাবল আজ কলেজ যাবে না। ম্যাজ ম্যাজ করছে। টিপ টিপ করছে মাথা। চারিদিকে ডেঙ্গু। তার কিছু হলে নাজেহাল হয়ে যায় বাবা। টুকটুকি ছোট। ঠাকুমা বাতের বাধায় কাতর। জিৎ অনেক কাজ করে দেয়। রান্নার মাসী সকালে আসার আগেই ছুটে গিয়ে নিয়ে আসবে টাটকা মাছ। মেপে জুকে ধনেপাতা কাঁচা লঙ্কা। মায়ের রেখে যাওয়া পুজোর আসনে জল বাতাসা। এগুলো না করলে দুটো ঝোল ভাত খেয়ে সময়মত বাস ধরবে কি করে বাবা? মাঝে মাঝে কাঁদে টুকটুকি। অকারণে কাঁদে। জিৎ তেরো বছর অব্দি ছিল মায়ের কাছে। টুকটুকি জানে না, মা কি, মা কে? এখন ওর বয়স পাঁচ। এই অবোধ শিশুকে বাঁচিয়ে রেখে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর মধ্যে কত রকমের লড়াই — রাকা জানবে কি করে! বহুদিন এই বাড়িতে তুমুল হেসে ওঠেনি কেউ। মুড়ি তেলেভাজার সঙ্গে গোল হয়ে আড্ডা? কে করবে? ভিকি শিখেছে সুইমিং বিখ্যাত ক্লাবে, ভিকি বাইক চালায় — কেউ যদি তুলনা করে সুখ পায় — পাক। তার মাথায় বিনবিন করে একটা — ওরে তোকে মানুষ হতে হবে।

— কে বলত? তোমার মা?

সুধা প্রশ্ন করে।

রাতের বিছানায় আলগা ছেড়ে দেওয়া শ্রান্ত শরীরে সবুজ আলোয় ভেসে আসা শব্দেরা মিলে তৈরি করে মায়ার জগৎ। জিৎ আর সুধার জগৎ। প্রতিদিনের শেষে অপেক্ষায় থাকে দুজনে — মায়াবী সময়টুকুর জন্য। ফেসবুকে আলাপ। সুধা বলেছিল — ইংলিশ মিডিয়াম? তারপরে আবার এমন নামী কলেজ? আমি ভীষন সাধারণ। বাংলা অনার্স।

জিৎ বলেছিল — আমি আলাপি নই তেমন। তোমার রিকোয়েস্ট দেখে অবাক হয়েছিলাম।

— অবাক কেন?

— আমার সাধারণ প্রোফাইল। বাইক নিয়ে ছবি নেই। কায়দা নেই। মেয়েরা আমায় পছন্দ করে এটা ভাবতেই পারি না।

উত্তরে লাভ সাইন ভেসে আসে। আদর মাখানো শব্দে লেখে সুধা — আমার প্রোফাইল আমাদের গ্রামের মতোই সাধারণ। যে ছবিটা দেখছ? বিনুনি করা মেয়েটি, চোখে কাজল — তোমার শহরে এমন মেয়ে দেখোনি। সাধারণ অতি সাধারণ।

— তাতে কি হয়?

— রাকা সিমলি ভিকি — দুর্দান্ত দুরন্ত। তুমি ওদের মত হতে চাও না?

— নাহ্। চাইনা ওদের মত জীবন। নামের মত মায়াময় প্রোফাইল তোমার। সবুজ মাঠের ছবি, ধানক্ষেত, দুটো শালিক। আঃ। কতদিন দেখিনি।

— সাধারণ জীবন ভালো লাগে তোমার? রাকা কত বড়লোক! মহলে থাকে।

জিৎ শ্বাস ফেলে। ছোট ছোট শব্দ লেখে — মহল থেকে পৃথিবীর সমস্ত কিছু সুন্দর লাগে, সুধা। বৃষ্টিতে ভেজা কলকাতার কোনো অসুবিধা চোখে পড়ে না। লাইন দিয়ে দুধ আনতে হয় না। রেইন পার্টি হয়। উদ্দাম নাচ হয়।

সুধা লেখে — আচ্ছা, আমাকে দেখে কী মনে হয়?

— একমুঠো ভিজে বাতাস। শরীর ছুঁলে ঠান্ডা হয়ে যায় ভিতরটা।

— তাই? আর?

— আর কিচ্ছু না। এমন থেকো। সুন্দর হয়ে।

ফোন হাতে নিয়ে জিৎ চুপ করে রইল। কি ভাবে বলবে যে, সুধা তার মায়ের মত? বানিয়ে বলা মনে হবে না? আজকাল ছেলেরা এইরকম করেই পটায় মেয়েদের। সুধা ভুল বুঝতে পারে। জিৎ কিছুতেই চায় না। দিনের শেষে ওয়েসিসের মত মেসেজগুলো এনার্জি দেয়। কত নরম কত শান্তির কথা বলে মেয়েটা — জিৎ, তুমি খেয়েছ? টুকটুকি আজ কোন্ গল্প শুনল? রান্নার মাসী এসেছিল? ঠাকুমার মালিশ খুঁজে পেলে? দাঁড়াও, আমি অনলাইন দেখে দেব।

প্রতিদিনের যে কথাগুলি অন্যের কাছে ফালতু, বেকার — ভুলেও শেয়ার করে না জিৎ। সেই কথা গুলো হৃদয় খুঁড়ে খুঁজে নেয় সুধা। ঠিক যেন সেই স্কুলবেলার মত। জিৎ আপন মনে বকবক করছে মায়ের সঙ্গে। ঠিক তেমন। ভেবেছিল, সিনেমাটা হলে চমকে দেবে সুধাকে। কল্পনায় দেখতে পাচ্ছিল, খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে মুখ। হেসে বলে উঠবে — ওমা! তুমি মুভি বানাও? তোমার গুণের সীমা নেই জিৎ।

নাহ্। কাউকে বলেনি। কেন বলবে? ভিকি, শেলী, মিমি, সিমলি, রৌনক — এরা না হয় তেমন ক্লোজ নয়, কাছের বন্ধু নয়, কিন্তু রাকা? সেই স্কুল থেকে একসঙ্গে পড়েছে। এখন কেমন বদলে গেছে। এমন ভাব দেখায় যেন জিৎ পাতি গরীবের ছেলে। মোটেই নয় সেটা। বাবা ভালোই মাইনে পায়। মা নেই, তাই এলোমেলো হয়ে গেছে সংসারটা। অপটু হাতে কত সামলাবে জিৎ? এইটা রাকা বুঝবে না? না বুঝুক। আজকাল আর কষ্ট হয় না। সুধা আছে। সুধা বুঝিয়েছে — রাকা মানুষ খারাপ নয়। হয়ত — হয়ত — তোমাকে অন্যের চোখে হিরো দেখাতে চায়।

জিৎ মানতে পারে না — ধুত। তুমি ভাবছ। সবাইকে ভালো ভাবা তোমার স্বভাব।

সুধা ছাড়ে না। কুটকুট করে টাইপ করে — কথামৃতের গল্প রোজ পড়ে শোনাচ্ছ টুকটুকির জন্য, আর এটা জানো না?

জিৎ অবাক। এ মেয়ে কোথা থেকে যাচ্ছে কোথায়? এর মধ্যে রামকৃষ্ণদেব কেন এলেন?

সুধার মেসেজ আসে — সেই সাপের গল্প? হিংসে না করো কিন্তু প্রতিবাদ করো। বলে দেবে — বাইক নেই না কি নেই সেটা বুঝব আমি। ফোঁস করবে। দেখবে, কেউ আর সাহস পাবে না। হয়ত এটাই চায় রাকা।

জিৎ লেখে — তুমি চেনো ওকে? প্রোফাইলে গিয়ে দেখো। বুঝবে। হাই – ফাই। নিত্য নতুন গাড়ির ছবি। ড্রেস। বয়ফ্রেন্ড। নাইট ক্লাবে পার্টি। সব ট্রেন্ডি। বিদেশে যায় যেন ক্যানিং ঘুরতে যাচ্ছে। কোনো দুঃখ নেই।

সুধা লেখে — আছে দুঃখ। তুমি বলেছিলে, ওর মা ওদের ছেড়ে চলে গেছে প্রেমিকের সঙ্গে। বিয়ে করে আছে বিদেশে। তাই না?

জিৎ গোঁজ হয়ে লেখে — বড়লোক মহিলা। গাড়ি শাড়ি সম্পর্ক — সবকিছু নতুন চাই।

সুধা লেখে — রাকা ছোট্ট ছিল। এখনো হয়ত অপেক্ষায় থাকে মায়ের জন্য।

চোখে না দেখেও বুঝতে পারে সুধার মুখ মলিন। দুখী সাইন আসতে থাকে একের পর এক। সুধা থাকে গ্রামে। ওর বাবার কিসের যেন দোকান করেন। সুধা একটাই মেয়ে। মা আছে। পুকুর আছে। বাড়ি ঘর আছে। মাঝে মাঝে ছবি পাঠায় সুধা। ওদের জীবনে টাকা ছাড়া বাকি সবটুকু সুখ আছে। সুধা আবার লেখে — অপেক্ষায় থাকা বড্ড যন্ত্রণার। তোমার মা বেঁচে নেই। কষ্ট আছে, অপেক্ষা নেই। রাকা হয়ত অপেক্ষা করে। বাইরে সুখী ভিতরে নিঃস্ব।

জিৎ মানতে পারে না। প্রতিবাদও করে না। সুধা যদি চায় এমন করে ভাবতে, দোষ কী? সাধারণ প্রোফাইল আর অসাধারণ হৃদয় নিয়ে ওর কাছে থাকুক, ব্যাস!




রাকা ডেকেছে। শুক্রবার রাতে ওর বাড়ি মিটিং। সঙ্গে ইটিং ড্রিকিং তো আছেই। এরকম পার্টি প্রায়ই করে রাকা। জিৎ যেতে চায় না। বাবার উপর চাপ পড়ে যায়। রাকা সমস্ত জেনেও এরকম টর্চার করে। অসুবিধার কথা বললেই বা শুনছে কে? বন্ধুবেশি ছুরির ফলা এক একজন। মুখ টিপে হাসবে কনুইয়ের গুঁতো দেবে — জিৎ বিয়ে না করেই সংসারী সেটা বুঝিয়ে ছাড়বে। আগে আগে কষ্ট হত। প্রচন্ড উথাল পাথাল করত বুকের ভিতর, আজকাল অল্পতেই থিতিয়ে যায় কষ্টের বোধ। জানে, একজন অপেক্ষা করছে। সুধা গাছ। বৃক্ষরূপী অমৃত। যার মাটিতে বিষটুকু ঢেলে আরামে ঘুমিয়ে পড়ে জিৎ।

এবারের পার্টি অবশ্য কাজের জন্য। বলছে, সিনেমা সংক্রান্ত কি সব আলোচনা করতে চায়। মেসেজ করেছে — চলে আসবি। বাড়িতে বলে আসবি। এই শোন, তোর জন্য সুখবর আছে।

জিৎ স্মাইলি দেয়। রাকা লেখে — তোর স্বপ্ন সফল হবে হয়ত।

ব্যাস। সবুজ আলো অফ করে দিল। মাথা গরম হয়ে যায়।

কিরকম অদ্ভুত ঝুলিয়ে রাখল মেয়েটা? এইগুলো করে উৎকট আনন্দ পায় পাজিটা। বুঝতে পারছে, বুকের মধ্যে ড্রাম বাজছে, শরীর কাঁপছে, সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবনের কাছে এটা তো প্রায় লটারির সমান। রাকা জানে তবু নিষ্ঠুরের মত চুপ করে যাবে।

আজ এসপার – ওসপার করেই ছাড়বে। এত টেনশন নেওয়া যায় না। সুধা বলেছে — আজ না হয় কাল আসবে সুযোগ। মনে মনে আবারও একবার গলে গেল জিৎ। সুধা। সুধার জন্য এমন করে ভাবতে পারে! এমন সাহস পায় ভিতর থেকে!

রাকার নিজস্ব বিশাল বসার ঘর, কৃত্রিম ঝর্ণা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা চেয়ার, উর্দি পরা বেয়ারার নিঃশব্দ পরিবেশন আর ভিকির উদ্দাম গিটার বাজনা, মিমির কিনকিন গলায় ইংরেজি গান

— সব মিলিয়ে লাগাম ছাড়া পরিবেশে বিরক্তি গ্রাস করতে করতে জিৎ শুনল, রাকা বলছে — চিয়ার্স! সিনেমাটা ফাইনালি হচ্ছে।

ফ্রেন্ডস! প্লিজ, কংগ্রাচুলেট টু জিৎ। গতকাল প্রবুদ্ধ দা এসেছিল আমাদের বাড়ি। ড্যাড প্রোডিউসার হতে চায় শুনে দাদা বললেন, সবরকম হেল্প করবেন।

বলেই ঘুরে ঘুরে ক্ল্যাপ দিয়ে উঠল রাকা। সঙ্গে সঙ্গে চামচারা ঝাঁপিয়ে পড়ল। ধাই ধাই ধপ ধপ হাতে তালি টেবিলে তালি — রাকার পরণে আজ লাল সিল্কের স্লিভলেস ড্রেস। ফর্সা শরীরে কেটে বসেছে ছোট ফ্রক। ফুলের মত ফুলে উঠছে নিচে রোমহিন ফর্সা পা, দ্যুতি মাখা চোখ, মিউজিকের তালে তালে দুলে উঠে এগিয়ে আসছে জিতের দিকে পরক্ষণে পিছিয়ে যাচ্ছে।

এ কি রহস্য? খুলে কেন বলছে না পুরো ঘটনা? প্রবুদ্ধ চ্যাটার্জি করছেন মুভি? কাহিনীকার জিৎ? উফ্। এ যে স্বপ্ন?

মেয়েটা নাচছে কেন? স্বপ্নের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ যদি নাচে, সে যদি অপ্সরা হয় তবু মনে হয় গরম তেল ঢেলে দিচ্ছে শরীরে! জিৎ আর সহ্য করতে পারল না। আচমকা চেঁচিয়ে উঠে বলল — স্টপ ইট রাকা। পরিষ্কার করে বল — আমি সিনেমাটা করছি কি না?

জড়ানো গলায় রাকা উত্তর দিল — ইয়েস। তুই করছিস।

— ভূত প্রেত ম্যাজিক আমি করব না, বলে দিলাম।

— ওরে না না। ওই কি যেন — চয়ন একটি ছেলের নাম — ওইটাই। কি? এবার খুশি তো?

ঘর ফেটে গেল করতালিতে। ভিকি এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল। শেলী বলল — জিৎ, তোর জন্য শ্যাম্পেন এনে রেখেছি।

নিষ্ঠুর ছেলে মেয়েগুলোর মুখ বদলে মোমের মত গলে যাচ্ছে খুশিতে। মিমি বলল — জিৎ হচ্ছে জিনিয়াস। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ব্রাইট।

ভিকি, রৌনক, ফিরোজ সকলে চেঁচিয়ে উঠছে — জান লড়িয়ে দেব। শপিংমলে প্রোমো করব। জিৎ, তোর সিনেমা হিট হবেই।

ফটাস করে শ্যাম্পেন খুলল রাকা। সকলের বাহুবন্ধনের মধ্যে থেকে শ্যাম্পেন খেতে খেতে জিৎ দেখল, রাকা এখন দেবীর মত বরাভয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে কত গালি দিয়েছে মেয়েটাকে। আজ সরি বলে যাবে। রাত যত বাড়ছে খুশির ফোয়ারা তত উপচে পড়ছে। টুকটুকি মনে পড়ছে না। সুধা হয়ত জেগে থাকবে? সে থাকুক। কাল না হয় মেসেজ করে দেবে। এখন সামনে রাকা ছাড়া কাউকে দেখতে ইচ্ছে করছে না। গ্রামের ধারে নদীর পাড়ে খোলা চুলের কালো চোখের মেয়েটি অপেক্ষায় থাক।

অপেক্ষা! চয়ন অপেক্ষায় ছিল — সিনেমার কাহিনী অনেকটা এইরকম। চয়ন অপেক্ষায় থাকে। প্রেমিকা আর ফেরেনি। গল্পটা ভাবার সময় নিজেকে চয়ন আর প্রেমিকা বলতে রাকা মনে হয়েছিল। নিষ্ঠুর ভাবে প্রতারণা করে প্রেমিকা। অপেক্ষায় থাকে চয়ন। অনন্তকাল। নদীর পাড়ে বুড়ো বটগাছের নিচে বসে থাকে। সূর্য ডুবে যায়। একসময় দেখা যায়, বৃদ্ধ চয়ন শুয়ে আছে গাছের নিচে। শরীরে প্রাণ নেই। অপেক্ষায় ছিল জীবনের শেষদিন পর্যন্ত।

রাত বাড়ছে। শ্বেতমহলের কোনায় কোনায় জ্বলছে নিভু নিভু বেলোয়াড়ি আলো। লালচুল দুলিয়ে ভিকি আন্তরিক স্বরে বলছে — চিন্তা নেই। গড়িয়া হোক কি গড়পার — বাড়ি পৌঁছে দেব আমি। আজ সেলিব্রেট করো।

জিৎ ডুবে যেতে থাকে আনন্দে। উৎসবের সাগর দোলায় ভাসতে থাকে তার উনিশবছরের যৌবন।

কিচ্ছু মনে পড়ে না। কিচ্ছু না। তার জন্য অপেক্ষায় কারা আছে — এইসব ভাবতে মন চাইছে না। সামনের ঘূর্ণিত রক্তচক্রের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত অতীত।




বাড়ির চাবি একটা থাকে নিজের কাছে। জিৎ রেখে দিয়েছে। দেরি হয় ফিরতে মাঝে মাঝে। আজকেও অনেক রাত হয়েছে। গেট খুলে ভিতরে ঢুকতে গিয়ে দেখে বারান্দার তারে ঝুলে রয়েছে বাবার লাল গামছা। ভিজে চুপচুপ। সময়মত তুলে নেয়নি? উফ্। পা টিপে টিপে উঁকি দিয়ে দেখল, ঠাকুমার ঘরে শুয়ে আছে টুকটুকি। মুখটা একটু ফোলা নাকি? কেঁদেছিল? গায়ের চাদর সরে গেছে। বৃষ্টি ভেজা ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। মেয়েটার ধাত আছে। একটুতেই গলা ব্যথা করে। ঘরে ঢুকতে গিয়ে ফিরে এলো জিৎ। থাক। দরকার নেই। দাদা ন্যাওটা হয়ে যাচ্ছে বড্ড। শীত করলে টেনে নেবে চাদর। শিখুক একটু নিজে নিজে। বাবার ঘরে আলো জ্বলছে। নিশ্চয় বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়েছে! প্রতিদিন মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে লাইট বন্ধ করে বাবার অভ্যেস খারাপ হয়েছে তারই জন্য। থাক। আজ লাইট অন থাক। নিজে শিখবে। বউ কী কারো মরে না? এমন কাতর হয়ে পড়লে চলে? এইটাই বলত রাকা। তখন রাগ হত। স্বার্থপর ভাবত। এখন মনে হচ্ছে — ঠিক বলত। প্রতিটি লোকের উচিত স্বাবলম্বী হওয়া। টুকটুকি এত দেরিতে এলো কেন পৃথিবীতে? একটুও বিবেচনা বোধ নেই? একটা সন্তান অকারণে পৃথিবীতে এলো, মা চলে গেল — সব ভেসে গেল। উফ্। যত দায়িত্ব পালন করবে জিৎ? কোনো মানে হয়?

নিজের ঘরে এসে মেজাজ আরো খিঁচড়ে গেল। অগোছালো অনাদরে পড়ে থাকা সাধারণ একটা ঘর। জানালা খোলা। বৃষ্টির ছাঁট এসেছে নির্ঘাৎ। জানালার পাশের কামিনী গাছ, মেঘ ঘেরা আকাশ — আজ কিচ্ছু চোখে পড়ল না। লাইট জ্বালিয়ে দেখে নিল ঠিক আছে কি না ল্যাপটপ। গল্পটা ওর মধ্যে আছে। চয়ন নামের ছেলেটি — বৃষ্টির জল পড়লে হারিয়ে যাবে প্লট। জামাকাপড় একটানে খুলে মোবাইল ছুঁড়ে ফেলল একদিকে। সুধা হয়ত জেগে আছে। নাহ্। ওর প্রোফাইল অন করতে ইচ্ছে করছে না। মাথায় ঘুরছে বিখ্যাত পরিচালক। মনে আসছে রাকার মুখ। স্বপ্নের দরজার চাবির মুখ।

শরীরটা ধপাস করে বিছানায় ফেলে দিল জিৎ, তলিয়ে গেল ঘুমের মধ্যে। অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখল — বসে আছে টাকার পাহাড়ের চূড়ায়। বসে বসে কাঁচকলা খাচ্ছে। রাকা খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলছে — চয়ন নয়, তুই পাবি কাঁচকলা।

তিন চারদিন দম নেবার সময় পেল না জিৎ। বাড়িতে একটু সমস্যা হচ্ছে। একটু নয়, বেশ বেশি হচ্ছে। বাবাকে বুঝিয়েছে — পড়াশুনোর সঙ্গে সঙ্গে এরকম কাজের সুযোগ পেয়েছে — কাজ করছে, আউটডোর যেতে হতে পারে। বাবা একটু সামলাতে পারবে না?

ভাষাহীন বোবা চোখে তাকিয়ে বাবা উত্তর দিলেন — পারব রে। তুই চিন্তা করিস না। আর কত করবি? এবার একটু নিজের কথা ভাব।

অবশেষে মেসেজ করল সুধাকেও। উত্তর এলো অনেকক্ষণ পরে। এটা আশা করেনি জিৎ। একটা সাধারণ মেয়ে, লাফিয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। সে এখন সেলিব্রেটি হতে চলেছে। সুধার প্রোফাইলে তার নাম যোগ হলে ফাটাফাটি হবে না ব্যাপারটা? কিন্তু, সুধা নিরুত্তাপ। আলগা ভাবে লিখল — বলেছিলাম না? রাকা তোমার ভালো চায়? এখন? কী মনে হচ্ছে?

রাকার নাম শুনে শরীরের রক্ত টগবগ করে উঠল, ফুর্তির ইমোজি দিয়ে জিৎ লেখে — রাকা যা করেছে — জীবন বদলে যাবে এবার।

— সিনেমাটা হিট করবে, দেখো।

— করতে বাধ্য। প্রবুদ্ধ দা আছে। রাকার বাবা ফাইন্যান্স করছে। কাশ্মীরে শুটিং।

— চয়ন তো গ্রামের ছেলে। তাই না? তুমি গ্রামে শুটিং করবে না?

জিৎ থমকে গিয়ে লিখল — ভেবেছিলাম। পরে দেখলাম, রাকা ঠিক বলত। গ্রাম – ট্রাম এখন আর পাবলিক নেবে না। হিট ছবি না দিলে — পরে আর চান্স পাব না।

সুধা লিখল — ভেবেছিলাম, এই সুযোগে আমার বাড়ি আসবে। তোমার গল্প কত করেছি। আমার মেনি বেড়াল, কাজলা গাই — চাঁপাগাছে ফুল ফুটেছে — তোমায় দেখাব বলে সাজিয়ে রেখেছিলাম কদমতলার বেদি।

মেসেজ দেখে বিরক্ত লাগে। জিৎ তাড়াতাড়ি লেখে — দেখব তো। কাশ্মীরে ও তো গ্রামেই শুটিং হবে। লোকেশন খুব সুন্দর। মেয়েটা গ্রামের। ছেলেটা শহরের।

—- গল্প উল্টে গেল? মিলন হবে তো?

— সাসপেন্স সুধা। সাসপেন্স। গরীব মেয়ে। বড়লোকের ছেলে বিয়ে করবে কি না — দেখা যাক।

সুধা লেখে — করতে পারে। সিনেমায় করে। গল্পে করে। বাস্তবে করে না।

খোঁচা হজম করে জিৎ। মন খারাপের সময় পাশে ছিল সুধা। এখন তাকে এড়িয়ে চলছে জিৎ। কী করবে সে? বিচ্ছিরি একটা পরিস্থিতি থেকে ভালো জায়গায় যাবে না কি আবার আরেকটা অতি সাধারণ অবস্থায় গিয়ে পড়বে? সে দেখল, সুধা লিখছে — বাই জিৎ। কিছুদিন প্রোফাইল অফ থাকবে। রাগ করো না। তুমিও ব্যস্ত। আমিও — পারিবারিক কারণ!

ড্রামাবাজি। নাটক। ন্যাকা — মনে মনে বলতে বলতে জিৎ লিখল — এটা না করলেই পারতে। তবে, তুমি যদি মনে করো — ইটস ওকে।




দুরন্ত গতিতে এগোতে থাকে শুটিং। পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে যায় শহর। ভিকিদের দলটা সর্বক্ষণ ঘিরে আছে। আলোচনার পুরোভাগে প্রবুদ্ধ চ্যাটার্জি থাকলেও — জিৎ আছে। তার নাম জানছে শহর। এই অনুভুতির মজা আলাদা। টের পাচ্ছিল জিৎ। ছেলেটা ছিল এলেবেলে, পাড়ার মুদি দোকানে লাইন দিয়ে পিছনে দাঁড়াতে হত, পাজামা পরে কাটিয়ে দিত সারাদিন, সে যখন ফাটা জিন্স পরে দোকানে আসে বা বারমুডা আর মোবাইল নিয়ে পাড়ায় হাঁটে, লোকে বলে — ও তুমি সিনেমায় কাজ করছ? দারুণ ব্যাপার তো?

ভালো রেজাল্ট, ভালো ছেলে — লোকের চোখে এগুলোর কোনো দাম ছিল না। ছোট্ট হাতে টুকটুকির ন্যাপি পরিষ্কার করলে কেউ পাত্তা দেয় নি। বাজার করেছে, ঠাকুমার পা টিপেছে, রান্না করতে হয়েছে কখনো — এতটুকু প্রশংসা করে নি আত্মীয় স্বজন। আর এখন? মামা – মাসীদের ফোন — তুই এখন সেলিব্রেটি রে জিৎ। তুই আমাদের গর্ব।

জিৎ প্রতিবাদ করে বলে — দূর। এক্ষুনি কেন?

তারা আরো প্রতিবাদ করে বলবে — প্রবুদ্ধ চ্যাটার্জির সঙ্গে তোর নাম পোস্টারে। কম কথা?

বুকের ভিতর বেজে ওঠে স্বপ্নের ড্রাম। নতুন নতুন পোশাক কেনে। বাবার দেওয়া হাত খরচে কুলোয় না। আরো টাকা চায়। রাকার বাবা একটা একাউন্ট খুলে দিয়েছে — টাকা জমা হচ্ছে, পারিশ্রমিক হিসেবে। দামি মোবাইল কিনল। প্রবুদ্ধ দা বলেই দিয়েছেন — আগে দর্শনধারী / পরে গুণ বিচারি।

ভাবতে ভাবতে দেখল, বৃষ্টি নেমেছে আবার। এখন বৃষ্টি ভালো লাগে না। আগের মত কবিতাও লেখে না। ইলিশভাজার কাঁটা বেছে টুকটুকির জন্য আলাদা করে রাখে না। স্ক্রিপ্ট ঘষামাজা করতেই দিন পেরিয়ে যাচ্ছে। একটা লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে গেলে পুরনো কিছু অভ্যাস ভুলে যেতে হয়।

বাড়ি এখন তাকে ছেড়ে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। টুকটুকি এখন কাঁদে না। বাবা লাইট জ্বালিয়ে ঘুমায় না। বাতের ব্যথা নিয়ে ঠাকুমার নালিশ শুনতে পায় না। বাড়িতেই বা থাকে কতক্ষণ যে শুনবে? বাবা একদিন বলেছিল — রেজাল্ট যেন ভালো হয়। খেয়াল রাখিস। তোর মায়ের স্বপ্ন ছিল।

মায়ের স্বপ্ন? মায়ের ছবিতে রোজ ফুলের মালা পরিয়ে চন্দন দিত। অনেকদিন দেওয়া হয় নি। ইস। ধুলো জমে গেল বোধহয়? তাড়াতাড়ি ছবির সামনে গিয়ে দেখে, পরিষ্কার তকতক ছবি। অপটু হাতে চন্দনের ফোঁটা। টাটকা মালা। বাবা হেসে বললেন — সম্পর্কের ধুলো পরিষ্কার করা কঠিন। ফটোর ধুলোয় সমস্যা নেই। টুকটুকি করে দেয় রোজ।

এতদিনের নরম গলা ধারালো করে জিৎ বলে — কেন বাবা? এতদিন তবে করো নি কেন? তোমাদের শোক সামলাতে সারাজীবন নষ্ট করলাম আমি।

— সারাজীবন? তুই মোটে উনিশ।

— রাকা কাজটা না করালে — কী হত? এই ই করে যেতাম। যেতাম না? ভালো ছেলে হয়ে থাকতাম তোমাদের কাছে।

বাবার মুখের আলো নিভে যায়। শরীর ঝুঁকিয়ে ক্লান্ত গলায় বলেন — ভুল করেছি। সংসার যখন আমার ভার নিতে হবে বইকি। শোকের ছুতো দিয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে থাকা উচিত হয় নি।

আহত গলায় জিৎ বলেছিল — ছুতো কেন বলছ?

বাবা মাথা নেড়ে বলেছিলেন — নিজের কাছে অসৎ হয়ে লাভ নেই। তোর মা চলে যাওয়ার পর থেকে বেশি করে সংসার দেখা উচিত ছিল। করিনি। তুই অনেক করেছিস। অনেক কম্প্রোমাইজ করেছিস।

বাবার তীব্র দৃষ্টির সামনে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে ফেলতে জিৎ বলেছিল — কম্প্রোমাইজ কেন বলছ? আমার ডিউটি নেই সংসারের প্রতি?

বাবা ক্লান্ত স্বরে বলে — নিজের চাইতে কাউকে বেশি ভালোবাসা যায় না। সেটাই সত্য।

— তার মানে? নিজেকেই শুধু ভালোবাসি? আমি স্বার্থপর?

উত্তর না দিয়ে চলে যাওয়া বাবার দিকে তাকিয়ে জ্বলে উঠেছিল শরীর — যা খুশি হোক। এবার থেকে নিজের জন্যেই ভাববে। নিজের জন্যেই করবে। দুনিয়া যাক রসাতল।




দিন কতক দম ফেলার সময় পেল না জিৎ। প্রবুদ্ধ চ্যাটার্জি খাটিয়ে মারছেন। ভয়ঙ্কর খুঁতখুঁতে। কমার্শিয়াল ছবির নামকরা পরিচালক। বদনাম আছে বাজারে। বেশিরভাগ মেয়েঘটিত। সে যাই থাক। কাজের প্রতি সাংঘাতিক মনোযোগ। ছবির দায়িত্ব নিলে বদলে যায় লোকটা। ডুবে যায় একেবারে। এটা বুঝেছে জিৎ, ম্যাজিক করে এত উপরে ওঠা যায় না। পরিশ্রম চাই। প্রবুদ্ধ হেসে বলে — শুধু পরিশ্রম নয় রে। সততা দরকার।

— সততা বলতে? সিনেমার জগতে সৎ হলে চলে?

চশমার আড়ালে ঝকঝক চোখ জরিপ করে, মাপে তারপর ধীরে বলে — জিৎ, নিজের কাছে সৎ থাকবি। তোর খারাপ দিকটাও যেন লোকে জানে। ভালোমানুষের মুখোশ বেশিদিন থাকে না। খারাপ হলে পুরোটা খারাপ — ভালো হলে পুরোটা ভালো।

— ঠিক বুঝতে পারছি না। খারাপ মানুষ পাত্তা পাবে ইন্ড্রাস্ট্রিতে?

— আলবাত পাবে। কাজ ভালো হলে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবে লোক। কিন্তু — যদি জানে লোকটার ভিতরে আরেকটা অন্য লোক আছে — তবে –! জেনুইন হতেই হবে রে। বিশ্বাস ভেঙে গেলে — মুশকিল!

ভিতরের কোথায় যেন গিয়ে ধাক্কা দেয় কথাগুলো। এলোঝেলো চুল কপাল থেকে উঠিয়ে আনমনে বলে — যদি জেনুইন না থাকতে পারি? ছুঁড়ে ফেলে দেবে? ফিরে আসা যাবে না?

— আস্থা বুঝিস? খুব দামী বস্তু। ওটা চলে গেলে — তবে —

হাত নেড়ে কথাটা উড়িয়ে দিয়ে প্রবুদ্ধ দা বলেন — ধ্বংসের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে নতুন সৃষ্টির বীজ। ভালোবেসে চাইলে ফিরে আসা যেতেই পারে।

কাজ শুরু হতে হতে — চয়ন একটি ছেলের নাম — ছবির স্ক্রিপ্ট বদলে যাচ্ছে ক্রমাগত। ঝিনচাক গান ঢুকেছে। নাচ আছে। চয়ন নাচবে। নায়িকার নাম রেশমা। বলিউডি স্টাইলে বাংলা ছবি হতে চলেছে। প্রোডাকশন, কস্টিউম — সব ফাটাফাটি। জিৎ এখন পাখা মেলে আকাশে উড়ে বেড়ায়। স্বপ্নের মিনারে চড়ে বসে থাকতে থাকতে একদিন সকালে দুম করে ফোন এলো রাকার।

মনে মনে জিভ কাটে জিৎ — এই রে! রাকার সঙ্গে কথাই হয় নি। ফোন তুলে সরি বলতে রাকা স্বভাবসিদ্ধ ধমক দিল — কিসের সরি? কাজ আমাদের সকলের। তুই করছিস — গ্রেট। প্রবুদ্ধ দা হ্যাপি রে। তুই ভালো ফিল্ড পাবি পরে।

আবেগে বুজে যাওয়া গলা পরিষ্কার করে জিৎ কোনমতে বলে — তোর জন্যে রাকা। নইলে, আমার মত মধ্যবিত্ত ছেলের ক্ষমতা কোথায়?

— এখন আর কোথায় মধ্যবিত্ত? দামি ফোন, উবের ছাড়া চলে না, হরদম পার্টি।

বিগলিত সুরে জিৎ বলে — আঙ্কল আমার নামে যে টাকাটা দেন পারিশ্রমিক হিসেবে, অনেকটা টাকা।

— আঙ্কল? ছোটবেলা থেকে কাকু — আজ আঙ্কল হয়ে গেল?

— কাকু — ফাকু চলে না কি?

টপিক ঘুরিয়ে রাকা বলে — টুকটুকি কেমন আছে?

তুতলে যায় জিৎ — ভালোই আছে মনে হয় — মানে — ভালোই আছে।

— সে – ই। আগে টুকটুকি ছাড়া কথা বলতি না — সে যাই হোক। আসল কথা বলি। তুই হঠাৎ লোকেশন কাশ্মীর করলি কেন?

জিৎ ঘাবড়ে গেল। বাজেট বেড়ে গেল? পুলিশের মত জেরা করছে!

রাকা আবার বলল — কি রে? গ্রাম থেকে কাশ্মীর? ব্যাপার কি?

— নাহ্। শোন। এটা প্রবুদ্ধ দা রাজি হয়েছেন। বললেন যে, গ্রাম চলবে না। বাজেট বেড়ে গেল, তাই না?

— বাজেট প্রবলেম না। তুই রাজি হয়ে গেলি কেন?

— রাকা। কমার্শিয়াল ছবি হিট করাতে গেলে জায়গা সুন্দর, হিরোইন সুন্দরী হতেই হবে।

— গ্রাম চলবে না?

— দূর। রেশমা মানায় গ্রামে?

— গান বদলে দিয়েছিস? রবীন্দ্রসঙ্গীত পাল্টে দিলি?

নদীর পাড়, চাঁপাফুলের গাছ, বিড়াল — ফালতু হয়ে গেল? সাদা বরফ, গ্ল্যামার চাই তোর?

হিসহিস করে বলল রাকা।

— এরকম করে বলছিস যেন আমিই চাই? পাবলিক চায়। প্রবুদ্ধ দা চায়। টাকা ফেরৎ তুলতে হবে না?

— আর তুই? স্বপ্নের ছবি, চয়নের অপেক্ষা — তীব্র অপেক্ষা — সব ভুলে গেলি?

— ওটা — জাস্ট কল্পনা —

ছেলেমানুষী। ব্যবসায় ওটা চলবে না। পাবলিক যা চায় তাই তো করতে হবে।

— চুপ কর। সোজা জবাব দে। কে কি চায় জানতে চাই না। টাকা দিয়েছিলাম তোর চাওয়া দেখে। সেটা বদলালো কেন?

— রাকা। আমি — আমি — চয়নের মত অপেক্ষা কেউ করে না কি ওইরকম? অবাস্তব।

— করে না?

ছুরির ধার ঝলকে ওঠে গলায় — টুকটুকি করে না? জ্যেঠু? ঠাকুমা? আর — সুধা? করে না অপেক্ষা? তোর জন্য?

জিৎ কথা হারিয়ে ফেলে। কোনোমতে বলতে পারে — বিড়াল, চাঁপা গাছ, নদীর ধার কি করে জানলি? সুধা? তার কথা জানলি কি করে?

ফোনের ওপার শান্ত। চুপ। যেন হাজার – অযুত বছরের নীরবতা ভঙ্গ করে রাকা বলে — তুই চয়ন না রে। হতেই পারিস না। সুধার মত মেয়েগুলো বোকা, তোদের মত হিসেবী ছেলের চোখে আশ্রয় খোঁজে।

— রাকা!

আর্তনাদ করে ওঠে জিৎ — কি বলছিস?

— ভয় নেই। সিনেমা হবেই। রাকা সেন কথার খেলাপ করে না। একটাই অনুরোধ, কোনোদিন কোনো সুধাকে মিথ্যে গল্প বলিস না।

— তুই — তুই — জানলি কি করে? প্লিজ প্লিজ — নিতে পারছি না।

ভেঙে পড়ে জিৎ। টাকার পাহাড় ছেড়ে নিচে গড়িয়ে পড়তে পড়তে অনুনয় করে — পরিষ্কার করে বল।

রাকা খুব নিরুত্তাপ স্বরে বলে — চিরকালের অহঙ্কারী রাকা অন্য একটা প্রোফাইল তৈরি করে, ফলস ছবি দিয়ে, তোর সঙ্গে ভালোবাসার জোয়ারে ভেসে যেতে চেয়েছিল।

ভেবেছিল, একদিন নদীর ধারে দেখা করতে বলে চমকে দেব। জানিস জিৎ, ওই দৃশ্য বুকের মধ্যে আঁকা হয়ে আছে। চয়ন আর রানি অথবা সুধা — রাকা আর জিৎ — নদীর পাড়ে সূর্য ডুবছে। চয়ন অপেক্ষা করছে। সুধা ফিরে আসছে। চয়ন আর মরবে না। দুজনে বেঁচে উঠবে। সুধা বাঁচিয়ে তুলবে।

— রাকা! তুই — তুই —

কথা শেষ করতে পারে না জিৎ। দুমড়ে যেতে যেতে শুনতে পায় রাকা বলছে — মা যখন চলে গেল, আমার বয়স পাঁচ। ওমন মিষ্টি মা — রোজ আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া মা — চলে গেল? বিশ্বাস হয় নি, জানিস? অপেক্ষা করি, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাই, ড্রাগ নিয়ে নিজেকে শেষ করতে করতে তুই চলে এলি।

মেকি লাইফটা ছেড়ে চলে আসব তোর সঙ্গে — এমন ভাবতাম। ভাগ্যিস! ফেক প্রোফাইল তৈরি করেছিলাম। না হলে, ফেক ছেলেটাকে চিনতাম কি করে?

মোবাইল বন্ধ করার খুট শব্দের সঙ্গে সঙ্গে চরাচর জুড়ে নেমে আসে ভয়ঙ্কর নীরবতা। সিনেমাটা হবে। এটা নিয়ে সন্দেহ নেই। তাহলে এমন কেন হচ্ছে? কেন মনে হচ্ছে আবার ফেল করে গেল? কবরের মত কনকন শীতল কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে মস্তিষ্কের চারিধার — বারান্দার তারে দুলছে লাল গামছা, সুর করে কি একটা গাইছে টুকটুকি, রান্নার মাসীর ডাল সম্বারের ঘ্রাণ ছেয়ে ফেলছে গোটা বাড়ি। বৃষ্টি ভেজা কাক এসে বসে পড়েছে কার্নিশে। সকলে নিশ্চিন্ত। সকলে স্থির। সকলে আনন্দময়। ফেল করা ফেক জিৎ কোথাও নেই। অপেক্ষায় নেই, ভরসায় নেই, ভালোবাসায় নেই।

একেবারেই কী নেই? ফিরে আসতে চাইলে আটকাবে কে? জিৎ মনে মনে উচ্চারণ করে — রাকা। নতুন প্রোফাইল করার সুযোগ দিবি একবার? প্লিজ!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *