short-story-protidwandi

প্রতিদ্বন্দ্বী
হাবিব আনিসুর রহমান


লেকের পাড়ে বসেছিল সে। সূর্য ডোবার আগের গোধুলি সময়। জোড়ায় জোড়ায় তরুণ-তরুণীরা গল্প করছে ওর আশেপাশেই। সেদিকে তাকায় না সে। বরঞ্চ লেকের পানি আর সূর্য তার সাথে বড় বড় গাছের সবুজ পাতা দেখেই সময়টা কাটাবে এখন আবার এমনও হতে পারে সে কোন দিকেই তাকাবে না, এখানে এভাবে বসে থাকবে তারপর সন্ধ্যা গড়িয়ে চারপাশে অন্ধকার নেমে আসবে। এই কদিন সে এই পার্কে এসে বসছে। হাসপাতাল থেকে পনের মিনিটের হাঁটাপথ। আজ সামনের লেকটাকে মনে হলো একটা অন্ধকার নদী! কখনও কখনও নদীও অন্ধকার হয়! স্রোতে হারালে সামনে যেতে না পারলে নদী মরে গেলে! মরা নদী মানেই তো অন্ধকার নদী। এই যেমন সে। সে এখন থেমে যাচ্ছে, চারপাশের কিছু মানুষ তাকে থামিয়ে দিচ্ছে, সে এখন স্রোতহীন অন্ধকার নদীর মতোই!

ডাক্তার বলেন, ঘাবড়াবেন না, আপনার বাবার বিষয়টাকে আমরা বলি ডিপ্রেসিভ ইলনেস, দীর্ঘদিন ভুগে ভুগে আজকের এই কঠিন অবস্থায় চলে এসেছেন, চিকিৎসা নিলে তাকে সুস্থ করে তুলতে পারবো আমরা। সিস্টারটাও ভালো, প্রতিদিন ভালো ভালো কথা ব’লে তার মনটাকে চাঙা করতে চায়। শুধু তারাই পারছে না নিজেদের মনটাকে স্বাভাবিক রাখতে। মন! সে কি স্বরবর্ণ বা ব্যঞ্জণবর্ণের মতো স্পষ্ট করে লেখা সরল কিছু অক্ষর যে ইচ্ছে করলেই পড়ে ফেলা যায়! মন অদ্ভুত জটিল আর রহস্যে ভরা, তাকে জানা যায় না, পড়াও যায় না! তার মনে হলো, সে ছোট্ট একটা ফুলের গাছ অথচ ফুল ফোটার আগেই সবুজ পাতাগুলো ঝরে যাচ্ছে। যখন গাছের গোড়ায় দরকার ছিল প্রাণদায়িনী জলের ধারা, আলো বাতাস অথচ মনে হচ্ছে জলের অভাবে আলোর অভাবে শুকিয়ে মরে যাবে গাছটা। ইফতেখার বলতো – রীতা মন হচ্ছে ভালোবাসার জমিন, সেখানেই চাষ হয় ভালোবাসার! একটু দূরের বেঞ্চে বসে আছে একজন। তাকিয়ে আছে তার দিকে। কি ভাবছে তাকে লোকটা! খারাপ মেয়েমানুষ ভাবছে কি, বেশ্যা টেশ্যা কিছু? কে জানে কদিন ধ’রে হাসপাতালে থেকে থেকে তার চেহারাটা কেমন হয়েছে দেখার ফুরসত পায়নি সে! বাবা পড়ে গিয়েছিল মেঝেতে, পাশের বাসার মানুষগুলোর সাথে ধরাধরি করে কোনরকমে এই হাসপাতালে আনতে পেরেছে। বাবা অজ্ঞান ছিল তখন। সে ভেবেছিল হয়তো আর ফিরে পাবে না তার বাবাকে। হাসপাতালে এসে একটা শয্যা পাওয়া কী যে কঠিন! প্রথম দিন সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝেছে।

বাবার চোখ দুটো খোলা থাকে, কেউ সামনে গিয়ে দাঁড়ালে অপলক তাকিয়ে থাকেন তার দিকে। কথা বলেন না। বাবার সহকর্মী মঈনুল সাহেব যেদিন তার সামনে এসে দাঁড়ালেন তখনও বাবার মুখে কোনো কথা নেই। আশ্চর্য হলো সে, মঈন চাচাও বাবাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন না, কেমন আছেন ভাই? কোনো কথা বিনিময় হলো না তাদের মধ্যে! শুধু দুজন তাকিয়ে থাকলেন দুজনার দিকে। তাহলে কি বাবা অফিসে গিয়ে এই মানুষটাকে পরিবারের সবকিছু বলে দিতেন? তিনি কি এই পরিবারের সবটাই জেনে গেছেন, আর কি জানার নেই কিছু! ডাক্তার সাহেব ডেকে পাঠালেন তাকে। – শুনুন, আমরা প্রথমে যা ভেবেছিলাম এখন দেখছি বিষয়টি সে রকম সহজ কিছু নয়, বেশ জটিল, উনার মেন্টাল হেলথের কথা ভেবে আগামীকাল একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে আসতে বলেছি এই সময়, আপনি থাকবেন কেমন, আচ্ছা আপনার মা উনাকে তো দেথছি না? আচমকা ডাক্তারের কথা শুনে খারাপ লাগলো রীতার। হাসপাতালে এসে এমন প্রশ্ন শুনতে হবে ডাক্তার সাহেবের কাছ থেকে সেটা ভাবেনি সে। রীতা মাথা নত করে থাকলো কয়েক সেকেন্ড। উত্তর না দিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ততক্ষণে চলে গেছেন ডাক্তার। বাবাকে হাসপাতালের দেয়া দুপুরের খাবার খাইয়ে সেবিকা আঁখির কাছ থেকে ছুটি নিয়ে এই পার্কে এসে বসে থাকে রীতা। এখানকার দিনগুলোর সময়কে এভাবেই ভাগ করে নিয়েছে। বাবার মনটাকে শক্ত রাখার জন্যে সুন্দর সুন্দর কথা বলে তার সামনে। মাঝে মাঝে হাসেও। বোঝাতে চেয়েছে, যা কিছু ঘটেছে অথবা যা কিছু ঘটতে যাচ্ছে তার সবটাই স্বাভাবিক। এখন আমাদের বেঁচে থাকতে হবে এটাই বড় কথা।

ঝালমুড়ি ঝালমুড়ি বলে চিৎকার করতে করতে একটা ছেলে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। সে বললো – পাঁচ টাকার দাও। – আপা, এখন পাঁচ টাকার দেওন যায় না, আমাগো পোষায় না। তারপরও ছেলেটা তাকে দিল পাঁচ টাকার। সে ছোটো ব্যাগ খুলে একটা পাঁচ টাকার নোট দিল ছেলেটাকে। ঝালমুড়ি খেতে খেতে লেকের কালো পানির দিকে তাকালো। বিকেলের স্নিগ্ধ ঝিরঝিরে একটা বাতাস বইছে পানির ওপর। বাতাসের স্পর্শ লেগে তিরতির কাঁপন উঠছে সেই পানিতে। একদিন তার মনেও ওই ঝিরঝির বাতাসের মতো কাঁপন তুলেছিল ইফতেখার। কতো কথা যে বলতো সে – রীতা, একদিন তোমাকে নিয়ে চন্দ্রার গভীর বনে হারিয়ে যাবো। আর একদিন বলেছিল – নৌকায় তোমাকে নিয়ে বুড়িগঙ্গার ওপর ভেসে বেড়াবো, যাবে একদিন? মাঝে মাঝে সে চলে আসতো ওদের ভাড়া করা বাড়িতে। ইফতেখার এলে মা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে যেতো। ছোট্ট ড্রইং রুমে বসে কথা বলতো ওরা। একদিন দুপুর বেলা এসে হাজির ইফতেখার। সেদিন কলেজে যায় নি রীতা, ওকে দেখে অবাক হয় – কি ব্যাপার ইফতেখার, তুমি! – এখানে কাজ ছিলো, ভাবলাম একটু দেখে যাই আছো কি না। মা সেদিন চটপটি রান্না করে খাইয়েছিলো তাকে। কফি খাবেন আপা? ছোট্ট একটা ছেলে কফি বিক্রি করে বেড়াচেছ। কতো? জিজ্ঞাসা করলো রীতা। আজ দুপরে খায় নি সে। আসার সময় হাসপাতালের সামনের দোকান থেকে সিঙাড়া কিনে খেয়েছে। – পনের টাকা, এক কাপ দিই আপা? সিদ্ধান্ত নিতে পারে না সে। একটু আগে পাঁচ টাকার ঝালমুড়ি খেয়েছে এখন আবার পনের টাকার কফি! অথচ মন চাচ্ছে একটু কফি খেতে, রোজ রোজ তো আর খাচ্ছে না! আশেপাশের মানুষ খাচ্ছে তো। হঠাৎ মনে হলো ওসব মানুষ শুধু কফিই খাচ্ছে না, ওরা প্রাণ খুলে হাসছে, আনন্দ করছে! কিন্তু সে হাসতে পারবে না অথবা আনন্দও করতে পারবে না। সে কফিঅলা ছেলেটাকে বললো – এক কাপ দাও। কফিতে চুমুক দিয়ে অবাক হলো রীতা, পার্কে এতো মজার কফি পাওয়া যায়! নাকি দীর্ঘদিন কফি খায় নি সে! নাকি সে এখন ভীষণ তৃষ্ণার্ত, সে জন্যেই কফিটা এতো সুস্বাদু লাগছে। কফির প্রতিটা চুমুক তার কছে অমৃত মনে হলো। সে অবিশ্বাস্য রকমের তৃপ্তি নিয়ে কফি খেতে লাগলো। কিন্তু কফি খেতে খেতে অপরাধী মনে হলো তার নিজেকে। অভাবের সংসারে মায়ের হাজারটা অভিযোগ ছিল বাবার বিরুদ্ধে। কিছু হলেই মা রেগে যেতো, হয়তো কফির প্রসঙ্গ উঠলে মুখের ওপর বলে দিত বাবাকে – পেরেছো কোনদিন কফিশপে বসিয়ে এক কাপ কফি খাওয়াতে, পারো নি, এ জীবনে আর পারবে না, মরার আগে আর কেনোদিন কফি খাওয়া হবে না আমার। মা এভাবেই কথা বলতো বাবার সাথে। মা’র কথা শুনে বাবার মনের ভেতর কি হতো তা জানতে পারেনি রীতা। জানা সম্ভব নয়, একজনের মনের কথা অন্যজন জানতে পারে না। খুব ছোটবেলা থেকেই বুঝতে পেরেছিল রীতা, সে একটা অস্বচ্ছল পরিবারে জন্মেছে। যেখানে সংসারের একটি প্রয়োজন মিটলে আর একটি মেটানো কষ্টসাধ্য ছিল বাবার পক্ষে। স্কুল পার হয়ে কলেজে পড়ার সময় জেনে ফেলেছে তার বাবা শুধু বেতনের টাকাতেই সংসার চালায়। বেতন হাতে পেয়েই বাড়িভাড়া দিয়ে দিত প্রথমেই, তারপর চালডাল বাজার করে ফেলতো। একদম ছকে বাঁধা জীবন বাবার। সকালে উঠেই দুপুরের খাবারের বক্সটা ব্যাগে পুরে ছুটতো বাস ধরার জন্যে। তারপর অফিস সেরে আবার বাস। প্রতিদিন তিন থেকে চার ঘন্টা বাসেই কেটে যেতো বাবার। এর বাইরেও জীবন বলে কিছু ছিল বাবা সেটা বুঝতে পারেন নি। বুঝতে পারেন নি মায়ের চাহিদা। মা আসলে এই টানাটানির জীবনকে মানতে পারেনি কখনও। বাবার সাথে মার বিয়ে হয়েছিলো যখন তখন মা’র বয়স খুব কম, ক্লাস টেনে পড়তো। রীতার সাথে তার মায়ের বয়সের পার্থক্য ষোল বছর, পাশাপাশি মা-মেয়ে দাঁড়ালে মনে হতো দাঁড়িয়ে আছে দুইবোন। রীতা মাঝে মাঝে কলেজ থেকে ঘরে ফিরে দরোজায় দাঁড়ালে শুনতে পেত ভেতরে চিৎকার করছে মা। কখনো তার আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো না মা। কিন্তু বাবার সহ্যশক্তি ছিল সীমাহীন।

আপনি একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ান প্লিজ। – কেন? সেবিকা আঁখির দিকে তাকালো রীতা। এখন স্যারের সাথে একজন সাইকোলজিস্ট থাকবেন, তিনি কথা বলবেন আপনার বাবার সাথে। আঁখির কথা শেষ হবার আগেই ডাক্তারের সাথে একজন বয়স্ক লোক এসে দাঁড়লেন তার বাবার পাশে। দুজনই বাবার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলা শুরু করলেন। দূর থেকে কথা ভেসে আসছিল রীতার কানে, কোনোটা স্পষ্ট কোনোটা অস্পষ্ট। ডাক্তার সাহেব বাবাকে বলছেন- ইনি আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চান, আমরা চাই আপনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে যান, ইনি প্রশ্ন করবেন, আপনি উত্তর দেবেন কোনো কিছু লুকোবেন না প্লিজ। বাবা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দুজনের দিকে। সাইকিয়াট্রিস্ট ভদলোক একটু হাসলেন, তারপর বললেন- বলুন আজ কতো তারিখ? বাবা চুপ, মুখে কোনো কথা নেই। রীতা জানে, আজ কতো তারিখ কতো সাল সবই জানে তার বাবা, কিন্তু বাবা উত্তর দেবে না এসব প্রশ্নের। – কথা বলুন প্লিজ, কথা না বললেতো হবে না, দেখুন হাসপাতালে মানুষ আসে রোগ থেকে মুক্তি পাবার জন্যে, সুস্থ হ’তে হলে তো চিকিৎসককে সহায়তা করতে হবে তাই না? কথা বলুন প্লিজ। রীতা তার বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, কথা বলে- বাবা, উনি যেটা জানতে চাচ্ছেন সেটা বলো, এভাবে মূক- বধির হয়ে থাকলে আরও কষ্ট পাবে, কথা বলো, আমি অস্বস্তি বোধ করছি। – ঠিক আছে আপনি যান আমি দেখছি। শিলা চলে গেলে সাইকিয়াট্রিস্ট শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন তার বাবার সামনে – আপনি এখানে আসার পর আপনার মেয়েটি তার গোসল খাওয়া ঘুম বাদ দিয়ে এখানে পড়ে আছে, ওর তো ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, আপনার স্ত্রী কোথায়? হঠাৎ এই প্রশ্ন শুনে উঠে দাঁড়ালেন বাবা, স্যালাইনের সুচ খুলে ফেলে রীতার দিকে হাঁটা শুরু করলেন…। সাইকিয়াট্রিস্ট নার্সকে বললেন- পেশেন্টকে ধরুন পড়ে যাবে। রীতা এসে তার বাবাকে ধ’রে শুইয়ে দিল। মনোবিজ্ঞানী ভদ্রলোক রীতাকে ডাক্তারের রুমে নিয়ে গিয়ে বললেন – শোন, তোমার বয়স কম, আমি তুমি সম্বোধন করতে চাই, আপত্তি আছে? – না স্যার, আমার কেনো আপত্তি নেই আপনি বলুন। – দেখো, তোমার বাবার সামনে তোমার মায়ের কথা বলতেই তিনি উত্তেজিত হয়ে বিছানা ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন, তুমি এ বিষয়ে কিছু বলবে? – স্যার, যে মানুষটার স্ত্রী নিখোঁজ, কোথায় গেছে কেউ জানে না, তিনি কি বলবেন স্যার? – স্বেচ্ছায় কোথাও গেছেন, মানে নিজের ইচ্ছায় চলে গেছেন? – স্যার আমি নিজে কিছুই জানি না, শুধু এটুকু জানি আমার মা নানা অথবা মামার বাড়ি যান নি, বাবাও কিছু বলেন নি আমাকে। – ঠিক আছে তুমি যাও, আমি বিষয়টা দেখবো।

একটু দূরে বসা লোকটা দেখছিল রীতাকে, তার চোখদুটো কেমন বিবর্ণ হলুদ! বিাচ্ছিরি ভাবে তাকাচ্ছে এখনও, নেশাটেশা করে মনে হয়! আজকাল এই অবেলায় পার্কে এসে বসেনা কোন ভদ্রঘরের মেয়ে, কিন্তু রীতার বসার কোন জায়গা নেই, বাবাকে হাসপাতালে রেখে এই বেঞ্চে এসে বসে একটু বিশ্রামের জন্যে। হাসপাতালের চেয়ারে বসতে ভাল লাগে না তার, চারপাশে রোগির ভিড়, তাদের আত্মিয়স্বজন, ওষুধ ওষুধ গন্ধ সবকিছুতে। উঠে দাঁড়ায় রীতা। হেঁটে যায় হাসপাতালের দিকে।

তার বাবার হাতে লাগানো সুচ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা স্যালাইন পানি ঢুকছে শরীরে। বাবা ঘুমোচ্ছে কেনো এখন! তার রাতের খাবার? সেবিকা আঁখি কোথায়? দ্রুত সে বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কি হলো? আঁখিকে ডাকতে হলো না। সে নিজেই কাছে এসে দাঁড়ালো। – আপনার বাবাকে আজ রাতে খাবার দিতে নিষেধ করেছেন ডাক্তার স্যার। – কেনো, কেনো, না খেলে উনি তো দুর্বল হয়ে পড়বেন! – আজ তাকে ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হয়েছে, উনি সকাল পর্যন্ত ঘুমাবেন, ঘুম থেকে উঠলেই আবার নরমাল মিল দেয়া হবে। রীতা কি করবে এখন? এখানেই অন্য অ্যাটেনডেন্টদের মতো একপাশে চাদর পেতে ঘুমিয়ে থাকবে নাকি অন্য কিছু করবে? রীতার খারাপ লাগছিল খুব, কি করবে সে এখন, কোথায় যাবে, ভেবে কুলকিনারা করতে পারে না। একবার মনে হলো, সেই যে ঘরে তালা দিয়ে বাবাকে নিয়ে এখানে চলে এসেছে তারপর আর ঘরে যাওয়া হয় নি।

রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রীতা। একটা বাসে উঠে বসে। যানজটের শহরে জটটা তুলনামূলক কম আজ। ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব, আকাশে মেঘ, বৃষ্টি হবে নাকি! বাস সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশাল বিলবোর্ডগুলোতে বোম্বের স্বল্পবসনা নায়িকাদের উঁচু উঁচু বুক আর নগ্ন সুন্দর পা’গুলো দেখছিলো সে। লাক্স, পেপসি কোলার বিজ্ঞাপণ, দিপিকা পাডুকোন, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া এসব মিস ইউনিভার্স উড়ছে বিলবোর্ডের আকাশে। জীবনে কখনও এমন সাধ হয়নি রীতার যে সে তার শরীর দেখিয়ে এই শহরের মানুষদের পাগল করে দেবে, তার চেহারা দেখে মানুষ পণ্য ভোগ করবে! কী সব এলোমেলো ভাবছে সে? প্রিয়াঙ্কা চোপড়া হওয়া তো দূরের কথা সে তো এখন ইফতেখারের নায়িকাও হতে পারলো না! সত্যি কথাটা হলো তার মা চলে গেছে বাবা আর তাকে ছেড়ে, কোথায় গেছে তারা জানে না। হয়তো এটা শুনেছে ইফতেখার, তারপর সে আর আসে নি তাদের বাড়ি। কেনো আসবে? যে মেয়ের মা চলে যায় তাকে আর ভলোবাসতে পারে কেউ? হঠাৎ আজ ভেতরে ভেতরে ইফতেখারের কথা মনে পড়লো কেনো? ইফতেখার একদিন বলেছিল – এসো না একদিন আমার ঘরে? মিরপুর এক নম্বরের দিকে যেতে কিয়াংসী চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, ওটার পাশেই দেখবে ছ’তলা বিল্ডিং, নাম মধুমতি, ওটার তিনতলায় থাকি, খুব সহজ ঠিকানা। – কৈ যাইবেন আপা? বাস কন্ডাকটার জানতে চায়। রীতা বলে- আজিমপুর। অবাক হয়ে তার দিকে তাকায় যুবক। – আজিমপুর! – কতো ভাড়া? – হায়! এই বাস তো যাইবো মিরপুর এক নাম্বার। বোকার মতো তাকিয়ে থাকে রীতা যুবক বাস কন্ডাকটারের দিকে। ঘড়ি দেখে রীতা, এক ঘন্টা আগে সে এই বাসে উঠেছে, দাঁড়িয়ে ছিল তারপর বসার জায়গা পেয়েছে, বসেছেও, কিন্তু একবারও সে খেয়াল করেনি যে সে কোন বাসে উঠেছে, কখন উঠেছে, কিভাবে সে মিরপুরের বাসে উঠলো! অবচেতন মনে কি হচ্ছে এসব! – এখন কি করবেন আপা? – আচ্ছা, এক নম্বরের দিকে যেতে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আছে না? – হ্যাাঁ, এই তো সামনে। – আমাকে ওখানে নামিয়ে দেবেন। বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় রীতা। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। জোরে এলে সে ফিরে যাবে কেমন করে!

বাস থেকে নেমে সামনে তাকায় রীতা। হ্যাঁ, সামনেই সেই চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, পাশেই ছ’তলা ভবনের নিচে বড়ো করে লেখা মধুমতি। ইফতেখার বলেছিল, তিন তলায় থাকে। পাশের চা-দোকানে সন্ধ্যার জটলা, লোকজন চা খাচ্ছে। একটা দমকা হাওয়া ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো রীতাকে। কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব সেই হাওয়ায়। হয়তো জোরেসোরে বৃষ্টি নামবে। রীতার মনে হলো, জীবনটা যেনো কেমন, একটু পরে কি হবে কেউই জানে না। জানা যায় না! শাহবাগের মোড় থেকে সে কি করে ভুল বাসে চেপে ইফতেখারের ঘরের সামনে চলে আসলো! আসলে জীবন এমনই, একটা অদ্ভুত জটিল রহস্যময় সুতো টেনে নিয়ে যায় মানুষকে, কোথায় যায় কেউ জানে না! সেই সুতোটা দেখা যায় না! দূর থেকে ইফতেখারের মধুমতির তিনতলার দিকে তাকায় রীতা। দেখলো বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ইফতেখার। কিন্তু তার পাশে ওটা কে! স্ট্রিট লাইটের আলো গিয়ে পড়েছে তার মুখমন্ডলে! শাড়ি পরে ইফতেখারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে! অসম্ভব সুন্দরী, রাস্তার আলোয় তার ঠোঁটের লাল লিপস্টিক পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে! শাড়িটা রীতার খুব পরিচিত, কদাচিৎ ওই শাড়িটা পরে বাইরে যেতো মা! চোখ মোছে রীতা। এই লাল লিপস্টিকের জন্যে বাবার সাথে প্রায় চিৎকার করে কথা বলতো তার মা!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *