শিপা সুলতানা
বাড়ির চারপাশে হাজার খানেক গাছ। আম, কাঁঠাল, ডেফল, চালতা, পানের লতা পেছানো সুপারির সারি, আনারসের বন, সৈয়দী সফরি, কমলা, বেতবন! এতোদিন এইসবই ব্যুহ মনে করতো আব্দুর রহিম, আজ তা কালসাপ হয়ে মাথার সামনে খাড়ায়া আছে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে দাঁড়িয়ে আছে খুনী, ধরবে আর গলা কেটে বেতবনে ছুঁড়ে দেবে, ঘন বেতবনে ঝুলে থাকবে তার লাশ অথবা চলে যাবে গভীর খাদের নীচে, শ’ দেড়শো বছর পর যদি কেউ ওইদিকে বাড়ি বানিয়ে আসে তবেই দেখতে পাবে তার কঙ্কাল! আর এই যে শিলপাটার মত চ্যাপ্টা হারামজাদী শুয়ে আছে তার পাশে, এত ঘন ঘন কেন আজকাল বাইরে যায় ঘুম থেকে উঠে! জিজ্ঞেসও করা যাবেনা, এমন হাঁক দেবে, বিছানায়ই ভিজিয়ে দেবে সে! তার পলকার মত শরীর তবু আলতো করে পাশ ফিরে রহিম, ফেরার সময় ভাল করে হাত বুলিয়ে নেয় ঘড়িতে। একটু করে শ্বাসও ফেলে সে, ঘড়িটা যদি মধ্যরাতে মাটি খুঁড়ে উঠানের মাঝখানে লুকিয়ে ফেলতে পারতো! কিন্তু তার তো সেই সাহসই নেই মধ্যরাতে বাইরে যাবার!
-চাচা, কুন্তা ডিসিশন নিলায় নি? পরে কিন্তু আমারে দুশ দিতায় পারতায় নায়।
-অয় অয় বা, লাল আর মাল সময়মত না ধরলে আউলি দিলায়। কাপে চিনি ঢালতে ঢালতে বদর উদ্দীন মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য অন্যমনস্ক হয়েছিলো সে, এই ফাঁকে কি বদর কিছু মিশিয়ে দিলো! চা খেয়ে বাড়ি যেতে যেতে ঢলে পড়লো সে আর ফট করে হাত থেকে ঘড়ি খুলে নিয়ে গেলো বদর! আজকের আগে সে টেরই পায় নাই বদরেরও চোখ পড়ছে তার ঘড়ির দিকে! এই জন্য আজকাল চায়ের দাম রাখে আবার রাখে না! আব্দুর রহিম উঠে পড়ে, এক মুহূর্তও আর নিরাপদ মনে হচ্ছে না বদরের দোকান, তার পাশেই তো অচেনা এক লোক বসে কুচকুচিয়ে হাসছিলো! কেন হাসছিলো! গ্রামের চায়ের দোকানে অচেনা লোক আসবেই বা কোথা থেকে, তবে কি কেউ শহর থেকে হায়ার করিয়ে নিয়ে আসছে! বুক ধুকপুক করতে করতে আলজিহ্বার নীচে চলে আসছে তার, কাঁপতে কাঁপতে ফিরে এসে বিছানায় গা ছেড়ে দেয় সে!
দুনিয়ার সকলের বাড়িতে সন্ধ্যা হয় মাগরিবের আজানের পর, তার বাড়িতে হয় আসরের পর পর। বছর বছর এতো গাছ কেটে বিক্রি করা হয় তবু যেন অন্ধকার কাটেনা তার বাড়ি থেকে। ছয় ছয়টা মেয়ের মাত্র দুইটাকে বিয়ে দিয়েছে তাদের মা, একটা কাঠের হাতাও কিনতে হয় নাই বাজার থেকে, পাঁচ বেড়ের, চার বেড়ের একেকটা কাঁঠাল গাছ, সেগুনগাছ কাটিয়ে বিয়ের ফার্নিচার বানিয়ে দিয়েছে, বিয়ের খরচ জুগিয়েছে, এখন আরেক সেট বানানো হচ্ছে তিন নম্বর মেয়েটার জন্য। কবে বিয়ে হবে তার ঠিক নাই, বানিয়ে রেডি রাখা আর কি! তবে ভাবেসাবে মনে হচ্ছে কাঠ মিস্তিরির জোগালি ছেলেটার সাথেই পালিয়ে যাবে মেয়ে। যাবার আগে তার ঘড়িটা নিয়ে যাবে। আগে শুধু জোগালি তাকাতো তার হাতের দিকে, এখন মেয়েও তাকায়। পালিয়ে গিয়ে এক ঘড়ি বিক্রি করেই লালে লাল হয়ে যাবে দুইটা। রহিমের ইচ্ছা করে টিলার কিনারে বসে যখন কাঠের তক্তার উপর ডিজাইন খোদাই করতে থাকে ছেলেটা, আলতো করে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দেয়, লোভীদের মরন এমনই হওয়া দরকার।
-বউ হুনো, জুগালি পুয়ারে আমার ভালা মানুষ মনে অর না, ইগুরে তুমি বিদায় করো
-বিদায় করলে তুমি ফুল তুলবায় নি ফার্নিচারো?
রহিম আর কথা বলেনা
-তুমারে লাস একটা কথা কইয়ার হুনো, দামি ঘড়ি দামি ঘড়ি কইয়া মানশে তোমারে পাগল বানাইরা জানো নি? ঘড়ি দামি অইলে দামান্দে তার বাপ থইয়া তোমারে দেয়নি?
বেদানা বেগমের কথা একবিন্দু বিশ্বাস করেনা রহিম। ঘড়ি দিছে বড় মেয়ের জামাই, কাতার থেকে, দেয়ার সময়ই বলে দিছে ‘ভালা ঘড়ি আব্বা, সাবধানে পিন্দইন যেনো’। তাছাড়া জন্মের পর থেকে এক পয়সার একটা লেবেঞ্চুস কেউ হাতে তুলে দেয় নাই তারে, বাপ মা মরে যাবার পর বিশাল বাড়িতে একা একা বড় হয়েছে, প্রতিবেশিরা বউ এনে দিয়েছে, হালচাষ করে ছয় কন্যাকে বড় করেছে, নিজে পছন্দ করে একটা লুঙ্গি কিনে নাই কোনোদিন। কাতার, সৌদিতে সোনা আর সোনা, লোকজন জানে বলেই তার হাতে ঘড়িটা দেখে আতকে উঠেছে, পাঁচশ টাকা দিয়ে শুরু করে কাল একজন বললো কম হলেও পাঁচ লাখ টাকা এই ঘড়ির মূল্য। মাগরিবের আগে আগে শেষবারের মত প্রস্রাব শেষ করে ঘরে ঢুকে পড়লো রহিম, রাতে উঠান পেরিয়ে পুবের ভিটার রান্নাঘরে গিয়ে ভাত খায়না প্রায় একমাস, দরজা লাগিয়ে শোবার ঘরের মেঝেতে বসে খায় কিন্তু পানি খায়না, কেটে দুই টুকরা করলেও রাতে উঠে বাইরে যেতে পারবেনা সে।
-আইচ্ছা দেখো চাই তোমার লাখ টেকার ঘড়ি কে কিনতো চায়, যাও বেচিয়া আও বেয়াক্কলর ঘরর বেয়াক্কল, আবো চাইর পুড়ি রইছইন বিয়ার বাকি, কার কাছে বিকাইতাম আমি, এমনেও বেয়াক্কল, অখন আবার পাগলর টাইটল লাগাইরায়…
আব্দুর রহিম রা করেনা, বউ নামে বেদানা বেগম, রাইস মিলে নিয়ে চিপলেও মুখ থেকে কোনো রস বের হবেনা, বেদানার চামড়ার মত শক্ত তার মন আর মুখ।
রহিম বাড়ি থেকে বের হয় কাঁপা কাঁপা পায়ে! তার জীবন বাড়ি আর ক্ষেত জমি, বিকাল হলে গ্রামের বাজারে গিয়ে বদরের দোকানে বসে এক কাপ চা খাওয়া, কারো সাতেও নাই সতেরোয়ও নাই, শুধু বসে বসে মানুষের কথা শোনা, তারপর টুকিটাকি বাজার খরচ করে বাড়ি চলে আসা। মানুষের দশ কুটুম থাকে, ঈদে পরবে বেড়াতে যায়, সে কারো বিয়ে কিংবা জানাজায় না গেলেও গা করেনা কেউ। সেও যায়না কোথাও। প্রায় আটদিন পর ভয়ে ভয়ে বদরের দোকানে গিয়ে বেঞ্চের এক কোণায় বসতেই মতিন মাস্টার এসে হাজির।
-রহিম ভাইছাব নি বা? কই আছলায় অতোদিন? ঘড়ি বেচার কিতা করলায়? তুমি আলাভুলা মানুষ, রুলেক্স ঘড়ি দি কিতা করতায়?
রহিম গরম চায়ে জিভ পুড়িয়ে ফেলে, বয়সে সে বড় হলেও মতিন তাকে কোনোদিন ভাইছাব ডেকেছে বলে মনে করতে পারেনা সে! দ্রুত এখান থেকে সরে যাওয়া উচিত, মাস্টার হলেও হেন কুকীর্তি না নাই তার নামে, তার হাতের দিকে যখন চোখ পড়েছে, সহজে হাল ছাড়বেনা -আমি ইন্টারনেটো দেখলাম ই ঘড়ির দাম কম অইলেও দুই কোটি টেকা। আমার মনে অর তোমার দামান্দে কোনো শেখর ঘড়ি মারিং করিলাইছে, বুঝছেনা অত দামি, না অইলে তোমারে না দিয়া হে নিজে আইজ কোটিপতি অইতো। অখন তুমি যদি কও ভাইছাব আমি কাস্টমার দেখতাম…
রহিম কি চা শেষ করতে পেরেছিলো? দোকানভর্তি লোকজনের হায় হায়, আহাজারি শুনে উঠে পড়ে সে, কাঁপতে কাঁপতে বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়! সত্যই তো তার দামান্দ এক শেখের খেজুর বাগানে কাজ করে, শেখের বাড়ির দরজা পর্যন্ত সোনার, একটা ঘড়ি যদি চুরি করে ফেলে, কেউ কি আর টের পাবে!
আব্দুর রহিমের জ্বর আসে, প্রচন্ড জ্বরে বাড়ির পথ ভুল হয়, সে সদরের দিকে হাঁটতে থাকে, একহাত দিয়ে অন্যহাতের ঘড়ি লুকিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে হাঁটু অবশ হয়ে আসে, বড় বড় বাস, লাইটেস পাশ কাটিয়ে যায়, কাঁপতে কাঁপতে রাস্তার কিনার ধরে সামনের দিকে এগুতে থাকে কিন্তু বাড়ির কোনো নাম নিশানা চোখে পড়েনা আব্দুর রহিমের।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
ভিন্ন অনুভুতি, চোখে ভেসে আছে যেন গল্পের চরিত্র ! শুভেচ্ছা লেখককে।