short-story-roopkatha

রূপকথা
মৌমন মিত্র


”ওরা ডক বলে। ডাক্তার বলে না।”

”সেটা আমি জেনে কী করব?”

”বলে দিলাম তোকে। যদি কখনও তোর নাটকে কাজে লাগে।” দীপ্ত হাসছে। হয়তো বুঝতে পারছে আমার মাথা গরম। মনে মনে রাগ পুষে রাখলে আমি দীপ্তর নাট্যদলের কিছু ট্যাঁস বাঙালিদের কটাক্ষ করি। ঠেস মেরে কথা বলি। দীপ্ত জানে।

আমার কাঁধ জড়িয়ে আমাকে আর-একটু কাছে টেনে নিল ও। জিজ্ঞেস করল,” কী হয়েছে? সেই থেকে রণচণ্ডী মূর্তি কেন?

মনটা সত্যিই বিক্ষিপ্ত। কীভাবে সামলাব বুঝতে পারছি না।

বললাম, ”ঠিক ধরেছিস। সকাল সকাল সেই সম্পাদকের ফোন।”

দীপ্ত বলল, “ওই বিষ লোকটা? কী বলছে? আমাদের বাড়িতে থাকার আগে ফোনে কত গদগদ গলা। এখন তো খোঁজও নেয় না তোর। কোথা থেকে যে জোগাড় করিস লোকজন!”

দীপ্ত ঠোঁট কাটা ছেলে। লোকের আড়ালে বা সামনে এক ভাবে কথা বলবে। পরিশ্রমী। মনে কোনও প্যাঁচ নেই। চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বয়স। দেখে বোঝা যায় না। সরল মন হলে চেহারায় দীপ্তি আসে। মা বলত ছোটবেলায়।

তখন আমি দিনরাত প্রেম করি। লেখাপড়ায় মন নেই। গাল ভর্তি ব্রণ। বাজার চলতি চন্দন প্যাক লাগাতাম। পাখার হাওয়ায় শুকোবে। তার পর ঘষে ঘষে তুলতে হত সেই প্যাক। মা হেসে বলত, ”কোনও লাভ নাই। মনের ভিতরটা ফুইটা উঠবই চোখেমুখে।” সেই সব মজার দিন! ঘুরেফিরে মনে পড়ে যায়।

আমার পরিবার বাঙাল। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে বাড়ি। যৌথ পরিবার। সবাই বাঙাল ভাষায় কথা বলে। এই দেশে সেই সব বাড়ির নানা কোলাহল ছাড়া থাকতে হয়। কখনও বেশ লাগে। কখনও অঝোরে কাঁদি। বাংলায় লিখলে মনটা কলকাতায় পড়ে আছে মনে হয়।

”কী রে, সেই লোকটাই ফোন করেছিল অত সকালে?”

দ্বীপ্তর প্রশ্নে সম্বিত ফিরল আমার। বললাম, “হ্যাঁ। সেই লোকটা। ফোনের ওপারে হঠাৎ চেঁচিয়ে বললেন, “তোমার লেখা এইবার পুজো সংখ্যায় নেওয়া যাবে না।”

সবে ঘুম থেকে উঠেছি। আকাশ থেকে পড়লাম। জানতে চাইলাম, “কেন? নেবেন না কেন? এই লেখার জন্য আপনিই আমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন। আমি এখনও জমা দিইনি। ভাল হয়েছে না মন্দ হয়েছে, না দেখেই হঠাৎ এইরকম সিদ্ধান্ত? ”লোকটা অসভ্যের মতো উত্তর না দিয়ে ফোন রেখে দিল।”

দীপ্তর অফিসের একটা কনফারেন্স কল এসেছে। বললাম, ”ধরে নে। আমার কথা পরে বলব।”

কাউকে কথাগুলো না বলে থাকতেও পারছি না। দীপ্তর অফিস কলটা আসার আর সময় পেল না।

এই রে! নামল বৃষ্টি। এখন এখানে ফল। কথায় কথায় বৃষ্টি। রোদ উঠলেও, সূর্যের তেজ নেই। পাতার রং কমলা, হলদেটে হচ্ছে ধীরে ধীরে। বৃষ্টির জল আর রোদের মিলমিশে চিকচিক করে।

মেয়ের আজ স্কুল স্পোর্টস-ডে। ভিজবে না তো? আজ স্কুলে যাওয়ার সময় বললাম, পঞ্চুটা নে। হাত নাড়িয়ে ‘না’ বলে বেরিয়ে গেল।

চোদ্দ বছর বয়স। বড্ড অবাধ্য। আমার চোদ্দ বছরে মায়ের কথা শুনতাম আমি? মনে পড়ছে না। সামান্য স্মৃতি।

যতদূর মনে পড়ে শুনতাম না মায়ের কথা। ভাল ভাবে মাকে জড়িয়ে আদর করে অবাধ্য হতাম। আমার মেয়ে, রুবির সে সব বালাই নেই। ওর কথাবার্তা বড় রুক্ষ। ঠোঁট কাঁটা। দীপ্তর মতো।

যাক গে। সংসারের অনেক কথা বললাম আপনাদের। মনের ভিতর রাগ, ক্ষোভ কেন জমে আছে, সেই কথায় ফেরা যাক। আমি নিজের মনে নিজে থাকি, জানেন। গল্প, উপন্যাস লিখি। ইউনিভার্সিটিতে কেমিস্ট্রি পড়াই। বাড়ি থেকে ইউনিভার্সিটি দশ মাইল মতন। ম্যাসাচুসেটসের একটা ছোট শহরতলিতে থাকি।

কয়েক বছর আগে বাংলায় লেখা শুরু করলাম। প্রথম প্রথম বিদেশের জার্নাল লিখতাম। হাত পাকল। প্রকাশক, সম্পাদকরা ধীরে ধীরে গল্প, উপন্যাস চাইতে শুরু করলেন। ব্যস। চাকরির পাশাপাশি অন্য এক ধরণের জার্নি শুরু হল। বেশ চলছিল।

সম্প্রতি কলকাতার কিছু লোকজন বুঝলেন, অকারণ কাঠি করা শুরু করেছে আমাকে। কেন?

আমি বিদেশে বসে লিখব। সেই সব লেখা পত্রিকায় ছাপা হবে কেন? আমি বহিরাগত। বাংলায় একমাত্র পশ্চিমবঙ্গে বসেই লিখতে হবে। সরাসরি এক বিখ্যাত কবি আমাকে এই কথাটা বলেছিলেন। নাম নেব না তাঁর। রহস্য থাক। আপনারা চেনেন সবাই তাঁকে। টিভিতে বসে প্রায়ই। লোকে বলে শাসকের ডান হাত।

কেন এভাবে ভাবে বাঙালি? এত সংকীর্ণ মনে কবিতা লেখা যায়? সাহিত্য চর্চা হয়? ভাবি মাঝেমধ্যে। মানুষের মন স্টাডি করতে ভাল লাগে আমার। স্টাডিগুলো কিন্তু বেশ মিলে যায়। যত মিলে যায় তত নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বাড়ে আমার।

যাই হোক। লোকটাকে আমি আবার কল করলাম।

”আপনার ভদ্রতা জ্ঞান নেই? কটাস করে কিছু না বলেকয়ে ফোন রেখে দিলেন?”

”কী…ই জজজজানতে চাও?” লোকটা তোতলা হয়ে গেল নাকি? এভাবে কথা বলছে? বলে বলুক। আমার উত্তর চাই।

”আমার লেখা কেন বাদ গেল? সামারে আপনি আমার বাড়িতে এসে পনেরো দিন থাকলেন। কবিতার অনুষ্ঠান করলেন। তারও অনেক আগে, বোধহয়, ফেব্রুয়ারি মাসে আমাকে লেখার আমন্ত্রণ জানান। আমি নানা কাজের মধ্যে উপন্যাসটা লিখলাম। এখন বলছেন লেখা জমা দিতে হবে না?”

”সুকল্যাণবাবুর গার্লফ্রেন্ডের লেখা নিইনি। উনি হয়তো আমার বসকে কিছু বলেছেন। তাই তোমার লেখাও নেওয়া হবে না।” আমার মাথা তড়াং করে গরম হয়ে গেল। কার গার্লফ্রেন্ড লেখা দেবে, বা দেবে না, তার ওপর আমার লেখা ছাপার বিষয়টা নির্ভর করবে কেন? আমার আমন্ত্রিত লেখা। আশ্চর্য! এ কেমন যুক্তি? আমি গলা এক ধাপ উঁচিয়ে বললাম, ”আপনাদের পত্রিকায় লেখা জমা দেওয়ার অফিশিয়াল পদ্ধতি নেই?”

”না। আমি যা বলব তাই হবে। তুমি কেন সমাজমাধ্যমে আমার ছবি পোস্ট করেছিলে? কেন সাহিত্য জগতে সবাই জানবে আমি তোমার বাড়িতে থেকেছি পনেরো দিন?”

আরও অবাক হলাম। হাঁ হয়ে বসে আছি। উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লাম লোকটার দিকে।

”বলব না কেন? আপনি আমার বাড়িতে এসেছিলেন। থেকেছেন। আপনার প্রয়োজন ছিল। আমার ভাল লেগেছে আপনাকে হোস্ট করতে। গোপন করব কেন?” লোকটার তোতলামি বেড়ে গেল। অ্যা, ব্যা, ত্যা। হরেক রকম শব্দ। স্পিকার অন ছিল। দীপ্ত পিছন থেকে এসে বলল, “লোকটা মদের ঘোরে কথা বলছে। যত ধ্যাষ্টামো! তুই ও এক ক্যালানে। বুঝতে পারিস না? কলকাতার সময়টা ঘড়িতে দেখ। এখন অনেক রাত ওখানে। মদ খেয়ে তোর সঙ্গে কথা বলতে চায়। ও চায় তুই কথা বাড়াবি। কথার ওপর কথা হবে।”

আমি সত্যিই ক্যালানে। দীপ্ত না বললে বুঝতেই পারতাম না। লোকটা অসুস্থ। চিকিৎসা দরকার। ফোন কেটে দিলাম ”রাখছি।” বলে।

”ও আমাদের বাড়িতে থাকার জন্য তোকে কোনও লিটারারি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল? সত্যি বলবি।”

”মোটেও না। বাজে বকবি না। ওঁদের অফিসের ডেস্কে আগেও আমার লেখা গিয়েছে। ছাপা হয়েছে। এই লোকটার সঙ্গে কোনও কানেকশন ছাড়াই। বিদেশে আসছে জানা। হোটেলে থাকবে? লোকটা বলেছিল, অনেক খরচ। তাই…”

”ও কী ভেবেছিল? বিদেশে খরচ নেই? হোটেল বা মোটেল, খাওয়া, কমিউট খরচ না ভেবেই ট্রিপ প্ল্যান করেছিল? নাকি মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে এভাবেই এন.আর.আই দের ঘাড় মটকে নেয় এরা? আর, কলকাতায় ফিরে সেই সব এন.আর.আই বন্ধুদের বদনাম করে? কাঠি করে?

সতর্ক থাকিস। তোর ভালমানুষিকে এই ধরণের লোকজন দুর্বলতা ভাবে। তোর সৌজন্যকে ভাবে লোভ।”

দীপ্ত সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল। অফিসে বসবে আবার। হয়তো আমার চেঁচামেচি শুনে নেমে এসেছিল। বৃষ্টি থামেনি এখনও। বেড়েছে। মেঘ আছড়ে পড়ছে মাটিতে। রুবিকে একটা টেক্সট করব? আজ আমার ক্লাস নেই। কলেজে যাব না। ভাবলাম বাড়ির পড়ে থাকা কাজগুলো শেষ করব। খানিকটা সময় বেশি ঘুমোব। তা না। সকাল থেকে আলটপকা অশান্তি।

লোকটার অনেক স্ক্যান্ডেল কলকাতায়। প্রাক্তন স্ত্রী উঁচু পদে কাজ করেন। স্বামীকে একদমই পাত্তা দেন না। একটা সময় একই অফিসে স্বামী স্ত্রী কাজ করতেন। লোকটা অফিস পলিটিকস করতে গিয়েছিলেন স্ত্রীয়ের বিরুদ্ধে। স্ত্রী কৌশল করে অফিস থেকে স্যাক করে দিয়েছিলেন। তার পর এই মেয়ে সেই মেয়ে। কত কেচ্ছা। সবই লোক মুখে শোনা। বিশ্বাস করতাম না। লোকটার মুখের মিষ্টি কথাগুলোই বিশ্বাস করতাম। আমারই ভুল।

এই দেশে হোটেলে থাকা খরচা সাপেক্ষ। আই.এন.আর-এ রোজগার লোকটার। ভেবেছিলাম খানিকটা সাহায্য হবে। সেই মানুষ যে কলকাতায় ফিরে এইরকম কাঠি করবে, কে জানত? হারামির হাতবাক্স। একদিকে হোটেল, কমিউট, রেস্তোরাঁর খরচ বাঁচাবে। অন্যদিকে গোপনে থাকবেন।

আমি এখনও বুঝতে পারলাম না। আমাদের বাড়িতে থাকবেন এই কথাটা গোপন করবেন কেন? কার কাছে গোপন করতে চেয়েছিলেন? কেনই-বা চেয়েছিলেন?

হঠাৎ কেন জানি না মনে হল। পুরনো পোস্টটা একবার ঘুরে দেখা যাক। ফেসবুক ঘাঁটছি। দেখি, লোকটা যে আমার বাড়িতে এসে ছিলেন, নানা শহরে ঘুরেছেন আমাদের সঙ্গে, সেই সব ছবি, পোস্ট সরাতে বলছে ফেসবুক।

নোটিফিকেশন। তোমার পোস্ট আনএথিকাল। ভুরু কুঁচকে বেশ কিছুক্ষণ পড়লাম নোটিফিকেশনটা। বুঝেছি। এও লোকটার কীর্তি। নিশ্চয়ই আমার পোস্টের বিরুদ্ধে কিছু লিখেছে ফেসবুকে। এই কথা? থাকতে দিলাম। ঘণ্টায় ঘণ্টায় জুস, ফ্রুটস, লাঞ্চ, ডিনার, স্ন্যাক্স। অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে দিলাম পাড়ার ক্লাবে। এই তার পরিণাম?




পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আর এক চমক। লোকটার লম্বা টেক্সট। ”তোমার নামে নালিশ করেছে শাওলি আচার্য। একটা টেপ রেকর্ড পাঠালাম। শোনো। তোমাদের কলকাতা কমপ্লেক্সের এক প্রতিবেশী বলেছেন তুমি একটি নষ্ট মেয়ে।” শাওলি কে? কিছুতেই মনে পড়ছে না। রেকর্ড শুনলাম। বেশ ইন্টারেস্টিং। আমার প্রতিবেশী অণু কাকিমার গলা।

কয়েক মাস আগে পর্যন্ত আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। হঠাৎ আমার সম্পর্কে এত কুৎসা রটিয়ে বেড়ালেন? কী স্বার্থ থাকতে পারে?

মনে পড়েছে। মনে পড়েছে। এই জন্যই ছোটবেলায় ব্যোমকেশ, ফেলুদা পড়তে হয়। বড় হয়ে গোয়েন্দা মনটা বেঁচে থাকে। সহজেই কে ভিলেন, কে কাঠি করছে বোঝা যায়।

শাওলি আচার্য এবং তনয় চাটুজ্জে সাহিত্য পাড়ায় স্বঘষিত সাহিত্যিক দম্পতি। তনয় কলির কেষ্ট। নতুন মেয়ে ধরে বই ছাপানোর ব্যবস্থা করে দেবে। আয়কর বিভাগে উচ্চ পদে চাকরি করেন।

কবি, সাহিত্যিকদের ভাল দেখভাল করেন। দামি মদ, মাংস জোগাড় করে দেন। কলকাতা, শহরতলির বুকে বড় বড় রিসোর্ট বুক করে দেন। কী বললেন? চিকেন না মাটন? না না। সেই মাংস নয়। মেয়েদের শরীর। তনয় মেয়েদের চামড়াকে মাংস বলেন। মেয়েদের ছোট বুক হলে বলেন, বুকে তুলো গোঁজা। আর বড় বুক হলে সোজা ব্যবসায় নেমে পড়েন। দেহ ব্যবসা। বুঝেছেন নিশ্চয়ই।

এই সমস্ত করে চাকরি ও সাহিত্য জগতে ভালই টিকে রয়েছেন। ওঁর স্ত্রী শাওলি, স্বামীর প্রতিফলিত আলোয় আলোকিত। লেখার চেষ্টা করেন। প্রচুর লেখেন। কিছুই হয়ে উঠছে না। কাঠি করলে কী আর মা সরস্বতী সঙ্গে থাকেন? আপনারাই বলুন। শাওলি গত কয়েক মাস ধরে আমার লেখা বন্ধ করার জন্য বেশ উঠে পড়ে লেগেছেন।

এইদিকে অণু কাকিমা বিশাল বড়লোক। দুঃখ হলে ক্যালকাটা ক্লাবে বসে মদ খান। কষ্ট হলে দুবাই চলে যান শপিং করতে। আর, আনন্দ উদযাপন করেন তাজ বেঙ্গলে পার্টি করে অথবা ইউরোপ ট্রিপ। বয়স ষাটের কোঠায়। একটি এন.জি.ও করেন। ঠোঁটে টুকটুকে লাল লিপস্টিক। সকাল সন্ধে দুপুর রাত্রি।

ওঁর এত পয়সা কোথা থেকে আসে ভাবছেন? সে সব ভাবার দরকার নেই। ভেবে কী করবেন, বলুন? সিস্টেম বদলাবেন? পারবেন না তো। তা হলে? বেকার মনকে অশান্ত করে কী লাভ?

এই অণু কাকিমার ট্যাক্সের ফাইলপত্র দেখেন তনয়। কীভাবে জানলাম? অণু কাকিমা বেশ কয়েক বছর আগে আমার একটা ইন্টারভিউ নিতে বলেছিলেন শাওলিকে। বিষয় ছিল প্রবাসে বাংলা চর্চা। শাওলির নেওয়া সেই ইন্টারভিউয়ের রেকর্ড আমার কাছে রয়েছে। তখনই শাওলির হাবভাব ভাল লাগেনি আমার। ভিডিও কলে কথা হয়েছিল। কেমন যেন হিংসুটে চাওনি। একটা হীনমন্যতায় ভোগেন। দেখে মনে হয় মেয়েটির জীবনে ভাল প্রেমের বড় অভাব।

অণু কাকিমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ”মেয়েটি কে?” অণু কাকিমা ফোনে ফিসফিস করে বলেছিলেন, ”ওর হাজবেন্ড আমাদের ট্যাক্স পেপারস দেখে রে। বজ্জাত ছেলে একটা। দিনরাত মেয়েবাজি। শাওলির বড় কষ্ট। স্বামীর পজিশন, খ্যাতি চায়। আবার স্বামীর সঙ্গে থাকতেও চায় না। আমার কাছে কাজ চায়, আমি কোথা থেকে চাকরি দেব?”

তার পর আর তেমন যোগাযোগ হয়নি। শাওলির সঙ্গেও না। অণু কাকিমার সঙ্গেও না। শাওলির সঙ্গে তাও দু’একটা বইমেলায় দেখা হয়। হাসেন। হাসিটার মধ্যে কেমন একটা ‘পটি পেয়েছে। পটি পেয়েছে’ ভাব। প্রাণ খোলা হাসি নয়।

সেই শাওলি তার স্বামীর ভয় দেখিয়ে এইসব রেকর্ড করেছে নিশ্চয়ই। অণুদিও নিজের স্বার্থে ভয়েস রেকর্ড করতে বাধ্য হয়। বুঝি। সবাইকে এজীবনে খেয়ে, পরে, ফলস গুডি গুডি ইমেজ বজায় রাখতে হয়। অণুদির রুচি, শিক্ষা অনুযায়ী কথাগুলো বলেছেন। শুধু আমার নামে নয়। দীপ্তর সম্পর্কেও বলেছেন।

যাই হোক। সম্পাদক মহাশয় আমার লেখা নেওয়া এই কারণেও বন্ধ করলেন। শাওলির সঙ্গে কথা বলব? না। শাওলির মতো নোংরা হতে পারব না।

এও ঠিক আমি মা সারদা নই। ছেড়ে দেব না কাউকে। পরিশ্রমের লেখা কাঠি করে ছাপবে না, আমি মেনে নেব। আদুরে গলায় কথা বলব? এই ভেবেছেন লোকটা? কী করা যায়? কী করা যায়? ভাবতে ভাবতে বেশ কিছুদিন কেটে গেল।

সম্প্রতি বস্টনের পথে পথে বাঙালিদের মিছিল। কলকাতার ধর্ষণ কাণ্ডের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার চেয়ে আন্দোলন চলছে। এই আবহে যৌন হেনস্থার অভিযোগে সাসপেন্ড হলেন বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক। ঘনিষ্ঠ দৃশ্যের শটে মেয়েদের চুম্বন করেন। কোলে বসতে বলেন। চুমু খান। পাবলিকলি হেনস্থা করেন। মেয়েটি এখন জনসমক্ষে ক্ষমা চান।

এই বিষয়ে দেখি, অণুদির লড়াকু স্টেটমেন্ট সমাজমাধ্যমের টাইমলাইনে। ঘরে ঘরে এখন বাঙালি মাতঙ্গিনী হাজরা। মনে মনে ভাবি, বাঙালি বুদ্ধিজীবীর মঙ্গল হউক। অণুদির মতো মানুষই কি পরিবর্তন আনবেন শেষমেশ?

দীপ্তকে সব বললাম। ডিটেলে। ও বলল, ”তোদের কে বিচার দেবেন বল? তোরা মেয়েরাই মেয়েদের চরম শত্রু। মুখ আর মুখোশ আলাদা।”

সত্যি কথা। আমার মাথায় প্রচণ্ড এক ভার চেপে বসল। এর শেষ দেখব আমি। অ্যাটিকে চলে গেলাম। ঠান্ডা মাথায় অণুদিকে টেক্সট করলাম। লম্বা টেক্সট।

”মে মাস অবধি তোমার সঙ্গে ভালই কথা হত লেখালেখি নিয়ে। তুমি আমাকে এত ঘৃণা করো, বলোনি তো কখনও? তুমি তো অনেক কিছুই জানো আমার বিষয়ে যা আমি নিজেই জানি না। একদিন সামনাসামনি আলোচনা করব। কেমন? দীপ্তও থাকবে। ওকে বোলো আমি কত খারাপ। দ্যাখো, যদি বিয়েটা ভাঙে। একটা সংসার রক্ষা করতে পারবে তুমি। কলকাতার মেডিকাল হাসপাতালে ধর্ষণের ঘটনাটির পর তোমার কথাগুলো খুব বেশি করে মনে পড়ছে। পৃথিবীতে কি শুধু শরীরেরই ধর্ষণ হয়? আর হ্যাঁ, যদি আমার এবং দীপ্তর মুখোমুখি কথাগুলোর সত্য প্রমাণ না হয়, আমাদের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। ইনবক্সে হলে ব্যাপারটা ভাল নয়তো জনসমক্ষে কথা উঠবে।”

কয়েক মিনিট পর অণুদি লিখল,” আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমি তোকে ভাল করে চিনি না। আমি তোর নামে বলব? কেনই-বা বলব?”

ভুল জায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছ অণুদি। হাসতে হাসতে আমি লিখলাম।

”আমিও অবাক! জানো? এ সব টেক্সটে অনর্থক আলোচনা না করাই ভাল। প্রমাণ সহ সামনাসামনি বসব। তুমি একজন প্রেস্টিজিয়াস শিক্ষিকা। নেটিজেন। সমাজমাধ্যমে তোমার প্রচুর খ্যাতি। তুমি ভেবেচিন্তেই বলেছ যা বলার। কেন বলেছ, সেটা তুমি বেটার জানবে। তাই না? তুমি উঁচু ডালের পাখি। আমি কী করে এ সব নোংরা কথা বুঝব? আমি শুধু সত্যিটা সর্বসম্মুখে বলতে পারি। তার জন্য উঁচু ক্লাস হতে হয় না বোধহয়। সামান্য শিক্ষা, মেরুদণ্ড, সৌজন্য আর ভদ্রতা থাকলেই হয়।”

পরের দিন তোলপাড় কাণ্ড। লোকটা কান্নাকাটি করে ফোন। শাওলি লোকটাকে কল করে হুমকি দিয়েছে। বলেছে, ”এই মতলব ছিল মনে মনে? আমাকে আমেরিকার মেয়েটার বিষয়ে খারাপ খারাপ কথা বলেছ। আমি বিশ্বাস করে একখানা অডিও পাঠালাম। সেটা মেয়েটিকে দিয়ে দিলে? তুমি কার দলে হে? দেখাচ্ছি মজা। তনয়কে আজই বলব তোমার সব মদ, মেয়ের সাপ্লাই বন্ধ করবে।” লোকটা এই সব কথা আমাকে বলছেন? কত নীচে নামবেন? ভারসাম্য হারিয়েছেন নাকি? এই লোকটার ওপর আমার এক সময় দয়া হয়েছিল? বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলাম?

এর পর সেদিন অনেক রাত। কলকাতায় তখন সকাল। শাওলিকে লিখলাম।

”নমস্কার শাওলি। আপনার একটি পুরনো লেখা পড়ব বলে ফেসবুকে আপনার প্রোফাইল খুঁজলাম। দেখলাম, আপনি আমাকে ব্লক করেছেন। কারণটা জানতে পারি? অনেক বছর আগে আপনি টেলিফোনে আমার একটি ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। রেকর্ড রয়েছে। অডিও টেপ। অত্যন্ত প্রিয় ‘নানা রঙের দিনগুলো’ আমার! তার পর সম্প্রতি কী এমন হল? আপনার সঙ্গে কি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমার কোনও শত্রুতা রয়েছে? আমিও সতর্ক হতে চাই। এই অপমানজনক আচরণ কেন করা হল আমার সঙ্গে? বিচার ছিনিয়ে আনবই।”

দীপ্তকে দেখালাম টেক্সটগুলো। ও পড়ে বলল, সবাই ব্লক করবেন তোকে এইবার। সকলে গহ্বরে পড়ে গিয়েছেন। শাওলি, অণু কাকিমা আজ ধরাশায়ী। মনে মনে বলবেন, কার পাল্লায় পড়লাম রে বাবা? ”কিছুক্ষণ হাসলাম আমরা। জোর বাড়ছে গলার।

রুবি আমাদের হাসি শুনে দোতলা থেকে ডাইনিং রুমে নেমে এল।

”কী হয়েছে বাবা?”

দীপ্ত হাসি থামিয়ে বলল, ”চারপাশে স্তূপীকৃত আবর্জনা। তোর মা ঘর পরিষ্কার করছে। পুজো চলে এল। কত পোকামাকড়। বাগস, ইউ নো? একাই করছে সব।” মেয়ে বলল, ”তার জন্য এত হাসাহাসি?”

আমি অকপট গলায় উত্তর দিলাম, ”ঘর পরিষ্কার থাকলে মন ভাল হয়। ইউ উইল কাম টু নো। মনে একশো প্রদীপ জ্বলে ওঠে।” রুবি মাথা নেড়ে পাশের ঘরে চলে গেল। কাল ছুটি। পড়তে বসবে না। সিরিজ বিঞ্জ ওয়াচ করবে। এক ব্যাগ চিপস খাবে।

দীপ্ত বসে ছিল ডাইনিংয়ে। উঠে এসে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। আমি তখন কালকের জন্য আমার লাঞ্চ প্যাক করতে ব্যস্ত। কাল পর পর দুটো ক্লাস। একটা গ্ৰুপ মিটিং সকাল এগারোটায়।

”অ্যাই রূপকথা।” এই গলায় আদরের আগে ডাকে আমাকে দীপ্ত। আমি বলি, “হুঁ ..”

ও বলে, ”রাতে দিনে কলকাতা মহানগরে স্লোগান, মিছিল। কিন্তু, আমার দুর্গতিনাশিনীর প্রতিবাদ শুরু হয় ঘরে। তার তেজোদ্দীপ্ত ক্রোধ। সে প্রয়োজনে ফোঁস করে উঠতে জানে। এই দুর্গা দিনরাত চা-সিগারেট। এই দুর্গা সমাজকর্মী। লেখিকা। মা। সব…”

আমি দীপ্তর দিকে ঘুরে তাকালাম। ও আমার শক্তির আলোয় প্রতিদিন সাহস যোগায়। রুবি আমাকে আলো দেয়। রুবির থেকে বিস্ফারিত আলো। লালচে। এই রশ্মি আমার অস্ত্র।

সত্যি বলতে, সমাজে ক্ষমতাদম্ভের পচন থাকবে। একথাও সত্য যে, মাথা নিচু করে, মুখ বুজে সহ্য করব না আমি। এক পা দুই পা করে আমি প্রতিদিন হাঁটছি।

কোথাও প্রতিবাদী আগুন ভরা কোনও স্পিচ নেই আমার। আমার ভিডিও রেকর্ডিং পোস্ট পাবেন না সমাজমাধ্যমে। আমি সেলফি তুলতে শিখিনি। আমাকে হালফিলের মিছিলে দেখতে পাবেন না।

আমি আছি। কঠোর প্রয়োগে।

আমি শুধু আমার রূপের কথা বলে গেলাম আপনাদের। সত্য। নির্ভয় রূপ আমার।

আমি রূপকথা। পক্ষকালের মধ্যে আমি দৃশ্যমান নই।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *