বিনোদ ঘোষাল
পৃথিবী এখানে যেন একেবারে আচমকা থেমে গেছে। ছুটতে ছুটতে এখানে পৌঁছে জিভ বার করে হাঁপিয়েছে অনেকক্ষণ, তারপর বিশ্রাম নিচ্ছে। সময়, শব্দ, তাড়া, পালানো সব সবকিছু থেমে গেছে এখানে। এলাকাটায় ঢুকতেই পারেনি। যেভাবে চব্বিশ বছরের নীলয় কিছু কিছু এলাকায় ঢুকতে পারত না। বারণ ছিল। আবার চারদিকটা তাকাল নীলয়। যতদূর চোখ যায় শুধু জলাভূমি। মাথার ওপর ঝকঝকে নীল আর নীচে সবুজ ব্যস।
না, ব্যস নয়। আরও কিছু রয়েছে এখানে। প্রানপণে আবার নিশ্বাস টানল নীলয়। হড়হড় করে খানিকটা সবজে নরম হাওয়া ওর ফুসফুসে ঢুকল। নিশ্বাসটা একটু চেপে রেখে আস্তে আস্তে ছাড়ল। এত আরাম লাগছে! মনে হচ্ছে যেন কেউ বুকের ভেতর মুঠো মুঠো ভোরবেলার শিউলিফুল ভরে দিচ্ছে আঁজলা ভরে।
‘ওই দেখুন চোখে লাগান ওটা। দেখুন দেখুন। ওটার নাম গ্রে ল্যাগ গুজ।’ বলে উঠল সুজন। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল নীলয়। সুজনের কথা শুনতে পেল না। ভাঙা হিন্দি আর বাংলার সঙ্গে কিছুটা ওড়িয়া মিশিয়ে আবার বলে উঠল সুজন। ‘ওই যে ওই যে ওই পক্ষীটা বসে আছে, অরেঞ্জ কালার ওর নাম হল রুডি শেলডাক…।’ বায়নাকুলারটা চোখে লাগিয়ে দেখুন।
এবার শুনতে পেল নীলয়। গলায় ঝোলানো ভারি বায়নাকুলারটা চোখে লাগিয়ে পাখিটাকে একেবারে সামনে টেনে আনল। সত্যিই অপুর্ব সুন্দর। সুজনের মুখে ‘পক্ষী’ শব্দটাও বেশ সুন্দর বাজছে কানে।
সুজন ততক্ষনে সেই পাখির ডিটেল বলে যাচ্ছে। এরা কোথা থেকে আসে। কতদিন ধরে আসছে।
গত একঘন্টা ধরে এই সুজন বেহেরার নৌকোতেই ঘুরছে নীলয়। আরও দেড়ঘন্টা ঘুরবে। মোট আড়াইঘন্টার কনট্রাক্ট হয়েছে এক হাজার টাকায়। আসলে আজ থেকে প্রায় পাঁচদিন আগে নীলয় এসেছে বারকুলে। চিলিকা লেকের খুব কাছের একটা হোটেলে উঠেছে। এখানে পৌঁছোবার পর গত কয়েকদিন হোটেলের ঘর ছেড়ে বেরোয়নি। মোবাইলও নেই সঙ্গে। নির্দেশ আছে মোবাইল অন করা যাবে না। খুব দরকার পড়লে কোনও বুথ থেকে ফোন করে কথা বলা যাবে। নিজের বাড়ির কারও ফোনে কথা বলা যাবে না। কারন ওর ফ্যামিলির সবার ফোন ট্যাপ করা হয়ে থাকতে পারে। এত সাবধানতার কারণ নীলয় হয়তো একটা খুন করেছে। মানুষ খুন।
‘আপনার কি পক্ষী দেখতে ভাল লাগছে না?’ ছোট্ট নৌকোটার ওপ্রান্তে বসে বাঁশের লগি ঠেলতে ঠেলতে জিজ্ঞেস করল সুজন। বছর পঁয়ত্রিশ বয়স। গায়ের রঙ মিশমিশে কালো। মাথায় ঘন কালো কোঁকড়া চুল। হালকা দাড়ি গোঁফ। সাড়ে পাঁচফুটের মতো হাইট। পরনে ময়লা হয়ে যাওয়া সাদা টি শার্ট আর মিলিটারিদের মতো জংলা ছাপ প্যান্ট। সুজনের চেহারার সবথেকে বড় বিশেষত্ব ওর হাতদুটো। একেবারে শালগাছের গুড়ির মতো পেশল এবং নির্মম কঠোর। প্রতিবার লগি টানার সময় ওর দুই হাতের কালোরঙের পেশিগুলো চড়চড় করে ফুলে উঠছিল। আঙুলগুলোও মোটামোটা। এই হাত কিছু একটা চেপে ধরলে সহজে ছাড়ে না বোঝা যায়।
‘হুঁ ভাল লাগছে।’
‘এই বছর সাড়ে সাত লাখ পক্ষী এসেছে’, খুব গর্বের সঙ্গে জানাল সুজন।
‘ও আচ্ছা’, বলেই নীলয় জিজ্ঞাসা করল, ‘এখান থেকে সমুদ্র কতদূর?’
‘অনেক দূরে। ওই দেখুন ওটার নাম হল আর্কটিক টার্ন। সেই সাইবেরিয়া থেকে আসে।’
নীলয় আবার বায়নাকুলার চোখে লাগাল সুজনের নির্দেশ করা পখিটাকে দেখল। চারদিকে শুধু পাখি আর পাখি। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ। কেউ উড়ছে, কেউ আবার দল বেঁধে এমনিই বসে রয়েছে, কেউ কেউ আবার মাছ খোঁজায় ব্যস্ত। কত রকমের রঙ তাদের। মানুষ না, এটা যেন শুধু পাখিদের পৃথিবী। মাঝে মাঝে তাদের বিচিত্র ডাকে নৈশব্দ স্থির পুকুরে ঢিল পড়ার মত একটু সময়ের জন্য কেঁপে উঠছে চারদিকটা। তারপর আবার চুপ।
‘আমাকে একটু ওই দিকটায় নিয়ে যেতে পার সুজন? অনেক পাখি। আরও কাছ থেকে দেখতে পাব।’ আঙুল তুলে বিস্তীর্ন জলাভুমির মাঝখানের দিকে ইঙ্গিত করল নিলয়।
‘না ওদিকে যাওয়া যাবে না। ওখানে জল কম, নৌকো আটকে যাবে।’
‘ও আচ্ছা।’
‘কেমন লাগছে দাদা আমাদের মঙ্গলাজোড়ি?’
‘স্বপ্নের মতো।’
নীলয়ের কথা সুনে সামান্য হাসল সুজন। হাসিটা সামান্য হলেও আনন্দের, গর্বের। এখানে যারা একবার আসে, তারা বারবার আসে। মায়ায় পড়ে যায়।
‘হুম। এখানে একটু থাম।’
নীলয়ের কথায় লগি টানা থামাল সুজন। খুব নিচু গলায় বলে উঠল ‘আরেব্বাস, ওই যে দেখুন দাদা …, ওহ আপনার কী ভাগ্য এই পাখি দেখতে পেলেন। এই পাখি খুব রেয়ার। চোখেই পড়ে না। কালও এক পার্টি এসেছিল, তন্ন তন্ন করে খুঁজেছেন তারা সকাল থেকে, দেখতে পাননি। আপনার লাক ভাল। আমিও অনেক দিন পরে…’ কথা থেমে গেল সুজনের। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল সেই পাখিটার দিকে।
কিছুক্ষন পর সুজন জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি একা এসেছেন?’
‘হ্যাঁ একাই। কেন বলো তো?’ ভুরু কূঁচকে সন্দেহ নিয়ে পালটা প্রশ্ন করল ও।
‘না না এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। আসলে এখানে তো খুব বেশি টুরিস্ট আসে না। আর যারা আসে তারা হয় টিয়ে অথবা বড় ক্যামেরা নিয়ে। আপনি একেবারেই খালি হাতে একা এসেছেন দেখে ভাবলাম…’
‘ও, আচ্ছা। মনের ভেতর মুহূর্তে গজিয়ে ওঠা আশঙ্কাটা আবার থেমে গেল নীলয়ের। সেদিনের পর থেকে সব কিছুকেই কেমন যেন ভয় লাগছে, সন্দেহ লাগছে। মনে হচ্ছে সবাই যেন সববিছু জানে। এইমাত্র চেপে ধরবে ওকে।’
‘আপনি বোধ হয় এই প্রথমবার এলেন এইখানে?’
‘হ্যাঁ’, বলার সঙ্গে সঙ্গে উল্টোদিক থেকে ওদের নৌকোর খুব কাছে আরেকটা অমন ছোট নৌকো এল। নৌকোয় মাঝি ছাড়া একজন লোক বসে রয়েছে, মাথায় হ্যাট, হাতে বিশাল লেন্সওলা ক্যামেরা। ইতিউতি তাকাতে তাকাতে চলে গেল। ক্যামেরা আর তাকানো দেখে আন্দাজ করা যায় লোকটা প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার। এখানে এসেছে পাখির ছবি তুলতে।
যেমন নিঃশব্দে নৌকোটা কাছে এসেছিল তেমনই চুপচাপ চলে গেল।
এখন জানুয়ারি মাসের বেলা একটা। ঝলমলে আকাশ। সিগারেট ধরাল নীলয়। সুজনকে জিজ্ঞেস করল ‘এখানে খুব বেশি লোক আসে না? তাই না?’
‘না আসে না। জানেই না অনেকে।’
‘হুঁ, না জানাই ভাল।’
‘ঠিক বলেছেন। মানুষ বেশি আসলে এটা আর পাখিদের থাকবে না। ওরা আর আসবে না। আসলে কী জানেন পাখিদের মতো মন না হলে পাখির কাছে আসা যায় না।’
আচমকা এমন এক কথায় চমকে উঠল নিলয়। এই লোকটা কবি না মাঝি? এমন শালগাছের মতো চেহারার মানুষ কি কবি হয় কখনও? নীলয় খেয়াল করছিল লোকটার চেহারা এমন রাক্ষুসে এমনকি ওর সঙ্গে যখন ডাঙায় নৌকো ট্রিপের রেট নিয়ে কথা হচ্ছিল তখনও লোকটার চোখদুটো ছিল লালচে ঘোলাটে কেমন কুতকুতে, চেহারার সঙ্গে মানানসই। কিন্তু এখন নীলয় স্পষ্ট দেখছে লোকটার চোখদুটো পাখি দেখতে দেখতে কেমন যেন পালটে গেছে। কেমন যেন মাথার ওপরের উজ্জ্বল ঝকঝকে আকশটার মতোই নীল। এটা হয়তো মনের ভুল। কিন্তু ভুলটাই বা কেন হচ্ছে? ভাবতে ভাবতে আবার আদিগন্ত ছড়ানো জলাভূমিতে নিজের চোখ মেলল নীলয়। এই জায়গাটার কথা ও জানতই না। আসাও হত না কোনওদিন। কাল রাত্রে বুড়োদাকে ফোন করেছিল ও। বুড়োদা জানিয়েছে পরিস্থিতি আপাতত নিয়ন্ত্রণে। আর দিন দুয়েক পরেই নীলয় বাড়ি ফিরতে পারবে। সুতরাং এই দু’দিনে যদি ও কাছাকাছি কোথাও বেরোতে চায় বেরোতে পারে। কোথায় বেরোবে নীলয় বুঝতে পারেনি। হোটেলের সামনে একটা চায়ের দোকানে জিজ্ঞাসা করেছিল ‘চিলিকায় এখন পাখি দেখা যায়?’
লোকটা জানিয়েছিল ‘হ্যাঁ যায়’। মোটরবোটে করে এই বারকুল থেকেই যাওয়া যায় তবে পাখিরা এইসময় যেখানে থাকে বোট ততটা যায় না। এক কিলোমিটার আগে থেকেই ফিরে আসতে হয়।
কারণ?
বোটের মোটরের শব্দে পাখিদের ডিস্টার্ব হয় বলে এই ব্যবস্থা।
যাহ, এই সময় এতটা কাছে এসেও পাখি দেখা যাবে না! নীলয় জানে চিলিকায় প্রতি বছর এই সময়টায় লাখে লাখে মাইগ্রেটরি বার্ড এসে আশ্রয় নেয়। অনেক বছর থেকে আসার ইচ্ছেও ছিল খুব। হয়ে ওঠেনি। কিন্তু সেই আসা যে এইভাবে হবে ভাবতেও পারেনি।
তাহলে কাছ থেকে দেখার আর কোনও উপায় নেই?
লোকটা বলেছিল ‘আছে’। সেইমতো বারকুল থেকে একটা অটো ভাড়া করে প্রায় ঘন্টা দেড়েক রাস্তা পেরিয়ে মঙ্গলাজোড়ি। মেন রাস্তা যতটা সুন্দর গ্রামের ভেতরের রাস্তা ঠিক ততটাই খারাপ। শেষ দু’কিলোমিটার একেবারে হাড়গোড় ভেঙে দিচ্ছিল যেন এমন ঝাঁকুনি। একটা গরিব ছোট্ট গ্রাম পেরোনোর পর সরু মাটির উঁচু রাস্তা। মাটির রঙ লাল আর দু’ধারে জলাভূমি। তার ওপর দিয়ে আরও অনেকটা যাওয়ার পর একটা ওয়াচ টাওয়ারের সামনে অটো থেমেছিল। অস্বাভাবিক চুপ জায়গাটা।
অটোওলা যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল এই লোকটার সঙ্গে। সুজন বহেরা। গাইড কাম মাঝি। গুটিকয়েক পর্যটক। পাখির সঙ্গে খুব যোগাযোগ না থাকলে এখানে যে কেউ আসে না তা বোঝাই যায়। টানা পাঁচদিন হোটেলের ঘরের ভেতর কাটানোর পর আচমকা এই বিশালত্ব নীলয়কে পুরো থমকে দিয়েছিল।
‘আপনার পক্ষী দেখতে ভাল লাগছে না?’ আচমকাই জিজ্ঞাসা করল সুজন।
‘না না কেন লাগবে না? খুব সুন্দর লাগছে। এত কাছ থেকে এত রঙের পাখি কোনওদিন দেখিনি।’
‘তাহলে দেখুন। বারবার অন্যদিকে মন যাচ্ছে কেন আপনার?’ প্রায় ধমকাল সুজন।
নীলয় বুঝল সুজন খেয়াল করেছে যে ওর পাখি দেখায় ঠিক ততটা মন নেই। আসলে সব মিলিয়ে পরিবেশটাই একেবারে অন্যরকম। শুধু পাখি আর পাখি। যেন পৃথিবীতে কোনও মানুষ থাকে না।
‘ওই দেখুন ওই যে অরেঞ্জ কালারের খুব লম্বা গলা ওটাই গ্রেটার ফ্লেমিংগো। আর ওই যে ছোটছোটগুলো ওটাকে বলে…’
‘তুমি এত পাখি চেনো কী করে সুজন?’
শুনে হাসল সুজন। ‘অনেকদিন ধরে ওদের সঙ্গে রয়েছি তো। চিনে গেছি। এতদিনে মানুষ চিনে উঠতে পারিনি স্যার কিন্তু পাখিদের ঠিক চিনে গেছি। পক্ষী মারনেওয়ালা সুজন বহেরা এখন পক্ষীরক্ষক’ বলে আপনমনেই হেসে উঠল সে।
‘মানে?’
‘লম্বা কাহানি।’
‘শোনাও তো।’
‘পক্ষী দেখবেন না?’
‘দেখতে দেখতেই শুনি।’
‘আমাদের এই মঙ্গলাজোরি গাঁও দেখলেন তো আসার সময়, খুব ছোট। একটা সময় গ্রামের সকলে শুধু পক্ষী শিকার করতাম। এই সিজন টাইমে আমরা হাজার হাজার পাখি মারতাম। বলে একটু থামল সুজন।’ জলে থুতু ফেলল।
‘সে কী!’ শিউরে উঠল নীলয়। ‘কেন?’
‘কিছু খেতাম আর বেশিরভাগ মার্কেটে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিতাম। কিছু পয়সা আসত। আমাদের এখানে তেমন কারও ক্ষেতিবাড়ি নেই। রোজগারও নেই। শুধু ওই টাইমটায় কিছু হাতে পয়সা আসত পক্ষী মেরে।’
‘তারপর?’
‘তারপর একদিন আমাদের গ্রামে ভগবান এল। সেলিম আলীর নাম শুনেছেন তো স্যার?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ খুব শুনেছি।’
‘হুঁ মানুষ নয় জানবেন। পুরো ভগবান আছেন স্যার। দশ সাল আগে আমাদের গাঁওতে এলেন কিছুদিন থাকলেন সারাদিন চোখে বায়নাকুলার দিয়ে পক্ষী দেখতেন। লিখতেন। আমাদের পক্ষী মারা দেখে উনি একদিন সকলকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন আমরা এই সিধা সাধা নিরীহ পক্ষীগুলোকে কেন মারি? ওরা সেই সাগর পার করে কত বিশ্বাস নিয়ে আমাদের গেস্ট হয়ে আসে, ওদেরকে কেন মেরে ফেলি আমরা?’ এটুকু বলে আবার জলে থুতু ফেলল সুজন। মুখ মুছে লগিতে সজোরে টান দিয়ে বলল, ‘তো আমরা বললাম পেটের জন্য মারি। নইলে ফালতু কেন মারব স্যার?’
‘উনি আমাদের তখন বললেন আমরা যদি পক্ষী মেরে পেট না ভরিয়ে এইসব পক্ষীকে বাঁচিয়ে রাখার কাজ করি তাহলে রোজগার অনেক ভাল হবে। উনি আমাদের লাইফ পুরো ঘুরিয়ে দিলেন স্যার। বললেন পক্ষীদের না মেরে ওদেরকে দিয়েই পেট চালাতে হবে। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম কীভাবে করব? বললেন আমরা যদি ওই পক্ষীদের সম্পর্কে জেনে নিয়ে ওদের দেখভাল করি তাহলে সিজনে যত টুরিস্ট আসবে তাদের গাইড হয়ে ইনকাম করতে পারব। উনিই আমাদের ট্রেনিং দিলেন। সারাদিন ধরে ওর সঙ্গে আমরা ঘুরতাম, পক্ষী চিনতাম। কী ভাল যে বাসতেন উনি পক্ষীদের নিজে না দেখলে বিশ্বাস হবে না স্যার। মনে হত ওগুলো ওর ছেলে মেয়ে আছে।’
নীলয় হাঁ করে শুনছিল। ঠান্ডা হাওয়া বইছিল। চারদিকে মোলায়েম আলস্য। কোনও উদবেগ নেই।
‘আমাদের ট্রেনিং দিয়ে উনি চলে গেলেন। তারপর আমরা কয়েকজন মিলে সেই কাজ শুরু করলাম। উনি প্রতিবছর আসতেন এখানে। অনেকদিন থাকতেন আমাদের গাঁয়ে। আমাদের দেওতা ছিলেন আলীস্যার। পক্ষীমারনেওয়ালা সুজন বহেরা পক্ষীকা গাইড হো গয়া স্যার।’ বলে একবুক গর্বের নিঃশ্বাস ভরল সুজন। দেখাদেখি নীলয়ও প্রাণভরে নিঃশ্বাস টানল ভেতরে। নীলয়ের হাওয়াতে মিশে থাকা কতগুলো ভাবনাও আবার হড়হড় করে ঢুকে পড়ল ভেতরে।
বরাবরের ব্রাইট স্টুডেন্ট নীলয় সরকার। মফস্বল থেকে কলকাতার নামী কলেজে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পরেই জড়িয়ে পরেছিল ছাত্ররাজনীতিতে। জীবনটাই পালতে গেল তারপর। কীভাবে যেন ক্ষমতার লোভ পাহাড়ি জোঁকের মতো নিঃশব্দে ছেঁকে ধরেছিল ওকে। টেরই পায়নি। কলেজের সব স্টুডেন্ট, থেকে স্যরেরাও তোষামোদ করে চলত ওকে। কী যে ভালো লাগত সেই অনুভূতিটা। যে কলেজে তিনবছরে পাশ করে বেরিয়ে যাওয়ার কথা, পাঁচ বছরেও সেখান থেকে বেরোতে পারল না ও। পরীক্ষায় পাশ করত না ইচ্ছে করে। বদলে ক্ষমতা। জিএস-ও হয়নি। রাজা হওয়ার থেকে মন্ত্রী হওয়ার স্বাদ আরও বেশী। ওদের পুরো ইউনিটটা কন্ট্রোল করত বুড়োদা। বছর পঞ্চাশেক বয়স। শাসক পার্টির যুব সম্প্রদায়ের দায়িত্বে রয়েছে ও। অসামান্য বাগ্মী। প্রচুর পড়াশোনা। ওর ভাষণ একবার শুনলে যে কোনও তরুণের রক্তে দোলা লাগবে। নীলয়েরও লেগেছিল একসময়। এবারের কলেজের ভোট ছিল হাড্ডাহাড্ডী। সেটা আগে থেকেই আঁচ করা গেছিল। কোনওভাবেই এতদিনের কায়েমী ক্ষমতা হাতছাড়া করা যাবে না। সেইমতো তৈরি ছিল নীলয়দের টিম। বিরোধীরাও যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলএবার। নীলয়দের বিরুদ্ধে একটা চাপা ক্ষোভ তৈরী হয়ে গেছিল স্টুডেন্টদের মধ্যে। সেটা বুঝত নীলয়। নিজেদের সংশোধনের কথাও অনেক পার্টির আলোচনায় বলেছিল। কিন্তু বুড়োদা প্রতিবার থামিয়ে দিয়েছিল ওকে। ভোটের দিন বরাবরের মতো ম্যানিপুলেট করার সময় এবার গর্জে উঠেছিল বিরোধীরা। ফল লোহার রড, উইকেট, বোমা। পুলিশ ছিল, কিচ্ছু করেনি। করার কথাও ছিল না, তেমনই নির্দেশ ছিল। র্যাফ আসার আগেই নীলয় হাতের রডটা কীভাবে যেন সপাটে চালিয়ে ফেলেছিল অর্জুনের মাথার মাঝখানে। অর্জুন, হ্যাঁ অর্জুন ওর জুনিয়র। মেধাবী ভালো ছেলে কিন্তু বিরোধীপক্ষ। রড চালানোর সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল সে। নীলয় নিজেই চমকে গেছিল। হাঁ করে তাকিয়েছিল হাতে রড নিয়ে মাটিতে কাতরাতে থাকা অর্জুনের দিকে। কলেজে এই ছেলেটা ওর বিরোধীপক্ষ হওয়া সত্বেও বেশ ভালো লাগত ওকে। মিশুকে। প্রাণবন্ত।
মোবাইলে কেউ ওই দৃশ্য তুলে রাখার আগেই নীলয়কে ওখান থেকে এসকর্ট করে করে এনেছিল ত্রিদিব, সুকান্ত, অঞ্জনরা। বুড়োদাকে জানানো হয়েছিল কেসটা। বুড়োদা সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিয়েছিল এখুনি যেন ওকে কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দিতে হয়। জায়গার ব্যবস্থা বুড়োদাই করে দিয়েছিল। পকেটে বন্ধুদের দেওয়া কয়েক হাজার টাকা আর পৃথিবী ফাটানো বুক ঢিপঢিপ সঙ্গে নিয়ে হাওড়া স্টেশনে ট্রেনে চেপে বসেছিল নীলয়। তার মধ্যেই খবর এসে গেছিল অর্জুন সিরিয়াস। আইসিইউ-তে। বাঁচার চান্স খুব কম। বন্ধুরা বলেছিল চিন্তা করিস না। কয়েকদিন ওখানে চুপচাপ থাক। বুড়োদা সব ম্যানেজ করে দেবে। সেইমতোই এইকদিন চুপচাপ থেকে নীলয়। কিন্তু সত্যিই কি চুপ থেকেছে আদৌ? এই কদিনে একা একা নিজের কত শত সহস্র প্রশ্নের মুখোমুখি যে হতে হয়েছে ওকে। বেশিরভাগেরই উত্তর মেলেনি।
‘এখানে সবরকমের পাখি খুব মিলেমিশে থাকে তাই না? কোনও অশান্তি নেই নিজেদের মধ্যে?’ জিজ্ঞাসা করল নীলয়।
‘হুঁ বেশির ভাগ। তবে সবাই নয়। একটা পক্ষী আছে ওয়েস্টার্ন মার্শ হ্যারিয়ার। ওটাও মাইগ্রেটরি বার্ড আছে কিন্তু মহা হারামী। ও শালা অন্য পক্ষীদের মেরে দেয়। আপনাকে একটু আগে যে ব্ল্যাক টেইল্ড গডউইট দেখালাম, সুন্দর দেখতে, ওদেরকে বেশি মারে।’
‘সে কী!’
‘হ্যাঁ মেরে খেয়ে নেয়’, বলতে বলতেই আঙল তুলে ‘ওই দেখুন হ্যারিয়ার, শালা খুনি পাখি।’ আঙুলটা এমনভাবে তুলল সুজন যেন পাখী নয় নীলয়ের দিকে তাক করেছে। শিউরে উঠল ও।
‘বায়নাকুলারটা চোখে নিয়ে দেখুন।’
দেখল নীলয়। বাজ পাখির মতো দেখতে। বাঁকা ধারালো ঠোঁট। জ্বলন্ত দুটো চোখ।
থমকে গেল নীলয়। আবার তাকাল চরাচরে। মাঝেমাঝে পাখিদের বিচিত্র ডাক ভেঙে দিচ্ছে নৈঃশব্দ। কোনও পাখিও উড়ছে, খানিকটা গিয়ে আবার নতুন জায়গায় বসছে। কত রঙ তাদের, কত রূপ!
‘এখন তোমাদের ভালো রোজগার হয় তাহলে?’
শুনে হেসে ফেলল সুজন। বলল ‘দেখছেন তো কত টুরিস্ট আসে। সারাদিনে দশ জনও না। বারোটা নাও চলে আমাদের। সকলের রোজ পার্টি জোটে না। আজ আপনাকে পেলাম তো হয়তো আবার কবে পাব জানি না। আর সালভর তো ফাঁকাই থাকে। এত দূরে এমনিই টুরিস্ট আসতে চায় না দাদা। শুধু পক্ষী ছাড়া এখানে তো আর কিছু নেই।’
‘তাহলে? বাকি সময় কী করো?’
‘টুকটাক কামকাজ করি। আর সালের চারমাস তো এদের সঙ্গেই কেটে যায়। থাকতে থাকতে একেকসময় নিজেকেই পক্ষী মনে হয়’ বলে হেসে উঠল সুজন। ‘আমি যেমন ওদের চিনেছি ওরাও আমাকেও চিনে গেছে।’
ভারি সুন্দর লাগল সেই হাসি। দৈত্যের মতো চেহারার একটা মানুষ এই অদ্ভুত পরিবেশে নিজেকে পাখির মতো মনে হয় বলছে।
‘আর যখন এই জায়গাতা পুরো ফাঁকা হয়ে যায়? সবাই আবার যে যার দেশে ফিরে যায় তখন মন খারাপ করে না?’
‘করে একটু, তারপর ভাবি আবার তো আসবে। আর সব পক্ষী ফেরে না স্যার। কিছু পক্ষী এখন এখানের রেসিডেন্ট হয়ে গেছে। পুরো ইন্ডিয়ান হা হা হা।’
‘তাই? কারা?’
‘পার্পেল সোয়াম্ফেন, রিভার টার্নফালভাস হুইসলিং ডাক এরা সব একসময়ে মাইগ্রেটরি ছিল এখন রেসিডেন্ট।’
‘আরে বাহ। কোথায় এরা?’
‘এখানে এদের মধ্যেই মিশে আছে। আমি তো দেখাতেই চাই স্যার। আপনার পক্ষী দেখার মন নেই।’
‘আচ্ছা সুজন ওই রেসিডেন্টদের মতো আমিও যদি এখানে থেকে যাই।’ আচমকাই কথাটা মুখ থেকে বেরিয়ে এল নীলয়ের।
শুনে আবার শরীর দুলিয়ে হেসে উঠল সুজন। ‘পক্ষী হয়ে?’
‘না না এই ধরো তোমার মতো।’
‘পারবেন না স্যার। আপনারা শহরের লোক। আমরা বহুত কষ্টে বাঁচি।’
‘তাও যদি কষ্ট করে থেকে যাই, রাখবে তোমাদের গ্রামে?’
সুজন থমকে তাকাল নীলয়ের দিকে। জিজ্ঞাসা করল ‘আপনি কী করেন স্যার?’
‘ধরে নাও আমিও একটা মার্স হ্যারিয়র। খুনি।’
শুনে আবার হাসি। ‘দিল ছোটাওয়ালা আদমি এখানে আসতে পারে না স্যার। ভিতরে পক্ষীদের ওপর প্রেম থাকলে তবেই এখানে আসা যায়। আপনি আচ্ছা আদমি আছেন। এখানে যারা আসে পক্ষীর পালকের মতো তাদের দিল হয়। তারা একটা মচ্ছর মারার আগেও দু’বার ভাবে।’
নীলয়ের ভেতরটা কখন থেকে যেন তোলপাড় করা শুরু হয়েছিল। খালি মনে হচ্ছিল কোথাও যেন একটা ভুল হয়ে গেছে। মস্ত ভুল। বুড়োদার জন্য হয়তো এইযাত্রা পার পেয়ে যাব? হয়তো অর্জুনও বেঁচে যাবে এবার। তেমনটাই বলেছে বুড়োদা, কিন্তু তারপর? সেখানেই কি শেষ? জেলে না ঢুকলেই কি মুক্তি?
‘আপনি চাইলে কিছুদিন থেকে যান আমার ঘরে।’
‘সুজন…’
‘হাঁ বলুন স্যার।’
‘তুমি তো এমন সুন্দর পাখিদের মতো হয়ে থাকো। তোমার জীবনে আর কোনও ইচ্ছে আছে? মানে স্বপ্ন আছে?’
‘আছে স্যার।’ বলে সামান্য হেসে একটু সময় নিল সুজন। ‘তারপর বলল আপনি স্যার জাটিঙ্গার নাম শুনেছেন। অসমের একটা ছোটা গাঁও। ওখানে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাসের মাঝে অমাবস্যার রাতে হাজার হাজার মাইগ্রেটরি বার্ড এসে সুইসাইড করে। শও-সাল হয়ে গেছে স্যার এখনও পক্ষীগুলো ওখানে এসে মরে যায়। নিজেদের মেরে ফেলে। কেন মরে কেউ জানে না। আমার স্যার খুব ইচ্ছে ওখানে একবার যাওয়ার। গিয়ে ওই পক্ষীগুলোকে বলতে চাই, আমাদের আলীস্যারের মতো করে বোঝাতে চাই স্যার, আর মরো না। কেন মরছ? এত সুন্দর জীবন তোমাদের? আমি জানি স্যার আমি বললে ওরা বুঝবে, আমিও তো একটা পক্ষী হয়ে গেছি না ওদের সঙ্গে থাকতে থাকতে। আমি রুপিয়া একটু করে করে জমাচ্ছি স্যার, তারপর একদিন ওখানে গিয়ে ওদের বাঁচাবই। সেদিন আর…’ বলতে বলতে লগি ছেড়ে দুহাত অবিকল প্রকাণ্ড এক পাখির ডানার মতোই নিজের বিশাল হাতদুটোকে ছড়িয়ে দিল সুজন।
‘সুজন…’ প্রায় আর্তনাদের মতো মুখের ভেতর থেকে শব্দটা বেরিয়ে এল নীলয়ের।
‘হাঁ স্যার।’
‘এক্ষুনি নৌকো ফেরাও। আমাকে আজই ফিরতে হবে, অনেক দেরি হয়ে যাওয়ার আগে আজই যেতে হবে।’ কাতরভাবে বলে উঠল নীলয়।
সুজন কী বুঝল কে জানে? দ্রুত নৌকো টানতে লাগল পাড়ের দিকে। জলে সপ সপ শব্দ হতে থাকল।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন