short-story-sharam

শরম
সালমা বাণী



মাঝরাতের নীরবতার ওপর শুরু হলো অবিরাম ঝমঝম শব্দের বিরতিহীন দাপাদাপি। ধলির ফুউউ ফুউত নাক ডাকা মুখ ডাকা শরীরের গভীরে সেই শব্দ দখল নিলে ভেজা বস্তার মতো ভারী শরীর কাত থেকে চিৎ হয়। চিৎ হবার সাথে সাথে দাঁতবিহীন মুখ হাঁ হয়ে গেলে বুকের খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে আসে ঘররঅঅ… ঘুরুউৎ…আর এক ভিন্ন মাত্রার শব্দ। একটুখানি পরেই ডান পা টেনে মেঝের ওপর খাড়া করলে ডানে বাঁয়ে কয়েকবার হেলেদুলে হাটু ভাঙা দ’য়ের মতো বসে থাকে পা খানা। এভাবেই বৃষ্টির শব্দের সাথে ক্রমশ মিশে যেতে থাকে সিড়ির তলে ধলির নাক ডাকা, মুখ ডাকা শব্দ!

পেশাবের চাপে মৃত্যুর মতো গভীর ঘুম যখন ভেঙে যায় তখন বাইরে মুষল ধারার সাথে যোগ হয়েছে আকাশ ফাটানো মেঘের গর্জন আর বিজলীর চমকানি। তেল চিটচিটে রং হারানো কাঁথাটা সেঁটে আছে মাদুরের ওপর যার ওপরে ধলির এই চিৎ হয়ে শুয়ে থাকার দশা। মাদুরের বাইরে পড়ে থাকে বা হাতটা অবশ ভঙ্গিতে টেনে এনে হাতের উল্টোপিঠ কোমরের তলে ঠেকিয়ে সাথে সাথে ককিয়ে ওঠে। আজও তার কাঁথা খানা ভিজে জবজবে। সে নিজেও টের পায় না কখন যে ভিজে যায় কাঁথাখানা। প্রতিদিনই ঘটে চলেছে এই অঘটন। ঝিমাতে ঝিামাতে উঠে বসে ধলি কুকাকুউ আউউ নানা রকম যন্ত্রণাদায়ক শব্দের উৎপত্তি ঘটাতে ঘটাতে। অতঃপর শব্দসমূহকে নিজের সাথে টেনে হেঁচড়ে বিছানা ছেড়ে সিঁড়ির তল থেকে হামা দিয়ে বের হয়ে আসে। তন্দ্রা জড়ানো অবসন্ন দেহ নিয়ে উঠে দাঁড়াতে গেলে বাঁক দেয়া কোমরের গিঁটগুলো মটমটে শব্দে ব্যাথা ছড়ায়। থরথরিয়ে কাঁপে শক্তিহীন বলহীন পা দুটো।

ভারী দেহটাকে সামাল দিতে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ে গেটের সমনে। বসে বসে ঝিমায় আর থেকে থেকে তন্দ্রা জড়ানো চোখের পাতা টেনে বাইরে তাকায় বৃষ্টির বিরতির আশায়। ক্রমশ তীব্র হতে থাকে তলপেটের চাপ। আরও কিছুটা সময় সেভাবে পার হলে সে আর অপেক্ষা করতে পারে না বৃষ্টির বিরতির। বিল্ডিংয়ের পেছনের দিকে যেখানে আগাছার ঝোপ, ময়লার স্তুপ, এক দলা অন্ধকার বেশ জুতসই গাঢ় সেদিকে সে এগোয়। ড্রেনের ওপর দুই পা ফাঁক করে বসলে ছরছরছরর শব্দ ওঠে ড্রেনের ভেতরে।

সন্ধ্যা রাতে ঘুমাতে যাবার আগে একই কায়দায় কোত দিয়ে দিয়ে সে যতদূর সম্ভব খালি করে আসে তলপেট। তারপরও প্রতিরাতেই ঘটে চলেছে এই অঘটন। ঘুম হালকা হবার সাথে সাথে ভীত সন্ত্রস্ত ধলি উঠে বসে হাতড়ায় নিজের তলপেটের তলের নির্দিষ্ট স্থান যেখান থেকে নিয়ন্ত্রণহীণ চুঁইয়ে বের হয় উষ্ণ জলের মতো তরল। যেদিন বেশি চুয়ায় এই তরল সেদিন কাঁথা ছাড়িয়ে চলে যায় মাদুরের তলে। আর সকালে মাদুর গুটিয়ে তুলে নেয়ার পর সেখান থেকে লাফিয়ে বের হয় বোটকা শ্বাস আটকে ধরা ঝাঁঝালো গন্ধ। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা ওপর তলার মানুষেরা তখন হাতের তালুর তলে নিঃশ্বাস চেপে ধরে চেঁচায়- উহুরে এই বুড়ির মুতের গন্ধে তো আর আমরা এখানে বসত করতে পারবো না। কেউ কেউ তৎক্ষনাৎ সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে- এই বুড়ি তোমাকে কইছি কাইল থেকে এই বিল্ডিংয়ে আর শুইতে আসবা না। ধলি কুউকুউ শব্দ তুলে নেড়ি কুকুরির মতো ককিয়ে বলে- কই যামু সোনা, এই বুড়িএএ কই যায় এই মরার বরষার মইদ্দে? শরম বাজান শরম, থাউউউক কাইল থেইকা আর হইবো না সোনা এই খাচ্চোইরা কাম… লজ্জায় মাথা নত করে ধলি।

সন্ধ্যার পর গ্রীণ রোড স্টাফ কোয়াটারের সাত নম্বর বিল্ডিংয়ের সিঁড়ির তলে এসে বসে ধলি। রাত এগারটা সাড়ে এগারোটার দিকে চারপাশের কোলাহল কমে এলে সতর্ক পায়ে বিড়ালের মতো প্রবেশ করে সিঁড়ির তলে। তারও আগে বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বার বার চোরের মতো ওপরের দিকে তাকায়। ঠিক কত বছর আগে থেকে সে সিঁড়ির নীচে ঘুমানো শুরু করেছে জিজ্ঞাসা করলে হাতের কড়ায় গুণতে থাকে। গুণে গুণে বলতে গিয়ে হিসাবে ভুল করে বার বার। কখনো বলে আইজ দুই কুড়ি বচ্ছর, কখনে বলে এক কুড়ি সাত বচ্ছর। ধলির মতো ষ্টাফ কোয়ার্টারের বাসিন্দারা যারা বহু বছর ধরেই বসত করছে তারাও এখন কেউ মনে করতে পারে না কবে কখন ঘুমানো শুরু করে ধলি এখানে।

ষ্টাফ কোয়ার্টারের যারা ধলিকে দেখছে বহু বছর ধরে তারা দেখছে ভোর হলে একখানা লাঠি হাতে ভাঙা কোমর নিয়ে কুঁজো হয়ে হাটছে ধলি। ধলির হাতের লাঠিটাও মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে খুব সহজে। পেয়ারা গাছের একখানা বড় ডাল কেটে বানানো এই লাঠি, সচারাচর দেখা বাঁশের তৈরি খাড়া সোজা লাঠির মতো না। গাছ থেকে কাটার সময় যতদিকে বিস্তৃত ছিল ডাল পালা সবগুলোর বাড়তি অংশ এঁকেবেঁকে আছে নানা স্থানে। লাঠির গোড়ার ডালপালাগুলো একটু ছাঁটা, তাছাড়া মাথার দিকে সবই বসে আছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় শাখা প্রশাখা বিস্তৃত একটা আস্ত গাছ হেঁটে আসছে। প্রতিটা পদক্ষেপের সাথে একই তালে খটাস্ খটাস্ শব্দ তোলে ওর লাঠি মাটির বুকে। ইদানিং বেশ কষ্ট হয় এই লাঠি টানতে। তারপরও ধলিকে টানতে হয় এই লাঠি। লাঠির ওপর নির্ভর না করে সে এক পাও এগুতে পারেনা। সোজা হয়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা বহু আগেই হারিয়ে ফেলেছে ধলির শিরদাঁড়া। ডান পায়ের হাঁটুর তল থেকে পানি জমে সুপারি গাছের গোড়ার মতো মোটা আর ভারি দুটো পা যেন ওর সমস্ত শরীরের চাইতে বেশি ওজন। ব্লাউজ পেটিকোট ছাড়া ত্যানার মতো নরম ময়লা শাড়ী প্যাঁচানো ধলির শরীরের প্রায় অর্ধেকই খোলা থাকে সব সময়। মুখমন্ডল থেকে শুরু করে শরীরের সমস্ত চামড়াই কুঁচকে গেছে। শরীরের খোলা অংশের রং মূলত রোদজ্বলা তামাটে হলেও অনুমান করা যায় ধলির চামড়ার রং এককালে ছিল একেবারেই সাদা ধবধবে। পেটের কাছে ঝুলে থাকা পানি ভর্তি বেলুনের মতো ঝুলঝুলে স্তনযুগল থেকে থেকে বের হয়ে পড়ে ধলি যখন হাটে। কখন যে স্তন দুটো বের হয়, আবার কখন যে বুকের ত্যানার তলে গড়িয়ে যায় সেই বোধও যেন কাজ করে না। বয়সের ভারের সাথে এখন এই স্তনযুগলের ভার বয়ে বেড়ানো যেন তার জন্য কষ্টকর। ষ্টাফ কোয়ার্টার আর তার আশেপাশের মানুষেরা যৌবনাবতী ধলিকে আজ আর মনে করতে পারে না। কেউ বলতে পারে না যৌবন কখন ধলির দেহ ছেড়ে চলে গেছে। ষ্টাফ কোয়ার্টারের বেশির ভাগ বাসিন্দাদের অস্থায়ী বসতের কারণে হয়ত ধলি কারো স্থায়ী স্মৃতি নয়।

কলোনির মানুষেরা জেগে ওঠার বহু আগেই উঠে বসতে হয় ধলিকে। কাক-পাখী অথবা মোরগদের জেগে ওঠার শব্দ কানে প্রবেশের সাথে সাথে উদ্বিগ্ন ধলি হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসে। ঘুম জড়ানো চোখেই পিঠের তল থেকে টেনে তুলতে থাকে মাদুর ও কাঁথাটা। কাঁপা হাতে মাদুরের পেটের ভেতরে কাঁথাটা পেঁচিয়ে নিয়ে বের হয়ে আসে সিঁড়ির তল থেকে। মেইন গেটের পাশে এগিয়ে বসে ঝিমাতে থাকে হাঁটুর ভেতরে কানা বকের মতো মাথা গুঁজে। নতুন বাসিন্দারা সিঁড়ি বেয়ে উঠানামার সময় হয়ত ধলিকে দেখে খেঁকিয়ে ওঠে এই বুড়ি- যাও যাও, এইখান থেইকা যাও, ভাগো, সিড়ির তলটা বুড়ি পচাইয়া রাখছে, যাও ভাগো। ধলি কথা বলে না কখনোই। শুধু মাথাটা একটু তুলে আবার গুঁজে দেয় হাঁটুর ভেতর, তখনও ওর শ্বাসনালীর কাছ থেকে শুধু কুউ কা অসহায় শব্দবলীই বের হয়।

এভাবে বহুক্ষণ বসে থাকার পর ধীরে ধীরে সমস্ত শরীর ভরা অবসন্নতা আর ক্লান্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যেতে থাকে লাঠি ঠুকে ঠুকে। কোনদিন তাকে দেখা যায় হাতিরপুল বাজারের কাছে, কোনদিন কাঁঠাল বাগান বাজারের কাছে। শুক্রবার জুম্মার সময় তাকে দেখা যায় ভূতের গলি মসজিদের সামনে ফকিরদের সারিতে। সারাদিন ভিক্ষা করে চাল তরিতরকারি যা জমে ধলি এনে তুলে দেয় পাতানো নাতনি মর্জিনার হাতে। বিনিময়ে মর্জিনা তাকে পেটভরে খেতে দেয় দুইবেলা। সকালের জন্যও বরাদ্দ থকে একথাল পান্তা রাতের বাসি সালোনের সাথে। রাতের ভাত ধলি মন ভরে তৃপ্তি সহকারে খেতে পারে বলে তার মনে অনেক প্রশান্তি।

বাজারের ভেতরে হেঁটে কখনো একখানা আলু, একখানা পটল, কোনদিন ক’খানা ঢেঁড়স, কয়েকটা শিম অথবা গাজর, দুটো পুঁটি বা টেংরা, রিঠার টুকরা বা পচন ধরার দশার মেনি সে যাই হউক- কোঁচড়ে রাখা পলিথিনের ব্যাগে ভরা বারো মিশালি এই সব মাছ তরিতরকারি ধলি উল্টে ঢালে মর্জিনার সামনের কুলায়। মর্জিনা সারাদিনের ছুটা কাজের শেষে ঝুপরিতে ফিরে দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকে। তরিতরকারীর জন্য বাড়তি কোন ভাবনা থাকে না তার। মর্জিনা সে সব একসাথে করে একখানা বড় তরকারি রান্ধে। সারাদিন খয়রাতির পর সন্ধ্যার সময় ধলি এসে জুত করে বসে মর্জিনার ঝুপড়ির সামনে। চুপচাপ বসেই থাকে মর্জিনার রান্না শেষ না হওয়া পর্যন্ত। সারাদিনের ঠিকা ঝি এর কাজ শেষে সন্ধ্যায় এসে চুলায় আগুন দেয় মর্জিনা। রান্না শেষ হলে মর্জিনা বুড়ির থালা ভরে ভাত, ভাতের ওপর তরকারি আর ডাল ঢেলে দেয়। মর্জিনার পানির মতো পাতলা ডাল গরম ভাত তরকারির স্বাদ পানসে করে দেয়। সে কারণে ধলি তরকারী দেয়ার আগেই চেঁচায় ডাইল দিস না, আমারে ডাইল দিবি না, আমি খালি সালোন দিয়াই ভাত খামু, ডাইল খামু না, তুই ডাইলরে ডাইল রাখোস না, ছোচনের পানি বানাছ, খাচ্চোর কুনহানকার।

মর্জিনার মনের ভেতর জলন্ত কয়লার মতো ক্ষোভ জ্বলে ধিকধিকিয়ে। গরম তেলে পানি ফেলার মতো ঝাঁঝিয়ে ওঠে মর্জিনা। ওই বুড়ি খাইলে খা নাইলে যা গিয়া। তর আলুপটলে আমার কাম নাই, আমি পাকামু না তর সালোন, যা, যা গিয়া, কাইল থেইকা পাকাইয়া খা গিয়া। সারাদিন বুড়ির যা নগদ কামাই তার কিছুই চোখে দেখে না মর্জিনা কখনো। কার কাছে রাখোস তর কামাই নানী? মর্জিনা এই কথা জানতে চেয়েছে বহুদিন। কিন্তু ধলির দাঁতবিহীন মাড়ির ফাঁক থেকে কোনদিনই বের করে আনতে পারেনি এই প্রশ্নের জবাব। অনেকদিন কোলের কাছে টেনে নিয়ে সযত্নে বুড়ির মাথায় তেল দিয়ে চুল আচড়ে বেঁধে দিয়েছে চিকন লিকলিকে একখান বেণি। সোহাগে ডলে ডলে মালিশ করছে গায়ে পায়ে সরিষার তেল। নানী তুই উপদা হও, আমি তর কোমর মালিস কইলা দেই, কইমা যাইবো তর ব্যাথা ব্যাদনা। কিন্তু মর্জিনার সব সেবা যত্ন ব্যর্থ হলে মনে মনে দিয়েছে অকথ্য গালি – মরার বুড়ি, এই একখান কথা যদি ভুলেও বাইর হয় ফোকা চোপার ফাঁক দিয়া। যত বারই মর্জিনা জিগ্যেস করে ততবারই ধলি উত্তর দেয়-ক্যান এইডা জিগাস ক্যান? তরে কমু ক্যান? তুই তর কামের ব্যাতন কি করস আমারে কঅ’ছ? বুড়ির কথায় মর্জিনার মেজাজ খারাপ হয়। ইচ্ছা করে বুড়িকে গালি দিয়ে বলতে- যা মাগি, মাগির ঘরের মাগি, খানকি বুড়ি কুনানকার, কাইল থেইকা আর তরে ভাত দিমু না, যেইখানে খুসি সেই খানে গিয়া খা গিয়া – কথাটা ঠোঁটের কাছে এসে গেলেও সাবধানে আটকে ধরে ফসকানোর আগে। বুড়ি তো আর তার কামাই খায় না, বুড়ি খায় তার নিজের কামাই। সেই বরং বুড়ির কামাই খায়, সে তো শুধু পাক করে দেয়। এই পাক যার কাছে যাবে সেই করে দেবে। তরিতরকারি মাছ মাংসের টুকরা সারাদিনের ভিক্ষার পরিমাণ তো আর কম না। রোজ রোজ এতগুলা মাছ তরিতরকারি কিনতে হলে কুলাতো না মর্জিনার সারা মাসের বেতনের সবটুকু টাকাতেও। আর না হয় খেতে হতো মাছ তরিতরকারি ছাড়া খালি ডাল দিয়ে। মর্জিনা নিজের রাগ নিজেই গলার ভেতরে গিলে ফেলে, আহ্লাদী সুরে বলে- থাক নানী তুই যেইদিন মন চায় সেই দিন কইস, আমারে তো আপন মনে করতে পারলি না আইজও।

দুপুরে ধলিকে ভাত দেয় না মর্জিনা। সে কারণে ধলিকে যে ক্ষুধার্ত থাকতে হয় তাও নয়। বহু বছর ধরে সে হাঁটছে পাড়ার পর পাড়ার রাস্তায় রাস্তায়। এই দীর্ঘ হাঁটার কারণে পাড়ার সকলের চেনা মুখ ধলি। কারো দরজায় গিয়ে হাঁটু মেলে বসলে যাও যাও ভাগো ভাগো করে না, তেড়ে মারতে আসে না চোর বদমাইস ভেবে। বরং ভূতের গলি, সেন্ট্রাল রোড, কাঁঠাল বাগান, হাতির পুল এই সব এলাকার কিছু বাড়িতে ধলির ভাতের স্থায়ী বরাদ্দ আছে। ধলি জানে ওই সব বাড়ির দরজায় গিয়ে ‘মাগো’ বলে ডাক দিলে কোনও না কোনও বাড়ি থেকে অবশ্যই তার এক থাল ভাত জুটবে। বান্ধা বাড়িগুলো ধলিকে দরজার সামনে বসতে দেয়। খেতে দেয় টাটকা অথবা বাসি বা বাড়তি যা আছে তাই।

শুক্রবার বাদ জুম্মা ধলিকে খেতে দেয় রহমান সাহেবের ছোট ছেলের বৌ সনিয়া। পাঁচ বছর বিয়ে হয়েছে। মানত করেছে গরীব খাওয়ানোর বাচ্চা কাচ্চা হয় না বলে। মানতের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রতি জুম্মাবার সে একজন ফকিরকে ভরা পেট খাওয়ায়। গরম ভাত আর টাটকা তরকারি। কোন রকম বাসি পচা থাকে না সেই থালায়। ধলি জুম্মা নামাজের পর মসজিদের নামাজিদের কাছ থেকে নগদ যা পায় তার সব নিয়ে এসে হাজির হয় রহমান সাহেবের বাড়ির গেটে। শুক্রবার গেটের পাহারা শিথিল থাকে ধলির জন্য। পেট ভরে খেয়ে ধলি দু’হাত তুলে চোখ মুদে সুর তুলে মোনাজাত করে – আল্লা মাবুদ তুমি বৌ এর মনের খায়েস পুরা কইরা দাও, পোলা দাও একখান সোনার চাঁন্দ। মোনাজাত ধরে রাখার সময় ধলির হাত কাঁপে থরথরিয়ে। দোয়া পড়ার সময় কাঁপে গলার স্বর, কাঁপে দোয়া দরুদ। মোনাজাত শেষে ফোঁকলা মাড়ির ভেতরে থেকে ফুঁ ঢেলে দেয় সনিয়ার গায়ে মাথায় – বোইন, ভাবিস না, আল্লার কুদরত, কখন যে কার ওপরে পড়ে কওন ভারি কঠিন। তবে যদি আল্লা মুখ তুইলা চায় তাইলে নাকি মরা গাঙে বান ডাকে।

তুমি ঠিক মতো দোয়া কইরো নানী, আল্লা যেন আমার মনের আশা পূর্ণ কইরা দেয়। দিবো দিবো, আল্লা দিবো, আমি কইলাম দেইখো বোইন, আল্লায় দিবো, সবুর করো আল্লা দিবো।

নানী তোমার পোলাপান হওনের গল্প কও না শুনি…।

আমার পোলাপান?

হ, নানী তোমার পোলাপান, তোমার নাতো কি আমার? কও তো শুনি তোমার ক্যামোন লাগতো পয়লা যখন তুমি পোয়াতি হইছো?

এইডা কি আর আইজ কাইলের কথা? আমার পোলা বাইচা থাকলে তো অখন বুড়া হইয়া যাইতো, আরেএ পাগলি মাইয়ার কথা শুনো, হ্যায় কিনা জিগায় আমার পোলা হওনের গলপো।

হ, নানী কও না, শুনছি পোয়াতি মাইয়া মাইনষের নাকি খুউব উল্টাপাল্টা খাইতে মন চায়, কথাটা কি সত্য নানী? তোমারও কি মন চাইতো উল্টাপাল্টা খাইবার?

কাঁপন ধরা ঘাড়ের ওপর মাথাটা আরও দুলতে থাকে স্মৃতিচারণের ভারে। ওর হাসির রেখা নজরে আসে না কুঁচকানো চামড়ার অসংখ্য ভাঁজের ভেতর থেকে। শুধু ফোঁকলা মাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে আসা জিহ্বা দেখে বোঝা যায় হাসির আবেগ। বহুদূর থেকে স্মৃতি হাতড়ে সামনে এনে দাঁড় করাবার চেষ্টা করে ধলি। মাথা দুলাতে দুলাতে বলে- হ এইটা হাচা কথা, পোয়াতি মাইয়া মাইনষের জিহ্বার কোন বাপ-মা নাই। সেইটা স্যাও নিজে কইবার পারবো না বেজন্মা জিহ্বার তহন কী যে খাইতে মন চায় আর কী যে চায় না ।

কও না নানী ক্যামোন লাগে প্রথম প্রথম? অনেক খারাপ লাগে শরীলের মইদ্দে?

হ, লাগে, অনেক খারাপ লাগে, তবে সগলের তো আর এক রকম লাগে না।

তোমার ক্যমোন লাগতো?

কত বছর হইছে, অখন কি আর মনে আছে! চোখের পাতা মুদে, গভীর আবেগ ভরা কন্ঠে ধলি বলে -তয় পরথম পরথম আমার খুউব বমি হইতো, কিছুই তো খাইতে পারতাম না, খালি কোতদূর পোড়া মাটি খাইতাম।

পোড়া মাটি? কই পাইতা?

একখান নোতুন মাটির পাতিল কিইনা ভাংতাম, মাটির পাতিল ভাইংগা ছোডও ছোডও টুকরা শাড়ীর আঁচলের মইদ্দে গিট দিয়া রাখতাম, কামের ফাঁকে ফাঁকে কোতদূর কইরা চাবাইতাম, খুউব ভাল লাগতো, সারাদিন মান আর কিছু খাইতাম না। বাড়ি বাড়ি কাম কইরা কত ভাত সালুন পাইতাম, হ্যার কিছুই আমার মুখে তুলতে পারতাম না, মাছ মাংসের গন্ধ শুনলে বমি আইতো, সাবান ছুনু, পাউডার কোনও কিছুর গনধো সইজ্জো করতে পারতাম না, তবে কেরোসিন ত্যালের গনধো ভালা লাগতো, আর… আ…র… ভাল লাগতো স্কুটারের ত্যালের গনধো, বলতে বলতে খলবলিয়ে হাসে ফোকলা মাড়ির হাসি।

আল্লারে আমার যদি তোমার মতো পোড়া মাটি খাইতে মন চায়, তাইলে? তাইলে কি হইবো? আমার সাহেবে তো আমারে পোড়া মাটি খাইতে দিবো না, কইবো তাইলে বাইচ্চার ক্ষতি হইবো!

আরে দূর না, যা খাইতে মন চায় সেইটা খাইবা বাইচ্চার ক্ষতি হইবো ক্যান?

তোমার স্বামী তোমারে নিশ্চয়ই অনেক আদর করতো, ভালবাসতো তুমি যখন পোয়াতি হইছিলা?

গরীবের আবার আদর, সোহাগ! সেই সব তো মনে নাই, তবে যখন আমি ছয় মাসের পোয়াতি আমারে সে ফ্যালাইয়া রাইখা গ্যালো যে আর ফিরা আইলো না।

আল্লা, তাইলে? তোমার পোলা হওনের সময় তোমার স্বামী কাছে আছিল না?

না আছিল না।

তোমার মন খারাপ হয় নাই?

মন খারাপ হইলে কী করুম, পোলা তো আর প্যাটের ভিতরে বইয়া থাকবো না, মন খারাপ হইলেও বাইর হওনের সময় হইলে ঠিকই বাইর হইবো।

তাহলে তুমি ছেলে মানুষ করলে কী করে?

ওই তো ফালাইয়া ধালাইয়া করছিলাম দশ বছর, তারপর তো মইরা গেলো বর্ষার সময় কাঁঠাল বাগানের ঢালে ডুইবা।

তারপর? তারপর তোমার আর কোন বাচ্চা হয় নাই?

না, আর তো বিয়া বসি নাই।

একলা একলা কাটাইয়া দিলা তোমার জীবনটা?

মাইনষের বাসায় কাম করতে করতে দিন যাইতো শ্যাষ হইয়া, একলা দোকলা ভাবনের সময় আছিল নাকি বোইন, কাঁপন ধরা গলায় ধলি শুনায় তার জীবনের গল্প সনিয়ার কাছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প শুনতে শুনতে সনিয়ার বসতে ইচ্ছা করলে গলা বাড়িয়ে কাজের মেয়েকে মোড়া দিতে বলে। ধলির সাথে সনিয়ার বসার দূরত্ব কমে এলে ধলির মনের ভেতর আাশার সঞ্চার হয়, সাহসে ভর করে ধলি করুন মিনতি জানিয়ে বলে-

বোইন আমার একটা আর্জি আছিল রাখবা?

কি আরজি কও?

আল্লা তুমগো ঢাইলা দিছে, বাড়ি দিছে, গাড়ি সব দিছে, তুমগো বাড়িটা কত বড় বোইন, আমাকে কোতদূর শুইবার জায়গা দিবা? আল্লায় তুমগো আরো দিবো, আমি দিন রাইত জিকির করুম তুমগো আল্লা আরও দিওনের লাইগা… তোমারে আল্লা সাত পোলার মা বানাইবো। আমারে খালি রাইতরে কোতদূর শুইবার জায়গা দিবা?

ওমা সে কী কথা! কি করে? তোমাকে কোথায় থাকতে দেবো? শুতে দেয়ার জায়গা কোথায়?

এই যে তুমগো সিড়ির তলের খালি জায়গাটাতে, খালি রাইতটাতে আইসা কোতদূর ঘুমামো, আর বিয়ান হইলেই উইঠা যামু গা।

কেন তুমি যেখানে থাকো সেইখানে কী হইছে?

বোইন আমি তো থাকি গিরিন রোড ইসটাফ কুয়াটারের সিড়ির তলে। একতলায় নতুন বাসিন্দা আইছে। হ্যারা আমারে কইয়া দিছে সিড়ির তলে আমার আর ঘুমানি চলবো না। আমি যদি আর সিড়ির তলে ঘুমাই তাইলে আমার খ্যাতা কাপড়ে নাকি আগুন দিবো। পোলাটার খুউব মেজাজ। আমারে দেখার লগে লগে এ্যামুন মেজাজ করে, মনে হয় ঘেডি মডকাইয়া ভাঙ্গবো। সারা রাইত ঘুমাইতে পারি না ডরে। যদি ভোর হইয়া যায়, যদি ট্যার না পাই? যদি পোলাডা আইয়া দেইখা ফ্যালে তাইলে কি হইবো? এই না ডরে সারা রাইত খালি ঘুম ছুটে আর আসে, আসে আর ছুটে -আমার বিছনাপাতি যদি ফ্যালাইয়া দেয় তাইলে কি করুম? তুমি যদি আমারে একটু থাকতে দিতা বোইন, লক্ষী সোনা আমার, আমি তোমার লাইগা অনেক দোয়া করুম সারা রাইত শুইয়া শুইয়া খালি দোয়া পড়ম।

আমি ক্যামনে দেই ধলি নানী? আমার তো নিজের বাড়ি না এইটা, আমার স্বামীরও বাড়ি না! এইটা তো আমার শ্বশুড়ের বাড়ি, আমার কথার কোনও দাম নাই, আমি তোমারে থাকতে দেই ক্যামনে?

যদি তুমি তোমার শ্বশুর, স্বামীরে কোতদূর কইয়া বইলা রাজি করাইতা। হুধা বর্ষা কালটা তারপর শুকনাদিনে আমি রাস্তায় পইরা থাকুম, মা না আমার, তুমি কইলে শুনবো। বর্ষা বাদলার মইেদ্দে কই একটু ঘুমাই কও?

না, মাথা খারাপ, আমার শ্বশুরে দেখলে তোমারে পিটাইয়া খ্যাদাইবো, রাজি তো পরের কথা। তার থেইকা তুমি যেখানে থাকো সেখানেই থাকো। আমি আলগা বখশিস দিয়া দিমু তোমারে।

সনিয়ার কাছ থেকে ব্যর্থ হয়ে ধলি সারাদিন আরও অনেক বাড়িতে চেষ্টা করে রাতে ঘুমানোর একটুখানি জায়গা বরাদ্দ পেতে। এভাবে সে তার চেষ্টা অব্যাহত রাখে প্রতিদিনই। কিন্তু কোথাও সে বরাদ্দ পায় না ঘুমাবার জায়গা। শেষ পর্যন্ত তাকে ফিরে আসতে হয় ষ্টাফ কোয়ার্টারের সিড়ির তলে। একতলার নতুন বাসিন্দারা বেজায় ক্ষিপ্ত। এই বাসিন্দারা আসার আগে ধলি সন্ধ্যার পর যে কোন সময়ে এসে বিছানা পেতে ঘুমাতে পারতো। সকালে যখন শরীর চাইতো তখন সে উঠে আসতো। যদি মন না চাইতো তাহলে সে অনেক বেলা অবধি হয়ত ঘুমাতো।

যৌবনের শুরু থেকে ধলি এই ষ্টাফ কোয়ার্টারের ঘরে ঘরে ছুটা কাজ করেছে। কোন না কোন বাড়িতে রাতেও তাকে থাকতে দিয়েছে। কাজের ক্ষমতা ফুরিয়ে যাবার পর সে অধিকার পেয়েছে সিঁড়ির তলে ঘুমাবার। এটা দীর্ঘ দিন ষ্টাফ কোয়ার্টার গুলোতে শ্রম দেয়ার দাবীতেই। বহু বছর ধরে নিশ্চিন্তেই ঘুমাতে আসছে রাতে। কেউ কখনো জারি করেনি কঠিন নিষেধাজ্ঞা।

কিন্তু একতলার বাসিন্দাদের লম্বা চুলয়ালা পোলার ঠাটানিতে ধলির শরীর কাঁপে থরথরিয়ে, শ্বাসনালীর গোড়ায় এসে জমে যায় শ্বাসপ্রশ্বাস। সে যখন ধলিকে হুঁসিয়ারি দেয়- এই বুড়ি কাইল থেইকা আর এইখানে ঘুমাইতে আসবা না তখন ধলি হয়ে পড়ে বিভ্রান্ত। হাঁপানি রোগির মতো হাঁপাতে থাকে। ভূতের গলি, কাঠাঁল বাগান, হাতিরপুল, সেন্ট্রাল রোড, এমন কি কলাবাগান পর্যন্ত বাড়ি বাড়িতে সে সারাদিন রান্নাবান্না, কাপড়কাঁচা, ঘরমোছা কত কত কাজ করেছে। কাজ করতে করতে যৌবন থেকে বার্ধক্যে পৌছেছে। যে সব বাড়িতে কাজ করেছে সেই সব বাড়িতে যেয়ে আকুতি জানিয়েছে শুধু রাতটুকুতে একটুখানি ঘুমানোর জায়গা চেয়ে। কোথাও সে পায়নি শুধু রাতের ঘুমের একটুখানি জায়গা। বিভ্রান্ত ও হতাস ধলি পুনরায় ভয়, উৎকন্ঠা নিয়ে সিঁড়ির তলে এসে মাদুর পাতে ঘুমের জন্য। বাঘের রাজ্যে হরিণের মতো কান খাড়া করে থাকে সারা রাত এই বুঝি ভোর হলো আর তাকে ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে এলো একতলার লম্বা চুলয়ালা পোলাডা।

এইবারের বর্ষাও যেন ক্ষেপেছে। সারাদিন রাইত ঝমঝম ঝমঝম আকাশ ফাটিয়ে ঢালে। সকাল হলে মাদুরের ভেতরে তার একমাত্র কাঁথাখানা পেচিয়ে কাঁখে ধরে উঠে হাঁটতে থাকে। গ্রীনরোডের বন্ধ দোকানগুলোর সামনের ফুটপথে বসে থাকে যখন বৃষ্টি পড়ে, টানের ব্যারাম ধলির সেই ছোট বেলা থেকে। বৃষ্টির পানি শরীরে পড়লে আজকাল টান এমন বাড়ার বাড়ে মনে হয় বুকের ভেতর থেকে ছিটকে বের হয়ে আসবে দিলকলিজা সব। বর্ষায় দিনে ধলির ভিক্ষার আয়ও আর আগের মতো হয় না। মর্জিনা তখন কমিয়ে দেয় ভাতের সাথে সালোন।

মর্জিনার একখান মাত্র ঝুপড়ি। তার ভেতরে ছেলেমেয়ে স্বামী নিয়ে সে মাথা গোঁজে কোন রকমে। ধলিকে গড়াতে দেয়ার মতো জায়গা কোথায়! দিনের বেলা মর্জিনার স্বামী চলে যায় রিকশা চালাতে। ধলির ছেলেমেয়েরাও বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। ধলি তখন মন চাইলে মর্জিনার বিছানায় একটু গড়াতে পারে। যেদিন মর্জিনার স্বামী রিকশা চালাতে যায় না সেদিন ধলিকে ফিরে আসতে হয় বিছানায় গড়ানোর ব্যর্থ মন নিয়ে। তখন হয়ত ধলি গ্রীণ রোডের বন্ধ দোকানের সামনে গিয়ে আঁচল পেতে কাত হয়। বৃষ্টির ছাটে কুঁকড়াতে থাকে ন্যাকড়ার তলের দেহখানি।

সকাল থেকে মরার বৃষ্টি এমন ক্ষ্যাপা ক্ষেপেছে বৃষ্টির ছাট বেশি হওয়ার কারণে আজ ফুটপথেও হাঁটু সমান পানি। একটু খানি জায়গাও নাই শুকনা। দু’দিন বৃষ্টিতে রিকশা চালিয়ে মর্জিনার স্বামীর গায়ে জ্বর সর্দি কাশি। মর্জিনার স্বামী ঝুপরির ভিতরে চৌকির ওপরে চিৎ হয়ে নাক ডাকে গভীর ঘুমে। ঝুপরির ভিতরে প্রবেশ করতে গিয়ে অহ্অ একখানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধলি। দুলতে দুলতে বের হয়ে আসে ঝুপরির সামনে থেকে। ওর ক্লান্ত দেহ মন এতই ক্লান্ত ইচ্ছা হয় হাত পা ছড়িয়ে দিয়ে ঝুপরির সামনে মাটিতে গড়িয়ে পড়তে। কিন্তু বৃষ্টির পানি ঝুপরির সামনে আধ হাঁটু। অগত্যা ধলি লাঠি ঠুকে ঠুকে পুনরায় রাস্তা পার হয়ে এগুতে থাকে দোকানের সামনের ফুটপথের দিকে।

সারাদিন ধলির কাটে ফুটপথে বসে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে। একটু খানি বৃষ্টি ছাড় দিলে ধলি চোরের মতো এসে দাঁড়ায় তার পুরানো আশ্রয়ে। কড়ড়ড় কড়ড়ড়ড়ড় কড়াৎ শব্দে বাজ পড়ে লাইট পোস্টের ওপরে। মেঘবৃষ্টির সাথে ইলেকট্রিক তারে আগুন ছিটকায় তারাবাতির মতো। বিকট শব্দে বিদ্যুত ব্যবস্থা অচল হলে চারিদিক নিকশ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। ধলি কাঁচুমাচু হয়ে বসে থাকে রাত আরও গভীর হওয়ার। ব্লাউজ বিহীন শরীরে শীত লাগলে ন্যাতানো আর্দ্র শাড়ীর আঁচল টেনে টেনে শরীরে প্যাঁচায়। রাত আরও গভীর হলে ধলি যথানিয়মে তার মাদুর পেতে কাত হয়। আজ পিঠের তলে কাঁথাটা না পেতে সে মেলে দেয় দেহের ওপর।

বার্ধক্যের ভারে নুজ্জ ক্লান্ত অবসন্ন দেহ গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় একটুখানি কাত হওয়া মাত্রই। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে বৃদ্ধ দেহ আন্দাজ করতে পারে না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় কোমরের ওপর গোটা কয়েক শক্ত আঘাতের যন্ত্রণায়। অন্ধকারে ওর চুলের মুঠি ধরে টেনে তোলে একটা সবল হাত। নিদ্রা নিমগ্ন চেতনা হতবিহ্বল হয় সাময়িক। নিদ্রার বিহ্বলতা কেটে গেলে ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠতে চায় ধলি। কিছু একটা বলতে যায় কিন্তু পারে না, শক্ত হাতের থাবা এসে চেপে বসে তার মুখের ওপর। শক্ত হাত, শক্ত পা ক্রমাগত ধলিকে আক্রমণ করে। কাবু করতে থাকে ক্রমাগত চড়কিল থাপ্পড়। পেটাতে পেটাতে বের করে নিয়ে আসে সিঁড়ির তল থেকে বাইরে। টেনে হেঁচড়ে বের করে নিয়ে আসে সিঁড়ির দোরগোড়ায়। শুধু চড় থাপ্পড় নয়। এক লাথির ভারী আঘাত ধলিকে সিঁড়ির দোরগোড়া থেকে নিক্ষিপ্ত করে সিঁড়ির বাইরে। গাঢ় অন্ধকার, ক্ষীণদৃষ্টি, দূর্বল শরীর নিয়ে ধলি ফিরে তাকাবার ক্ষমতা হারায়। বৃষ্টির পানি হাঁটু সমান জমে গেছে ষ্টাফ কোয়ার্টারের সামনের রাস্তায় রাস্তায়। এলোপাথাড়ি মারের আঘাত সামলাতে সামলাতে অন্ধকারে খসে গেছে ধলির শরীরে প্যাঁচানো ত্যানার মতো নরম জীর্ণ শাড়ীটা।

বাকী রাত গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁন্দে ধলি অন্ধকারে বসে। যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি শরীরে ধারন করে ধলি রাত ভোর হবার অপেক্ষায় বসে থাকে। হয়ত বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে কাঁদে, হাঁটুর ভেতরে মাথা গুজে কাঁদতে কাঁদতে ওর কান্না জড়িয়ে যায় তন্দ্রার সাথে।

অন্ধকার কেটে গেলে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে লক্ষ করে তার পরনের ন্যাকড়াটা পরনে নেই। সে একেবারেই নগ্ন। নিজের নগ্ন দেহের ওপর দৃষ্টিপাত করে ধলি নেড়ি কুকুরের মতো ককিয়ে ওঠে। একবার দুই হাত স্থাপন করে লজ্জাস্থানের অপর, পরমূহুর্তে ডান হাত তুলে নিয়ে স্থাপন করে তার স্তনের ওপর। মর্জিনা অবাক বিস্ময়ে জিগ্যেস করে কি নানী এত ভোরো আইলি যে, ঘুমাস নাই রাইতরে?

ধলি হাহাকার করে কাঁন্দে, গুমরে গুমরে কাঁন্দে। অবাক হয়ে মর্জিনা জিজ্ঞাসা করে- কী হইলো নানী? তুই উদাম ক্যান? শাড়ী কই হারাইছস? শরীল খারাপ করছে নাকি? কী হইলো? ট্যাকা টুকা হারাইয়া ফেলছস নাকি? আরে কইবি তো এ্যামুন কইরা কান্দোস ক্যান?

ধলি তবুও কাঁন্দে। তার বৃদ্ধ দেহ কান্নার বেগ সামলাতে না পেরে গড়িয়ে পড়ে মর্জিনার পায়ের কাছে। মর্জিনা সযত্নে তুলে ধরে ধলিকে। আর নিজের সাথে বকর বকর করে, হায়রে খোদা বুড়ির মনে হয় মাথামুথা সব গ্যাছে। পাশে বসিয়ে চোখে মুখে হাত বুলায়- থাউক হইছে, আর কান্দিস না, কি হইছে আমারে ক’অ, তরে নি কেউ মারছে? নাকি তরে বাইর কইরা দিছে? নাকি তর টাকাপয়সা সব কাইড়া নিছে? কি জ্বালার জ্বালা কইবি তো? নাকি খালি কানবি? না কইলে আমি কি করুম?

ধলি তবুও বলতে পারে না। ক্রমাগত জানতে চেয়ে অধৈর্য মর্জিনা ক্রদ্ধ হয়, কইলে ক’, নাইলে কান্দিস না, কবি তো? ক না কি হইছে? মর্জিনার জেরার মুখে কানতে কানতে বলে শরম, বোইন শরম… আঁ…আঁ… শরম…। মর্জিনা বিমূঢ় হয়ে আন্দাজ করতে থাকে শরম! ক্যামন শরম? ক্ষ্যাপা উত্তজনায় বলে- কিয়ের শরম মরার বুড়ি, কি আছে তর? তর আবার কিয়ের শরম? যা, বুড়ি মর গিয়া, তর কিয়ের শরম বুজলাম না… জ্বালাইয়া মারলো…।

শরম বোইন… শরম… হু হু কান্নার ভারে ধলি ডুকরে ডুকরে কাঁদে, ককিয়ে ককিয়ে কাঁদে আর ক্রমাগত বিলাপ করে শরম বোইন শরম…

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *