বিমল লামা
একদিন অফিস যাচ্ছি, ট্রেন ধরতে এসেছি, শুনি সামনের কোনও স্টেশনে অবরোধ। কিছুক্ষণের মধ্যেই দশ বারো জোড়া লোকাল ট্রেনের প্যাসেঞ্জার জমে গেল স্টেশনে। অনুমান করতেই পারছেন উন্নয়নশীল মফস্বলী স্টেশনের কী অবস্থা হতে পারে। দম আটকে আসছিল প্ল্যাটফর্মে, তাই স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে এলাম। সেখানেও অবস্থা বিশেষ সুবিধার না। আমার মতই ভেবেছেন আরও বহু লোকে। পান বিড়ি সিগারেট চা নাস্তার দোকানগুলোতে ঝাঁক ঝাঁক ভিড়। যেন অবরোধে ছাড় পাওয়া স্পেশাল ট্রেনের টিকিট বিক্রি হচ্ছে ওখানেই। একটু তফাতে তুলনায় কম ভিড় একটা দোকানে চা খেলাম। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে দোকানদারকে বললাম, “সুবিধাই হলো বলুন?”
“কিসের সুবিধা?”
“এই যে! বিক্রিবাটা বাড়ল! বাড়ল না?”
দোকানদার হেসে বলে, “তা একটু বাড়লো!”
“কত বাড়ল?”
“হিসেব কি আর করেছি!”
“আরে হিসাব তো আপনার ভাঁড়েই আছে!”
“মানে?”
দোকানদারের টেবিলের ওপর সাজানো পোড়ামাটির ভাঁড়ের পিরামিড। খইতে খইতে ভিতে এসে ঠেকেছে। সেটাই দেখিয়ে বললাম, “অন্যদিন কটায় শেষ হয়? পিরামিড? সারা দিনে তাই না?” তারপর ঘড়ি দেখে বললাম, “আজ তো সাড়ে এগারোটাতেই লক্ষ্য পূরণ! অ্যাঁ!”
দোকানদার কিছু বলে না। পাশ থেকে একটা অন্য লোক বলে, “তাই নাকি!”
এতক্ষণ লোকটা এক মনে চায়ে চুবিয়ে বন পাউরুটি খাচ্ছিল। এমনভাবে খাচ্ছিল যেন তার খুব তাড়া আছে। এক বগ্গা তাড়া। সময় নেই মুখ তুলে দেখার দুনিয়া উচ্ছন্নে গেল কিনা। রেল অবরোধে কারো কোনও সুবিধে অসুবিধে হল কিনা! দেখলেই ভাববেন পাগল একটা। এখন বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলছে, “তাই নাকি!”
তারপর দোকানদারের দিকে ফিরে, “এটা কি সত্যি কথা?”
দোকানদার সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। দেখে লোকটা হঠাৎ বলে, “তাহলে এই চা বন রুটির দাম আর দিলাম না।”
দোকানদার মুখের স্মিত হাসি মুছে বলে, “মানে?”
“মানে ওটা আমার কমিশন। সামান্যই নিলাম বলতে হবে।”
“কিসের কমিশন?”
“আরে আমরাই তো রেল রোকো অবরোধ করেছি। তারই তো সুবিধা পাচ্ছেন। তো এত সুবিধা যে করে দিল তাকে এক কাপ চাও খাওয়াতে পারবেন না!”
দোকানদার বিভ্রান্ত হয়ে কথা খুঁজে পায় না। শেষে বলে, “আপনি কি একা অবরোধ করেছেন?”
“তবে কি সবাইকে ডেকে আনবো ফ্রিতে চা খেতে?”
দোকানদার আরো বিভ্রান্ত হয়ে বলে, “না না! তা… তা কেন আনবেন। কিন্তু প্রমাণ কী আপনি অবরোধী দলে আছেন?”
তখনই লোকটার ফোন বেজে ওঠে। লোকটা তার ফোন দেখিয়ে বলে, “এই প্রমাণ!”
তারপর ফোন ধরে কানে চেপে বলে, “হ্যাঁ কমরেড! সব ঠিক আছে। এদিকে তো হুলুস্থুল কাণ্ড! দোকানগুলোতে সারাদিনের বিক্রি এখনই শেষ হয়ে গেছে। কমিশন খাবে তো অবরোধ শেষ হলে এদিকে চলে এসো।”
দোকানদার বলে ওঠে, “না না না!”
ফোন পকেটে রেখে লোকটা বলে, “ডাকবো না?”
“না!”
“তাহলে একটা সিগারেট দেন।”
দোকানদার দেয় সিগারেট। কমিশন ভেবে দেয় না পাগলা ভিখিরি ভেবে, আমি বলতে পারব না। আমি দাম দিয়ে সরে আসি। একটু তফাতে আসতেই লোকটা আমার কাছে এসে বলে, “আপনাকে ধন্যবাদ।”
“ধন্যবাদ! কেন?”
আরে আইডিয়াটা তো আপনিই জোগালেন। আমি দুঃখিত, আইডিয়া আপনার হলেও সুবিধা পেলাম আমি। আপনি পেলেন না। আন্তরিকভাবেই হাসেন ভদ্রলোক। যেন বিরাট রগড় করে দারুন মজা পেয়েছেন। আমি বললাম, “মানে আপনি অবরোধী দলে নন?”
“আরে না না! আমি তো অসুবিধাভোগী। যাচ্ছিলাম অফিস, আটকে গেলাম। কিন্তু ওই ব্যাটা দোকানদারগুলো তো সুবিধাভোগী, না কি!”
অফিস যাওয়ার ভাবনা ছেড়ে আমি ঘরমুখো হাঁটা দিলাম অটোর খোঁজে। লোকটাও হাঁটছে আমার সঙ্গে। কানের কাছে বকর বকর! বাজে কথার ফুলঝুরি। তারই মধ্যে থেকে দরকারিগুলো মনে মনে লাল রং করে রাখলাম। শেষে সব লাল কথা সিলেক্ট করে এক জায়গায় করতেই একটা দরকারি সূচনা পত্র তৈরি করা গেল:
লোকটার নাম লোকেশ্বর মালি। নিবাস এই শহরেরই দক্ষিণ সীমান্তে। নদীর ধারে পৈত্রিক ভিটে। পরিবার ছোট এবং সুখী, স্ত্রী এবং এক পুত্র। স্ত্রী গৃহবধূ, মধ্য তিরিশ হবে। আর মালি বাবু নিজে চাকুরীজীবী। সরকারি দপ্তরে আধিকারিক।
অটোস্ট্যান্ডে এসে হঠাৎ মালি বাবু বলেন, “আপনার হাঁটতে কেমন লাগে?”
“হাঁটতে ভালই লাগে।”
“তাহলে চলুন আজ হেঁটেই যাই। মাত্র চার কিলোমিটার তো রাস্তা।”
প্রস্তাবখানা মন্দ না। আজ আবহাওয়াও ভালো। বাতাসে পুজোর গন্ধ ধরে গেছে। বহুদিন রুটিন ছেঁড়া জীবন যাপনও হয়নি। যান্ত্রিক যাপন মনে পড়ে গেল প্রস্তাবে। একটা বিকট জীবন বয়ে বেড়াচ্ছি। সপ্তাহের সাত দিনই বাঁধা আছে ছক সারণি গণ্ডি কেটে। এদিক ওদিক করার মত একটা দিনও থাকে না হাতে যে ইচ্ছেমতো কিছু করব। অথবা করব না। তাই আজ অবরোধে পড়ে গোটা দিনটাই মনে হচ্ছে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা। বাকি দু’আনার খোঁজে চার কিলোমিটার হাঁটা যেতেই পারে। মালিবাবু লোক ভালো। সরল। একটু বেশিই সরল। না হলে অচেনা লোককে ঘরের কথা এমন করে কি বলতে আছে!
“জানেন মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বউটাকে গলা টিপে মারি। আর ছেলেটাকে ভাসিয়ে দেই নদীর জলে।”
তখন সবে মাত্র এক কিলোমিটার বোধহয় হেঁটেছি। তার মধ্যেই এই কথা! চার কিলোমিটার হাঁটলে না জানি আরও কী কী বলবেন! আমি বিব্রত বোধ করি তার কথা শুনে। প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলি, “আসুন, একটু ঠাণ্ডা খাওয়া যাক।”
ঠান্ডা খেয়ে মালিবাবু একটু ঠান্ডা হন। প্রসঙ্গটাও সত্যিই বদলে যায়। তিনি অফিসের কথা বলেন। বলেন তাদের অফিসের ক্যান্টিনের কথা, “এত ভাল রান্না করে না, কী আর বলব! একবার ওর রান্না খেলে আপনি রাঁধুনির প্রেমে পড়ে যাবেন।”
হেসে বলি, “তাই! আপনি পড়েছেন বুঝি?”
মালিবাবু উত্তর দেন না। মাথা ঝুঁকিয়ে হাঁটতে থাকেন এক মনে। ফিরে তাকাই তার দিকে। দেখে মনে হয় তিনি ভাবের ঘোরে চলে গেছেন। অন্য কিছু ভাবছেন যা তাকে হঠাৎ করে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা থেকে। এখন তিনি জগতে সম্পূর্ণ একা। নিজের কল্পলোকে হয়তো রান্না খাচ্ছেন তার অফিসের রাঁধুনির। আমিও আর তাকে বিরক্ত করি না। চুপচাপ হাঁটতে থাকি অচেনা লোকের মত। বেশ কিছুক্ষণ পর আচমকাই বাবু বলে ওঠেন, “ওহ্! দারুণ!”
আমি অবাক হয়ে তাকাই তার দিকে। আমার দিকে তিনি ফিরে তাকিয়ে বলেন, “কি, দারুণ না?”
যেন দুজনে পাশাপাশি খেতে বসেছি। আমি উত্তর দিই না। মালিবাবুও অপেক্ষা করেন না। আবার বলেন, “কথাটা সত্যিই জানেন। আমি প্রেমেই পড়ে গেছি।”
“রাঁধুনির?”
“না, ওর বউয়ের।”
“তাই?”
এরপর মালিবাবু শুরু করেন তার প্রেম কাহিনী।
“ওরা স্বামী স্ত্রী মিলে চালায় ক্যান্টিন। একটা ছেলেও আছে বারো তেরো বছরের। সেও আসে মাঝে মধ্যে। অফিস ছুটির সময় শুধু বউটাই থাকে ক্যান্টিনে। আমি রোজই অফিস ছাড়ার আগে কিছু খেতে যাই। তখন আর কেউ থাকে না। তাই খেতে খেতে গল্প করি বউটার সঙ্গে। আর গল্পে গল্পে কবে যে ফেঁসে গেছি বুঝতে পারিনি। বুঝলাম যেদিন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।”
“কী রকম?”
“খুব বিচ্ছিরিরকম মশাই!”
“মানে?”
“মানে কী আর বলব আপনাকে, সম্পর্ক শারীরিক পর্যায়ে চলে গেছে!”
“ক্যান্টিনেই?”
“আর কোথায়!”
আমি আর খোঁচাই না তাকে। কিন্তু মালিবাবু থামেন না। তিনি বিবরণ দিতে থাকেন তার শারীরিক প্রেমের।
শুরু না কি হয়েছিল আচমকাই। একদিন খেয়ে বের হতে যাচ্ছেন বউটা অনুরোধ করে আর একটু বসে যাওয়ার। কারণ অফিস পুরো ফাঁকা, তার নাকি ভয় করছে। তাই যতক্ষণ না ওর বর আসছে…। যদিও রোজ এমন হয় না। সে নিজেই ক্যান্টিনে তালা দিয়ে চলে যায়। কিন্তু সেদিন কোনও প্রয়োজন ছিল বোধহয়। তো মালিবাবু বসে যান। বসে বসে আরও গল্প করেন। গল্পের প্রসঙ্গ অবিরাম বদলাতে থাকে। শেষে গল্পে উঠে আসে বউটার শরীর। মালিবাবু বলেন, “তোমাকে দেখে মনে হয় না তোমার দশ বারো বছরের ছেলে আছে!”
বলাই বাহুল্য মালিবাবুর চোখ তখন বউটার শরীরের খোলা অংশে।
বউটা লজ্জা পেয়ে যায়। মাথা নিচু করে মৃদু স্বরে বলে, “তাই!”
“হ্যাঁ গো।”
সে আবার বলে, “তা আমাকে দেখে কী মনে হয়?”
মালিবাবুর তখন কান মাথা গরম হয়ে উঠেছে। বুকে সাহস জমে অনেক চওড়া হয়েছে তার পাটা। আর তিনি ভয় পান না। বউটার দিকে সোজা তাকিয়ে বলেন, “সত্যি কথা বলব?”
“বলুন না!”
“মনে হয় তোমাকে কুপ্রস্তাব দিই।”
বলে আর তিনি জায়গায় বসে থাকেন না। উঠে যান বউটার কাছে। তার চোয়াল ধরে বলেন, “সত্যি গো! তোমাকে দেখার জন্যই রোজ ক্যান্টিনে আসি।”
বউটার তখনও হাসিমুখ দেখে মালিবাবুর সাহস অনেক বেড়ে যায়। তখন তিনি নিচু হয়ে ওর গালে একটা চুমু খান। তাতেও মেয়ের আপত্তি নেই দেখে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন বউটার ওপর। দু’হাতে তাকে জাপটে ধরে উদ্ভ্রান্তের মতো তার সারা গা হাতড়াতে থাকেন। বউটা ব্যস্ত হয়ে বলে, “দরজা খোলা! এখানে না এখানে না, ভেতরে চলুন।”
ওখানেই থেমে যান মালিবাবু। আবার যেন ভাবের ঘোরে কোথাও হারিয়ে গেছেন। হয়তো ক্যান্টিনের ভেতরেই কোথাও! রান্না ঘরেরও পিছনে, চাল আটার বস্তার উপর। তার কান্ড দেখে ইঁদুর আরশোলা হয়তো তখন পরিত্রাহি রব তুলে দৌড়চ্ছে যে যেদিকে পারে। আর মালিবাবু অবশেষে আবিষ্কার করছেন এই ক্যান্টিনের রান্নায় এত স্বাদের আসল রহস্যটা কী!
হাঁটতে হাঁটতে কোমর ধরে গেছিল, তাই মালিবাবুর হাতটা ধরে বললাম, “বসুন একটু চা খাই।”
রাস্তার ওপর পাতা একটা বেঞ্চের উপর বসলাম। পাশে টেনে বসালাম মালিবাবুকেও। তিনি কেমন যেন অসংলগ্ন আচরণ করছেন। মুখটা দেখলেই বোঝা যায় মনে মনে ভীষণ ব্যস্ত আছেন। উত্তেজিতও। সঙ্গমরত কোন পুরুষের মুখ কল্পনা করলে হয়তো এরকমই মুখ কল্পনায় আসবে। তবে কি তিনি এখনও ক্যান্টিনের ভাঁড়ার ঘরে ঘাম ঝরাচ্ছেন!
“কাকাচ্চা!”
ছোকরা চা বাড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়েছিল অনেকক্ষণ। মালিবাবু তাকাচ্ছেন না দেখে হাঁক দিয়েছে বেশ জোরে। মালিবাবু এমন চমকে ওঠেন যে হাত লেগে চা-টাই পড়ে গেল। আতঙ্কে তার মুখ চুপসে গেছে, যেন ভূত দেখেছেন। থতমত খেয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি শান্ত স্বরে বললাম, “কী হলো?”
তিনি একইরকম মুখ করে তাকান ছোকরার দিকে। তারপর আচমকা গলা চড়িয়ে চোখ পাকিয়ে বলেন, “বেয়াদব! নিজেকে কী ভেবেছিস? ক্যান্টিনের মালিক? আরেকটা চা নিয়ে আয়, যা!”
“যাব্বাবা!”
বলে ছোকরা চলে যায়। আমি মালিবাবুর কানে কানে বলি, “হলো?”
মালিবাবু খুব রসিক লোকের মত স্বাভাবিক হেসে বলেন, “না।”
“কেন?”
“কনডোম ছাড়া কিছুতেই রাজি হলো না।”
“তাহলে?”
“তাহলে আর কী, পরদিন হলো।”
“পরদিন?”
“পরদিন, তার পরের দিন, তারও পরের দিন। দিনের পর দিন। আজ দেড় বছর টানা চলছে।”
আর একটা চা দিয়ে যায় ছেলেটা। মালিবাবু চা শেষ করে সিগারেট ধরান। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, “যাওয়া যাক।”
আবার হাঁটা দিই। সিগারেট শেষ হওয়া পর্যন্ত আর কোন কথা বলি না। তারপর বলি, “আর কতদিন চালাবেন?”
“না, আর চালাব না। একটা এসপার ওসপার এর ছক কষেছি। সব ঠিক থাকলে আর কোনও চাপ থাকবে না।”
“ছক কষেছি মানে?”
মানে ব্যাখ্যা করে মালিবাবু যা বললেন তাতে আমি একটু চাপেই পড়ে গেলাম। তিনি ঠিক করেছেন ক্যান্টিনাকে বিয়ে করবেন। তাতে বাধা দুই তরফেই। দু’জনেই বিবাহিত। তাহলে তার আগেই দু-দুটো বিবাহবিচ্ছেদ সম্পন্ন করতে হবে। নিজের এবং ক্যান্টিনার। সেটাই নাকি তার ছক। সব শুনে বললাম, “সে কি!”
“তবে আর বলছি কি!”
“কিন্তু আপনার তো ছেলে আছে? ক্যান্টিনারও তো ছেলে আছে বললেন?”
“কার ছেলে আছে?”
“ক্যান্টিনার। সরি, মানে ওই বউটার।”
মালিবাবু হেসে বলেন, “ক্যান্টিনা! নামটা ভালোই দিয়েছেন। কিন্তু আমি ওকে লুলু বলে ডাকি।”
“লুলু?”
“হ্যাঁ, লীলা নাম। তার থেকে লুলু।”
“অ! তা কতদূর এগিয়েছেন, ছক?”
“ডিভোর্সের প্রস্তাব দিয়েছি বউকে।” “বউ কি বলছে?”
“সেটাই তো পাল্টা চাপ তৈরি করেছে আমার ওপর, মশাই!”
“কী রকম?”
“বউ এক কথায় রাজি। বলছে বিশ লাখ হাতে পেলেই সই করবে।”
“সে তো ভালোই, সহজেই মিটে গেল ঝামেলা!” মালিবাবু হঠাৎ খেঁকিয়ে উঠে বলেন, “মিটে গেল ঝামেলা! কী যে বলেন!”
তার ভাব দেখে আমি দমেই যাই। আর কিছু বলি না। মাথায় যে গন্ডগোল আছে তা পরিষ্কার। চুপচাপ হাঁটতে থাকি তার পাশে পাশে। মালিবাবুও মাথা ঝুঁকিয়ে প্রায় নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে থাকেন। যেন সত্যিই মাথার ওপর বিরাট চাপ। এভাবেই বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর আচমকা এক প্রবল ঝটকায় মাথা ঝাঁকিয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেন, “আপনার সন্দেহ হচ্ছে না?”
“সন্দেহ! কিসের সন্দেহ?”
“আমার বউ এক কথায় রাজি কেন?”
“রাজি যে কারণেই হোক, সুবিধা তো আপনারই। তাই না?”
“না! ও কেন এক কথায় রাজি হবে? নিশ্চয়ই কোন ঘোটালা আছে। কালা আছে ডালে। সেটা আমাকে জানতেই হবে।”
মালি বাবুর চোখমুখ দেখে সত্যি বলতে কি আমার কেমন ভয় ভয় করে। যে অপরিহার্য হুঁশ থাকলে মানুষ, মানুষ হয়ে থাকে সেটা তার লোপ পেয়েছে বলেই মনে হল। এক্কেবারে সিনেমার সাইকো মনে হচ্ছে। যে কোনও সময় যাতা করে বসতে পারে।
“ডাব খাবেন?”
অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বরে মালিবাবু বলেন। একটা ডাবওলা সামনে। অত ডাব থাকতে আমার চোখ গিয়ে পড়ে তার লম্বা ঠোঁট বাঁকা ধারালো দা-টার ওপর। ওটাই তুলে মালিবাবু যদি আমার মাথায় বসিয়ে দেয়! কেন জানি এই ভাবনাটাই আমার মাথায় এল। তাড়াতাড়ি বললাম, “না না, ডাব খাব না! ডাব খাব না!”
“আরে খান না, আমি নিজের হাতে কেটে খাওয়াচ্ছি।”
বলতে বলতে দা-টা তিনি ডান হাতে তুলে নেন। বাঁহাতে একটা ডাব ধরে অভ্যস্ত দক্ষতায় কাটতে থাকেন ডাব। তার দা চালানো দেখে মনে হল স্বয়ং ক্যান্টিনার খুন্তি নাড়া। মুখ শুকনো করে ঢোঁক গিলে বললাম, “বাপরে! এমন ডাব কাটছেন যেন পাকা পেঁপে!”
মালিবাবু হেসে বলেন, “চাকরি পাওয়ার আগে এটাই করেছি দশ বছর।”
“দা চালিয়েছেন?”
“ডাব বেচেছি।”
বলেই মালিবাবু দা’য়ের বাঁকা ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে ডাবের মাথার খুলিতে চৌকো গর্ত করে ফেলেন। সেই গর্তে প্লাস্টিকের সরু নল ঢুকিয়ে আমার হাতে দিয়ে বলেন, “নিন, চোঁ করে টেনে নিন।” তারপর আর একটা ডাব কেটে ডাবওলার হাতে দিলেন। তৃতীয়টা কেটে নিজে খেতে লাগলেন। ডাবওলা অবাক হয়ে বলে, “এটা?”
“ওটা তুমি খাও।”
“আমি খাব?”
“হ্যাঁ, আমি খাওয়াচ্ছি। খাও।”
ডাবওলা বিভ্রান্ত হয়ে একবার আমার দিকে তাকায়, একবার মালিবাবুর দিকে। মালিবাবু শিশুর মত সরল হেসে বলেন, “আরে বুঝলে না? আমিও আগে ডাব বেচতাম। ডাব কাটতে আমার খুব ভাল লাগত। মনে হত শত্রুদের মাথা কাটছে। এক একটা মুখ কল্পনা করতাম আর খচাৎ খচাৎ করে সাবাড় করতাম। দিনের শেষে নিজেকে মনে হতো বিজয়ী সৈনিক। পরমবীর চক্র গলায় ঝুলিয়ে ঘরে ফিরছি। বহু বছর পর আবার ডাব কেটে সেই আনন্দ হল।”
ডাবওলা দু’হাতে কাটা ডাব ধরে শুধু বলে, “অ!”
তারপর তিনটে ডাবের দাম দিয়ে আবার হাঁটা দেন মালিবাবু। সঙ্গে আমিও। দু’জনে পাশাপাশি দু’পাড়ায় থাকি। পাড়ার কাছে এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচার মত করে বললাম, “এবার যাই তাহলে!”
“আরে যাবেন কোথায়? আপনার গল্প তো শোনাই হলো না!”
বললাম, “আপনার এই ভেলপুরি গল্পের পাশে আমার গল্প তো জল মুড়ি। সে আর শুনে কী করবেন!”
“তবু শুনি। সময় কাটবে। ওদিকে বেলতলা দিয়ে ঘুরে চলুন। তাহলে আমার বাড়ির সামনে দিয়েই আপনার বাড়ির পথ পেয়ে যাবেন।”
সে পথেই হাঁটা দিলুম। যদিও আমার গল্প বলার কোনই আগ্রহ আমি দেখালাম না। কিন্তু মালিবাবু প্রায় গোটা গল্পই বার করে ফেললেন প্রশ্ন করে করে। বিরামহীন প্রশ্ন। বাড়িতে কে কে আছে থেকে শুরু করে ভবিষ্যতে কে কে থাকতে পারে পর্যন্ত। সব শুনে মালিবাবু বললেন, “গল্প তো আপনারও দেখছি বেশ মশলাদার। তবে যে বললেন জল মুড়ি!”
“কী মশলা পেলেন গল্পে?”
“বলবো, গুছিয়ে গোড়া থেকে?”
“বলুন শুনি।“
মালিবাবুর উপস্থাপনা শুনে তো আমারই চোখ কপালে। বিশ্বাস হয় না এটা আমারই গল্প। অথচ সবই সত্যি। উপভোগ্য লাগে তার বলার গুণে।
মালিবাবুর ভাষ্য: আজ থেকে অনেক বছর আগে এক সমুদ্র তীরবর্তী স্কুলে ইংরেজির শিক্ষক হয়ে আসেন এক তরুণ যুবক। সঙ্গে তার সদ্য বিয়ে করা স্ত্রী। স্কুলের কাছাকাছি তারা একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। সেখানেই শিক্ষকের স্ত্রী জন্ম দেন এক পুত্র সন্তানের। পুত্র সন্তান বড় হয়ে বাবার স্কুলেই ভর্তি হয় আর সেখান থেকেই স্কুলের শিক্ষা পর্ব শেষ করে। বাবা মায়ের ইচ্ছে ছেলে উচ্চতর শিক্ষার জন্য বড় কোন শহরের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুক। কিন্তু ছেলে জেদ ধরে বসে সে স্থানীয় কলেজেই যা হোক কিছু একটা পড়বে। কারণ আর কিছুই নয়, ছেলে তখন বাড়িওলার কিশোরী মেয়ের প্রেমে পড়েছে। অবশেষে সে কথা জানাজানি হতেই দুই পরিবারে তুমুল অশান্তি। তারপর সেই শিক্ষক পিতা পাততাড়ি গুটিয়ে সেই সমুদ্র শহর ছেড়ে চলে যান। দুই পরিবার এমন ব্যবস্থা করে যে, ছেলে মেয়ে দুটি আর কখনোই যোগাযোগ করে উঠতে পারে না। সেই ছেলে বড় হয়। চাকরি পায়। কিন্তু অভিমানে বিয়ে কখনও করবে না ঠিক করে। শেষে তার বাবা মা বুকে পাল্টা অভিমান নিয়ে পরলোক গমন করেন। তারপর থেকেই সেই ছেলে একাই থাকে নিজের মত। অফিস যায়, আসে। মগ্ন থাকে নিজের কাজে। বই পড়ে, গান শোনে। তেমন মেশে না লোকের সঙ্গে। যখন ভাবছিল এভাবেই হয়তো জীবনটা কেটে যাবে, তখনই হঠাৎ বড় বাঁক নেয় তার জীবন…।
ব্যস্ত হয়ে বললাম, “আরে মালিবাবু, এসব আপনি কী বলছেন! আমি কখন আপনাকে এসব কথা বললাম!”
“বলেননি, কিন্তু সূত্র ধরিয়ে দিয়েছেন। তার থেকেই জীবনী বানালাম। শুধু বলুন, এ পর্যন্ত কোথাও ভুল তথ্য দিয়েছি কি?”
আমতা আমতা করে বললাম, “না, ভুল কিছু বলেননি। কিন্তু শুনতে কেমন যেন লাগছে। যেন অন্য কারো গল্প!”
“তার কারণ, কখনো দুই মলাটের মাঝে ধরে দেখেননি নিজের জীবনটাকে। প্রায় কেউই দেখে না। কিন্তু দেখলে দেখবেন প্রতিটা মানুষই এক একটা গল্পের বই। তাই না?”
“হুঁ, সেরকমই তো লাগছে। তা গল্প কি এখানেই শেষ?”
“শেষ কি! এখান থেকেই তো আসল গল্পের শুরু। বললাম যে, একটা বড় বাঁক এল জীবনে!”
“বেশ। বলুন শুনি!”
…বাঁকটা আর কিছুই না, বিচ্ছেদের বিশ বছর বাদে হঠাৎ একদিন মেয়েটির সঙ্গে দেখা। প্রথমে চিনতেই পারে না তারা একে অপরকে। সময় তার ছাপ ফেলেছে দু’জনেরই ওপর। বহিরাবরণে আগের সেই কিশোর কিশোরী তারা আর নেই। কিন্তু চোখাচোখি হতেই যেন বিদ্যুৎ খেলে যায় তাদের শিরা ধমনী রক্তের ভেতর। বেড়ে যায় হৃদস্পন্দন, অনিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাস। তখন তারা শপিংমলে। দু’সারি পণ্যসম্ভার এর নির্জন গলিপথে। বাতানুকূল মৃদু সংগীতের আবহে মুখোমুখি দুই বিপন্ন প্রাণ। প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগে দুজনেরই। অবশেষে, প্রায় যুগপৎ ফাঁক হয় দু’জনের ঠোঁট। আর উচ্চারিত হয় দুটি নাম, ‘মিলু/বাপন!’
ব্যস্ত হয়ে বললাম, “আরে মালিবাবু, থামুন থামুন। সিনেমা শুরু করলেন নাকি! এসব আমি কখন বললাম?”
মালিবাবু কেমন যেন সিরিয়াস মুখ করে কঠোর ভাবে বললেন, “আমাকে বলতে দিন। সত্যি মিথ্যা পরে বিচার করবেন।”
সত্যি বলতে কি, তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি কেমন চুপসে গেলাম। মনে হলো, কোনও পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের রোগীর চোখ। ভূতে পাওয়া মনোরোগীর মত। মালিবাবু আবার বলতে লাগলেন তাঁর গল্প, “যদিও জগতের আর কোনো শক্তির পক্ষেই সম্ভব ছিল না তাদের আটকে রাখার। কারণ, পরদিন মিলুর বর অফিস আর ছেলে স্কুলে বেরিয়ে যাবার পর মিলু গিয়ে হাজির হয় বাপনের বাড়ি। বাপন তো একাই থাকে গোটা বাড়িতে। মিলুকে ভেতরে নিয়ে সদর দরজা বন্ধ করতেই যেন সেই কবেকার সমুদ্র গর্জে ওঠে বুকের ভেতর। ফ্যানের হাওয়ায় যেন ঝাউবনের সোঁদা গন্ধ। খাটের উপর নরম ম্যাট্রেস কে মনে হয়…”
“থামুন!”
আমি আর সামলাতে পারলাম না নিজেকে। আচমকাই চিৎকার করে ধমক দিলাম মালিবাবুকে। মালিবাবু তখন কেমন যেন ভাবের ঘোরে চলে গেছেন। বিভোর হয়ে বলে যাচ্ছেন গল্প। যেন বাপন নয়, তিনি নিজেই ধীরে ধীরে মিলুকে বিছানায় তুলছেন।
আমার ধমক সত্বেও তিনি বলে চলেন, “…সন্ধ্যা রাত্তিরের নরম বালির সৈকত। তার ওপর চিৎ করে শুইয়ে দেয় মিলুকে। তারপর নিজে উপুড় হয়ে নেমে আসে মিলুর ওপর…”
এবার আমি মালিবাবুর দুটো কাঁধ ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিলাম। এমন ভাব করলেন তিনি যেন ধড়মড়িয়ে ঘুম ভাঙল। ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর ভীষণ করুণ সুরে বলেন, “আমাকে মাফ করে দিন। একটু বেশি বাজে বকে ফেলেছি।”
বলতে বলতে তিনি আমার হাত দুটো চেপে ধরেন আর বলেন, “বলুন আপনি রাগ করেননি। আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন! বলুন বলুন….!”
এমন ছিটিয়ালেরে ওপর কি রাগ করব! ভাবছিলাম জিজ্ঞেস করব এসব তথ্য তিনি পেলেন কোথায়। কিন্তু এমন পাগলামো করতে লাগলেন যে আর জিজ্ঞেস করতেই পারলাম না। হাতে পায়ে ধরতে লাগলেন। তাকে প্রায়শ্চিত্ত করার একটা সুযোগ দেওয়ার জন্য। তার বাড়িতে গিয়ে অন্তত এক কাপ চা হলেও খেতে হবে।
পাগলকে এড়ানো সম্ভব নয় জানি। তাই আর বেশি আপত্তি করলাম না।
মালিবাবুর বাড়িটা ভারী চমৎকার জায়গায়। এক্কেবারে নদীর পাড় ঘেঁষে। সেকেলে মোটা দেওয়ালের কড়ি বরগার বাড়ি। আজকালকার দরজার চেয়েও বড় বড় জানলা। জানলার বাইরে শান্ত নদীর জল রাশি। ওপারের দিগন্তরেখার নাগরিক বিন্যাস। জানলায় দাঁড়ালেই সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।
জানলা ঘেঁষেই বসার ব্যবস্থা। সোফা সেন্টার টেবিল ইত্যাদি। সেখানেই আমাকে বসতে বলে তিনি ভেতরে গেলেন চা বলতে। বেরিয়ে এলেন ব্যস্ত হয়ে, যেন খুব ফুর্তি হয়েছে এমন ভাব করে বললেন, “বউকে বলে এলাম চা করতে। ততক্ষণে আমি সিঙ্গাড়া নিয়ে আসি। আপনি বসুন। যাব আর আসব।”
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মালিবাবু বেরিয়ে গেলেন। আমি আর কী করি! জানলা দিয়ে নদী দেখতে লাগলাম। দেখতে দেখতে ভাবতে লাগলাম না জানি বাড়ির বাকি লোকেরা কেমন! কারো সাথে আলাপ তো করিয়ে দিয়ে যায়নি। হঠাৎ ঢুকে এসেছি দেখে না মারধর শুরু করে!
অন্যমনস্ক হয়ে জানলায় দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ চেনা কন্ঠে নিজের নাম শুনে চমকে উঠলাম। ফিরে দেখি হাতে চায়ের কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিলু। তারও অবস্থা আমারই মত। বিভ্রান্ত। হতবাক।
বেশ সময় লাগে প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠতে। তারপর মিলু ব্যস্ত হয়ে কাছে এসে বলে, “এখানে কী করছো?”
“কী করছি মানে! মালিবাবুই তো ডেকে এনেছে চা খেতে। চা তো নিয়েও এসেছো তুমি। উনি সিঙ্গাড়া আনতে যাচ্ছি বলে বেরোলেন।”
এই অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির চাপ সামলাতে বেশ সময় লাগে। দুজনেরই। অবশেষে বুঝতে পারি সিনেমার মতো কিছু চমক ঘটে গেছে বাস্তবে। এখন তাকে সামলানোর দায় আমাদেরই। সেই কথাই মিলুকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম।
কিন্তু মিলু কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে, “ও বাবা গো! আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। আমি এখন কী করি!”
সেই মুহূর্তে মিলুকে এত সুন্দর লাগছিল যে আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। হঠাৎ তাকে জড়িয়ে ধরে তার ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে চুমু খেতে লাগলাম। মিলু ছটফটিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “তুমি শিগগিরি পালাও এখান থেকে।”
“শোনো পালালে আরও সন্দেহ করবে। এমন ভাব করো যেন এই প্রথম দেখলে। একটু সিনেমা করো। মানে নাটক করো। বুঝেছো? ছেলে কই?”
“স্কুল থেকে ফেরেনি এখনও।”
উত্তেজনা চেপে তাড়াহুড়োয় এক নিঃশ্বাসে বললাম, “তোমার বর তো দেখি সবই জানে। তোমার আমার ছোটবেলার গল্প। শপিংমলে দেখা হওয়া। পরবর্তী ঘটনাক্রম।”
“কী করে জানলো?”
“সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি!”
“আমি কী করে জানবো!”
ভীষণ উত্তেজিত ছিলাম দুজনেই। মাথাও ঠিক মত কাজ করছিল না। তবে মালিবাবু দেরি করেন সিঙ্গাড়া আনতে। তাতে একটু সামলে ওঠার সময় পাই। যুক্তি করে ঠিক করি নাটক করব। যেন জীবনে এই প্রথম দেখা হল আমাদের।
মিলু ভেতরে চলে গেল।
আমি জানালায় দাঁড়িয়ে চা খেতে লাগলাম। চা যদিও নামছে না গলা দিয়ে। অথচ মিলুর হাতে জীবনের প্রথম চা। আমার কাছে এর মূল্য কত, মালিবাবু কি কোনদিন বুঝবেন! অবশেষে মালিবাবু এলেন। এসেই ব্যস্ত হয়ে হাঁকডাক করে বলতে লাগলেন, “পটলা সিঙ্গাড়াটা বানায় দারুণ। লাইন পড়ে। তাই একটু দেরী হল। কিন্তু কড়া থেকে সোজা ঠোঙায়।” তারপর গলা তুলে বললেন, “শুনছো, একটা প্লেট নিয়ে এস তো।”
মিলু প্লেট নিয়ে এলে মালিবাবু আলাপ করিয়ে দিলেন, “আমার বউ টুনু।”
“টুনু?”
“মানে তনুশ্রী। ছোট করে তনু। তনু থেকে টুনু। নিন, নিন, সিঙ্গাড়া খান।”
প্লেটের উপর ঠোঙা থেকে খানদশেক সিঙ্গারা ঢাললেন মালিবাবু। মিলু আবার সবার জন্য চা নিয়ে এল। তারপর তিনজনে বসে চা সিঙ্গাড়া খেতে লাগলাম। সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা যা ভীষণ বিকট লাগছিল সেই মুহূর্তে। কারণ মিলু আর আমি আগে কখনো নাটক করিনি এভাবে। সিনেমা তো নয়ই।
এক সময় শেষ হয়ে যায় সিঙ্গাড়া। শেষ চাও। তারপর মালিবাবু সিগারেট ধরান। আমাকেও দেন একটা। মিলু ভেতরে চলে যেতে চাইলে মালিবাবু বলেন, “না, বসো। একটা আলোচনা আছে।”
কথাটা শুনে বুকের গভীরে হঠাৎ কেঁপে ওঠে হৃদপিণ্ডটা। চকিতে একবার চোখাচোখি করে নিই আমি আর মিলু। মালিবাবু সেসব লক্ষ্য না করেই সিগারেটে টান দেন। তারপর বলেন, “এই সিঙ্গাড়াটা খাওয়া আপনার উচিত হয়নি।”
কথাটা শুনে যেন ককিয়ে উঠল কলজেটা। পরিষ্কার ব্যথা অনুভব করলাম বুকে। তবু রসিকতার করুন চেষ্টায় বললাম, “কেন বিষ দিয়েছিলেন নাকি?”
“না। আপনাকে বিষ দিলে আমারই ক্ষতি।”
“তাহলে?”
মালিবাবুও সিনেমা করছেন মনে হল। কেমন নাটকীয় ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “এই সিঙ্গাড়ার দাম শুনলে আপনার মাথা ঘুরে যাবে।”
“তাই! তা কত দাম এই সিঙ্গাড়ার?”
মালিবাবু মিলুর দিকে ফিরে বললেন, “টুনু জানে। একটু বলে দাও তো টুনু।”
মিলু বলে, “পাঁচ টাকা।”
“আরে, সে তো পটলার দাম। আমার দামটা বলো।”
মিলু আর আমি একসঙ্গেই বলে উঠি, “তোমার/আপনার দাম?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার দাম। পাঁচ টাকায় কিনে কত টাকায় তোমাদের বেচলাম, বলো ওনাকে।”
মিলু আর আমি শঙ্কিত মুখে তাকাই একে অপরের দিকে। কিন্তু কেউ কোনও শব্দ করিনা। কিন্তু অনুভব করি যেন দুটো পক্ষ গড়ে উঠেছে পরিষ্কার। একদিকে মালিবাবু। অন্যদিকে আমি আর মিলু।
আমাদের চুপ দেখে মালিবাবু আবার বলেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ! ওইটাই ওইটাই! মনে মনে যেটা ভাবছেন ওইটাই সিঙ্গাড়ার দাম। সে টুনুও বুঝেছে আপনিও বুঝেছেন। শুধু নিজ মুখে একবার উচ্চারণ করুন, আমি শুনে আশ্বস্ত হই।”
“কী আবোল তাবোল বকছেন!”
“আবোল তাবোল আমি বকছি না, আপনি ভালোই জানেন। এখন দামটা নিজ মুখে একবার উচ্চারণ করুন। আমি শুনি। বলুন বলুন। বলুন কত দাম সিঙ্গাড়ার? বলুন!”
মালিবাবুর চোখ মুখ আবার সেই সাইকো কিলারের মত হয়ে উঠেছে। রীতিমত ভয় করছে তার মুখ দেখে। তিনি পাগলের মত চেষ্টা করে যাচ্ছেন আমাকে দিয়ে সিঙ্গাড়ার দাম বলানোর। আমি যতই না বলছি তিনি ক্রমশ ক্ষেপে উঠছেন। একসময় পুরোই অপ্রকৃতিস্থের মত লাগে তাকে। মনেই হয় তিনি যা তা করে বসতে পারেন। একবার মিলুকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেও দিলেন মেঝের ওপর।
মিলুকে ওইভাবে পড়ে যেতে দেখে আমিও উত্তেজিত হয়ে পড়ি। ছুটে গিয়ে চেপে ধরি মালিবাবুর হাত। গলা চড়িয়ে বলি, “কী পাগলামো করছেন। শান্ত হোন।”
উল্টে তিনি আরও অশান্ত হয়ে ওঠেন। এক ঝটকায় আমার হাত ছাড়িয়ে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চিৎকার করতে থাকেন, “আপনার কর্তব্য। আপনার কর্তব্য ওকে বাঁচানো। আপনার অধিকারও আছে। দেখো টুনু উনি তোমাকে বাঁচাতে এসেছেন। আর তোমার কোনও ভয় নেই। দেখবে, দেখবে, উনি তোমাকে কীভাবে রক্ষা করেন!”
বলতে বলতে মালিবাবু হঠাৎ মিলুর গলা টিপে ধরেন। মিলু ককিয়ে ওঠে দম আটকে। আমিও এবার সত্যিই ক্ষেপে যাই। একহাতে মিলুকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে জোরালো ধাক্কা দিই মালিবাবুকে। কিন্তু তাতেও তিনি ছাড়েন না মিলুর গলা। তখন বাধ্য হয়েই কষে এক লাথি মারি তার তলপেটে। তিনি এবার ছিটকে পড়েন মেঝের ওপর। কিন্তু পরক্ষণেই লাফিয়ে উঠে দৌড়ে ভেতরে চলে যান। আমি মিলুর শুশ্রূষা করি। তাকে ফ্যানের তলায় বসিয়ে জল খাওয়াই।
আমি অন্দরের দিকে পিঠ করেছিলাম। মিলু সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ আর্ত চিৎকার করে ওঠে। আমি ঘুরে দেখি মালিবাবু। উদভ্রান্তের মত চেহারা। হাতে বিরাট একটা দা। সেটা উঁচিয়ে তেড়ে আসছেন আমার দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি লাফিয়ে পড়েন আমার ওপর। আমি চিৎ হয়ে পড়ি মেঝেতে। আমার বুকের ওপর চেপে বসে দা উঁচিয়ে ধরেন আর চিৎকার করে বলেন, “বল বল বল, বল শালা বল!”
আমি প্রাণভয়ে হড়বড়িয়ে থুতু ছিটিয়ে বলি, “কী বলব? কী বলব?”
“সিঙ্গাড়ার দাম কত?”
“বিশ লাখ! বিশ লাখ!”
“কত?”
“বিশ লাখ।”
এবার তিনি শান্ত হন। দা নামিয়ে নেন। আমাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। তারপর দা হাতে নিয়েই এগিয়ে যান মিলুর দিকে। যান্ত্রিক গলায় ঘড়ঘড় করে বলেন, “উনি কি ঠিক বলছেন?”
মিলু ভয়ার্ত স্বরে তাড়াতাড়ি বলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ! ঠিক! ঠিক বলেছেন!”
“কত দাম সিঙ্গাড়ার?”
“বিশ লাখ।”
“আবার বল।”
“বিশ লাখ।”
“জোরে বল।”
“বিশ লাখ।”
এবার তিনি দা নামিয়ে রেখে সোফায় বসেন। তারপর শান্ত স্বরে বলেন, “বেশ, তাহলে বিশ লাখ শোধ হয়ে গেল। ডিভোর্স পেপারে সই করতে আর টাকা চাইবে না।”
মিলু চুপ করে থাকে। মালিবাবু আবার ধমক দিয়ে বলেন, “কী চাইবে না তো?”
“না।”
আমি তখন কাঠ হয়ে মেঝেতে বসে আছি। মালিবাবু আমার দিকে ফিরে বলেন, “হয়তো ভাবছেন কোর্টে যাবেন। খোরপোষ আদায় করবেন। কিন্তু আপনার কেস টিকবে না। দুই তরফেই ব্যাভিচারের গ্রাউন্ডে কেসের দফারফা হয়ে যাবে।”
আমি শুধু শূন্য চোখে চেয়ে থাকি মালিবাবুর দিকে। তিনি আবার বলেন, “হয়তো ভাবছেন প্রমাণ করব কী করে! তা আপনাকে বলি, আমার কাছে ছবি ভিডিওসহ তথ্য প্রমাণ আছে। আমি টিকটিকি লাগিয়েছিলাম ওর পেছনে। রীতিমতো পেশাদার টিকটিকি।”
হঠাৎ উঠে গিয়ে টিভির সুইচ অন করেন মালিবাবু। তাকের ওপর বইয়ের আড়াল থেকে একটা ভিডিও ক্যামেরা বার করেন। তারপর এটা সেটা খুটখাট করতে করতে বলেন, “মিটমাট যখন হয়েই গেল আপনি আজই আপনার মিলুকে নিয়ে চলে যান। পেপার ওয়ার্ক ধীরেসুস্থে হবে। কাল থেকে এখানে আমার সঙ্গে থাকবে আমার ক্যান্টিনা।”
বলে তিনি নিজেই বেদম হাসেন। রীতিমতো অস্বাভাবিক সেই হাসি। তার হাসি দেখে ক্যান্টিনার জন্য আমার করুণা হয়।
মালিবাবু আবার বলেন, “আজ সারাদিন অনেক নাটক দেখলেন। যাবার আগে লাস্ট সিনটাও দেখে যান।”
বলেই তিনি রিমোট দিয়ে টিভি অন করেন। টিভির পর্দাজুড়ে ভেসে ওঠে এই বসার ঘরের ছবি। সেখানে জালনার ধারে আমি মিলুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছি।
টিভি চলতেই থাকে। আমি তারই মধ্যে উঠে নিজের ব্যাগটা তুলে নিয়ে মিলুর দিকে এগিয়ে গেলাম। তার হাতটা ধরে বললাম, “চলো মিলু, ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে যাই।”
মিলু আমার বাহু আঁকড়ে ধরে কবেকার সেই হারানো কন্ঠে বলল, “বাপন, আমাকে একবার সমুদ্র নিয়ে যাবে?”
আমি এক হাতে মিলুর কাঁধ ধরে বললাম, “আমরা কালই সমুদ্রে যাব। আমাদের সন্তানকেও তো সমুদ্র চেনানো দরকার।”
সেদিন গোটা পাড়া দেখলো, আমি মালিবাবুর বউ বাচ্চার হাত ধরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। যেন আমারই বউ বাচ্চা। এতদিন অন্যায় ভাবে আটকে রেখেছিলেন মালিবাবু।
আমার চৌকাঠে পা দিয়ে মিলু বললো, “সিঙ্গাড়ার দামটা একটু বেশি পড়ে গেল!”
আমি হেসে বললাম, “আমি তো সিঙ্গাড়ার দাম দিইনি।”
“তাহলে?”
“আমি দিলাম তোমার হাতের প্রথম চায়ের দাম!”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন