short-story-sonamukhi-sui

সোনামুখী সুঁই
কাজী লাবণ্য


ভোর ছিল আরো অনেক আগে। ক্রমশ নরম আলো ফুটে সকাল হয়ে আসছে। ফজরের নামাজ, কোরান তেলাওয়াত শেষে তসবিহ জপাও শেষ। এবারে উঠতে হবে। শরীর পৃথুলা হওয়াতে, হাঁটুর ব্যাথাটা কাবু করে রাখে। তবু উঠে পড়েন আয়েশা সিদ্দিকা। রুটি বানাতে হবে। সবজি চচ্চড়ি, ডিম ভাজি, ঘন দুধ দিয়ে সেমাই বা সুজি করতে হবে।

সাবধানে, শব্দ না করে দরজা খুলে বাইরে আসেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালে মন ভালো হয়ে যায়, অনেকখানি আকাশ। শরতের আকাশ বড্ড নীল, তার উপর কার্পাস তুলো বা কাশফুলের মত সাদা মেঘ! দণ্ডখানিক দাঁড়িয়ে দেখেন। এবারে দ্রুত হাতে হাঁসমুরগির খুপড়ির দরজা খুলে দেন, কবুতরের খোপের ঝাপ তুলে দেন, দেওয়া মাত্রই কবুতরের ঝাঁক ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে উড়াল দেয় নীল আকাশে, সেই অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে তিনি রান্নাঘরে যান।

হাঁস মুরগির বিষ্ঠা, গরু ছাগলের গোবর, ও অন্যান্য পচনশীল বর্জ্য ব্যবহার করে বায়োগ্যাস প্লান্টের মাধ্যমে চুলায় গ্যাসের আগুনে রান্না হয়। মেয়ে ওদের দেশ থেকে সবজি ছোলার পিলার, সবজি কাটার যন্ত্র এনে দিয়েছে, কাজেই কাজ অনেকটা সহজ হয়ে গেছে। রুটি বেলা হয়ে যায়। সবজি কাটা হয়ে আসে। পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে ডিম ফেটে রেডি করে রাখেন, শিমলার আব্বা উঠে গোসল সেরে আসতে আসতে রুটি সেঁকা হবে, ডিম ভাজি হবে। তিনি গরম গরম খাবার খেতে ভালোবাসেন। আয়েশা সিদ্দিকা চেষ্টা করেন স্বামীকে গরম খাবার দিতে। অবশ্য আজকাল তিনি গরম না হলেও কিছু বলেন না। স্ত্রীর বয়স হয়েছে তিনি বোঝেন এবং বিষয়টা সহানুভূতির সাথেই দেখেন।

নাস্তা বানানো শেষের দিকেই ঠিকে ঝি চলে আসে। সে এলে আগে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে তারপর কাজে সাহায্য করা শুরু করে। আয়েশা সিদ্দিকা পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে খুব সজাগ বা কিছুটা শুচিবায়ুগ্রস্থ বলা চলে। নাস্তার ব্যাপারটা আগে ফুলবানু দেখত। সেই সবকিছু সামলাত। একটা সময়ের পর থেকে সকালের নাস্তার দায়িত্ব তিনি নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। ঠিকে ঝি ধান চাল, মৌসুমের বিভিন্ন ফসলের কাজ করে, বাড়ির আঙিনা, খলান, ঝাটপাট দেয়।
খেতে বসে শিমলার আব্বা, জাকারিয়া মণ্ডল নিত্যকার মতই বলেন,
-তুমিও বসি যাওনা শিমলার আম্মা। একসাথে খাই।
-তুমি খাইয়া লও। আমি ইসবগুলের ভুষি খাইছি। আরেকটু পরে খাব। তিনি আর কথা বাড়ান না। আগেরদিনের মত জোর করেন না। গলা ফুলিয়ে বলেন না
-তুমি না বসলে আমি কিন্তু অনত্থ করব কইলাম। এত বলি সবাই একসাথে খাব তা না।

অবশ্য তখনকার দিনে শিমলা, টগর, পলাশ সবাই থাকত বাড়ি ভরে। তাদের দৌরাত্ম, তাদের হাঁকডাকে বাড়ি গমগম করত। শিমলা প্রথম সন্তান। সে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে লেখাপড়া শেষ করেছে। বিয়ের পর জামাইয়ের সাথে কানাডা চলে গেছে। সেখানে তাদের গতিময় সংসার। মেজ সন্তান টগর। বড়বোন এবং ওর নিজের চেষ্টা, মেধায়, সেও বোনের কাছে চলে গেছে। সেখানে ওরও সংসার। কেবল ছোট ছেলে পলাশ ঢাকায় থাকে। একটা বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করে। বিয়ের প্রস্তাব অনেক আসে কিন্তু ছেলের মতিগতি বোঝা যায় না। বেশি তাগিদ দিলে বলে,
-তোমরা এত ব্যস্ত হইছ ক্যান আম্মা? বিয়েশাদি করতেই হবে এমন কোনো কথা আছে নাকি! কোন আইনে আছে বিয়ে করতেই হবে!
এতদিন এমন কথা শুনলে আয়েশা সিদ্দিকা হাসতেন। কিন্তু দিনে দিনে ছেলের সিদ্ধান্ত শক্ত পোক্ত হচ্ছে বলে চিন্তিত হয়ে পড়েন। ছেলে বিয়ে করবে না! সংসার হবে না! এ কেমন করে সম্ভব!
তিনি নামাজে বসে আল্লাহর কাছে ছেলের সুমতি প্রার্থনা করেন। তবে ছেলে প্রায় সময় বাড়ি আসে, বাবা মায়ের খোঁজ খবর নেয়। বোঝে যে ফাঁকা বাড়িতে তাদের একা লাগে, দমবন্ধ লাগে।
বিশেষত আম্মার আজকাল মনটা বেশি খারাপ থাকে। পলাশ জানে আম্মা একজন মননশীল মানুষ। তিন সন্তানের নাম ফুলের নামে আম্মাই রেখেছেন। শক্তহাতে সন্তানদের মানুষ করেছেন। প্রত্যেককে ১ম শ্রেণি থেকে ৫ম/ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত নিজে পড়িয়েছেন। সময়মত বিয়েশাদি দিয়েছেন। আম্মা বাগান করেন- ফুলের, সবজির। তিনি বিভিন্ন ধরনের বই পড়েন। আম্মার সংগ্রহে প্রচুর বই আছে। গান শুনতে ভালোবাসেন। সন্তানদের সাথে বন্ধুর মত আচরণ করেন। অনেক সময় সবাইকে নিয়ে ছেলেমানুষি কাণ্ডকারখানা করেন, তাতে আবার আব্বার অকুণ্ঠ সমর্থন থাকে। কিন্তু কয়েকবছর ধরে আম্মার সকল মনোযোগ কেবল ধর্ম কর্মের প্রতি, কই আগে তো আম্মা এত ধার্মিক ছিলেন না। আম্মা আর আগের মত প্রাণখুলে হাসেন না। পলাশ ঠিক বুঝতে পারে না সমস্যাটা কোথায়! আব্বার সাথে আম্মার সম্পর্ক খুব ভালো। বরং সকল ব্যাপারে আব্বা আম্মার উপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল। তাহলে এটা কী বয়সের বৈশিষ্ট! হতে পারে। কিন্তু আম্মা এমন করে থাকলে পলাশের কিছুতেই ভালো লাগে না। তাই সুযোগ পেলেই ঢাকা থেকে বাড়িতে চলে আসে।

জাকারিয়া মন্ডলের প্রাচীর ঘেরা বড় বাড়ি। ভেতর বাড়িতে উঁচুপোঁতার দর দালান, বারান্দা, মাঝখানে প্রশস্ত আঙিনা। আঙিনা থেকে কয়েকটা সিঁড়ি উঠলে বারান্দা তারপর ঘর। আঙিনার একদিকে বড় ধানের গোলা। বাড়ির পেছনে নানা ফলমুলের গাছ। বাড়িতে দুধেল গাই। বেশকিছু গরু। বাড়িতে ইলেক্ট্রিসিটি সহ নাগরিক জীবনের সবরকম সুযোগ সুবিধা।

আয়েশা সিদ্দিকা সকালের নাস্তার পর পরই দুপুরের আয়োজন শুরু করেন। ততক্ষণে ফুলবানু পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে রান্নাঘরে আসে। দুপুরের কি কি পদ হবে সব বাতলে দিয়ে তিনি চলে যান, ফুলবানু বাকি সব কিছু করে ফেলে।

ছোট্ট ফেলানি এ বাড়িতে এসেছিল আজ থেকে ২৫/৩০ বছর আগে। পাশের গ্রামে ওর নানীবাড়ি ছিল। জন্মের সময় ওর মা মারা গিয়েছিল, বাবা আরেকটা বিয়ে করেছিল। বিয়ে করার আগে নানীর কাছে ফেলে গিয়েছিল বলে ওর নামই হয়ে গিয়েছিল ফেলানি। অবোধ ফেলানির ঠাঁই হয়েছিল নানীর কাছে। মেয়েটির একটি চোখ ট্যারা। সে সামান্য বাঁকা চোখে পৃথিবী দেখে। ওর নানী ওকে এনে আয়েশা সিদ্দিকার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন,
-বুবু, এই বাপমাও হারা মাইয়াটার ইহকাল পরকাল তোমার হাতোত তুলি দিনু। তোমরাই বাপ তোমরাই মাও। এ্যাক তোমরা দ্যাকেন।

ধীরে ধীরে সেই ছোট্ট ফেলানি বাড়ির একজন হয়ে উঠে। সবার মুখে এক নাম ফুলবানু! ফুলবানু! শিমলা তখন স্কুলে পড়ে। সেই ওর নাম ফেলানি বদলে ফুলবানু রেখেছিল। সে শিমলার আম্মাকে নানি আর আব্বাকে নানু ডাকে। এদেরকে আন্টি আর মামা। আন্টি, মামারা কে কি খাবে, কার কার কোন খাবার পছন্দ সব ফুলবানুর মুখস্ত। সেভাবেই সে সবার রুচি পছন্দে খাবার দাবার তৈরি করত। বাড়ির সমস্ত কাপড় চোপড় ধুয়ে শুকিয়ে যার যার আলনা, আলমারিতে গুছিয়ে তুলে রাখত। জাকারিয়া মন্ডল এলাকার মান্যগণ্য মানুষ হওয়ায় দিনরাত অগণিত মানুষের আনাগোনা তাঁর কাছে। সেখানে লোক বুঝে চা, নাস্তা, পান শুপারি দেয়া সবই করত। এতবড় দরদালান ঝেড়ে মুছে ঝকঝকে চকচকে করে রাখত ফুলবানু।

ওর উপর সকল ভার দিয়ে আয়েশা সিদ্দিকা নিশ্চিন্ত মনে গল্প উপন্যাসে ডুবে থাকতেন বা বাড়ির গরু দেখার রাখাল ছেলেটাকে সাথে নিয়ে নির্বিঘ্নে বাগান করতেন।

শিমলা, টগরের বিয়ে হয়ে যাবার পর ফুলবানুর বিয়ের জন্য তোড়জোড় চলতে থাকে। কিন্তু একেতো মেয়েটির চোখে কিছুটা সমস্যা, তায় কাজের মেয়ে, ছেলে পাওয়া অসাধ্য হয়ে ওঠে।

জাকারিয়া মন্ডল প্রভাবশালী ও সজ্জন মানুষ হওয়াতে অনেকেই এই কাজে এগিয়ে আসেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে মোটা টাকা যৌতুকের বিনিময়ে এক ছেলের বাবা রাজী হয়। যৌতুকের ব্যাপারটা নিয়ে জাকারিয়া মন্ডল কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লে স্ত্রী, সন্তানদের উৎসাহ আগ্রহে তিনি এক বৈশাখ মাসে যৌতুক দিয়েই বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু পরের বৈশাখ পার হয়ে আরেক বৈশাখ আসার আগেই মেয়েটাকে মেরে ভয়াবহভাবে জখম করে যৌতুকের টাকা নিয়ে সেই ছেলে পালিয়ে যায়। ফুলবানুর ট্যারা চোখের উপর ছিল ওর আক্রোশ। সেই আক্রোশে সে এমন আঘাত করে যে অনেক চিকিৎসা করেও চোখটা আর ভালো হয় না। আধমরা মেয়েটাকে সেবা শুস্রষা করে সুস্থ করে তোলেন আয়েশা সিদ্দিকা। কিন্তু আগের সেই প্রাণচঞ্চল ছটফটে মেয়েটা কেমন যেন মনমরা চুপচাপ হয়ে যায়। অসহায় এক চোখে সে জীবন দেখতে থাকে।




চার বছর সাত মাস একুশ দিন আগের কথা।

বাড়িতে কেউ নেই। শিমলার আম্মার মন খুব একটা ভালো নেই। ছেলেমেয়েদের জন্য বুকের ভেতর হাহাকার করলেও তিনি প্রকাশ করেন না। বাস্তবতা মেনে নিতে তাঁর কষ্ট হলেও তিনি স্বাভাবিক যাপন করেন। অন্য কাজে কর্মে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। তাঁর একান্ত ব্যক্তিজীবনেও আসে পরিবর্তন। অনেক বড় পরিবর্তন। তিনি জানতেন এবং প্রস্তুত ছিলেন। তারপরও সেটা মানা বেদনার। একদিন যেমন প্রবল পেটব্যথা আর ভীতিকর মানসিক অবস্থার মধ্য দিয়ে মাসিক নামক এক অস্বস্তিকর কিন্তু স্বাভাবিক জীবনের অপরিহার্য প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল সেটাই আবার মেনোপজ নামক নতুন একটি শব্দকে চিনিয়ে দিয়ে, চিরতরে বিদায় নেয়।

তিনি সহজভাবে গ্রহন করতে আগে থেকেই প্রুস্তুতি শুরু করেছিলেন যেমন স্বাস্থ্যকর ডায়েট বজায় রাখা এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা। ফলে তেমন ‘হট ফ্লাস’ ‘ঘাম’ ‘মুড সুইং’ বা অন্য কোন সমস্যা হয় না। যারা মেনোপজের লক্ষ্মণগুলি বুঝে শুনে এবং প্রসন্নচিত্তে সহজভাবে গ্রহন করতে পারেন তাদের তেমন সমস্যা হয় না।

কিন্তু বড় ধরনের সমস্যা যে অন্য দিক থেকে আসবে তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। নারীদের একদিন যেমন ঘোষণা দিয়ে নারীত্ব শুরু হয় তেমনি আবার ধীরে ধীরে একদিন শেষও হয়। কিন্তু পুরুষদের তা কি হয়! হয় না। মেনোপজের পর নারীরা ফুরিয়ে যায় না, এ তিনি বেশ ভালোভাবে জানতেন। কিন্তু নিজের জীবনে তা চর্চা করার মানসিকতা অনুভব করেননি। ভেবেছেন নিবিড় দাম্পত্য তো বহুকাল কাটিয়েছি। এখন আবার এই নিয়ে তোলপাড় করা কেন!

কিন্তু স্বামীকে নিয়ে প্রবলভাবে ভাবিত হয়ে পড়েন। কি করা যায়! অনেকগুলি বিব্রতকর রাতের ব্যর্থ চেষ্টার এক মহূর্তে স্বামী বলেন,

-শিমলার আম্মা, চিকিৎসা ব্যবস্থা কত উন্নত তুমি ভাবছ ক্যান? কত রকমের ময়শ্চারাইজার, লুব্রিকেন্টস, জেল, শুস্কতা সম্পর্কিত সমস্যার উপশম করতে পারে। শুনেছি হরমোন রিপ্লেসপেন্ট থেরাপি নাকি আছে, চল তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। শিমলার আম্মার মনোপুত হয় না এ প্রস্তাব। তাঁর কেন যেন রুচি হয় না, আত্মসম্মানে বাঁধে। স্বাভাবিক নিয়মে যা এসেছে তাই-ই সই, এমন একটা মনোভাব ভেতরে কাজ করে। আবার স্বামীর কষ্টটাও মানতে পারেন না। স্বামীর চাহিদাকে তিনি অবহেলা করেন না, করতে পারেন না।

দাম্পত্যের শুরু থেকে বলা চলে এক রাতের জন্যও স্বামী তাঁকে ছাড়া থাকেননি, থাকতে পারেতেন না। তখন এটা তাঁর ভালো লাগত, কেবল ভালোলাগা নয়, বান্ধবী, বোন, জা, ননদের কাছে বিষয়টি গর্ব করার মত ছিল। কিন্তু আজ তিনি মহাসংকটে।

দিন দিন স্বামীর মেজাজ খিটখিটে হতে থাকে। অল্পতেই রাগারাগি করে। শিমলার আম্মা জিজ্ঞেস করলে বলে কই কিছু তো হয়নি। এক শুক্রবারে জুম্মার নামাজে গিয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাড়িতে আনার পর থানা হেলথ কমপ্লেক্সের একজন ডাঃ আসেন, তিনি ব্লাড প্রেসার মাপেন, কিছু টেস্ট করতে বলেন। অতঃপর ধরা পড়ে তার প্রেসার বেশি। নিয়মিত ওষুধ খেতে থাকেন। বয়স হয়েছে প্রেসার হাই হতেই পারে। তারপরও সবকিছু মিলিয়ে শিমলার আম্মা দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। একটা মানসিক চাপ অনুভব করেন।

চার বছর সাত মাস একুশ দিন আগের কথা। এক ঘোর অন্ধকার রাতে স্বামী স্ত্রীর মাঝে কথা কাটাকাটি হয়। যুক্তিতর্ক হয়। চিকিৎসকের কাছে যাওয়া নিয়ে মতান্তর হয়। এভাবে আরব্য রজনীর হাজার কাহিনীর শেষে আয়েশা সিদ্দিকা স্বামীকে একটা সমাধানের কথা বলেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সকল যোগাযোগে কি কণ্ঠস্বর লাগে! লাগে না। তিনি ইঙ্গিত করেন। মীমাংসার ইঙ্গিত। স্বামীকে ভালো রাখার ইঙ্গিত। দাম্পত্য, সংসার, সমাজ, সম্পর্কগুলো টিকিয়ে রাখার ইঙ্গিত। সারা জীবনের শ্রম, তপস্যা, ভালোবাসার ফসল তার এই সোনার সংসার। যা দেখে এলাকার মানুষ ঈর্ষা করে, প্রশংসা করে, এ যে তাকে টিকিয়ে রাখতেই হবে। তাই এই ইঙ্গিত। ন্যায় অন্যায় বোধের বাইরে গিয়ে এই ইঙ্গিত।

শিমলার আব্বা চমকে ওঠেন। বাকরুদ্ধ হয়ে যান। স্ত্রীর প্রতি বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। সমস্ত জীবন তিনি এই মহিলার কাছ থেকে ছোট বড় সকল সমস্যার মীমাংসা পেয়েছেন এবং তার কোন সিদ্ধান্তে তিনি অসফল হননি, ব্যর্থ হননি। কিন্তু আজ তিনি তাঁর এ সিদ্ধান্তে একমত হতে পারেন বলে মনে হয় না। এ কি করে সম্ভব!

সে মুহূর্তে শিমলার আব্বা তা মেনে না নিলেও পরবর্তীতে দেখা যায় সেই ইঙ্গিতের পথ ধরেই হাঁটছেন, সে পথেই তিনি মীমাংসা খুঁজছেন।

এভাবেই চার বছর সাত মাস একুশ দিন ধরে চলছে তাদের জীবন যাপন। কিন্তু সত্যিই কী তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক আগের মত অনাবিল, চমৎকার আছে? এও সম্ভব?




আচ্ছা দেওয়াল কি সত্যি সাক্ষ্য দিতে পারে! সে কি সব কথা, সব ঘটনা ধরে রাখতে পারে অদৃশ্য কোন অক্ষরে? মৌন মূক দেওয়ালগুলোকে কী কোনদিন কথা বলাতে পারবে বিজ্ঞান! চার দেওয়ালকে সাক্ষ্য মেনে সেই রাতে কী কথা হয়েছিল আজ আর তা মনে করতে পারেন না আয়েশা সিদ্দিকা। কিন্তু আজকাল অসম্ভব এক বৃশ্চিক যন্ত্রণায় অস্থির বোধ করেন। ভাবেন, এমন মীমাংসায় তিনি অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, মেনে নিয়েছেন, কিন্তু দেখেন সে ধারনা মজবুত নয়।

আবার এও ভাবেন অনুমতি তো তিনি নিজেই দিয়েছেন, তাহলে! হায়! নিজের থেকে অচেনা বুঝি আর কেউ নেই।

তাই বলে তিনি আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন না। অপ্রীতিকর কিছুই করেন না। কেবল সকালের নাস্তা বানানো ফুলবানুর জন্য একদম নিষিদ্ধ হয়ে যায়। পরিচ্ছন্নতা, পবিত্রতা, শুদ্ধতার ব্যাপারে তিনি নিজেকে আপোষহীন মনে করেন। যদিও ফুলবানুর সাথে তিনি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেন।

মানুষ দুঃখ বিলাসী। দুঃখের পোটলা যক্ষের ধনের মত আগলে রাখতে মানুষ পছন্দ করলেও শিমলার আম্মা তা করেন না। সৌজন্য, নির্লিপ্ততা নিয়েই বিরাজিত থাকেন। আগের মতই ওজস্বিনী ভাষায় তিনি আজও কথা বলার চেষ্টা করেন।

কিন্তু পরিবর্তন হয়েছে তাঁর স্বামীর। অনেক বড় পরিবর্তন। কুন্ঠা, ভয়, অপরাধবোধে মানুষটা ছোট হয়ে থাকে।

আয়েশা সিদ্দিকা স্বামীর এই পরিবর্তনেও কষ্ট পান। ভাবেন, ভালোবাসার বশ্যতা এক, আর নিরুপায়ের ভূমিকায় অন্ধ আত্মসমর্পণ আর এক। তিনি নানাবিধ দুশ্চিন্তায় দিন, মাস, বছর কাটান।




ঋতু পরিক্রমায় আবার নীলাকাশে সাদা ভেলায় শরত এসেছে। সাদা কাঁশফুল আর শিউলি ফুলের সুঘ্রান জানান দিচ্ছে শারদোৎসবের আর বেশি দিন বাকি নেই। পুজোর ঢাকে কাঠি পড়া সময়ের ব্যাপার। চমৎকার আবহাওয়া।

পলাশ বাড়ি এসেছে। মায়ের মুখে সামান্য হলেও হাসি ফুটেছে। রাতের খাওয়া দাওয়ার পর শিমলার আব্বা আগের মত স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে হেঁকে ওঠেন,

-শিমলার আম্মা! ও শিমলার আম্মা! কই তুমি? এ্যা? পলাশের ঘরে আসো। তিনি গুটিগুটি পায়ে ঘরে এসে ছেলের পাশে বসেন।

-কই পলাশ? বের কর বাবা…

পলাশ তার ব্যাগ থেকে দুটো টিকেট বের করে আব্বার হাতে দেয়।

-এই যে আব্বা। তোমাদের ভিসা হয়ে গেছে। শিমলা’পু ওখান থেকে সব পেপার্স রেডি করে পাঠিয়েছে। তোমরা আগামী সপ্তাহে কানাডা যাচ্ছ।

-আচ্ছা, শিমলার আম্মা শোনো, এদের সাথে কথাবার্তা বলে আমি এই ব্যবস্থা করেছি। চল, কিছুদিন বেড়িয়ে আসি, আমাদের একটা চেঞ্জ দরকার। তোমাকে সারপ্রাইজ দেব বলে আগে জানাইনি। তিনি থামেন। একটু দম নিয়ে আবার বলেন,

-আর হ্যাঁ, সাত্তার মিয়াকে বলেছিলাম সে একটা মেয়েদের কর্মজীবি হোষ্টেলে ফুলবানুর থাকা খাওয়ার সব ব্যবস্থাই করেছে। সে সেখানে রান্না বান্না করবে মাস গেলে বেতনও পাবে। দরকার হলে তুমি আরেকজন কাজের মানুষ ঠিক করে নাও।

তিনি চুপ করে চিরদিনের সঙ্গী স্ত্রীর মুখপানে তাকিয়ে থাকেন। মনে হয় শিমলার আম্মার মুখের পেশি ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে আসে। সেখানে এক অলৌকিক আলো ফুটতে থাকে।

স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে তিনি বলেন,

-শিমলার আম্মা, কিছু তো বল।

আজ বহুদিন পরে আয়েশা সিদ্দিকা স্বামীর চোখে চোখ রেখে হাসেন। কথা বলেন। ছেলে মেয়ের কাছে যাবেন, কি কি নেবেন তাও বলেন। পলাশের দিকে তাকিয়ে বলেন তুইও ভিসার জন্য আবেদন করলি না কেন বাবা? তিনজনে যেতাম। এরপর থামেন। বড় করে নিশ্বাস ফেলে মৃদুকন্ঠে বলেন,

-ফুলবানু কোথাও যাবে না। ও এখানেই থাকবে। ওর সারা জীবনের দায়িত্ব আমার। পেছনের জমিটায় একটা ঘর তুলে ওর নামে লিখে দিতে চাই, তোমরা কি বল?

-শিমলার আব্বা এবং পলাশ একসঙ্গে বলে ওঠে, ‘তুমি দিতে চাইলে কে কি বলবে? দিবা, তুমি অবশ্যই দিবা’।

পলাশ উঠে এসে আম্মাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দের সাথে চিৎকার দিয়ে ওঠে

-আম্মা তুমি কানাডা, আমেরিকা বেড়াতে যাচ্ছ। দেখ তোমার স্বপ্ন, তোমার মনের ইচ্ছে ঠিক পুরন হলো।

আম্মা! ও আম্মা! আমার জন্য কি কি আনবা বল…

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *