রাজশ্রী বসু অধিকারী
রাত্রিদিন ঘটর ঘটর চলছে। নীচের তলায় দুই সদস্যের ভাড়াটে পরিবারে কেবল বাবা আর মেয়ে। মেয়ের বিয়ের জন্য কারো কোনও বিশেষ চাড় নেই। বাবা মেয়ের আপাতনিরীহ সংসার। এসব কথা নিশীথ শুনেছে ওর মায়ের কাছ থেকে। শুনেছে মানে রোজই শুনতে হয়। খেতে বসিয়ে নিচের ভাড়াটেদের সাতকাহন ছেলের কাছে ঝুড়ি খুলে না বললে মায়ের হয় না। প্রথমদিকে তো ওই মেয়েটি অর্থাৎ সান্ত্বনা চুল খুলে দাঁড়ালে কীরকম লাগে, দুপুরে কী রঙ এর শাড়ী পড়েছিল, শাড়ীতে বেশী ভাল লাগে নাকি সালোয়ার কামিজে, এইসব গল্প চলত একঘন্টা ধরে। একদিন নিশীথ খুব বিরক্তি নিয়ে মাকে থামিয়ে দিয়েছে, ‘আঃ মা, একজন অচেনা মহিলার এত বর্ননা শুনে আমি কী করব বলো তো? তার চেয়ে আর একটু তরকারী দাও বরং!’ মা মুখ বেঁকিয়েছে, ‘আহা অচেনা আবার কী! এক ছাদের তলায় থাকা। গিয়ে চেনা করে নিলেই হয়!’
খেয়েদেয়ে তো কাজ নেই আমার! দু’দিনের ভাড়াটে মহিলার সঙ্গে যেচে পড়ে আলাপ করতে যাব, সেই সময়টা দু’টো বই পড়লে কাজ দেবে, মনে মনে ভেবেছিল নিশীথ। নিজের স্কুল আর বই ছাড়া এ পৃথিবীতে আর কোনওকিছুর ওপরেই বিশেষ ইন্টারেস্ট নেই তার। মা যতই ছেলেকে দু’বেলা সংসারের নানাবিধ ঘটনাবলী সম্মন্ধে অবগত করান না কেন, খেয়ে উঠে আঁচাতে আঁচাতে সে সব ভুলে যায় নিশীথ। তবে এই মেয়েটি অর্থাৎ সান্ত্বনাকে কিছু দিন যাবত আর ভুলে থাকা যাচ্ছে না। তার যথেষ্ট কারণও আছে।
ক’দিন আগে স্কুল ছুটির পর লাইব্রেরী হয়ে বাড়ী ফিরতে একটু দেরী হয়েছিল ওর। মোটরবাইকটা কিছু বেগড়বাঁই করে গ্যারাজে গিয়েছে। স্কুলের সামনে থেকে রিক্সা নিল নিশীথ। বাড়ী ফিরতে তখনও কিছু দেরী। বাসস্ট্যান্ডের মোড় পার হয়েছে এমন সময় পেছন থেকে তীব্র ডাক।
রিক্সা দাঁড় করিয়ে ঘাড় ঘোরাতেই ওই মহিলা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে সামনে, ‘যাক আপনাকে পেয়ে গেলাম। নিন একটু সরে বসুন…, এই রিক্সাভাই একটু ধরে দিন তো ব্যাগ দু’খানা…’ ওই সান্ত্বনা নিশীথকে কনামাত্রও সান্ত্বনা না দিয়ে, ওর অনুমতির তোয়াক্কা না করে লাফিয়ে উঠে বসে পড়ে পাশে। নিশীথের নাকে ঝাপটা মেরে যায় বেলফুলের সুবাস। কী পারফ্যুম কে জানে। নাকে বেশ ভাল লাগলেও নিশীথের চোখে বিরক্তি, ‘আর কি রিক্সা ছিল না?’
‘ওমা থাকবে না কেন? কিন্তু সবাই যে কুড়িটাকার ওপরে চাইছে। এক বাড়ীতেই তো যাব। তাহলে আর কেন শুধু শুধু টাকা খরচ করি!’ অসভ্য কৃপণের মত কথাটা বলে একগাল হাসে মেয়েটা। তারপর হুকুম চালায়, ‘এই দিকটা ধরুন তো…, ধরুন ধরুন, আমি একা পারব না। আর, এই যে ও রিক্সাভাই, ওই প্যাকিং বাক্স সমেত ব্যাগটা পায়ের কাছে রেখে দিন…’
এরপর একটা প্রায় দেড়মনি ওজনের কী যেন একটা মেশিনের প্যাকিং সমেত বাক্স প্রায় আশিভাগ নির্দ্বিধায় নিশীথের কোলে তুলে দিয়ে আর নিজে কুড়িভাগ ছুঁয়ে রেখে গুছিয়ে বসে। আবার হুকুম চালায়, যেন এটা ওর নিজের ভাড়া করা রিকশা, ‘নিন, এবার চলুন। বেশী দূর না, এই তো কাছেই…।’
নিশীথ কখনোই প্রস্তুত ছিল না এরকম একটা জবরদখলমার্কা ক্লাইম্যাক্সের জন্য। এবার ক্ষুণ্ণ স্বরে প্রশ্ন করে, ‘এটা কী? এত ভারী!’
‘এটা একটা বিশেষ ধরনের গ্রাইন্ডার। হলুদ লঙ্কা জিরে ধনে সব গুঁড়ো হবে। অবশ্য এসব আপনি বুঝবেন না। আপনি তো শুধু বইমুখে করে বসে থাকেন। সংসারনভিজ্ঞ যাকে বলে।’
হাসলে যে ওকে বেশ মোহময়ী দেখায় সে চিন্তাটা নিমেষের জন্য নিশীথের মনে ভেসে যায়। কিন্তু তা প্রকাশ করার মত অশিক্ষিত নিশীথ নয়। সে একজন স্কুলমাষ্টার। গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলে, ‘কী হবে এসব মেশিন দিয়ে?’
‘গুঁড়ো করব আবার কী!’
‘গুঁড়ো দিয়ে কী হবে?’
‘কী আবার হবে! বিক্রী করব! খুব ডিমান্ড এই মশলাগুলোর।’
‘মানে? আমার বাড়ীতে বসে আপনি এইসব ফালতু জিনিসের ব্যবসা করবেন? এটা কি কমার্শিয়াল টেনান্সি?’ নিশীথ বিরক্তি চেপে রাখতে পারে না।
কিন্তু ওকে নস্যাৎ করে দিয়ে ঝনঝন বেজে ওঠে সান্ত্বনা। নিশীথের নাকের ওপর তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের অদ্ভুত মুদ্রা বাজিয়ে বাজিয়ে বলে, ‘ও হ্যালোওও, অনেকগুলো অফেন্সিভ কথা বলে ফেলেছেন। আর একটাও না…’
‘মানে?’
‘মানে আবার কী? ফার্ষ্টলি গুঁড়োমশলা কোনও ফালতু জিনিস নয়। সেকেন্ডলি টেনান্সি নিয়ে আপনার সঙ্গে কোনও কথা হবে না, আপনি বাড়ীর মালিক নন। মাসীমা মালিক, মাসীমার পারমিশন নিয়ে তবেই স্টার্ট করা হয়েছে। থার্ডলি…’
‘কী? মা জানে? মা রাজী হয়েছে?’ নিশীথ অবাক।
‘এই তো! আপনি নিজের ফ্যামিলির কোনও খবর রাখেন না। মাসীমা শুধু রাজীই নয়, আমার কাছে সবার প্রথম একগাদা অর্ডারও দিয়ে গেছেন। ফার্ষ্ট প্রোডাকশন আপনাদের দোতলাতেই যাবে। পাঁচশ’ গ্রামের এক একটা প্যাকেট, হলুদ, জিরে, ধনে, শুকনোলঙ্কার গুঁড়ো। আর আপনি টেনান্সি নিয়ে রাস্তার মাঝখানে ঝগড়া করছেন! ছি ছি। নিন এবার রিক্সার ভাড়াটা দিয়ে দিন। আমার কাছে একটাও খুচরো নেই। আর এটা ধরুন, আমি নামব…’ বলতে বলতে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা নিশীথের কোলের ওপরে পুরো মেশিনটা চাপিয়ে অবলীলায় নেমে গিয়েছিল সান্ত্বনা।
পেছন থেকে ওকে দেখতে দেখতে একটা কথাই মনে হয়েছিল নিশীথের, বড্ড জাঁহাবাজ মেয়ে। এদের বাড়ীভাড়া দেওয়াটাই ভুল হয়েছিল। অবশ্য ভাড়া ফাইনালের আগে মা যে বারবার ওকে বলেছিল একবার নিজে গিয়ে কথাবার্তা বলে নিতে, আর ও যে কিছুতেই যায়নি আলসেমী করে সেটা একবারও মনে পড়ে না।
সান্ত্বনা বাড়ীর গেট থেকে চেঁচায়, ‘কী হল? আমার মেশিনটা নিয়ে বারান্দায় দিয়ে যাবেন তো? নাকি আমাকেই টানতে হবে মহিলা হয়ে?’
অদ্ভুত লেগেছিল নিশীথের। এমন করে কথা বলছে যেন ওরই দায়িত্ব এই ঢাম্বুল মেশিনটাকে পৌঁছে দেওয়ার। এভাবে একজন অপরিচিত মানুষকে দিয়ে কেউ কাজ করিয়ে নিতে পারে! এই প্রথম দেখল। একটাও কথা না বলে রিক্সাওলার সঙ্গে ধরাধরি করে দু’খানা মেশিনই এনে ভেতরের বারান্দায় রেখে দেয়। তারপর ভাড়া মিটিয়ে, ভাড়ার ওপর চালকের দাবীমতো আরো দশটাকা বেশী বখশিস মিটিয়ে যখন গম্ভীর মুখে ও সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে যাবে তখনই পেছন থেকে ডেকেছিল স্বান্তনা, ‘এই যে, শুনুন…’
রাগ চেপে তাকিয়েছিল নিশীথ। একটাও কথা বলেনি। কেন ডেকেছে জানার যেন কোন ইচ্ছেই নেই।
ওই মেয়েটা মিষ্টি করে হেসে বলেছিল, ‘থ্যাঙ্কিউ…’
নিশীথের গোমড়া মুখকে একটুও পাত্তা না দিয়ে আরও একটু এগিয়ে এসে ওই মেয়ে বলেছিল, ‘আসুন না এককাপ কফি খেয়ে যাবেন? বাবার সঙ্গে আলাপটাও হয়ে যাবে!’
বাবার উল্লেখ না করলে নিশীথ মুখের ওপর যোগ্য জবাব দিয়েই দিত। কিন্তু ভদ্রলোকের সঙ্গে একবার আলাপ করাটা দরকার। মাও বলে প্রায় প্রায়। নিশীথ অভদ্রতা করতে পারেনি। নেমে এসে বলেছিল, ‘উনি কি ঘুমোচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি ডেকে দিচ্ছি। এমনিতেও চা দেব এখন, ডাকতেই হবে। আসুন…’
নিশীথ নিজের বাড়ীতে আগন্তুকের মতো এসে দাঁড়ায় ভেতরদিকে একটি ঘরের দরজায়।
‘বাবা, এই দ্যাখো, কে এসেছেন। ওপরের নিশীথবাবু।’
সুশীলবাবু উঠে বসে একগাল হেসে দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। মাথার ঝকঝকে সাদা চুল আর ফর্সা দুধে আলতা রং এর মানুষটির আন্তরিক হাসিমুখটা নিশীথের একদেখাতেই ভাল লেগে গিয়েছিল। প্রথামাফিক হাতজোড় না করে নিজের অজান্তেই পা ছুঁয়ে প্রনাম করেছিল ও।
‘এস বাবা, এতদিন আছি, তোমার কাছে যে একবার যাব তা আর হয়ে ওঠেনি। বহুবার ভেবেছি… তা বাড়ীর মালিক বলে কথা…’
পাশে দাঁড়ানো সান্ত্বনার দিকে অপাঙ্গে তাকিয়ে নিশীথ বলেছিল, ‘না না… আমি বাড়ীর মালিক নই… মায়েরই বাড়ী… উনিই সব… আমারই আসা উচিত ছিল…’
সান্ত্বনা আর দাঁড়ায়নি, ‘আমি কফি নিয়ে আসছি…’
নিশীথ আর কফি খাওয়ার জন্য বসে থাকেনি। ওর একটা ফোন এসে যাওয়ায় সান্ত্বনার বাবাকে জানিয়ে উঠে এসেছিল। আপাদমস্তক ভদ্রলোক নিশীথ সেনগুপ্ত এই অভদ্রতাটা করেছিল ইচ্ছে করে জেনে বুঝে। বহুক্ষণ থেকে মনের মধ্যে চাপা রাগের একটা ভালমতো প্রতিশোধ নিতে পেরে বেশ আরাম বোধ হয়েছিল ওর। বেশ হবে, যখন কফি নিয়ে এসে অহংকারী দুর্বিনীত মেয়েটি কাউকে পাবে না সেই কফি দেওয়ার জন্য। ও বুঝবে যে ওর কফির নেমন্তন্ন রাখতে নিশীথ ওদের ঘরে ঢোকেনি। ঢুকেছে ওর বাবার সাথে সাধারন সৌজন্যমূলক সাক্ষাতের জন্য। আপনার বাবার সঙ্গে দেখা করব না, এটা মুখের ওপর বলা যায় না। আপনার দেওয়া কফি খাব না, এটা বলার ইচ্ছা থাকলেও সেটা বলা যায় না। তাই দুটো কাজই নিজের বুদ্ধিমতো করেছে নিশীথ। যাক, মায়ের একটা ক্ষোভ ছিল। সেটাও মেটানো গেল ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করে নিয়ে। আবার মেয়ের চরম অসভ্যতার উপযুক্ত জবাবও দেওয়া গেল কফিটা ফেলে চলে এসে।
পুরোটা ভেবে ভেবে নিশীথ বেশ আত্মপ্রসাদ লাভ করছিল। সেই ভাবটা যে ওর চোখ মুখ থেকে আর যাচ্ছেই না সেটা নিজে খেয়ালই করেনি। রাত্রে খেতে বসেও নিজের মনে মাথা নেড়ে নেড়ে অদৃশ্য শত্রুর সাথে মোকাবিলা করেই যাচ্ছিল। অনেকটা যেন, দ্যাখ কেমন লাগে… এই ভঙ্গী।
‘কী রে! অন্যদিন তো ধ্যান করতে করতে খাস। আজ এত ফূর্তি কিসের? তখন থেকে ডাকছি সাড়া নেই…’ মা বেশ জোরে জোরে বলে ওঠে।
‘অ্যাঁ? তুমি ডেকেছো? কই না তো!’
‘না তো মানে? আমি ডাকলাম আর আমি জানব না? নে পায়েসটা খা। খেয়ে বল কেমন হয়েছে…’
নিশীথ বিনা বাক্যব্যয়ে সাবাড় করে দেয় ওর অতীব প্রিয় সুখাদ্যটি। এতই ভাল লাগছে খেতে যে শেষ করার আগে একটা শব্দও খরচ করে না। বাটি পরিষ্কার করে তাকায় মায়ের দিকে, ‘আর আছে নাকি? ভারী চমৎকার হয়েছে। আর এক হাতা দাও তো…’
‘আ মরণ! আমি কি করেছি নাকি! আর থাকলে তো দেব!’
‘তাহলে? কে করেছে?’
‘সেটাই তো বলে গেলাম তখন থেকে। তুই কিছু শুনলে তো! ওই সিনু দিয়ে গেল দুপুরে…। আজ তো ওর জন্মদিন ছিল কিনা। আহা বেচারার মা নেই…, বড্ড ভাল মেয়েটা…’
জন্মদিন? আজ জন্মদিন ছিল ওই মেয়েটার! আর আজকেই নিশীথ ওর কফি না খেয়ে চলে এল? একটা উইশ পর্যন্ত না করে চলে এল? মনে মনে ভারী লজ্জা হতে থাকে ওর। কিন্তু জানবেই বা কী করে! মা না বললে ওর পক্ষে তো কিছুই জানা সম্ভব নয়। স্বভাবভদ্র নিশীথ সামান্য অভদ্রতা করে চলে এসে এতক্ষণ যেটুকু আনন্দ পেয়েছিল সেখানে একঘটি জল পড়ে গিয়ে অনুশোচনায় মন ভিজে যায়। নেহাত অনেক রাত, তাই নেমে গিয়ে মেকআপ করা যাচ্ছে না। নিজেকে একটি পাষন্ড মনে হতে থাকে ওর। কাল সকালবেলাতেই গিয়ে এককাপ কফি চেয়ে খেয়ে আসবে এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে তবেই একটু স্বস্তি পায় নিশীথ। কফি এবং সেই সঙ্গে একটা বিলেটেড হ্যাপী বার্থডে উইশ। এইটুকু তো করাই যায়। ও যতই অভদ্রতা করুক, নিশীথ সেনগুপ্ত তো সেটা পারবে না।
সকালবেলা একটু ছাদে হাঁটাহাটি করার অভ্যাস নিশীথের। সেই সঙ্গে গলা খুলে একটু রেওয়াজ। হারমোনিয়ামটা আবার টিউন করাতে দিয়েছে। আজ রবিবার। একটু বেলাবেলি গিয়ে হরদার দোকান থেকে সেটা নিয়ে আসবে ভেবেই রেখেছে। খালি গলায় ‘কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া’ বারকয়েক গাইবার পর ভারী সুন্দর হারমোনিয়াম বাজনা শুনে পা গলা দুই-ই থেমে যায় নিশীথের। আশেপাশেই কেউ বাজাচ্ছে। একদম পাকা হাতের বাজনা, যাত্রার আসরে যেমনটি শোনা যায়। কান খাড়া করে নিশীথ নিজের বাড়ীর নিচের তলা থেকে ভেসে আসা বাজনাটাকে খুঁজে পায়। তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ডাকে, ‘মা… হারমোনিয়াম কে বাজাচ্ছে বাড়ীতে?’
‘ওমা! আর কে আছে বাজানোর মতো! দেখ কান্ড! এমন সব প্রশ্ন করে ছেলেটা’ মা পিছনে ফিরে আলু কাটতে কাটতে বলে।
‘আর কে আছে মানে?’
‘যা গিয়ে দেখে আয় অত কৌতূহল তো…’ মা বিরক্ত মুখে বলে।
‘হ্যাঁ দেখব তো বটেই…’ ধুপধাপ পা ফেলে ফেলে এগোয় নিশীথ। তারপরেই নিচের ঘরের দরজায় ওর পা আটকে যায়।
সান্ত্বনা ওদের কোনের ঘরের খাটের ওপর বসে একমনে নিশীথের হারমোনিয়ামটা বাজিয়ে চলেছে। দরজা ছেড়ে ভেতরে না এসে পারে না নিশীথ, ‘এ কী? এটা তো আমার হারমোনিয়াম… আপনার কাছে কেন?’
বাজানো থামিয়ে তীব্র চোখে তাকায় সান্ত্বনা, ‘নাম লেখা আছে? প্রমাণ কী যে এটা আপনার? সব হারমোনিয়ামই একরকম দেখতে?’
‘মানে! আমার জিনিস আমাকেই প্রমাণ দিতে হবে?’
‘হ্যাঁ হবে…, প্রমাণ ছাড়া কোনও কিছু হয় না আজকের দিনে, বুঝেছেন?’
রাগে ঝনঝন মাথা নিয়েও নিশীথ দু’সেকেন্ড চিন্তা করে। তারপর লাফিয়ে এসে সান্ত্বনাকে সরিয়ে দিয়ে নিজের দিকে টেনে নেয় হারমোনিয়াম, ‘নাম, আমার নাম … আমি নিজে ব্লেড দিয়ে কেটে কেটে লিখে রেখেছি …, এই তো এই তোওওও…’ বলতে বলতে ব্লো এর ভাঁজ খুলে খুলে দেখায়। খুঁজতে খুঁজতে একসময় পেয়েও যায় আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা নসুলাল শব্দটা। আর সেটা দেখানোমাত্রই হাসিতে ফেটে পড়ে সান্ত্বনা, লাল মুখে চোখে বলে, ‘এবাবা ছিঃ আপনার নাম নসুলাল! ইশশ এটা জানলে কক্ষনও…’
‘কী? সেটা জানলে আসতেন না এ বাড়িতে?’
‘তা কেন? এই বাড়ীটা তো আর আপনার নয়!’
‘হ্যাঁ, এই বাড়ীটা আপনার মাসীমার। কিন্তু হারমোনিয়ামটা আমার। দিন ওটা। আর আমিও দেখছি হরদাকে। বাড়ী বয়ে দিয়ে যেতে কে বলেছে ওকে! যাকে তাকে দিয়ে গেলেই হল!’ গজগজ করে নিশীথ।
চিহ্ন প্রমাণ দিয়ে নিজের হারমোনিয়াম ফেরত নিয়ে বিজয়গর্বে ওপরে উঠে আসে নিশীথ। সান্ত্বনার মুখে কেমন কালো ছায়া নেমে এল সেদিকে দৃষ্টিপাত করে না। সেদিনের পর নিচের সিঁড়ি আর বারান্দার মাঝে মোটা পর্দা ঝুলেছে। আসা যাওয়ার পথে আর দেখা যায় না ওদের কাউকে। এক আধবার যে সান্ত্বনাকে ডেকে ‘সরি’ বলার কথা মনে হয়নি তা নয়। কিন্তু অতটা ঝগড়া করে আবার নিজে কথা বলতে যাওয়া বড় লজ্জার। মনে মনে ঠিক করে রেখেছে এবার দেখা হলে আর পুরনো ঝগড়া তুলবেনা। বরং ভদ্র ব্যবহার করবে। সকালবেলায় নিচের তলার ঘটর ঘটর মিউজিকাল ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে গলা সাধাটাও প্রায় অভ্যাস করেই ফেলেছে নিশীথ। মোদ্দা কথা আজকাল ওর মনে কেমন একটা উদার হাওয়া বইতে থাকে। সেখানে কোনও বিবাদের বাষ্পমাত্রও নেই। বরং যেন রয়েছে একটা অপেক্ষা। আবার কখন দেখবে সেই দমকা হাওয়ার মত মেয়েটাকে। আগে যেটা ছিল অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার, উঠতে বসতে যখন তখন দেখা হয়ে যেত, সেটা কীভাবে যেন একদম বন্ধ এখন। আর যতই না দেখা হচ্ছে, নিশীথ সারাক্ষণ কী এক অজানা উৎকন্ঠায় থাকছে। সকাল থেকে রাত অবধি কী যেন হয়নি কী যেন হল না। স্বভাবশান্ত নিশীথ ক্রমশ অশান্ত হয়ে ওঠা মন নিয়ে চাপা ছটফটানিতে ভুগতে শুরু করে।
খেতে বসে কান খোলা থাকে। কিন্তু হঠাৎ মায়েরও কী যেন হয়েছে, মা আজকাল মোটেই নিচের তলার কোন গল্প বা খবর পরিবেশন করে না। নিশীথও জিজ্ঞেস করে উঠতে পারে না। সবদিক দিয়ে যেন ওকে কেউ বন্ধ ঘরে রেখে দিয়েছে। আর বন্ধ ঘরে মুক্ত বাতাসের যে কী পরিমাণ চাহিদা তা তো ভুক্তভোগী মাত্রই জানে। শুধু নিশীথ সেই দলের একটা সংখ্যাবৃদ্ধি করেছে এতদিনে। আর নতুন কিছুই নয়।
সেদিন অফিসফেরত সিঁড়ি দিয়ে না উঠে থেমেছিল ও। উদ্দেশ্য এককাপ কফি সহযোগে সান্ত্বনার বাবার একটু খবর নেওয়া। বৃদ্ধমানুষের জন্য এটুকু করাই যেতে পারে। করা উচিতও বটে। ওরা কেউ বারান্দায় নেই। মোটা পর্দার ওদিক থেকে একটি ওরই মত বয়সের ছেলে এসে দাঁড়ায়।
‘কাউকে খুঁজছেন?’
‘হ্যাঁ, মানে আমি মানে সান্ত্বনা…’
‘সান্তুউউ একবার এদিকে এসো, দেখো কেউ তোমাকে ডাকছেন।’ ছেলেটি ভেতরের দিকে চলে যায়। নিশীথ কী করবে বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে থাকে। কানের ভেতর দিয়ে ওই সান্তু ডাক বহু ঘুরপথ পেরিয়ে আরও ভেতরে কোথায় কোথায় যেন ধাক্কা মারতে শুরু করেছে। এই অনুভূতি নিশীথের জীবনে প্রথম। সান্ত্বনা বেরিয়ে এসেছে, ‘ওমা! আপনি এখানে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসবেন তো!’
নিশীথ কেন এসেছিল ভুলে যায়। মোটা পর্দার দিকে তাকিয়ে বলে ফেলে, ‘সান্তু নামটা আপনাকে একটুও মানায় না। বিশ্রী।’
‘তাই? এটাই বলতে এসেছিলেন? ওই যে পরাগ আমার ছোটবেলার বন্ধু, ওরই দেওয়া এই বিচ্ছিরী নামটা। এতকাল দিল্লীতে ছিল। মাত্র তিনদিন আগে কলকাতা ফিরেই আবার হাঁকডাক শুরু করেছে।’
‘ও আচ্ছা। আমি আসি।’ নিশীথ সিঁড়িতে পা রাখে। সান্ত্বনার বাবার কথা জিজ্ঞেস করা হয় না । সে খবরে সত্যিই কি আর দরকার আছে? খবর নেওয়ার লোক এসে গেছে। মুখ গোঁজ করে পেছন ফেরে ও।
‘এই যে নসুলাল, শুনুন…’
সান্ত্বনার চোখ মুখ দিয়ে সারা শরীর দিয়ে হাসি ফুটে বেরোচ্ছে। কিন্তু ও হাসছে না।
‘কী?’
‘যে নামটা ভাল সেটা বলে গেলেই তো হয়। খামোখা এখন আবার করুণ গলায় ‘সঁইয়া মেরি’ গাইতে বসবেন…’
চিরভদ্র চিরশান্ত নিশীথ হঠাৎ অশান্ত হয়ে ওঠে। নিজের কাছেই নিজেকে অচেনা মনে হয় ওর।
দু’ধাপ নেমে এসে সামনে দাঁড়ানো হাসি হাসি চোখের মেয়েটার হাতটা চেপে ধরে বলে, ‘আমার কাছে আপনার একটাই নাম, যন্ত্রণা।’
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন