short-story-sondhya-meye

সন্ধ্যামেয়ে
মাসউদ আহমাদ


পুরান ঢাকায় এলে অদ্ভুত অনভূতি হয় রাহাত আবিরের। একধরনের ভাবনা ও স্মৃতিকাতরতায় পেয়ে বসে। ভাবনাটুকু তার, কিন্তু স্মৃতিরেখা সরাসরি তার ব্যক্তিগত নয়। তা হলেও সে বিহ্বল হয়ে পড়ে। এই এলাকার পথঘাট, পুরনো বাড়ি আর মানুষ তাকে আকর্ষণ করে। আনমনা করে দেয়। কেন যে এমন হয়, সে বলতে পারে না।

ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে রিকসা থেকে নেমে রাহাত হাঁটতে শুরু করে। আর তখনই সমরেশ বসুর বিখ্যাত গল্প ‘আদাব’-এর কথা মনে পড়ে। ‘রাত্রির নিস্তব্ধতাকে কাঁপিয়ে দিয়ে মিলিটারি টহলদার গাড়িটা একবার ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশ দিয়ে একটা পাক খেয়ে গেল।’

দাঙ্গার ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে গল্পটি লেখা, কিন্তু পটভূমি এই ভিক্টোরিয়া পার্ক, ঠাঠারি বাজার হয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়িয়ে পাটুয়াটুলির লেনে গিয়ে মিশেছে। কতকাল আগে লেখা গল্প, তবু তার রেশ ও সুরভী এখনো ছড়িয়ে আছে। হাঁটতে হাঁটতে গল্পের চরিত্র ও পার্শ্বচরিত্রের ভেতরের চাপা আর্তনাদ ও উত্তাপ সে টের পায়।

রাহাতকে যেতে হবে কোতোয়ালি থানার সামনে। তার বন্ধু আরিয়ান কিছু টাকা ধার নিয়েছিল। চাকরির বদলির কারণে সে ঢাকার বাইরে যাচ্ছে। সম্ভব হলে একবার দেখা করতে বলেছে। টাকাই শুধু নয়, সে রাহাতের ঢাকা শহরের প্রথম বন্ধু।

পাঁচটায় পৌাঁছানোর কথা। এখন চারটে উনচল্লিশ। নভেম্বরের বিকেলটা দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। ডানপাশে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় রেখে রাহাত রাস্তার বাঁ পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকে। রাস্তায় প্রাইভেট গাড়ি, সিএনজি, রিকসা ও পথচারীর কারণে হাঁটাটা সামান্য যন্ত্রণারই। কিন্তু তার খারাপ লাগে না।

ফুটপাতে খাবারের দোকান, ভ্রাম্যমাণ পোষাক বিক্রেতা ও বাইকচালকের ভিড়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে ছোটখাটো একটা মার্কেটও গড়ে উঠেছে। তার পাশেই একটা রেস্তোরাঁ। সে হাঁটতে থাকে।

বাংলাবাজার চৌরাস্তায় ফুটওভার ব্রিজের কাছাকাছি চলে এসেছে রাহাত। তখন ডানপাশে চোখ পড়ে। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। পুবদিকের প্রবেশপথ ও স্কুলের নামটা কেমন ঝাপসা। জীর্ণ। এই স্কুলে একসময় পড়েছেন কবি ও ঔপন্যাসিক সৈয়দ শামসুল হক। ১৯৪৮ সালে, পূর্ববাংলার যোগাযোগ ব্যবস্থা যখন অত্যন্ত অনগ্রসর ও দুর্গম, সেই সময় কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকায় পড়তে এসেছিলেন তিনি। তাঁর বাবা তাঁকে পাঠিয়েছিলেন। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সে হাঁটছিল। চোখ ও মনের কোথাও বিহ্বলতা এসে গিয়েছিল তার। হঠাৎ মনে হলো, আমি ঠিক রাস্তায় যাচ্ছি তো?

রাহাতের জিন্সের প্যান্টের পকেটে ভাইব্রেট হয়। ফোন বের করতে করতেই কলটা কেটে যায়। নিজেকে একটা পুরনো ভবনের সামনে সে আবিষ্কার করে। এখানে আমি কীভাবে এলাম? তাহলে কি মানুষ যা কল্পনা করে, সেটা সে পায়? ভাবে সে।

সৈয়দ শামসুল হকের প্রথমজীবনের একটি সাহিত্য আসরের অভিজ্ঞতা মিথের মতন মনে হয় রাহাতের। ঘটনাটি সত্যি। তবু কোথাও একটা ধাঁধা ঝুলে থাকে।

পুরনো ভবনের সামনে, যেখানে সে দাঁড়িয়ে আছে, এখানে ‘সওগাত’ পত্রিকার অফিস ছিল। অফিসের গুদামঘরে পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের পাক্ষিক বৈঠক বসতো। পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ খুবই বড় সংগঠন। তখনকার দিনে, যারা আধুনিক প্রগতিশীল, বামপন্থায় বা সত্যিকার অর্থে ভাষার ব্যবহার করে লিখছেন, পাকিস্তানী আদর্শের নয় এইরকম লেখকেরা, প্রায় ষাট-পঁয়ষট্টি জন এই সংগঠনের সঙ্গে ছিলেন। সভায় জায়গা দেওয়া যেত না। এখানে একবার তরুণ সৈয়দ শামসুল হক একটি গল্প পড়ার সুযোগ পান। গল্প ও কবিতা পাঠের পর, কেউ একজন তা নিয়ে সমালোচনা করতেন। সৈয়দ হকের গল্প পড়া শেষ হলে দাঁড়ালেন খালেদ চৌধুরী। নির্মম সমালোচক হিসেবে তাঁর নাম ছিল। গল্পটির সমালোচনা করতে দাঁড়িয়ে তিনি বলতে লাগলেন মানবসম্প্রদায়ের আদিকালে লোহা যুগ ছিল। তারপরে তাম্রযুগ। তখন, সৈয়দ হক ভাবছেন, কী গল্প একখানা লিখেছি যে, একেবারে মানব সভ্যতার আদি থেকে সমালোচককে টানতে হচ্ছে। কিন্তু দেখা গেল, খালেদ চৌধুরী একেবারে মানব সভ্যতার বর্তমান পরিস্থিতিতে এসে বললেন, মানব সভ্যতার ইতিহাসে বোধহয় এত নিকৃষ্ট গল্প আর কখনও লেখা হয়নি।

সেই মুহূর্তে সৈয়দ হকের মানসিক অবস্থা কী হয়েছিল? জানার খুব ইচ্ছে ছিল রাহাতের। পরে, একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন, ‘বিশ্বাস করো, আমার মনে হলো আমি মাটির সঙ্গে মিশে যাই। কোনওরকমে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে, তখন ফ্লোরে বসে সভা হতো, ওই লেখাটা পকেটে নিয়ে বাইরে চলে এলাম। সওগাত প্রেসের সামনে একটা ডালিম গাছ ছিল। ওই জায়গাটা একটু আঁধার মতো। ডালিম গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছি, কেউ যেন আমাকে দেখতে না পায়। সভা শেষ হয়েছে। সবাই হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম, সবাই চলে যাক, আমি তারপরে বেরোই। অলক্ষে। আর আমার বুক একেবারে ভাঙা, হৃদয় ভাঙা, মানে লেখা আর হবে না আমাকে দিয়ে। হঠাৎ কাঁধে একটা হাত! তাকিয়ে দেখি ফজলে লোহানী। বললেন, মন খারাপ? ওঁর ওই হাত রাখা আর মন খারাপ বলার পরে আমার চোখ দিয়ে একদম ঝরঝর করে পানি পড়তে লাগলো।

তখন লোহানী আমাকে বললেন, এই যে যারা যাচ্ছে, কেউ থাকবে না। তুমি থাকবে। উনি আমাকে সদরঘাটে এনে একটা রেস্টুরেস্টে বসে পরোটা, তরকারি, চা-টা খাইয়ে আমাকে চার্জ করে দিলেন এবং ভীষণরকম। ওই কাজটি উনি যদি সেদিন না করতেন, হয়ত আমি বহুদিন লিখতাম না। একেবারেই লিখতাম না। হয়ত লিখতাম। হয়ত ভাবতাম আমাকে দিয়ে হবে না এবং ওই সমালোচনা তো ভোলার নয়। সবার সামনে উলঙ্গ করে দেওয়া। শুধু গল্প খারাপ হয়েছে তা তা নয়, সবার সামনে এইরকম অপমান।’

কতদিন আগের কথা। তবু মনে হয়, সেই ডালিমগাছের নিচে বসে এখনও কাঁদছেন তিনি। কাছে গেলেই তাঁর নিঃশব্দ কান্নার ব্যথাভার টের পাওয়া যাবে।

রাহাত সন্তর্পণে ডালিম গাছটা খুঁজতে থাকে। যেন চেনা কোনও বাড়ি ও গাছটা সে খুঁজে ফিরছে। না, পায় না। সেই গাছ তো নেইই, পুরনো পরিবেশের প্রায় সবই লুপ্ত হয়েছে। ঢাকা শহর দ্রুত তার পরিসর ও বৈশিষ্ট্য পাল্টে ফেলেছে। এখানেই বা সেই হাওয়া কেন বন্ধ থাকবে?

নিজের অজান্তেই বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

মাথাটা ঝাঁকিয়ে রাহাত আবার হাঁটতে শুরু করে। কয়েক পা এগিয়ে বাঁয়ে টার্ন করলেই প্রশস্ত রাস্তা সদরঘাটের দিকে চলে গেছে। এই পথেই কোতয়ালী থানা। কিন্তু তার আগেই ডানদিনে, মূল রাস্তার সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের মস্ত গেট। খোলা গেটের ভেতরে রাহাতের চোখ চলে যায়। ভেতরে যে লাল বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে, সেখানে বিয়ে হয়েছিল বরিশালের কবি জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে লাবণ্য গুপ্তর। সেটা অনেক আগের কথা। ১৯৩০ সালের ৯ মে। দিনটা ছিল শুক্রবার।

এক মে মাসের দুপুরে, কী ভেবে রাহাত এখানে দাঁড়িয়েছিল। যেন অপেক্ষা করছে, একটু পরেই স্ত্রীর হাত ধরে বেরিয়ে আসবেন তিনি, স্বয়ং জীবনানন্দ দাশ। একসময় সত্যি সত্যিই সে দেখল, মাথায় ঘোমটা দেওয়া ও ধুতি-পাঞ্জাবি পরা নবদম্পতি এগিয়ে আসছেন। অবিকল জীবনানন্দ-লাবণ্যর মূর্তি। কাছে আসতেই রাহাতের ঘোর কেটে যায়। সে যাঁকে প্রত্যাশা করেছিল, তিনি সেই লোক নন।

পাটুয়াটুলি লেন ধরে যেতে যেতে রাহাত দু’দণ্ড দাঁড়ায়। কোথাও একটু নিবিড় নির্জনতার গন্ধ পায়। মনটা কেমন করে ওঠে। বোধের ভেতর কী যেন চলতে থাকে।

সে আবার হাঁটতে শুরু করে।

একসময় এই এলাকায় রাহাতের বেশ আসা হতো। এলেই মালাই চিড়া ও খাশির পায়া খাওয়া চাই। সকালের দিকে এলে মাঠা। কিন্তু এখানকার বাড়ি ও গলির প্রাচীন হাওয়া তাকে খুব টানে।

এখন দরকার ছাড়া আসা হয় না।

একটু অন্যমনষ্কভাবেই হাঁটছিল রাহাত। হঠাৎ মনে হলো, পাশ থেকে কেউ একজন তাকে ডাকলো।

এই এই, তুমি রাহাত আবির না?

পুরান ঢাকায় রাহাতের পরিচিত মানুষ কমই আছে। কাজেই তার নাম ধরে ডাকা, তাও একজন নারী; ব্যাপারটা অদ্ভুতই বটে।

ব্রাহ্মসমাজকে পেছনে ফেলে একজন বেরিয়ে আসছেন। তাঁকে দেখে রাহাত থমকে দাঁড়ায়। চেনা মনে হয়, তবু ঠিক চিনতে পারে না।

আমি নিকিতা। চিনতে পারছ?

রাহাত চোখ সরু করে তাকায়। চিনতে পারে। হ্যাঁ, নিকিতাই। নিকিতার সেই চোখ ও নাক। আর হাসি। কথা বলার ভঙ্গিও অবিকল আগের মতো। মেডিক্যালপড়ুয়া স্লিম ও লম্বা নিকিতার স্বাস্থ্যটা কেবল বেড়েছে।

রাহাত বলল, কেমন আছ? ভালো?

নিকিতা হাসলো। মাথা দুলিয়ে বলল, এখানে সুমনা হাসপাতালে এসেছিলাম। তোমাকে অনেক বছর পর দেখলাম।

রাহাত হাসার চেষ্টা করে। তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের কথা ও স্মৃতির জানালা পটপট করে খুলে যায়।

নিকিতা বলল, হঠাৎ এদিকে? কোনও কাজে?

তা একটু ওই কাজেই।

তাড়া নেই তো? চলো, কোথাও একটু বসি। কফি খাই।

রিস্টওয়াচে একবার সময় দেখে রাহাত বলল, হুম। বসা যায়।

পাটুয়াটুলি লেন ধরে পথটা ইসলামপুরের দিকে চলে গেছে। ওরা কিছুক্ষণ হাঁটতে থাকে। হঠাৎ নিকিতা বলল, এসো।

একটা সুড়ুঙ্গের মতো সিঁড়ি বেয়ে নিকিতা উপরে উঠতে লাগলো। কয়েকটি মুহূর্ত মাত্র। নিকিতা রাহাতের চেনামুখ। যদিও সেসব একযুগ বা তারও আগের কথা। তবু ওর পেছনে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে একদমই অচেনা লাগে। নিকিতার চুল ও পিঠ বেয়ে রাহাতের চোখ তার নিতম্বে আটকে যায়। হার্টবিট বাড়তে শুরু করে। মনে হয়, আগে যে নিকিতাকে সে চিনতো, সে কিছুতেই এই মেয়ে নয়।

সিঁড়িভাঙার পর, নিকিতা লিফটের সামনে দাঁড়ায়। একসময় লিফটের ভেতরে ঢুকে পড়ে। কিন্তু লিফট যেন চলছেই, থামছে না।

কোথায় যাচ্ছি আমরা? জিজ্ঞেস করতে গিয়েও নিকিতার চোখে তাকায় রাহাত। হেসে ফেলে।

ইদানিং ঢাকা শহরে অদ্ভুত কিছু রেস্টুরেন্ট হয়েছে। সাধারণত বিশাল বিল্ডিংয়ের ছাদে, নির্জন ও গ্রামের আবহ নিয়ে এসব তৈরি হয়। অল্প, কিন্তু নানারঙের আলো। রেস্টুরেন্ট মানে তো শুধু খাওয়াদাওয়া নয়, নিরিবিলিতে বসে প্রাণখুলে কথা বলা আর আড্ডাও। এখানে তার পুরোটাই আছে।

কোনার দিকে একটা টেবিলে বসতেই সার্ভিস বয় ছুটে এলো। ম্যাডাম, কী খাবেন বলুন?

নিকিতা এখানে পরিচিত। বোঝা যায়।

একবার রাহাতের চোখে তাকিয়ে নিকিতা বলল, শুধু কফি? নাহ। এই শোনো, তুমি আমাদের তন্দুরি চিকেন দাও। আর ক্রিস্পি চিকেন সালাদ। কফি পরে দাও।

রাহাত নীরবে মাথা দোলায়।

তন্দুরি চিকেন ও সালাদ আসতে সময় নেয়। রাহাত নিকিতাকে দেখে। নিকিতা তাকে।

পুরনো দিনের কথা ও স্মৃতিভার রাহাতের চোখের সামনে এসে ভিড় করে।

এই সময় নিকিতার ফোন বেজে ওঠে। তুমি একটু বসো; বলেই নিকিতা উঠে যায়।

রাহাত নিজের মধ্যে ফিরে আসে।

রেস্টুরেন্টের বাইরে কি নাম লেখা ছিল? রাহাত খেয়াল করেনি। সে চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়।

তখন বসন্ত। তখন কেবলই নিকিতা। সে এক সময় ছিল দুজনের। নিকিতা রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে পড়তো, থার্ড ইয়ার। রাহাত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে ফাইনাল দিচ্ছে। একবার নিকিতারা কয়েক বন্ধু ইউনিভার্সিটির একটা গানের অনুষ্ঠানে এসেছিল। সেখানেই পরিচয় হয়।

তারপর জীবনের বাঁকফেরা।

সকালে পদ্মানদীর পাড়ে গিয়ে মুখোমুখি বসে থাকা। পার্কের নির্জন সবুজ ঘাসে পাশাপাশি, কথা ও কথাহীন দীর্ঘ মুহূর্ত। কোন দোকানের চা ভালো, পরোটা কোথায় ভালো বানায়। আর ডিম খিচুড়িটা। নতুন সিনেমা এসেছে উপহার কিংবা বর্ণালীতে। একসঙ্গে দেখা চাই। রাহাত থাকত বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে। নিকিতা আচমকা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসেও চলে আসতো। বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনের বট পরোটা ওর খুব প্রিয় ছিল। নিকিতা আর রাহাত। রাহাত আর নিকিতা। সারা শহর চষে বেড়ানো দুজনে। সোনাদীঘির মোড়ের সেই বিখ্যাত মাজেদা হোটেল আজও কী চমৎকার চোখে ভাসে। বর্ণালী সিনেমার উল্টো দিকের সাগরের চায়ের দোকান। কিছুদিন না গেলে, বা একা গেলে, দোকানি বলতো, স্যার, ম্যাডাম আসেনি?

কখনও রেলস্টেশনে গিয়ে বসে থাকত দুজনে, অপেক্ষা করত। যেন ট্রেন ধরবে। আদতে দুজনকে কাছে পাওয়ার ব্যকুলতা।

তখন, নিকিতার চোখেই পৃথিবীটা দেখতে ইচ্ছে করে রাহাতের। ভালো লাগে। সব সুন্দর ওই ভালোলাগায় মিলেছে। দুজনের আনন্দ-বেদনা আর সুখ-দুঃখ একসঙ্গে মেলানো। এই ছিল তখনকার দিনরাত্রি। একবার নিকিতাকে রাহাত ওদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। নিকিতা শহুরে মেয়ে। তবু গ্রাম তাকে অবাক ও অভিভূত করেছিল। তার মনে কী ছিল রাহাত জানে না, সে এমনই প্রকাশ করেছিল।

সেই নিকিতা, এখন সে কেউ নয়। কিন্তু সে রাহাতের কীই না হতে পারতো।

একদিন, গ্রেটার রোডে বর্ণালী সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। নিকিতা হঠাৎ বলল, এসব আর ভালোলাগে না। মান্না ও মৌসুমীর কী একটা সিনেমা চলছিল। দুজনে দেখতে গিয়েছে। সিনেমা আর দেখা হয় না। নিকিতা রহস্যময় হাসি হাসে।

রাহাত ভাবল, সে দুষ্টুমি করছে। সে কপাল কুঁচকে ভালো করে তাকাতেই টের পায়, নিকিতার চোখে অন্য-পুরুষের ছায়া।

রাহাত মন খারাপ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ফিরে আসে।

তারপরের ঘটনাগুলো দীর্ঘদিনের হলেও সংক্ষিপ্ত।

পরে সে জানতে পারে, মেডিক্যালেরই এক ডাক্তারের সঙ্গে নিকিতার ঘনিষ্ঠতার কথা। সে ওসবে কান দেয়নি। রাহাত নীরবে সরে যায়। মাস্টার্স শেষ হওয়ার পর, সে ঢাকায় চলে আসে। নিকিতার সব কথা ও স্মৃতি সে মন থেকে মুছে ফেলে।

কিন্তু সব স্মৃতিই কি আর ধুয়ে মুছে যায়?

বিকট একটা শব্দ ভেসে এলো। অমনি টুপ করে বিদ্যুত চলে গেল। অন্ধকারে ভরে গেল পুরো রেস্টুরেন্ট। পাশ থেকে কোনও তরুণীর গোপন আর্তনাদ শোনা গেল, ভয় নাকি শিৎকারের; বোঝা গেল না। খানিক পরেই আলো জ্বলে উঠলো।

নিকিতা হাসিমুখে ফিরে আসে। আর তখনই খাবার নিয়ে হাজির হয় সুদর্শন সাভির্স বয়।

এমবিবিএস পাশ করার পর, এক ব্যবসায়ীকে বিয়ে করেছে। পারিবারিকভাবে। নিকিতা জানায়।

রাহাতের চোখ ছোট হয়ে আসে। তাহলে সেই ডাক্তার? যার সঙ্গে নিকিতা পদ্মা গার্ডেনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল?

নিকিতা বলল, ঢাকায় এসে কিছুদিন প্রাইভেট হসপিটালে প্র্যাকটিস করতাম। কনসিভ করার পর, ছেড়ে দেই। কিন্তু সন্তান হয়নি।

কেন?

সে কথা আর জিজ্ঞেস করা হয় না।

নিকিতা বলল, আমার হাজব্যান্ড ব্যবসায়ী। পুরান ঢাকায় ওদের বাড়ি আছে। একদিন এসো।

মনোযোগী ছাত্রের মতোন রাহাত মাথা দোলায়। হাসে।

বারোতলার ছাদ থেকে ঢাকা শহরের অনেকটা পরিষ্কার দেখা যায়। বুড়িগঙ্গা নদীকে এত চমৎকার লাগে, মনে হয় রাহাত পাখির চোখে দেখছে।

সন্ধ্যা নামছে। আকাশের সিঁড়ি বেয়ে গোধূলির অচেনা আলোর রেখা নামছে। দিন ও রাতের এই সময়টা বড় অদ্ভুত লাগে রাহাতের। মন কেমন করে ওঠে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই রাস্তার সোডিয়াম বাতি ও দোকানে দোকানে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে উঠেছে।

কথা খুব একটা এগোয় না। নিকিতা বলল, চলো, উঠি।

খেতে খেতে রাহাত হাসার ভঙ্গি করলো। ভেতরে সে কোনো তোলপাড় অনুভব করলো না।

পরিচয়ের পর, প্রথম দেখা হওয়ার দিন বেলাশেষে নিকিতা যখন বলেছিল, যাই। মনে হয়েছিল, পৃথিবীর সমস্ত আলো একসঙ্গে ব্যাগে পুরে বলল, যাই।

কিন্তু কী আশ্চর্য, কোথাও একটা স্থবিরতা ভর করে। পুরনো প্রেমের স্মৃতি ও ব্যথাভার সে অনুভবই করে না। তবে কি তার বয়স হয়ে গেল? সম্পর্কের লাবণ্যের রেণু কোথাও কি এতটুকুও অবিশিষ্ট নেই?

ফস করে একটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাহাত খোলা আকাশে চোখে রাখে। ক্যামেরা প্যান করে ঘোরানোর মতো সে চোখদুটো নিকিতার চোখে নামিয়ে আনে। কিছু একটা পড়ার চেষ্ট করে।

নিকিতার জন্য মনের কোথাও একটু টান ও ব্যাকুলতা সে টের পেল না।

এমনও হয়?

কোনও কারণ নেই। তবু জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতার কয়েকটি লাইন মনে পড়ে রাহাতের। মনে মনে সে কথাগুলো পড়তে থাকে—

‘কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে/ সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে/ চোখে তার/ যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার/ স্তন তার/ করুণ শঙ্খের মতো – দুধে আর্দ্র – কবেকার শঙ্খিনীমালার/এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায়নাকো আর।’

জিন্সের প্যান্টের পকেটে মুঠোফোন বাজছে। গোঙানির মতো ভাইব্রেট হচ্ছে।

কোতোয়ালি থানার সামনে যে বন্ধুর কাছে এসেছিল রাহাত, সে কি চলে এসেছে? অপেক্ষা করছে?

এক বয়স্ক মহিলাকে দেখে নিকিতা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এই, একটু আসছি প্লিজ, বলে সে উঠে যায়।

সদরঘাটের ওপার থেকে বড় লঞ্চের হুইসল শোনা যায়।

খোলা ছাদের নির্জন রেস্টুরেন্ট থেকে রাহাত নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে। লিফটের পাশেই সিঁড়ি। সে ধীর পায়ে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে।

সন্ধ্যা নামছে।

বন্ধুর সঙ্গে আর দেখা হয় না। সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে সেই কবে। অনেকদিন পর, ভিক্টোরিয়া পার্কের ভ্রাম্যমাণ হকারের কাছে রাহাত একটা সিগারেট কেনে। মুঠোফোন বন্ধ করে রিকসায় চেপে বসে। ওর সারামুখে গাঢ় ও দুঃখী বিষাদরেখা। নিকোটিনের ধোঁয়ার রিং গোল্লা হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

রিকসায় বসে একবার সে পাশ ফিরে তাকায়, পুরান ঢাকার পথ, বাড়ি ও আকাশের রঙ ধোঁয়ার থেকেও দ্রুত ঝাপসা হতে থাকে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “short-story-sondhya-meye

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *