স্তম্ভ
সাগরিকা রায়
সাগরিকা রায়
এ বছর শীত এল বেশ দেরিতে। রাস্তার দুই ধারের গাছের পাতা কেবল ঝরতে শুরু করবে করবে করছে, তখন বাংলাদেশ থেকে এল অনুকাকিমা। শহরের ঝলমল দেখে কাকিমা ভারি অবাক হল। এরকমটাই ভেবেছিল মহুল। কাকিমার ঘরের ভেতরে রুম ফ্রেসনার স্প্রে করতে গিয়ে দেখে কাকিমা জানালা দিয়ে বাইরের পৃথিবী দেখছে। মহুলকে দেখে আশ্চর্য গলায় কাকিমা বলল, “তোমাদের এহানে রাইত অয় না? সব্বদা আলো দেহি। কারণ কি? আন্ধার কোথায়?”
মহুল ভাবল অফিসে আজ ভাল জমিয়ে দেওয়া যাবে। মুখে অবশ্য আলোর কারণটা বলল। এত ত্রিফলা, এত ইলেকট্রিসিটি…অবদান কি রাখবে না? অনুকাকিমা ঘোর গ্রামে থাকেন। গ্রামের বাইরে এই প্রথম পা দিয়েছেন। এখন কি আসা হতো? হতো না। এই আমবাগান অঞ্চলে থাকে মহুলরা কয়েক পুরুষ ধরে। মহুলের বাবার জেঠিমা এখনও বেঁচে। তবে ইদানিং শরীর কেমন ধূসর হয়ে আসছে। সঙ্গে স্মৃতি। মাঝে একদিন অনুকাকিমার নাম ধরে ডাকছিল। গলার স্বরে কেমন এক আকুলতা ছিল। মহুলের কাকা অনুকাকিমাকে খবর দিয়েছিল। যদি সম্ভব হয়, একবার এসে দেখা করে গেলে ভাল হয়। অনুকাকিমা খবর পেয়েছে অনেক দেরি করে। মহুলের ফেসবুক ফ্রেন্ড জাহিরুলকে জানিয়েছিল মহুল সমস্যাটা। চিঠি পৌঁছতে কত দিন লেগে যাবে, কেউ বলতে পারেনা। জাহিরুল গ্রামের ঠিকানা নিয়ে সেখানে গিয়ে কাকিমার সঙ্গে দেখা করেছে । খবরটা দিয়েছে । অনুকাকিমার ভাইপো পিসিকে পৌঁছে দিয়ে চলে গেছে। ফের এসে নিয়ে যাবে। কিন্তু ততদিনে বাবার জেঠিমা, মহুলের আমবাগানের রানির স্মৃতিতে আরও এক পোঁচ ধূসর রঙ লেগেছে। অনুকাকিমা গিয়ে দাঁড়াতে মোটে চিনতে পারল না। চোখের ওপরের হালকা পর্দা সরিয়ে অনুকাকিমাকে চেনার চেষ্টাটুকুও নেই সেখানে।
কাকিমা মহুলকে জিগ্যেস করেছে, “কত বচ্ছর হইল উনার? একশো দেড়শো?”
মহুল ভ্রু কোঁচকাতে গিয়ে থেমে গেল। যেন এই প্রশ্নটা ওরও। বাবার জেঠিমা মানে মহুলের বড় ঠাম্মা। মানে হল মহুল যদি পঁয়ত্রিশ, বাবার বয়স পঁয়ষট্টি, দাদু পঁচাশি, দাদুর পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবচে বড় দাদা হল পঁচানব্বই, তাঁর স্ত্রীর বয়স বিরানব্বই। সোজা হিসেব। এমন কী আর? তাহলে কেন সবাই মিলে বড় ঠাম্মাকে হেরিটেজ বানিয়ে দিচ্ছে?
অনুকাকিমা পানের খিলি মুখের ভেতর গুঁজে বলল, “এহানে কিরম কিরম গন্ধ পাইতেছি। আমার মন ভাল্লাগতেছে না। বড়দিদি এইবারে আর উঠবে না। আমারে তো চিনতেই পারল না। তো এহানে থাইকা কী করুম? আমি যাই গা। ওহানে বাচ্চুর বৌ একলা। বাচ্চু দুকান বন্ধ কইরা বাসায় ফিরতে রাত কইরা ফেলে। বৌ ভয় পায়। বাঁশঝাড় থিকা কারা কথা কয়। হিস ফিস কইরা পেরেত কথা কয়। বাচ্চুর বৌরে একলা রাখা ঠিক না। বুঝই তো সব! দুনিয়াটা ঠিক নাই। চাইরদিকে প্রেত ঘুরতেছে। কার বৌরে টাইনা নেয়, কার কচি মেয়েটারে নিয়া যায়। বাঁশঝাড়ে তাগো মড়া দেখছি। বাচ্চুর বৌ যোবতি। অরে ছাইড়া থাকা ঠিক না। পাহারা দিব কে?”
অনুকাকিমা পশ্চিমের ঘরে জেঠিমার খাটের পাশের সোফায় শুয়ে রাত কাটিয়ে দিল। ভোরে উঠে স্নান সেরে ব্যাগ গুছিয়ে নিল। জেঠিমার ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত জেঠিমার দিকে তাকিয়ে বিদায় নিল, “দিদি গো। যাই। বাড়িত যাই। তুমি ভালা থাইকো। যেহানেই থাহো, ভালা থাইকো। অনেকডা দিন তুমার লগে ছিলাম। আশিব্বাদ দিও আমাদের। যাই গো।”
অনুকাকিমা চলে গেলেও জেঠিমা বুঝতেও পারল না। আমরা সবাই নীরবে দেখলাম জেঠিমাকে একা ফেলে অনুকাকিমা চলে গেল। অথচ জেঠিমা কত আকুল গলায় অনুকাকিমাকে দেখতে চেয়েছিল! মানুষ বড্ড নিজের কথা ভাবে। আর কটাদিন থেকে গেলে কে বলতে পারে জেঠিমার হয়তো অনুকাকিমাকে মনে পড়ে যেত। তখন কিছু একটা কথা বলতে পারতো। কে বলতে পারে! কী কথা বুকে রেখেছে জেঠিমা,কেউ জানতে পারবে না হয়তো! কথাটা না বলতে পারলে শান্তিতে মরতেও পারবে না জেঠিমা।
মহুলদের পুরনো বাড়ির কার্নিশে অশ্বত্থগাছ চারা তুলে জায়গা দখলের ধান্দা করছে। বাড়ির পেছনদিকের অব্যবহৃত ঘরগুলো সারাক্ষণ তালা দেওয়া থাকে। মহুলের ছোটবেলায় এইরকমই ছিল। এখন বড় হয়ে চাকরিতে ঢুকেও একইরকম সব আছে। খুব ঝড় বৃষ্টির দিনে মহুলের মনে হয় ওই ঘর গুলোতে কারা হাঁটাচলা করে। ছেলেবেলার ছাপ মনে এখনও রয়েছে মনে করে ও। কিন্তু লেখা এই বাড়িতে বিয়ে হয়ে এসে অদ্ভুত কিছু কথা বলেছিল। যে কথা মহুলের কাছে কিন্তু খুব আশ্চর্যের বা মিথ্যে বলে মনে হয়নি। তাহলে মহুল কি নিজেও মনে মনে লেখার কথাগুলোকে বিশ্বাস করতো আগে থেকেই?
মহুলের স্থির চোখের দিকে তাকিয়ে লেখা বলল, “তুমি কখনও কি শুনতে পাওনি ? আমি আজ দুপুরে তোমাদের পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। তখন দেখলাম পেছন দিকের প্রায় সাত থেকে আটখানা ঘর তালাচাবি দেওয়া। অথচ জানো, আমার কেমন শিরশিরে ভয় করল। আমি থাকতে পারছিলাম না। মনে হল, এখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক নয়! তারপর চলেও আসছিলাম, হঠাৎ করে কী মনে হতে,কী মনে হল বল তো? মনে হল,আমাকে কেউ দেখছে! কেউ যদি তোমাকে লুকিয়েও দেখে তোমার ইন্দ্রিয় ঠিক জানিয়ে দেবে তোমাকে। ঠিক জানিয়ে দেবে। আমাদের বাড়িতে একটা বাথরুম আছে। এখন আর সেটা বাথরুম হিসেবে নেই। স্টোর বানিয়ে ফেলেছে বাবা। তো, যখন বাথরুম ছিল, স্নান করতে গিয়েছি, মনে হল, আমি এখানে একা নই! আরও কেউ আছে। বাথরুম বিরাট কিছু নয়, বা ফার্নিচারে ভর্তি, তাও তো নয়! কিন্তু…! অনুভূতিটা মাথায় এমনভাবে চেপে বসল, আমি চোখ তুলে দেওয়াল থেকে মেঝে অব্দি দেখেও কিছু খুঁজে না পেয়ে সিলিঙের দিকে তাকালাম। তাকিয়ে দেখতে দেখতে এক জায়গায় চোখ আটকে গেল। একটা আইহোল রয়েছে! একটা মানুষের চোখের আয়তনের মত জায়গা। আমি তাকাতেই জায়গাটা আলোকিত হয়ে গেল। মানে? কেউ ছিল চোখ লাগিয়ে। আমি তাকাচ্ছি দেখে সে সরে গেল!”
“হুম? তারপর? কে ছিল, খোঁজ করনি?”
“বুঝেছিলাম। ওপরতলায় একটি পরিবার থাকতো। ভাড়াটে। মাকে সব বলতে মা নীরবে ওদের ঘর ছাড়তে বলে দিল। আর বাথরুম বদলে দিল। এটা বলছি,আজ চলে আসতে গিয়েও আমার একই রকম অনুভূতি হল। যেন কেউ আমাকে দেখছে। ঠিক আমার পেছনে সে আছে। চমকে পেছন ফিরে তাকালাম। কেউ ছিল না! কিন্তু মহুল, আমি তার অস্তিত্ব অনুভব করেছি! এই বাড়িতে কিছু একটা আছে। বিশ্বাস কর।”
মহুল লেখাকে অবিশ্বাস করেনি। করার কারণও খুঁজে পায়নি। একদিন কেন, অনেকগুলো দিন ওরও লেখার মতই অনুভূতি হয়েছে। কাউকে জানাতে সাহস পায়নি। অকারণে বকাবকি চলবে। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, পেছনের ঘরগুলো বানিয়েছিল কারা? কেনই বা? সেই ছেলেবেলায় জেঠিমাকে দেখেছিল পেছনের ঘর থেকে বের হয়ে আসতে। অত্যন্ত চুপিসারে বেরিয়ে আসছিল জেঠিমা। সবাইকে লুকিয়ে কাজ করার মত হাবভাব। জেঠিমার মধ্যে এমন কিছু ছিল, মহুলের সাহস হয়নি সামনে এসে দাঁড়ায়।
পরে বন্ধ দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে মহুল চুপিচুপি ঘরের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছিল। ওর মনে হয়েছিল, একা একা কেউ ভেতরে পায়চারি করছে! কাউকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু কারও অস্তিত্ব ছিল! ভাল করে দেখতে গিয়ে রাঙাপিসিকে দেখেছিল মহুল ওই ঘরে। রাঙাপিসি বিধবা হয়ে বাপের বাড়িতে চলে এসেছিল। কী হয়েছিল জানে না মহুল। কিন্তু বাড়ির কাজের লোক সদানন্দকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল জেঠিমা। কয়েকদিন পরে রাঙাপিসিও কোথায় চলে গেল। ওই ঘরে আর দেখেনি মহুল কাউকে। কিন্তু আগমনী গান গাইতে আসে যে বৈষ্ণবী, সে জেঠিমাকে বলেছিল, “মিষ্টি খাওয়াও গো মা। কেষ্ট রাধাকে নিয়ে বেশ আছে। তোমার দেওয়া টাকায় মুদী দোকান দিয়েছে সেই তাঁতির হাটে। এখন সে সত্যি সদানন্দ।” কথার মানে বোঝেনি মহুল। অথচ বৈষ্ণবীর কথায় জেঠিমা এত খুশি কেন হয়েছিল, আজ একটু একটু বুঝতে পারে। আজ লেখা বলার পরে সেইদিনটা হুট করে ছুটে এল সামনে!
ছুটির দিন লেখাকে নিয়ে বাড়ির পেছনের কয়েক বিঘে জমিতে ওদের পারিবারিক আমবাগানে এল মহুল। গাছের তলে তলে ঝুলে আছে অসংখ্য আম। পাকা আমের গন্ধে বাগান ভরপুর হয়ে আছে। প্রায় তিনশো গাছ রয়েছে। বাগানের পাহারাদার রয়েছে তিন-চারজন লোক। বিভিন্ন স্বাদের আম রয়েছে এই বাগানে। এই আমবাগান করেছিল জেঠিমা। দশটি আম গাছ থেকে এখন এই বিরাট বাগান। জেঠিমার নাম হয়ে যায় আমবাগানের রানী। অনুকাকিমা এবারে এসে আমবাগান দেখে খুব খুশি হয়েছিল। রুমাদিদা বলেছিল, “থেকে যাও অনু।” কিন্তু অনুকাকিমার সংসার ওদেশে। বাংলাদেশ ছেড়ে এদেশে বাস করার ইচ্ছে অনুকাকিমার হয়নি। কিন্তু রুমাদিদা এতে কষ্ট পেয়েছিলেন। জেঠিমার শরীর দিন দিন ভেঙে পড়ছে।কাকিমা থাকলে ভাল হতো। আমবাগানের কথা সকালেই মনে হয়েছে। মহুল অনেকদিন আমবাগানে আসেনি। আজ কেন যে ইচ্ছে হল! খুব ইচ্ছে হল এখানে আসতে!
খানিকটা ঘোরাঘুরি করে ফিরে যাবে ভেবেছে, কিন্তু লেখা এত বড় বাগান দেখেনি আগে। ও উচ্ছল হয়ে “দাঁড়াও,ঘুরে দেখি,” বলে মহুলকে ছেড়ে এগিয়ে গেছে। হিমসাগরের দিকে চলে গিয়েছে লেখা। মহুল কাঞ্চন ল্যাংড়া আমগাছের দিকে ছিল। লক্ষ্মণভোগ আমগাছের পরে গোলাপখাস। আর তারপরে হিমসাগর। এক একটা জাতের আমের জন্য এরিয়া ভাগ করা আছে। লেখাকে ডাকতে হলে এগিয়ে যেতে হবে। নইলে লেখা ডাক শুনতে পাবে না। মহুল ডাকার আগেই লেখাকে ছুটে আসতে দেখল। গাছপালার ভেতর দিয়ে ছুটে আসছিল লেখা। শাড়ির আঁচল উড়ছে বাতাসে হই হই করে। খোলা লম্বা লম্বা চুলগুলো মুখ ঢেকে দিচ্ছে। উদ্ভ্রান্তের মত ছুটে আসছিল লেখা। ভয়ে বিস্ফারিত চোখ। মহুল কিছু বুঝে ওঠার আগেই লেখা জাপটে ধরেছে ওকে, “মহুল, মহুল, ওখানে গর্তের মধ্যে…একটা হাত উঠে এসেছে আমাকে ধরার জন্য! আমবাগানের ভেতরদিকে…বাড়িতে চল,এখান থেকে চল…! পালাও!”
ওরা বাড়িতে চলে এসেছিল। কাউকে কিছু জানায়নি মহুল। লেখাকে বারণ করেছে বাড়িতে কিছু জানাতে। আসলে মহুল নিজেই এই ব্যাপারে তদন্ত করতে চাইছিল। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, জানতে হবে। ওদের পরিবারে এমন কী রহস্য আছে, যার সন্ধান ও জানে না? বাবা,মা কি জানতেন? দুজনেই চলে গিয়েছেন স্বর্গে। সে বছর পাঁচেক আগের কথা। সিকিম বেড়াতে গিয়ে গাড়ি খাদে পড়ে গিয়েছিল। মহুল যায়নি সেবারে বাবা-মায়ের সঙ্গে। জেঠিমা যেতে দেয়নি। বলেছিল,মহুলকে না দেখে থাকতে পারবে না জেঠিমা। আসলে ঠাম্মি হলেও বড়দের দেখাদেখি ও জেঠিমাই বলে আসছে ছোট থেকে। মায়ের বড্ড ইচ্ছে ছিল মহুলকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার। কিন্তু জেঠিমা মাকে আড়ালে বলেছিল মহুলের ফাঁড়া আছে। ওকে না নিয়ে যাওয়াই ভাল। কিন্তু ফাঁড়াটা ছিল কার? বাবা,মা দুজনেই মরে গেল! মহুল আজও সুস্থ শরীরে বেঁচে আছে! জেঠিমা কি ভুল দেখেছিল?
লেখা রাতে শুনছিল এসব কথা।ও নিজের হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে ছিল, “জেঠিমা কি দেখতে পান? কোনও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, এটা কি উনি জানতে পারেন?”
“জেঠিমা কিভাবে পারেন, সেটা জানি না। কিন্তু পারেন । আমি সেটাই ভাবছি। অনুকাকিমাকে কি নিজের গুপ্ত রহস্যের চাবি দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন জেঠিমা? বড্ড দেরি করে এসে সেই চাবি আর পেল না অনুকাকিমা।”
“কী হয়েছিল আগে? জেঠিমা কী করেছিলেন ?”
“একদিন খুব ঝড়বৃষ্টি ছিল। ঝড়ে আম কুড়োতে আমাদের বাগানে ঢুকেছিল চারটে বাচ্চা ছেলে। যা হয় আর কি! সেই সময় বাজ পড়ে মরে যায় বাচ্চারা। জেঠিমা দুপুরে ঝড় উঠতেই খুব চেঁচামেচি করছিল। বলছিল- সবাই ঘরে ঢুকে পড়। কেউ বাগানে যাবে না। আমি না বলা পর্যন্ত কেউ যেন বাগানে না যায়।” জেঠিমার সেই মূর্তি দেখে আমিও চমকে উঠেছিলাম। পাগলের মত জানালা দরজা নিজে বন্ধ করছিল, সবাইকে বলছিল বাকি দরজা জানালা বন্ধ করে দিতে। জেঠু জেঠিমাকে সামাল দিতে পারছিল না। জেঠিমা বলছিল, “আর একটু সময়! আর একটু! সাবধানে থাক সবাই।” ঠিক ঘন্টা খানেক পরে জেঠিমা শান্ত হয়ে চোখ বুজে বসে রইল। হাতজোড় করে কার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাচ্ছিল, জানে না মহুল। তখন ঝড় থেমে গিয়েছে। জেঠিমা বাড়িতে সবাইকে ডেকেছিল, “আজ গোলাপখাস এরিয়ায় বাজ পড়েছে! চলে গেল ওরা। পুড়ে ঝুড়ে চলে গেল! এতটুকু টুকু বাচ্চাগুলো। আহা রে!”
আজও জানি না। কী করে জেঠিমা জেনেছিল? কে বলেছিল তাঁকে মৃত্যুর দূত আমবাগানে সেদিন থাকবে? সেইজন্যই কি কাউকে বাগানে যেতে দেয়নি সেদিন? জানি না। তবে এমন ঘটনা আছে আরও। কিন্তু আজ তুমি কী দেখলে ? তোমার চেহারা দেখে আমি নিজে গিয়ে আর তদন্ত করার সাহস পেলাম না। মনে হল, তোমাকে বাড়িতে নিয়ে আসাই ভাল হবে। খুব ভয় পেয়েছিলে!”
লেখা চুপ করে থাকে। এখনও ও স্বাভাবিক হয়নি। মহুল ভাবল, এই আমবাগান নিয়ে জেঠিমার প্রচন্ড ভালবাসা ছিল। জেঠিমা অসুস্থ হওয়ার পরে আর কেউ নেই পরিবারকে বিপদের হাত থেকে বাঁচায়। একবার জেঠিমাকে দেখে আসতে ইচ্ছে হল। এত রাতে জেঠিমা কি ঘুমিয়েছে? আকর্ষণ করছে জেঠিমা। কেন? মহুলের অস্বস্তি হচ্ছিল। ও লেখাকে শুতে বলে বেরিয়ে এল। জেঠিমার ঘরে অল্প আলো জ্বলে রাতে। চড়া আলোয় ঘুম হয় না জেঠিমার। মহুল সিঁড়ি দিয়ে উঠে জেঠিমার ঘরের দিকে যাচ্ছিল। দরজা ভেজিয়ে রাখা। বকুল নামের মেয়েটা রাতে থাকে। নাইট ডিউটি। সেন্টারের মেয়ে। এরা রাতের ডিউটি করতে এসে নিজের ঘুমনোর জায়গাটা দেখে নেয় আগে। পিনুর মা রাতে ওয়াশরুমে যেতে গিয়ে পড়ে গেলেন। এদিকে নাইটের আয়ার পেশেন্টকে দেখার কথা। সে ঘুমোচ্ছিল। শব্দ পেয়ে উঠেছে। এই তো হল অবস্থা! দরজায় অল্প চাপ দিতে দরজা খুলে গেল। আয়া মেয়েটি যথারীতি ঘুমোচ্ছে। জেঠিমা দরজার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। যেন মহুল আসবে তিনি জানতেন। শীর্ণ মুখে হাসার চেষ্টা করলেন, “আয়, আজ তোর বউ ভয় পেয়েছে। ওখানে সে আছে। একটি মেয়েকে রেপ করে খুন করেছিল সেই কারা, মেয়েটির বড্ড একা লাগে। ও নিজের বাড়িতে যেতে চেয়েছিল। বাড়িতে ওর মা ওর জন্য অপেক্ষা করছিল যে! মেয়েটি এখনও মায়ের কাছে যাবে বলে সঙ্গী খোঁজে। অনুকে বলেছিলাম, এই বাড়ি, আমবাগান, সব রক্ষা করতে। সে ভার নিল না। তুই নিবি ভাই? আয়। তোর হাতে আমি সব ভার দিয়ে যাই। এই বাড়ির গেটের সামনের দুটো থাম মানে স্তম্ভ ভেঙে পড়ছে। ওগুলো সারাই করতে হবে। আমার শাশুড়ি তখন নতুন বৌ হয়ে এসেছেন। সেই সময় সারাই হয়েছিল। রাজেন্দ্র নামের এক মিস্ত্রি সারাই করেছিল। আমি যখন এই বাড়িতে এলাম, তখন রাজেন্দ্রর ছেলে একটা স্তম্ভ নতুন করে বানিয়ে দিল। এখন আমার আর সময় নেই। কিন্তু ওগুলো সারাই করতে হবে মনে রাখিস।” বলেই জেঠিমা শীর্ণ গলায় গেয়ে উঠলেন, “ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়োতে সুখ / পাকা আমের মধুর রসে রঙীন করি মুখ/ আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা আম কুড়োতে যাই…!” জেঠিমার রুগ্ন স্বর কেঁপে কেঁপে ঘরময় ঘুরে বেড়ায়।
মহুল নিজে থেকে জেঠিমার কাছে গিয়ে বসেছে। জেঠিমা ওর হাত নিজের হাতে চেপে ধরলেন। মহুলের শরীরে তীব্র কম্পন জেগে উঠল। কিছু একটা প্রবিষ্ট হল যেন। একটা তরঙ্গ ওর রক্ত কণিকার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। শরীর তোলপাড় হচ্ছিল।
কখন জেঠিমার থেকে বিদায় নিয়ে ঘরে চলে এসেছে, মনেই নেই। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন লেখাকে জাগাল না। নিজেও ঘুমের অতলে ঢুকে পড়েছে কখন! আমবাগানের আনাচ কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছিল মহুল। সব দেখেশুনে রাখতে হবে। আমবাগানের সবটুকু ঘুরে ফেরার সময় দেখল কাঞ্চন ল্যাংড়া আমের এরিয়ার দিক থেকে এক গা গয়না পরে জেঠিমা চলে যাচ্ছে আমবাগান থেকে। সঙ্গে একটি অল্প বয়সী মেয়ে। হাসিখুশি মেয়েটিকে নিয়ে যাচ্ছে জেঠিমা। দুজনে হেসে হেসে যাচ্ছে। কী ব্যাপার হল এটা? জেঠিমা আমবাগানে কেন?
ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। মহুল প্রথমে বুঝতে পারেনি। পরে তাড়াহুড়ো করে উঠে বসল। এমন স্বপ্ন কেন দেখল ও? কাল রাতে জেঠিমার সঙ্গে ওর যা কথা হয়েছে, সেটা কাউকে বলা যাবে না। একবার জেঠিমার সঙ্গে দেখা করা দরকার। এই স্বপ্নের অর্থ জানতে হবে।
মহুল গিয়ে দেখল জেঠিমা কখন ঘুমের মধ্যেই চলে গিয়েছেন! খবর শুনে বাড়িশুদ্ধ সকলে জেঠিমার ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে।
“কখন গেলেন উনি?”
কেউ জিজ্ঞাসা করছিল কাউকে। মহুল জানে জেঠিমা কখন গেলেন। যাওয়ার আগে মহুলকে জানিয়ে গিয়েছেন। আর সঙ্গে করে সেই মেয়েকে নিয়ে গেলেন, যে সঙ্গী খুঁজে ফিরছিল মরে যাওয়ার পরেও। রহস্যের চাবিটা জেঠিমা মহুলকে দিয়ে গিয়েছেন।
মহুল রক্তের মধ্যের সেই তরঙ্গ অনুভব করে। এখন অনেক কাজ। ভেঙে পড়া স্তম্ভ সারাই করতে হবে। রাজেন্দ্রর নাতি আছে নিশ্চয়?
মহুল জেঠিমার মরদেহর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটা কাজ বাকি আছে। একবার তাঁতির হাটে যেতে হবে। সদানন্দের কাছে।
———————————————————-
মহুল ভাবল অফিসে আজ ভাল জমিয়ে দেওয়া যাবে। মুখে অবশ্য আলোর কারণটা বলল। এত ত্রিফলা, এত ইলেকট্রিসিটি…অবদান কি রাখবে না? অনুকাকিমা ঘোর গ্রামে থাকেন। গ্রামের বাইরে এই প্রথম পা দিয়েছেন। এখন কি আসা হতো? হতো না। এই আমবাগান অঞ্চলে থাকে মহুলরা কয়েক পুরুষ ধরে। মহুলের বাবার জেঠিমা এখনও বেঁচে। তবে ইদানিং শরীর কেমন ধূসর হয়ে আসছে। সঙ্গে স্মৃতি। মাঝে একদিন অনুকাকিমার নাম ধরে ডাকছিল। গলার স্বরে কেমন এক আকুলতা ছিল। মহুলের কাকা অনুকাকিমাকে খবর দিয়েছিল। যদি সম্ভব হয়, একবার এসে দেখা করে গেলে ভাল হয়। অনুকাকিমা খবর পেয়েছে অনেক দেরি করে। মহুলের ফেসবুক ফ্রেন্ড জাহিরুলকে জানিয়েছিল মহুল সমস্যাটা। চিঠি পৌঁছতে কত দিন লেগে যাবে, কেউ বলতে পারেনা। জাহিরুল গ্রামের ঠিকানা নিয়ে সেখানে গিয়ে কাকিমার সঙ্গে দেখা করেছে । খবরটা দিয়েছে । অনুকাকিমার ভাইপো পিসিকে পৌঁছে দিয়ে চলে গেছে। ফের এসে নিয়ে যাবে। কিন্তু ততদিনে বাবার জেঠিমা, মহুলের আমবাগানের রানির স্মৃতিতে আরও এক পোঁচ ধূসর রঙ লেগেছে। অনুকাকিমা গিয়ে দাঁড়াতে মোটে চিনতে পারল না। চোখের ওপরের হালকা পর্দা সরিয়ে অনুকাকিমাকে চেনার চেষ্টাটুকুও নেই সেখানে।
কাকিমা মহুলকে জিগ্যেস করেছে, “কত বচ্ছর হইল উনার? একশো দেড়শো?”
মহুল ভ্রু কোঁচকাতে গিয়ে থেমে গেল। যেন এই প্রশ্নটা ওরও। বাবার জেঠিমা মানে মহুলের বড় ঠাম্মা। মানে হল মহুল যদি পঁয়ত্রিশ, বাবার বয়স পঁয়ষট্টি, দাদু পঁচাশি, দাদুর পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবচে বড় দাদা হল পঁচানব্বই, তাঁর স্ত্রীর বয়স বিরানব্বই। সোজা হিসেব। এমন কী আর? তাহলে কেন সবাই মিলে বড় ঠাম্মাকে হেরিটেজ বানিয়ে দিচ্ছে?
অনুকাকিমা পানের খিলি মুখের ভেতর গুঁজে বলল, “এহানে কিরম কিরম গন্ধ পাইতেছি। আমার মন ভাল্লাগতেছে না। বড়দিদি এইবারে আর উঠবে না। আমারে তো চিনতেই পারল না। তো এহানে থাইকা কী করুম? আমি যাই গা। ওহানে বাচ্চুর বৌ একলা। বাচ্চু দুকান বন্ধ কইরা বাসায় ফিরতে রাত কইরা ফেলে। বৌ ভয় পায়। বাঁশঝাড় থিকা কারা কথা কয়। হিস ফিস কইরা পেরেত কথা কয়। বাচ্চুর বৌরে একলা রাখা ঠিক না। বুঝই তো সব! দুনিয়াটা ঠিক নাই। চাইরদিকে প্রেত ঘুরতেছে। কার বৌরে টাইনা নেয়, কার কচি মেয়েটারে নিয়া যায়। বাঁশঝাড়ে তাগো মড়া দেখছি। বাচ্চুর বৌ যোবতি। অরে ছাইড়া থাকা ঠিক না। পাহারা দিব কে?”
অনুকাকিমা পশ্চিমের ঘরে জেঠিমার খাটের পাশের সোফায় শুয়ে রাত কাটিয়ে দিল। ভোরে উঠে স্নান সেরে ব্যাগ গুছিয়ে নিল। জেঠিমার ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত জেঠিমার দিকে তাকিয়ে বিদায় নিল, “দিদি গো। যাই। বাড়িত যাই। তুমি ভালা থাইকো। যেহানেই থাহো, ভালা থাইকো। অনেকডা দিন তুমার লগে ছিলাম। আশিব্বাদ দিও আমাদের। যাই গো।”
অনুকাকিমা চলে গেলেও জেঠিমা বুঝতেও পারল না। আমরা সবাই নীরবে দেখলাম জেঠিমাকে একা ফেলে অনুকাকিমা চলে গেল। অথচ জেঠিমা কত আকুল গলায় অনুকাকিমাকে দেখতে চেয়েছিল! মানুষ বড্ড নিজের কথা ভাবে। আর কটাদিন থেকে গেলে কে বলতে পারে জেঠিমার হয়তো অনুকাকিমাকে মনে পড়ে যেত। তখন কিছু একটা কথা বলতে পারতো। কে বলতে পারে! কী কথা বুকে রেখেছে জেঠিমা,কেউ জানতে পারবে না হয়তো! কথাটা না বলতে পারলে শান্তিতে মরতেও পারবে না জেঠিমা।
মহুলদের পুরনো বাড়ির কার্নিশে অশ্বত্থগাছ চারা তুলে জায়গা দখলের ধান্দা করছে। বাড়ির পেছনদিকের অব্যবহৃত ঘরগুলো সারাক্ষণ তালা দেওয়া থাকে। মহুলের ছোটবেলায় এইরকমই ছিল। এখন বড় হয়ে চাকরিতে ঢুকেও একইরকম সব আছে। খুব ঝড় বৃষ্টির দিনে মহুলের মনে হয় ওই ঘর গুলোতে কারা হাঁটাচলা করে। ছেলেবেলার ছাপ মনে এখনও রয়েছে মনে করে ও। কিন্তু লেখা এই বাড়িতে বিয়ে হয়ে এসে অদ্ভুত কিছু কথা বলেছিল। যে কথা মহুলের কাছে কিন্তু খুব আশ্চর্যের বা মিথ্যে বলে মনে হয়নি। তাহলে মহুল কি নিজেও মনে মনে লেখার কথাগুলোকে বিশ্বাস করতো আগে থেকেই?
মহুলের স্থির চোখের দিকে তাকিয়ে লেখা বলল, “তুমি কখনও কি শুনতে পাওনি ? আমি আজ দুপুরে তোমাদের পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। তখন দেখলাম পেছন দিকের প্রায় সাত থেকে আটখানা ঘর তালাচাবি দেওয়া। অথচ জানো, আমার কেমন শিরশিরে ভয় করল। আমি থাকতে পারছিলাম না। মনে হল, এখানে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক নয়! তারপর চলেও আসছিলাম, হঠাৎ করে কী মনে হতে,কী মনে হল বল তো? মনে হল,আমাকে কেউ দেখছে! কেউ যদি তোমাকে লুকিয়েও দেখে তোমার ইন্দ্রিয় ঠিক জানিয়ে দেবে তোমাকে। ঠিক জানিয়ে দেবে। আমাদের বাড়িতে একটা বাথরুম আছে। এখন আর সেটা বাথরুম হিসেবে নেই। স্টোর বানিয়ে ফেলেছে বাবা। তো, যখন বাথরুম ছিল, স্নান করতে গিয়েছি, মনে হল, আমি এখানে একা নই! আরও কেউ আছে। বাথরুম বিরাট কিছু নয়, বা ফার্নিচারে ভর্তি, তাও তো নয়! কিন্তু…! অনুভূতিটা মাথায় এমনভাবে চেপে বসল, আমি চোখ তুলে দেওয়াল থেকে মেঝে অব্দি দেখেও কিছু খুঁজে না পেয়ে সিলিঙের দিকে তাকালাম। তাকিয়ে দেখতে দেখতে এক জায়গায় চোখ আটকে গেল। একটা আইহোল রয়েছে! একটা মানুষের চোখের আয়তনের মত জায়গা। আমি তাকাতেই জায়গাটা আলোকিত হয়ে গেল। মানে? কেউ ছিল চোখ লাগিয়ে। আমি তাকাচ্ছি দেখে সে সরে গেল!”
“হুম? তারপর? কে ছিল, খোঁজ করনি?”
“বুঝেছিলাম। ওপরতলায় একটি পরিবার থাকতো। ভাড়াটে। মাকে সব বলতে মা নীরবে ওদের ঘর ছাড়তে বলে দিল। আর বাথরুম বদলে দিল। এটা বলছি,আজ চলে আসতে গিয়েও আমার একই রকম অনুভূতি হল। যেন কেউ আমাকে দেখছে। ঠিক আমার পেছনে সে আছে। চমকে পেছন ফিরে তাকালাম। কেউ ছিল না! কিন্তু মহুল, আমি তার অস্তিত্ব অনুভব করেছি! এই বাড়িতে কিছু একটা আছে। বিশ্বাস কর।”
মহুল লেখাকে অবিশ্বাস করেনি। করার কারণও খুঁজে পায়নি। একদিন কেন, অনেকগুলো দিন ওরও লেখার মতই অনুভূতি হয়েছে। কাউকে জানাতে সাহস পায়নি। অকারণে বকাবকি চলবে। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, পেছনের ঘরগুলো বানিয়েছিল কারা? কেনই বা? সেই ছেলেবেলায় জেঠিমাকে দেখেছিল পেছনের ঘর থেকে বের হয়ে আসতে। অত্যন্ত চুপিসারে বেরিয়ে আসছিল জেঠিমা। সবাইকে লুকিয়ে কাজ করার মত হাবভাব। জেঠিমার মধ্যে এমন কিছু ছিল, মহুলের সাহস হয়নি সামনে এসে দাঁড়ায়।
পরে বন্ধ দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে মহুল চুপিচুপি ঘরের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছিল। ওর মনে হয়েছিল, একা একা কেউ ভেতরে পায়চারি করছে! কাউকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু কারও অস্তিত্ব ছিল! ভাল করে দেখতে গিয়ে রাঙাপিসিকে দেখেছিল মহুল ওই ঘরে। রাঙাপিসি বিধবা হয়ে বাপের বাড়িতে চলে এসেছিল। কী হয়েছিল জানে না মহুল। কিন্তু বাড়ির কাজের লোক সদানন্দকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল জেঠিমা। কয়েকদিন পরে রাঙাপিসিও কোথায় চলে গেল। ওই ঘরে আর দেখেনি মহুল কাউকে। কিন্তু আগমনী গান গাইতে আসে যে বৈষ্ণবী, সে জেঠিমাকে বলেছিল, “মিষ্টি খাওয়াও গো মা। কেষ্ট রাধাকে নিয়ে বেশ আছে। তোমার দেওয়া টাকায় মুদী দোকান দিয়েছে সেই তাঁতির হাটে। এখন সে সত্যি সদানন্দ।” কথার মানে বোঝেনি মহুল। অথচ বৈষ্ণবীর কথায় জেঠিমা এত খুশি কেন হয়েছিল, আজ একটু একটু বুঝতে পারে। আজ লেখা বলার পরে সেইদিনটা হুট করে ছুটে এল সামনে!
ছুটির দিন লেখাকে নিয়ে বাড়ির পেছনের কয়েক বিঘে জমিতে ওদের পারিবারিক আমবাগানে এল মহুল। গাছের তলে তলে ঝুলে আছে অসংখ্য আম। পাকা আমের গন্ধে বাগান ভরপুর হয়ে আছে। প্রায় তিনশো গাছ রয়েছে। বাগানের পাহারাদার রয়েছে তিন-চারজন লোক। বিভিন্ন স্বাদের আম রয়েছে এই বাগানে। এই আমবাগান করেছিল জেঠিমা। দশটি আম গাছ থেকে এখন এই বিরাট বাগান। জেঠিমার নাম হয়ে যায় আমবাগানের রানী। অনুকাকিমা এবারে এসে আমবাগান দেখে খুব খুশি হয়েছিল। রুমাদিদা বলেছিল, “থেকে যাও অনু।” কিন্তু অনুকাকিমার সংসার ওদেশে। বাংলাদেশ ছেড়ে এদেশে বাস করার ইচ্ছে অনুকাকিমার হয়নি। কিন্তু রুমাদিদা এতে কষ্ট পেয়েছিলেন। জেঠিমার শরীর দিন দিন ভেঙে পড়ছে।কাকিমা থাকলে ভাল হতো। আমবাগানের কথা সকালেই মনে হয়েছে। মহুল অনেকদিন আমবাগানে আসেনি। আজ কেন যে ইচ্ছে হল! খুব ইচ্ছে হল এখানে আসতে!
খানিকটা ঘোরাঘুরি করে ফিরে যাবে ভেবেছে, কিন্তু লেখা এত বড় বাগান দেখেনি আগে। ও উচ্ছল হয়ে “দাঁড়াও,ঘুরে দেখি,” বলে মহুলকে ছেড়ে এগিয়ে গেছে। হিমসাগরের দিকে চলে গিয়েছে লেখা। মহুল কাঞ্চন ল্যাংড়া আমগাছের দিকে ছিল। লক্ষ্মণভোগ আমগাছের পরে গোলাপখাস। আর তারপরে হিমসাগর। এক একটা জাতের আমের জন্য এরিয়া ভাগ করা আছে। লেখাকে ডাকতে হলে এগিয়ে যেতে হবে। নইলে লেখা ডাক শুনতে পাবে না। মহুল ডাকার আগেই লেখাকে ছুটে আসতে দেখল। গাছপালার ভেতর দিয়ে ছুটে আসছিল লেখা। শাড়ির আঁচল উড়ছে বাতাসে হই হই করে। খোলা লম্বা লম্বা চুলগুলো মুখ ঢেকে দিচ্ছে। উদ্ভ্রান্তের মত ছুটে আসছিল লেখা। ভয়ে বিস্ফারিত চোখ। মহুল কিছু বুঝে ওঠার আগেই লেখা জাপটে ধরেছে ওকে, “মহুল, মহুল, ওখানে গর্তের মধ্যে…একটা হাত উঠে এসেছে আমাকে ধরার জন্য! আমবাগানের ভেতরদিকে…বাড়িতে চল,এখান থেকে চল…! পালাও!”
ওরা বাড়িতে চলে এসেছিল। কাউকে কিছু জানায়নি মহুল। লেখাকে বারণ করেছে বাড়িতে কিছু জানাতে। আসলে মহুল নিজেই এই ব্যাপারে তদন্ত করতে চাইছিল। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, জানতে হবে। ওদের পরিবারে এমন কী রহস্য আছে, যার সন্ধান ও জানে না? বাবা,মা কি জানতেন? দুজনেই চলে গিয়েছেন স্বর্গে। সে বছর পাঁচেক আগের কথা। সিকিম বেড়াতে গিয়ে গাড়ি খাদে পড়ে গিয়েছিল। মহুল যায়নি সেবারে বাবা-মায়ের সঙ্গে। জেঠিমা যেতে দেয়নি। বলেছিল,মহুলকে না দেখে থাকতে পারবে না জেঠিমা। আসলে ঠাম্মি হলেও বড়দের দেখাদেখি ও জেঠিমাই বলে আসছে ছোট থেকে। মায়ের বড্ড ইচ্ছে ছিল মহুলকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার। কিন্তু জেঠিমা মাকে আড়ালে বলেছিল মহুলের ফাঁড়া আছে। ওকে না নিয়ে যাওয়াই ভাল। কিন্তু ফাঁড়াটা ছিল কার? বাবা,মা দুজনেই মরে গেল! মহুল আজও সুস্থ শরীরে বেঁচে আছে! জেঠিমা কি ভুল দেখেছিল?
লেখা রাতে শুনছিল এসব কথা।ও নিজের হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে ছিল, “জেঠিমা কি দেখতে পান? কোনও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, এটা কি উনি জানতে পারেন?”
“জেঠিমা কিভাবে পারেন, সেটা জানি না। কিন্তু পারেন । আমি সেটাই ভাবছি। অনুকাকিমাকে কি নিজের গুপ্ত রহস্যের চাবি দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন জেঠিমা? বড্ড দেরি করে এসে সেই চাবি আর পেল না অনুকাকিমা।”
“কী হয়েছিল আগে? জেঠিমা কী করেছিলেন ?”
“একদিন খুব ঝড়বৃষ্টি ছিল। ঝড়ে আম কুড়োতে আমাদের বাগানে ঢুকেছিল চারটে বাচ্চা ছেলে। যা হয় আর কি! সেই সময় বাজ পড়ে মরে যায় বাচ্চারা। জেঠিমা দুপুরে ঝড় উঠতেই খুব চেঁচামেচি করছিল। বলছিল- সবাই ঘরে ঢুকে পড়। কেউ বাগানে যাবে না। আমি না বলা পর্যন্ত কেউ যেন বাগানে না যায়।” জেঠিমার সেই মূর্তি দেখে আমিও চমকে উঠেছিলাম। পাগলের মত জানালা দরজা নিজে বন্ধ করছিল, সবাইকে বলছিল বাকি দরজা জানালা বন্ধ করে দিতে। জেঠু জেঠিমাকে সামাল দিতে পারছিল না। জেঠিমা বলছিল, “আর একটু সময়! আর একটু! সাবধানে থাক সবাই।” ঠিক ঘন্টা খানেক পরে জেঠিমা শান্ত হয়ে চোখ বুজে বসে রইল। হাতজোড় করে কার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাচ্ছিল, জানে না মহুল। তখন ঝড় থেমে গিয়েছে। জেঠিমা বাড়িতে সবাইকে ডেকেছিল, “আজ গোলাপখাস এরিয়ায় বাজ পড়েছে! চলে গেল ওরা। পুড়ে ঝুড়ে চলে গেল! এতটুকু টুকু বাচ্চাগুলো। আহা রে!”
আজও জানি না। কী করে জেঠিমা জেনেছিল? কে বলেছিল তাঁকে মৃত্যুর দূত আমবাগানে সেদিন থাকবে? সেইজন্যই কি কাউকে বাগানে যেতে দেয়নি সেদিন? জানি না। তবে এমন ঘটনা আছে আরও। কিন্তু আজ তুমি কী দেখলে ? তোমার চেহারা দেখে আমি নিজে গিয়ে আর তদন্ত করার সাহস পেলাম না। মনে হল, তোমাকে বাড়িতে নিয়ে আসাই ভাল হবে। খুব ভয় পেয়েছিলে!”
লেখা চুপ করে থাকে। এখনও ও স্বাভাবিক হয়নি। মহুল ভাবল, এই আমবাগান নিয়ে জেঠিমার প্রচন্ড ভালবাসা ছিল। জেঠিমা অসুস্থ হওয়ার পরে আর কেউ নেই পরিবারকে বিপদের হাত থেকে বাঁচায়। একবার জেঠিমাকে দেখে আসতে ইচ্ছে হল। এত রাতে জেঠিমা কি ঘুমিয়েছে? আকর্ষণ করছে জেঠিমা। কেন? মহুলের অস্বস্তি হচ্ছিল। ও লেখাকে শুতে বলে বেরিয়ে এল। জেঠিমার ঘরে অল্প আলো জ্বলে রাতে। চড়া আলোয় ঘুম হয় না জেঠিমার। মহুল সিঁড়ি দিয়ে উঠে জেঠিমার ঘরের দিকে যাচ্ছিল। দরজা ভেজিয়ে রাখা। বকুল নামের মেয়েটা রাতে থাকে। নাইট ডিউটি। সেন্টারের মেয়ে। এরা রাতের ডিউটি করতে এসে নিজের ঘুমনোর জায়গাটা দেখে নেয় আগে। পিনুর মা রাতে ওয়াশরুমে যেতে গিয়ে পড়ে গেলেন। এদিকে নাইটের আয়ার পেশেন্টকে দেখার কথা। সে ঘুমোচ্ছিল। শব্দ পেয়ে উঠেছে। এই তো হল অবস্থা! দরজায় অল্প চাপ দিতে দরজা খুলে গেল। আয়া মেয়েটি যথারীতি ঘুমোচ্ছে। জেঠিমা দরজার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। যেন মহুল আসবে তিনি জানতেন। শীর্ণ মুখে হাসার চেষ্টা করলেন, “আয়, আজ তোর বউ ভয় পেয়েছে। ওখানে সে আছে। একটি মেয়েকে রেপ করে খুন করেছিল সেই কারা, মেয়েটির বড্ড একা লাগে। ও নিজের বাড়িতে যেতে চেয়েছিল। বাড়িতে ওর মা ওর জন্য অপেক্ষা করছিল যে! মেয়েটি এখনও মায়ের কাছে যাবে বলে সঙ্গী খোঁজে। অনুকে বলেছিলাম, এই বাড়ি, আমবাগান, সব রক্ষা করতে। সে ভার নিল না। তুই নিবি ভাই? আয়। তোর হাতে আমি সব ভার দিয়ে যাই। এই বাড়ির গেটের সামনের দুটো থাম মানে স্তম্ভ ভেঙে পড়ছে। ওগুলো সারাই করতে হবে। আমার শাশুড়ি তখন নতুন বৌ হয়ে এসেছেন। সেই সময় সারাই হয়েছিল। রাজেন্দ্র নামের এক মিস্ত্রি সারাই করেছিল। আমি যখন এই বাড়িতে এলাম, তখন রাজেন্দ্রর ছেলে একটা স্তম্ভ নতুন করে বানিয়ে দিল। এখন আমার আর সময় নেই। কিন্তু ওগুলো সারাই করতে হবে মনে রাখিস।” বলেই জেঠিমা শীর্ণ গলায় গেয়ে উঠলেন, “ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়োতে সুখ / পাকা আমের মধুর রসে রঙীন করি মুখ/ আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা আম কুড়োতে যাই…!” জেঠিমার রুগ্ন স্বর কেঁপে কেঁপে ঘরময় ঘুরে বেড়ায়।
মহুল নিজে থেকে জেঠিমার কাছে গিয়ে বসেছে। জেঠিমা ওর হাত নিজের হাতে চেপে ধরলেন। মহুলের শরীরে তীব্র কম্পন জেগে উঠল। কিছু একটা প্রবিষ্ট হল যেন। একটা তরঙ্গ ওর রক্ত কণিকার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। শরীর তোলপাড় হচ্ছিল।
কখন জেঠিমার থেকে বিদায় নিয়ে ঘরে চলে এসেছে, মনেই নেই। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন লেখাকে জাগাল না। নিজেও ঘুমের অতলে ঢুকে পড়েছে কখন! আমবাগানের আনাচ কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছিল মহুল। সব দেখেশুনে রাখতে হবে। আমবাগানের সবটুকু ঘুরে ফেরার সময় দেখল কাঞ্চন ল্যাংড়া আমের এরিয়ার দিক থেকে এক গা গয়না পরে জেঠিমা চলে যাচ্ছে আমবাগান থেকে। সঙ্গে একটি অল্প বয়সী মেয়ে। হাসিখুশি মেয়েটিকে নিয়ে যাচ্ছে জেঠিমা। দুজনে হেসে হেসে যাচ্ছে। কী ব্যাপার হল এটা? জেঠিমা আমবাগানে কেন?
ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। মহুল প্রথমে বুঝতে পারেনি। পরে তাড়াহুড়ো করে উঠে বসল। এমন স্বপ্ন কেন দেখল ও? কাল রাতে জেঠিমার সঙ্গে ওর যা কথা হয়েছে, সেটা কাউকে বলা যাবে না। একবার জেঠিমার সঙ্গে দেখা করা দরকার। এই স্বপ্নের অর্থ জানতে হবে।
মহুল গিয়ে দেখল জেঠিমা কখন ঘুমের মধ্যেই চলে গিয়েছেন! খবর শুনে বাড়িশুদ্ধ সকলে জেঠিমার ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে।
“কখন গেলেন উনি?”
কেউ জিজ্ঞাসা করছিল কাউকে। মহুল জানে জেঠিমা কখন গেলেন। যাওয়ার আগে মহুলকে জানিয়ে গিয়েছেন। আর সঙ্গে করে সেই মেয়েকে নিয়ে গেলেন, যে সঙ্গী খুঁজে ফিরছিল মরে যাওয়ার পরেও। রহস্যের চাবিটা জেঠিমা মহুলকে দিয়ে গিয়েছেন।
মহুল রক্তের মধ্যের সেই তরঙ্গ অনুভব করে। এখন অনেক কাজ। ভেঙে পড়া স্তম্ভ সারাই করতে হবে। রাজেন্দ্রর নাতি আছে নিশ্চয়?
মহুল জেঠিমার মরদেহর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটা কাজ বাকি আছে। একবার তাঁতির হাটে যেতে হবে। সদানন্দের কাছে।
———————————————————-