short-story-successful-man

সাকসেসফুল ম্যান

আইভি চট্টোপাধ্যায়


কঙ্কনা আর জয়তী। সান্যালবাবুর দুই মেয়ে। দুই বোন পিঠোপিঠি বড় হচ্ছে, অথচ বাড়িতে এতটুকু হুল্লোড় নেই। সচরাচর এমনটি দেখা যায় না।
পাড়ার লোকজন বলে, ‘ওদের বাড়িটাই অমন, প্রাণ নেই।’
বন্ধুরা, যদিও স্বজনবন্ধু বলতে তেমন কেউ নেই সান্যালদের, বলে, ‘আহা, মেয়েদুটোর জন্যে খারাপ লাগে । বেড়ে ওঠার পুরো সময়টা এমন দুশ্চিন্তা.. হাসিখুশি থাকবে কি করে !’
বাবা শান্ত, স্থির। মা ততোধিক শান্ত, প্রায় নি:শব্দ, কখনো কখনো স্বামী-কন্যা-সংসার সম্পর্কেও নির্লিপ্ত মনে হয়। জয়তী যে এমন ভালো চাকরিটা পেল, সান্যাল স্বভাবের বাইরে গিয়ে পাড়ার মিষ্টির দোকান থেকে গোটা এক হাঁড়ি পান্তুয়া নিয়ে এলেন। বাবাকে এত খুশি দেখে দুই বোনের বুকে মেঘ। মা কিন্তু নির্লিপ্ত। মেয়েদের, স্বামীকে পান্তুয়া দিলেন প্লেটে সাজিয়ে। বড় জামাইয়ের জন্যে প্লাস্টিকের টিফিনবাক্সে পান্তুয়া গুছিয়ে দিলেন। ব্যস!
হ্যাঁ, জামাই। বিয়েটা অবশ্য এখনো হয়নি। কঙ্কনার ভাবী শ্বশুরবাড়ি অর্থনৈতিক পঙ্গু পরিবারের মেয়ে আনার পক্ষপাতী নন।
সজল বলেছিল,’চলো, রেজিস্ট্রি করে নিই। এবাড়ির বাবা-মা তো রাজি আছেন।’
কঙ্কনা রাজি হয়নি। নীলুপিসিমা বুঝিয়েছিলেন, ‘তোর বিয়েটা হয়ে গেলে ভাইও তো নিশ্চিন্ত হবে।’ শেষে রাগ করে বলেছিলেন, ‘বাপের মতই গোঁ হয়েছে। নিজের ভালোটা পাগলেও বোঝে।’
মন্টেসারি ট্রেনিং নিয়ে পাড়ার স্কুলে একটা চাকরি পেয়েছে কঙ্কনা। বিয়ে না হলেও সজল নিজে থেকেই সহায় থেকেছে। রোজই আসে একবার। বাড়ির ছেলের মতই সব গুছিয়ে দেওয়ার চেষ্টায়। সজল এলে চন্দ্রার চোখে কেমন এক দীপ্তি। আশার এক চিলতে আলো, ভরসার রোদ্দুর।


এমন কিন্তু চিরদিন ছিল না। সুকান্ত সান্যাল নামী কোম্পানীর চাকরিটা পেয়েছিলেন, মা কালীবাড়িতে পুজো দিয়ে এলেন। পলিটেকনিকে ডিপ্লোমা, একটা ডিগ্রীও ছিল না। এমন চাকরি সত্যিই আশা করেনি কেউ। চাকরি তো শুধু নয়, তিনটে ইনক্রিমেন্ট নিয়ে রাজকীয় প্রবেশ। ইন্টারভিউ নিতে এসেছিলেন মিস্টার নায়েক, মুম্বই থুড়ি তখনকার বোম্বাই হেড-অফিস থেকে। খুব খুশি হয়েছিলেন নবীন ছেলেটির বুদ্ধিমত্তায়। ‘ক্রিয়েটিভ জিনিয়াস’, বলেছিলেন।
চাকরি, তারপর বিয়ে। চন্দ্রা এসে ঘর আলো করলেন। ফুটফুটে দুই মেয়ে পরপর। বাবা ছেলের সাজানো সংসার দেখে নিশ্চিন্তে পাড়ি দিয়েছেন। মা তখনো বেঁচে। হাতে ধরে ঘরকন্নার খুঁটিনাটি শিখিয়ে দিতেন বৌমাকে।
এখনকার চন্দ্রাকে দেখে সেই চঞ্চলা অথচ কুশলী গৃহিণীকে মেলানো যায় না। সান্যাল নিজেই চিনতে পারেন না। ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে একটা মানুষ, অথচ প্রাণ নেই। দায়ী করেন নিজেকেই।
সান্যাল জানেন না, তাঁর ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে চন্দ্রার কত বিনিদ্র রাত কেটেছে। সান্যাল বোঝেন না, নির্লিপ্তির সাধনায় কতখানি আবেগ চেপে রাখতে হয় চন্দ্রাকে, তাঁরই মুখ চেয়ে।


****
অথচ এমনটা হবার কথা ছিলই না। ড্রাফটসম্যান হয়ে ঢুকেছিলেন, কোম্পানিতে সেটা নেহাত ওয়ার্কার-গ্রেড নয়। তিনটে ইনক্রিমেণ্ট, নতুন সহকর্মীরা বেশ হিংসে করে ফেলেছিল। প্রসাদ, দেবু বেশ বাঁকা বাঁকা টিপ্পনী কেটেছিল।
রজত অবশ্য তেমন হিংসে করেনি, বরং পিঠ চাপড়ে দিয়েছিল, ‘সাবাশ গুরু। হিম্মত আছে তোমার। আমার মাথাতেই আসেনি। আমাকেও তো পে-স্ট্রাকচার বলেছিল, এই এই দেব, রাজি আছ কিনা। বারগেন করার কথা মাথায় আসেই নি।’
একই সঙ্গে একই ডিপার্টমেণ্টে চাকরি দুজনের, বিয়েও প্রায় পিঠোপিঠি, চন্দ্রার সঙ্গে নীলিমার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল।
মাইনে পত্তর ভালো, ফ্রী কোয়ার্টার, ফ্রী যাবতীয় মেডিকেল খরচা। পাঁচ বছরের মধ্যে সুপারভাইজার পদে প্রোমোশন। আরো ভালো বড় কোয়ার্টার, দু’বছরে একবার বেড়াতে যাওয়া। ততদিনে দুই মেয়ে নিয়ে ভরা সংসার। শহরের একটি নাটকের দলে বেশ পরিচিতি। মসৃণ যাপন।


কোম্পানিতে একটা ইউনিয়ন ছিলই। মালিকের ধামাধরা। যেমন হয় আর কি! শাসকদলের সঙ্গে, প্রশাসনের সঙ্গে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা। মালিকপক্ষের এতেই বেশ স্বস্তিবোধ হয়। শ্রমিক অসন্তোষ চেপে রাখতে সুবিধে।
চার পাঁচজন প্রতিবাদী শ্রমিক যুবক, সমাজে এমন প্রতিবাদী চেহারা থাকেই, একটা দল গড়ে উঠল। আর একটা ইউনিয়ন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা। পুরোনো ইউনিয়নের তো বটেই, টনক নড়েছে ওপরওয়ালা ম্যানেজমেণ্টেরও। প্রথমে অবশ্য তারা কিছু বলেনি, বিশ্বস্ত প্রভুভক্ত ইউনিয়নের লোকজন তো আছেই। কোম্পানির গেটের বাইরে, রাস্তাঘাটে মারধর। কোয়ার্টার এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভয় দেখানো। এসব যেমন হয় আর কি! সম্ভাবনা যেটি —— বিনাশ হতে পারত, এই সব প্ররোচনামূলক কাজকর্মে একটা শক্তপোক্ত চেহারা নিল। একটি নতুন ইউনিয়ন তৈরী হয়েই গেল প্রায়। নিয়ম মাফিক আইন মোতাবেক নাম ঘোষণা হবার আগেই সমর্থনের ঢল নেমেছে। শোষিত মানুষজন নতুন আশায় নতুন স্বপ্নে নতুন প্রতিবাদী নেতাদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে নিজে থেকেই।


সান্যাল জড়িয়ে পড়লেন অন্যভাবে। নতুন একটা নাটক। ইবসেনের নাটক, একটু ভারতীয় চেহারা দিয়ে নিজেই চিত্রনাট্য লিখে ফেলেছিলেন। তাতে শাসক-বুর্জোয়া-প্রলেতারিয়েত জাতীয় কিছু শব্দ। অন্য একটা পরিচয় তৈরী হতে পারে, সে ভাবনাটাই মাথায় আসেনি।
কিন্তু এই পরিচয় সাদরে মেনে নিল সদ্যজাত ইউনিয়ন। কর্তৃপক্ষের বক্রদৃষ্টিপাতেও বিলম্ব হল না। পুরোনো ইউনিয়নের নেতারা কেউ বঙ্কিম হাস্যে বললেন, ‘এই যদি মনে ছিল, আমাদের বললেই হত।’ কেউ বললেন, ‘দেখে নেব এবার।’
তখন পর্যন্ত বেশ হাসি মজার ব্যাপারই-
মজা করে হাসিমুখে মিঠেকড়া জবাব, মালিকতোষণনীতি নিয়ে মৃদু কটাক্ষ, সাম্যবাদ সমাজবাদ নিয়ে ঘরোয়া আড্ডায় আলোচনা, যেমন হয়।
রজত, প্রসাদ, দেবু- সহকর্মী ক’জন প্রকাশ্যেই নতুন ইউনিয়নের কাজে যুক্ত। রজত বেশ জোর করত, ‘ভয় পাচ্ছ নাকি সান্যালদা?’ প্রসাদও বলত, ‘আমরা তো অন্যায় কিছু করছি না। বাঁচার লড়াইটুকু তো করতেই হয়।’
তবু তেমন জড়াতে ইচ্ছে হয় নি। নতুন নাটক লেখা নিয়ে ব্যস্ত তখন। মেয়েরা বড় হচ্ছে। ভাইদের সংসারেও দেখাশোনাটা করতে হত। কখনো সখনো সঙ্গে থাকতেন। চাঁদা তোলা, মাঝে মাঝে একসঙ্গে শ্রমিক বস্তীতে যাওয়া, একসঙ্গে দোল-দুর্গোৎসবে আনন্দ করা। সমাজে থাকতে গেলে এটুকু সঙ্গ না দিলে হয়!

মালিকপক্ষ চুপ করে বসে ছিলেন না। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার নীতি কাজে লাগানো পুরোনো রীতি। দুই ইউনিয়নের কাজিয়ায় সরাসরি না হলেও একটিকে সমর্থন দেওয়া। বিপদের গন্ধ পেয়ে অনেকেই গুটিয়ে গেল। বাকিরা পারলেন না। অশিক্ষিত অবোধ সরল মানুষগুলো তাঁদের দরদী বন্ধু বলে আঁকড়ে ধরেছে।
রজত বললেন,’হয় এসপার, নয় ওসপার। নিজেদের আখের গোছানোর জন্যে তো কিছু করছি না।’ কথাটা মনে ধরেছিল চার বন্ধুরই।



****
ছোট্ট কঙ্কনাকে কোলে বসিয়ে গল্প করেছিলেন সান্যাল, ‘কি করবে বল তো আমার? জানিস মা, ওই বুড়ো সুরিনকে বসিয়ে দিয়ে নিজের লোক ঢোকাচ্ছিল রঘুবর দত্ত। সময়মত প্রতিবাদ না হলে বুড়ো ধনে প্রাণে মরত।’
চন্দ্রাও এসে বসতেন গল্পের টানে, হ্যাঁগো, হীরা বলছিল প্রসাদ নাকি বস্তীর মদের ঠেকটা ভেঙে দিয়েছে ! ওরা খুব খুশি, আর মাতালের হল্লা নেই, মাতাল হয়ে বউয়ের ওপর অত্যাচার নেই।’
‘হ্যাঁ, প্রসাদ তো ওদের বস্তীতে ছবি আঁকা শেখাচ্ছে সন্ধেবেলা। ভালো কাজ করছে।’
‘তুমি বস্তীর ছেলেমেয়েদের নিয়ে নাটক করছ, না বাবা?’ জয়তী উত্‍সাহে লাফিয়ে উঠেছে কোলে, ‘কোন নাটকটা?’
‘অমন বস্তীর ছেলেমেয়ে করে বলতে নেই মা। ওদের একটা করে নাম আছে, ওরা সবাই স্কুলে পড়ে। হীরার মেয়ে মুন্নী-মঞ্জু, টিফিন সাপ্লাইয়ের ভজনের ছেলেমেয়ে বাপী-অক্ষয়-সোনা। ওদের তো চেনো তুমি, না?’
কঙ্কনা-জয়তীর চোখে বাবা একজন হিরো। প্রসাদকাকু, রজতকাকু, দেবুকাকু। সব অন্যরকম মানুষ। ভালো মানুষ। ভালো মানুষেরাই তো অন্য মানুষের জন্যে এত ভাবে, এত কাজ করে।


রজতের স্ত্রী নীলিমা অবশ্য বেশ রাগ করেন, ইউনিয়ন নিয়ে রজতের এমন মাতামাতি পছন্দ করেন না একেবারেই, ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। তাও যদি দু’পয়সা পকেটে আসত! ওই ইউনিয়ন করেই পান্ডেবাবুদের কেমন রমরমা। ছেলেকে জামাইকে কোম্পানিতে বড় বড় মাইনের চাকরি করে দিয়েছে। মিত্তিরবাবু কেমন প্লেনে চেপে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর এদের দ্যাখো! বস্তী নিয়ে পড়ে আছে।’
প্রসাদকে নিয়ে অবশ্য স্ত্রী মিনুর বেশ গর্ব, ‘বরাবরই ওর এমন কাজ পছন্দ। বিয়ের পর এ নিয়ে কত গল্প করত, জানো? পৃথিবীর সম্পদে সবার সমান অধিকার। মানুষ তো বটেই, পশুপাখি গাছপালা সবার সমান অধিকার। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ সুবিধে ভোগ করবে, এমন হওয়াই উচিত নয়।’
দেবু বিয়েই করেন নি, তাই এসব নিয়ে তেমন বলার কেউ নেই।
তবে সান্যাল চন্দ্রার কাছে গল্প করতেন,’দেবুর বড্ড মেজাজ। ওই যে হেমব্রম বলে নতুন সুপারভাইজার ছেলেটা এসেছে না? কথা কাটাকাটি হতেই কলার চেপে ধরেছে। ভাগ্যিস প্রসাদ ছিল! নইলে আজ একটা ইস্যু তৈরী হতই।’


ছোট্ট শিল্পশহরটিতে এমন চাপা উত্তেজনা সর্বত্রই। কখন গণ্ডগোল বেধে যায়! সান্যালকে নিয়ে অবশ্য তেমন ভাবনা নেই। বড্ড শান্ত, মরমী ভদ্রলোক, যে কোনো মানুষের বিপদে আছেন। বস্তীতে যে কোনো কাজেকর্মে, সে জন্মাষ্টমীর আনন্দই হোক, কি টুসুপুজোর মেলা। মেয়ের বিয়ের আনন্দে, আবার আপদে বিপদে, হাসপাতালে, শ্মশানে। বড়সাহেবের খাস পিওন রামধারী টুডু জনে জনে বলে, ‘সান্যালবাবু সাক্ষাত্‍ দেওতা আছে।’
টেবিলে টেবিলে টিফিনবাক্স গুছিয়ে দিয়ে মাথা নেড়ে সায় দেয় বুড়ো বনমালী, ‘সান্যালবাবুর মাথাটা বড় ঠান্ডা আছে।’
ঝাড়ু হাতে ফুলমনি আলোচনায় যোগ দেয়, ‘এখন সময়মত হফতা পেয়ে বাঁচছি। সব সান্যালবাবুর দয়া।’

দুপুরে বাড়িতে খেতে আসার সময় আজকাল দু’চারজন কুলি কামিন সঙ্গে সঙ্গে থাকে। ‘হুই ইন্নিয়ানের বাবুরা তুদের মারবে বলেচে, মোরা তুদের সঙ্গ সঙ্গ থাকব।’
রজত, প্রসাদ, দেবু, নতুন ইউনিয়নের সুকোমল, অভিষেক, অমল সবার সঙ্গেই থাকবে ওরা।
‘ভাগ্যিস তুরা আছিস, তাই তো বুড়া হপনের অপারেশন করতে টাকা দিল ম্যানজার সায়েব। মানিকের হাতটা মেশিনে কাটা গেল, দেবুবাবু অত চিল্লামিল্লি করল বলেই তো উয়ার ব্যাটা কাম পেল, নইলে তো উদের গোটা সংসারটো না খায়ে মরত।’


বড্ড কৃতজ্ঞতা। আর কিছু না পারুক, প্রাণ দিয়ে আগলে রাখতে তো পারবে।
সান্যাল বুঝিয়ে বলেন, ‘আরে না না। আমাদের মারবে কেন? আমাদের লড়াই তো ওদের সঙ্গে নয়। আমাদের লড়াই অন্যায়ের সঙ্গে। আমাদের লড়াই অধিকার রক্ষার জন্যে। প্রতিবাদ করার জন্যে।’
এ সব ভারি ভারি শব্দ বোঝে না ওরা। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি। যদিও তিন শিফটে ডিউটি, বেশিরভাগ দিনই একনাগাড়ে দু’শিফট কাজ করে ওরা। লোক কম, কাজ বেশি। বস্তীতে ফিরে হাঁড়িয়ার নেশা। অবসর বিনোদন বলতে এই। তবু কি করে যেন ভালো-মন্দ ন্যায়-অন্যায় চিনেও নিচ্ছে। ‘তুই বাবুটো ভালো আছিস’ বলে জড়িয়েই থাকে সর্বদা।

কঙ্কনা ক্লাস থ্রী, জয়তী সবে ক্লাস ওয়ান। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে জয়তীই। কখনো বুধিয়া, কখনো লছ্মী ছোট্ট জয়তীকে কোলে নিয়ে কারখানার গেটের কাছে। মাথায় হেলমেট বাবা, দূর থেকে দেখেই চিনে ফেলে মেয়ে।
সেদিনও জয়তীর হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে মুর্মু। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে বাবাকে। সুধাংশুকাকু আর নিতাইকাকুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে আসছে। হঠাত্‍ কি হল কে জানে, একটা হট্টগোল। সবাই দৌড়ে যাচ্ছে বাবার কাছে। এতদূর থেকে ভিড়ের মধ্যে বাবাকে আর দেখতেই পাচ্ছে না জয়তী। মুর্মুকাকা জয়তীকে কোলে নিয়ে দৌড়ে মায়ের কাছে বাড়ি পৌঁছে দিল। উত্তেজিত হয়ে কি যে বলল মাকে। মায়ের মুখটা কেমন সাদা ফ্যাকাশে।
অনেক রাতে বাড়ি ফিরল বাবা। রোজকার মতো কোলে নিল না জয়তীকে।



****
এত বছর পরেও সে রাতটা স্পষ্ট মনে পড়ল। সেই রাতটা ফিরে এসেছে। আজ বাবার আর জয়তীর অভিজ্ঞতা মিলেমিশে একাকার। একটাও তারা দেখা যাচ্ছে না। আকাশে মেঘ জমেছে বুঝি! নাকি কষ্টে মুখ লুকিয়েছে এক আকাশ তারা! বড্ড গুমোট। একটু বাতাস নেই।
অনেকদিন পরে নিশ্চিন্ত হালকা একটা আনন্দবাতাস বইছিল বাবা-মায়ের মন জুড়ে। খবরটা পেয়ে এমনই গুমোট হয়ে উঠবে বাড়ি, আবার!
কতদিন পর একটু স্বস্তি এসেছিল। দিদিভাইয়ের বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে। এমন ভালো চাকরি পেয়েছে জয়তী ।নতুন জায়গায় চমৎকার তিন কামরার বাড়ি এখন। অনেকদিন আগে কিনে রাখা আড়াইকাঠা জমিটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে বাবা। সজলদা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে জমির ভিত কাটিয়েছে।
বাড়ির কাজ শুরু হবে শিগগির। স্কুলের চাকরির সঙ্গে সঙ্গেই একটা শাড়ির ব্যবসা শুরু করতে পেরেছে কঙ্কনা। একটা থোক টাকা না পেলে এসব হয়! সব তো জয়তীর জন্যেই।
না না, জয়তীর জন্যে নয়। এই চাকরির জন্যে।


সেদিন অবশ্য এমন একলা ভার বইতে হয়নি। বারান্দায় সেই বিকেল থেকে শ’খানেক কুলিমজুর। বাবা ফিরল অনেক রাতে। ‘তোমরা বাড়ি যাও। কিছু হয় নি আমার। কিছু হবেও না।’
‘দিদিভাই, কি হয়েছে রে?’ জিজ্ঞেস করেছিল জয়তী।
‘বাবাকে মেরেছে ইন্নিয়ন, এমনি এমনি মেরেছে’, দু’বছরের বড় দিদি বিজ্ঞের মতো জবাব দিয়েছিল। ইন্নিয়ন, মানে ইউনিয়ন। মানে পান্ডে আঙ্কল, নাইডু আঙ্কল। প্রসাদকাকু রজতকাকু, দেবুকাকু ওদের নিয়ে খুব রাগ করে। কিন্তু পান্ডে আঙ্কল কতবার স্কুটারে নিয়ে ঘুরিয়েছে ওদের। ইউনিয়ন নিয়ে এত যে লড়াই, নাইডু আন্টি ক’দিন আগেই ইডলি সম্বর দিয়ে গেল। ওরা বাবাকে মারবে!’
জয়তী হেসেই ফেলেছিল। বাবা তো সুপারম্যান। বাবা তো সবার হিরো।
কঙ্কনা রাগ রাগ গলায় বলল, ‘দাঁড়া, আমি একটু বড় হই। ইন্নিয়নকে খুব মারব।’


বড় হবার আগেই অবশ্য সব বুঝে ফেলতে হয়েছিল। সময় আর পরিস্থিতি সব বুঝিয়ে দেয়। অন্য ইউনিয়ন নয়, অপ্রত্যাশিত ধাক্কা এসেছিল অন্যদিক থেকে।
‘এমডি সাহেবকে ভয় দেখানো!’ কোম্পানীর গেটের মুখে সান্যালকে ঘিরে ধরেছিল চার পাঁচজন যুবক। শক্ত চোয়াল, হাতে লোহার শিকল। আগে থেকে কেউ আঁচ করতে পারে নি ব্যাপারটা। সবাইকে ছেড়ে সান্যালকেই কেন আক্রান্ত হতে হল, তাও কেউ বোঝেনি।
তবে কোম্পানীর ভেতরে বাইরে ‘এম ডি সাহেবের গাড়িতে পাথর ছুঁড়ে গাড়ির কাচ ভেঙে ফেলেছে কিছু দুষ্কৃতী, ভাগ্যক্রমে এম ডি অক্ষত আছেন’, এই মর্মে প্রচার হল বেশ। দুষ্কৃতী তালিকায় চার পুরোনো সহকর্মী ও বন্ধু।
রজত সিংহ, দেবাশীষ মিত্র, বিনায়ক প্রসাদ এবং সুকান্ত সান্যাল।
‘শুধু এম ডি সাহেবের নয়, এরা কোম্পানীর ক্ষতি করতে চায়। কোম্পানীর আবহাওয়া দূষিত করতে চায়। আমরা পুলিশে দিচ্ছি না, এ কোম্পানী থানা পুলিশ করে কোনো কর্মীকে বিপদে ফেলতে চায় না। আমাদের মূল্যবোধ অন্যরকম। কিন্তু এমন ক্ষতিকর ভাবনা যারা রাখে, এমন দুষ্কর্ম যারা করতে পারে, তাদের এ কোম্পানীতে জায়গা নেই। কোম্পানীর স্বার্থে, এবং কোম্পানীর প্রতিটি কর্মী ও তাদের পরিবারের স্বার্থে এই চারজন দুষ্কৃতীকে বরখাস্ত করা হল। টারমিনেট করা হল।’
চারজনকে যেন অফিসের পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে দেখা না যায়। কোনো শো-কজ নয়, কোনো সাসপেনশন নয়, সোজাসুজি ডিসমিস। বিনা বিচারেই দোষী সাব্যস্ত।



****
চার বন্ধু মিলে মামলা করলেন, আর তো উপায় নেই। এমনভাবে কি টারমিনেশন লেটার ধরিয়ে দেওয়া যায়?দেশে আইন কানুন বলে কিছু নেই?
নতুন ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট সুকোমল, ক’দিন খুব হল্লা করল, ‘আমরা আছি। মামলা হোক।’ বাকিরা একটু গুটিয়েই রইল। ভয় পেয়েছে। তিক্ত হাসেন চার বন্ধু। একে অন্যের পাশে দাঁড়াতে পারে না, এরা দাঁড়াবে মানুষের কাজে!
রঘুবর দত্ত, অখিল পান্ডে, অশোক নাইডু.. পুরোনো ইউনিয়নের নেতারাও এ ঘটনায় থমকে দাঁড়িয়ে। এতটা কেউ ভাবে নি। রঘুবর দত্ত নিজে এসেছিলেন, ‘আমরা লড়ব তোমাদের হয়ে। শুধু ওয়ার্কারদের বোঝাতে হবে যে তোমরা আমাদের লোক।’
ন্যায়ের আশায় উন্মুখ চারজনই স্বস্তি পেয়েছিলেন, শেষের কথাটায় মন বিস্বাদ। শুধুই রাজনীতি! শুধুই আপোষ! না, কোনো অন্যায়ের সঙ্গে সমঝোতা নয়। সততার লড়াই হোক। শ্রমিকরা সবাই, কুলি মজুর থেকে অফিসবাবুরা সবাই সঙ্গে আছে। এতখানি সমর্থন কম কথা নয়।
বেশ, আইনি লড়াই চলুক। কোনো অন্যায় করেন নি যখন, মিথ্যে মিথ্যে একটা অপবাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়াই চলুক। ন্যায়ের জন্যে লড়াই, সততার লড়াই।



****
সেই লড়াই চলেছে দীর্ঘ একুশ বছর। লোয়ার কোর্ট থেকে হাইকোর্ট। সেখানেও হেরে গিয়ে কোম্পানী মামলা করেছে সুপ্রীম কোর্টে।
দীর্ঘ একুশ বছর দীর্ঘতম হয়েছে সান্যাল পরিবারে। অকালে বুড়িয়ে যাওয়া বাবা, আইন আদালতের জটে মাঝে মাঝেই হারিয়ে যাওয়া বাবা। দিনে দিনে নিষ্প্রভ মাযের চাঁদের দীপ্তি। কঙ্কনা, জয়তী কালের নিয়মে বড় হয়েছে। মনের দিকে বেড়ে উঠেছে বয়সের চেয়েও বেশি। একুশ বছরে সান্যাল অনেক রকম কাজ করেছেন। চাকরি পাননি ওঁরা চারজনই, আগের কোম্পানীর সঙ্গে মামলা চলছে এমন লোককে বহাল করতে রাজি হয় নি কেউ।
প্রসাদ চলে গেছেন গ্রামের বাড়িতে। চাষ আবাদে গাঁয়ের ছোট্ট গণ্ডীতে জীবন বেঁধে নিয়েছেন। হাইকোর্ট পর্যন্ত মামলায় আর জোর পান নি। নিয়মিত কেসের খরচ অবশ্য পাঠিয়ে দিয়েছেন।
রজত আর দেবু একসঙ্গে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ছোট্ট ব্যবসা, স্কুলের বিজ্ঞান ল্যাবোরেটরিতে ইন্সট্রুমেন্ট যোগান দেওয়া। অল্প মূলধন, সান্যালকেও টেনে নিয়েছিলেন দুজনে।


সততা আর মনোযোগ, ব্যবসা একটু একটু করে দাঁড়িয়ে পড়ছিল। আশেপাশের অনেকগুলো স্কুলের সঙ্গে ব্যবস্থা। পায়ের নীচে একটু জমি। সায়েন্টিফিক ইন্সট্রুমেন্টের সঙ্গে সঙ্গে স্টেশনারি সাপ্লাই। আস্তে আস্তে আয় বাড়ছিল।
সেই ব্যবসা করতে করতেই হেলমেট ব্যবসা শুরু করলেন রজত। একটু ধাক্কা লেগেছিল, কারণ খবরটা রজত নিজে দেননি। ব্যবসার হিসেবপত্র রজতই রাখতেন, নতুন ব্যবসার মূলধন যে এই ব্যবসা থেকেই নেওয়া দেবু সেটা ধরে ফেললেন। বেশ একটা অশান্তি। মনোমালিন্য। অবশেষে সান্যাল আর দেবুকেও ব্যবসায় জড়িয়ে নিলেন রজত।
চন্দ্রা বারণ করেছিলেন। সম্পর্কে বিশ্বাস ছিল না আর। দেবু বুঝিয়েছিল, ‘মেয়েদুটো বড় হচ্ছে বৌদি। আমার বোন তিনটেরও বিয়ের বয়স হয়েছে। এখন বাছাবাছি করার সময় নয়। রজত ভুল করেছে, একবার ক্ষমা করে দেওয়াই যায়। আমাদেরও সব টাকা এখানেই ঢুকে আছে, না ?’


হেলমেটের ব্যবসা থেকে হঠাত্‍ কন্সট্রাকশন ব্যবসায় ঢুকে পড়লেন রজত। ঠিক ব্যবসা নয়। রাজমিস্ত্রীর যোগান দেওয়া। স্টোনচিপস সাপ্লাই ।
‘দুটো হাত আছে, মাথায় বুদ্ধি আছে। সেটা কাজে লাগাব না? বলুন তো বৌদি?’ চন্দ্রাকে বলেছেন।
‘যেটুকু পুঁজি আছে, আমার সঙ্গে ব্যবসায় লাগাও’, সান্যালকেও বুঝিয়েছেন।
এই জমিটা কেনাও সেই সময়। তিন বন্ধু মিলে। অনেকদিন পরে জানা গেছিল, দেবু আর সান্যালের সঙ্গে সঙ্গে আড়াই কাঠা করে জমি কিনলেও রজত বেশ অনেকটা জমি কিনেছিলেন। প্রায় দু’ বিঘে। সে জমি প্লট করে বিক্রী হয়েছিল আরো কিছুকাল পরে। ততদিনে রজতের সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ।


রাতারাতি ব্যবসার একচ্ছত্র মালিক হয়ে উঠেছেন রজত। দেবু আঘাতটা সহ্য করতেই পারে নি। অমন প্রাণবন্ত ছেলেটা। স্ট্রোক। সব শেষ।
সান্যাল আরো শান্ত, প্রায় নি:শব্দ। চন্দ্রা নির্লিপ্ত উদাসীন। ব্লাউজ সেলাই করে, শাড়িতে ফলস লাগিয়ে কিছু বাড়তি রোজগার।
মেয়েরাও মায়েরই মত। দুই মেয়ে বাবার কাছে একটা জিনিসও চায় না। বরং হাইস্কুলে উঠেই টিউশন পড়ানো শুরু করেছে কঙ্কনা। কি করে যে ওদের পড়াশোনা হল কে জানে। ছোটবেলায় কত জেদী ছিল জয়তী, এখন হাসি গল্পের আওয়াজও শোনা যায় না। পুজোর সময়ও একখানা নতুন জামা কি শাড়ি হয় না। যদি রাগ করত ওরা, যদি চেঁচামেচি অশান্তি হত, ভালো লাগত।



****
তেইশ বছর পর সুপ্রীম কোর্টে মামলার রায়। ন্যায়ের জয় হয়েছে। চাকরি ফেরত দিতে হবে, সঙ্গে এত বছরের টাকা। নতুন ইউনিয়নের সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনাশ হয়েছে। মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়া প্রতিবাদীদের ডেকে নিল কোম্পানিও। রজত সাকসেসফুল বিজনেসম্যান এখন, ওর আর এ চাকরিতে দরকার নেই। নীলিমা এসে সেটলমেণ্টের টাকা নিয়ে গেল।
দেবু আর নেই, উদার কোম্পানি দেবুর ছোট বোনকে চাকরি দিল। সেটলমেণ্টের টাকা নিতে এসে প্রসাদ দেখা করে গেল। সবসময় ছটফট করত ছেলেটা, বুড়ো হয়ে গেছে। ছবি আঁকে না আর, চোখেই দেখেনা ভালো।
চাকরিটা ফিরে পেলেন সান্যালও, এরিয়ার হিসেবে টাকাও কম পাওয়া হল না, এতদিনের লড়াই শেষ।


কিন্তু প্রৌঢ় সান্যালের চোখে আর দ্যুতি ফিরল না। বড্ড অপমান। আবার মাথা নিচু করে সেই অফিসে চাকরি! চাকরবৃত্তি। ‘যাই হোক, মেয়ে দুটোর বিয়ে নিয়ে আর ভাবনা নেই’, চন্দ্রাকে বললেন একদিন।
‘তুমি এ চাকরিটা আর নিও না বাবা।‘ জয়তী বলল, ‘আমি তো চাকরি পেয়েছি। তুমি ভাবনা কোরো না আর।’
টলটলে দু’চোখে চন্দ্রা চাইলেন কতদিন পরে, ‘ঠিক বলেছে জয়ী। এইটাই ঠিক সময়। তুমি আমাদের নিয়ে ভাবনা কোরো না।’
কঙ্কনা সজলও হাত ধরে রইল, ‘আমরা আছি। তোমাকে আর কোনো অপমানের মধ্যে যেতে দেব না।’
অনেকদিন পরে মাথা তুলে আকাশের দিকে চোখ। বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে বসে থাকা পাখিটার ডানা ঝাপটে সাড়া।


‘তুমি বরং বাড়িটা করে নাও। তোমার নিজের প্ল্যানে বাড়ি।’, চন্দ্রা বলেছিলেন।
‘আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি কি, জানো বাবা?’ দুই মেয়ে কোলের কাছে ঘনিয়ে এসেছে অনেকদিন পরে, ‘আমরা আর ভয় পাই না।’
‘আমি যে বড্ড ভয় পেয়েছি রে। যদি তোরা বড় হয়ে আমাকে দায়ী করিস! তোদের নিতান্ত প্রয়োজনের জিনিসও দিতে পারিনি। আমি যে একজন হেরে যাওয়া মানুষ। আ ফেলিওর ম্যান।’
বাবাকে জড়িয়ে ধরল কঙ্কনা। বাবা জানেই না, দু’ বোনের চোখে বাবা নিজেই একজন হিরো।
‘দেয়ালে পিঠ থেকে গেছে, তবু আদর্শচ্যুত হয় নি, এমন মানুষ ক’জন মেলে? তুমি ফেলিওর? আমরা হিসেব নিকেশ শিখিনি, কিন্তু আমাদের চোখে তোমার চেয়ে সাকসেসফুল আর কেউ নেই।’
লড়াইশেষে এ কি কম প্রাপ্তি!



****
‘চোখের সামনেই তো একজন দারুণ সাকসেসফুল ম্যান! দেখছ না? মানুষ হিসেবে কতটা সাকসেসফুল, সে হিসেব আলাদা’, চন্দ্রা বলেছিলেন।
‘দারুণ নয় মা, নিদারুণ!’ জয়তী হেসে লুটোপুটি ।
রজতের কথা বলছে ওরা। কদিন আগে টিভিতে দেখাচ্ছিল। প্রোগ্রাম-এর নাম ‘দ্য সাকসেসফুল ম্যান’.. প্রতিষ্ঠিত মানুষদের নিয়ে, তাঁদের জীবনের ওঠাপড়া নিয়ে প্রোগ্রাম।
সমাজের মাপকাঠিতে প্রতিষ্ঠিত তো বটেই। ব্যবসার সূত্রে রজত বছরের বেশির ভাগটাই বিদেশে থাকে এখন। সেটলমেণ্টের টাকা নিতে এসে গল্প করে গেছে নীলিমা। ছেলে মুম্বই। মেয়ে টরন্টো। ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট রজত সিনহার ইন্টারভিউ টিভিতে দেখায় মাঝে মাঝেই।


আর এ পরিবারের মেয়েরা? জ্ঞান হবার বয়স থেকে শুধু দায়িত্বপালন। কি সুন্দর গান গাইত কঙ্কনা, নাচত ঠিক যেন এক পেখম মেলা ময়ূর। স্কুলবেলা থেকে ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে সব ইচ্ছে ভুলে থাকা।
আর জয়ী?
মেধাবী মেয়েটার মাথা চিরকালই পরিষ্কার। সুযোগ পেলে আরো কত পড়াশোনা করতে পারত। শুধু মাথা নয়, হৃদয়খানাও সোনা-বাঁধানো। মূল্যবোধ, ন্যায়-অন্যায়, বিবেক।
ওদের কোম্পানিতে ইউনিয়ন তৈরী করা বারণ। তবু শ্রমিকরা একটা অ্যাসোসিয়েশন গড়েছে। শ্রমিক ওয়েলফেয়ার কিছু কাজ হয়। মেয়েদের জন্মনিয়ন্ত্রণ শিক্ষা, বস্তীতে স্যানিটেশন, ছোট ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষা। কোম্পানী এগজিকিউটিভ হয়েও জয়তী স্বেচ্ছায় এসব কাজে যুক্ত থাকে। শুধু নিজে নয়, সহকর্মীদের সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছে। এমনকি ওর বস শ্রীনিবাস, তাঁর স্ত্রীকেও জড়িয়ে নিয়েছে। চোখে চোখে হাসেন স্বামী-স্ত্রী। চন্দ্রা বলেন, ‘বাপের ধারা যাবে কোথায়!’


সহকর্মীরা টুকটাক পরামর্শ নিতে আসে। বুদ্ধি নিতে আসে কেউ কেউ। সেদিন ‘অধিকার’ নিয়ে কেমন প্রাঞ্জল যুক্তিপূর্ণ মতামত দিচ্ছিল মেয়ে। ক’দিন আগে ‘গোল্ডেন হ্যাণ্ডশেক’ বলে তিন মাসের মাইনে দিয়ে জনা এগারো লোক বসিয়ে দিয়েছে অফিস।
জয়তীর অবশ্য সেসব ভয় নেই। কাজের জোরে ইতিমধ্যেই অফিসের নজরে পড়েছে।চাকরিতে বেশ উন্নতি করছে জয়তী। এক বছরের মাথায় স্পেশাল ইনক্রিমেন্ট।বেঙ্গালুরু পাঠিয়ে বিশেষ ট্রেনিং দিয়ে আনল অফিস। এখন তো একটা প্রোজেক্ট লিডার হয়ে কাজ করছে।



****
আজ বিকেলে একটু উত্তেজিত হয়ে ফিরেছে জয়তী। লাল লাল মুখ। ‘কি হয়েছে জয়ী?’ চন্দ্রা জিজ্ঞেস করেছিলেন। উত্তর দেয়নি মেয়ে।
কিন্তু সেই থেকে সান্যালের মনটা অশান্ত। বুকের মধ্যে একটা ভয় সবসময়। তেইশটা বছর সব জোর কেড়ে নিয়েছে। ঘুম আসছিল না। বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। জয়তী। এত রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে।
‘কি হয়েছে মা? ঘুমোস নি?’
জয়তী মুখ ফেরালো। রাস্তার আলো এসে পড়েছে মুখের একদিকে। বড্ড সাদা। চোখে লাগছে। জয়ীর মুখটা অস্পষ্ট। কেমন দূরের দূরের। ‘কী হয়েছে জয়ী?’


‘বাবা, আজ কাকে দেখলাম জানো?’
সান্যাল একটু অবাক হলেন, ‘কাকে রে?’
‘কোম্পানীর নতুন ডিরেক্টর। বলেছিলাম না? কোম্পানীতে একটা বদল আসছে?’
ডিরেক্টর! সে নিয়ে মেয়ে এত উত্তেজিত কেন! বোর্ড, ডিরেক্টর এসব নিয়ে একজন সাধারণ কর্মী মাথা ঘামায় নাকি! অবশ্য কোম্পানীর অবস্থা একটু টালমাটাল এখন। নতুন ডিরেক্টর এসে কি বিশেষ ব্যবস্থা নেয়! সেই নিয়ে টেনশন?
‘তাজ বেঙ্গলে আজ সেমিনারে গেছিলাম না অফিস থেকে? সেখানেই দেখলাম। মহুয়াদি দেখালো । দূর থেকে। আমাদের এমডি ভিপি সবাই সঙ্গে।’
‘ও আচ্ছা। তোদের সঙ্গে কথা বললেন?’
‘কি যে বলো বাবা! অফিসের যে প্রেজেন্টেশন আছে, তাই জানতেন না ওঁরা। দূর থেকে দেখলাম।’
‘তাহলে? তুই এমন শুকনো মুখে কেন?’ কঙ্কনাও এসে দাঁড়িয়েছে।
‘নতুন ডিরেক্টর কে জানিস দিভাই? রজতকাকু। দ্য রিয়েল সাকসেসফুল ম্যান।’
‘তাই? তোকে চিনতে পারল?’
‘কি যে বলিস দিভাই! আমার মতন একটা তুচ্ছ মানুষের দিকে নজর পড়বে! শ্রীনিবাস স্যার গিয়ে কথা বললেন। তখন আমাদের দিকে থাকলেন একবার।’
আনমনেই চোখ বন্ধ করল জয়তী। মনে পড়ে গেল সন্ধের সেই বিশেষ ক্ষণটা। তাকালেন ডিরেক্টর সাহেব। তারপর তাকিয়েই থাকলেন। একেবারে সোজাসুজি। তারপর..



****
পৃথিবীটা সত্যিই গোল। সেই রজত। প্রথম আলাপে ‘সান্যালদা’ ডাক। সান্যালদার ভাবনা, সান্যালদার নাটক নিয়ে মুগ্ধ রজত। দেরিদা, ফুকো নিয়ে আলোচনা। সাম্যবাদী শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন।
প্রবল জীবনীশক্তি,উদ্যোগী পুরুষ। যেমন করে হোক, অধিকার রক্ষা করবেই। ছিনিয়ে নিতে হয়, সেও ভালো। প্রচণ্ড সংগ্রামের সময় সহমর্মী সহকর্মীকে ফাঁকি দিতে বিবেক দংশন হয় না, এমন নিরেট শক্ত মন। নিজের জোরে, বুদ্ধি শ্রম কূটনীতির জোরে আজ রজত এই জায়গায়।
এইরকমই তো হবার কথা। এইরকমই তো হয় পৃথিবীতে। ক্লিষ্ট হাসেন সান্যাল। দ্য রিয়েল সাকসেসফুল ম্যান। নিজের সফলতার রাস্তায় সব কাঁটা তুলে ফেলতে পারে। একান্ত আপন মানুষের কাছ থেকেও ছিনিয়ে নিতে পারে সব। সাফল্যটাই আসল। পেছনের অন্ধকার কেউ মনে রাখে না।


‘তাই বুঝি এমন একা একা… বারান্দায়…’ একটু থেমে বললেন, ‘রজতকে দেখে ধাক্কা, না রে?’
‘হ্যাঁ বাবা। তোমার আর রজতকাকুর জীবনটা মেলাচ্ছিলাম। বাবা, একটু আসবে এ ঘরে? তোমায় একটা জিনিস দেখাব।‘ হেসে ফেলল ।
ঘরে ঢুকে ব্যাগ খুলে একটা কাগজ বার করে আনল জয়তী। কাগজটা খুলে মেলে ধরল। চিঠি। কোম্পানীর লেটারহেডে চিঠি। টারমিনেশন লেটার ।
‘বাড়ি ফেরার একটু আগে শ্রীনিবাস স্যার আমাকে ডেকে চিঠিটা দিলেন।’
মিস্টার শ্রীনিবাসের মুখটা মনে পড়ে গেল।
‘আমি জানতাম না, এমন একটা ডিসিশন নেওয়া হয়েছে। আই হ্যাড নো ক্লু। ট্রাস্ট মী জয়তী। আমি আজ পর্যন্ত কোনো ডিরেক্টরকে এভাবে কোম্পানীর হিউম্যান রিসোর্স নিয়ে ডাইরেক্ট কথা বলতে দেখি নি।’
অবাক সবাই। কোনো শো-কজ নেই, কোনো কারণ দেখানো হয় নি। হঠাত্‍ সন্ধেবেলা দেখানো একটা কোম্পানী প্রোজেক্ট। সেখানে প্রথম ডিরেক্টরের সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনা জয়তীর। আলোচনা আর কোথায়, প্রেজেন্টেশন দিল জয়তী, সেইসময় টুকটাক প্রশ্ন। তার জেরে কাউকে টারমিনেশন লেটার দেওয়া যায়!
‘চাইলে তুমি কোর্টে যেতে পারো’, চুপিচুপি বলেছেন শ্রীনিবাস। বলেছে সহকর্মীরা সবাই। এ অফিসে এগজিকিউটিভ ক্যাটাগরী এমপ্লয়ীদের কোনো ইউনিয়ন নেই। ওয়ার্কারদের একটা সংগঠন আছে, তারা বেতন সংক্রান্ত আলোচনা ছাড়া কোনো কাজে থাকে না।


বলতে বলতে হেসে ফেলল জয়তী।
আপাত নিরীহ কর্মকাণ্ড, শ্রমিক ওয়েলফেয়ার সম্পর্কিত কাজকর্মে ভয় পেয়েছেন নতুন ডিরেক্টর। এ কোম্পানীতে শোষক-শোষিত সচেতনতা তৈরী হয়ে না পড়ে। কর্মযোগী ডিরেক্টর কর্মনাশা কাজকর্মের সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পেয়েছেন।
একদা সাম্যবাদে বিশ্বাসী, আজকের ‘দ্য সাকসেসফুল ম্যান’ রজত সিংহ থুড়ি সিনহা জয়তী সান্যাল নামের একটি মেয়েকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছেন তাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *