সাগরিকা রায়
বনিকে দেখে খুশি হল মিতুমাসি। এই হাসিমুখ দেখবে বলে কলেজ করে বাস ঠেঙিয়ে, অটোতে উঠে ঘেমে-টেমে আসে বনি। এমন খুশির হাসি কেউ কি হাসে বনির দিকে তাকিয়ে? এমন কি ওর বর সুমিতও নয়। বস্তুত সুমিত কি কখনও হাসে? মনে করতে পারে না বনি। ও হাসি এলে বরং বিরক্তি দেখায়। বলে, “এটা আবার এমন কী ঘটনা? এত হাসিই বা পাচ্ছে কেন তোমার?” বয়সের তফাত থাকলেও মিতু মাসির টান ছিঁড়তে পারে না বনি।
পাখা খুলে দিয়ে মাসি বলল, “এবার কিন্তু অনেকদিন বাদে এলি।”
মাসির অভিযোগের জবাব না দিয়ে বনি হাসল, “কী করছিলে?”
মাসি উঠে গিয়ে ক্যাবিনেটের সামনে দাঁড়াল “দেখে যা।”
ক্যাবিনেটের সামনে গিয়ে অবাক বনি। চমৎকার সব হাতের কাজ। ভারি ভারি সব নক্সাতোলা কাঁথা। ন্যাপথালিন দিয়ে ভাঁজ করে রাখা।
“কাঁথা স্টিচ! তুমি তো এগুলো নিয়ে হস্তশিল্প মেলায় যেতে পারো।” বনি ভারি কাঁথাগুলো টেনে বের করে, “ইশ, এসব ধনরত্ন লুকিয়ে রেখেছ। কী যে করো তুমি!”
মাসি হেসে কাঁথাগুলো নিয়ে বিছানার উপর রাখে। একটা করে কাঁথার ভাঁজ খুলে দেখে বনি। “এমন ছোট ছোট স্টিচ, এই করেই চোখের বারোটা বাজিয়েছ। কী করে করলে বলতো?”
“সোনামুখি সূচ দিয়ে। এই গোলাপের ঝাড়টা করতে দু’মাস লেগেছিল।” মিতু মাসি ধাপে ধাপে পিছিয়ে যাচ্ছে সেই কুড়ি বছরের জীবনে।
“আর এটা?” বনি ধনরত্ন নামিয়ে চলেছে “এটা কি বেডকভার?”
“তোর মেসোর জন্য করেছিলাম। ডিজাইন এনে দিয়েছিল আমার মেজ-জা। ফুল ডাঁটা, আকড়ি, লতাপাতা, ফুলে দেওয়ার জন্য রঙ বেছে একটা কাগজে লিখে দিয়েছিল। এক নম্বর দুই নম্বর করে।”
“মানে?” বনি বুঝতে চায়।
“সাদা জমির উপর এই ডিজাইনটা পেন্সিল দিয়ে তুলেছিলাম। সব একনম্বর গোলাপি রঙের সুতোর, দুই নম্বর হল সবুজ সুতোর। এই রকম আর কি! বেডকভারে করে, বালিশের কভারেও করেছিলাম। তোর মেসোর জন্মদিনে সে সব দিয়ে ঘর সাজাতাম। ও খুব খুশি হতো।” মাসির মুখে ছিলকে ওঠে হাসি, “তোকে সব শিখিয়ে দেব।”
বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ে বনি।
“এখান থেকে যেটা ইচ্ছে নিতে পারিস। তুই সূচ ধরতে জানিস?”
“না। সেখান থেকেই শেখাতে হবে।” বনিও হাসছিল।
“কিছুই নারে। ইচ্ছেটা চাই আর সেন্সটা চাই।” মাসি সব গুছিয়ে রাখছিল ফের, “কয়েকটা ফোঁড় জানতে হবে। শেখাবো তোকে। আমার মামির হাতের কাজ দেখলে কী বলতিস তুই? আহা। আমি তার থেকে শিখেছি বলতে পারিস। তোর মেসো বলতেন, মিতু তোমার মতো গুণী মেয়ে আমার জীবনে” বলতে বলতে মিতুমাসি লাজুক হাসে, “খুব হয়েছে, কেবল বড়দের কথা শোনা চাই।”
বনি হাসে। দেওয়ালে ফ্রেমে আটকে থাকা গম্ভীর মানুষটি নীরবে মিতুকে দেখে যান।
মোবাইল বাজছে। সুমিতের নাম দেখে নিয়ে বনি সুইচ অন করে। সুমিত জানে আজ মাসির কাছে আসবে বনি। এই তো এল। এরই মধ্যে ফোন!
“আমি দশ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে পড়ছি।” বনি সুইচ অফ করে। মাসি কী বলছিল, বনি শুনতে পায়নি।
“কিছু বললে?” বনি তাকালে মাসি বলে, “তোর মেসো একটা তাজমহলের ছবি এনে বলেছিলো সোফার কভার বানাতে। সেকেলে মানুষ আমরা। কী করব বল?”
“বানিয়েছিলে?” বনি জানতে চায়।
“এক বছর লেগেছিল বাবা। যে সে কথা বল? সংসার সামলে তারপর তো সব। ওটা কোথায় দেখ তো।”
নকশার দুনিয়া থেকে এক সময় বিদায় নিতেই হয়। সুমিত ওয়েট করছে। দেরি হলে মিষ্টি করে সূচ ফোটাবে। মাসিকে ক্যাবিনেট গোছাতে হেল্প করে বেরিয়ে এল বনি। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে মিতুমাসি। শীতের বেলায় হুট করেই শরৎ নিয়ে আসে মেয়েটা। ফের কবে যে আসবে!
তারক সরকার লেন থেকে একটু এগিয়ে যেতেই ফলের দোকানের সামনে দাঁড়াল সুমিত। সরকারবাজার ছাড়িয়ে পার্টি অফিসের পাশের সরু গলির মধ্যে বনির মাসির বাড়ি। এদিকটা পুরনো কলকাতার কথা মনে করিয়ে দেয়। জোড়ামন্দিরের বাগানের সাদা পাথরের মূর্তি সেদিনের স্মৃতি নিয়ে ঝাপসা হয়ে আছে। একটা মোটা সাদাকালো বেড়াল সবুজ বাড়িটার দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল।
দশমিনিট পাঁচমিনিট আগেই শেষ হয়ে গেছে, এখনও বনি এল না! সুমিত ভুরু কোঁচকাতে যেতেই দেখতে পেল বনি আসছে। হাল্কা নীল কোটা শাড়িতে ডার্ক শেড। ওকে দেখতে পেয়েছে বনি। হাত তুলল। সেই সময় একটা অটো রিকশা ওদের মাঝখান দিয়ে চলে গেল। এ যেন সেই গানটার মতো- এপারে তুমি রাধে ওপারে আমি, মাঝে অটো বহে রে। সুমিত দেখল অটোর পিছনে সুন্দর করে লেখা- ‘দেখা হলে বলে দিও আজও বেঁচে আছি।’ সুমিত হেসে ওঠায় অবাক হল বনি। রাস্তা টপকে পাশে এসে দাঁড়াতে দেখল সুমিত তখনও হাসছে। অটোর বাণী বনির নজরে আসেনি। ও মিতু মাসির শিল্পের জগতে নিবিষ্ট ছিল। ছিল কি, এখনও আছে। চোখের সামনে নেচে বেড়াচ্ছে নানা ফোঁড়। ডাল, হেরিংবেরিং, চেন… কি কাজ! ভাবাই যায় না!
“হ্যালো, মন কোথায়?” সুমিত মজা করল।
“মন এখন রেস্ট চাইছে।” বনি ক্লান্ত হাসে “এখন বাড়ি চল।”
“বাড়ি? বাসা বল। ভাড়াবাড়িকে বাসা বলে জান না?” সুমিত ফের খরখরে হয়ে যাচ্ছে।
বনি এতক্ষণ মনে মনে নরম আচ্ছাদনে ডুবে ছিল। এখন মনে হল সুমিত ওকে মিতুমাসির স্নেহ স্পর্শ থেকে টান মেরে দূরে ফেলে দিল। শরীর, মন ওরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল, “তোমাদের বাড়ী আছে কসবায়। শরিকি ঝামেলা থাকলেও তোমার তো একটা ঘর আছে সেখানে। সেটা কিন্তু তোমারই বাড়ি। চল, আমরা সেখানে যাই।”
“ইশ কী আমার এলেন রে! ঘরের প্রপার মেন্টেনেন্স না হলে বাস করার উপায় নেই।” সুমিত অন্যদিকে তাকিয়ে মুখের কেমন ভঙ্গি করে “‘বাড়ি চল’, আহা সোনা, জানে না যেন কিছুই।” বনির কথা এমন ভাবে নকল করে, ভোকাল কর্ডের অবাক করা ক্ষমতা ওর ।
“তো, প্রপার মেন্টেনেন্স কর, অফিস থেকে লোন নাও, আই হ্যাভ কনফিডেন্স ইন কনফিডেন্স গানটা গাইতে গাইতে কাজ শুরু কর।” বনি তূণ থেকে বেছে বেছে বাণ ছুঁড়তে থাকে। এই বনিকে ভয় পায় সুমিত। এ যেন অন্য মানুষ। ভোরে উঠে হাউসকোট চাপানো আলুথালু বনি নয়। একে ঠিকঠাক বোঝা যায় না। তখন বুদ্ধির ঝিলিক গুপ্ত ছোরার মত ঝলকে ওঠে। সুমিত ভয় পেয়ে যায়। আহত হওয়ার ভয়। এই ভয় থেকে নিজেকে বের করতে নানান পন্থা আছে ওর। গলার স্বর চেঞ্জ করে ফের, “আরে, এটা রাজপথ ভুলো না। হাজবান্ড ওয়াইফ ঝগড়া করছে দেখলে ভিড় জমে যাবে যে পাগলি সোনা। সুইটি আমার। চলো, একটু ঘুরে ফিরে তারপর বাসায় যাই, কেমন?”
“আজ থাক, ইচ্ছে নেই।” বনি অপাঙ্গে সুমিতকে নজরে রাখে। বহুদিন একসাথে আছে। নতুন তো নয়। বনির কাছে সারেন্ডার করার কায়দা জানে সুমিত।
“বাসায় চলে যাই চল।” দুজনে পাশাপাশি হাঁটছিল। একটা লিজারড টেল হেয়ার কাটের ছেলে হনহন করে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। সুমিত ভেবেছিল এসপ্ল্যানেডে যাবে। কিন্তু আজ হল না। নেক্সট স্যাটারডেতে প্ল্যান প্রোগ্রাম করবে। বাসে উঠতে গিয়ে দেখল সেই টিকটিকি কাট ছেলেটা ওদের সঙ্গেই বাসে উঠল। সেদিন চাঙ্গোয়া রেস্টুরেন্টের সামনে একজন নাইজেরিয়ানকে দেখেছিল সুমিত। ওর খুব ভাল লাগে ওদের গুঁড়ো গুঁড়ো চুল দেখতে। লোকটা কিন্তু বেশি লম্বা ছিল না। মিডিয়াম? নাহ, পাঁচ ফুট দশ তো হবেই। হয়তো বেশি বয়স নয়। অবশ্য ভাল করে দেখাই হল না।
“টিকিট?” বনি ভাড়া মিটিয়ে দিল। বাস থেকে নেমে সুমিতের মনে পড়ল, আজ দেবল আসবে। একেবারে ভুলে গিয়েছিল। এখন বনিকে খবরটা দিলে প্রচন্ড ক্ষেপে যাবে। অথচ খবরটা না দিলেও নয়। গত পরশুই দেবলের সঙ্গে কথা হল। ইনভাইট করা মাত্র রাজি। আজ সন্ধে সাড়ে সাতটার মধ্যে আসবে।
সুমিত ভয়ে ভয়ে তাকায় “বনি, আজ বোধহয় দেবল আমাদের ওখানে আসতে পারে। কোন ঠিক নেই অবশ্য।”
বনি অবাক “কে দেবল? এতক্ষণ বলনি!”
“আসলে ভুলেই গিয়েছি। হঠাৎ দেখা। এক সঙ্গে প্রেসিডেন্সিতে পড়তাম। ও নিজে থেকেই বলল-তোর অ্যাডটা দে। তখন না দিয়ে কী করি ?”
বনি বিরক্ত – “বন্ধুকে তো নিজে থেকেই আসতে বলতে পার। যাক, কী খাওয়াবে? চিকেন নিয়ে যাই? ডিনার করে যাবে নিশ্চয়ই।”
মাইক্রোআভেনে রান্না সেরে ফেলেছে বনি। ড্রয়িংরুম এখন জমজমাট। দারুণ কথা বলতে জানে দেবল। বনির ভাল লাগছিল। দুজনের মাঝে অনেকদিন পর একজন আসায় মেজাজটা ফুরফুরে লাগছে। কফি, পকোড়া হয়ে গেছে। দেবল বিরক্ত করতে চায়নি। বনি ছাড়ল না- “এবার এলে বলে আসবেন না। তখন খেতে বলব না। জানি যখন আসছেন, না খাইয়ে ছাড়ব? তাও এত রাতে! বউ নেই মানেই তো বেচারি লোক।”
দেবল হেসেছে- “বউ থাকলেই বুঝি ভাগ্যবান? বিয়ের কথা চলছে। দেখা যাক কী হয়। কে আসেন আমার ঘরে।”
বনি হাসল।
“পাত্রী দেখা চলছে যখন, মনে কাউকে ধরেছে নিশ্চয়ই।”
দেবল সরাসরি তাকাল, “যাকেই ধরুক, সে আপনার তুলনায় কিছুই নয়, সুমিত লাকি।”
বনি হাসতে গিয়েও দেবলের গভীর দৃষ্টির সামনে থতমত খেল। কালো কুচকুচে হাউস কোটের ভেতর দিয়ে উদ্ধত ভারি বুক, সরু কোমর ছাপিয়ে ভারি নিতম্বে যৌবনের সোচ্চার আমন্ত্রণ যেন উপভোগ করছে দেবল।
বনি চোখ সরিয়ে নিল “চল, টেবিল এ খাবার দিয়েছি।”
সুমিত মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে কী খুঁজে যাচ্ছে। কথাটা কানেই গেল না ওর।
দেবল হাসল, “তাড়াতে চাইছেন?”
বনি কি একটু লাল হল? মুখে বলল “ধ্যাত!”
“আরে দেবল, তুই নাকি সাঙ্ঘাতিক ছবি তুলছিস। রিপন বলেছে। ইংলিশ অনার্সের, মনে নেই? বাদুড়বাগানের রিপন রে।”
“ওহ, অফকোর্স ছবি তুলছি, দারুণ কিনা জানি না।”
বনি মিক্সড ফ্রায়েডরাইস আর গারলিক চিকেন গরম করে টেবিলে রাখে, স্যালাড সাজায়। সঙ্গে সরষে আমের শুকনো আচার। কাজ করতে করতে বুকের ধুকপুকুনি টের পাচ্ছিল বনি। দেবলের দৃষ্টি ওরকম কেন? শরীর রিমঝিম করে, কাঁপে, থরথর করে কাঁপে! পুরুষের চোখে সত্যি কি অ্যাট্রাক্টিভ ও?
সাড়ে দশটার মধ্যে বেরিয়ে গেল দেবল ফের আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে।
সুমিত অন্যমনস্ক ভাবে বলল, “সারাদিন বড় অস্বস্তির মধ্যে কাটিয়েছি বনি, এখন তবু একটু ভাল লাগছে।”
বনি অগোছালো ঘর গোছাতে গোছাতে থেমে গেল। সুমিত উপর দিকে ইশারা করল “ল্যান্ডলর্ড ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিতে বলেছেন। নেক্সট মাসে এগ্রিমেন্ট শেষ হয়ে যাচ্ছে। উনি আর রিনিউ করতে চান না। সেলও করবেন না। মেয়ে-জামাইকে দেবেন। তো, আমাদের একটা আস্তানা খুঁজে নিতে হবে। এখন ভাড়া ফ্ল্যাট কোথায় পাব! আমার অফিস, তোমার কলেজ কাছাকাছি হলে… এমন জায়গায় ফ্ল্যাট পেলে ভাল হত। দেবল বলেছে ওর জানাশোনা কে নাকি ফ্ল্যাট বিক্রি করবে। পুরনো হলেও খারাপ নয়। বারাসাতের দিকে। দেবল ভবানিপুরে ত্থাকে। মেট্রোর সুবিধে আছে। কী করি? ফ্ল্যাট কিনেই নেব?”
বনি খুশি। অনেকদিন ধরেই কথাটা ভাবছিল ও। কোলিগদের সবার ফ্ল্যাট আছে। দাম কত?
“তা আছে। পঞ্চাশ চাচ্ছে। এত টাকা এখনই কোথায় পাই?”
বনি অতশত ভাবছিল না। নতুন ফ্ল্যাটের ভাবনায় উচ্ছসিত ছিল বরং ।
“লিভিংরুমে লেটেস্ট ডিজাইনের সোফাসেট রাখব, লিভিং-ডাইনিঙের মাঝে কাচের পার্টিশন থাকবে। মডিউলার কিচেন্…।”
“আর বেডরুমে এলসিডি টিভি” সুমিত যোগ করে।
“ওহহ! খুব মিউজিক শুনব। কেউ কারো লাইফে ইন্ট্রুড করবনা। তোমার ফেসবুক, আমার মিউজিক…। ঠিক…।”
মোট দশদিন মাসির কাছে যাওয়া হয়নি। অটো থেকে নেমে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল মাসির দরজার উপর। দরজা খুলে হাসল মাসি “সেলাই শেখার ভয়ে ডুব দিয়েছিলি তো?”
“না না, একটা দারুণ ব্যাপার হয়েছে। ফ্ল্যাট কিনব বলে ছুটছি। বারাসাত, নয়াবাদ, গড়িয়া…।”
“তাহলে এখন সেলাই শেখা হচ্ছে না?’ মাসি হাসে।
“না, শিখব”, বনি উঠে বসে “শেখাও, রোজই এসময় আসব। একটু করে শিখব।”
“আজ কতগুলো জিনিস শেখাব। প্রথমে সূচে সুতো পরাতে হবে।”
মন দিয়ে সেলাই শিখতে থাকে বনি। ফোন বাজতেই মগ্নতা ভেঙে যায়। সুমিত নয়, দেবলের ফোন। আজ আসছে। ভাল খবর আছে। মাসির থেকে ছুটি নিতে হল। আসছে মানে রাতে খেয়ে যাবে। সুমিতকে জানিয়ে দিল বনি। আসার সময় সুমিত যেন টক দই নিয়ে আসে।
ঠিক সময়ে এল দেবল। চশমার কাচের ভেতরে চোখ ঝকঝকে। বনি কোথায় যেন পড়েছিল গোয়েন্দার চোখ নাকি ইস্পাতের মত ঝকঝকে হয়। দেবলের চোখ দেখে একথা কেন মনে হল। খবর হল চিংড়িঘাটায় একটা ফ্ল্যাট আছে। পয়ঁত্রিশ চাচ্ছে। বলে কিছু কম করা যাবে।
“সেও অনেক বেশি।” বনির দিকে তাকায় সুমিত।
“ব্যাঙ্ক-লোন পাওয়া যাবে বলেছিলেন।” বনি জানতে চায়।
“আগে ফ্ল্যাট পছন্দ করুন। টাকা পয়সা নিয়ে পরে ভাববেন।”
“কিন্তু টাকার কথা না ভাবলে চলবে? বনি অবাক।
দেবল নরম সুরে বলে “দরকারের কথাও তো ভাবতে হবে বল।”
শেষ শব্দটায় চমকে ওঠে বনি। সীমারেখা ছিঁড়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে দেবল। বনি সুমিতের দিকে তাকায়। সুমিত ততক্ষণে ফেসবুকে ঢুকে পড়েছে। দরকারেও ওকে পাওয়া যায় না।
সেদিন একটা দরকারে বারবার ফোন করেছে ওকে, মিষ্টি গলায় কে এক মহিলা বলে চলেছে ‘সরি, দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়ালড ইজ টেম্পোরারিলি আউট অফ সার্ভিস।’
দেবল হেসে ফেলে বলে “টাকাটা ফ্যাক্টর নয় বলছি তো, দেখে নাও না।”
বনির মন বিদ্রোহ করে, আবার প্রয়োজনের কথা ভাবতে হয়। বরং সুবিধে নাও। বাথরুমের আয়নায় ওর জলে ভেজা মুখ, চুল ওকে ভেংচি কাটে- সঙ্গে সুমিত আছে। কিন্তু কোথায় যে আছে, এমন একটা সিরিয়াস কন্ডিশন, অথচ দেখ…! বনি বাথরুম থেকে বের হওয়ার আগে ভাবল আজ ফ্ল্যাট দেখতে যাওয়ার আগে হেয়ার স্পা করে নেবে। শরীরে অ্যালোভেরা অয়েল মাসাজ করল অনেকক্ষণ ধরে। শাওয়ার খুলে উরু কোমর, শরীরের অনাবৃত অংশ ফেনায় ফেনায় ভরে দিল। বেছে বেছে শাড়ি পরল। হলুদ রঙ ওকে মানায়, সেটা জানে বনি। হলুদ পেটিকোট বের করল। লো-কাট ব্লাউজ পরল। বেরোবার সময় সুমিত সপ্রংশস চোখে তাকাল “দারুণ, রোজ কেন এমন সাজো না?”
“রোজ কেন সাজো না, রোজ কেন সাজো না …” কথাটা কামড় দিয়ে যাচ্ছে।
দূর থেকে দেবলের ফোর হুইলারের লাল আলোটা দেখা যাচ্ছে। আজ ফ্ল্যাট কেনার পাশাপাশি চাইনিজ রেস্তোরাঁয় খেয়েছে ওরা। সুমিতকে ফোন করে ফ্ল্যাট দেখতে যাওয়ার কথা বলেছিল। সুমিতের মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল বনি। ওকে না জানিয়ে আসাটায় অবাক হবে। সুমিত বোঝে না আস্তে আস্তে দেবলকে হাতে রাখতেই হবে। রাগ, অভিমান সন্দেহ ঝুলিতে রেখে দাও। ছোট, ছোট ফোঁড়, রঙ বেরঙ্গি আলপনায় কুশলী শিল্প গড়ে উঠবে। কিন্তু যতক্ষণ সেটা হাতে না পাচ্ছে ফোঁড়গুলো দিয়ে যেতে হবে। এরজন্য যদি একটু পাশাপাশি হাঁটতে হয়, হাসতে হয় সে সব নিয়ে ভাবতে নেই। যেমন ধর আমাকে আজ পারফিউম গিফট করেছে দেবল। এই সুবাস ও মনে রাখবে অনেকদিন। ফ্ল্যাটের দামটা ওই কমাবে দেখ।
ও পয়ঁত্রিশ লাখের ফ্ল্যাট দেখে এসেছে শুনে সুমিত বিরক্ত। “দামটা কম মনে হচ্ছে? আমি কিন্তু ত্রিশের বেশি উঠতে পারব না। পঁচিশ হলেই ভালো।”
বনি মুখ নিচু করে নখের চাকচিক্য পরীক্ষা করছিল। সবটা কি খুলে বলা যায়! কোনও বুদ্ধি খরচ করে না, কেবল বকবক। ব্যাঙ্ক লোনের খোঁজ নিতে পারে তো! এমন হাঘরে দশা সুমিতের।
পরদিন কলেজে হাজির দেবল- “কী হল, ফোন করছি, তুলছ না।”
বনি হাসে “ওসব আমাদের জন্য নয়, আপাতত ভাড়া বাসা দেখি, শখ পরে।”
দেবল আনমনে তাকিয়ে ছিল বনির দিকে। বনির খারাপ লাগছিল, সাদা জমি সাদাই রয়ে গেল। ও তো সূচে সুতো পরাতেই পারে না। নকশা করবে কী করে। ফ্ল্যাটটা খুব পছন্দ হয়েছিল। সুমিত হাসে- “একবারে গাছে উঠো না। ধাপে ধাপে ভাব।”
সুমিতের হাসিটা অসহ্য লগল বনির। মামাতো দাদা বলেছিল “বর দেখতে ভাল, যতক্ষণ না হাসে। সুমিতের পারসোনালিটি নেই।”
জানালার বাইরে শতশত ফ্ল্যাটের আলোয় ঝলমল করছে শহর। এমন একটি ফ্ল্যাট কেন হবে না বনির?
বোধহয় শেষরাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল, ডোরবেলের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। সুমিত দরজা খুলেছে। দেবলের গলা পেল বনি। নিজেকে গুছিয়ে নিল ও। দেবলকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। অনাবাদি জমিতে ফসল হয় না। ইচ্ছে করেই নিজেকে এলোমেলো করে ঘরে ঢুকল। দেখুক দেবল, জ্বলে পুড়ে যাক।
“একটা ভাল খবর আছে।” দেবল তাকিয়ে থকে বনির দিকে, “আমার ফ্ল্যাটটা টু বিএইচকে। পঁচিশে হয়ে যাবে। যদি নাও…। আমি আপাতত আমার বারুইপুরের বাড়ি থেকে যাতায়াত করব।” অনেকটা কথা বলে থামল দেবল।
হতভম্ব হয়ে পড়েছিল বনি। সুমিত সশব্দে চেয়ার টেনে বসে পড়ল “নাও মানে? এখনই নেব। দরকার হলে ভেন্ডার কামরায় করে চলে যাব হা হা হা! চল, লেটস গো।”
বনির বোকাটে ভাবটা কাটেনি “এত কমে ছেড়ে দেবেন? আপনার ফ্ল্যাট, ভাল ফ্ল্যাট, লোকসান হবে যে!”
গভীর চোখে তাকাল দেবল “কার কিসে লোকসান, লাভ, ভেব না। তবে মাঝে মাঝে এসে বিরক্ত করব।”
নিজের ফ্ল্যাটটা ওদের দিয়ে গেল দেবল। গোছগাছ হয়ে গেলে সুমিত আমন্ত্রণ জানাল “এস, পার্টি হয়ে যাক।”
“বনি পানিপথে ভ্রমণ লাইক করবে তো?” দেবল জানতে চায়।
কলেজ থেকে ফেরার সময় বনি মিতুমাসির কাছে গেল। প্রচুর গল্প জমে আছে। সবটুকুই নতুন ফ্ল্যাট নিয়ে। সবশুনে মাসি অবাক “বাহ, এমন বন্ধু আর কে আছে! তাকে একদিন খাইয়ে দে।” বনি হাসে “দেব।”
সেই হাসি চোখে মাখিয়ে বের হল বনি। একদিন কেন, মাঝে মাঝেই ডাকতে হবে দেবলকে। ভাগ্যে এমন বশংবদ মেলে। এ যেন ঘরের বাইরে একফালি বারান্দা। বনির ঘরে বর আছে, থাকুক, দেবলের বউ আসবে আসুক না, কেউ কারও ঘর তো ভাঙছে না। কেবল একটু খোলা হাওয়া থাকল। দাঁড়ে বসে ছোলা ভেজানো খেতে খেতে কখনও লাল লঙ্কা খেতেও ইচ্ছে করে। কী অসাধারণ শিল্প, কী অসামান্য কাজ!
ঘরের ভিতরে দুজনে তখন মত্ত। দেবলের হাতে রেড ওয়াইনের গ্লাস। সুমিত একটা পারফিউম বের করে ওকে দেখাচ্ছে। “কাল বনি এটা আমাকে এটা গিফট করেছে।”
দেবল দেখল শিশিটা ওর খুব চেনা। এটা লেডিজ পারফিউম। এমন একটা শিশিই ও গিফট করেছিল বনিকে।
“লেডিজ তো কী হল, গিফট ইজ গিফট বুঝলে।”
দেবলের নিভে যাওয়া মুখটা দেখতে দেখতে দরজার বাইরে স্তব্ধ হয়ে পড়ল বনি। দেবল আর আসবে না এখানে। বনিকে একটা ভন্ড ভেবে চলে যাবে ও। কী অসাধারণ সূচের কাজ করে দেখাল সুমিত। নিখুঁত ফোঁড়, সমান মাপ, দুর্দান্ত কালার কম্বিনেশন। ফেসবুকে মুখ গুঁজে থেকেও অঙ্কটা করে গেছে সবার আড়ালে। বনি যখন সূচে সুতো পরানো শিখছে, সুমিত ততক্ষণে ফুল তুলে ফেলেছে সাদা জমিতে। বনিকে দেওয়া গিফট সুমিতকে দিয়েছে বনি। দেবলকে কেমন কায়দা করে সেটা দেখালো সুমিত!
সুমিত কি একটা রসিকতায় হাসছে, অথচ ঘরের ভিতরে দেবল, আর বাইরে বনি… স্তব্ধ!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন