দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
“সুধী বন্ধুজন। আজ আমাদের পরম সৌভাগ্য যে আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছেন বীরভূমনিবাসী আন্তজ্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাউল শ্রী গোপীনাথ দাস বাবাজি আর তাঁর খেপি ব্রজদাসী–আর অল্প সময়ের মধ্যেই তেনারা আমাদের মঞ্চে এসে উপস্থিত হবেন।”
এই অবধি বলে মুনিরের ছেলে জহিরুল একটু থেমে চারিদিকে একবার চোখ চালিয়ে নিল। তার বয়েস বড়জোর আঠারো উনিশ। চেহারায় ফকিরি আবরণের আড়ালে যুগোপযোগী চাকচিক্যও উঁকিঝুঁকি মেরে যায় খানিক খানিক। উমের খাঁয়ের মাজারের ঠিক সামনের চাতালে একটি প্রাচীন আমগাছের পত্রমুকুটের ছায়ায় মঞ্চ বাঁধা হয়েছে। সেখান থেকে বাড়ির ভেতর অবধি যাতায়াত করবার জন্য একটি শুঁড়িপথ ছেড়ে তার চারদিকেই দর্শকের ভিড়। মক্তবপুর ও আশেপাশের দুচারটে গ্রামের সমস্ত লোকজন এসে ভেঙে পড়েছে আসরে।
মুসলমান-প্রধান এই এলাকায় উমের খাঁয়ের ভক্ত অনেক। এককালে এ-অঞ্চলের জমিদার ছিলেন তাঁর পিতৃপিতামহ। খানদানি মুসলমান বংশের সেই সন্তান অথচ সেই জীবনের পথে হাঁটলেন না। রাজদণ্ডের বদলে কলমকে তাঁর সঙ্গী করেছিলেন উমের। তারপর একদিন সেই কলম আর কন্ঠের সুরের ওপর ভরসা করে বে-শরা ফকিরির পথ নিলেন তিনি।
নিজের জমিজমা, ধনসম্পত্তি অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে ভিক্ষান্নে জীবনধারণের পথ নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তবু স্বধর্মের সমাজনির্দেশিত পথ ছাড়বার সাজা থেকে তাঁকে ছাড়ান দেয়নি তাঁর সমাজ। তাঁকে তারা হত্যা করতে এসেছিল। রক্তের ধারায় মুছে দিতে চেয়েছিল মানুষকে ভালোবাসার সঙ্গীতের ধারাকে।
উমের কিন্তু তাতেও নিজের পথকে ছাড়েননি। যুদ্ধঘোষণা করেছিলেন তিনিও, তবে সে-যুদ্ধে ভালোবাসা আর সঙ্গীতকে অস্ত্র করেছিলেন তিনি। অভাব, প্রাণসংশয়, সমাজের ভ্রূকুটির নিয়ত সম্মুখীন হতে হতে দেশ, কাল, সমাজ ও স্বজাতির বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধের পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। তবু সেই দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যেই অগণিত গান লিখে গিয়েছেন তিনি। মানুষ ও ঈশ্বরকে ভালোবাসার গান। নিজের সৃষ্টি সেই গানে নিজেই সুর বসিয়ে গেয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, লৌকিক গানের আসর থেকে আসরে। তারপর একসময় ভালোবাসা ও সঙ্গীতের ধর্মে দিক্ষা দিয়েছেন নিজের একমাত্র সন্তানকেও। তার হাতে তুলে দিয়েছেন সেই ফকিরি ধর্মের উত্তরাধিকার।
তাঁর নশ্বর শরীর দীর্ঘকাল আগেই ধুলোয় মিশে গেছে। শুধু রয়ে গেছে গানের খাতাটি। ধীরগামী জলধারার মতই মধুর অথচ অসীম শক্তিধর সেই গানের খাতা ধীরে ধীরে তার পথ কেটে নিয়েছে এই অঞ্চলের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে স্থানীয় মানুষজনের বুকে। একদা তাদের জানমালের মালিক, সর্বস্বহারা ফকির হয়ে গিয়েও ফের হয়ে উঠেছেন তাঁদের হৃদয়ের অধীশ্বর।
আজ, তাঁর স্মৃতিতে তাঁর ছেলে মুনির ফকিরের আয়োজিত বার্ষিক এই সঙ্গীত-আসরের শেষ রাতটিতে লোকজনের ভিড় অন্যান্যদিনের তুলনায় বেশি। বিস্তীর্ণ উঠোনটিতে আলোর বন্দোবস্ত বিশেষ নেই। প্রায় অন্ধকার সেই আসরে কুয়াশার হালকা আস্তরণের নিচে চাদরে গা মাথা ঢেকে ধৈর্য ধরে বসে রয়েছেন বহু নারীপুরুষ। তাঁদের চেহারায় কোন বহুজাতিকত্ব নেই, আচরণে সংস্কৃতামোদী এবং নাগরিক অস্থিরতাও নেই।
উমের ফকির এ-অঞ্চলের বাউল-ফকির সমাজে একটি শ্রদ্ধার্হ নাম। তাঁর স্মৃতি-উৎসবে তাই নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, বীরভূমের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাউল ও ফকিরসমাজের খ্যাত-অখ্যাত সমস্ত শিল্পীরাই এসে জড়ো হন। তিনরাত্রি ধরে চলে সঙ্গীতের উৎসব।
তবে এ-বছর তাতে আরো একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন ঘটেছে। মুনির ফকিরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এসে উপস্থিত হয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাউল সম্রাট গোপীনাথ বাবাজি স্বয়ং। এবং তাঁর আসবার সম্ভাবনাটি চাউর হতে আজ অনুষ্ঠানের তৃতীয় রাতে এ-আসরে যত দর্শক এসে পৌঁছেছেন, এ-আসর বহুকাল তেমন জনসমাগম দেখেনি।
ব্যাপারটা কি তরুণ জহিরুলের মনের ভেতর কোথাও একটা ঈর্ষার জন্ম দিয়েছিল? অসম্ভব নয়। তার শরীরি ভাষায়, ঘোষণার উচ্চারণভঙ্গীতে সেই বিদ্বেষের সূক্ষ বহিঃপ্রকাশ ঘটে যাচ্ছিল বারবার। নাম ঘোষণার পর প্রায় মিনিটপাঁচেক কেটে গেছে। গোপীনাথ বাবাজির তখনও দেখা নেই। মঞ্চের পেছনদিকের ঘেরা দেয়া জায়গাটির দিকে খানিক বাঁকা দৃষ্টি দিয়ে সে এবার কিঞ্চিত শ্লেষ মাখানো গলায় ফের বলল, “আপনারা ধৈর্য ধরেন গো। মনে হয় বাউলসম্রাট মেকাপে বসিছেন। অতবড় শিল্পী… তাই মনে হয় আসতে একটু দেরি লাগে।”
চাপা একটা হাসির শব্দ উঠল চারদিক থেকে কথাগুলো শুনে। তারপর দর্শকের মধ্যে থেকে উড়ে এল একটা অনুরোধ, “তাহলে ততক্ষণ জহিরুল তুমিই না হয় একখান শুনায়ে দাও দেখি–”
এ গ্রামের দর্শকমণ্ডলীরও সেটা অজানা নয়। তাদের মধ্যে থেকে সাবধানবাণী উড়ে আসছিল, “দেখিস বাপধন, আমাদের মক্তবপুরের নাম খারাপ করিস না রে–”
একটু থমকে গিয়ে এদিক ওদিক চাইছিল তরুণটি। মঞ্চে গাইবার ব্যাপারে তার কিঞ্চিৎ জড়তা আছে। মঞ্চের ওপর বসে থাকা মুনির মুখ তুলে একবার চাইলেন ছেলের দিকে৷ মৃদু হাসি তাঁর মুখে। মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হল দুজনে। তার পরেই নিচু হয়ে জহিরুল মুনিরের দোতারাটি তুলে নিয়ে নিজের গলায় পরে নিল। যন্ত্রটি পুরনো। তার চেহারায় কোন চাকচিক্য অবশিষ্ট নেই আর। দু’এক মুহুর্ত তার শরীরে হাত বুলিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল জহিরুল। দক্ষ আঙুলের ঘায়ে কথা বলে উঠল তার পূর্বপুরুষের তারবাদ্যটি।
এলোমেলো সুরখণ্ডগুলোকে একটি নির্দিষ্ট চালে বাঁধতে বাঁধতে নিচু গলায় সে কথা বলে চলেছে তখন, “হিঁদুর বইতে লেখে, পরমাত্মায় জীবাত্মার পায়ে ধরি বলে দেহিপদপল্লবমুদারম। শুদ্ধোদনে বাপ হইয়ে ব্যাটার পায়ে ধরিছিলো। তা সে বিষয়ে লালন সাঁই কী বলেন তাই নিবেদন করি -আলেফ অর্থাৎ আল্লাহ, তেনাকে স্পর্শ করতি গেলে দ্যাখবে স্পর্শটি লেগেছে গিয়া মিম,অর্থাৎ কিনা নবীর দেহে। তাই সাঁই বলছেন
আলেফ দিয়ে টোকা মারো
লাগবে গিয়ে মিমের গায়
বলতে বলতেই হঠাৎ ‘আলেফ’ শব্দটির ওপর সুতীব্র একটি টান মেরে যেন প্রায় বাতাসেই ভাসিয়ে দিল সে তার তরুণ শরীরটিকে। তার অপটু কন্ঠকে অবলম্বন করেই উৎসারিত হচ্ছে পদটির গভীর ভাবময় পংক্তিগুলি—
আলেফ দিয়ে টোকা মারো
লাগবে গিয়ে মিমের গায়
আয় নবীকে দেখবি যদি আয় রে আয়
গাইতে গাইতেই তার সতর্ক চোখদুটি দর্শকের ভাবলেশহীন মুখগুলির দিকে বারবার ফিরে ফিরে চায়। পর্দা না ছোঁয়া সুরগুলি তার গানটির মূল ভাবকে ছুঁতে চেষ্টা করে প্রাণপণ, কিন্তু তাদের তল পায় না।
নিজের অক্ষমতার তিক্তস্বাদটুকুকে হজম করে নিয়ে সে আশৈশব অভ্যস্ত ব্যাখ্যাটি বলে চলেছে তখন,
তা বন্ধুজন, শোনেন, আদিতে আছেন তিনজন। আল্লা অর্থাৎ আলেফ, তেনার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি আদম অর্থাৎ লাম, আর আদমের শ্রেষ্ঠ সন্তান মিম অর্থাৎ কিনা নবী। তা আলেফ যখন নিখোঁজ হইয়ে যান তখন কী ঘটে? সাঁই বলতেছেন—
কাঁধে কার হাতের ছোঁয়া পেয়ে গানটি ফের ধরতে গিয়েও থমকে গেল সে। কোমল স্পর্শটি বুকে ভরসা জোগায়। তার ফিরিয়ে ধরা মুখটি তখন তাকিয়ে রয়েছে দুটি বয়োজীর্ণ গভীর চোখের দিকে।
“তুমি বরং দোতরা ধরো বাবা। বড়ো মিঠা হাত। আমি গানটা গাই? বলতে বলতেই গানের পরবর্তী কলিটি তুলে নিলেন মঞ্চে উঠে আসা গেরুয়াধারী নতুন মানুষটি,
আজব এক সুরত দেখিয়া
আলেফ যায়রে নিখোঁজ হইয়া
লামটি তখন যায় ফাটিয়া
তখন তাহার কী উপায়
আয় নবীকে দেখবি যদি আয় রে আয়
“কিন্তু কথা হল, নিখোঁজ হইয়ে আলেফ যান কোথা গো?”
প্রশান্ত চোখদুটি জহিরুলের তরুণ, উদ্ধত দৃষ্টিকে বেঁধে নিয়েছে যেন এবার? সরাসরি প্রশ্নটি তার দিকে ছুঁড়ে দিয়েই ব্যাখ্যানের সুতোটি নিজেই তুলে নিলেন মঞ্চে উঠে আসা গোপীনাথ, “যান মাতৃগর্ভে। ভালোবাসার দায়ে নারীর গর্ভফান্দে আসি স্বেচ্ছায় দেহকারায় বন্দি হন তিনি। দশ মাস দশদিন মায়ের গর্ভে বসি যন্ত্রণা ভোগ করি তারপর ভূমিষ্ঠ হয়ে জীবনকারায় বন্দি হন। তারপর—
আলেফ পড়িয়া ফান্দে
জারেদজার হইয়া কান্দে
পড়িয়া নিরানন্দে
ধরে গিয়া মিমের পায়
আয় নবীকে দেখবি যদি আয় রে আয়
হঠাৎ গোটা আসরটি যেন একসঙ্গে জেগে উঠে পদটির ধূয়া ধরে নেয়। বাংলার বাউল-ফকির-বৈষ্ণব-শাক্ত নির্বিশেষে যুগে যুগে একটি জায়গায় এক; তা হল সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে ঈশ্বরত্ব থেকে সরিয়ে এনে কাছের মানুষ করে নেয়া্র আকুতি। পিতা কিংবা সন্তান থেকে শুরু করে নর্মসহচর, এমন কত রূপেই না দেবতাকে বারেবারে গ্রহণ করে চলেছে তারা যুগে যুগে।
আজ এই বয়স্ক ও অভিজ্ঞ বাউলের গানে আবার সেই নিবিড় সম্পর্কের পুণরুচ্চারণ শ্রোতাদের মনে নতুন করে সাড়া জাগিয়েছে। গাইতে গাইতেই মানুষটার দুটি গাল ভেসে যাচ্ছিল জলে। অশ্রুবিকৃত কন্ঠে তাঁর গানের বাকি পদগুলি ভালো বোঝা যায় না। কিন্তু সে গান ততক্ষণে শব্দবোধের সীমাকে ছাড়িয়ে গিয়ে, বাক ও মনের অগোচর কোন অনুভুতিকে স্পর্শ করেছে। সেখানে মানুষের তৈরি শব্দবন্ধের সাহায্য ছাড়াই ভাবের বিনিময় ঘটে চলে—
***
মঞ্চের একপাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে মানুষটাকে চেয়ে চেয়ে দেখছিল জহিরুল। খানিক আগে গড়ে ওঠা মুগ্ধতার অনুভূতিটি তার ফের এখন হারিয়ে যাচ্ছে এক গোপন ঈর্ষার বৃত্তে। তার নিজের উঠোনে দাঁড়িয়ে তারই অক্ষমতাকে এই সভার সামনে খুলে ধরেছেন ওই বহিরাগত বাউল।
গানের রেশটুকু মিলিয়ে যেতে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন মুনির ফকির। বললেন, “মক্তবপুরের সৌভাগ্য যে এই আসরে আপনার মতন মানুষের পদধুলি পড়েছে। লালন সাঁইয়ের এই গান এমনভাবে কখনো শুনব তা আমি…”
উত্তরে মৃদু হেসে সামান্য মাথা নোয়ালেন গোপীনাথ বাউল। তারপর, বিনা ভূমিকায় একেবারে সোজা ঢুকে এলেন তাঁর নিজের গানের ভেতর,
আমি এমন জনম পাবো কীরে আর
এমন চাঁদের বাজার মিলবে কি আবার
হাতের নিঁখুত টানে তাঁর আনন্দলহরীর তারে সুর বেজে ওঠে। তার সঙ্গে সঙ্গতের মতই জেগে ওঠে মঞ্চের বুকে ঘুরন্ত দেহটির ছন্দময় পদাঘাত। তারপর সেই সুরের মধ্যে থেকেই ফের জেগে ওঠে গায়কের কন্ঠসুর,
এমন আনন্দ রসে
আর কি গো যাবো ভেসে
মানব জন্ম পাবো
দেহের কামনা অপার
গোপী বাউলের গলাটি সুন্দর। তদগত ভাবের স্পর্শে উচ্চারিত শব্দগুলি এক একটি মণিখন্ডের মতই উজ্জ্বল হয়ে ঝরে পড়ছিল। কিন্তু, কোথায় যেন একটু তফাৎ এসে গিয়েছে। গানের চালের মধ্যে নাগরিক ঔজ্জ্বল্যের হালকা মিশেল। তার সুরের বিস্তারে হিন্দুস্তানী রাগসঙ্গীতের মৃদু হলেও সুনিশ্চিত সুবাস।
ব্যাপারটা অন্যদেরও নজর এড়ায়নি দেখা গেল। দর্শক আসন থেকে হঠাৎ তীক্ষ্ণ গলার একটি আওয়াজ ভেসে এল, “ও বাউল, অত তানকারী দেখাবা যদি, তাহলে তানটাই করো না কেনে, গান আর কেন?”
কথাগুলো মঞ্চে বসা ব্রজদাসীর কান এড়ায়নি দেখা গেল। তাঁর সুগৌর মুখটিতে কেউ যেন একমুঠো আবির মাখিয়ে দিয়ে গেছে একমুহূর্তের জন্য। কিন্তু তারপরেই নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। ঠোঁটদুটি তাঁর নিঃশব্দে নড়ছিল শব্দহীন কোন প্রার্থনায়। ততক্ষণে গোপী বাউল তাঁর গানের শেষ পংক্তিগুলিতে এসে পৌঁছেছেন-
এহেন জনম পেয়ে
কাল কাটালাম ঘুমাইয়ে
জনম গেল রে বয়ে গেল আমার
পরের গোয়ালে ধুয়া
কাটালাম পথে কত কুঁয়া
দীন উমের কয় দোহাই দিয়া
সাঁই যা করো এবার—
গান শেষ করে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন তিনি। ঈষৎ দুলছে শরীরটি। সদ্যসমাপ্ত সঙ্গীতের ঘোর তখনও রয়ে গেছে তাঁর দেহে। হঠাৎ জহিরুল এসে দাঁড়াল তাঁর সামনে। এরই মধ্যে কোন ফাঁকে গিয়ে গাঁজার কলকিতে টান লাগিয়ে এসেছে সম্ভবত। চোখদুটি ঈষৎ লাল। পায়ের ভঙ্গী টালমাটাল। পকেট থেকে একটি কুড়ি টাকার নোট বের করে গোপী বাউলের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে, “গানটা তো ভালোই গাইলা গো বাউল! এক্কেবারে টিভি, সিনিমার বাউল গান গো! এই এলাকায় এমনটা তো শোনা যায় না বিশেষ! তাই তোমায় কুড়ি টাকা পুরুস্কার দিলাম। কিন্তু জিগেস করি, দুদ্দু শাহের পদে আমার ঠাকুদ্দা উমের খাঁ সাহেবের ভনিতা তুমি দিলা কোন হিসাবে?”
কথাটা শুনে বিজু ফকির একটু হতভম্ব হয়ে থেমে গেলেন। মুনিরও বিব্রত মুখে মাথা নাড়ছিলেন। এ-আসরে এ ধরণের আক্রমণ তিনি আশা করেননি। জহিরুলের জ্ঞানের গভীরতা আছে। কথাটা সে ভুল বলেনি। পদটা দুদ্দু শাহেরই। কিন্তু তা হলেও এ-আসরে নিমন্ত্রিত অতিথিকে সে-কথাটা এমন অভদ্রভাবে বলাটা রুচি-বহির্গত কাজ।
গোপী বাউল হতচকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন জহিরুলের দিকে। খানিক বাদে ধীরে ধীরে বললেন, “না, মানে জাত বাউল তো আর নই। জ্ঞানট্যান তত নাই। ছোটবেলায় বাপ মা মরে ঘর ছেড়েছিলাম। পথে পথে ঘুরি, তা সর্বেশ্বর দাস বাউল দয়া করে তেনার আখড়ায় ঠাঁই দিলেন। তেনার কাছেই শুনে শুনে যেটুক শিক্ষা। তা-বাদে আমি তো আর কিছু জানিশুনি না গো। তত্ত্বজ্ঞান দূরস্থান কোন জ্ঞানই তো আমার এ জীবনে হল না আর। চিরকাল শুনে এসেছি এ-হল গে উমের খাঁ সাহেবের পদ। তা ভুল যদি হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে..”
“না না ভুল হবে কেন, ভুল হবে কেন? এই যে, শোনেন বলি—” বলতে বলতে ব্যাপারটা সামাল দেবার জন্য মুনির উঠে দাঁড়াচ্ছিলেন, কিন্তু তাঁকে থামিয়ে দিয়ে জহিরুল ফের গোপী বাউলের দিকে ঘুরে বলে, “চিরকাল ভুল শুনেছো হে দাসমশায়। শোন বলি, এ হল মক্তবপুর। তোমার হিল্লি-দিল্লি-কলকাতা নয় যে বগলদাবায় বিলাতি খেপি নিয়ে ইস্টেজে দাঁড়ায়ে যা বললে, লোকে চক্ষু গোল গোল করি তা ফকির-বাউলের গান বলি গিলল আর আন্ডিল আন্ডিল ট্যাকা দিয়ে গেল। এ-গাঁয়ের ছেলে আমি। তত্ত্ব শিখিছি মুনির ফকিরের কাছে। আমি যদি বলি এ উমের খাঁয়ের গান নয় তাহলে তেনার নিজের ছেলে, এই আমার বাপ দূরস্থান, স্বয়ং উমের খাঁও আসি যদি বলে এ-গান তেনার তাহলি তারেও বলব, ‘ভুল বলতেছ। ভুল তোমার হতে পারে, আমাদের ভুল হবে না।’ আমাদের বোকা বোঝাতে না এসে শহরের বাউল সাদা বোষ্টুমি কোলে শহরে গিয়া গান শোনাও না কেনে। এখেনে এসেছ কী করতে?”
আকস্মিক এই অন্যায় আক্রমণে গোপী বাউল একেবারে নির্বাক হয়ে গেছেন তখন। আন্তর্জাতিক আঙিনায় তাঁর বিপুল সাফল্য এসেছে। সে সাফল্যের আলোয় পৌঁছোবার পথে কখন যেন সঙ্গীতের আঙ্গিকে তাঁর মিশে গেছে ভারতীয় সঙ্গীতের অন্যান্য ধারার গায়কিও। হতে পারে তত্ত্বের গভীর জ্ঞান তাঁর নেই। তবু, সুর আর নিবেদিত চিত্তের সাধনায় এ-দেশের মাটির গানের খানিক রস তো তিনি পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের আঙিনায়!
তবু, সর্বত্যাগী ফকির-বাউলের সমাজেও মাৎসর্য কোনো নতুন বিষয় নয়। আজ নিজের মাটিতে দাঁড়িয়ে এই অযাচিত, তীক্ষ্ণ অপমানটুকু বড়ো ধাক্কা দিয়েছে তাঁকে। ধাক্কা দিয়েছে ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে ওই উক্তিটি। অথচ এ-সাধনায় ভালোবাসার তো কোন জাত থাকবার কথা নয়!
ঠোঁটদুটি কাঁপছিল তাঁর। দু’একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে ধীরে ধীরে মঞ্চ থেকে নিচের দিকে পা বাড়াচ্ছেন তিনি, তখন ব্রজদাসী উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে ফিরিয়ে নিয়ে এসে তাঁকে বসিয়ে দিলেন নিজের খালি জায়গাটিতে, তারপর তাঁর হাত থেকে আনন্দলহরিটি নিজের হাতে তুলে নিয়ে গিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর দু কাঁধ বেয়ে স্বর্ণাভ চুলের ঢেউ উপচে পড়েছে। পরণের সাদা খোলের কাপড়টি তাঁর গৌরবর্ণ শরীরে ভারী ভালো মানিয়েছে। গোটা আসর হঠাৎ একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেল। ব্রজদাসীর গানের খ্যাতি আছে এ অঞ্চলে। দর্শকদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে হাতের যন্ত্রটিতে ঘা দিলেন তিনি, তারপর গোপী বাউলের অপমানিত মুখটির দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে গান শুরু করলেন,
আমি আর চাহিনে জনম আর চাহিনে মরণ
তোমার চরণতলে রেখে দাও
শুধু তোমার চরণতলে রেখে দাও
আমি বড় দুখি তাই তোমারে ডাকি
সেই পলকে তবু ফিরে চাও
আমারই এ চাওয়া তাই তোমারই দেওয়া
আমার এ নশ্বর দেহে একটু হাওয়া
দুদিনের তরে এসে বেড়িয়ে যাওয়া
এ ভুল চিরতরে মুছে দাও।
সাগরপাড়ের মেয়ে মার্গারেট এই দেশের মাটির সন্তান গোপীনাথ বাউলকে ভালবেসে নিজের দেশ-ঘর-ভাষা-সংস্কৃতিকে ছেড়ে এসে বাউলধর্মে দিক্ষা নিয়ে ব্রজদাসী হয়েছেন। কিন্তু সেজন্য কোন লাঞ্ছনা তাঁর কপালে জোটেনি। পরম আদরেই তিনি রয়েছেন এ দেশের মাটিতে। কিন্তু তাঁকে ভালোবেসেই গ্রাম ছেড়ে নগরের পথে পা বাড়ানো গ্রামের মানুষটি নিজের সংস্কৃতির বিশুদ্ধতাকে বিনা প্রতিবাদে বিসর্জন দিয়েছেন। পীরিতি নামের তিন আখরের নাম জপ করতে গিয়ে ত্যাগ করেছেন সুরের শুদ্ধতাকে। সাধনসমুদ্রে ডুব দিয়ে তত্ত্বজ্ঞানের রত্নখনি ত্যাগ করে ভালোবাসার নুড়িপাথর কুড়িয়ে নৌকা বোঝাই দিয়েছেন শুধু সেই মেয়েটির মুখ চেয়ে। অংশত তারই মূল্য চোকাবার দায়ে আজ এ আসরে তাঁর এই লাঞ্ছনাটুকু প্রাপ্য হয়েছে। সে গ্লানিকে মুছিয়ে দেবার জন্যই হয়ত বা বিদেশিনী মেয়েটি প্রেমিকের কাছে তাঁর অকুন্ঠ আত্মদানের কথা স্বীকার করে নিচ্ছিলেন সভার মধ্যে দাঁড়িয়ে। ভবা পাগলার সৃষ্টি, ইষ্টদেবতার পায়ে আত্মদানের গানটি সাগরপারের মেয়ে মার্গারেটের গলায় হঠাৎ করেই যেন পরিপূর্ণ মানবিক প্রেমের গাথায় বদলে গেল।
*****
জহিরুল মঞ্চ থেকে নেমে কোথায় যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল। এইবারে দেখা গেল সে ফের এসে মঞ্চে উঠছে। তার মুখে মৃদু নেশাতুর হাসির স্পর্শ। হাসতে হাসতেই ঈষৎ তরল গলায় সে বলে উঠল, “ওরে বাস রে! পীরিতি যে কাঁঠালের আঠা গো, লাগলে পরে ছাড়ে না হে–” দর্শকের ভেতর থেকে তখন সগর্জন দাবি উঠেছে, “আরেকখান হোক ব্রজদাসী।”
মাথা নামিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন ব্রজদাসী। জহিরুলের মন্তব্যটি তাঁর কানে গেছে। কিন্তু তাতে তিনি কোন প্রতিক্রিয়া দেখাননি। একটুক্ষণ বাদে মাইক্রোফোনটি হাতে ধরে নিয়ে তিনি বললেন, “এইবারে একখানা নতুন গান শোনাবার অনুমতি দিন। এ গানের পদকর্তা হলেন বরুণ দাস। নামটি আপনাদের তত পরিচিত নয়। তবে কিনা গানটি ভালো। ওতে লোকশিক্ষা হয়।” বলতে বলতেই গানে ঢুকে এলেন তিনি-
আগে জান রে মন কিসে হয় পিরীতি
না জানলে পিরীতির মর্ম শেষে হয় অধোগতি
পি শব্দে হয় ইন্দ্রিয় দমন
রি শব্দে হয় রিপু দমন
তি শব্দে হয় রে ভক্তি
এই তিনে মিলে হয় পিরীতি
আবার রতিতে আবদ্ধ হইয়া
ঘনীভূত রস আস্বাদিয়া
তবে হয় জীয়ন্তে মরা
শুদ্ধ হয় চিত্ত মতি
ভেবে দীন বরুণ কয়
কোন কোন ভাগ্যবানের এই পিরীতি হয়
সাধন ভজনে হয় রতির উদয়
ঐ রতিতে মিলে জগতপতি..
গাইতে গাইতে তাঁর অভিযোগভরা তীক্ষ্ণ চোখদুটি বারংবার ছুঁয়ে যাচ্ছিল জহিরুলকে। চারিচন্দ্রের উপাসনায় দেহরসের আস্বাদনের মধ্যে দিয়ে দেহাতীতে পৌঁছোবার যে প্রেম আরাধনায় তিনি ব্রতী হয়েছেন তাঁর ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে, সেই প্রেমের এমন সগৌরব, উচ্চকিত প্রকাশে আসরে খানিক আগে তৈরি হওয়া সমস্ত গ্লানি যেন ধুয়ে মুছে যাচ্ছিল।
হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন মুনির। দীর্ঘ পদক্ষেপে এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন মার্গারেটের পাশে। দুহাতে তার মুখটি ধরে বললেন, “দেখো রে সাঁইয়ের লীলাখান! দুই বছর আগে এই মেয়ে যেদিন প্রথম আমার আখড়ায় আসে, বাংলা ভাষাটা অবধি জানতো না। আর আজ সে মক্তবপুরের মাটিতে দাঁড়ায়ে উমের খানের নাতিরে প্রেমতত্ত্বের শিক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা ধরে! এই জ্ঞানরত্ন কোন সাধনায় পেলা তুমি বল–বলতে বলতেই আবেগদীর্ণ ভাঙা ভাঙা গলায় তিনি গেয়ে উঠলেন-
“আগুন আছে ছাইয়ের ভিতর
আগুন বার করে নে—
আগুন ইস্পাতেতে মজুত ছিল রে
ভাই মজুত আছে পাথরে—”
তাঁর চোখে চোখ রেখে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিলেন মার্গারেট। দু চোখ দিয়ে তার অবিরল ধারায় জল গড়িয়ে পড়ে শুধু। তারপর, একসময় ধীরে ধীরে পিতৃপ্রতিম ফকিরটির হাত ছাড়িয়ে তিনি এগিয়ে গিয়ে গোপী বাউলের হাত ধরলেন। গোটা আসর নিঃশব্দ হয়ে দেখে চলেছিল তখন মঞ্চের ওপর অভিনীত হয়ে চলা এই জীবন নাট্যের একটা বিচিত্র অঙ্ককে।
জহিরুল কখন যেন এগিয়ে এসেছিল সামনে। হঠাৎ নিচু হয়ে সে মার্গারেট আর গোপী বাউলের পা স্পর্শ করল। তার সব অভিমান এইবারে শান্ত হয়েছে। মার্গারেটের মুখে হাসি, চোখে জল। গোপী বাউলেরও চোখ শুকনো ছিল না। দুহাতে তরুণটিকে তুলে ধরে তার চোখে চোখ রেখে বললেন, “জেনে রেখো বাবা, সর্বতত্ত্বের সার রসতত্ত্ব। পীরিতি! এই হল গিয়া তিন আখরের বীজমন্ত্র। সর্বসাধনার আধার। ওতেই সবকিছুর শুরু—আবার ওতেই সর্বতত্ত্বের লয় গো! ফকিরি তত্ত্বের জ্ঞান তোমার হয়েছে বটে কিন্তু আসল তত্ত্বের হাতেখড়ি হতে তোমার আজও বাকি আছে। যে ভাষাতেই বল না কেন, যেদিন তোমার ঈশ্বরীর পায়ে মাথা ঠ্যাকায়ে বলতে পারবা দেহি পদপল্লবমুদারম, সেদিন তোমার জ্ঞানচক্ষু খুলবে গো! আশীর্বাদ করি সে শিক্ষা তোমার পুরা হোক।”