short-story-tinti-table

তিনটি টেবিল
অরুণাভ দত্ত


আমার কথা


এই পাতা ঝরার সন্ধ্যায় আমি এখন বসে আছি ‘অপেক্ষা’য়। আমার সামনে টেবিলে রাখা উষ্ণ কফির পেয়ালা থেকে ধোঁয়া উঠছে। ‘অপেক্ষা’ আসলে একটা কফি হাউস। দোকানের আয়তন খুব বেশি নয়। তবে বেশ সাজানো-গোছানো। এই কফি হাউস আমাদের খুব পছন্দের জায়গা। আমরা প্রায়ই এখানে এসে মিলিত হই। আমরা অর্থাৎ আমি আর আমার গল্পের প্লটগুলো।

যখনই কোনও প্লট আমার মনোজগতে এসে ডালাপালা মেলতে চায়, তখনই আমি এখানে চলে আসি আমার প্লটের সঙ্গে খানিক বোঝাপড়া করতে। ব্ল্যাক কফির রূপ, রস, গন্ধের আনন্দ নিতে নিতে পর্যবেক্ষণ করি আমার আশপাশের কফিপানকারীদের, কখনও তাদের মধ্যে থেকে খুঁজে নিই প্লটের সঙ্গে মানানসই চরিত্র।

তবে আজ এর একটা ব্যতিক্রম ঘটেছে। আজ আমি কফি হাউসে এসেছি, গরম কফি এসেছে, শুধু আসেনি কোনও প্লট। এদিকে শব্দের পর শব্দ বসিয়ে একটা গল্পের দেহ গড়ে তোলার অসম্ভব তাগিদ আমাকে অস্থির করে তুলেছে। তাই চাতকের মতো একটা কাহিনীর বীজ খুঁজে পাওয়ার অপেক্ষায় এই ‘অপেক্ষা’-তে আমি অপেক্ষমাণ। কেন জানি না আজ এলোমেলো ভাবনাগুলোকে কিছুতেই গোছাতে পারছি না। আবার অন্যদিনের তুলনায় আজ কফি হাউসে মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা।

আমার টেবিল থেকে অল্প দূরে কলেজে পড়া চারটি ছেলে একটা টেবিল ঘিরে বসে একটার পর একটা সিগারেট নিঃশেষ করছে আর বয়সোচিত ঠাট্টা-তামাশা করে তাদের উষ্ণ রক্তকে যেন আরও উষ্ণ করে তুলছে। দোকানের একেবারে কোণের দিকে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক খবরের কাগজ হাতে পথচারীদের আসা-যাওয়া লক্ষ্য করছেন। শুনেছি তার অতি ঝগড়াটে গৃহিণীর সংসর্গ এড়িয়ে চলতে তিনি রোজ সন্ধেটা এখানে এসে কাটিয়ে যান।

এদের ছাড়া আমার টেবিলের কাছাকাছি দুটি ছেলে-মেয়ে মুখোমুখি বসে রয়েছে। ওরা সদ্য কৈশোর পেরিয়েছে। মেয়েটি ফর্সা, সুশ্রী। ছেলেটির ছিপছিপে গড়ন। সঙ্গে রয়েছে তাদের টিউশনের ব্যাগ দুটো। কফি হাউস অন্যান্য দিনের মতো সরগরম না থাকায় ওদের কথাবার্তা স্পষ্ট কানে আসছে। আমি বুঝতে পারছি যে, আমার দর্শন ও শ্রবণেন্দ্রিয় ওই ছেলে-মেয়েটিকে কেন্দ্র করেই সজাগ হয়ে উঠেছে।


প্রথম টেবিল


‘বাড়িতে জানিয়েছিস যে, এক্সট্রা ক্লাস আছে?’ ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল।

‘হ্যাঁ, কিন্তু আজ এখানে নিয়ে এলি হঠাৎ?’ পাল্টা প্রশ্ন করে মেয়েটি।

‘আজ খুব কফি খেতে ইচ্ছে হল, তাই ভাবলাম…’ ছেলেটি নার্ভাস হয়ে পড়েছে। ডিসেম্বরের সন্ধেতেও কপালের ঘাম মুছে ঠোঁটে হাসি ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

‘কি খাবি বল?’ মেয়েটির দিকে মেনুকার্ড এগিয়ে দিয়ে সে বলে।

মেয়েটির ঠোঁটের প্রান্তে লেগে আছে টুকরো হাসি। যেন ছেলেটির মনের খবর সে জানে। ততক্ষণে ওয়েটার এসে দাঁড়িয়েছে। মেয়েটি বলে, ‘তুই যা হোক কিছু অর্ডার কর।’

মেনুকার্ডটা টেনে নিয়ে ছেলেটি বলে, ‘হ-হটডগ?’ মেয়েটি মাথা নাড়ে। ছেলেটি অর্ডার দেয়, ‘কাকু, দুটো দুধ কফি আর দুটো হটডগ।’ ওয়েটার চলে যেতেই ছেলেটি এবার এক নিঃশ্বাসে মেয়েটির দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, ‘তোর সঙ্গে কি ঋকের কিছু চলছে?’

‘কী চলবে?’

‘না, মা-মানে, আমি… আমি…’ ঘাবড়ে-টাবড়ে গিয়ে ছেলেটির ল্যাজেগোবরে দশা।

‘আসলে ঋক আমার পিসতুতো ভাইয়ের বন্ধু। ছোটবেলা থেকেই আমাকে চেনে। তাই আমার সঙ্গে কথা বলে, ইয়ার্কি করে।’

ছেলেটির মুখ তখন উত্তেজনায় রক্তিম। যেন একটা খুব গুরুতর কথা যেন ওর বুক থেকে উঠে এসে ঠোঁটে আঁটকে রয়েছে, কিন্তু কথাটা ঠোঁট থেকে বেরোলেই তার হার্টফেল হয়ে যাবে।

‘আমাকে কি কিছু বলতে চাস?’ শান্ত গলায়, ঠোঁটে মুচকি হাসিটা বজায় রেখে মেয়েটি প্রশ্ন করে। ওর এই হাসি, কৌতুকাবহ দু’চোখের দৃষ্টি ছেলেটিকে ঘামিয়ে অস্থির করে তুলছে। মেয়েটি যেন বিধাতার মতো সব জেনেশুনেও ছেলেটির পরীক্ষা নিচ্ছে। ওয়েটার এসে টেবিলে কফি, হটডগ রাখে। মেয়েটিকে তাড়াতাড়ি কফির কাপ এগিয়ে দিতে গিয়ে ছেলেটির হাতে খানিকটা গরম কফি চলকে পড়ে যায়। কিন্তু তার জ্বালা-যন্ত্রণা সব লোপ পেয়েছে। দুর্দান্ত সহ্যশক্তি সঞ্চারিত হয়েছে দেহ, মনে। মেয়েটি নিজের রুমাল দিয়ে ছেলেটির হাত মুছিয়ে দেয়। সে জাদুস্পর্শে ছেলেটির হৃদপিণ্ডের গতিবিধি বেড়ে যায় বোধ হয়।

‘একটা কথা …আমি মানে!’ ক্রমাগত ছেলেটি তোতলাচ্ছে। ওদিকে নীরব সলজ্জ হাসির রেখাটা চওড়া হতে হতে ক্রমে মেয়েটি গোটা মুখ দখল করে নিচ্ছে। ‘তু-তুই তো বু-বুঝতেই পারছিস…’ কোনও রকমে ছেলেটি বলল।

‘হুম!’ মেয়েটির অতিসংক্ষেপিত সলজ্জ উত্তর ছেলেটির কানে যেন বীণার ধ্বনির মতো গুনগুন করতে লাগল । সেইসঙ্গে আশ্বস্তও হল কিছুটা।

‘এটা মানে…’ ছেলেটি একটা চকোলেট ব্যাগ থেকে বের করে উল্টোদিকে এগিয়ে দিল।

‘থ্যাঙ্ক ইউ!’ শোনা গেল সলজ্জ কণ্ঠস্বর।

‘তুইও কি…?’

ছেলেটির অসম্পূর্ণ প্রশ্নের নীরব উত্তর দিল মেয়েটির লজ্জায় গলে পড়া মুখখানা। ওই টেবিলের মধ্যে একটি মিষ্টি প্রেমের অঙ্কুর গজানো লক্ষ করছিল অনেকেই। বলে রাখি, এরই ফাঁকে একটি যুবক এসে ঠিক আমার পিছনের টেবিলে বসেছে। অন্যদিকে সেই তামাকখেকো কলেজে পড়া ছেলেগুলো তাদের বিনোদনের নতুন রসদ খুঁজে পেয়েছে। ছেলে-মেয়েটিকে অস্বস্তিতে ফেলার জন্য ওরা শিষ দিচ্ছে, বিকৃত গলায় গান গাইছে। এই বিক্ষুব্ধ পরিবেশে নবঅঙ্কুরিত প্রেমও নুয়ে পড়ছে বার বার। মেয়েটি খুব অস্বস্তি বোধ করছে।

সহসা বিড়ালকে বাঘ হতে দেখলাম। মেয়েটির অস্বস্তি দেখে ছেলেটির লজ্জা, ভয়, দ্বিধা সব কেটে গিয়েছে মুহূর্তে। সে পিছন ফিরে কটমট করে কলেজের ছেলেগুলোর দিকে তাকাল। তার পর টেবিলে কফি আর হটডগের দাম রেখে উঠে দাঁড়িয়ে ছেলেগুলোর সামনে শক্ত করে ধরল মেয়েটির হাত, আর অপরাহত মেজাজে নেমে পড়ল রাস্তায়।

তাকিয়ে দেখলাম, এই শীতের সন্ধেয় তারা পরস্পরের হাত ধরে হাঁটছে আর সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে দেখতে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।


দ্বিতীয় টেবিল


আমার টেবিলের সোজাসুজি একটা বেসিন। বেসিনের উপর দেওয়ালে একটা আয়না ঝুলছে। সেই আয়নায় প্রতিফলিত হচ্ছে আমার পিছনের টেবিলে বসে থাকা যুবকটির মুখ। যুবকটি এতক্ষণ ধরে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করছিল ছেলে-মেয়ে দুটিকে। সহসা কফি হাউসের দরজা ঠেলে প্রবেশ করল শ্যামবর্ণা এক যুবতী। তার হাতে মাঝারি মাপের একটা ব্যাগ। ভিতরে ঢুকে যুবতী বিহ্বল দৃষ্টিতে কাকে যেন খুঁজতে লাগল। আয়নায় দেখলাম সেই যুবতীকে দেখা মাত্র যুবকের দৃষ্টিতে ভিড় করেছে আশঙ্কা। যুবতী এসে বসল আমার পিছনের টেবিলে, যুবকটির মুখোমুখি।

‘কফি অর্ডার করি?’

‘খেতে আসিনি।’ যুবতী ফোঁস করে উঠল, ‘কাল রাতে ফোনে যে কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তার উত্তর দাও।’ আয়নায় এখন শুধুমাত্র যুবতীর পিঠে এলিয়ে পড়া খোলা চুল দৃশ্যমান। ‘হাবা-বোবার মতো বসে থাকবে এখনো? তোমার সিদ্ধান্তটা আজ জানিয়ে দাও।’ হতাশা ও রাগ মাখানো নারীকণ্ঠ ছড়িয়ে পড়ল কফি হাউসের আনাচে-কানাচে।

ডেঁপো ছেলেগুলোর সমস্ত মনোযোগ এখন এই টেবিল ঘিরে। খবরের কাগজের আড়াল থেকে গুপ্তচরের মতো সেই ভদ্রলোকও ওদের লক্ষ করছেন। আমার কাপের কফি শেষের পথে। পিছন ফিরে তাকানো যায় না। কথাবার্তা শুনেই ওদের মুখের অভিব্যক্তি আন্দাজ করে নিচ্ছি। আশেপাশের কানগুলো ওদের আলোচনাকে ঘিরে উৎসুক হয়ে পড়েছে দেখে যুবক বলল, ‘আস্তে!’

‘এইভাবে আস্তে আস্তে, ধীরে-সুস্থে অনেকগুলো বছর কেটে গিয়েছে। এখনও হুঁশ হল না তোমার?’ যন্ত্রণা ও বিদ্রূপ সমান ভাবে মিশে আছে যুবতীর গলায়।

‘আমি তো দেখছি, বলো।’

‘এত বছর ধরে ঠুঁটো জগন্নাথের মতো দেখেও এখনও আশ মিটল না তোমার?’

ওয়েটারকে দু কাপ কফি অর্ডার দিয়ে যুবক বলল, ‘আমি তো চেষ্টা ছাড়িনি। এখনও তো কত পরীক্ষা, ইন্টারভিউ…’

‘ক্যারি অন, দিতে থাকো, এদিকে সামনের বৈশাখেই আমার…’ মনে মনে আন্দাজ করে নিলাম এখন যুবতীর মুখ জুড়ে যন্ত্রণার উপস্থিতি। যুবক নিরুত্তর। ‘ছেলের নিজের ব্যবসা, নিজের বাড়ি।’

এখন হয়তো রাগে, ঈর্ষায় ফেটে পড়ে যুবক মাথা নিচু করে নিজের অক্ষমতার কথা ভাবছে।

‘কিন্তু আমি রাজি হইনি।’ সহসা কোমলতা ফুটে উঠল যুবতীর কণ্ঠস্বরে, ‘তাই আজ বাড়িতে কিছু না জানিয়ে চলে এলাম। আজই আমরা ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিসে গিয়ে বিয়ে করব! আমি তৈরি হয়ে এসেছি।’

যুবতীর হাতে একটা ব্যাগ আগেই দেখেছি। আয়নায় দেখলাম কত আশা নিয়ে সে যুবকের হাতে হাত রেখে বলছে, ‘আপাতত একটা ভাড়া বাড়িতে থাকব। কাউকে কিছু জানাবার দরকার নেই।’

ওয়েটার দু’কাপ উষ্ণ কফি এনে রাখল। যুবক এখনও নীরব। যুবতী জিজ্ঞাসা করল, ‘যাবে তো ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিসে?’ আশঙ্কায় কাঁপছে দু’জনেরই হৃদয়।

‘কিন্তু চাকরি?’

‘উফফ! যে কোনও একটা কাজ ঠিক জুটে যাবে দেখো।’

‘যে কোনও কাজ জুটিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে থাকলে, এতগুলো বছর অপেক্ষা করছি কেন বলো?’ স্তিমিত হয়ে আসে যুবকের কণ্ঠস্বর।

‘তুমি আদৌ পুরুষমানুষ তো? আমি যদি এতটা স্যাক্রিফাইস করতে পারি, তুমি কেন পারবে না? তোমার কাছে তোমার অ্যাম্বিশনই সব। সবার সঙ্গে লড়াই করে এতগুলো বছর শুধু তোমার অপেক্ষায় বসে আছি, এর কোনও দাম নেই? তুমি কি জানো না বাড়িতে আমাকে কী কী অশান্তি ফেস করতে হয়?’ কান্নায় বুজে এল যুবতীর কণ্ঠ। সকলের দৃষ্টি ওই টেবিলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। ডেঁপো ছেলেগুলো ফিকফিক করে হাসছে। ওরা যেন সর্বভুক, আনন্দ-বেদনা সবই ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়।

যুবক তখনও নিরুত্তর। যুবতীটি চিৎকার করে বলল, ‘তোমাকে আমার ঘেন্না লাগে!’

ঘৃণার বাণে বিদ্ধ যুবক কি যেন বলতে গিয়েও থেমে গেল। আমার মনে পড়ল কিছুক্ষণ আগের সেই ছেলেটিকে। ‘তোমাকে ভালবাসি’ কথাটা সে কিছুতেই মুখ ফুটে বলতে পারল না। অথচ এই যুবতী কেমন অবলীলায় বলে ফেলল ‘তোমায় ঘৃণা করি’। ঘৃণা প্রকাশ করতে কেউ কুণ্ঠিত হয় না, হয় শুধু প্রেমের প্রকাশে।

‘হাত ছাড়ো। কারোর হাত ধরার যোগ্য তুমি নও। কাপুরুষ!’

দেখলাম তিরস্কারে ক্ষত-বিক্ষত হওয়া যুবক যুবতীর হাত ধরে ফেলেছে। বলছে, ‘প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেয়ো না! আর ক’টা দিন সময় দাও!’

‘আর একটা দিনও তোমার জন্য নষ্ট করতে পারব না।’ চেয়ার ঠেলার শব্দ হল। যুবতী উঠে দাঁড়িয়েছে। দেখলাম খানিকটা গিয়ে যুবতীটি আবার ফিরে এল সেই টেবিলের কাছে। একটা বড়সড় খাম যুবকের সামনে ফেলে দিয়ে বলল, ‘সাত বছরের স্মৃতি, সব দিয়ে গেলাম।’

যুবতীটি চলে যাওয়ার পর খামটা হাতে নিয়ে মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে রইল যুবক। অপমানে, লজ্জায় সে আকর্ণ রক্তিম হয়ে উঠেছে। তার পর তাকে নতশিরে পরাজিত সৈনিকের মতো দোকান থেকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম। পিছন ফিরে দেখি ওদের টেবিলে পড়ে থাকা কফির দামের পাশে কফির কাপ দুটো যেন একে অপরের থেকে মুখ ফিরিয়ে আছে।

আমার কাপের কফিও শেষ। ওদের সেই আধটুকরো জীবনের কথা ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়ালাম। একটু আগে একটা সম্পর্কের জন্ম দেখেছি, এখন দেখলাম মৃত্যু। আদিকবি বাল্মীকির কথা মনে পড়ল, প্রেমের এমন ছন্দপতনেই তো মহাকাব্যের সৃষ্টি হয়েছিল। এ সব ভাবতে ভাবতে দেখি একজন বৃদ্ধা কফিশপে ঢুকে আমার পাশের টেবিলে বসছেন। তার বয়স আন্দাজ ষাটের উপর, টকটকে ফর্সা রঙ, চোখে চশমা।

বিল মেটাবার জন্য কাউন্টারের দিকে যেতে গিয়ে খেয়াল হল যে, আমার কলমটা টেবিলে ফেলে এসেছি। আমার টেবিলের কাছে ফিরে যেতেই শুনলাম আমার পাশে চেয়ার টানার শব্দ হল। তাকিয়ে দেখি একটু বৃদ্ধা যে টেবিলে বসেছেন, সেই বৃদ্ধার মুখোমুখি চেয়ার টেনে এক বৃদ্ধ বসলেন। বৃদ্ধের গালে চাপ সাদা দাড়ি। তাঁর বয়স হয় তো বৃদ্ধার চেয়ে খানিক বেশি। সেইসঙ্গে লক্ষ করলাম তাদের দুজনের চোখের চাহনি। অপার বিস্ময়, আনন্দ নিয়ে তাঁরা পরস্পরকে দেখছে। যেন চাতক দেখছে বৃষ্টির ফোঁটা। যেন সূর্যমুখী দেখছে সূর্যের মুখ। নিষ্পলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বৃদ্ধ কফির অর্ডার দিলেন। আমার কি হল জানি না, যন্ত্রচালিতের মতো আবার চেয়ারে বসে পড়লার আর দ্বিতীয় কাপ কফির হুকুম দিলাম।


তৃতীয় টেবিল


‘আমার খোঁজ পেলে কোথায়?’ বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন।

বৃদ্ধা উত্তর দিলেন, ‘পরশু মেজদি চলে গেল। খবর পেয়ে এখানে এলাম। হাসপাতালে মেজদিকে শেষ দেখা দেখতে গিয়ে কলেজের তথাগতর সঙ্গে দেখা হল। তথাগত তোমার ভাল বন্ধু ছিল। ক’দিন আগে তার হার্টে পেসমেকার বসেছে। আমাকে দেখে ঠিক চিনতে পারল। ওর সঙ্গে কথায় কথায় কেন জানি না তোমার কথা জানতে খুব ইচ্ছে হল!’

বৃদ্ধ মুচকি হাসলেন। ‘জানি শুনে তুমি হাসবে। তোমার ফোন নম্বরটা তথাগতর কাছ থেকে নিলাম। ভাবলাম, কেমন আছে, কী করছে, খোঁজ নিই একবার। তোমার সঙ্গে যে আবার দেখা হবে, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।’

দু কাপ কফি এল। বৃদ্ধা আবার বললেন, ‘সেই কবেকার কথা। এমনই এক সন্ধেবেলায় মাকে গানের মাষ্টারের বাড়ি যাচ্ছি বলে লুকিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করেছিলাম, আর বলেছিলাম, আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, চলো আমরা পালিয়ে যাই। তুমি সেদিন ভয় পেয়েছিলে। আমি পিছিয়ে এলাম। সেদিনের পর তুমি আর আমার কোনও খবর নাওনি।’

আমি হতবাক হয়ে ওই টেবিলের দিকে তাকালাম। আমার সন্দেহ হল, একটু আগের সেই যুবক-যুবতী আবার ছদ্মবেশ ধরে আসেনি তো?

কফির কাপে চুমুক দিয়ে বৃদ্ধ বললেন, ‘সেদিন আমি কী করেছিলাম জানো? তোমার সঙ্গে দেখার করার পরে আমি বাড়ি ফিরে গেলাম। পরিবারের সকলকে আমাদের সম্পর্কের কথা জানিয়ে তোমাকে বিয়ে করব বললাম। কেউ রাজি হল না। তখন আমার চাকরি নেই। ভাবতে লাগলাম, কী করি? একদিন সাহস করে তোমার হাত ধরেছিলাম, এখন কাপুরুষের মতো পালিয়ে যাব? আমার মনে আছে, দুটো টিউশনি জুটিয়ে নিয়ে সেই টাকায় একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম। পুরনো, বিশ্রী একটা ঘর। স্বপ্ন দেখেছিলাম, এই বিশ্রী ঘরখানা তোমার হাতে পড়ে কেমন সুন্দর হয়ে উঠেছে! তা এ সব করতে করতে প্রায় মাস দুয়েক কেটে গেল। বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দেব ঠিক করে তোমাকে কিছু জানায়নি।”

গরম কফিতে দ্বিতীয় চুমুক দিয়ে বৃদ্ধ বললেন, “শেষমেষ সারপ্রাইজটা তুমিই দিলে। আমাদের বিয়ের কথা বলতে তোমার বাড়িতে গিয়ে খবর পেলাম, তুমি ভাগলপুরে তোমার মামাবাড়ি চলে গেছ। মামাবাড়িতেই তোমার বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছে। পরে শুনেছিলাম, তুমি সুখে সংসার করছ।’

‘সুখের সংসারই বটে!’ বিষাদ মেশানো হাসি হাসলেন বৃদ্ধা, ‘বিয়ের পর সেই অচেনা লোকটার সঙ্গে আমার বিয়ের এক বছর উদযাপন কোথায় হয়েছিল জানো? কোর্টে। ঘর তো কোনওদিনই বাঁধিনি, তাই ঘর ভাঙার দুঃখ হয়নি। ডিভোর্সের পরে এখানে ফিরে এসে তোমার বাড়িতে একদিন গেলাম। তুমি তখন চাকরি পেয়ে কানপুরে চলে গেছ, বাড়ির লোকের সঙ্গে ভাবসাব নেই, কানপুরে কোথায় থাকো তা কেউ জানে না। আমার মাসতুতো দাদা জলপাইগুড়িতে একটা মেয়েদের প্রাইভেট স্কুলে আমার চাকরি করে দিল। তেত্রিশটা বছর সেখানে এক রকম আছি বলতে পারো।’

দুজন দুজনকে অবাক হয়ে দেখছেন।

‘বিয়ে করেছ?’ বৃদ্ধা প্রশ্ন করলেন।

‘না।’

‘অন্য কাউকে মনে ধরেনি?’

‘সেদিন সন্ধেবেলায় চলে যাওয়ার আগে তুমি আমায় কী বলে গিয়েছিলে, তা মনে আছে?’

‘না।’

‘তুমি বলেছিলে, হাত ধরতে চাওয়া যতটা সহজ, শেষ পর্যন্ত হাত ধরে থাকা, ততটা সহজ নয়। কিন্তু হাড়ে হাড়ে আমি বুঝেছি যে, হাত ছাড়তে চাওয়া যতটা সহজ, ছেড়ে থাকা ততটা সহজ নয়। তাই আজও…’ এই বলে তিনি বৃদ্ধার হাতের উপর হাত রাখলেন, ‘আমার প্রোস্টেট ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ চলছে। আর কয়েক মাস আমার সঙ্গে সূর্যাস্ত দেখবে?’

বৃদ্ধার দু চোখ বেয়ে নামছে নোনতা জলের ধারা। তিনি কান্না ভেজা কণ্ঠে বললেন, ‘দেড় বছর ধরে আমিও যুঝছি …লিউকেমিয়া।’ চমকে উঠলেন বৃদ্ধ। বৃদ্ধা বললেন, ‘আমারও খুব ইচ্ছে, আমাদের জীবনের শেষ সূর্যাস্তটা আমরা একসঙ্গে দেখব।’

বৃদ্ধ টেবিল থেকে ন্যাপকিন নিয়ে তাঁর চোখের জল মুছিয়ে দিলেন। পড়ন্ত বিকেলে যেন আবার সকাল হল, পাতা ঝরার ঋতুতে আজ ফুল ফোটার আমেজ। হঠাৎ শুনলাম, পিছন থেকে ছেলেগুলোর টিটকিরি ভেসে আসছে, ‘দাদু এই বয়সেও কী রঙিন! ও দাদু, আমাদেরও দু’-একটা টিপস দিন না!’

আমার মতো সেই বৃদ্ধও ছেলেগুলোর দিকে বিরক্ত চোখে তাকালেন । তার পর বৃদ্ধার হাত দু’টি ধরে বললেন, ‘চলো, আমরা যাই।’

তাদের প্রস্থানের পর কফির দ্বিতীয় কাপ শেষ করে আমিও বেরোচ্ছি । মৌন বিস্ময়ে একবার ফিরে তাকালাম সেই তিনটি টেবিলের দিকে। দেখি, ওয়েটার এসে সেই তিনটি টেবিল থেকে তিন জোড়া কফির পেয়ালা উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ।

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *